অধ্যায় ১১ : ব্যবিলনের ইহুদী সমাজ
খ্রিস্টের জন্মের পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে, সম্রাট দ্বিতীয় নেবুকাদনেজার বা বখতেনাসার ছিলেন নব্য ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা। তিনি ইহুদীদেরকে তাদের পবিত্র ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেন, তাদের নতুন স্থান হয় ব্যবিলন। সে অনেক আগের কথা। তবে ব্যবিলনে ইহুদীরা নতুন করে তাদের ইহুদী সমাজ কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করল। কয়েকশ বছরে সেই সমাজ ভালোই শেকড় গেড়ে বসে মেসোপটেমিয়ার রাজধানী ব্যবিলনে।
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এসে মেসোপটেমিয়ার অধিপতি পারস্যরাজ ইহুদীদেরকে সুনজরেই দেখতেন। তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন এক্সিলার্ক (Exilarch) বা নির্বাসিত ইহুদীদের নেতা বাছাই করে নেয়ার অনুমতি দেন। মঙ্গোলদের বাগদাদ ধ্বংস করা পর্যন্ত এই এক্সিলার্ক প্রথা চালু ছিল। আরামায়িক বা হিব্রুতে ‘রেশ গালুতা’ বলা হয়, আর আরবিতে রাস আল- গালুত/জালুত (এন না এই ১), যার মানে নির্বাসিতদের নেতা। ইহুদীদের ওল্ড টেস্টামেন্টে ‘গালুত’ বলে ডাকা হতো নির্বাসিতদেরকে। (জেরেমায়া/ইয়ারমিয়া কিতাব ২৯:২২, ২৮:৬, ২৯:১) ইহুদীদের মতে, এমনই একজন এক্সিলার্কের সন্তান ছিলেন শাল্লুম বেন হুশিয়েল, যিনি পারস্য থেকে সত্যধর্মের খোঁজে আরবে উপস্থিত হন, এবং মুহাম্মাদ (সা)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইহুদী বিশ্বাসে তিনি ব্যবিলনের ৩৭তম এক্সিলার্ক। ইসলাম ধর্মে তিনি সালমান ফার্সি (রা) বা ‘পারস্যের সালমান’ (puli plate) নামে পরিচিত। তবে মতান্তরে তার পূর্বনাম ছিল রুজবেহ খোশনুদান।
এক্সিলার্ক হবার শর্ত হলো, তার পূর্বপুরুষের কাউকে অবশ্যই কখনো না কখনো জুদাহ রাজ্যের রাজা থাকতে হবে। এক্সিলার্ক ইহুদীদের থেকে কর সংগ্রহ করতেন সাম্রাজ্যকে দেয়ার জন্য, বিচারক নিয়োগ দিতেন, বিচারকার্য দেখভাল করতেন, পারস্যরাজের দরবারে ইহুদীদের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলতেন। এ শতকের মাঝামাঝিতে এসে ব্যবিলনের ইহুদী শাস্ত্র ছড়িয়ে পড়ে পূর্বদিকের ফিলিস্তিনেও। বার-কহবার যে বিদ্রোহের কথা বলা হচ্ছিল আগে, সে বিদ্রোহের সময় অনেক ইহুদী স্কলাররাই ফিলিস্তিন ছেড়ে ব্যবিলনের বাসিন্দা হয়ে যান এ শাস্ত্রের টানে। আর তাছাড়া রোমান সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের হাত থেকে বাঁচার বিষয়টা তো আছেই।
অবশ্য ব্যবিলন থেকেও অনেক স্কলার ফিলিস্তিনি ইহুদী সমাজে গিয়ে জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। মিশনাহর যথাযথ সংকলন হয়ে যাওয়ার পর এমন মনীষী বিনিময় বেড়ে যায়। তাদেরকে মিশনাইক মনীষী বলা হয়। আর এর পরের যুগের ইহুদী মনীষীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইহুদী আইনপ্রয়োগ সংক্রান্ত নানারকম পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিতর্কে। সেটি ব্যবিলন ও ফিলিস্তিন, দুজায়গার ইহুদীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আগে উল্লেখ করা জুদাহ হা-নাসির এক ছাত্র র্যাবাই রাভ তৃতীয় শতকে মধ্য-মেসোপটেমিয়াতে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। একই সময়ে আরেক র্যাবাই নেহার্দিয়াতে আরেকটি ব্যবিলনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেন, যেটি ২৫৯ সালে নেহার্দিয়া শহরের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায়।
পারস্যের পার্থিয়ান সাম্রাজ্য আরেকটি নামেও পরিচিত ছিল- আর্সাসিদ সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২৪৭ খ্রিস্টাব্দ ২২৪)। পারস্যের দুর্বার যোদ্ধা ও অগ্নিপূজা ধর্মের একজন পুরোহিত সাসানের নামে প্রতিষ্ঠিত সাসানীয় সাম্রাজ্য আগের পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের ইতি টানে। একে ইরানি সাম্রাজ্য নামেও ডাকা হতো, যাদের রাজাদেরকে ‘শাহেনশাহ’ বলা হতো। ইতিহাসের পাতায় এ সাম্রাজ্য নব্যপারসিক সাম্রাজ্য নামেও পরিচিত। তারা অনুসরণ করতেন পারসিকদের নিজস্ব নবী জরথুস্ত্র’র শিক্ষা।
জরথুস্ত্র যে কবে জীবিত ছিলেন, সেটা ইতিহাস নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কেউ বলেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক, কেউ বা বলেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ কি সপ্তম শতক! তার জন্ম কোথায়, তাও জানা নেই। তবে তিনি বাস করতেন ইরানের পূর্বাঞ্চলে। প্রাচীন ইরানি শব্দ ‘জরথুস্ত্র’ অর্থ করা যায় ‘উটের রাখাল’। মারা যাবার সময় তার বয়স ছিল ৭৭ বছর ৪০ দিন। তার প্রচারিত বিশ্বাসের মাঝে ছিল মৃত্যুর পর বিচার, পুনরুত্থান, দোজখ, বেহেশত, ইত্যাদি। ইসলামি ব্যাখ্যায় জরথুস্ত্রর অনুসারীদেরকে অনেকক্ষেত্রেই বলা হয়ে থাকে মাজুস (অন্তর), ফার্সিতেও কাছাকাছি- ‘মাগুস’, ইংরেজিতে ম্যাজিয়ান। ‘অগ্নিউপাসক’ হিসেবেও অনুবাদ করা হয় এ শব্দকে। কুরআনে মাজুসদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা ইহুদী খ্রিস্টানদের মতোই একসময় একেশ্বরবাদী ছিল, শেষ বিচারের দিনে তারা আল্লাহর বিচারের সম্মুখীন হবে। (কুরআন ২২:১৭ )
প্রাচীন ইরানি ভাষাকে আবেস্তা বলা হয়। আবেস্তা ভাষায় লেখা ‘জেন্দ আবেস্তা’ হলো জরাথুস্ট্রবাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, যাতে অসৃষ্ট এক মহাপ্রভু আহুরা মাজদার উপাসনা করা হয়। আবেস্তা ভাষায় ‘আহুরা’ মানে উপাস্য, ‘মাজদা’ মানে জ্ঞান। এ ধর্মে প্রধান দুটো পবিত্র উপাদান হলো ‘পানি’ আর ‘আগুন’। এগুলো তাদের কাছে সর্বোত্তম বিশোধক। তাদের অগ্নিমন্দিরে তাই পানি আর আগুন রাখা হতো। অন্য ধর্মগুলো তাদের বিশ্বাসকে অগ্নিউপাসনা বলে ভুল ভাবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রাচীন রীতিগুলো সম্পর্কে পড়লে জানা যায়, আগুন তাদের দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনার সময় জ্বালিয়ে রাখতে হতো, কিংবা যেকোনো উপাসনার সময়। আগুনকে তারা একটি আত্মিক অন্তর্দৃষ্টি আর জ্ঞান পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করত। আগুনকে তারা আহুরা মাজদার ঐশ্বরিক উপস্থিতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও ধরে নিত, কখনও তাই তাদের পবিত্র মন্দিরের আগুনকে নিভতে দিত না।
সাসানীয় সাম্রাজ্য ক্ষমতা দখলের পর জরথুস্ত্রর ধর্মের একটি সংস্কারকৃত রূপকে রাজ্যের সরকারি ধর্ম হিসেবে প্রচলিত করে। প্রথম সাসানীয় শাহেনশাহ আরদাশির (২২৬-২৪০) নব্য জরথুস্ত্র ধর্মের পুরোহিতদের চাপ দিলেন ইহুদী ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের জরথুস্ত্রর ধর্মে নিয়ে আসতে। তবে তার মৃত্যুর পর শাহেনশাহ শাপুর (২৪১-২৭০) আর চাপ দেননি, বরং তিনি অন্যান্য ধর্মকেও শান্তিমতো রাজ্যে বিস্তার হতে দিয়েছিলেন, এমনকি তিনি আবার ইহুদীদের এক্সিলার্ক প্রথার অনুমতি দেন।
অবশ্য ইহুদী নেতারা পারস্য সাম্রাজ্যের সকল আইন মানতে বাধ্য ছিলেন। আর কিছু করতে না পেরে ইহুদী নেতা শামুয়েল তার বিখ্যাত নিয়ম বর্ণনা করেছিলেন- “দিনা দে-মালখুত দিনা” অর্থাৎ “সরকারের আইনই হলো ধর্মের আইন”। তবে ফিলিস্তিনের ইহুদী সম্প্রদায়ে কখনই এই নীতি মানা হয়নি, অর্থাৎ রোমান আইনকে ধর্মের আইন হিসেবে মানেনি ইহুদীরা। তবে ফিলিস্তিনের বাইরে থাকা অন্যান্য ডায়াসপোরার ইহুদীরা শামুয়েলের এ নীতিই মেনে নেয়, অর্থাৎ রাজ্যের আইনকেই তারা ধর্মজ্ঞান করে চলতে থাকে।
ব্যবিলনের ইহুদীদের মধ্যে নানা ফেরকা বা উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তাদের সকলের মূল ধর্মবিশ্বাস ছিল একই। বহুকাল পর্যন্ত ব্যবিলনীয় ইহুদীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল বেশ বিখ্যাত। আর ফিলিস্তিন অঞ্চলের ইহুদীদের করুণ অবস্থার সময় ব্যবিলনের ইহুদীরাই ধর্মটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তবে আর যাই হোক, জরথুস্ত্রর ধর্মের অনুসারীদের সাথে আর কোনো বড় সমস্যার উল্লেখ আমরা পাই না, যা সমস্যা কেবল রাজাবাদশাহদের সাথেই। উল্লেখ্য, জরথুস্ত্রর ধর্মের অনুসারীদের অগ্নিমন্দির এখনও দেখতে পাওয়া যায়; কারণ আজও জরথুস্ত্রর ধর্ম টিকে আছে, তাই অগ্নিমন্দিরগুলোও আছে। এ মুহূর্তে পৃথিবীতে ১৭৭টি অগ্নিমন্দির আছে। এর মধ্যে কেবল ২৭টি ভারতের বাহিরে, বাকিগুলো ভারতেই, খোদ মুম্বাইতেই ৪৫টি। ভারতে এমন নিয়ম ছিল আগে যে একজন জরথুস্ত্র নারী অগ্নিমন্দিরে ঢুকতে পারবেন না যদি তিনি জরথুস্ত্রর বাইরে কাউকে বিয়ে করেন, তবে সুপ্রিম কোর্টে এ আইনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
একটা সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের সরকারি ধর্ম হয়ে দাঁড়ালো খ্রিস্টধর্ম। তখন কিন্তু ঠিকই খ্রিস্টধর্মের অনুসারীদের অত্যাচার করা হতো পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যে, ইহুদীদেরকে কখনই নয়। কারণ, পারস্য সাম্রাজ্য তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যকে। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে যেখানে সেখানে খ্রিস্টান পাদ্রী ও সাধারণ অনুসারীদের হত্যা করা হতে লাগলো রাজ্য জুড়ে। তবে খুব ক্ষুদ্র একটা সময়ের জন্য (৪৪৫-৪৭৫) ইহুদীদের ওপরও ক্ষেপে যায় পারস্য সরকার। তখন এক্সিলার্ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, সিনাগগ আর সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, নিষিদ্ধ করা হয় তাওরাত। তবে ষষ্ঠ শতকে আবার পরিস্থিতি ইহুদীদের জন্য ভালোর দিকে যায়।
পারস্য সাম্রাজ্যের ব্যবিলনে এভাবেই দিনাতিপাত করতে লাগলো ইহুদীরা; আর এরপরই আবির্ভাব ঘটে ইসলামের।