অধ্যায় ১২ : ইসলামি সাম্রাজ্যে ইহুদী ধর্ম
ঐতিহাসিক তাবারির বক্তব্য অনুযায়ী, আরবের হেজাজের ইহুদীরা হিব্রুতে কথা বলতো না, বলতো পারস্যের তৎকালীন ভাষায়। এ থেকে বোঝা যায়, সেই গোত্রগুলো এসেছিল ব্যবিলনীয় ইহুদী সমাজ থেকে। আবার কোনো কোনো ইহুদী গোত্র মূল বনী ইসরাইলি ছিল না, তারা ছিল ধর্মান্তরিত।
৩৯০ সালের দিকে ইয়েমেনের হিমইয়ার সাম্রাজ্যের রাজ ছিলেন আবু কারিবা আসাদ কিংবা আবু কারাব (৩৯০-৪২০)। খ্রিস্টান বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের সাথে শত্রুতা ছিল হিমইয়ারদের। উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল আরবের দখল নিয়ে মসলা ব্যবসায় লাভ পাওয়া। তাছাড়া আরব দখল করলে ভারতে ব্যবসার রুট সুগম হয়। আবু কারিবা ‘তুব্বা’ উপাধিতেও পরিচিত ছিলেন। তুব্বা অর্থ ‘সূর্যকে যে ছায়ার মতো অনুসরণ করে’। নামটা থেকে সূর্যপূজারীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয়, তিনি পৌত্তলিক ছিলেন, যেমনটা ছিল তার হিমইয়ার অঞ্চলের অধিবাসীরা।
তিনি উত্তর আরবে আক্রমণ করলেন আরবকে বাইজান্টিন প্রভাব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। খ্রিস্টান বাইজান্টিনরা চাইতো পুরো পৌত্তলিক আরবকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলতে। ইতোমধ্যে আবিসিনিয়াতে খ্রিস্টান ধর্ম তারা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। আবিসিনিয়া ছিল ইয়েমেনেরও পরে, মিসরের দক্ষিণে, এখন এর নাম ইথিওপিয়া। বাইজান্টিনরা হিমিয়ারের উত্তরাঞ্চলকেও চেষ্টা করতে লাগল পৌত্তলিক থেকে খ্রিস্টান করার।
সে সময়ে হিমইয়ারের রাজা কারিবা আসাদ সিদ্ধান্ত নিলেন শত্রু বাইজান্টিনদের এ কাজ করতে দেবেন না। কারিবার সেনাবাহিনী উত্তর আরবের ইয়াসরিব তথা মদিনায় পৌঁছাল।
এখানে তিনি তেমন কোনো প্রতিরোধ পেলেন না। তাই তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা না করে নিজের ছেলেকে ইয়াসরিবের গভর্নর বানিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলেন না। তার কাছে খবর পৌঁছাল, ইয়াসরিবের অধিবাসীরা তার ছেলেকে খুন করে ফেলেছে।
ছেলে হারাবার প্রবল শোক নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন ইয়াসরিবে। তার মনে তখন জিঘাংসার আগুন জ্বলছে, রক্তে ভাসিয়ে দেবেন ইয়াসরিবকে।
ইয়াসরিবের সব খেজুর গাছ কেটে ফেললেন তিনি। এ গাছগুলোই ছিল ইয়াসরিববাসীদের আয়ের প্রধান উৎস। নগরী অবরোধ করা হলো। নিজ নগরী রক্ষার জন্য ইয়াসরিবের পৌত্তলিকদের সাথে স্থানীয় ইহুদী বাসিন্দারা যুদ্ধ করলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এ যুদ্ধের মাঝেই কারিবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
তখন ইয়াসরিবের দুই ইহুদী বিজ্ঞ লোক এ খবর শুনে রাজা কারিবাকে দেখতে গেলেন। তারা ছিলেন কাআব আর আসাদ। তারা কারিবাকে ওষুধ দিলেন। কারিবা সুস্থ হয়ে উঠলেন এর ফলে। তখন তারা দুজন অনুনয় করলেন, তিনি যেন ইয়াসরিব আক্রমণ না করে ফিরে যান। কারিবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি আক্রমণ তো বন্ধ করলেনই, নিজে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে ফেললেন। তার কথায় পুরো সেনাবাহিনীও নিজেদের পৌত্তলিক ধর্ম বাদ দিয়ে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করলো। অবশ্য, ইহুদী ধর্ম ঠিক ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করার মতো নয়, বরং পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত হতে হয়। তবু তারা ইহুদী মতাদর্শ গ্রহণ করে। এরপর ইয়াসরিব ত্যাগ করলেন রাজা কারিবা।
নিজের রাজ্যে ফিরে এসেই তিনি সবাইকে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে বললেন। অনেকে প্রতিবাদ করলেও অনেকে আবার গ্রহণ করে ইহুদী ধর্ম। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, সকলেই ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তবে প্রথম মতবাদটিই বেশি প্রচলিত। ইহুদী আর পৌত্তলিকরা এর পর থেকে পাশাপাশি থাকতে লাগল সারা আরবেই। এমনকি, হিমইয়ার রাজ্যেও। কেউ কেউ অবশ্য কারিবার ইহুদী ধর্ম গ্রহণকে উপকথা বলে মন্তব্য করে থাকেন, তবে এটা স্বীকার করে নেন যে, পরবর্তী রাজারা ইহুদী ছিলেন।
আরবের বেশ কয়েকটি ইহুদী গোত্রের নাম আমরা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারি-
-বনু হারিস বা বানু হোরায়স, এরা ইয়েমেনের কাহতানীদের বংশধর, যারা ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে।
-বনু কায়নুকা, ৭ম শতকের মদিনার তিনটি প্রধান ইহুদী গোত্রের একটি। তারা ধর্মান্তরিত ইহুদী নয়, বনি ইসরাইলের ইহুদীই।
-বনু শুতায়বা।
-বনু সালাবার ‘জাফনা’।
-বনু জাওরা।
-বনু জুরায়ক। ইসলামি বিবরণ অনুযায়ী, এ গোত্রের এক ইহুদী জাদুকর লাবিদ বেন আসাম মুহাম্মাদ (সা)-এর ওপর জাদুটোনা করেছিল।
-বনু কুদা। এরা হিমিয়ার রাজ্যের ধর্মান্তরিত ইহুদী।
-বনু কুরাইজা, তাদের নিজস্ব দাবি অনুযায়ী, তারা বনী ইসরাইলের ইহুদী, কোহেন (ইহুদী ইমাম বা পুরোহিত) বংশের। হিমিয়ারের রাজাকে থামিয়েছিলেন যে দুজন ইহুদী, তারা বনু কুরাইজার ইহুদী ছিলেন বলে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন। তারা এই বলে সেই রাজাকে থামিয়েছিলেন যে, “এই মরূদ্যানে কুরাইশদের থেকে আগত এক নবী আসবেন, এ মরূদ্যানই হবে তাঁর আবাস, তাঁর সমাধি।” ইবনে ইসহাক আরও বলেন, হিমিয়ারের রাজা ইহুদী র্যাবাইদের নিয়ে মক্কায় যান, সেখানে ইহুদীরা মক্কার কাবাঘরকে ইব্রাহিম (আ)-এর নির্মিত