অধ্যায় ১০ : উপসংহার

অধ্যায় ১০ – উপসংহার

আলীবর্দীর ১৬ বছরের শাসন সুবাহ বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেটা এতটাও গৌরবের বা শান্তিপূর্ণ ছিল না, যেটা গোলাম হোসেন বা করম আলীর বর্ণনা আমাদের বিশ্বাস করতে বলে, তবে অষ্টাদশ শতকের অন্যান্য সময়ের চেয়ে এটা উজ্জ্বল একটি সময় ছিল তা বলা চলে নির্দ্বিধায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমরা এসময়টাকে দেখি অবক্ষয়ের সূচনাপর্ব হিসেবে, যা পরে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়। আলীবর্দীর ভাগ্যে বিশ্বাসঘাতকতা ও জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া, দুর্বল দিল্লি সম্রাটের স্বীকৃত ক্ষমতা শান্তিপূর্ণভাবে উপভোগ করা লেখা ছিল না। ভারতের অন্যান্য অংশে বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়ানো শক্তিগুলো বাংলায় তাদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল, আর শান্তিপূর্ণভাবে এখানে শাসনের সমস্ত সুযোগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। মারাঠা আক্রমণ আর আফগান বিদ্রোহ, আলীবর্দীর প্রশাসনের বড় অংশের জন্য চরম মাত্রার দ্বিধা আর বিপর্যয় তৈরি করেছিল। এটা অবশ্যই বলতে হবে যে আলীবর্দীর কৃতিত্ব ছিল এটাকে দূরদর্শিতার সঙ্গে বিবেচনায় কুশলী হয়ে ক্ষমতার ব্যবহার করে এই অশুভ শক্তিগুলোর সঙ্গে লড়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন, আর অংশত সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু বিশৃঙ্খলার স্রোত কোনোভাবেই প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছিল না। আলীবর্দীর জীবনের শেষদিকে তা গর্জনরত ঢেউয়ে পরিণত হয়; আর ইউরোপীয় বণিকেরা (ইংরেজ, ফরাসি আর দিনেমার) বাংলার রাজনীতিতে নাক গলানোর ধৃষ্ঠতা দেখাতে শুরু করে, যা কিছু বছর ধরেই তারা দক্ষিণ ভারতে করে আসছিল। এর কিছুদিন পরেই বাংলা ভারতীয় উপদ্বীপের মতোই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দেখে, যা প্রবলভাবে তার ইতিহাসের গতিপথকে প্রভাবিত করে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ধারণা দেয় সেখানকার শান্তি-শৃঙ্খলার। আলীবর্দীর শাসনামলে বাংলার আপাত সমৃদ্ধি হলেও, সেসময়কার রাজনৈতিক গোলযোগ বাংলার অর্থনৈতিক জীবনীশক্তি নাশ করে ফেলেছিল। বাণিজ্য বিভিন্ন কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল, শিল্প-কারখানা কমে আসছিল, উৎপাদন কমে আসছিল, আর কৃষিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল, খাদ্যদ্রব্যের ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে গিয়েছিল। এককথায় বলা যেতে পারে বাংলার ইতিহাসে প্রাক্- পলাশী সময়কাল অর্থনৈতিক পতনের গল্প রেখে গিয়েছিল পরবর্তীকালের জন্য।

সেসময়ের ক্ষয়ে যেতে থাকা রাজনৈতিক পরিবেশ তার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব রেখে গিয়েছিল সমাজ ও সাহিত্যেও। সমাজে ও শিক্ষার বলয়ে, আমরা খুব কমই প্রচলিত বৈশিষ্ট্যগুলোর দেখা পাই, কিন্তু মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরণের কোনো সুচিন্তিত ও সৎ উদ্যোগের দেখা মেলে না। বাংলার ইতিহাসের এমন জটিল পর্যায়ে, মানুষকে ধর্মীয় বা সামাজিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে কোনো বুদ্ধ, চণ্ডীদাস বা চৈতন্যের আবির্ভাব হয়নি। শুধু বাংলা কেন, গোটা ভারতেই কাউকে দেখা যায়নি। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, ঢাকার রাজবল্লভসহ প্রদেশের অন্য নেতারা তাদের নিজেদের মতো করে সাহিত্য ও শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন যদিও, কিন্তু সেটা বড় বেশি আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক কূটচালে পূর্ণ, নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে রক্ষার প্রয়োজনে, আর খুব বিস্তৃত দৃশ্যপটে মনুষ্যত্বের সৎ দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়। এই পৃষ্ঠপোষকতায় যে সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল তা ছিল দূষিত চরিত্রের, যদিও শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে সেগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন,  রচনাশৈলী ও নীতি দুটোই বিকৃত রুচির হয়ে পড়েছিল – প্রথমটি উদ্ধত পণ্ডিতি করে; বর্ণনায় উদ্ভট হয়ে দাঁড়ায় অতিরিক্ত ভালো-মানুষির চিত্রায়ণে, যা রীতিমতো হাস্যকর আর পরেরটা উইচার্লির স্টার্ন বা স্মলেটের চেয়েও দুর্বচনীয়, অশ্লীলতায় স্থূল-অমার্জিত আর হীরা মালিনী ও বিদু ব্রাহ্মণীর মতো চরিত্রের অবৈধ প্রেমের অন্তর্ভুক্তি সবচেয়ে বিবর্তনকারী ছিল।

শুধু তাই নয়, এই সময়কাল ইতিহাসের অনুরাগীদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। এটা দেখায় যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও, অপরাধ থেকে অপরাধেরই জন্ম হয়, আর বলপূর্বক ও বিশ্বাসঘাতকতায় পাওয়া ক্ষমতা দখলদার, ভাগ্যান্বেষী বা তার পরিবারের জন্য কখনোই শান্তি ও সুখের উৎস হতে পারে না – আলীবর্দীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখান থেকে এই দৃষ্টান্তও সামনে আসে যে, বাংলার মতো বিভিন্নভাবে বিচ্ছিন্ন দেশে সব গোত্রের সহযোগিতা নিশ্চিত করা একজন জ্ঞানী ও কুশলী শাসকের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। আমরা দেখতে পাই আলীবর্দী তার সরকার গঠন করেছিলেন হিন্দু ও মুসলিম কর্মঠ কর্মকর্তাদের আন্তরিক সহযোগিতায়, যদিও এর তলেই হিন্দু বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি স্রোত প্রবাহিত হয়ে চলেছিল। প্রকৃতপক্ষে সিরাজ-উদ-দৌলা বড় ভুল করে ফেলেছিলেন নীতিগতভাবে, হিন্দু কর্মকর্তা, জমিদার ও পুঁজিরক্ষকদের তার সহানুভূতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে। হিন্দু সহযোগিতা ছিল আলীবর্দীর শক্তিমত্তার উৎস, আর সেটার অনুপস্থিতি তার উত্তরাধিকারীর জন্য ভয়াবহ রকমের ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *