অধ্যায়-১০ – ধীর ও সূক্ষ্ম পরিবর্তনসমূহ
কোয়ান্টাম বিদ্যা অনুসারে কণা উচ্চ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতি। কিন্তু চিরায়ত পদার্থবিদ্যা এ বিষয়টি মেনে নেয় না। উচ্চ বা চিরায়ত প্রতিবন্ধকতা বলতে এমন একটি প্রতিবন্ধকতাকে আমরা বুঝি যা কেবল চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে একটি ইলেকট্রন বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র দ্বারা সৃষ্ট একটি প্রতিবন্ধকতা বা বাধাকে অতিক্রম করে ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। প্রতিবন্ধকতা পার হওয়ার জন্য কণাটির যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি নেই। কণাটি বৈদ্যুতিক প্রতিবন্ধকতার ওপর লাফিয়ে পড়ে ফিরে আসে, কিন্তু বাধা অতিক্রম করতে পারে না। ইলেকট্রনের এই ব্যর্থতার দৃশ্যটি রেখাচিত্রের সাহায্যে ১০.১ নম্বর চিত্রের উপরের দৃশ্যে দেখানো হল। অন্যদিকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুসারে পদার্থের তরঙ্গ-সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য ইলেকট্রন কণাকে প্রতিবন্ধকতা ভেদ করার ছোটো একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই প্রক্রিয়াটি ১০.১ নম্বর চিত্রের নিচের দৃশ্যে দেখানো হল। একটি ভারী কেন্দ্রীণ যেমন ইউরেনিয়াম বা রেডিয়াম কেন্দ্রীণের তেজস্ক্রিয় ভাঙন সম্পর্কে জানতে এবং ইলেকট্রনিক্সের কিছু প্রক্রিয়ায়ও কোয়ান্টাম বিদ্যার এই সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু কোয়ান্টাম প্রভাব মূলত আণুবীক্ষণিক প্রভাব সেহেতু দৈনন্দিন ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে সুড়ঙ্গকরণ বিষয়ের কোনও উদাহরণ দেওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু বর্তমানে আমরা এরকম ক্ষেত্রের তেজস্ক্রিয়তার বিষয় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
চিত্র-১০.১ : চিরায়ত পদার্থবিদ্যায় ইলেকট্রন এবং পদার্থের অন্যান্য মৌলিক উপাদানগুলোকে কণা ধরা হয়। সুতরাং একটি ইলেকট্রন যার বৈদ্যুতিক বিভবের প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে পার হওয়ার যথেষ্ট শক্তি নেই। উপরের চিত্রের ন্যায় কণাটি বাধার ওপর লাফিয়ে পরে ফিরে আসে। কিন্তু কোয়ান্টাম বিদ্যা অনুসারে পদার্থের তরঙ্গ- সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য ইলেকট্রনকে ছোটো একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়- বাধা অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে যাওয়ার। বিষয়টি চিত্রের নিচের দৃশ্যে দেখানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় টানেলিং বা সুড়ঙ্গকরণ।
আমরা দেখব যে, মহাবিশ্বের সকল গ্যালাক্সি ও ব্ল্যাকহোল অদৃশ্য হওয়ার পর বা এমনকি অদৃশ্য হওয়ার পূর্বে অবশিষ্ট বস্তুগুলোর ধীর ও সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে। এই বস্তুগুলো একসময়ে গ্যালাক্সি বা নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বস্তুগুলোর এই ধীর ও সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতিতে। কিন্তু চিরায়ত পদার্থবিদ্যার নীতি অনুসারে এই প্রক্রিয়াটি সম্ভব না। এক্ষেত্রে শ্বেতবামন, নিউট্রন নক্ষত্র এবং অন্য ক্ষুদ্র বস্তুগুলো চিরকালই একই রূপে থাকবে।
একটি খণ্ড বস্তুর সুদীর্ঘ জীবনকাল বিবেচনা করা যাক। এক্ষেত্রে একটি পাথর বা গ্রহাণুকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটি অবশেষে শীতল হয়ে পরমশূন্য তাপমাত্রায় (০ কেলভিন) পৌঁছবে। পদার্থটির পরমাণুগুলো তখন হিমায়িত হবে এবং সংযুক্তি বল ও রাসায়নিক বন্ধন দ্বারা একটি নিশ্চল অবস্থায় রূপ নেবে। চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে পরমাণুর এ অবস্থা চিরকালই এক থাকে। এছাড়া পরমাণুগুলোর অন্য একটি অবস্থা তৈরি হতে পারে যাতে পরমাণুগুলোর শক্তি কমে যেতে পারে। পরমাণুগুলো নিম্ন শক্তিতে পৌঁছতে হয়ত তাদেরকে বৈদ্যুতিক বিভবের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করবে যা চিরায়ত পদার্থবিদ্যা মেনে নেয় না। কিন্তু কোয়ান্টাম বিদ্যা অনুসারে সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতিতে নিম্ন শক্তির অবস্থাতে পরমাণুগুলো নিজেদেরকে পুনর্বিন্যস্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে এদের খুব দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এমনকি অত্যাধিক দৃঢ় বস্তুগুলো ১০^৬৫ বছরে বা তারও কিছু বেশি বছরে তাদের আকৃতি ও রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন ঘটায়। বস্তুগুলো তখন মধ্যাকর্ষীয় প্রভাবের অধীনে গোলাকার রূপ নিয়ে তরলের ন্যায় আচরণ করবে। উদাহরণস্বরূপ, ধরে নেওয়া যাক সবচেয়ে শক্ত একটি হীরার ঘনক আকৃতি তৈরি করলাম এবং এটিকে আলাদা একটি স্থানে রেখে দিলাম। তারপর ১০^৬৫ বছরে বা এরকম সময়ে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে মহাকর্ষীয় বলের অধীনে এটি গোলাকার আকৃতি ধারণ করবে।
নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় তেজস্ক্রিয়তা একটি পরিচিত বিষয়। তেজস্ক্রিয়তার একটি সাধারণ উদাহরণ : যেমন একটি ভারী কেন্দ্রীণ থেকে আলফা কণার নির্গমন। স্মরণ করা যাক, ‘আলফা কণা’ হচ্ছে একটি হিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রীণ। এই কেন্দ্রীণে থাকে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন। যখন একটি ভারী কেন্দ্রীণ যেমন থোরিয়াম বা রেডিয়াম c ́ থেকে আলফা কণা নির্গত হয় তখন তেজস্ক্রিয় ক্ষয় সাধিত হয়। রেডিয়াম c ́ হচ্ছে রেডিয়াম উপাদানের একটি আইসোটোপ। আইসোটোপ হল একই মৌলিক পদার্থ বা উপাদানের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু। আইসোটোপের পরমাণুতে মূল উপাদানের পরমাণুর মতই ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা একই, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন। একটি উপাদানের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং এর আইসোটোপগুলো একই যেহেতু এগুলো পরমাণুর ইলেকট্রন সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত। এই ভারী কেন্দ্রীণগুলোর (থোরিয়াম, রেডিয়াম c 7 ) গড় জীবনকাল রয়েছে যাদের অর্ধেক আলফা কণা ত্যাগ করে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অতি হালকা কেন্দ্রীণে পরিণত হয়। থোরিয়ামের গড় জীবনকাল ২×১০^১০ বছর এবং রেডিয়াম c ́ এর গড় জীবনকাল ১০^-৩ সেকেন্ড। এই তেজস্ক্রিয় ক্ষয় চিরায়ত পদার্থবিদ্যা মেনে নেয় না। কারণ একটি নির্দিষ্ট বল দ্বারা আলফা কণা কেন্দ্রীণের সঙ্গে যুক্ত থাকে। চিরায়ত পদার্থবিদ্যার নীতি অনুসারে শক্তির প্রতিবন্ধকতার কারণে কণাটি বন্ধন মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু আলফা কণাটি প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করে আকর্ষণ বল থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় একটি ভারী কেন্দ্রীণের ভাঙ্গন ঘটে এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ফিশন’। ১০.২ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য। এবার মনে হয় যেন কণাটি একটি কূপে অবস্থান করছে যাকে ১০.২ নম্বর চিত্রে ‘পটেনশিয়াল কূপ’ বলে উল্লেখ করা হল। কেন্দ্র থেকে যে কোনও দূরত্বে কণাটির ওপর শক্তি প্রয়োগ হয় যা Q কূপের ঢাল রেখায় দেখানো হল। ধরা যাক কণাটির শক্তি E। চিত্রের পটেনশিয়াল কূপের ‘কুজ’ অতিক্রম করার মত শক্তি কণাটির নেই। ফলে কণাটি কেন্দ্রীণ হতে মুক্ত হতে পারে না। এই বিষয়টি চিরায়ত পদার্থবিদ্যার নীতি অনুসরণ করে। কিন্তু কণাটির শক্তিস্তরে এই বাধাটির ভেদ যদি সীমিত হয়, তবে কোয়ান্টাম বিদ্যা অনুসারে, আলফা কণাটি সুড়ঙ্গ তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে অপরদিকে বেরিয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অমীমাংসেয়।
চিত্র-১০.২: এটি একটি শক্তি নকশা যেটি এখানে একটি আলফা কণার ওপর তার মূল কেন্দ্রীণের প্রযুক্ত বলকে দেখাচ্ছে। অল্প দূরত্বে অর্থাৎ ১০^-১৩ সেন্টিমিটারের কম দূরত্বে আলফা কণা কেন্দ্রীণের আকর্ষণ অনুভব করে। আর কণাটি বেশি দূরত্বের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীণের অন্য প্রোটনদের জন্য তড়িৎবলের বিকর্ষণ অনুভব করে। এক্ষেত্রে আলফা কণার পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি না থাকলেও বাধা বরাবর সুড়ঙ্গ তৈরি করে ‘কুঁজে’র অপর পাশে বেরিয়ে যেতে পারে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সুড়ঙ্গকরণ’ পদ্ধতি।
এখানে আরেকটি পারমাণবিক বিক্রিয়া রয়েছে যার নাম ‘ফিউশন’। এই ফিউশন বিক্রিয়া সম্বন্ধে অধ্যায় ৬-এ উল্লেখ করা হয়েছিল। এই বিক্রিয়ায় দুই বা ততোধিক কেন্দ্রীণ একত্রে যুক্ত হয়ে একটি ভারী কেন্দ্রীণ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু গঠন করে। এ সময় প্রচুর তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছু কেন্দ্রীণ কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতিতে পরস্পরের খুব নিকটে চলে আসে। সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতিতে এমনটি ঘটতে অতি দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। মূলত অতি দীর্ঘ সময়ের মাপকাঠিতে মহাবিশ্বের যে কোনও সাধারণ বস্তু তেজস্ক্রিয়তায় রূপ নেবে। কারণ কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গকরণ প্রক্রিয়ায় বস্তুর ফিশন বা ফিউশন বিক্রিয়া সৃষ্টি হবে যা থেকে বস্তুশক্তি বিমুক্ত করবে। অতি দূর ভবিষ্যতে বা প্রায় ১০^১০০ বছর শেষে মহাবিশ্বে নিউট্রন নক্ষত্র ব্যতীত সমস্ত বস্তু লোহায় পরিণত হবে। আর লোহার কেন্দ্রীণ সবচেয়ে বেশি সুস্থিত। এই প্রক্রিয়াসম্পন্ন হওয়ার জন্য সময়ের মাপকাঠি জি. গ্যামাউ-এর সূত্রানুসারে হিসাব করা যেতে পারে। বস্তু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে লোহায় পরিণত হতে সময় লাগবে প্রায় ১০^৫০০ বছর থেকে ১০^১৫০০ বছর। এই সময় সীমায় একটি সাধারণ বস্তু তেজস্ক্রিয়তায় রূপ নেয় এবং এটি প্রতিনিয়ত শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। সুতরাং, এই সময় শেষে হীরার ঘনক একটি গোলাকার লোহায় পরিণত হবে।
অবশেষে শ্বেতবামন ও নিউট্রন নক্ষত্রের সঙ্গে কি ঘটবে? বাহিরের কোনও মাধ্যম যদি শ্বেতবামনকে চাপ প্রয়োগ করে, তবে এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নিউটন- নক্ষত্রে পরিণত হবে। একটি সুপার নোভা বিস্ফোরণে কার্যতই কি ঘটে? সেখানে এর অবশিষ্টাংশ একটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয়। বাহিরের স্তরের বিস্ফোরণের জন্য সুপার নোভার কেন্দ্রস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে এই কেন্দ্রস্থল সাময়িকভাবে শ্বেতবামন পর্যায়ে পৌঁছায়। ইলেকট্রনগুলো তখন পরমাণু থেকে অবমুক্ত হয়। সংকোচন চলতে থাকলে ইলেকট্রনগুলো প্রোটনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিউট্রন সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীণ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় নিউট্রন নক্ষত্র। কিন্তু মহাবিশ্বের সুদূর ভবিষ্যৎ বিবেচনা করা যাক, যাতে শ্বেত বামনেরা মহাশূন্যে একা একা বিচরণ করছে। দূর ভবিষ্যতে শ্বেতবামনকে সংকুচিত করার জন্য তাদের কাছাকাছি শূন্যতায় কোনও শক্তি বা মাধ্যম থাকবে না।
যাই হোক, শ্বেতবামনের রূপান্তরের একটি রূপরেখা দেখানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে শ্বেতবামন কোয়ান্টাম বিদ্যার সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারে। শ্বেতবামন একটি প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিম্নগামী হয়ে নিউট্রন নক্ষত্রের পর্যায়ে পৌঁছবে। এই পর্যায়টি গোটা নক্ষত্রটির একটি নিম্ন শক্তির পর্যায়। শ্বেতবামন সুড়ঙ্গকরণ প্রভাবে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারবে যদিও বাহিরের কোনও মাধ্যম এখানে কাজ করবে না। এই অবস্থা পরিবর্তনের রূপরেখা ১০.৩ নম্বর চিত্রে দেখানো হল। একটি শ্বেতবামন এই পদ্ধতি নিউট্রন নক্ষত্রে পৌঁছতে যে সময় লাগবে তা প্রকৃতপক্ষে অতি দীর্ঘ। এই সময়ের পরিসর জি. গ্যামাউ-এর সূত্রানুসারে পরিমাপ করা যেতে পারে। এই সময়ের মাপকাঠি অন্যান্য প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই অধ্যায়ের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির এফ. জে. ডাইসন এ প্রক্রিয়ার সময়ের পরিসর হিসাব করেছেন। একটি শ্বেতবামন প্রায় ১০^১০^৭৬ বছরে সুড়ঙ্গকরণ প্রক্রিয়ায় নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হবে।
চিত্র-১০.৩ : চিত্রটি পটেনশিয়াল (বিভব) প্রতিবন্ধকতার পরিকল্পিত রূপরেখা। শ্বেতবামন থেকে নিউট্রন নক্ষত্রের মাঝখানে এবং নিউট্রন নক্ষত্র ও ব্ল্যাকহোল পর্যায়ের মাঝখানে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সুড়ঙ্গকরণ প্রভাবে একটি শ্বেতবামন নিউট্রন নক্ষত্রের পর্যায়ে এবং নিউট্রন নক্ষত্র বাধা অতিক্রম করে ব্ল্যাকহোলের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।
একটি নিউট্রন নক্ষত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বের অনুচ্ছেদটির পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে। যদি একটি নিউট্রন নক্ষত্র বাহির থেকে সংকুচিত হয়, তবে এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এটি এমনই প্রক্রিয়া যাতে তিন সূর্যভরেরও কম ভরের ব্ল্যাকহোল সুপার নোভা বিস্ফোরণে সৃষ্টি হতে পারে। আবার সুড়ঙ্গকরণ পদ্ধতিতেও এটি হতে পারে। এক্ষেত্রে সময়সীমা হবে শ্বেতবামন থেকে নিউট্রন নক্ষত্র সৃষ্টি হওয়ার সময়ের সমান। সুতরাং শেষ পর্যন্ত সকল শ্বেতবামন ও নিউট্রন নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। অবশেষে ব্ল্যাকহোলেরা হকিং প্রক্রিয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বইটির পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ব্ল্যাকহোলের গঠন নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এদের ভর ছিল সূর্যভর তুল্য বা তারও অধিকতর বেশি যেমন গ্যালাটিক ও সুপার গ্যালাটিক ব্ল্যাকহোল। কিন্তু তত্ত্ব বলে সূর্যভরের চেয়ে কম ভরসম্পন্ন ব্ল্যাকহোলও সৃষ্টি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, পৃথিবীর ভরের ব্যাসার্ধ শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে ১ সেন্টিমিটার। সুতরাং পৃথিবীকে যদি এই ১ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের কম ব্যাসার্ধে সংকুচিত করা যেত, তাহলে এটি তার নিজ মধ্যাকর্ষীয় বলের অধীনে ক্ষয় হতে হতে ছোটো একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হত। বৃহৎ ব্ল্যাকহোল (প্রায় দশ, সূর্য ভরের সমান) ছাড়া ছোটো ব্ল্যাকহোল কেবল মধ্যাকর্ষীয় বল দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে। পৃথিবী ভরের সমান বা তারও কম ভরের ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে যদি পৃথিবী বা অন্য কোনও নক্ষত্রকে কৃত্রিম উপায়ে বা অন্য কোনও প্রক্রিয়ায় অতিশয় পিষ্ট করা যায়। জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্যার এমন কোনও প্রক্রিয়া বর্তমান বিশ্বে জানা নেই। তাছাড়া আমাদের এমন কোনও প্রযুক্তি নেই যা দ্বারা কৃত্রিমভাবে এরকম ছোটো একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি করা যায়। স্টিফেন ডব্লিউ হকিং-এর প্রস্তাব অনুযায়ী মহাবিশ্বে আদি অবস্থায় ঘনত্ব বিক্ষোভ দ্বারা ছোটো ছোটো ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হওয়ার কথা। মহাবিশ্বের আদি অবস্থায় তার ঘনত্ব ওঠানামা করত অর্থাৎ স্থানে স্থানে ঘনত্বের চরম ভিন্নতা ছিল। বিকিরণ এবং বস্তুর অদম্য ও প্রচণ্ড গতির কারণে ঘনত্বের এই তারতম্য সৃষ্টি হত। ফলে কিছু ক্ষুদ্র অঞ্চলের ঘনত্ব বেড়ে যেত, যাতে অতি ক্ষুদ্র অঞ্চলে অনেক ভর জমা হত। আর এই অঞ্চলটি যদি শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের কম হয় যাতে ঘনীভূত আছে তাহলে এই ভর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার কথা। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্ল্যাকহোল বর্তমান মহাবিশ্বে আছে কিনা তাও আমাদের জানা নেই। হয়ত মহাবিশ্বের আদি অবস্থায় ১০১৫ গ্রাম ভরের বা তারও কিছু কম ভরের ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হয়ে হকিং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে এরা বিলুপ্ত। কিন্তু ছোটো ব্ল্যাকহোলসহ সূর্যভরের কম ভর সম্পন্ন ব্ল্যাকহোল এখনও থাকাটা যুক্তিসংগত যখন বস্তুর দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের প্রশ্ন আসে। নিউট্রন নক্ষত্র যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে, তেমনই সুড়ঙ্গকরণ প্রভাবে উচ্চ প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যে কোনও বস্তুখণ্ড ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে (যদি বস্তু খণ্ড ভরের ব্ল্যাকহোল সম্ভব হয়)। যদি কোনও বাহ্যিক শক্তি বস্তু খণ্ডকে সংকুচিত করে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের মধ্যে নিয়ে আসে তাহলে বস্তুটি কার্যতই বিভব বাধা অতিক্রম করবে এবং ব্ল্যাকহোলের রূপরেখায় পর্যবসিত হবে। কিন্তু এমনটি ঘটতে বাহিরের কোনও আলাদা শক্তির প্রয়োজন নেই। আর বস্তু ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়ে এবং হকিং প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উধাও হয়ে যাবে।
বিজ্ঞানী ডাইসনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বস্তুর সুদীর্ঘ স্থায়িত্ব বিবেচনা করা যাক। যদি ছোটো ব্ল্যাকহোল সম্ভব হয় তবে শ্বেতবামন ও নিউট্রন নক্ষত্রগুলো ১০^১০^৭৬ বছরের পূর্বেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের সর্বনিম্ন সম্ভাব্য ভরের ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে জানা নেই। তাই এই বিশ্লেষণে কিছু অনিশ্চয়তা থেকে যায়। ‘MB’ সর্বনিম্ন ভরের একটি ব্ল্যাকহোল বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক, MB ভরের চেয়ে কম ভরের কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাকহোল মূলনীতি অনুসারে অসম্ভব এক্ষেত্রে তাহলে নিচের অণুকল্পগুলো দেখা যাক :
(1) MB = O। এক্ষেত্রে সকল বস্তুই অস্থায়ী। তুলনামূলকভাবে এদের জীবনকাল কম। চতুর্দশ অধ্যায়ে একটি সাধারণ বস্তুর অতি অল্প জীবন সীমার পরীক্ষামূলক আলোচনা লক্ষ করুন।
(2) MB = ২x১০^-৫ গ্রাম। এই ভরকে প্লাঙ্ক ভর বলা হয়। এই পরিমাণ ভর হকিং তত্ত্বে প্রস্তাবিত। তত্ত্বানুযায়ী প্রত্যেক ব্ল্যাকহোল প্লাঙ্ক ভরে পৌঁছানো পর্যন্ত তার ভর হারাতে থাকে। অবশেষে এই অবস্থায় ব্ল্যাকহোলে বিকিরণের চূড়ান্ত বিস্ফোরণে নিঃশেষ হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে প্লাঙ্ক ভরের চেয়ে বেশি ভরের সকল বস্তুর জীবনকাল হচ্ছে ১০ বছর। পক্ষান্তরে প্লাঙ্ক ভরের চেয় ক্ষুদ্রতর খন্ডগুলো পুরোপুরিভাবে স্থায়ী।
(3) MB = ৩×১০^১৪ গ্রাম। এই পরিমাণ ভরকে বলা হয় কোয়ান্টাম ভর, কারণ এটি সবচেয়ে ছোটো ব্ল্যাকহোলের ভর। আর এ জন্য কিছু ক্ষেত্রে চিরায়ত ব্যাখ্যা সম্ভব। এই ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম ভরের চেয়ে বেশি ভরের বস্তুর জীবনকাল ১০^১০^৫২ বছর এবং কোয়ান্টাম ভরের ক্ষুদ্রতর ভরগুলো পুরোপুরিভাবে স্থায়ী।
(8) MB = ২.৮×১০^৩৩ গ্রাম। এই ভরকে বলা হয় চন্দ্রশেখর ভর কারণ এই ভর শ্বেতবামনের সর্বোচ্চ ভর। এক্ষেত্রে চন্দ্রশেখর ভরের চেয়ে বেশি ভরের জীবনকাল ১০^১০^২৬ বছর যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছিল।