পবিত্রঘর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন, তাদের রাজাকে অনুরোধ করেন কাবাঘর তাওয়াফ করতে, মাথা মুণ্ডন করতে, ইত্যাদি। ইয়েমেনেও র্যাবাই দুজনকে নিয়ে যান রাজা, সেখানে ইয়েমেনীদের সামনে এক অলৌকিক কাজ করে দেখান দুজন, তারা আগুন থেকে বেরিয়ে আসেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে, আগুন তাদের স্পর্শই করেনি। এ ঘটনা দেখে ইয়েমেনীরা ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে। ৭ম শতকের মদিনার প্রধান তিন ইহুদী গোত্রের একটি বনু কুরাইজা।
-বনু হাদল।
-বনু নাজির, এরাও মদিনার প্রধান তিন ইহুদী গোত্রের একটি। কুরাইজার মতো বনু নাজিরও কোহেন বংশের দাবিদার ছিল।
-বনু জু’, এরা বনু কায়নুকার উপদল। তারা পালিয়ে গিয়েছিল উত্তর আফ্রিকায়।
-বনু আওফ, তারা ধর্মান্তরিত ইহুদী।
-বনু আওসের অনেকে ইহুদী ছিলেন, তবে আওস ও খাজরাজ গোত্রকে শিয়ারা ইহুদী বলে মন্তব্য করলেও, স্বয়ং ইহুদী মতে, মদিনার এ গোত্র দুটো ইহুদী ছিল না, বরং ইহুদীদের কাছ থেকে মদিনার ক্ষমতা নিয়ে নেয়। লেখকের ব্যক্তিগত মতামত, আওস গোত্রের নাম যেহেতু ‘আওস মানাত’ বা ‘দেবী মানাতের উপহার’ থেকে এসেছে, এরকম পৌত্তলিক নাম ইহুদী গোত্রের হতে পারে না। ইসলামের আবির্ভাবের পর এ নামটি ‘আওস-আল্লাহ’ নামে পরিবর্তন করা হয়। আর, খাজরাজ গোত্র খ্রিস্টের জন্মের সাত শতাব্দী আগে দক্ষিণ আরব থেকে বিতাড়িত হয়, তারা জর্ডানের নাবাতীয় গোত্র আল-আজদ (১:১)-এর হয়ে ইয়েমেনের মা’রিব পানির বাঁধ তৈরি করেছিল। তৃতীয় বারের মতো এ বাঁধ ধ্বংসের পর তারা ইয়াসরিবে চলে যায়। নিজেদের তারা ইসমাইল (আ) এর বংশধর বলে দাবি করত। প্রাক-ইসলামি একটি সময়ে তাদের গোত্রের নাম ছিল বনু কায়লা। ইহুদী সূত্র মতে, আওস ও খাজরাজ গোত্র মুহাম্মাদ (সা) মদিনায় আসার কয়েক বছর আগেও (৬১৭ সালে) যুদ্ধ করেছিল, যা বুয়াস যুদ্ধ নামে পরিচিত। বনু খাজরাজের বংশধর নুসায়বা গোত্র জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের পবিত্র চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকারের জিম্মাদার, তাদের সাথে এ দায়িত্ব সুলতান সালাউদ্দিনের সময় থেকে ভাগাভাগি করে আসছে জুদেহ আল-গৌদিয়া পরিবার। দুটোই মুসলিম পরিবার।
ইহুদীরা এখানে কৃষিকাজের সূচনা করে, এবং খুব দ্রুতই অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অবস্থানে চলে যায়। কিন্তু পঞ্চম শতকে ইয়েমেন থেকে আওস ও খাজরাজ গোত্র এসে হাজির হলে ইহুদীরা কর্তৃত্ব হারায়। পরবর্তীতে একেক ইহুদী গোত্র একেক নতুন গোত্রের সাথে মিত্রতায় চলে যায়।
আগের অধ্যায়গুলোতে বলা ‘ইহুদী বনাম রোমানদের যুদ্ধের’ সময়ই নানা ইহুদী গোত্র আরবের হেজাজ এলাকায় এসে বসবাস করতে থাকে। তবে ঠিক তখনই তারা প্রথম আসে কি না, তা নিয়ে মতভেদ আছে ইতিহাসবিদদের মাঝে। কেউ বলেন, ৫৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই জুদাহ রাজ্যের পতনের পর কোনো কোনো গোত্র আরবে পালিয়ে গিয়েছিল! আবার কেউ বলেন জুদাহ যখন রোমানরা দখল করে নেয়, তখন তারা আরবে যায়। কারও মতে, ইহুদীদের মহাবিদ্রোহের আমলে (৬৬-৭৩ সাল) এ আরব অভিবাসন হয়েছিল; কিংবা ১৩৫ সালের বার-কহবা বিদ্রোহের সময় রোমানদের হাত থেকে পালিয়ে আরবে আশ্রয় নেয় অনেক ইহুদী।
পবিত্র কুরআনে বনী ইসরাইলের ব্যাপারে অন্তত ৪৩ বার কথা এসেছে, এতটাই গুরুত্ব তাদেরকে দেয়া হয়েছিল ইসলামে। প্রথম দিককার আয়াতে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান করা হয়, কোমলভাবে তাদের কিতাবের কথা তোলা হয়। কিন্তু যতই তারা প্রত্যাখ্যান করতে থাকে ইসলাম, ততই পালটে যেতে থাকে ইহুদীদের প্রতি সম্বোধনের সুর, একটি পর্যায়ে সৃষ্টি হয় শত্রুভাবাপন্নতা। ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে মিত্র হিসেবে নিতে মুসলিমদের নিষেধ করা হয় (কুরআন, সুরা মায়িদা ৫:৫১), যদিও তারাও আহলে কিতাব।
হযরত মুহাম্মাদ (সা) মদিনার শাসক হওয়ার পর তিনি মদিনা সনদ ভাঙার দায়ে প্রথমে বনু নাজির ও এরপর বনু কায়নুকাকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। তৃতীয় গোত্র বনু কুরাইজার সব পুরুষকে হত্যা করা হয় পরিখার যুদ্ধে (খন্দক যুদ্ধে) মদিনার বিরুদ্ধে গিয়ে মক্কার সাথে হাত মেলানো অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে। এগুলো মুহাম্মাদ (সা) এর মৃত্যুর ৬ বছর আগে, ৬২৬ সালের মাঝে সংঘটিত হয়। ৬২৮ সালে মুসলিমরা ইহুদী-অধ্যুষিত খায়বার জয় করে নেয়
ইসলামি ইতিহাসে এ ঘটনাগুলোর বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ইহুদীরা তাদের ইতিহাসে এগুলো পারতপক্ষে এড়িয়ে যায়, কিংবা খুবই সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়। বরং ইহুদীরা জোর দেয় কীভাবে তাদের কোন গোত্র আরবে পৌঁছালো, ইসলামি খেলাফতের সময় বা তারপর তাদের জীবনকাল এই নতুন শাসনাধীনে কেমন চলেছিল, এসবের ওপর।
ইয়েমেনের রাজধানী তখন ছিল ‘সানা’ ইয়েমেনি ইহুদীদেরকে, তাই সানায়ী ইহুদীও ডাকা হয়। তারা অন্যান্য ইহুদী জাত অর্থাৎ আশকেনাজি, সেফার্দি ইত্যাদি ইহুদীদের থেকে আলাদা, এদের সম্পর্কে পরে আলাপ করা হবে। তবে এটুকু জেনে রাখা যায়, ইয়েমেনি ইহুদীরা পড়ে ‘মিজরাহি’ বা ‘পুবদেশী’ ইহুদীদের কাতারে। তাদের কথা যে কারণে এলো-সানায়ী ইহুদীদের কাছ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী আগে যখন ব্যবিলনের হাতে প্রথম বাইতুল মুকাদ্দাস বা ফার্স্ট টেম্পল ধ্বংস হয়ে যায়, তারও বেয়াল্লিশ বছর আগে তারা ইয়েমেন এলাকায় এসে স্থায়ী হয়েছিল।
জেরেমায়া বা নবী ইয়ারামিয়ার বরাত দিয়ে ‘আ জার্নি টু ইয়েমেন অ্যান্ড ইটস জ্যুস’ বইতে জানানো হয়, প্রায় ৭৫,০০০ ইহুদী ইয়েমেনে চলে গিয়েছিল, যাদের মাঝে লেবীয় ইমাম বা পুরোহিতরাও ছিলেন। ‘জ্যুয়িশ কমিউনিটিজ ইন এক্সোটিক প্লেসেস’ বইতে দক্ষিণ ইয়েমেনের হাব্বান গোত্র থেকে আমরা জানতে পারি, জুদাহ রাজ্য থেকে আসা ইহুদীরা সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংসের আগে এখানে বসত গাড়ে। তবে তারা এসেছিলো রোমান বাহিনীর সাথে, রাজা হেরোদ রোমান সেনাদের সাহায্য করার জন্য যেসব ইহুদীকে এ অঞ্চলে পাঠিয়েছিলেন, তারা আর ফিরে যায়নি, এখানেই থেকে যায়।
কথিত আছে, বনু আওস ও বনু খাজরাজ ইয়াসরিবে এসে স্থায়ী হয় কিছু
ভবিষ্যদ্বাণী শুনে যে, আরব থেকে এক নতুন নবী আসবেন এবং তিনি ইয়াসরিবেই আসবেন। ৪৭০ সালে পারস্যের রাজা ফিরোজ নির্বাসিত ইহুদীদের মাঝে এক্সিলার্ক প্রথা বিলুপ্ত করার চেষ্টা করেন। তখন ব্যবিলনের ত্রিশতম এক্সিলার্ক দ্বিতীয় মার-জুত্রাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় মাহুজা সেতুর ওপর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ইহুদীদের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। যেদিন তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, সেদিনই তার ছেলে তৃতীয় মার-জুত্রার জন্ম। তাকে গোপনে বড় করে তোলা হয়। আঠারো বছর বয়সে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইসরাইলে। সেখানে তিনি সানহেদ্রিনের প্রধান হয়েছিলেন বলে কথিত আছে। এক্সিলার্ক নিধন থেকে পালাতে এই মার-জুত্রার ছেলে এক্সিলার্ক পঞ্চম হুনা নিজের মেয়ে ও কিছু মানুষ নিয়ে পালিয়ে ইয়াসরিবে চলে গিয়েছিলেন নিরাপত্তার জন্য। এসবই ইহুদী নথি মোতাবেক। মুহাম্মাদ (সা) যখন ইয়াসরিবে এলেন, তখন তাদের প্রতীক্ষিত নবী হওয়া সত্ত্বেও ইহুদীরা তাঁকে গ্রহণ করেনি, কারণ তিনি বনী ইসরাইলি ছিলেন না, ছিলেন বনী ইসমাইলি, যাকে তারা দাসীর বংশধর বলে মনে করত। (ইহুদীরা মনে করে ইসমাইল (আ) এর মাতা হাজেরা ছিলেন দাসী।) ইহুদীদের নিজস্ব উৎসগুলোতে উল্লেখ না থাকলেও ইসলামি কিতাবগুলো অনুযায়ী, মুহাম্মাদ (সা)- এর জন্মের আগে পরে এবং মদিনায় আগমনের পরে অনেক ইহুদী পণ্ডিতই ভবিষদ্বাণীর সাথে মিলিয়েছিলেন মুহাম্মাদ (সা)-কে।
৬৩২ সালে মারা যান হযরত মুহাম্মাদ (সা)। তার মৃত্যুর পর শুরু হয় খলিফাদের শাসন। ৬৪৪ সালের মাঝে মুসলিমদের অধিকারে আসে সিরিয়া, ইসরাইল, মিসর, ইরাক এবং পারস্য। ওদিকে পঞ্চম শতকে পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলেও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বহাল তবিয়তে টিকে ছিল, তবে তাদেরকে ডাকা হতো ‘বাইজান্টিন (Baohsia) সাম্রাজ্য’ বলে। বহু বছর পরে, ১৪৫৩ সালে মুসলিম অটোমান অর্থাৎ উসমানী খিলাফতের কাছে পতন হয় বাইজান্টিনদের। যতদিন টিকে ছিল, ক্ষমতার সাথে টিকে ছিল তারা। তবে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন সবে ইসলামের যাত্রা শুরু, সেই উদীয়মান মুসলিম বাহিনীর কাছেই তুলোধুনো হয় বাইজান্টিন বাহিনী। মুসলিমদের আক্রমণে বাইজান্টিনদের পূর্ব ফ্রন্ট ধ্বসে পড়ে এবং এপাশ থেকে সীমানা কমে গিয়ে এশিয়া মাইনর অর্থাৎ আনাতোলিয়া বা আধুনিক তুরস্কের সীমানার দিকে ঠেকে। এই মুসলিম বাহিনীর হাতে পতন হয় পরাক্রমশালী পারস্য সাম্রাজ্যেরও।
পরের ষোল বছরে উমাইয়া খলিফাদের আমলে ইসলামি সাম্রাজ্যের সীমানা আরও বাড়তে শুরু করে। অষ্টম শতকের শুরুতে জিব্রাল্টার প্রণালী পেরিয়ে ইসলাম ইউরোপে তারিক ইবনে জিয়াদের হাত ধরে প্রথম পা রাখে। সত্যি বলতে, তারিকের পাহাড় বা ‘জাবাল-আল-তারিক’ থেকেই ‘জিব্রাল্টার’ নামটি এসেছে। বর্তমান স্পেনে (পর্তুগালের তৎকালীন আঞ্চলিক নাম আন্দালুস) ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম।
তবে মুসলিমদের মাঝেই ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। ৭৫০ সালে উমাইয়াদের সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে আব্বাসীরা। আব্বাসীয় খিলাফাতের রাজধানী দামেস্ক থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বাগদাদে। এ সময় হাদিস সংকলন করা হয় এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখা থেকে শুরু করে আইন ও সামরিক ক্ষেত্রেও উন্নতি করে মুসলিমরা।
কিন্তু সাম্রাজ্যের ইহুদীদের কী অবস্থা তখন? ইহুদীদেরকে গণধর্মান্তরে জোর করা হয়নি। তাদেরকে তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়া হয়। সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতেও বাধ্য করা হয়নি। বিনিময়ে তাদেরকে ইসলামি কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। ৮০০ সালে এ নিয়ে ‘উমার চুক্তি’ সম্পাদিত হয়।
উমার চুক্তিতে ইসলামি শাসনাধীন সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া জেরুজালেমের যেসব নাগরিক মুসলিম নন, তাদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন শর্ত উপস্থাপিত হয়। এই অমুসলিমদেরকে ‘যিম্মি’ বা ‘আহলে কিতাবি লোক’ বলা হয়। তারা মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিমদের নিরাপত্তার অধীনে থাকবে। খলিফা দ্বিতীয় উমারের সম্মানে এ নাম দেয়া হয় চুক্তির। তবে উমার (রা) জেরুজালেমের বাসিন্দাদের ব্যাপারে যে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটি আর এই ‘উমার চুক্তি’ এক নয়। এ চুক্তিতে যিম্মি অমুসলিমদের নানা অধিকার তুলে ধরা হয়। ইহুদীদের ব্যাপারেও একই অধিকার ছিল, তবে নিষেধাজ্ঞাগুলো ছিল এমন- নতুন করে সিনাগগ বানানো যাবে না আর, মুসলিমদের চেয়ে উঁচু ঘর বানানো যাবে না। শিঙ্গা বাজালে নিচু স্বরে বাজাতে হবে, জোরে প্রার্থনা করা যাবে না, মুসলিমদের সাথে কবর হবে না, মুসলিমদের ব্যাপারে মিথ্যা বলা যাবে না, মুসলিমদের মতো পোশাক পরা যাবে না, অস্ত্র রাখা যাবে না, ইত্যাদি। তবে খ্রিস্টানদের কাছে এগুলো নতুন হলেও ইহুদীদের কাছে ছিল পরিচিত। ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে তখন জিজিয়া অর্থাৎ কর দিতে হতো।
তবে ইহুদীদের মতেই, মুসলিম শাসনামলে ইহুদীরা বেশ শান্তিতে ছিল, তারা নিজেদের উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়। নানা শহরে ইহুদীরা রং করা, তাঁত বোনা, রেশমি কাপড় তৈরি, ধাতুর কাজ, ইত্যাদি শিখে নেয়, এবং বেশ পারদর্শিতা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক ব্যবসাতেও তারা সফলতা লাভ করতে থাকে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় ব্যবিলনের ইহুদী সমাজ থেকেও ইহুদীরা মুসলিম সাম্রাজ্যে অভিবাসী হয়ে আসতে লাগলো। বেশ কয়েকজন ইহুদী ব্যবসায়ী ইসলামি সাম্রাজ্যের বাইরেও ব্যবসা করতে শুরু করে।
বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের যে প্রদেশগুলো মুসলিমদের হাতে চলে আসে, সেখানকার ইহুদীরা মুসলিম শাসনকে সাদরে গ্রহণ করে। খ্রিস্টানদের হাতে শোষিত হবার বদলে ইসলামি আইনের কাঠামোর মধ্যে থাকতে পছন্দ করত ইহুদীরা। প্রাচীন পারস্যের (সাসানীয় সাম্রাজ্যে ইহুদীরা যেমন কাঠামোবদ্ধ জীবন যাপন করতে পারত, মুসলিম শাসনেও তারা সে জীবন ফিরে পায়
উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফারা ইহুদীদের ব্যবিলনীয় এক্সিলার্ক প্রথা মেনে নেন। এক্সিলার্করা খলিফার দরবারে ইহুদীদের প্রতিনিধি হিসেবে যেতেন, জিজিয়া প্রদান করতেন, ইহুদীদের বিচারব্যবস্থা দেখভাল করতেন। আব্বাসীয় শাসনামলে, এক্সিলার্কদের সাথে ক্ষমতায় ভাগ বসান ইহুদী অ্যাকাডেমিগুলোর র্যাবাইরা। প্রত্যেক অ্যাকাডেমির প্রধানকে ডাকা হতো গাওন, যার অর্থ ‘প্রতিভাবান’। ইহুদী ধর্মীয় আইনপ্রণেতাদেরকে একত্রে ‘হালাখা’ বলা হতো, অর্থাৎ ‘ইহুদী আইন বা জীবনব্যবস্থা’।
এই গাওনদেরকে বাছাই করা হতো ব্যবিলনের বনেদী ইহুদী পরিবার থেকে। অষ্টম শতকে গাওনদের নিয়োগ দিতেন এক্সিলার্করা, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে লাগলো। গাওনরাই নিয়োগ দিতেন এক্সিলার্কদেরকে, এতটাই স্বাধীন হয়ে গেলেন তারা। দশম শতকে ব্যবিলন থেকে সরিয়ে অ্যাকাডেমিগুলো বাগদাদে নিয়ে আসা হয়। একাদশ শতকে গিয়ে ব্যবিলনের চাইতে বাগদাদের ইহুদী সমাজের সম্মান বেড়ে গেল, ইহুদীদের জ্ঞানবিজ্ঞান সব বাগদাদকেন্দ্রিক হতে শুরু করলো।
এই মুসলিম শাসনের সময়ই খাজার ও কারাইট ইহুদীদের আবির্ভাব ঘটে।