অধ্যায় ১৬ : স্পেনের খ্রিস্টান রাজত্বে
স্পেন, পর্তুগাল আর এন্ডোরা মিলিয়ে আইবেরীয় বা ইবেরীয় উপদ্বীপ। এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপদ্বীপ। খ্রিস্টানরা আইবেরিয়া দখল করে নেয়ার পর স্পেনের সেফার্দি ইহুদীরা মুসলিম ভূমিতে এসে ইউরোপীয় অভ্যাসগুলোর অনেক কিছুই ধরে রাখে। ইহুদীরা নানা রকমের পেশার কাজ করত তখন। দোকানদারি, কারিগর, ওষুধপত্র, মহাজনি, ইত্যাদি। তাদের সমাজে শ্রেণীবৈষম্য ঢুকে যায়, অনেক ইহুদীই তখন বেশ গরিব। তবে একটি ছোট অংশ রাজদরবারে কাজ করতেন প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে।
স্প্যানিশ ইহুদী আর উত্তর ইউরোপের ইহুদীদের মাঝে কিছু মিল ছিল। স্বায়ত্তশাসিত ছোট ছোট ধর্মীয় সমাজকে আরবিতে ‘আলজামা’ বলা হতো, ঠিক যেমনটা হিব্রুতে ‘ক্বাহাল’ বলা হতো। স্পেন আর পর্তুগালের পুরনো নথিপত্র ঘাঁটলে আমরা এ ‘আলজামা’-র হদিস পাই। সেখানে মুসলিমদেরকে ‘মুর’ (The Moors) বলা হতো। ইহুদী ও মুরদের সমাজকে আলজামা বলে ডাকা হতো। প্রত্যেক আলজামারই অর্থনৈতিক আর বিচারভিত্তিক স্বাধীনতা ছিল। তবে খ্রিস্টান শাসনের চেয়ে মুসলিম শাসনের অধীনে ত্রয়োদশ শতকের ইহুদীরা বেশি উন্নতি করে, সোজা কথায়, তারা বেশি আরামে ছিল। ইসলামি শাসনতন্ত্রের অধীনে, স্প্যানিশ বা আন্দালুসিয়ার ইহুদীরা নানা বিষয়ে পড়ালেখা করতে থাকে, হোক সেটা ধর্মীয় কিংবা বিজ্ঞানভিত্তিক। যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে, তখনও ফার্দিনান্দ আর ইসাবেলার নৃশংসতা শুরু হয়নি।
কিন্তু চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। আইবেরীয় অঞ্চলের ক্যাস্টিল (Castile) এবং অ্যারাগন (Aragon) নামের শক্তিশালী দুটো খ্রিস্টান রাজ্যে ইহুদীদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা শুরু হয়। প্রাণভয়ে হাজার হাজার ইহুদী ১৩৯১ সালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। দুই দশক পর, ১৪১২ সালে স্প্যানিশ শাসকেরা ক্যাস্টিলীয় আইন প্রয়োগ করতে শুরু করেন, যার ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টানদের থেকে ইহুদীদের বসতবাড়ি আর এলাকা আলাদা করে দেয়া হয়।
১৪১৩-১৪১৪ সালে স্পেনের অ্যারাগনের কাতালনিয়াতে অবস্থিত তরতোসা শহরে খ্রিস্টান আর ইহুদীদের মাঝে একটি বাহাস বা বিতর্কের আয়োজন করা হয়। অবশ্য, ইহুদী সূত্রে এ বাহাসকে স্বাধীন বাহাস বলা হয় না, বরং ইহুদীদের দমন করার ষড়যন্ত্রই বলা হয়। এই বাহাসের আলোচ্য বিষয় ছিল ‘মেসায়া’ বা ‘খ্রিস্ট’। ইহুদীদের দিক থেকে অংশ নেন প্রোফিয়াত দুরান, ইয়োসেফ আলবো, আর র্যাবাইনিক স্কলার মোশে বেন আব্বাস এবং আসক্রক হা-লেভি, প্রমুখ; একেকজন একেক ইহুদী সমাজ থেকে আসা। অন্যদিকে খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ভিনসেন্ট ফেরার। বিতর্কের ফলাফল ঘোষণা করা হয় খ্রিস্টানদের পক্ষে। ফলে, অ্যান্টিপোপ বেনেডিক্ট আদেশ করেন যে ইহুদীদের সকল তালমুদের কপি সেন্সর করার জন্য কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে। ইহুদীদের ওপর ধর্মান্তরের চাপ তো চলতেই থাকে, তবে সেটা সরকারিভাবে না। তবে আগে যাদেরকে জোর করে খ্রিস্টান করা হয়েছিল, তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হলো, তারা চাইলে নিজ ধর্মে ফিরে যেতে পারে এখন। খ্রিস্টান সেই বিতার্কিক ভিনসেন্ট ইহুদী সমাজে গিয়ে গিয়ে তার ধর্মীয় বক্তৃতা দিতে থাকলেন। তাকে পরবর্তীতে ক্যাথোলিক চার্চ সেইন্ট হিসেবে ঘোষণা করে- সেইন্ট ভিনসেন্ট।
তরতোসার বাহাসের পর যারা খ্রিস্টান হয়ে গেল, তাদের অনেকেই সরকারি উচ্চপদে চাকরি পেল। ইহুদী থেকে যারা খ্রিস্টান হয়েছিল তাদেরকে ডাকা হতো ‘কনভার্সো’ (converso)। আর যারা নিজের ধর্ম ধরে রাখলো, তারা নতুন করে ইহুদী সমাজকে সংস্কার করতে লাগলো। আলজামাগুলো নতুন করে গড়া হলো, ক্যাস্টিলের নানা জায়গায় নতুন নতুন ইহুদী সমাজের উত্থান হলো।
পঞ্চদশ শতকে ইহুদী-বিরোধী অনুভূতি আবারও জেগে উঠলো স্প্যানিশ খ্রিস্টানদের মাঝে। প্রথম দিকে এই ঘৃণা কেবল কনভার্সোদের বিরুদ্ধেই ছিল, ইহুদী থেকে খ্রিস্টান হওয়া এ লোকগুলো কর সংগ্রাহকের কাজ করত। তাদের প্রতি এ বিরুদ্ধাচারণের পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হতো, এরা মন থেকে খ্রিস্টান হয়নি। যারা গোপনে ইহুদী রয়ে গেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যেত বা সন্দেহ করা হতো তাদেরকে ‘মারানো’ (marrano) বলা হতো। এটা কেবল ইহুদীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না, বরং নির্যাতিত মুসলিমদের ক্ষেত্রেও একই কথা। তাদের মাঝেও যারা প্রকাশ্যে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে, কিন্তু গোপনে ইসলাম পালন করে গিয়েছে, তাদেরকেও ‘মারানো’ ডাকা হতো।
১৪৭৪ সাল থেকে ক্যাস্টিলের রানী ছিলেন ইসাবেলা, আর ১৪৭৯ সাল থেকে অ্যারাগনের রাজা হন ফার্দিনান্দ। এ দুজনে স্বামী স্ত্রী হওয়াতে, ইসাবেলা যেমন একই সাথে অ্যারাগনের রানী ছিলেন, তেমনই ফার্দিনান্দ ছিলেন ক্যাস্টিলের রাজা, অন্তত ১৫০৪ সালে ইসাবেলা মারা যাওয়া পর্যন্ত। এরা দুজন খ্রিস্টান ব্যানারে একত্রিত করেন স্পেনকে, এ কারণে অনেকসময় ইসাবেলাকে স্পেনের প্রথম রানীও বলা হয়। তাদেরকে একত্রে ক্যাথোলিক মনার্ক (সম্রাট- সম্রাজ্ঞী) ডাকা হতো, পোপ চতুর্থ আলেকজান্ডার তাদেরকে এ উপাধি দেন। গত শতকে, ১৯৭৪ সালে তাদেরকে ক্যাথোলিক চার্চ ‘ঈশ্বরের সেবক’ উপাধি দেয়। তাদের কথা আনার কারণ, একটু আগে বলা সেই ‘মারানো’ ইস্যুতে তারা নাক গলাতে শুরু করেন রাজা-রানী হিসেবে। সরকারিভাবে ১৪৮০ সালে এ দুজন ‘মারানো’ হবার অভিযোগ সত্য কি না, তা যাচাইয়ের নামে ইতিহাসের কালো অধ্যায় ‘ইনকুইজিশন’-এর সূচনা করেন।
মুসলিমদের পাশাপাশি হাজার হাজার ইহুদী থেকে খ্রিস্টান হওয়া কনভার্সোকে সন্দেহের বশেই শাস্তি দেয়া শুরু হলো। যারা অনুতপ্ত হলো না, তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হলো। ১৪৮০-র দশকে, কয়েকজন ‘মারানো’ এক খ্রিস্টান বালককে খুন করে তার হৃৎপিণ্ড দিয়ে জাদুবিদ্যা করতে গিয়েছিল—এমন অদ্ভুত অভিযোগ এনে জোর করে ইনকুইজিশনে জবানবন্দী আদায় করা হয়েছিল।
সাম্রাজ্য জুড়ে ইনকুইজিশন শুরুর আগেই ১৪৭৮ সালে ক্যাস্টিলীয় ইনকুইজিশন শুরু হয়ে গিয়েছিল, এবং তাতে পোপের আদেশ বা সম্মতি ছিল। এর চার বছর পর সেভিয়াতে (Seville) প্রথম ট্রাইবুনাল কাজ শুরু করে। ট্রাইবুনালের অনুরোধে, ত্রিশ দিনের ‘এডিক্ট অফ গ্রেস’ ঘোষণা করা হলো- এ ত্রিশ দিনের মধ্যে কেউ যদি নিজে এসে অপরাধ স্বীকার করে, তাহলে তাকে অত্যাচার নির্যাতন করা হবে না। তবে তাকে অন্যদের পরিচয় ফাঁস করে দিতে হবে। আর আগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাদেরকে চাবুকের বাড়ি, লাল-হলুদ (কিংবা কালো) সাম্বেনিতো পোশাক পরে থাকতে হবে, অথবা তাদের সম্পত্তি সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে।
যাদেরকে ‘মারানো’ হিসেবে সন্দেহ করা হতো, এবং অত্যাচারের মুখেও স্বীকার করত না, তাদের শেষ ঠিকানা ছিল আগুনে পুড়ে মরা। অনেক খ্রিস্টানই ভূয়সী প্রশংসা করলো এ নীতির। তাতে নির্দোষ লোক মারা গেলে তাদের কী আসে যায়! ষোড়শ শতকে ফ্রাঞ্চেস্কো পেগনা ঘোষণা করলেন, যদি নির্দোষ লোক এই ইনকুইজিশনে মারাও যায়, তবে তারা খ্রিস্টান শহীদ হবেন।
সরকারি হিসেবে, দেড় লাখ লোককে ইনকুইজিশনে ‘জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, আর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ ইহুদী ও মুসলিমকে। তবে আসল সংখ্যাটা ঢের বেশি হবে। যারা শাস্তি পায়, তাদের পরিবারের কেউ কোনোদিন রূপা বা সোনার অলংকার পরতে পারবে না, সরকারি চাকরিও পাবে না- এমন নির্দেশ ছিল।
সেভিয়াতে যারা কনভার্সো ছিল। তাদের অনেকেই নিজেদের নাম থেকে সন্দেহ দূর করার জন্য তাদের খ্রিস্টীয় বিশ্বাসকে জোরসে প্রচার করতে লাগল। ধনীদের জন্য ব্যাপারটা বরং আরও সহজ ছিল। যেমন মেসা নামের একজন ধনী কনভার্সো নবীদের ভাস্কর্য বানিয়ে সাজিয়ে ফেলে, অবশ্যই একজন ইহুদী এমনটি করতে পারে না, কারণ ইহুদী ধর্মে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ নিষেধ। এর দ্বারা সে প্রমাণ করতে চাইলো, সে আর ইহুদী নেই।
