অধ্যায়-১১ – জীবন ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ

অধ্যায়-১১ – জীবন ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ

একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম যা সমুদয় স্বপ্ন নয়
উজ্জ্বল সূর্যটা নিভে গিয়েছিল ছিল না তার কিরণ
তিমির অনন্ত শূন্যে ছিল নক্ষত্রদের বিচরণ।
দুর্গম, শীতল পৃথিবী ছিল না তার আলোকচ্ছটা
চাঁদহীন পৃথিবীর আকাশে দুর্ভেদ্য আঁধারের ঘনঘটা।

– ডার্কনেস্, লর্ড বায়রন্

.

আমরা যেসব সময়ের পরিসর নিয়ে আলোচনা করে আসছি সে সব সময়ের পরিসরে জীবন্ত সত্তাগুলো কোন দশায় পর্যবসিত হবে? তারা কীরূপে টিকে থাকবে? এসব বিষয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা প্রায় অসম্ভব। অত্যন্ত শীতল অবস্থায় জীবন হয়ত ছমছমে, ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হয়ে পড়বে। যাই হোক, প্রাণ ও সভ্যতার টিকে থাকার ধরনের সম্ভাব্যতা নির্ভর করে শক্তির উৎসের উপযোগিতার ওপর। পূর্বে আলোচিত মহাবিশ্বের প্রতিটি ধাপের শক্তির উৎসসমূহের উপযোগিতা নিয়ে এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। সভ্যতাকে টিকে থাকার জন্য প্রতিটি ধাপে অনেক প্ৰযুক্তিগত উদ্ভাবনী কৌশলের প্রয়োজন পড়বে। আসন্ন উদ্ভাবনী কৌশলসমূহ অনুমান সাপেক্ষে নিচে তুলে ধরছি। খুব প্রায়ই সমাজ বা সভ্যতাকে প্রখর সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সভ্যতা যদি ধ্বংসাত্মক সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি না হয় তবেই মঙ্গল। উদাহরণস্বরূপ, পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ। আমার আশা ও অনুমান এই যে, এ জাতীয় সমস্যা এড়াতে মানবজাতি বা সভ্যতা পরিপক্কতা ও ধীশক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে। কয়েক বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সূর্য বিকিরণ দিয়ে যাবে। ফলে প্রাণ ও সভ্যতার পাবে পর্যাপ্ত শক্তি। এখানকার শক্তির উৎসের আলোচনায় আমি বাধ্যতামূলকভাবে সৌরশক্তিকে বুঝাচ্ছি না। বিভিন্ন ধরনের শক্তি সূর্যের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, স্রোত ও বায়ু হতে যে শক্তি নেওয়া হয় তাও সূর্যের ওপরই নির্ভরশীল। যদি সূর্য শীতল হয়ে যায়, তাহলে সাগর বরফে পরিণত হবে। স্থির হয়ে যাবে বায়ুমণ্ডলের বাতাস। থাকবে না কোনও স্রোত, জোয়ার-ভাটা। তাছাড়া অন্যান্য উৎসেরও একই পরিণতি ঘটবে।

