অধ্যায়-১৪ : আন্দালুসিয়ার দিনগুলিতে

অধ্যায় ১৪ : আন্দালুসিয়ার দিনগুলিতে

৭৫০ সালের দিকে উমাইয়াদের হাত থেকে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতা চলে যায় আব্বাসীয় খিলাফাতের হাতে। তবে স্পেনে ( মোটামুটি ‘আন্দালুসিয়া’ বলা যায়) স্বাধীন উমাইয়া শাসন চলতে লাগলো। যত সময় এগুতে লাগলো, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর ওপর আব্বাসীয়দের নিয়ন্ত্রণ কমে যেতে লাগলো। ৮৫০ সালের পর তুর্কি যোদ্ধাদের সহায়তায় আব্বাসীয়রা ক্ষমতা বজায় রাখে, খলিফার অধীনে তুর্কি জেনারেলরাও ছিল ক্ষমতাবান। ৯০৯ সালে তিউনিসিয়ার শিয়া ফাতিমিরা উত্তর আফ্রিকা দখল করে নেয়। ৯৬৯ সালে তারা জয় করে নেয় মিসর আর ফিলিস্তিন। দশম শতকের শেষ দিকে ইসলামি সাম্রাজ্য নানা সুপারপাওয়ারে ভাগ হয়ে যায়, যেমন সুন্নি আব্বাসীয় আর শিয়া ফাতিমি খেলাফত। তাদের মাঝে দ্বৈরথ লেগেই থাকত।

ইসলামি সাম্রাজ্যের এই শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও অনৈক্যের সাথে সাথে র‍্যাবাইনিক ইহুদীবাদের কুদিন আসতে থাকে। এতদিন পর্যন্ত ব্যবিলনের অ্যাকাডেমিয়া সব ইহুদীদের ওপর কর্তৃত্ব করত, কিন্তু এখন সেটি নানা জায়গায় বিকেন্দ্রীকরণ হতে থাকে। স্থানীয় নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইহুদীরা তাদের শাস্ত্র শিক্ষা দিতে লাগলো। র‍্যাবাইরা বেশি গুরুত্ব দিতে লাগলেন পবিত্র ভূমির ওপর, টাইবেরিয়াসে র‍্যাবাইনিক অ্যাকাডেমি গঠিত হলো। সেখানে বেন আশের আর বেন নাফথালির মতো স্কলাররা ছিলেন যারা ‘মাসোরা’ অর্থাৎ ‘মৌখিক তাওরাতের পরম্পরা’-তে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তারা হিব্রু যতিচিহ্ন ও জের জবর পেশের সমতুল্য চিহ্নগুলো যোগ করেন হিব্রু বাইবেলে। তাদেরকে ‘মাসোরী’ স্কলার বলা হয়।

নবম শতকে র‍্যাবাইদের অ্যাকাডেমিকে রামলায় নিয়ে যাওয়া হয়, আর এরপর জেরুজালেমে। মিসর, ইয়েমেন আর সিরিয়ার ইহুদী সমাজের সমর্থন ছিল জেরুজালেমের প্রতিষ্ঠানের প্রতি, কিন্তু একাদশ শতকে তুর্কি আর খ্রিস্টান আক্রমণের কারণে এর প্রভাব কমতে থাকে।

মিসরের ইহুদী সমাজেরও পরিবর্তন আসে এ সময়টাতে। ফাতিমিদের অধীনেও ভালো ছিল ইহুদীরা। দশম শতকের শেষ নাগাদ কায়রোতে একটি ‘ইয়েশিভাহ’ অর্থাৎ ইহুদী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়, এখানে তাওরাত, হালাখা বা ইহুদী আইন, তালমুদ, ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হতো।

তিউনিসিয়ার মরুশহর কায়রাওয়ানেও গড়ে ওঠে ইহুদী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কারা প্রতিষ্ঠা করতেন এগুলো? মূলত ধনী ইহুদীদের পাশাপাশি প্রখ্যাত তালমুদবেত্তাদের সহায়তায় গড়ে ওঠে এগুলো, তারা ইহুদী বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের সহায় ছিলেন। মরক্কোর ফেজ শহরে সে সময়ের সবচেয়ে প্রখ্যাত স্কলারের আবির্ভাব ঘটে, যার নাম আইজ্যাক আলফাসি (১০১৩-১১০৩)। তিনি গবেষণা আর সংকলন করেন ইহুদী আইনসমগ্ৰ।