এই বিকল্পগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে সব বস্তুর ভর ‘MB’ ভরের চেয়ে বেশি তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে বস্তু কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গকরণ প্রভাব কাজে লাগাবে তবে বাহ্যিক কোনও বলের প্রয়োজন নেই। অবশেষে হকিং প্রক্রিয়ায় ব্ল্যাকহোলগুলো নিঃশেষ হবে। সব ধরনের বস্তুর এবং মহাবিশ্বের সুদীর্ঘ ভবিষ্যৎ নির্ভর করে এই বিকল্পগুলোর মধ্যে যেটি সঠিক তার ওপর। বিজ্ঞানী ডাইসন বিকল্প-২ কে সমর্থন করেছেন।
এই বিশ্লেষণে যতদূর আমরা অনুমান করেছি যে, স্থায়ী মৌলিক কণাগুলো – যেমন—ইলেকট্রন ও প্রোটন বাস্তবিকই সম্পূর্ণরূপে স্থায়ী। এই কণাগুলোর স্থায়িত্বের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ যা চতুর্দশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মহাবিশ্ব মুক্ত হলে এটি চূড়ান্তভাবে কী আকৃতি লাভ করবে বা এর চূড়ান্ত পরিণতি কী? উপরের আলোচনায় এটি পরিষ্কার যে, এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর বস্তুর দীর্ঘ স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করে। প্রোটন কণা যদি অস্থায়ী হয় তবে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কী দাঁড়াবে তা নিয়ে চতুর্দশ অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব। বর্তমান ক্ষেত্রে একটি ব্ল্যাকহোলের সর্বনিম্ন ভর ধরা যাক ২×১০^-৫ গ্রাম যা প্লাঙ্কের ভরের সমান। ১০^১০^১৬ বছরে প্লাঙ্ক ভরের চেয়ে বেশি ভরের সব ধরনের বস্তু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিকিরণে পরিণত হবে। আর এই বিকিরণ বিচ্ছুরিত হয়ে মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশে যাবে। বস্তুর মোট ঘনত্ব এবং বিকিরণ শূন্যতে পৌঁছবে কিন্তু কখনই পুরোপুরি শূন্য হবে না। বস্তুর ঘনত্ব শূন্যতে পৌঁছলে অবশেষে এর ঘনত্ব বিকিরণ ঘনত্বের থেকে বেশি হবে। পটভূমি বিকিরণ পরমশূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছবে কিন্তু কখনই তা অতিক্রম হবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে সকল ভৌত প্রক্রিয়া কি অবশেষে থেমে যাবে? যেহেতু পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে, শূন্যস্থান প্রকৃতপক্ষে শূন্য নয় বরং শূন্যস্থানের বিক্ষোভ সম্পৰ্কীয় একটা টগবগে ভার বিরাজমান। সুতরাং মহাবিশ্বের সুদূর ভবিষ্যতে সমস্ত মহাকাশীয় প্রক্রিয়া থেমে গেলেও মনে হবে যেন ওই শূন্যতায় সর্বদাই আণুবীক্ষণিক বস্তু বিদ্যমান।
মুক্ত মহাবিশ্বের বা বদ্ধ মহাবিশ্বের চূড়ান্ত অবস্থাগুলোর বিবেচনায় সময়ের ধারণা কিছুটা বদলে যায় যেমনটি আমরা দ্বাদশ অধ্যায়ে দেখব। যদি মহাকাশীয় সমস্ত প্রক্রিয়া থেমে যায়, সময় তখন কীরূপে নিজেকে প্রকাশ করবে? কীরূপে অতিবাহিত হবে সময়? ‘শূন্যস্থানের বিক্ষোভ’ সময় লিপিবদ্ধকরণের জন্য একটি ঘড়ি সরবরাহ করতে পারে কি না তাও সন্দেহজনক। সময় কি স্বয়ং থেমে যাবে? এই প্রশ্ন কি অর্থপূর্ণ? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই জটিল। আমি মনে করি একটি উপায় থাকবে আর তা হল মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব। এই বিকিরণের ঘনত্ব ও তাপমাত্রা দ্বারা সময় অতিবাহন স্বয়ং প্রতিভাত হবে। এই মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ সব সময়ে কমতে থাকবে, শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছবে কিন্তু কখনই শূন্য হবে না।