অধ্যায় ১০ : দর্শনের সান্ত্বনা – বোয়েথিয়াস
কোনো কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের জন্যে প্রতীক্ষারত বন্দী অবস্থায় আপনি যদি থাকেন, আপনি কি দর্শনের কোনো বই লেখার জন্য জীবনের শেষ দিনগুলো ব্যয় করবেন? বোয়েথিয়াস সেই কাজটি করেছিলেন, এবং তাঁর লেখা সব সৃষ্টির মধ্যে সেটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। বোয়েথিয়াসের আসল নাম ছিল আনসিয়াস মানলিয়াস সেভেরিনাস বোয়েথিয়াস (৪৭৫-৫২৫ খ্রিস্টাব্দ), তিনি ছিলেন শেষ রোমান দার্শনিকদের একজন। জার্মানিক বারবারিয়ান গোত্রগুলোর হাতে রোমসাম্রাজ্যের পতন হবার মাত্র বিশবছর আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই রোমের সেই অতীতের মহিমান্বিত রূপ আর গৌরবের কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। রোম তখন পতনের দিকে ধাবিত। রোমান দার্শনিক সিসেরো এবং সেনেকার মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন দর্শন একধরনের থেরাপি বা মনোচিকিৎসার মতো, যা আত্মসহায়তায় ভূমিকা রাখতে পারে। এটি যেমন একটি প্রায়োগিক উপায়, যার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানো যেতে পারে, তেমনি এটি বিমূর্ত ভাবনা চর্চা করারও একটি ক্ষেত্র। এছাড়াও বোয়েথিয়াস তাঁর লেখায় সেই সংযোগটিও নিশ্চিত করেছিলেন, যার মাধ্যমে আমরা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের কাজ সম্বন্ধে জানতে পারি। তিনি ল্যাটিন ভাষায় তাঁদের কাজ অনুবাদ করেছিলেন, এভাবে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁদের কর্মকে, যখন চিরকালের জন্য তাঁদের কাজ হারিয়ে যাবার ঝুঁকি ছিল সুস্পষ্ট। একজন আন্তরিক খ্রিস্টধর্মানুসারী হিসাবে, মধ্যযুগে যারা তাঁর বইগুলো পড়েছিলেন, তাঁর লেখা গভীরভাবে প্রতি-আবেদন রেখেছিল বহু ধার্মিক দার্শনিকদের কাছে। তাঁর দর্শন, সে-কারণে গ্রিক ও রোমান দার্শনিকদের দর্শনের মধ্যে যেভাবে সেতুবন্ধন রচনা করেছিল, একই সাথে সেটি সম্প্রসারিত হয়েছিল ভবিষ্যতের খ্রিস্টীয় দার্শনিকদের দর্শনের সাথে যা তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিমে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল বহু শতাব্দী।
বোয়েথিয়াসের জীবন ছিল সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের একটি মিশ্রণ। গথদের রাজা থিওডরিক, সেই সময়ে যিনি রোমের ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁকে কনসালের মতো উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি বোয়েথিয়াসের ছেলেদেরকেও সম্মানসূচক কনসাল হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, এমনকি যখন নিজেদের যোগ্যতায় সেই দায়িত্ব পালন করার মতো তাদের বয়সই হয়নি। মোটামুটি বোয়েথিয়াসের জীবন চলছিল বেশ ভালোভাবেই। তিনি ধনী ছিলেন, পারিবারিক পরিচয়ও ছিল, এবং তাঁকে প্রশংসা করার মানুষও কম ছিল না। সরকারি কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি দর্শন চর্চা করার মতো বেশ সময় বের করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং তিনি প্রচুর লিখেছেন এবং অনুবাদও করেছিলেন। সত্যিকারের সুসময়ও ছিল তাঁর। কিন্তু এর কিছুদিন পর তাঁর ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছিল। রাজা থিওডরিককে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার ঘোলাটে অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। রোম থেকে তাঁকে রাভেনায় প্রেরণ করা হয় কারাগারের বন্দি হিসাবে। সেখানেই তাঁকে নির্যাতন করা হয় ও পরে শ্বাসরুদ্ধ করে আর পিটিয়ে হত্যা করার মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। শত নির্যাতনেও তিনি নিরপরাধ এই দাবি থেকে কখনোই সরে আসেননি, তবে স্পষ্টতই তাঁর অভিযোগকারীরা তাঁকে বিশ্বাস করেনি।
কারাগারে বন্দি থাকাকালীন, যখন তিনি নিশ্চিত যে খুব শীঘ্রই তার মৃত্যু হবে, বোয়েথিয়াস একটি বই লিখেছিলেন, তার মৃত্যুর পর যা মধ্যযুগের অন্যতম জনপ্রিয় বইয়ে পরিণত হয়েছিল The Consolation of Philosophyবইটির শুরুতেই আমরা বিষণ্ণ হতাশ আত্মগ্লানিতে আক্রান্ত বোয়েথিয়াসকে দেখতে পাই। হঠাৎ করে তিনি অনুধাবন করেন যে, একজন নারী উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার উচ্চতা যেন মনে হয় পরিবর্তিত হচ্ছিল গড়পড়তা উচ্চতা থেকে আকাশের চেয়ে বেশি উচ্চতায়। তার পরনে ছিল প্রায় ছিন্ন একটি কাপড় যেখানে সেলাই করা একটি মইয়ের ছবি যা কাপড়ের প্রান্তে গ্রিক অক্ষর ‘পাই’ থেকে উপরের দিকে যা বিস্তৃত ছিল আরেকটি গ্রিক অক্ষর ‘থিটা’ অবধি। তার একহাতে ছিল একটি রাজদণ্ড, অন্যহাতে একটি বই। বোয়েথিয়াস বুঝতে পেরেছিলেন যে এই নারীটি আসলে দর্শনের প্রতিরূপ। তিনি কথা বলতে শুরু করেন প্রথমেই বোয়েথিয়াসকে পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে, বিশেষ করে আসলেই তার কী বিশ্বাস করা উচিত সে-বিষয়ে। তার (দর্শনের) কথা ভুলে যাবার জন্য তিনি বোয়েথিয়াসের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন, এবং সেকারণে তিনি এসেছেন তাকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে, তার সাথে যা ঘটছে সে-বিষয়ে কীভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। বইটির বাকি অংশ মূলত তার ও নারীরূপী দর্শনের কথোপকথন, যেখানে বিষয় হিসাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে ভাগ্য এবং ঈশ্বর। খানিকটা গদ্য এবং খানিকটা পদ্য হিসাবে এটি লেখা হয়েছিল।
সেই নারীরূপী দর্শনের দেয়া উপদেশগুলোই মূলত ছিল তাঁর বইটির প্রাণ।তিনি বোয়েথিয়াসকে স্মরণ করিয়ে দেন যে ভাগ্য সবসময়ই পরিবর্তনশীল, এবং এই পরিবর্তনে তার বিস্মিত হওয়া উচিত না। এটাই ভাগ্যের চরিত্র, ভাগ্য অস্থির আর পরিবর্তনশীল। ভাগ্যের চাকা আবর্তিত হয়। কখনো আমরা উপরে, কখনো আমরা নিচে। সম্পদশালী কোনো রাজাও একদিনে পথের ভিখারিতে রূপান্তরিত হতে পারেন। বোয়েথিয়াসের অনুধাবন করা উচিত এই বাস্তবতাটি। ভাগ্য কোনো নিয়ম মেনে চলে না। আজ ভাগ্যবান বলে কেউ কালও ভাগ্যবান থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মরণশীল মানুষরা, দর্শন বোয়েথিয়াসকে বলেছেন, নির্বোধ, কারণতারা তাদের সুখকে পরিবর্তনশীল কোনোকিছুর উপর নির্ভরশীল হবার সুযোগ করে দেয়। সত্যিকারের সুখ আসে শুধুমাত্র ভিতর থেকে, সেইসব জিনিস থেকে যা মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এমন কোনোকিছু থেকে না যা কোনো খারাপ ভাগ্য অনায়াসে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমরা দেখেছি এটি স্টয়িক দর্শনেরও মূল ভাবনাগুলোর অংশ। আজ যখন খারাপ কিছু ঘটলে মানুষ তাদের নিজেদের ফিলোসফিকাল বলে ব্যাখ্যা করে, তারা আসলে এটাই বোঝাতে চান। তারা চেষ্টা করেন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের কোনোকিছু দ্বারা প্রভাবিত না হবার জন্য, যেমন আবহাওয়া, অথবা তাদের বাবা-মা কে ছিলেন। দৰ্শন বোয়েথিয়াস বলেছিলেন যে, কোনোকিছু নিজে থেকে অসহনীয় খারাপ নয়; সেটি নির্ভর করে সেটি সম্বন্ধে আপনি কীভাবে ভাবছেন তার উপরেই। সুখ হচ্ছে মনের একটি অবস্থা; বাইরের পৃথিবীর কোনো পরিস্থিতি নয়। এই ধারণাটি এপিকটিটাস শুনলে তার নিজের বলেই চিহ্নিত করতে পারতেন।
দর্শন চেয়েছিলেন বোয়েথিয়াস আরো একবার তার কাছে ফিরে আসুক। তিনি তাকে বলেন, তিনি সত্যিকারভাবে সুখী হতে পারবেন, এমনকি যখন তিনি মৃত্যুর জন্য কারাগারে অপেক্ষা করছেন। তার সব হতাশা আর দূঃখের নিরাময় করবেন তিনি। বার্তাটি হলো, সম্পদ, ক্ষমতা এবং সম্মান সবকিছুই অর্থহীন, কারণ তারা ক্ষণস্থায়ী। এত ভঙ্গুর কোনো ভিত্তির উপর কিছু নির্মাণ করা কারোরই উচিত না। সুখকে আসতে হবে আরো বেশি স্থায়ী কোনো উৎস থেকে, যা কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা, যেমন বোয়েথিয়াস বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে থাকবেন, তুচ্ছ পার্থিব কোনো কিছুর মধ্যে সুখ অনুসন্ধান করা ভুল হবে। কারণ সবকিছু তিনি এমনিতেই হারাবেন মৃত্যুর কাছে। কিন্তু সত্যিকারের সুখ বোয়েথিয়াস কোথায় পাবেন খুঁজে? দর্শনের উত্তর হচ্ছে যে তিনি সেটি খুঁজে পাবেন ঈশ্বরে অথবা ভালোত্বে (দেখা যায় দুটো আসলে একই জিনিস)। বোয়েথিয়াস আদি খ্রিস্টানদের একজন কিন্তু এই বিষয়টি তিনি ‘দ্য কনসোলেশন অব ফিলোসফি’ বইতে উল্লেখ করেননি। দর্শন যে ঈশ্বরের কথা তাকে বলেছিল সেটি প্লেটোর ঈশ্বরও হতে পারে, ভালোত্বের বিশুদ্ধ রূপ। কিন্তু পরবর্তী সময়ের পাঠকরা সম্মান আর সম্পদের মূল্যহীনতা ও ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য মনোযোগ নিবদ্ধ করার সেই খ্রিস্টীয় শিক্ষাকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।
পুরো বইজুড়ে নারীরূপী দর্শন বোয়েথিয়াস আগেই যা জানতেন সেই সবকিছুই আবার তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আবারো এটা সেই ধারণারই অংশ যা এসেছে প্লেটো থেকে, কারণ প্লেটো বিশ্বাস করতেন, সব জ্ঞানই আসলে আমাদের ইতিমধ্যে জানা আছে এমন ধারণাগুলোরই এধরনের স্মৃতিচারণ। আমরা আসলেই নতুন কিছুই শিখি না, শুধুমাত্র আমাদের পুরোনো স্মৃতিগুলোকে নতুন করে ঝালিয়ে নিই। জীবন হচ্ছে এই মনে করারই সংগ্রাম, যা-কিছু আমাদের আগে থেকেই জানা। বোয়েথিয়াস যা আগে থেকেই জানতেন একটি স্ত রে, সেটি হলো তিনি তার স্বাধীনতাহীনতা এবং সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করেছেন। এইসব কিছুর অনেকটাই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে, এই পরিস্থিতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটাই তিনি বাছাই করতে পারবেন, এবং শুধুমাত্র সেটাই তার নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু বোয়েথিয়াস একটি সত্যিকারের সমস্যা নিয়ে বেশ ভাবনায় ছিলেন, যে-সমস্যাটি বহু ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষকেও চিন্তায় রেখেছিল। ঈশ্বর, সবধরনের ত্রুটিহীন হবার কারণে, অবশ্যই সবকিছু জানেন, যা ঘটে গেছে, ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে। যখন আমরা ঈশ্বরকে বিশেষায়িত করি ‘সর্বজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহার করে, তখন এর অর্থ কিন্তু সেটাই বোঝায়। সুতরাং যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকে, তিনি অবশ্যই জানেন এর পরের ফুটবল কিংবা ক্রিকেট বিশ্বকাপ কে জয় করবে এবং আমি এর পরের বাক্যে কী লিখব, সেটাও তিনি জানেন। ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সবকিছুই তার জানা থাকবে আগে থেকেই। অর্থাৎ তিনি আগে থেকেই যা জানবেন সেটা অবশ্যই ঘটবে। সুতরাং এই মুহূর্তে ঈশ্বর জানেন সবকিছু কী ঘটতে যাচ্ছে।
একারণেই বলতে পারি, আমি পরবর্তীতে কী করতে যাচ্ছি, এমনকি যখন আমি নিজে নিশ্চিত নই কী আমি করতে পারি, কী হতে পারে সেটি ঈশ্বর অবশ্যই জানেন। যখন আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি কী করব, বেশকিছু সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আর পরিণতি আমার সামনে তখন উন্মুক্ত। আমি যদি দুইদিকে ভাগ হয়ে যাওয়া কোনো রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াই, আমি জানি আমি বাঁয়ে কিংবা ডানে যেতে পারি, অথবা কোথাও না, আমি সেখানেই বসে থাকতে পারি। আমি হয়তো এই মুহূর্তে লেখা বন্ধ করে দিতে পারি এবং এক কাপ চা বানানোর জন্য উঠতে পারি। অথবা, এই ল্যাপটপে আমি যেমন টাইপ করে যাচ্ছিলাম সেটাই অব্যাহত রাখতে পারি। এটা অনুভূত হতে পারে একান্ত আমার নিজের সিদ্ধান্ত হিসাবে, এমন কিছু যে আমি নিজেই নির্বাচন করছি করা কিংবা না-করার জন্যে। কেউ আমাকে বাধ্য করছে না কোনো একটি পথ বেছে নেবার জন্য। একইভাবে আপনি আপনার চোখ বন্ধ করতে পারেন যদি সেটা চান। তাহলে কোন্ সময় ঈশ্বর জানতে পারেন আমরা আসলে কী করব? যদি ঈশ্বর আগেই জেনে থাকেন আমরা কী করতে যাচ্ছি, কীভাবে তাহলে আমরা দাবি করতে পারি, আমরা আসলেই সেই কাজ করার জন্যে স্বাধীনভাবে ইচ্ছা পোষণ করেছি? তাহলে কোনোকিছু বাছাই করার ক্ষমতাটি বা ইচ্ছাশক্তিটি কি একটি বিভ্রম? মনে হতে পারে, আমাদের কোনো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকতে পারে না যদি আগেই ঈশ্বর সবকিছু জেনে থাকেন। ধরুন দশ মিনিট আগেই ঈশ্বর একটুকরো কাগজের উপর লিখতে পারেন, ‘মাহবুব তার লেখা অব্যাহত রাখবে’, এটা সেই সময়ে যেমন সত্যি এবং পরে আমিও আবশ্যিকভাবেই আমার লেখা চালিয়ে যাব, যদিও সেই সময় আমি সেটা অনুধাবন করতে পারি কিংবা না-পারি। কিন্তু যদি ঈশ্বর সেটি করতে পারেন তাহলে নিশ্চয়ই আমি কী করব সেটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই আমার, এমনকি যদিও আমার মনে হতে পারে আমি সেই কাজটি করলাম। আমার জীবনের প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় ইতিমধ্যেই পরিকল্পিত ও নির্ধারিত হয়ে আছে। এবং যদি আমরা কী করব সেটি বাছাই করার কোনো অধিকার বা ক্ষমতা না থাকে, তাহলে আমাদের কাজের জন্য শাস্তি কিংবা পুরস্কার দেয়া কতটুকু ন্যায়বিচারের পরিচায়ক হতে পারে? আমাদের নিজেদের যদি আমরা কী করববা করব না সেটা বাছাই করার অধিকার বা ক্ষমতা না থেকে থাকে, তাহলে কীভাবে ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেবেন আমরা স্বর্গে যাব কি যাব না? জটিল এই সমস্যাটি আমাদের মনে অনেক সংশয় সৃষ্টি করে। দার্শনিকরা এইসব পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন প্যারাডক্স। বিষয়টি আদৌ সম্ভব মনে হয় না যে, কেউ আগে থেকেই জানতে পারে আমি কী করতে যাচ্ছি এবং আমি কী করতে যাচ্ছি সেই বিষয়ে আমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করছি। এই দুটি ধারণা পরস্পরবিরোধী। তারপরও এটি সম্ভব হতে পারে যদি আপনি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর সবকিছু জানেন।
কিন্তু বোয়েথিয়াসের কারাকক্ষে আবির্ভূত হয় নারীরূপী দর্শনের কাছে এই বিষয়ে কিছু উত্তর ছিল। আমাদের ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে, তিনি বোয়েথিয়াসকে বলেছিলেন, এবং যা অবশ্যই বিভ্রম নয়। যদিও ঈশ্বর জানেন আমরা কী করতে যাচ্ছি, আমাদের জীবন পূর্বনির্দিষ্ট নয়। অথবা অন্যভাবে যদি বলা হয়, আমরা কী করতে যাচ্ছি সেই বিষয়ে ঈশ্বরের জ্ঞান দৈবনির্দিষ্ট বা পূর্বনির্দিষ্ট থেকে ভিন্ন (সেই ধারণাটি যে আমরা কী করব বা করব না সেই বিষয়ে আমাদের কোনোকিছু বাছাই করার ক্ষমতা নেই); তারপরও আমরা পরবর্তীতে কী করব সেটি নির্বাচন করার একটি সুযোগ থাকে আমাদের। ভুল হচ্ছে ঈশ্বরকে এমনভাবে ভাবা যে তিনি একজন মানুষ, যে কিনা সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি কাজের পরিণতি দেখতে পাচ্ছেন। দর্শন বোয়েথিয়াসকে বলেছিলেন যে, ঈশ্বরের অবস্থান সময়ের সীমানার বাইরে, পুরোপুরি যিনি সময় থেকে বিচ্ছিন্ন। এর অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর একমুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু অনুধাবন করতে পারেন। ঈশ্বর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবকিছু একটি দৃশ্যপটেই দেখতে পান। আমরা মরণশীল মানুষরা শুধু একটা ঘটনার পর কী ঘটছে সেটাই দেখতে পারি। এ কারণে ঈশ্বর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানেন আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে ধ্বংস করে বা আমাদের আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা কোনো মেশিনে পরিণত না করেই, যাদের কিনা কিছু বাছাই করার ক্ষমতা নেই এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের সীমানায় ঈশ্বর আমাদের দেখছেন না, তিনি একই সাথে সবকিছুই দেখতে পারছেন এধরনের সময়ের সীমামুক্ত কোনো উপায়ে। এবং দর্শন বোয়েথিয়াসকে জানান, ঈশ্বর মানুষকে বিচার করেন তারা কীভাবে আচরণ করে, কী ধরনের সিদ্ধান্ত তারা নেয়, এমনকি যখন তার আগে থেকেই জানা থাকে মানুষ কী করবে। যদি দৰ্শন সঠিক হয়ে থাকে এই বিষয়ে এবং ঈশ্বরের যদি অস্তিত্ব থাকে, তিনি খুব ভালো করেই জানেন কখন আমি এই বাক্যটি শেষ করব; কিন্তু তারপরও এটা আমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, এখানেই দাঁড়ি চিহ্ন দিয়ে আমি বাক্যটি শেষ করছি। আর, এরই মধ্যে আপনারা, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন পরবর্তী অধ্যায় পড়বেন কি পড়বেন না সেই বিষয়ে, যে অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে প্রদত্ত দুটি যুক্তি।