কিন্তু সত্যি বলতে, ইহুদীরা এ সময় সর্বোচ্চ উন্নতি করে স্পেনে তথা আন্দালুসিয়ায়। দশম শতকের স্প্যানিশ রাজদরবারে উমাইয়া খলিফা তৃতীয় আব্দ আল-রাহমান (৯১২-৯৬১) এবং দ্বিতীয় হাকাহ (৯৬১-৯৭২) দরবারের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেন ইহুদী কূটনীতিক হিসদাই ইবনে শাপরুতকে (৯১৫-৯৭০)। তিনি একই সাথে স্থানীয় ইহুদী সমাজের নেতাও ছিলেন, নানা ইহুদী প্রতিষ্ঠানে টাকা দিতে তিনি। উমাইয়া খেলাফতের রাজধানী তখন ছিল কর্ডোভাতে। ইহুদী সমাজ উন্নতির শিখতে পৌঁছায় কর্ডোভায়, সেখানে জমায়েত হয় নানা ইহুদী কবি, ব্যাকরণবিদ, আর ইয়েশিভাহ ছাত্রের।

একাদশ শতকে উমাইয়া খেলাফত ভেঙে যেতে শুরু করলে, মুসলিম সমাজের স্থানীয় শাসকরা তাদের দরবারে ইহুদীদের নিয়োগ দিতে শুরু করে। এর মধ্যে একজন ইহুদী ছিলেন গ্রানাদার সামুয়েল ইবনে নাগরেলা (৯৯৩-১০৫৬)। তিনি গণিত আর দর্শনে বিজ্ঞ ছিলেন, হিব্রু আর আরবিতে চমৎকার লেখালেখি করতেন। তিরিশ বছর ধরে তিনি গ্রানাদার উজির পদে ছিলেন। সামরিক নানা অভিযানে জয়লাভ করেন তিনি, সে নিয়ে হিব্রু কবিতাও রচনা করে ফেলেন। তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন ইহুদী স্কলার সে সময় স্পেনের বাসিন্দা ছিলেন, তারা বাস করতেন সেভিয়া, সারাগোসা, টলেডো, লুসেনা আর কালাদায়ুদ অঞ্চলে।

১০৮৬ সালে আল-মুরাবিতুন (আলমোরাভিডরা) উত্তর আফ্রিকা থেকে এসে স্পেনের খ্রিস্টানদের আক্রমণ করে, আর সেই সাথে ইহুদীদেরকেও। প্রধানত সুন্নি এই সাম্রাজ্য আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসিনের হাতে শুরু হয়। একে ‘বর্বর’ মুসলিম সাম্রাজ্যও বলা হয়, শব্দটা আসলে গ্রিক ‘বারবারোস’ থেকে এসেছে, যার মানেই ‘বর্বর’। তাদের সাম্রাজ্য টিকে ছিল ১১৪৭ সাল পর্যন্ত।

ইহুদীরা অবশ্য এর আগেই খুব শ্রীঘ্রই তাদের আগের নিরাপত্তা ফিরে পেল। ইহুদীদের পরের প্রজন্মে জন্ম নেন জনপ্রিয় কয়েকজন কবি, দার্শনিক, আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।

১০৮৬ সালে খ্রিস্টানদের হাতে আন্দালুসের পতন যখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, তখন আলমোরাভিডদের প্রচেষ্টায় কাস্টিল আর আরাগনের যৌথ খ্রিস্টান বাহিনীকে ঠেকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে ইহুদীদের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গেল। তখন খ্রিস্টানদের হাতে স্পেন আসলেই পতিত হতে পারে, এমনটা ভেবে স্পেনকে বাঁচাতে মরক্কো থেকে ‘বর্বর’ আল-মোহাদ খিলাফাত এসে পড়ে স্পেনে, তারা ১১৪৭ সালে মরক্কোর মারাক্কেশ শহরে খতম করে আলমোরাভিডদের অষ্টম ও শেষ রাজা ইসহাক ইবনে আলিকে। এরপর থেকে মরক্কো ও আন্দালুসের শাসক আলমোহাদ খেলাফত।