ইহুদীদের হিসেবে অন্তত ৭০০ জনকে ‘হেরেটিক’ আখ্যা দিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। এটা ১৪৮২ সাল পর্যন্ত হিসেব। ১৪৮৩ সালে পুরো স্পেনের প্রধান ইনকুইজিটর হিসেবে নিয়োগ পান টমাস দে টর্কেমাডা, তিনি সারা দেশ জুড়েই ট্রাইব্যুনাল বসান। অবশ্য অ্যারাগনে ইনকুইজিশন বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয়, সেখানকার ইনকুইজিটরকে হত্যা করার চেষ্টাও করা হয়। ১৪৮৬ থেকে ১৪৯০ সাল পর্যন্ত ৪,৮৫০ জন ইহুদী কনভার্সো চার্চে পুরোপুরি নিজেকে বিলিয়ে দেয় এই ইনকুইজিশনের পর। আগুনে পোড়ানো হয় প্রায় ২০০ জন মানুষকে।
ইনকুইজিটররা জনসম্মুখে ‘মারানোদের শাস্তি দিতে পছন্দ করত। এ অনুষ্ঠানগুলোকে ‘অটো দা ফে’ ডাকা হতো। এগুলো শুরু হতো একটি ধর্মীয় বক্তৃতা দিয়ে, এরপর শাস্তির পালা।
তবে আগুনে পোড়ানোর ঘটনাগুলো দেখভাল করত আরেকটি সেকুলার কমিটি। ১৪৮১ সালে প্রথম এমন একটি পোড়ানোর ঘটনা পাওয়া যায়। ইহুদী হিসেবে মোট প্রায় ৩০,০০০ জন আগুনে পুড়ে মারা যায়। তাহলে মুসলিমসহ আসল সংখ্যাটি কত বেশি হবে, তা চিন্তার বাইরে। ইহুদী ও মুসলিমদের ওপর এ অত্যাচার থামে, যখন তারা স্পেন ত্যাগ করতে শুরু করে। এরকম সময়ের প্রেক্ষাপটেই একটি কাল্পনিক ঘটনাকে ব্যবহার করে ‘এপ্রিল ফুল’ তত্ত্ব মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ে গত শতকের শেষ দিকে, ইতিহাসের পাতায় যার কোনো বর্ণনা নেই।
সত্যি কথা হলো, স্পেনের মুসলমানদের পুড়িয়ে মারার সাথে এপ্রিল ফুলের কোনো সম্পর্ক নেই। যতই মুখরোচক আর আবেগী ঘটনা মনে হোক না কেন, সেটি ছড়ানো একটি মিথ্যাচার প্রচারেরই শামিল। বরং পাঠকের দায়িত্ব সত্যটাকে জানান দেওয়া। আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা এমনিতেই হতো, আর সেটা ইনকুইজিশনের শাস্তি হিসেবে। তবে এমনিতে গণ পোড়ানোর সেই ঘটনা অসত্য।
১৪৯২ সালের পহেলা এপ্রিল এমন কিছুই হয়নি। বরং এর তিন মাস আগে, জানুয়ারির ২ তারিখ গ্রানাদার আমির দ্বাদশ মুহাম্মাদ রানী ইসাবেলার হাতে চাবি তুলে দিতে বাধ্য হন। পতন হয় গ্রানাদার আলহামরা (Alhambra) প্রাসাদের। যদিও মুসলিম ইতিহাস এ বইয়ের অংশ নয়, তবুও প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু আলাপ করা যায়।
এপ্রিল ফুল প্র্যাংকের শুরুটা ভিন্ন। পহেলা এপ্রিল তারিখে কাউকে পোড়ানো না হলেও স্পেনে যে আগে ও পরে অত্যাচার অনেক হয়েছে, এটা খুবই সত্য। এবং এ অত্যাচারে ক্যাথোলিক পোপের সমর্থন ছিল, সেটাও সত্য।
৭১১ সালে মুসলিমরা অধিকার করে নেয় স্পেন। না, স্পেন বলা ঠিক হচ্ছে না, স্পেনের একটা অংশ; তখন তো আর স্পেন নাম ছিল না। এ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খলিফার নির্দেশে উমাইয়া কমান্ডার তারিক বিন জিয়াদ, তার কথা একটু আগে বলা হয়েছিল। এমন না যে তিনি একই বিনা সাহায্যে এই অসাধ্য সাধন করে ফেলেন। তাকে স্পেনের অন্যরাই সাহায্য করেছে। স্পেনের ক্ষমতায় তখন ছিলেন রডেরিক, তিনি এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি জুলিয়ানের মেয়েকে ধর্ষণ করেন। ক্রুদ্ধ জুলিয়ান তখন তারিককে (মানে, আরবদেরকে) আমন্ত্রণ করেন স্পেন অধিকার করে নিতে, তিনি তাদেরকে গোপনে জিব্রাল্টার পার করে দেবেন। জুলিয়ানের কাছে কিছু বাণিজ্য জাহাজ আর স্প্যানিশ দুর্গ ছিল। মোটামুটি ১২,০০০ সেনা নিয়ে তারিক বিন জিয়াদ রডেরিকের এক লাখের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। রডেরিক নিহত হন, ‘ভিসিগথ রাজ্য’ হাতে আসে মুসলিমদের। এরপর জুলিয়ানের পরামর্শে গ্রানাদা, কর্দোভা ইত্যাদি জয় করতে তারিক সেনা পাঠান। সেই ছিল শুরু।
স্পেন-পর্তুগালের এ অঞ্চলকে মুসলিমরা ডাকতো ‘আন্দালুস’। মোটামুটি ১৪৯২ পর্যন্ত এ অঞ্চলের ক্ষমতা হাতে থাকে মুসলিমদের। এ সময় ‘আহলে কিতাব’ হিসেবে খ্রিস্টান ও ইহুদীদের সাথেই সহাবস্থানে থাকে মুসলিমরা, ৭০০ বছরেরও বেশি। তবে বেশ আগে থেকেই ধীরে ধীরে নানা অঞ্চল হারাতে থাকে মুসলিমরা, ক্যাথোলিক খ্রিস্টানদের হাতে। আর ক্রুসেড তো চলছিলই। ক্রুসেডের তিনটি ফ্রন্টের একটি ছিল স্পেন ও মাগরিব (উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা)।
এখানেই সেই দুজনের নাম চলে আসে- ক্যাস্টিলের ইসাবেলা আর অ্যারাগনের ফার্দিনান্দ, সহস্র প্রাণ বধকারী, হাজারো মুসলিম, ইহুদী ও প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টানের রক্তে রাঙানো ছিল তাদের হাত; যার বর্ণনা এতক্ষণ দেয়া হলো। তারা জোরদার করেন বহু আগে শুরু হওয়া ‘রিকনকুইস্টা’, অর্থাৎ মুসলিমদের হাত থেকে স্পেন পুনরুদ্ধার অভিযান। একে একে বিভিন্ন অঞ্চল পুনর্দখল করতে করতে শেষে বাকি থাকে গ্রানাদা। গ্রানাদার নেতৃত্ব বিভক্ত ছিল, সেটা গ্রানাদার জন্য ছিল একটা বড় সমস্যা। তারপরেও ১৪৮২ থেকে ১৪৯২, দশ বছর লাগে গ্রানাদা পুরোপুরি হাতে আসতে ইসাবেলার।
ইসাবেলা কেন বলা হচ্ছে? কারণ, বেশি উদ্যমটা তারই ছিল, স্বামী ফার্দিনান্দ সাহায্য করেছিলেন ঋণ আর নেভি সাপোর্ট বা গোলাবারুদ দিয়ে। সিরিয়াল কিলিংয়ের মতো করে সিরিয়াল জেনোসাইড শুরু করেছিলেন তারা, ১৪৯৯ সালের আগে থেকেই পরিমিত আকারে ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়া এ জেনোসাইডের শিকার ছিলেন আন্দালুসিয়ার মুসলিম আর ইহুদীরা। তৎকালীন ক্যাথোলিকদের নয়নমণি হলেও ভিক্টিমদের কাছে তিনি ‘ক্যাস্টিলের কসাই’ ইসাবেলা। তিনি ও ফার্দিনান্দ যে জেনোসাইড বা গণহত্যা করছিলেন, সেটাকে বলতে হয় Ethnic Cleansing, অর্থাৎ একদম জাতিবিনাশ। সেই সাথে ক্যাথোলিকদের বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয় গ্রানাদাতে ক্যাথোলিক জনসংখ্যা বাড়াবার জন্য, এই সেটলাররাই পরে ইসাবেলার কাজকে সহজ করে দেয়। অনেকটা যেমন, ফিলিস্তিনে ইহুদীরা এলো সেটলার হিসেবে, পরে রাষ্ট্রটাই হয়ে গেল ইসরাইল রাষ্ট্র। ক্যাথোলিকদের সাথের এ লড়াইতে ইহুদী আর মুসলিমরা একত্রিত হয়েছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
১৪৯১ সালের ২৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত হয় গ্রানাদা চুক্তি। তাতে দুমাস সময় দেয়া হয় শহরটিকে। শর্তাবলি মেনে নিয়ে ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি দ্বাদশ মুহাম্মাদ শহরটি ছেড়ে দেন ইসাবেলার কাছে। কারণ তাদের আর প্রতিরোধের ক্ষমতাটিও ছিল না। আলহামরা প্রাসাদে সেদিনই খ্রিস্টান সেনারা ঢুকে পড়ে, পাছে কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু কোনো প্রতিরোধ আসেনি মুসলিমদের দিক থেকে।
কনস্ট্যান্টিনোপলের জয় (১৪৫৩) মুসলিম ইতিহাসে যত বড় একটা বিষয়, খ্রিস্টান ইতিহাসে তত বড় হিসেবেই দেখা হয় গ্রানাদা পুনরুদ্ধারকে (১৪৯২)। অন্তত পাল্টা ধাওয়ার মতো।
গ্রানাদা চুক্তির শর্ত আপাতদৃষ্টিতে মুসলিমদের অনুকূলে ছিল বলে মনে হচ্ছিল, তাই দ্বাদশ মুহাম্মাদ হয়তো গ্রানাদা ছেড়ে দিয়েছিলেন শেষমেশ :
-তিন বছর পর্যন্ত মুসলিমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে। কেউ বাধা দেবে না।
-গোলাবারুদ অনুমোদিত না হলেও, অন্যান্য অস্ত্র রাখতে পারবে মুসলিমরা। এক মাস পর্যন্ত।
-কোনো মুসলিমকে ধর্মান্তরিত হতে জোর করা হবে না এ সময়ের মাঝে। এমনকি যেসব খ্রিস্টান মুসলিম হয়েছিলেন, তাদেরকেও আগের ধর্মে ফিরে আসতে বলা হবে না।
-দ্বাদশ মুহাম্মাদকে অর্থকড়ি আর পাহাড়ি এলাকায় আলপুজারাসের শাসনক্ষমতা দেয়া হয়। (তিনি অবশ্য পরের বছরই মরক্কো চলে যান।)
আরও ছিল কিছু বিষয়। পরবর্তী সাতটি বছরে মুসলিম জনসংখ্যা কমে আসে অনেক। তবে কাগজে কলমে মুসলিমদের অধিকার ছিল ইসলাম পালনের।
কিন্তু প্রাথমিক নির্যাতনটা ছিল ইহুদীদের জন্য। চার মাসের মাঝে সকল ইহুদীকে চলে যেতে হবে। নয়তো জোরপূর্বক খ্রিস্টান হতে হবে। আর যারা চলে যেতে চেয়েছিলো, তারাও তাদের বাড়িঘর ধনসম্পদ এগুলো বিক্রি করতে পারেনি। যারা ধর্ম পাল্টাবেও না, চলেও যাবে না, তাদের জন্য ছিল বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ড। ২ লাখ ইহুদী ধর্ম পাল্টায়।
এত কিছু বলার কারণ, ইতিহাসের কষ্টিপাথরে এপ্রিল ফুলের মিথ্যে গল্পটা যাচাই। ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল অন্তত পুড়িয়ে মারা হয়নি কাউকে ওভাবে।
১৪৯২ সালে পাঁচ কি ছয় লাখ মুসলিম ছিল আন্দালুসে, কিন্তু এর দুবছর আগেও জানা যায় মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ ছিল, কোথায় গেলেন তারা? ধারাবাহিক জেনোসাইডের শিকার সম্ভবত। ইহুদীদের সংখ্যাও কমে যায়।
১৪৯৯ সালে শুরু হয় আসল ঘটনা। টলেডোর আর্চবিশপ সিসনেরোস জোরপূর্বক চেষ্টা করতে থাকেন সব নাগরিকদেরকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করাতে। বাধা হিসেবে দাঁড়ায় মুসলিম সম্প্রদায়। ফলে তাদের ঘর-বাড়ি কিংবা মসজিদ যেখানেই পাওয়া যায়, ক্যাথোলিকেরা কচুকাটা করতে শুরু করে। জোর করে তাদের বাড়ির আঙিনায় শূকর হত্যা করে রক্ত ও উচ্ছিষ্ট ছড়ানো হয়। মুসলিমদের পবিত্র রাতগুলোতে খ্রিস্টান যুবকেরা মদ পান করে মসজিদ এবং মুসলমানদের বাড়িতে কুলি করতো দাঙ্গাকে প্রণোদনা দিতে। ক্ষিপ্ত কোনো মুসলমান বিদ্রোহ করলে সাথে সাথে তাকে হত্যা করা হতো। মুসলিম ও ইহুদী নারীদের তুলে নিয়ে নির্যাতন চলতে থাকে সমান তালে। মুসলিমদের বিদ্রোহের অজুহাতে গ্রানাদা চুক্তিতে কথা দেয়া সকল শিথিলতা আর সুবিধা কেড়ে নেয়া হয়। তখন থেকে ধর্মান্তর-প্রচেষ্টা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর কখনও কখনও সেটা সরাসরি হত্যানীতি।
১৫০১ সালে গ্রানাদায় ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ আর কোনো মুসলিম রইলো না। তারা কোথায় গেল? অনেকেই নিহত, আর অনেকেই রাজ্যত্যাগ করেছিলো, স্পেন থেকে মরক্কো কিংবা আফ্রিকার নানা দেশে তাদের পালিয়ে যাবার দলিল রয়েছে। এ ‘সাফল্যে’ অনুপ্রাণিত হয়ে ইসাবেলা গ্রানাদার বাইরেও শুরু করেন ধর্মান্তরকরণ। একমাত্র অ্যারাগনের রাজারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত মুসলিমদের ধর্মান্তর করতে বাধা দেন, তারা ইসাবেলার বিরুদ্ধাচরণ করেন। কিন্তু সেটাও শেষ হতে বাধ্য হয় ১৫২৪ সালে। ১৫২৫ সালে আইন জারি করা হয়, ইসলাম বলে আর কিছু থাকবে না স্পেনজুড়ে। অবশ্য মুসলিম যে ছিল না স্পেনে তা নয়, বাইরে খ্রিস্টান রীতিনীতি পালন দেখালেও ঘরের ভেতরে তারা ইসলাম পালন করতো। একে ক্রিপ্টো-ইসলাম (গুপ্ত-ইসলাম) বলা হতো। মরক্কো পালিয়ে যাওয়া একজন প্রাক্তন ক্রিপ্টোমুসলিম আহমদ ইবনে কাসিমের লেখা গ্রন্থ ‘কিতাব নাসির আল- দ্বীন’-এ আমরা স্পেনের তৎকালীন মুসলিমদের গোপন জীবন সম্পর্কে ধারণা পাই। অবশ্য ১৫০৪ সালের ক্রিপ্টো-ইসলাম জারি করার ফতোয়া অনেকে অস্বীকার করেন। অন্তত দেড় থেকে সাড়ে তিন লাখ মুসলিম উধাও হয়ে যান ইতিহাসের পাতা থেকে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসের কালোতম অধ্যায়গুলোর একটি এটি। নারীদের গণধর্ষণ থেকে শুরু করে আগুনে পুড়িয়ে মারা, ক্রুশে পেরেক ঠুকে মারা, ভারী পাথর দিয়ে শরীরের অঙ্গ থেঁতলে দেয়া, জ্যান্ত মানুষকে করাত দিয়ে চিরে ফেলা, শরীর থেকে জীবন্ত মানুষের চামড়া ছিলে নেয়া, গরম পানি ও তেল ঢেলে শরীর ঝলসে দেয়া, সাঁড়াশি দিয়ে দাঁত উপড়ানো কিংবা মাথার চুল ও মুখের দাড়ি ছিড়ে নেয়া, প্রকাশ্যে জননাঙ্গ কর্তন, নারীদের গোপনাঙ্গে মোটা কাঠের গজাল ঢুকিয়ে হত্যা করা, মা-বাবার সামনে শিশুদের পুড়িয়ে মারার মতো কুকর্ম ইসাবেলা- ফার্দিনান্দের প্রণোদনায় শুরু হয়েছিল।
