অধ্যায়-১৮ বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বাদশাহর দ্বৈরথ
‘আন্ডারডগ’ পরিস্থিতি বলতে বর্তমানে যা বোঝায়, জালুত আর দাউদ (আ) এর পরিস্থিতি ছিল ঠিক তা-ই। অবশ্যই কেউ কোনো দিনই ভাবেননি দাউদ সেদিন জিতে যাবেন, তা-ও ঢাল তরবারি ছাড়াই কেবল গুলতির জোরে। অবশ্য, নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারটি মেনে নেন না যে, সেদিন দাউদ (আ) এর মতো বালক জিতেছিলেন; তাদের মতে, বড়জোর এটা হতে পারে যে, দাউদ হয়তো কিছু একটা শুরু করেছিলেন এবং শেষ করেছিলেন অন্য কেউ। সে-ই অন্য একজন ছিলেন বেথেলহেমেরই ইলহানন। তবে ধর্মীয় ইতিহাস এ ব্যাপারটা অস্বীকার করে তীব্রভাবে।
তালুত (সল) আর দাউদ (আ) এর সময় থেকে ইহুদীদের ইতিহাস পাল্টে যেতে থাকে। বিস্তারিত ঘটনায় যাবার আগে পরবর্তীতে কী হতে চলেছে, তাতে একঝলক চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।
শামুয়েল (আ) পর্যন্ত জাজ (Judges) বা কাজীদের যে শাসন চালু ছিল, সেটা চলেছিল কয়েকশ বছর। ততদিনে ইসরাইলের বারোটি গোত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরপর এলো ইসরাইলি রাজতন্ত্র, প্রথম বাদশাহ হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে এলেন তালুত (Saul)। সেই রাজতন্ত্র চলতে থাকে বাদশাহ দাউদ (আ) এবং তার পুত্র সুলাইমান (আ) এর সময়কাল পর্যন্তও। এ সময়টা ছিল ইসরাইলের স্বর্ণযুগ।
দাউদ (আ) এর শাসনামলে ইসরায়েল ও এহুদা (Judah) যুক্তরাজ্যের রাজধানী হয়ে দাঁড়ায় জেরুজালেম। সেখানে মোরিয়া পাহাড়ের ওপর সুলাইমান (আ) নির্মাণ করলেন ফার্স্ট টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস। কিন্তু ততদিনে গোত্রগুলোর মাঝে রাজনৈতিক কোন্দল বেড়েই চলেছিল। যে-ই না সুলাইমান (আ) মারা গেলেন, সাথে সাথেই গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেলো উত্তরের দশ গোত্র আর দক্ষিণের এহুদা ও বেঞ্জামিন গোত্রের মাঝে। ফলে রাজ্য দু’ভাগ হয়ে গেল। উত্তরে ইসরায়েল রাজ্য, আর দক্ষিণে জুদাহ বা এহুদা রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে মেসোপটেমিয়ার আসিরিয়ান রাজা তৃতীয় টিগলাত পিলেসারের (Tiglath III) তুমুল আক্রমণে ধূলিসাৎ হয়ে যায় উত্তরের ইসরায়েল রাজ্য, চলে যায় আসিরিয়ানদের দখলে। টিকে থাকে কেবল দক্ষিণের জুদাহ রাজ্য। এমন কোনো ঐতিহাসিক নথি আমরা পাই না যা থেকে জানা যায় আসলে সেই উত্তরের দশ গোত্রের ভাগ্যে কী হয়েছিল। কোথায় হারিয়ে যায় ‘লস্ট ট্রাইবস অফ ইসরায়েল’?
গল্পটা শুরু করা যাক সেই মেষপালক আর শখের বীণাবাদক বালকের কিং ডেভিড হয়ে ওঠার ঘটনা দিয়েই।
বেথেলহেমের বালক দাউদের বড় তিন ভাই ইলিয়াব, অবিনাদব আর শম্ম- তিনজনই তালুতের বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন, একমাত্র দাউদ বাকি ছিলেন, কারণ তিনি তখনও সেই বয়সে উপনীত হননি। কিন্তু তাঁর জালুত হত্যা দেখার পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল, যে যুদ্ধে আদতে দাউদ যোগই দেননি।
দাউদ যখন শিবিরে ফিরে এলেন তখন সেনাপতি তাকে ধরে নিয়ে গেলেন তালুতের কাছে। তালুতে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে যুবক, তুমি কার পুত্র?”
জবাবে দাউদ বললেন, “আমি আপনার গোলাম বেথেলহেমের ইয়াসির পুত্র।” (শামুয়েল ১, ১৭:৫৮ )
তালুত এ ঘটনার পর আর দাউদ (আ)-কে বাড়িতে ফিরে যেতে দিলেন না। নিয়ে চললেন তার সাথেই প্রাসাদে। তালুতের ছেলে রাজপুত্র জোনাথান তাকে নিজের কোর্তা খুলে পরিয়ে দিলেন, দিলেন তলোয়ার, ধনুক ও কোমরবন্ধনীও। খুব অল্প দিনের মাঝেই জোনাথান আর দাউদের মাঝে চমৎকার একটি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, নবীত্ব তখনও বরণ করেননি দাউদ।
সময় যেতে না যেতেই একসময় দাউদ (আ) তালুতের বাহিনীর সেনাপতি পদ পেয়ে গেলেন। কিন্তু এ সুদৃষ্টি বেশি দিন টেকেনি। শত্রু পৌত্তলিক ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ শেষে একবার বাহিনী যখন শহরে প্রবেশ করছে, তখন তালুত শুনতে পেলেন, লোকে গানের সুরে শ্লোগান দিচ্ছে-
“তালুত মারলেন হাজার হাজার,
আর দাউদ মারলেন অযুত অযুত।”
(২ শামুয়েল, ১৮:৭ )
এটি শুনে তালুত ভয়ংকর ক্ষেপে গেলেন। বুঝে গেলেন, একটা সময় আসবে যখন তার রাজত্ব কেড়ে নেবেন দাউদ, তাই তখন থেকেই চোখে চোখে রাখতে লাগলেন তাকে।
বাইবেল বলছে, এরকম কোনো একদিন তালুত রাগ সইতে না পেরে নিজের হাতের বর্শা ছুঁড়ে মারলেন দাউদের দিকে, তা-ও একবার নয়, দু’বার এমন করেছিলেন তিনি। তালুত চিৎকার করতে লাগলেন, “আমি দাউদকে দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে ফেলব।” কিন্তু দু’বারই দাউদ সামনে থেকে সরে যেতে পেরেছিলেন।
এরপর থেকে দাউদ তালুত থেকে দূরে থাকতেন। ওদিকে রাজ্যের সকলেই দাউদ (আ)-কে খুবই ভালোবাসতো, কারণ তিনি সকলের কাছে গিয়ে গিয়ে খোঁজখবর নিতেন। তালুত তখন বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি আসলে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাই কিছু একটা করা দরকার। তিনি দাউদকে ডেকে বললেন, “দেখ, আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা মেরবকে আমি তোমার সঙ্গে বিয়ে দেব; তুমি কেবল আমার পক্ষে শক্তিশালী হয়ে মাবুদের জন্য যুদ্ধ করো।” (২ শামুয়েল, ১৮:১৭) কিন্তু তিনি সেই বিয়েটা দিলেন না, প্রথমে কোনো কন্যার সাথেই তার বিয়ে দেননি। দিলেন অন্য কারও সাথে।
তবে শেষমেশ দাউদের জনপ্রিয়তার কাছে হার মেনে তার সাথে নিজের মেয়ে মীখলের বিয়ে দিলেন। কিন্তু তালুতের চেয়ে দাউদের জনপ্রিয়তা ঢের বাড়তেই থাকলো। বাইবেল মতে, এ পর্যায়ে এসে তালুত তার পুত্র জোনাথান ও তার নিজের সমস্ত গোলামকে বলে দিলেন, যেন তারা দাউদকে হত্যা করে। কিন্তু জোনাথান তো দাউদের বন্ধু ছিলেন, এ কাজ তিনি কীভাবে করেন?
জোনাথান দাউদের কাছে ছুটে গিয়ে জানালেন, “আমার বাবা তোমাকে মারার জন্য পরিকল্পনা করছে, তুমি অনুগ্রহ করে ভোরবেলা কোনো এক জায়গায় লুকিয়ে পড়বে, কোনো এক ক্ষেতে।”
পরদিন জোনাথান নিজের বাবাকে গিয়ে বোঝালেন যে, দাউদ যা-ই করছেন আসলে সবই ইসরায়েলের ভালোর জন্য। তাকে হত্যা করে জনগণের রোষের শিকার হওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। এ কথা শুনে তালুত আপাতত মেনে নিলেন যে, তিনি দাউদকে হত্যা করবেন না।
কিন্তু দাউদ বাড়ি ফিরে আসার পর ক’দিনের মাঝেই তালুতের সিদ্ধান্ত আবারও পরিবর্তিত হলো। তাকে হত্যার চেষ্টা করতে লাগলেন তালুত। দাউদের স্ত্রী মীখল তাকে জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন। পরে তালুত দাউদকে ধরতে দূতদের পাঠালে মীখল বললেন, “তিনি অসুস্থ আছেন।”
দূতেরা ফিরে গেলে তালুত তাদের আবারও পাঠালেন, দাউদকে দেখে আসতে। তারা বিছানায় লেপ উল্টে আবিষ্কার করলো দাউদ আসলে অনেক আগেই পালিয়ে গেছেন।
দাউদ পালিয়ে চলে গেলেন রামা’তে এবং খুলে বললেন সকল কিছু। (সম্ভবত এ সময় তিনি নবীত্ব লাভ করেন।)
দাউদ (আ) যেদিন রামা থেকে ফিরে এলেন, সেদিন জোনাথানার সাথে দেখা করলেন, করে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কী করেছি? আমার অপরাধ কী? তোমার পিতার কাছে আমার দোষ কী যে, তিনি আমার প্রাণ নিতে চেষ্টা করছেন?” কোনো সদুত্তর আসলে জোনাথান দিতে পারলেন না। দাউদ (আ) তার সঙ্গী- সাথীদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। ইতোমধ্যে নবী শামুয়েল (আ) মারা গেলেন, তখন দাউদ (আ) কিছু সময়ের জন্য কোনো এক কারণে ফারান বা পারান মরুভূমিতে চলে গেলেন। (১ শামুয়েল, ২৫:১)
বলা হয়ে থাকে, এ এলাকাটাতেই বর্তমানে মক্কা। কেননা, ইব্রাহীম (আ) তার পুত্র ইসমাইল (আ)-কে এ পারান মরুতেই রেখে গিয়েছিলেন।