আলমোহাদরা ইহুদী সমাজেও উৎপাত করল। ইহুদীদের জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করতে হলো, তাদের অ্যাকাডেমি আর সিনাগগ বন্ধ করে দেয়া হলো। কিছু ইহুদী গোপনে নিজের ধর্ম পালন করতে লাগলো। বাকিরা মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্য খ্রিস্টান শাসিত স্প্যানিশ এলাকায় চলে গেল।

ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে আলমোহাদদের ক্ষমতা শেষ হয়ে এলো। কারণ তখন খ্রিস্টান বাহিনীগুলো স্পেনের প্রাক্তন মুসলিম অধ্যুষিত বেশিরভাগ এলাকাই দখলে নিয়ে নিল।

মুসলিম জাহানের অন্যান্য এলাকাতেও ইহুদীদের পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকলো। আলমোহাদদের ইহুদী উৎপাতের সময় অনেকেই মিসরে পালিয়ে যায়, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রখ্যাত সেফার্দি ইহুদী র‍্যাবাই ও দার্শনিক মোজেস মাইমনিদিজ (১১৩৮-১২০৪)। তার আসল নাম আবু ইমরান ‘মূসা বিন মায়মুন’ বিন উবাইদুল্লাহ আল-কুরতাবি। তিনি তার ইহুদী আইন নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মিসরের ইহুদী সমাজের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হন তিনি। আজকে তাকে ইহুদী ধর্মের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ র‍্যাবাইদের একজন বলা হয়। তার চৌদ্দ খণ্ডের ‘মিশনে হ তোরাহ’ তালমুদি আইনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে। মৌখিক তাওরাতের একজন স্কলারও ছিলেন তিনি। মুসলিম বিজ্ঞানী আল-ফারাবি, ইবনে সিনা আর ইবনে রুশদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তিনি। মাইমনিদিস কিন্তু সুলতান সালাউদ্দিন তথা সালাদিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছিলেন! তিনি ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে নবী না মানলেও তাকে মেসায়া আগমনের ঘোষক বা পথ তৈরিকারক হিসেবে বলতেন, ঠিক যেমন খ্রিস্টধর্মে মেসায়া বা খ্রিস্ট ঈসা (আ)-এর ক্ষেত্রে ঘোষক বা পথ তৈরিকারক জন দ্য ব্যাপটিস্ট বা ইয়াহিয়া (আ)।

ক্রুসেডের সময় ইহুদী সমাজের একটি অংশ বেঁচে গিয়েছিল ফিলিস্তিনে। পবিত্র ভূমি ভ্রমণ করতে যাওয়া ইহুদীরা তাদের সাথে যোগ দিলে সে জনসংখ্যা আবারও বাড়ে।

উত্তর আফ্রিকার ইহুদী সমাজ সুন্দরমতোই তাদের ধর্মপালন চালিয়ে গেল আলমোহাদদের প্রস্থানের পর। আগের চেয়ে বরং উন্নতিই করলো। স্পেনের খ্রিস্টান আরাগন রাজ্যের সাথে সাহারা মরু দিয়ে সোনার ব্যবসার মাধ্যমে এ অঞ্চলের নানা ইহুদী ব্যবসায়ী সম্পর্ক স্থাপন করল।

অন্যদিকে ব্যবিলনিয়ার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ গাওন শেরিরা বার হানিনা ১০৩৮ সালে মারা যাবার পরও ইহুদী সমাজ ভালোই টিকে ছিল। কিন্তু ত্রয়োদশ শতকে (১২৫৮) হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করেন, এটা বাগধারার মতো করে আমরা সবাই জানি। মঙ্গোলদের এই ব্যবিলনিয়া অর্থাৎ ইরাক ধ্বংস করে দেয়ার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ইহুদীবাদ এক কথায় ধ্বসেই যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *