অধ্যায় ১০ – নিকেশ

অধ্যায় ১০ – নিকেশ 

কয়েকদিন পর খোঁজখবর নিয়ে গেসু আবার এলো আমার ঘরে। 

“আমি সজলের পিছে টিকটিকি লাগায়া রাখছি…কই যায়, কই থাকে সব জানা যাইবো।” 

বুঝতে পারলাম খুব দ্রুতই কাজে নামতে হবে আমাকে। 

“সজল মরার আগে আমাগো একটু সাবধানে থাকা লাগবো…তোমারে জায়গা চেঞ্জ করতে হইবো। কেরাণীগঞ্জে আমার এক দোস্তের ওইখানে থাকো কয়টা দিন।” 

পরদিন ভোরে গেসু আমাকে নিয়ে চলে গেল নদীর ওপারে। কেরাণীগঞ্জের অনেক ভেতরে, তার এক বন্ধুর বাড়ি হলো আমার সাময়িক ঠিকানা। 

দুদিন পর গেসু কেরাণীগঞ্জে এসে জানালো, সজল কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা জানতে পেরেছে সে। 

“রাইতের বেলা কামটা আরামসে করন যাইবো,” সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল। “আইজকা রাইতেই করা লাগবো…ওইহানে বেশিদিন থাকবো না…দেরি করলে আর পামু না ওরে।” 

এভাবে লুকিয়ে থেকে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। এসব থেকে মুক্তি চাই। 

“হের পর বৌদিরে দেখুম। হেরেও জিন্দা রাখন যাইবো না। হেয় একটা বেঈমান!” 

দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম আমি। খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করতে, ওই কাজটাও কি আমাকেই করতে হবে! কিন্তু মুখে সেটা বলিনি 

“তুমি রেডি থাইকো…রাইতে আইতাছি,” বলেই চলে গেল গেসু। 

কথামতোই সে ফিরে এলো রাত ন’টার দিকে। তার লাল চোখদুটো দেখে বুঝতে পারলাম, গাঁজা মদ খেয়ে এসেছে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ভুনা মাংস আর পরোটা। আমি, গেসু আর তার সেই বন্ধু একসঙ্গে বসে খেলাম, তারপর রাইফেলের ব্যাগটা নিয়ে রওনা দিলাম জিঞ্জিরার দিকে।

রাত প্রায় এগারোটার দিকে নদীর তীরঘেঁষা একটি চারতলা ভবনের ছাদে উঠলাম আমরা। পুরো ভবনটাই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাজে ব্যবহার করা হয়। গেসু কীভাবে কী ম্যানেজ করেছে জানি না, ভবনের দারোয়ান চাবি দিয়ে দরজা খুলে ছাদে ওঠার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আমাদেরকে। 

নদীর উপরে থাকা বেশ কিছু লঞ্চের মধ্য থেকে এমভি জামান নামের একটি লঞ্চ দেখিয়ে দিলো গেসু, ওটার এক কেবিনেই আছে সজল। ক্যাবিনের সামনের অংশটা রেলিং দিয়ে ঘেরা। বাতি জ্বলছে সেখানে, কিন্তু জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। 

গেসু জানালো, মোকাররম নামে সজলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে, এই লঞ্চটা তার বাপের। ইঞ্জিন মেরামতের জন্য নদীতে নোঙর করে রাখা হয়েছে। সজলের এমন আত্মগোপন একটিই বার্তা দিলো আমাদেরকে : বড়সর আঘাত হানতে যাচ্ছে সে, আর সেটা অবশ্যই আমাদের উপরে! 

টেলিস্কোপে চোখ রাখলাম আমি। এমভি জামানের উপর তলার কেবিনগুলো স্পষ্ট হলো আমার কাছে। ভিআইপি কেবিনটার দিকে ফোকাস করলাম। কেবিনের বাইরে বাতি জ্বলছে কিন্তু দরজা বন্ধ। বোঝার উপায় নেই, ভেতরে লোকজন আছে কি না। 

সজল যে এখানে আছে সেটা গেসু কিভাবে জানতে পারলো? 

আমার কথা শুনে মুচকি হাসলো নাটকা, সিগারেটে লম্বা টান দিলেও জবাব দিলো না। 

রাত প্রায় বারোটার দিকে এমভি জামানের কাছে একটা নৌকা এসে ভিড়লো। নৌকার যাত্রি মাঝবয়সি এক লোক। নৌকাটা লঞ্চের গায়ে ভিড়লেও মাঝবয়সি লোকটা চুপচাপ বসে রইলো। লঞ্চের ভেতরে থাকা এক ছেলে তার সঙ্গে কিছু কথা বলে চলে গেল উপর তলায়। একটু পর ভিআইপি কেবিনের দরজা খুলে গেল, সেখান থেকে বের হয়ে এলো বোরকা পরা এক মেয়ে। কিছুক্ষণ পর সেই মেয়ে নৌকায় উঠে বসতেই ওটা চলে গেল আবার। 

“…মাইয়াটারে আমি চিনি,” সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল নাটকা গেসু। একটু আগে করা আমার প্রশ্নের জবাব দিলো যেন। 

নৌকাটা চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সজল। একটা ট্রাউজার আর গায়ে শাল জড়িয়ে কেবিনের রেলিংয়ে ঝুঁকে সিগারেট ধরালো। 

“মারো!” চাপাকণ্ঠে তাড়া দিলো গেসু। উত্তেজনায় ছটফট করছে সে। 

আমার হাত ট্রিগারে চলে গেল। ক্রসহেয়ারে বিদ্ধ করলাম টার্গেটের বুকের বাঁ-পাশটা। গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লাম… নিশ্বাস ছাড়ার সময়টাতেই চেপে দিলাম ট্রিগার। 

সাইলেন্সার লাগানোর ফলে কেবল থুপ্ করে একটা ভোঁতা শব্দ হলো। সজলের দেহটা লুটিয়ে পড়লো রেলিংয়ের ওপাশে। 

“সাব্বাশ!” গেসু আমার পিঠে আলতো করে চাপড় মেরে বলল। তার চোখেমুখে পৈশাচিক আনন্দ। 

নিথর হবার আগে খুব বেশি নড়াচড়া করলো না সজল। লঞ্চের ভেতরে শোরগোল তৈরি হলো কিন্তু সেটা দেখার ফুরসৎ নেই আমাদের। এক্ষুণি সটকে পড়তে হবে এই ভবন থেকে। রাইফেলটা ব্যাগে ভরে কোনো রকম সন্দেহের উদ্রেক না করেই আমরা ঐ ভবন থেকে বের হয়ে এলাম। আগে থেকেই গেসুর বন্ধু একটা অটো ঠিক করে রেখেছিল, সেটাতে উঠে বসতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি 

সেই রাতে আমার ঘুম এলো না। এমন না যে, মানুষ হত্যা করে অপরাধ বোধ থেকে ঘুম আসেনি। সত্যি বলতে, গেসু আর তার বন্ধুকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি। 

তারা দুই বন্ধু প্রচুর মদ খেয়ে চুর হয়ে যাবার পর আলগোছে সেখান থেকে সটকে পড়ি আমি, চলে আসি পুরান ঢাকায়, তবে নিজের ঘরে নয়, মুন্নার সেই চিলেকোঠায়। 

পরদিন সকালে সজল হত্যার খবর চাউর হয়ে গেল পুরান ঢাকায়। লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, নিজদলের কোনো বেঈমানের হাতে নিহত হয়েছে সে। অলিগলির অকর্মা চাপাবাজেরা জবরজঙ কাহিনিও বানিয়ে ফেলল এই সুযোগে। সাদামাটা গল্পে তাদের আগ্রহ থাকে না কখনও। তাদের কথা শুনে মনে হলো, চোখের সামনেই সজলকে মরতে দেখেছে! 

জগতটার নাম যেখানে আন্ডারওয়ার্ল্ড সেখানে সাধারণ মানুষ কী করে আসল সত্য জানবে? কতই না ভুলভাল জানে তারা! 

অপরাধ জগতের জটিল হিসেব, জটিল অঙ্ক। এখানে সব কিছুই সম্ভব। যে সজল আমাকে এ পথে নিয়ে এসেছে, আজ সে-ই আমার শিকার হয়েছে! 

তবে বুঝতে পারলাম, এখনও আমি মুক্ত নই। নতুন করে হিসেব কষতে লাগলাম। তিনজনের একটি চক্র-এর মধ্যমণি হলো মনিকা বৌদি! সজল কিংবা গেসু-তারা দুজনেই কি বৌদির প্রেমিক? না কি ক্রীড়নক? 

সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। 

গেসু আর বৌদির মাথায় কী আছে তা-ও জানি না। আমাকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনাটা কী, সেটাও পরিস্কার নয়। ঘটনা যাই হোক না কেন, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমার মুক্তির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য যেটার খুব বেশি দরকার ছিল। 

অধ্যায় ১১ – লাল টিপ 

বিকেলের শেষের দিকে, শীতকাল বলে আলো কমতে কমতে সন্ধ্যার আমেজ সৃষ্টি করেছে। হালকা কুয়াশাও পড়েছে এ সময়। গতকাল ভারি শৈত্য বয়ে গেছিল শহরের উপর দিয়ে, সেদিনও তার রেশ রয়ে গেছিল কিছুটা। 

ফাঁকা গোরস্তানে কেউ নেই, কিন্তু আমি জানি একটু পর একজন আসবে সেখানে। গতকাল লোকমারফত গেসুকে জানিয়েছিলাম, আমার খুব টাকার দরকার, কবরস্তানে আসবো বিকেলের দিকে। 

নাটকা গেসুর পরনে লুঙ্গি আর সোয়েটার, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ, হাতে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার। কবরস্তানের এককোণে একটা ভাঙা কাঠের টুলের উপর বসে সিগারেট ধরিয়ে আমার অপেক্ষায় বসে থাকলো সে। 

গভীর করে দম নিয়ে নিলাম আমি, নিশ্বাস ছাড়লাম ধীর গতিতে…তারপর থুপ্ করে একটা শব্দ হলো কেবল। 

কাঠের টুল থেকে পড়ে গেল গেসু। মুহূর্তে তার সোয়েটার ভেসে গেল রক্তে। গুলিটা লেগেছে গলার নিচে, যদিও আমি চেয়েছিলাম বুকের বাঁ-দিকে লাগাতে। সামান্য হেরফের হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা নেই, বড়জোর দুই মিনিট বেঁচে থাকতে পারবে সে। 

কবরস্তানের মাটিতে পড়ে থাকলেও জীবনের শেষটুকু শক্তি ব্যয় করে চারপাশের উঁচু ভবনগুলোর দিকে আমাকে খুঁজে বেড়ালো গেসু। দুহাতে শক্ত করে নিজের গলা চেপে ধরে আছে কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না-ফিকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আঙুল গলে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করছে সম্ভবত, অতো দূর থেকে সেটা আমার পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। 

রাইফেল নিয়ে জানালার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসেছিলাম এতক্ষণ, এবার উঠে দাঁড়ালাম, সরিয়ে দিলাম জানালার পদাটা। গেসুর বিভ্রান্ত দৃষ্টি আমাকে খুঁজে পেলো কবরস্তানের পাশেই আলিমুদ্দীনের পাঁচতলা বাড়ির চারতলার একটি জানালায়। 

আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত অবিশ্বাসে তাকিয়ে থেকে গেসু তার চেপে রাখা গলা থেকে একটা হাত আলগা করলো, সেই হাতের রক্তমাখা তর্জনি নিজের মাথায় ঠেকিয়ে আকুতি জানালো আমার কাছে। তার ইঙ্গিতটা বুঝতে একটুও সমস্যা হয়নি। তীব্র যন্ত্রণা পাচ্ছিল সে। 

আবারো হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম আমি। রাইফেলের টেলিস্কোপে রাখলাম ডান চোখ। ক্রসহেয়ারটা তাক্ করলাম গেসুর কপালে। দুচোখের ঠিক মাঝখানে। 

থুপ! 

মুহূর্তে গেসুর কপালে একটা লাল রঙের টিপ তৈরি হয়ে গেল। টিপটা গলে লাল তরল গড়িয়ে পড়লো তার কপাল বেয়ে। বড়জোর দুয়েক সেকেন্ড, তারপরই নিথর হয়ে গেল সে। 

এভাবে গেসুকে মুক্তি দিয়েছিলাম, তার চেয়েও বড় কথা, নিজের মুক্তিটাকে নিশ্চিত করেছিলাম আমি। কিন্তু সত্যিই কি মুক্তি পেয়েছিলাম? 

অধ্যায় ১২ – ওহ্ মনিকা! 

পরম নিশ্চিন্তে আমার নগ্ন বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে মনিকা। 

ওর মুখের দিকে তাকালেই খুব মায়া হয় আমার। এখনও হচ্ছে। খুব বেশিই হচ্ছে। তার জীবনের গল্পটা আমাকে বলেছে। কীভাবে অসহায় এক পরিবারের সুন্দরি কিশোরী মেয়ে বিধুদার মতো ভয়ঙ্কর লোকের দৃষ্টিতে পড়ে গেল, নিরীহ বাবা- মা বাধ্য হলো মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে-তারপর সেই কিশোরী মেয়েটি চেষ্টা করলো সব কিছু মানিয়ে নিতে, কিন্তু বিধুদাকে ততদিনে চেনা হয়ে গেছে তার-ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা মাথার এক খুনি-সন্ত্রাসের যুবরাজ। নামে রাজনীতি, আসলে সে ছিল চাঁদাবাজ, দখলদার এবং কন্ট্রাক্ট কিলার। সামান্যতম সন্দেহ হলে নিজ দলের বহুদিনের পুরনো, বিশ্বস্ত লোকজনকেও হত্যা করতো অবলীলায়। টাকা আর ক্ষমতার জন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদেরকেও রেহাই দিতো। বাইরে থেকে দেখলে সদাহাস্যময় একজন মানুষ অথচ ঘরের ভেতরে হিংস্র এক পশু- রীতিমতো একজন সাইকোপ্যাথ। 

একদিক থেকে মনিকা আর আমার মধ্যে মিল আছে, সে- ও আমার মতো মুক্তি চেয়েছিল। কলকাতায় গিয়েও যে সেই মুক্তি মিলবে না, জানতো। তাই অনেক আগেই বাবা-মা, ভাইবোনকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে একটা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এজন্যে সজলের সঙ্গে সম্পর্ক করতেও পিছপা হয়নি। কিন্তু সজল আমাকে দিয়ে চেষ্টা করেও বিধুদাকে মারতে ব্যর্থ হয়, উল্টো নিজেই বিপদে পড়ে যায়, দাদার হাত থেকে বাঁচতে চলে যায় কলকাতায়। 

বিধুদা যখন আমাকে দিয়ে সজলকে হত্যা করতে গেল তখন সেই খবরটা মনিকাই জানিয়ে দিয়েছিল। অথচ বিধুদার সন্দেহ গিয়ে পড়েছিল তার এক ক্যাডার খলিলের উপরে। বেঘোরে মারা যায় ছেলেটা। দেরিতে হলেও বিধুদা সন্দেহ করেছিল বিভীষণ তার নিজ ঘরেই আছে। কিন্তু মনিকাকে অমানুষিক নির্যাতন করার পরও ও সব কিছু অস্বীকার করেছিল। এক পর্যায়ে দাদার পিস্তলটা হাতে নিয়ে বলেছিল, এটা দিয়ে তাকে যেন মেরে ফেলে। ওর এমন আচরণে বিধুদা ভড়কে যায়। ভাবতে শুরু করে, স্ত্রীকে সন্দেহ করে ভুলই করলো বোধহয়। এরপরই তার সমস্ত সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে আমার উপরে। কিন্তু আমাকে ডেকে নিয়ে বৈঠকি খুন করার আগেই নিহত হয়ে যায়। 

মনিকা মার খাবার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, খুব বেশিদিন বিধুকে অন্ধকারে রাখতে পারবে না। সজলের সঙ্গে দেখা করে ও পরামর্শ দেয়, গেসুকে ম্যানেজ না করলে বিধুকে মারা সহজ হবে না। বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে গেসুকে ম্যানেজ করে ফেলেছিল সজল। কখন কোথায় আঘাত হানতে হবে, সব বলে দিয়েছিল বিধুদার এই বিশ্বস্ত সহচরই। 

মনিকা স্বীকার না করলেও, আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, নিজের মুক্তির জন্য গেসুর সাথেও ও সম্পর্ক তৈরি করেছিল। শুধুমাত্র টাকা পেয়ে দাদার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি নাটকা! 

তাঁতীবাজারে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হতেই বিধুদা যখন দেখতে পেলো কিছু ছেলেপেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে, তখনই পিস্তল বের করে গুলি করতে চেয়েছিল কিন্তু তার পিস্তলে একটাও গুলি ছিল না! নিহত হবার সময় দাদার সঙ্গেই ছিল গেসু, সে কিছুই করেনি। গুলিবিদ্ধ হবার পর অবিশ্বাসে তার দিকে তাকিয়েছিল দাদা ঠিক যেভাবে হাজার বছর আগে সিজার তাকিয়েছিল ব্রুটাসের দিকে! 

দাদা মারা যাবার পর মনিকা কলকাতায় চলে যায় বাবার অসুখের কথা বলে। তারপরই নতুন একটি পরিকল্পা করে ও পুরোপুরি মুক্তি পাবার জন্যে। সজলকে জানায়, গেসুকে মারতে হবে, সে সব জানে, তাকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। দাদার রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণের টাকা-পয়সার ভাগ চাইছে এখন। 

এদিকে গেসুও বুঝে যায়, সজল বেঁচে থাকলে তার পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। তাই আমাকে দিয়ে সজলকে শেষ করে দেয় সে। 

সজলকে হত্যা করার পরই আমি সব বুঝে যাই, মনিকার সঙ্গে যোগাযোগ করি। ও জানতো, সবার অগোচরে আমি একজন খুনি। ওকে জানাই, আমি এসব থেকে মুক্তি চাই। এর জন্যে যা করার করতে রাজি আছি। এ কথা শোনার পর রহস্যময় হাসি দিয়েছিল। বলেছিল, ও আমার মতোই মুক্তি চায়। 

এরপরই আমাকে ওর গল্পটা বলেছিল। সব শোনার পর ওর প্রতি খুব মায়া জন্মে যায় আমার। মনিকার কথাতেই গেসুকে হত্যা করি আমি। এই একজনই ছিল আমাদের দুজনের মুক্তির পথে একমাত্র বাধা। 

গেসুকে মারার পরই মনিকা আমাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে, তবে তার বদ্দার বাসায় না, বিধান নগরে নিজের ফ্ল্যাটে ওঠে। যদিও সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় বদ্দার কাছেই থাকে ও, মাঝেমধ্যে দেখা করে যায় আমার সঙ্গে। কখনও কখনও রাতে থাকে। 

একমাস ধরে আমি তার এই ফ্ল্যাটেই আছি। এখানে থাকার সময়ই দ্রুত আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। গভীর ভালোবাসা দিয়ে মনিকা আমার জীবনটা ভরিয়ে দেয়। এরকম ভালোবাসা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। ওর ভালোবাসা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহই ছিল না। 

ক-দিন আগে পর্যন্ত! 

ঘটনাচক্রে আমি জেনে গেছি, পাশের ঘরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা আছে বিধুদার যক্ষের ধন! 

এটা জানার পর থেকে ভীষণ দোটানায় পড়ে গেছি। মনিকার ভালোবাসা, আমার প্রতি ওর উদগ্র আকর্ষণ, ওর প্রতি আমার মায়া আর নিজের মুক্তি—সব মিলিয়ে চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ মনে হয় নিজেকে-কোন দিকে যাবো, কোন পথটা বেছে নেবো, বুঝতে পারিনি। 

পর পর দুই রাত অত্যুঙ্গ সঙ্গমের পর মনিকা যখন অচেতন হয়ে পড়ে ছিল, চেষ্টা করেছিলাম আমি, কিন্তু পারিনি। ওর মায়াভরা মুখ আমাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে দুবারই। 

তবে আমি চাই মুক্তি। সবার অগোচরে আমি যে একজন খুনিতে পরিণত হয়েছি, সেটা কেবল একজন মানুষই জানে এখন। ও না থাকলে আমি আবার আগের মতো একজন হয়ে 

যাবো পাড়া-মহল্লার পড়াশোনা করা ভদ্রগোছের এক ছেলে। বিপুল ধনরাশির কারণে বাকি জীবন নিয়েও ভাবতে হবে না আর। অভাবে পড়ে আবারো তলিয়ে যাবো না অন্ধকার জগতে। 

মনিকার দিকে তাকালাম। সুতীব্র ভালোবাসার পর কী নিশ্চিন্তেই না আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে! যেন আমি-ই তার একমাত্র আশ্রয়। 

ও আমার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। ওর হৃদস্পন্দনটাও টের পাচ্ছি নিজের বুকে। আর সেটা একতালে শান্তভাবে স্পন্দিত হচ্ছে। 

গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলাম আমি। তার ঘাড়ের উপর আলতো করে চেপে বসলো আমার হাত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *