অধ্যায় ১৭ : উসমানি সাম্রাজ্যে ইহুদীরা
শুরুতে একটু ধারণা নিয়ে নেয়া যাক উসমানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন নিয়ে। যারা তুর্কি ভাষার অঘুজ উপভাষায় কথা বলতো, তারা হলো অঘুজ তুর্কি। ‘অঘুজ’ মানে ‘গোত্র’। অষ্টম শতকেই তারা মধ্য এশিয়াতে একটি চমৎকার সংঘবদ্ধ গোত্র সমাজ বানিয়ে ফেলেছিল। পরবর্তীতে, তাদেরই একজন যোদ্ধা নেতা ছিলেন সেলজুক বেগ, যিনি মারা গিয়েছিলেন একাদশ শতকের শুরুর দিকে, ধারণা করা হয় ১০০৭ বা ১০০৯ সালের দিকে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সুন্নি মুসলিম সেলজুক সাম্রাজ্য বা আলে সেলজুকের প্রতিষ্ঠাতা। ক্ষমতার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সেলজুক সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পশ্চিম আনাতোলিয়া ও লেভান্ত (সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তিন, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক) থেকে শুরু করে পূর্ব দিকে আফগান পর্বতমালা ‘হিন্দু কুশ’ পর্যন্ত; আর ওদিকে মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত। মোট কথা, প্রায় চল্লিশ লাখ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল সাম্রাজ্য।
এই সেলজুক সাম্রাজ্যের একটি অংশবিশেষ ছিল আনাতোলিয়া ও উত্তর সিরিয়া অঞ্চল নিয়ে গঠিত সালতানাত-ই-রুম। ১২৩১ সালের দিকে সালতানাত- ই-রুমের পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকার দায়িত্ব পান অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত উসমানের পিতা আর্তুরুল গাজী, জায়গাটা ছিল উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়া (‘গ’ এর উচ্চারণ উহ্য, ঠিক যেমন এর্দোগান নয়, এর্দোয়ান)। এ দায়িত্ব লাভ করেন সুলতান প্রথম আলাউদ্দীন কায়কোবাদের কাছ থেকে।
এরপর ১২৮১ সাল থেকে ১২৮৮ সালের মধ্যে কোনো এক সময় উসমান গাজী তার পিতার কাছ থেকে কাঈ গোত্রের খানের দায়িত্ব বুঝে নেন। ১২৯৯-১৩০০ সালের দিকে সেলজুক সুলতান তৃতীয় আলাউদ্দীন কায়কোবাদ তাকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ‘সাত ঘোড়ার লেজওয়ালা’ প্রতীক দান করেন।
তিনিই উসমানি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, যাকে পশ্চিমা ভাষায় বলা হয় অটোমান সাম্রাজ্য; উসমান নামটিই পরিণত হয়েছিল ‘অটোমান’-এ। পশ্চিমা দুনিয়ায় তুর্কি সাম্রাজ্য, তুরস্ক আর অটোমান সাম্রাজ্য একে অন্যের প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হতো তখন। ১৯২০-২৩ সালে এসে আংকারা তুর্কি সরকার সরকারিভাবে কেবল ‘তুরস্ক’ (টার্কি) নামকে বেছে নেয়, তুর্কি ভাষায় যার উচ্চারণ ‘তুর্কিয়্যে’। প্রথম উসমানের সময় এই সাম্রাজ্য ছিল বেশ ছোট, যা তুঙ্গে পৌঁছায় সুলতান সুলেমানের সময়। এক পর্যায়ে বিশালাকার ধারণ করা এ সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে তার অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে যায়।
পঞ্চদশ শতকের দিকে উসমানি সাম্রাজ্য বিশ্ব রাজনীতির এক বড় ক্ষমতায় পরিণত হয়। তখন অনেক আশকেনাজি ইহুদীরা উসমানি বা অটোমান এলাকায় বসত গাড়ে। অবশ্য এর আগে থেকেই আনাতোলিয়াতে হেলেনিস্টিক ও বাইজান্টিন ইহুদীদের বসত ছিল। পরের শতাব্দীতে অবশ্য স্প্যানিশ আর পর্তুগিজ ইনকুইজিশন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদী ‘মারানো’রা এসে আশ্রয় নেয় অটোমান ভূমিতে। আর স্প্যানিশ ইহুদীরা ১৪৯২ সালে বিতাড়িত হবার পর আরও বেশি করে অটোমান সাম্রাজ্যে আশ্রয় নেয়। এ সাম্রাজ্যের যে শহরগুলোতে ইহুদীরা স্বাধীনভাবে বসবাস ও উন্নতি করতে থাকে তার মাঝে আছে- গ্রিস, কায়রো, দামেস্ক, কনস্ট্যানন্টিনোপল, বলকান অঞ্চল, ইত্যাদি।
এ সেফার্দি অভিবাসী ইহুদীদের কেউ কেউ বেশ উন্নতি করে উসমানি দরবারেও সুযোগ পেয়ে যায়। যেমন ধরুন আমরা ডোনা গ্রাসিয়ার (১৫১০- ১৫৬৯) কথা জানি। তিনি থাকতেন কনস্ট্যান্টিনোপলে, সেখানকার ইহুদী সমাজের একজন নেত্রী আর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ডোনা। এই নারীর ভাইপো জোসেফ নাসি (১৫২৪-১৫৭৯) উসমানি দরবারের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, তিনি টাইবেরিয়াসে আবাস গড়া ইহুদী তাঁতি সমাজের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ আবাস গড়তে তিনি সাহায্য করেছিলেন। সত্যি বলতে, এই টাইবেরিয়াসের কমিউনিটি গড়াই হয়েছিল মেসায়ার আগমনের চিন্তায়। পরবর্তীতে তাদের কাজই ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের পর সাহায্য করে তাদের ইহুদী আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড নতুন করে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে। উসমানি রাজ্যের নানা জায়গায় ইহুদীদের অ্যাকাডেমি গড়ে তোলা হয়। যেমন, কায়রো, কনস্ট্যান্টিনোপল এবং সালোনিকা। এ সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ইহুদী স্কলার ছিলেন জোসেফ কারো (১৪৮৮-১৫৭৫)।
একটু আগে বলা সেই মেসায়ার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকা ইহুদী সমাজের আধ্যাত্মিক উত্তরসূরিরা ফিলিস্তিনের সাফেদ এলাকায় ছোট সমাজ গড়ে তোলে। ষোড়শ শতকে এই সমাজ তাঁতের কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে পড়ে, আর সেই সাথে কাব্বালা তথা ইহুদী জাদুবিদ্যা বা আধ্যাত্মিক শাস্ত্রের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সাফেদে মেসায়ার আগমন প্রত্যাশী নানা কবিতা রচনা করা হতো।
তুর্কি শহর বুরসাতে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম ইহুদী সিনাগগ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার নাম ছিল এস হা-হায়িম, মানে জীবনবৃক্ষ। ১৩২৪ সালে এটি অটোমান কর্তৃপক্ষের হাতে আসে। সিনাগগটি কিন্তু আজও ব্যবহৃত হচ্ছে! অবশ্য এ শহরে সর্বশেষ ২০১১ সালে মাত্র ১৪০ জন ইহুদীর খোঁজ পাওয়া যায়।
কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ী অটোমান সুলতান মেহমেদ বা মুহাম্মাদের উত্তরসূরি দ্বিতীয় বায়েজিদের (১৪৮১-১৫১২) আমলে বড় সংখ্যক ইহুদী স্পেন আর পর্তুগাল থেকে পালিয়ে চলে আসে। ইহুদী ইতিহাস অনুযায়ী, অটোমান সাম্রাজ্য যখন খ্রিস্টানদের সাথে যুদ্ধরত, তখন ব্যবসায়িক বড় রকমের কাজগুলো অলিখিতভাবে ইহুদীদের ওপরই ন্যস্ত ছিল মূলত। ইহুদীদেরকে তারা দেখত অটোমানদের মিত্র, কূটনীতিক এবং গুপ্তচর হিসেবে। তাদের নানা দিকের নৈপুণ্য ও মেধাকে অটোমান সাম্রাজ্যে কাজে লাগানো হতো প্রায়ই। যেমন, ১৪৯৩ সালে দুজন ইহুদী প্রিন্টিং প্রেস অর্থাৎ ছাপাখানা স্থাপন করে, তারা ছিল ডেভিড ও সামুয়েল ইবনে নাহমিয়াস। এই নতুন প্রযুক্তির কারণে বইপত্রের প্রাচুর্য দেখা দিল অটোমান সাম্রাজ্যে। বিশেষ করে ধর্মীয় ও সরকারি কাগজপত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ কাজে দিল ছাপাখানা। এছাড়া নানা ডাক্তার আর কূটনীতিক তো ছিলই।
ষোড়শ শতকে অটোমানদের প্রাণকেন্দ্র ইস্তাম্বুলে অর্থনীতির চালকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় যারা ছিল, তাদের বেশিরভাগই হয় গ্রিক নয়তো ইহুদী। এই ইহুদীরা ছিল মূলত সেই স্পেন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদী পরিবার। তারা সাথে করে বাপদাদার ধন সম্পদ তুলে এনেছিল। তা দিয়েই তারা ধনী বনে যায় অটোমান সাম্রাজ্যে। তাদের মাঝে মেনদেজ পরিবার ইহুদী ‘মারানো’ ব্যাংকিং পরিবারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সুলতান সুলেমানের দেয়া নিরাপত্তার অধীনে তারা ১৫৫২ সালে ইস্তাম্বুলে আস্তানা গাড়ে এবং ব্যবসা করে। এই মেনদেজ পরিবারের একজন আলভারো মেনদেজ ১৫৮৮ সালে ইস্তাম্বুলে নিয়ে এসেছিলেন পঁচাশি হাজার ডুকাটের মতো বিশাল অঙ্ক! তাদের তাই দ্রুত সমাজের উঁচু স্তরে পৌঁছে যাওয়া অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়।
রোমান সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের প্রতিষ্ঠা করা তুরস্কের প্রাচীন শহর অ্যাড্রিয়ানোপল বা আজকের এডিনা শহরের একটি সিনাগগ
উসমানি সাম্রাজ্যে ইহুদীদের মর্যাদা ছিল ‘যিম্মি’ হিসেবে, মানে চুক্তিবদ্ধ জাতি, যারা আসমানি কিতাব পেয়েছিল, কিন্তু মুসলিম নয়। এ সাম্রাজ্যে ইহুদীদের ওপর কোনো আলাদা নিয়ম আরোপ করা হয়নি, তা ঠিক নয়। যেমন ধরুন, ইহুদীদেরকে বিশেষ কর দিতে হতো, তাদেরকে বিশেষ কাপড় পরে চলাফেরা করতে হতো যেন দেখলে চেনা যায়। পাশাপাশি, তারা বন্দুক সাথে রাখতে পারতো না, ঘোড়ায় চড়তে পারতো না, নতুন করে সিনাগগ বানাতে পারতো না, উন্মুক্ত স্থানে উপাসনা করতে পারতো না, ইত্যাদি নানা বিধিনিষেধ তো ছিলই। তবুও এটা বলতেই হয়, তুলনামূলকভাবে অটোমান সাম্রাজ্য ইহুদীদের আরামেই থাকতে দিয়েছিল, অত্যাচারে ফেলেনি।
বহু বছর টিকে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ালেখা করেছিলেন ইহুদী ইসরাইলের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেনগুরিয়ন। নাম যা-ই থাকুক না কেন, এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বয়ং সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ১৪৫৩ সালে। অনেকে একে কনস্ট্যান্টিনোপল বিশ্ববিদ্যালয়ও ডেকে থাকেন বটে!