ফ্রান্সে ষোড়শ শতকে মার্চের ২৫ তারিখে নববর্ষ উদযাপিত হতো বসন্তের আগমনে। উৎসবটা এক সপ্তাহ ধরে চলত, এপ্রিলের ১ তারিখ পর্যন্ত। কিন্তু ১৫৬৪ সালে পোপ গ্রেগরির প্রভাবে ক্যালেন্ডার পরিবর্তন হলো, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে বসন্তের বদলে পহেলা জানুয়ারিতেই নববর্ষ উদযাপন করতে হবে, এই ছিল রাজা নবম চার্লসের আদেশ। রক্ষণশীলরা ব্যাপারটার বিরোধিতা করতে চাইলেন, কিন্তু কে শোনে কার কথা। নববর্ষ স্থায়ী হলো পহেলা জানুয়ারি। আর সেই যে ২৫ মার্চ থেকে এক সপ্তাহ? সেটি থাকলো বসন্তবরণ হিসেবে। যারা এ পুরনো উৎসব পালন করত, তাদেরকে নতুন ধারার ফরাসিরা টিটকারি দিত, প্র্যাংক বা মজা করত, নির্বোধ সব উপহার দিত আর পার্টির আমন্ত্রণপত্র পাঠাতো; গিয়ে দেখা যেত সেখানে আসলে কোনো পার্টি নেই। চলতো ১ এপ্রিল পর্যন্ত। এই প্র্যাংকের শিকারদের বলা হতো এপ্রিল ফুলের ভিক্টিম। অবশ্য তখন এ প্র্যাংককে ডাকা হতো ‘এপ্রিল ফিশ’ (poisson d’avril)। ফিশ কেন? কারণ, সে সময় সূর্য মৎস্য রাশির ইতি ঘটিয়ে নতুন রাশিতে ঢুকেছে। ইংল্যান্ডেও পরবর্তীতে চলে আসে এ প্র্যাংক ডে, আর ইংলিশ, স্কটিশ ও ফ্রেঞ্চরা নিয়ে আসে আমেরিকায়।
এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি নিয়ে আরও বেশ কিছু তত্ত্ব আছে, তবে আগুনে পোড়ানোটা সত্য নয়।
জানা মতে, ১৯৯৭ সালের ২৮ মার্চ একটি ইমেইলের মাধ্যমে প্রথম এ ভুয়া কাহিনী ছড়িয়ে দেয়া হয়।
শেষ কথা, আগুনে স্প্যানিশ মুসলমান পোড়াবার তত্ত্ব বিশ্বাস করানোটাই বরং সবচেয়ে বড় এপ্রিল ফুল প্র্যাংক।
লক্ষ প্রাণের খুনী কুখ্যাত ইসাবেলা আর ফার্দিনান্দ একটি কারণে আবার ইউরোপীয় ইতিহাসে বিখ্যাত। তারা ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের আমেরিকা ভ্রমণের অর্থায়ন করেছিলেন, তাই তাদের নাম ইউরোপিয়ানদের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাসে ভালোর খাতায় লিপিবদ্ধ। সেই সালটাও ১৪৯২!
রানী ইসাবেলা ‘আলহামরা ডিক্রি’ নামের একটি ফরমানে সই করেন এপ্রিলের এক তারিখ নয়, তার একদিন আগে, মার্চের ৩১ তারিখ। সেখানে জোর করে ইহুদী বিতাড়ন কিংবা তাদেরকে ধর্মান্তরের আদেশ ছিল। এ ডিক্রি একই সাথে মুসলিমদেরও কফিনে পেরেকের মতোই ছিল।
এপ্রিল ফুলের মতো একটি নগণ্য ব্যাপার দিয়ে স্পেন অর্থাৎ তৎকালীন আন্দালুসিয়ার কান্নাকে হালকা করার প্রচেষ্টা আসলে খুবই হাস্যকর প্রচেষ্টা। সারা ইতিহাসে খোঁজ নেই, কিন্তু আবেগান্বিত জনতা কেবল পহেলা এপ্রিলের আগুন দেয়ার ভুয়া ইতিহাস নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে ব্যস্ত থাকে। অথচ স্পেনে মুসলিম ও ইহুদীদের ওপর অত্যাচার হয়েছিল দীর্ঘ একটি সময় জুড়ে, একটি দিনকে কেন্দ্র করে নয়।