খুব সম্ভবত সূর্য হয়ে যাবে শ্বেতবামন। কিন্তু এই অবস্থায় পৌঁছার পূর্বে এটি পরিণত হবে লাল দানবে। তবে সূর্যের ভর সুপারনোভা বিস্ফোরণের জন্য উপযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে সূর্যের ভর অনেক কম বলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটবে না। এই অবস্থায় পৃথিবী তখন হয়ত ভস্ম হয়ে যাবে অথবা যে কোনও পরিণামে পৃথিবী অসহনীয় মাত্রায় উষ্ণ হয়ে যাবে। ফলে প্রাণীদের জীবন ধারণ হবে অসম্ভব। সভ্যতাকে বাহিরের কোনও গ্রহে পাড়ি জমাতে হবে কিংবা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করতে হবে শূন্য উপনিবেশ। সর্বাধিক কয়েক দশ বিলিয়ন বিলিয়ন বছরে সূর্য অবশেষে শীতল হয়ে যাবে। এই সময়ের অনেক পূর্বেই সভ্যতা কৃত্রিম শক্তির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে সক্ষম হবে। নিঃসন্দেহে পারমাণবিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর টিকে থাকতে সক্ষম হবে। সভ্যতা তখনই হয়ত অন্য কোনও নক্ষত্রে স্থানান্তরিত হতে চেষ্টা চালাবে। আর স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য কৃত্রিম পারমাণবিক শক্তিকে অবলম্বন করবে। তখন বিকিরণকারী নক্ষত্র হিসেবে সবচেয়ে কাছে যে নক্ষত্রটি থাকবে সেটিও হবে আমাদের থেকে বেশ কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। বর্তমানে সৌরজগতের বাহিরে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টেরাই এটি আমাদের থেকে প্রায় ৪.৩৪ আলোকবর্ষ দূরে। যেখান থেকে কোটি কোটি বছরের জন্য শক্তি পাওয়া যাবে এমন একটি বিকিরণকারী নক্ষত্রের নৈকট্য অঞ্চলে যেতে হলে পরিবহণ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হবে কষ্টসাধ্য।

প্রায় এক হাজার বিলিয়ন বছরে বা তারও কিছু সময় পর গ্যালাক্সির সকল নক্ষত্রই নির্বাপিত হবে। তখন অন্য গ্যালাক্সিতে যাওয়ার প্রচেষ্টা নিরর্থক হবে। কারণ সকল গ্যালাক্সিই তখন একইরকম মরণাপন্ন অবস্থায় থাকবে। কিন্তু তখনও আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যেই আরও শক্তির উৎস থাকবে। এই বিষয়টি নিচে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

অধিকাংশ নক্ষত্রের নিজ অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণন গতি রয়েছে। অনেকটা একইরকমভাবে পৃথিবী যেমন প্রতিদিনে একবার তার নিজ অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণন শেষ করে। এই ঘূর্ণনে একটি শক্তি সঞ্চিত রয়েছে যাকে বলা হয় আবর্তনশীল শক্তি বা নক্ষত্রের কৌণিক ভরবেগের শক্তি। এটি পদার্থ বিদ্যার সুপ্রতিপন্ন বিধান যে, কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত থাকে। এবার যখন একটি আবর্তনশীল নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয় তখন সংরক্ষিত আবর্তন ব্ল্যাকহোলকে আবর্তনশীল গতি দান করে। সুতরাং একটি আবর্তনশীল ব্ল্যাকহোলের আবর্তনশীল শক্তি রয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজার পেনরোজের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া অনুসারে এই আবর্তনশীল শক্তি থেকে নির্যাস নেওয়া যেতে পারে। একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোলের চারপাশে একটি অঞ্চল রয়েছে যাকে বলা হয় ‘আর্গোমণ্ডল’। এই অঞ্চলের ভিতর রয়েছে ঘটনা দিগন্ত। এই আর্গোমণ্ডলে কোনও কণা বা পর্যবেক্ষক নিতান্ত স্থির থাকতে পারে না। কারণ ব্ল্যাকহোলের প্রযুক্ত বলের দরুন কণাটি ঘুরপাক খেতে থাকে। উপরন্তু বাহিরের পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হয় কণাটিতে ঋণাত্মক আধান বিদ্যমান আছে। এমনকি কণাটি এই ইরিগোমণ্ডল থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু কণা বা যে কোনওকিছু ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তে প্রবেশ করলে তা আর সেই স্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এবার পেনরোজের প্রক্রিয়ায় একটি E, কণাকে আর্গো মণ্ডলে পাঠালে কণাটি সেখানে ভেঙে গিয়ে দুটি কণায় পরিণত হবে। দুটি কণাতেই শক্তি বিদ্যমান থাকবে। এই কণা দুটিকে যথাক্রমে E1 ও E2 দ্বারা সূচিত করা যাক। ধরা, E1 ঋণাত্মক আধানযুক্ত এবং E2 ধনাত্মক আধানযুক্ত। E কণাটি অবশেষে ব্ল্যাকহোলের ভিতরে প্রবেশ করবে এবং E2, কণাটি আর্গোস্তর ত্যাগ করে বাহিরে বেরিয়ে আসবে। শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি অনুসারে আমরা পাই, Eo = E1 + E2। এই সমীকরণটি এই অর্থ প্রকাশ করে যে, Eo এর চেয়ে E2 বেশি শক্তিসম্পন্ন যেহেতু E1 ঋণাত্মক শক্তি সম্পন্ন। সুতরাং E2-Eo পরিমাণ ধনাত্মক শক্তি ব্ল্যাকহোল থেকে বেরিয়ে আসে। এই শক্তি আসে ব্ল্যাকহোলের আবর্তনশীল শক্তি থেকে (১১.১ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য)।

সভ্যতা গ্যালাক্সির মধ্যে একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোল পেতে পারে। পেনরোজের পদ্ধতি অনুসারে এই ব্ল্যাকহোল থেকে নির্গত শক্তির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারবে। এখন আমরা গ্যালাক্সির গতিশীল বিবর্তনের পর্যায়ে রয়েছি। গ্যালাক্সিটি প্রায় ১০^১২ থেকে ১০^২৭ বছর স্থায়ী হবে। এই গ্যালাক্সিটি একটি একক গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত হবে। খুব সম্ভবত সভ্যতার জননী নক্ষত্র অর্থাৎ ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোল যার থেকে তখন শক্তি আহরণ করবে সেটি কোনও না কোনও সময় নিকটের ত্রি-দেহী বা বহু-দেহী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। ফলে এই ব্ল্যাকহোলটি গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে যাবে। তখন সভ্যতা এই জননী নক্ষত্রকে ত্যাগ করবে এবং অন্য আরেকটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোল খুঁজে পাবে।

রোজার পেনরোজের আবিষ্কৃত বিশেষ পদ্ধতি

চিত্র-১১.১ : সভ্যতা একসময়ে রোজার পেনরোজের আবিষ্কৃত বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে একটি ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোলের শক্তি ওপর নির্ভরশীল হবে। এখন থেকে প্রায় ১০^২৭ বছর পর ব্ল্যাকহোলটি একটি সুপার গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলের পাশে অবস্থান করবে। এই রকম একটি ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোলের চারপাশে একটি অঞ্চল রয়েছে যাকে বলা হয় ‘আর্গোমণ্ডল’। কোনও কণা এই স্তরে প্রবেশ করতে পারে এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসতেও পারে। একটি তেজস্ক্রিয় কণা সমকোণে এ অঞ্চলে প্রবেশ করে ভেঙে যায়। মূল কণাটি ভেঙে দুটি কণায় পরিণত হয়। একটি কণা ব্ল্যাকহোলের ভিতরে চলে যায় আর অন্যটি আর্গোমণ্ডল ত্যাগ করে বাহিরে চলে আসে। কণাটি মূল কণার থেকে অধিক শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসে। আর কণাটি এই অতিরিক্ত শক্তি লাভ করে ব্ল্যাকহোলটির ঘূর্ণন থেকে।

আমি অনুমান করছি যে, সমাজগুলো তখন শূন্যস্থানে সহজে পরিবর্তনশীল কিছু বসতি নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকবে। পার্শ্ববর্তী বস্তুগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের সময় বসতিগুলো উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম থাকবে। ওই সভ্যতাগুলো ছায়াপথীয় ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ভিড় জমাতে ব্ল্যাকহোল থেকে শক্তি আহরণ করার জন্য। এই সমাজগুলো বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত থাকবে। হয়ত কিছুসংখ্যক থাকবে যারা আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত (যদি এরকম অস্তিত্ব থাকে)। যেহেতু গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোলের ব্যাসার্ধ শোয়ার্জশিল্ড বাসার্ধে হয় ২ থেকে ৩ আলোকবর্ষ দূরত্বের সমান। তাই এরকম ব্যাসার্ধের ব্ল্যাকহোলের আশেপাশের সভ্যতাগুলো আপেক্ষিক অর্থে সহজেই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু জোরালোভাবে বলতে হয় যে, ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোলের শোয়ার্জশিল্প ব্যাসার্ধ হয় না। এই ব্যাসার্ধ সুষম গোলাকার ব্ল্যাকহোলকে সমর্থন করে, যার ঘূর্ণন নেই। কিন্তু এখানে ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের আকৃতিটি আনুমানিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে।

তত্ত্ব বলে এই অবস্থা ১০^১০০ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত গ্যালাটিক বা সুপারগ্যালাটি ব্ল্যাকহোল এবং তাদের ঘূর্ণন শক্তি বিরাজমান থাকবে। অবশ্য এই ঘূর্ণন শক্তি ১০^১০০ বছরের পূর্বেই হয়ত নিঃশেষিত হয়ে যাবে। ব্ল্যাকহোল থেকে তখন হকিং বিকিরণও সম্ভবত এতটাই নিস্তেজ হয়ে আসবে যা সভ্যতাকে টিকে থাকার জন্য সাহায্য করতে পারবে না। লক্ষ করা উচিত যে, আমরা যে সব সময়ের পরিসর আলোচনা করে আসছি বা একটি সুপারগ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হওয়ার জন্য যে সময়ের পরিসর প্রয়োজন তার তুলনায় মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স চোখের একপলকের চেয়েও কম। সুতরাং মহাবিশ্বের বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়াগুলো এমনও হতে পারে যা আমাদের প্রচণ্ড কল্পনা শক্তিরও বাহিরে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আর কৃত্রিম বিষয় দুটির মধ্যে একটি অস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এটি বলা যায় যে, বর্তমানে আমরা যে সব জীবন্ত প্রাণীদের জানি তারা অনির্দিষ্টভাবে টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট নব্য বুদ্ধিদীপ্ত বিশেষত শীতল পরিবেশকে সহ্য করতে সক্ষম এমনভাবে গড়ে ওঠা প্রাণগুলো অনির্দিষ্ট ভাবে টিকে থাকতে পারবে। এটি অগত্যা অপ্রাকৃত প্রক্রিয়া হতে পারে না। অনির্দিষ্টভাবে টিকে থাকার জন্য এই প্রাণীরা হবে মধ্যবর্তী পর্যায়ের বুদ্ধিদীপ্ত সত্তা, যেমন আমরা। এখানে অবশ্য কারও মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে ‘প্রাণ’ বলতে কী বোঝায়? এখানে এই জটিল প্রশ্নের মধ্যে প্রবেশ করার অভিপ্রায় আমার নেই।

সুতরাং ১০^১০০ বছর পর বা তারও অনেক পূর্বে বাহিরের শক্তির উৎসগুলো নিঃশেষিত হয়ে থাকবে। প্রশ্ন জাগে সভ্যতা এবং জীবন কী মুক্ত মহাবিশ্বে বেঁচে থাকার সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির ওপর নির্ভর করে অনির্দিষ্টভাবে টিকে থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। অবশ্যই শক্তির মজুদই হবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি বিলিয়ন বিলিয়ন বছরব্যাপী অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে শক্তির অপচয় যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতি হয়ে দাঁড়াবে। বস্তুর ক্ষয় প্রাপ্তের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে যদি বস্তু বাস্তবিকই দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী না হয়। একটি চমৎকার প্রবন্ধে ডাইসন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন যে, চেতনা কি নির্দিষ্টভাবে বিন্যস্ত অণুর মূল পদার্থের ওপর নির্ভর করে না কি অণুসমূহের গঠনের ওপর নির্ভর করে? অন্য কথায়, যদি গঠনের দিক থেকে মস্তিষ্কের অবিকল প্রতিরূপ তৈরি হয়, কিন্তু এটি তৈরিতে ভিন্ন উপকরণ ব্যবহৃত হয় তবে কী এই প্রতিরূপ মূলটির মত কাজ করবে? যদি উত্তর হয় ‘না’ তাহলে জীবন ও চেতনা আলাদা হতে পারে না—একই সূত্রে গাঁথা। জীবন অস্তিত্বমান থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তরল পানি ও অবাধ শক্তিসহ উষ্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে। এই ক্ষেত্রে গ্যালাক্সির অবাধ শক্তি সরবরাহ সীমিত বলে জীবনের ব্যাপ্তিও সীমিত।

যাই হোক ডাইসন মনে করেন যে, চেতনার ভিত্তি হচ্ছে ‘গঠন’ বস্তু নয়। এইক্ষেত্রে তিনি একটি ‘জৈবিক অবরোহ বিধান’ এর অবতারণা করেছেন। এই বিধান অনুসারে পরিবেশের বাহ্যিক তাপমাত্রা অবনমিত হলে অনুভবক্ষম জীবের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ একই গতিতে হ্রাস পাবে।

ডাইসন কিছু যুক্তি দেখান, যেগুলো এ বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তিনি দেখান যে, জীবনীশক্তি অধিকতর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জৈবিক কাজ কমিয়ে দিতে পারে। একটি সমাজ এভাবে বিপাকের পরিমাণ কমিয়ে মাঝে মাঝে হাইবারনেশনে সময় ব্যয় করলে এ সমাজ অনির্দিষ্টভাবে সীমিত নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে। তিনি এও দেখান যে, এ রকম একটি সমাজের সসীম স্মৃতির প্রয়োজন নেই। মূলত একটি এনালগ কম্পিউটারের স্মৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের জন্য অনিঃশেষ ক্রমবর্ধমান ধারণ ক্ষমতার একটি স্মৃতিভান্ডার পাওয়া নীতিগতভাবে সম্ভব। তিনি যুক্তি দেন যে, বিভিন্ন সমাজ সীমাবদ্ধ পরিমাণ শক্তি ব্যয় করে বিশাল ও চিরপ্রসারণশীল দূরত্ব ও সময়ব্যাপী পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে।

ডাইসন বলেন যে, অবিমিশ্র গণিত শাস্ত্রে কার্ট গডেলের উপপাদ্যের সঙ্গে পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার একটি সাদৃশ্য রয়েছে। ১৯৩১ সালে গডেল এ উপপাদ্য পেশ করেছিলেন। তিনি গণিত শাস্ত্রের মূল বিষয়গুলির এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। গডেল প্রমাণ করেছিলেন যে, অবিমিশ্র গণিত শাস্ত্রের জগৎ অফুরন্ত। স্বতঃসিদ্ধের সীমিত সেট ও সিদ্ধান্তের নিয়ম কখনই পুরো গণিতকে ঘিরে রাখতে পারে না।

ডাইসন বলেন, ‘যদি আমার ভবিষ্যৎ দর্শন সঠিক হয় তবে পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদার জগৎও অফুরন্ত। আমরা যতদূর ভবিষ্যতের মধ্যে যাই না কেন সেখানে নিত্যনতুন বিষয় ঘটতে থাকবে, বেরিয়ে আসবে নতুন নতুন তথ্য। তৈরি হবে গবেষণার নতুন জগৎ, থাকবে প্রাণ, চেতনা ও স্মৃতির চির প্রসারণশীল জগৎ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *