অধ্যায়-১২ – একটি পতনশীল মহাবিশ্ব
পূর্বের অধ্যায়গুলোতে আমরা মুক্ত মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছি যে মহাবিশ্ব হওয়ার কথা চিরপ্রসারণশীল। কিন্তু বদ্ধ মহাবিশ্ব অর্থাৎ যদি ভবিষ্যতের কোনও এক সময় এ মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে যায় এবং সংকুচিত হতে শুরু করে তবে এর চূড়ান্ত পরিণতি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হয়। যদি প্রকৃতপক্ষেই মহাবিশ্ব আবদ্ধ হয় তবে এক্ষেত্রে সময়ের পরিসর কী হবে যে পরিসরে মহাবিশ্ব প্রসারণ থামিয়ে সংকুচিত হতে শুরু করবে। বদ্ধ মহাবিশ্বের মডেলগুলো ইচ্ছামতো দীর্ঘ সময়ের পরিসর দ্বারা তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মডেলগুলোর অর্থাৎ মহাবিশ্বের ঘনত্বকে বর্তমান ঘনত্বের ওপরে ধরতে হবে, কিন্তু এ ঘনত্ব হবে সংকট বা ক্রান্তি ঘনত্বের যথেষ্ট কাছাকাছি। এই সংকট ঘনত্ব নিয়ে অধ্যায়-৫ এ আলোচনা করা হয়েছিল। সুতরাং, তত্ত্বানুসারে বদ্ধ মহাবিশ্ব সংকুচিত হওয়ার পূর্বে প্রায় ১০^১০০ বছর পর্যন্ত প্রসারিত হবে। এক্ষেত্রে মহাবিশ্ব অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে এবং এসব প্রক্রিয়ার সবই আবার বিপরীতগামী হবে। পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে অধিকাংশ প্রক্রিয়া আলোচনা করা হয়েছিল।
যুক্তির খাতিরে ধরা যাক, মহাবিশ্বের বর্তমান গড় ঘনত্ব সংকট ঘনত্বের দ্বিগুণ। স্মরণ করা যাক, ফ্রিম্যানের সাধারণ মডেলে বদ্ধ মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ছিল সসীম। মহাবিশ্ব ততক্ষন প্রসারিত হবে যতক্ষণ না এর ব্যাসার্ধ বর্তমান ব্যাসার্ধের দ্বিগুণ হয়। গড়পড়তায় কাছাকাছি গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব বর্তমানে প্রায় এক মিলিয়ন আলোকবর্ষ। এদের মধ্যে গড় দূরত্ব তখন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। সর্বোচ্চ প্রসারণের অবস্থায় পৌঁছতে অপরিহার্য সময় হবে প্ৰায় ৫০ বিলিয়ন বছর। মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা কমে গিয়ে ১.৫ কেলভিনে পৌঁছবে। তারপর এই বিকিরণ তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করবে। এই সময়ে মহাবিশ্বের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ হবে না। একটা সময় পর ‘বিগ ব্যাং’ বিপরীতগামী হলে মহাবিশ্বের মুখ্য পরিবর্তন ঘটবে। কয়েক দশ বিলিয়ন বছরে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ প্রসারণের পর এর গড় ঘনত্ব বর্তমান ঘনত্বের মত একই থাকবে। কিন্তু দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো লোহিত সরণের পরিবর্তে নীল সরণ প্রদর্শন করবে। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে না গিয়ে এরা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকবে। তড়িৎ চৌম্বক বিকিরণ সাধারণত দৃশ্যমান আলো তড়িৎ চুম্বক বর্ণালির নীল প্রান্তের দিকে সরে যায় বলে নীল সরণ ঘটে। এক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য হ্রাস পায়। মহাবিশ্বের এই পরিবর্তনের কয়েক বিলিয়ন বছর পর মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা ৪০০ কেলভিনের উপরে উন্নীত হবে। ফলে সমগ্র মহাবিশ্ব অত্যাধিক গরম হবে। তাই যে কোনও প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিছু সময় শেষে গ্যালাক্সিগুলো অবশেষে পরস্পরের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলিত হয়ে একটিতে পরিণত হবে। তারপর শীঘ্রই নক্ষত্রগুলো থেমে থেমে বারবার পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ করতে শুরু করবে। এম. জে. রিচ দেখিয়েছেন যে, এরকম সংঘর্ষে নক্ষত্রগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার পূর্বে মূলত মহাজাগতিক পট বিকিরণের দরুন তারা অদৃশ্য হয়ে যাবে। আর যখন এই পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা প্রায় ৪০০০ কেলভিনে পৌঁছবে তখন সব ইলেকট্রন পরমাণুর বাহিরে চলে আসবে। যখন এই তাপমাত্রা কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রিতে পৌঁছবে তখন সব নিউট্রন ও প্রোটন কেন্দ্রীণ থেকে বিদীর্ণ হয়ে যাবে। পরিণামে তথাকথিত ‘মহাসংকোচনে’র অনন্ত ঘনত্বের আঁটসাঁট স্থানে সমস্ত পদার্থ ও বিকিরণের সর্বজনীন পতন ঘটবে।
অবশ্যম্ভাবীরূপে এই প্রশ্নটির সৃষ্টি হয়— ‘মহাসংকোচনের পর কী ঘটবে?’
তৃতীয় অধ্যায়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছিল যে, ‘বিগ ব্যাং’-এর পূর্বে কী ঘটেছিল যার সঙ্গে মহাসংকোচনের এই প্রশ্নটি সম্পর্কযুক্ত। মূলত এই বিষয়টি পরিষ্কার নয় যে, মহাসংকোচনের পরের প্রভাব নিয়ে কথা বলাটা অর্থবহ কি-না। ঠিক যেরকম এটি পরিষ্কার নয় যে, ‘বিগ ব্যাং’-এর পূর্বে কী ঘটেছিল তা নিয়ে কথা বলা অর্থপূর্ণ কি না। এই প্রশ্নগুলো নেহাত অর্থহীন নয়। কিন্তু বিষয় হচ্ছে এসব ব্যাপারে আমরা সাধারণত জানি না। বিগ ব্যাং বা মহাসংকোচনের কাছাকাছি চূড়ান্ত অবস্থাগুলো যখন পাই তখন সময়ের প্রকৃতি কীরূপে পরিবর্তিত হয় এসব বিষয় জিজ্ঞাসার মাধ্যমে কেউ উপরের প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে পারেন। ম্যারিলেন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সি. ডব্লিউ মিসনার এরকম বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছিলেন। আসল কথা হচ্ছে যেসব ভৌত প্রক্রিয়া দ্বারা আমরা সময় পরিমাপ করি সবই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন—সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণন বা পরমাণুর কেন্দ্রীণের চারপাশে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন এই সব প্রক্রিয়াই একদিন মহাসংকোচনের কাছাকাছি বিরাজমান অবস্থায় ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর কেউ স্বয়ং নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন এইরকম চূড়ান্ত অবস্থায় সময়ের বিবর্তন বলতে কী বোঝায়? এরকম একটি বিশ্লেষণ ওই সমস্যাটির কিছুটা ব্যাখ্যা দিতে পারে। কিন্তু এটি অতটা সন্তুষ্টিজনক নয় এবং সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যও নয়। এটি পরিষ্কার যে, মধ্যাকর্ষণজনিত বিষয়টি এই চূড়ান্ত অবস্থাগুলোকে পরিচালিত করে। কিন্তু আমরা আইনস্টাইনের যে অধিক সন্তুষ্টিজনক মধ্যাকর্ষণ তত্ত্বটি পেয়েছি তা এই চূড়ান্ত অবস্থাগুলোর ক্ষেত্রে হয়ত প্রযোজ্য নয়। কেউ হয়ত এটিকে কোয়ান্টাম বিদ্যার সূত্রানুযায়ী কিছুটা পরিবর্তন করতে পারেন। অন্য কথায়, কারও হয়ত তথাকথিত মধ্যাকর্ষীয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োজন। হকিংসহ কেউ কেউ মনে করেন যে, সন্তুষ্টিজনক একটি মধ্যাকর্ষীয় কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে হয়ত বিগ ব্যাং বা মহাসংকোচন সম্পর্কে বুঝতে সক্ষম হবেন।
একটি বদ্ধ মহাবিশ্বে মহাসংকোচন থেকে যে কোনও প্রাণীর বেঁচে থাকার আশা খুবই কম। কিন্তু কেউ এ সম্পর্কে মতবাদী হতে পারে না। কারণ কেউই মানবের উদ্ভাবনের সীমা জানেন না। যদি মূলত মহাবিশ্ব আবদ্ধ হয় তাহলে সম্ভবত কয়েক দশ বিলিয়ন বছরের মহাসংকোচন থেকে প্রাণী কী প্রকারে বেঁচে থাকবে তাই ভাবতে হয়। যদি এটি প্রকৃতির নিয়ম পরিপন্থি না হয় তবে কিছু না কিছু টিকে থাকা উচিত। যদি বিগ ব্যাং চক্র পুনরাবৃত্তি হয় এবং গ্যালাক্সিগুলো বারবার জন্মলাভ করে তবে এই শর্তগুলোর কারণে কিছু অঞ্চলে প্রাণের অস্তিত্ব বিকশিত হবে। বদ্ধ মহাবিশ্বের অনুমান সাপেক্ষে এমনটি ঘটবে কি না তা অবশ্য জানা নেই।