অধ্যায় ৮: জুলাই – নভেম্বর
সীমান্ত অতিক্রমের পর থেকে জুন অবধি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনৈক্য ও উপদলীয় কলহ সামান্যই প্রশমিত হয়েছে। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে হতাশা আর ক্ষোভ। ইতিমধ্যে নতুন সরকারকে সংগঠিত করার জন্য প্রশাসনিক, যুব প্রশিক্ষণ ও আঞ্চলিক কমিটি গঠনের যে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার ফল সঞ্চারে তখনও বাকী। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র ও যুবকদের প্রথম দলকে স্বদেশে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সম্প্রসারিত করার স্বার্থে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহত্তর শক্তি সমাবেশের জন্য ভারত সরকার এবং সোভিয়েট প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে আমাদের কথাবার্তা সবে শুরু হয়েছে এবং এসবের ফলাফল তখনও অজ্ঞাত। এই সমুদয় বিষয়ে কিছু অগ্রগতি সাধিত হবার পর, বিশেষত দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পুনরুজ্জীবিত করার পর, দলীয় শৃঙ্খলা বিধানের কাজে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের উদ্বুদ্ধ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হত।
কিন্তু তার পূর্বেই ২০শে জুন কোলকাতায় ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব অশোক রায় যথাশীঘ্র বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেও বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করেন এবং আপত্তি না হলে ২৯শে জুন নাগাদ মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এই অধিবেশনের আয়োজন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। ভারত সরকারের কোন বিশেষ অংশের আগ্রহে বা কোন নির্দিষ্ট বিবেচনা থেকে এই জরুরী অধিবেশন তলবের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে ভারতের ক্ষমতাসীনদের দক্ষিণপন্থী অংশ যে তাজউদ্দিন সম্পর্কে উষ্ণভাব পোষণ করতেন না, তার আভাস ইতিমধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। এ সম্পর্কে কোন জল্পনা-কল্পনা নিরর্থক জেনে এবং যদি কারো সংশয় দেখা দিয়ে থাকে তা নিরসনের জন্য তাজউদ্দিন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেও বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন। সময়ের স্বল্পতা ও যোগাযোগের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে এই অধিবেশন ৫ই ও ৬ই জুলাই শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠানের কথা স্থির হয়। দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার উদ্দেশ্যে গৃহীত ব্যবস্থাদির ফলোভের আগেই নানা কারণে সন্দিহান, বিভক্ত ও বিক্ষুব্ধ প্রতিনিধিদের সম্মুখীন হওয়া তাজউদ্দিন তথা মন্ত্রিসভার জন্য খুব সহজ ছিল না।
তার প্রমাণও পাওয়া গেল শিলিগুড়িতে নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং দলীয় নেতৃবৃন্দ সমবেত হওয়ার পর। পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত প্রায় তিন শত প্রতিনিধির এই সমাবেশে (অবশিষ্ট ১৫০ জনের মত নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল পাকিস্তানিদের হেফাজতেই) অভিযোগ ও অপপ্রচারের স্রোতই ছিল অধিক প্রবল। প্রবাসী সরকারের সম্পদ ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতাই এদের অনেক অভিযোগের উৎস। আবার সরকারী ব্যবস্থাপনার কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও নিঃসন্দেহে ছিল সমালোচনার যোগ্য। কিন্তু এইসব অভাব-অভিযোগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতিকে অবলম্বন করে কয়েকটি গ্রুপ উপদলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মন্ত্রিসভার ব্যর্থতা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর অপসারণের দাবীতে ছিল নিরতিশয় ব্যস্ত।
আওয়ামী লীগের ভিতরে একটি গ্রুপের পক্ষ থেকে তাজউদ্দিনের যোগ্যতা এবং তার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা নিয়ে নানা বিরুদ্ধ প্রচারণা চলতে থাকে। কর্নেল ওসমানীর বিরুদ্ধেও এই মর্মে প্রচারণা চলতে থাকে যে, মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনায় তার অক্ষমতার জন্যই মুক্তিসংগ্রাম দিনের পর দিন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল, মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারে তাদের মৌলিক অনীহার কারণেই খুব নগণ্য পরিমাণ অস্ত্র তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন তারা নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত তাদের সমর্থন লাভ করবে কিনা, তাও সন্দেহজনক। এই সব প্রচার অভিযানে ভারতের উদ্দেশ্য ও তাজউদ্দিনের যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির ব্যাপারে তৎপর ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ। মন্ত্রিসভার বাইরে মিজান চৌধুরীও প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় একই সন্দেহ প্রকাশ করে দলীয় সম্পাদকের পদ থেকে তাজউদ্দিনের ইস্তফা দাবী করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের এক নৈরাশ্যজনক চিত্র উপস্হিত করে বলেন এর চাইতে বরং দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ অথবা আপোস করা ভালো। কিন্তু এর কোন একটি চিন্তা বাস্তবে কার্যকর করার কোন উপায় তার জানা আছে কিনা এমন কোন আভাস তার বক্তৃতায় ছিল না।
এই সব অভিযোগ, সমালোচনা, অনাস্থা, অপপ্রচার ও নৈরাশ্য সৃষ্টির প্রয়াসের পরেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিচল থাকেন। বিভিন্ন প্রচারণার জবাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন, ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর জন্য যে সব ব্যবস্হা গৃহীত হয়েছে তার ফল সঞ্চারের জন্য ৩/৪ মাস সময় প্রয়োজন, এর জন্য অধৈর্য হয়ে পড়লে চলবে না। তাজউদ্দিন ঘোষণা করেন, বিজয়ের জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম ও অশেষ ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন, তা সকল প্রতিনিধির পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে, ফলে যোগ্যতার নেতৃত্বের উদ্ভব সেখানে ঘটবেই; তিনি নিজেও যদি সক্ষম না হন, তবে যোগ্যতর ব্যক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে; কিন্তু বিজয় বাংলাদেশের অনিবার্য। তুমুল করতালিতে তাজউদ্দিন অভিনন্দিত হন। পরদিন ৬ই জুলাই আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সভায় সংগঠনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। হির হয় সাবেক নিখিল পাকিস্তান কার্যকরী কমিটি নয়, বরং সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিকেই অতঃপর দলের বৈধ নেতৃত্ব হিসাবে গণ্য করা হবে। বিভ্রান্তি ও অনৈক্য সৃষ্টির নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং মন্ত্রিসভার পক্ষে সর্বসম্মত আহা জ্ঞাপনই ছিল শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত পরিষদ সদস্যদের সম্মেলনের প্রধান অবদান। অন্য কোন বিষয়ে শিলিগুড়ি সম্মেলন যে বিশেষ কোন অবদান রেখেছিল-কি মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পথ-নির্দেশের ক্ষেত্রে, কি দেশের অভ্যন্তরে কোন সাংগঠনিক কর্মসূচী গ্রহণ করার ক্ষেত্রে-এ কথা বলা কঠিন।
সপ্তাহকালের মধ্যেই কোলকাতায় প্রবাসী সরকারের সদর দফতর ৮ থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের যে বৈঠক শুরু হয় (১০-১৫ই জুলাই), তারও ফলাফল বহুলাংশে ইতিবাচক, যদিও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের তুলনায় তা ছিল অসম্পূর্ণ। মার্চ-এপ্রিলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং বিশেষ করে রাইফেলস (ইপিআর)-এর বিদ্রোহী সেনাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ হলেও পরবর্তী মাসগুলিতে এদের তুলনামূলক নিষ্ক্রিয়তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য তাদের এই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ ছিল একাধিক।
তাজউদ্দিনের ১১ই এপ্রিলের বক্তৃতায় বিভিন্ন সীমান্তবর্তী রণাঙ্গনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট হওয়ার পর ১৯শে মে বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্রবাহিনীর সমন্বয়ের মাধ্যমে সেগুলি অংশত পুনর্গঠন করা হয়। কিন্তু এই সকল সেক্টরকে সবল করে তোলার মত সমরাস্ত্র ও সম্পদ পর্যাপ্তভাবে সরবরাহ করা যেমন সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তেমনি গৃহীত হয়নি কোন নির্দিষ্ট সমর পরিকল্পনা এবং কার্যকর কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে এই সব সেক্টরকে সংগঠিত ও সক্রিয় করার পদক্ষেপ। জুন মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সীমান্তকে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের পক্ষে সুগম করার জন্য এবং অংশত বাংলাদেশ বিদ্রোহকে বহির্বিশ্বের কাছে। জীবিত রাখার জন্য পাকিস্তানী বিওপি ধ্বংসের মত সীমিত সংঘাত শুরু করে, তখন তারা স্থানীয় ভিত্তিতে কোন কোন বাংলাদেশ সেক্টর বাহিনীর সহযোগিতা নেয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমান্ডের কোন সুস্পষ্ট ভূমিকা না থাকায়, ভারতীয় কমান্ডারদের দেওয়া দায়িত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশ সেক্টর ইউনিটের বিভিন্ন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ছিল। সম্ভবত এই সময় থেকেই একটি বিদ্রোহী বাহিনীর জটিল মানসিকতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে ভারতের অফিসারদের অক্ষমতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। তা ছাড়া ভারতে আসা মাত্রই এখানে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া যাবে, এমন আশা নিয়েই বিদ্রোহী বাহিনী পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে ভারতে প্রবেশ করে। কিন্তু পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ যে ভারতের জন্য একটি জটিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং পূর্বোল্লিখিত এত সব আন্তর্জাতিক বিচার বিবেচনার উপর নির্ভরশীল, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের মত অধিকাংশ সেক্টর অধিনায়কদের উপলব্ধির বাইরে ছিল। কাজেই আলোচ্য তিন মাসে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের নগণ্য সরবরাহ এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি জ্ঞাপনে ভারতের গড়িমসিদৃষ্টে সেক্টর ইউনিটগুলির পক্ষে মনোবল বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সব কারণে দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থানরত অধিকাংশ সেক্টর বাহিনী হতোদ্যম ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে জুলাইয়ে সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধের অধোগতি রোধ এবং কমান্ড ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে এক ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সেক্টর অধিনায়কদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং তাদের সমবায়ে ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের এই উদ্যোগের পিছনে মেজর জিয়াউর রহমান মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রধান সেনাপতি ওসমানীকে দেশরক্ষা মন্ত্রী পদে উন্নীত করে সাতজন তরুণ অধিনায়কের সমবায়ে গঠিতব্য এক কাউন্সিলের হাতে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণই ছিল আলোচ্য প্রস্তাবের সার কথা। কিন্তু প্রস্তাবের মূলমর্ম ওসমানীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থাব্যঞ্জক হওয়ায় কর্নেল ওসমানী ১০ই জুলাই সম্মেলনের প্রথম দিনেই প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। সেক্টর অধিনায়কদের মধ্যে খালেদ মোশাররফ উত্থাপিত যুদ্ধ কাউন্সিল’ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাজউদ্দিনের চেষ্টায় ওসমানীর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হতে কেটে যায় একদিনেরও বেশী সময়। সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনের এই অপ্রীতিকর সূচনা সত্ত্বেও তারপর কয়েকদিনের আলোচনায় বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা পুনঃনির্ধারণ, মুক্তিবাহিনীর শ্রেণীকরণ ও দায়িত্ব অর্পণ, সশস্ত্র তৎপরতার লক্ষ্য ও পরিসীমা নির্ধারণ, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি নির্মাণ, প্রতিপক্ষের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশের অভ্যন্তরে অনিয়মিত যুদ্ধে (irregular war) নিযুক্ত ছাত্র ও তরুণদের বাহিনীর নামকরণ হয় ‘গণবাহিনী’, যদিও মুক্তিযোদ্ধা’ (Freedom Fighter of FF) নামেই তারা অধিক পরিচিতি লাভ করে। দেশের সীমান্ত এলাকায় সমুখ অথবা গোপন আক্রমণে শত্রুসেনাকে ঘায়েল করার জন্য ‘ইবিআর’, ‘ইপিআর’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে আনসার, পুলিশ ও নতুন রিক্রটের সমবায়ে গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনী’, ‘মুক্তিফৌজ বা MF নামেই যার অধিক পরিচিতি ঘটে। এই নিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় কিছু ‘মুক্তাঞ্চল’(lodgement area) গঠনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে নিয়মিত বাহিনীকে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সেক্টর কমান্ডারদের সপ্তাহব্যাপী বৈঠকের পর দেখা যায়, সংগঠন ও আক্রমণ ধারার ব্যাপারে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও দু’টি অত্যন্ত মূল বিষয়ে তথা, কেন্দ্রীয় কমান্ড গঠন এবং পূর্ণাঙ্গ রণনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথোচিত দৃষ্টি না দেওয়ায় উভয় বিষয়েই মারাত্মক দুর্বলতা রয়ে গেছে। প্রায় চৌদ্দশ’ মাইল সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত এবং কোন কোন অংশে দুর্গম এই রণাঙ্গনকে স্বল্প সম্পদ ও সীমিত সহায়তার উপর নির্ভর করে কোলকাতা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যে কোন কমান্ডের পক্ষেই সাধ্যাতীত ছিল। বিশেষত সেক্টরগুলির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কোন উপায় না থাকায় কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে সেক্টর নিয়ন্ত্রণের চিন্তা ছিল অবাস্তব। সেক্টরের পক্ষেও ঊর্ধ্বতন কমান্ডের সময়োপযোগী নির্দেশের বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সুযোগের অভাবে নিজেদের বুদ্ধিবিবেচনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সম্ভবত কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে দুই বা তিনটি আঞ্চলিক কমান্ড স্থাপন করে এবং আঞ্চলিক কমান্ডের হাতে সেক্টর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্পণ করে কমান্ড ব্যবহার মৌলিক দুর্বলতা বহুলাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হত।
কিন্তু ওসমানীর পদত্যাগ প্রচেষ্টার পর এহেন নাজুক বিষয় তাঁর কাছে উত্থাপন করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে। সেই পর্যায়ে ওসমানীর সম্ভাব্য পদত্যাগের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বিবেচনা করেই আঞ্চলিক কমান্ড গঠনের প্রশ্নটি স্থগিত থাকে। কেন্দ্রীয় কমান্ড ও সেক্টর অধিনায়কদের মধ্যে বিশাল দূরত্ব পূরণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাহিনীর নিজস্ব টেলিযোগাযোগ বা অন্য কোন উপায় না থাকায় প্রাত্যহিক যোগাযোগের জন্য তাদের পক্ষে ভারতীয় সিগনালের উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এর ফলে বাংলাদেশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও একান্ত নিজস্ব বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমান্ড ও সেক্টরের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ ছিল অনেকটা সঙ্কুচিত। তা ছাড়া প্রধান সেনাপতির নিজস্ব কর্মর্তালিকায় বিভিন্ন সেক্টরে নিয়মিত পরিদর্শন বিশেষ কোন অগ্রাধিকার পেত না। কমান্ড ব্যবহার এই সব অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতার ফলে সেক্টর অধিনায়কদের অনেকেই এক ধরনের স্বাধীন ক্ষমতার উৎস হিসাবে বিরাজ করতে থাকেন। ক্রমে এই স্বাধীন ক্ষমতা কোন কোন অধিনায়কের মধ্যে আত্মপরিপোষণের অভিপ্রায় ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে উদ্দীপ্ত করে।
কমান্ড গঠনে এই দুর্বলতা অপেক্ষাও আরও বড় দুর্বলতা ধরা পড়ে বাংলাদেশের নিজস্ব রণনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে। পাকিস্তানী হামলা শুরু হবার সাড়ে তিন মাস পর জুলাইয়ে সেক্টর অধিনায়কদের এই প্রথম সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেও দেখা গেল, সংগঠন ও আক্রমণ ধারার ব্যাপারে কয়েকটি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিকই, কিন্তু দখলদার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করার মত কোন রণনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নির্দিষ্ট সময়সূচী নির্ধারণ করা হয়নি। সম্মেলন নিয়মিত বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘আক্রমণ ধারার নির্দেশ’ (Operations instruction), তৎপরতার কৌশল ও লক্ষ্য প্রভৃতি বিষয়ে কিছু সাধারণ আলোকপাত করতে সক্ষম হলেও তাকে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সামগ্রিক বিজয় লাভের উপযোগী পরিকল্পনা হিসাবে গণ্য করা যায় না।
রীতিগত (Conventional) যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে বিজয়োপযোগী রণনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অসুবিধা ছিল দখলদার পাকিস্তানী সৈন্যের তুলনায় বাংলাদেশের সেনাদলের সংখ্যা, সমরাস্ত্রের মান, সামরিক অবকাঠামো ও সাংগঠনিক দৈন্যতা। পক্ষান্তরে গেরিলা যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে রণনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রধান অসুবিধা ছিল, দেশের ভিতরে রাজনৈতিক অবকাঠামোর অভাব তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও নিয়ন্ত্রণের উপযোগী ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক সংগঠনের অনুপস্থিতি। তা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে গেরিলা যুদ্ধে দখলদার সৈন্যদের কেবলমাত্র পরিশ্রান্ত ও দুর্বলই করা সম্ভব; তাই গেরিলা যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায়ে পরিশ্রান্ত শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করার জন্য প্রয়োজন পড়ে বিরাট ও একত্রীভূত বাহিনীর চূড়ান্ত আঘাত-যেমন চীনের ছিল 4th Route Army অথবা দক্ষিণ ভিয়েতনামে ভিয়েত-কং গেরিলা তৎপরতার সর্বশেষ পর্যায়ে ছিল উত্তর ভিয়েতনামের নিয়মিত বাহিনীর সাহায্য।
প্রত্যেক জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নিজস্ব কতকগুলি বৈশিষ্ট্য এবং কিছু সমস্যা থাকে। এগুলির বাস্তব সদ্ব্যবহার ও সমাধানের উপরেই নির্ভর করে সেই বিশেষ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য ও ব্যর্থতা। রীতিগত ও গেরিলা-এই উভয়বিধ লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের উপরোল্লিখিত সীমাবদ্ধতার দরুন এবং অন্যদিকে তাদের আপকালীন আশ্রয়দাতা ভারতের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল যাবত শরণার্থীসৃষ্ট দুঃসহ চাপ মেনে চলার অক্ষমতা ও অসম্মতির ফলে বাংলাদেশকে মুক্ত করার একমাত্র বাস্তব উপায় ছিল: দেশের অভ্যন্তরে অনিয়মিত যুদ্ধে এবং সীমান্ত বরাবর ছোট ও মাঝারি সংঘর্ষে পাকিস্তানী সেনাদের যুদ্ধ-পরিশ্রান্ত করে তোলার পর ভারতীয় বিমান, নৌ ও হল বাহিনীর সহযোগিতায় চূড়ান্ত আঘাতের ব্যবস্থা করা। মে, জুন ও জুলাই মাসে তাজউদ্দিনের সঙ্গে এবং তাজউদ্দিনের পক্ষে বিভিন্ন বৈদেশিক মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাবার কালে আমার মনে কখনও এমন সংশয় দেখা দেয়নি যে তাজউদ্দিন এই রণনীতির বিকল্প অন্য কিছু সম্ভব বলে মনে করতেন। বস্তুত ভারত যাতে অপ্রতিহতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে পারে এবং চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্তরে, ভারতের সামরিক শক্তি যাতে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়, সেই উদ্দেশ্যেই আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে ভারতের অনুকূলে আনা আলোচ্য সময়ে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ও করণীয় হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহুলাংশেই ভিন্ন। মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং এবং বিশেষত নিয়মিত বাহিনীর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ও অস্ত্রসজ্জার জন্য ভারত সরকারের উপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে তিনি ছিলেন নিরলস। জুলাই মাসে তিনটি ব্যাটালিয়ানের সমবায়ে একটি ব্রিগেড গঠন এবং সেপ্টেম্বরে তিনটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যাটালিয়ান গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সম্পদ ও সহায়তা লাভের জন্য বাংলাদেশ মন্ত্রিসভাকে তিনি তৎপর রাখেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভারতীয় সহায়তার পরিধি সম্পর্কে দ্বিধান্বিত মনোভাব ওসমানীর রণনৈতিক পরিকল্পনা সংক্রান্ত চিন্তাকে অস্বচ্ছ ও অসম্পূর্ণ করে রাখে। মে মাসে মন্ত্রিসভার সঙ্গে তিনি যখন দিল্লীতে আলাপ-আলোচনার জন্য যান, তখন সম্ভবত এই উপলব্ধিতে তিনি পৌঁছান যে, বাংলাদেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সম্ভাবনা অনুপস্থিত অথবা খুবই অনিশ্চিত। যদিও মে মাস থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং এর জন্য ভারতীয় সহায়তা কিছু কিছু শুরু হয়, তবু জুন-জুলাইয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসংগ্রামীদের মুক্তিযুদ্ধে নিয়োগের (Induction) ঘটনায় ওসমানী চিন্তিত বোধ করতে শুরু করেন। তা ছাড়া আলোচ্য সময়ে, ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের দুই নেতা লে. জেনারেল অরোরা এবং মেজর জেনারেল জ্যেকবের সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর যোগাযোগ বাহ্যত সৌজন্যমূলক হলেও তা যে সব সময় সহজ ও পারস্পরিক আস্থাবর্ধনে সহায়ক হত, একথা বলার উপায় নেই। পরিস্থিতি বিশেষণে দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা এবং সমস্যা সমাধানে সাধারণ মতপার্থক্য ছাড়াও অপর পক্ষের প্রচ্ছন্ন পদমর্যাদা-সচেতন আচরণ ওসমানীর জন্য সম্ভবত পীড়াদায়ক হত। যতদূর জানা যায়, ভারতীয় বিএসএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ জাতীয় কোন সমস্যা তার কখনো ঘটেনি। কিন্তু মে মাস থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিএসএফ-এর ভূমিকা দ্রুত হ্রাস পতে শুরু করে।
এই সব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা আত্মমর্যাদা-সচেতন ওসমানীকে কতখানি প্রভাবিত করে বলা কঠিন, তবে তার সমর পরিকল্পনা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে কেবলমাত্র দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গেরিলা যুদ্ধ এবং সীমান্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর সাহায্যে ‘মুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যকে অবলম্বন করে। কিন্তু নিয়মিত বাহিনী যেখানেই মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করুক, বিমান প্রতিরক্ষা, ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বাহিনীর অভাবে তার সুরক্ষা দুঃসাধ্য ছিল। অবশ্য অক্টোবরের শুরুতে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা ওসমানী নিজেই বাতিল করে দিয়ে নিয়মিত বাহিনীর এক উল্লেখযোগ্য অংশকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা কৌশলে লড়াই করার জন্য নিয়োগ করতে শুরু করেন। এই গোপন তৎপরতা দেশের ভিতরে দখলদার বাহিনীকে যতই নাজেহাল করুক, কেবলমাত্র এই পন্থায়, বিশেষত রাজনৈতিক অবকাঠামো এবং সুসংগঠিত নেতৃত্ব-কাঠামোর অভাবে, দখলদার বাহিনীকে বৎসরকালের মধ্যে সম্পূর্ণ উৎখাতের চিন্তা ছিল অবাস্তবধর্মী। বাংলাদেশের সামরিক শক্তির এই মৌলিক অক্ষমতার ফলে দেশকে। শত্রুমুক্ত করার বিঘোষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে যে শূন্যতা (gap) বিরাজমান ছিল, তা পূরণ করার জন্য ভারতীয় সামরিক সহায়তাকে কোন নির্দিষ্ট রূপে, মাত্রায় ও সময়ে গ্রহণ করা দরকার তা সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের।
রণনৈতিক পরিকল্পনায় এই মৌলিক অসম্পূর্ণতা ও অস্পষ্টতা ছাড়াও সীমান্তবর্তী নিয়মিত বাহিনী যখন অনেক কারণেই নিষ্ক্রিয়, সেই সময় অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসে, ভারত সরকার ক্রমশ এই উপলব্ধিতে পৌঁছান যে, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সেনাদের সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর জন্য কোন বাস্তব উপায় নেই। কিন্তু মূলত নিজের প্রয়োজনেই তারা যখন বাংলাদেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে প্রায় সম্মত, তখন সেই সুযোগ সদ্ব্যবহারের জন্য কোন পরিকল্পনা বা উদ্যোগ বাংলাদেশ সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে গৃহীত হয় নাই।
জুলাই থেকেই ভারতের ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতৃত্ব যখন সীমান্ত সংঘর্ষে (মূলত গোলন্দাজ আক্রমণে পাকিস্তানী বিওপি’র ধ্বংস সাধন অথবা মুক্তিফৌজ কর্তৃক বিওপি দখলে) ফল লাভের জন্য তাদের সীমান্তবর্তী বাহিনী, Formation Command-এর উপর চাপ বৃদ্ধি করতে শুরু করে, তখন ভারতীয় ফরমেশন কমান্ডারগণ বাংলাদেশ সেক্টর ইউনিটগুলিকেও সক্রিয় করার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়েন। কার্যক্ষেত্রে এই ব্যগ্রতা সর্বদা ফলদায়ক হয়নি। বরং সেক্টরের করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমান্ডের কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকায় স্বল্প অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেক্টর বাহিনী, বিশেষত তাদের অধিনায়কদের কারো কারো মনে এ আশঙ্কার সৃষ্টি হয় যে, সম্ভবত তারা ‘কামানের খোরাক হিসাবে ব্যবহৃত হতে চলছে। পক্ষান্তরে, ভারতীয় সৈন্যের অধিনায়কদের মধ্যে ক্রমশ এই ধারণা গড়ে উঠতে থাকে যে, বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনী নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধিতেই অধিক আগ্রহী, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থায় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভারত যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে জড়িত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে প্রবল বলে গণ্য করে, তখন বাংলাদেশের ভিতরে সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক হারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ করার উপর সকল গুরুত্ব আরোপ করলেও নিয়মিত বাহিনীর সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে তারা নিরাশ হয়ে পড়ে। ফলে ক্রমবর্ধমান সীমান্ত লড়াই ও চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য মুখ্যত নিজেদের শক্তি ও সম্পদই ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের পরিবর্তনমান সমর পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল সামরিক পরিকল্পনা ও পরিচালনা বাংলাদেশ কমান্ডের হাত থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে শুরু করে।
অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও ভিন্নতর প্রত্যাশা অবাস্তব ছিল। যদিও ২৫শে মার্চে পাকিস্তানী আক্রমণের জবাবে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সংগ্রাম স্বতঃস্ফুর্ত গণযুদ্ধের ব্যাপকতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তবু সেই সংগ্রামকে পরিচালনার মত না ছিল সেখানে কোন সুশঙ্খল বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন, না ছিল মাও, টিটো বা গিয়াপের মত কোন বিপ্লবী রাজনৈতিক-সামরিক প্রতিভার উপস্থিতি। অন্যদিকে ভারতের ক্ষমতাশীল ধনিক গোষ্ঠী ও দক্ষিণপন্থীমহল অনন্যোপায় হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করায় সম্মত হলেও, তারা এই সংগ্রামের বৈপ্লবিক সম্ভাবনার বিরুদ্ধে ছিল সজাগ ও সচেষ্ট। এই অবস্থায় তবুও চলে, তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বামপন্থী (এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র) অংশ উদ্ভূত বৈপ্লবিক পরিস্থিতি এবং তার ভূরাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক পরিমাণে সক্ষম হন। বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের উদ্যোগ ও আচরণে এ জাতীয় রাজনৈতিক উপলব্ধির কোন নিদর্শন পাওয়া দুষ্কর ছিল। বরং বলতে হয়, নিয়মিত বাহিনীর অধিকাংশ সেক্টর কমান্ডার পেশাদার বাহিনীর মাঝারি ও কনিষ্ঠ অফিসারসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা নিয়ে এক বিদ্রোহজনিত পরিস্থিতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন অথবা পরে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। এদের সংগঠনের ধরনধারণ, যুদ্ধের কলাকৌশল, মনস্তাত্বিক গঠন-প্রায় সবই ছিল রীতিগত যুদ্ধের (Conventional war) উপযোগী। কাজেই এত স্বল্প সময়ের মধ্যে রীতিবহির্ভূত যুদ্ধ (Unconventional war) পরিচালনার মত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কলাকৌশল আয়ত্ত করা যেমন এদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তেমনি রীতিগত যুদ্ধে এদের চাইতে কয়েকগুণ বেশী শক্তিশালী, কয়েকগুণ বেশী সমরাস্ত্র সজ্জিত এবং কয়েকগুণ বেশী সুনিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এদের কাছ থেকে চূড়ান্ত সাফল্য প্রত্যাশা করাও সংগত হত না।
তদুপরি ছিল এদের অজস্র সমস্যা। কমান্ড, যোগাযোগ ও সরবরাহের পূর্বোল্লিখিত সমস্যাবলী বাদেও অফিসারের স্বল্পতাজনিত সমস্যা ছিল খুবই তীব্র। বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ, দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ এবং তাদের সাথে নূ্যনতম যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজন তাদের সমস্যার কলেবর বৃদ্ধি করে। এর পরেও তাদের উপর দায়িত্ব পড়ে নিয়মিত বাহিনীর আয়তন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করার। জুলাই মাসে মেঘালয়ের তুরা অঞ্চলে ১-ইবি, ৩-ইবি এবং ৮-ইবি-এই তিন ব্যাটালিয়ানের সমবায়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত করা হয়, তার মূল পরিকল্পনা ছিল কর্নেল ওসমানীর। শুরুতে সব কটি ব্যাটালিয়ানের লোকবল ছিল কম। ত্রিপুরা রাজ্যে দুটি পৃথক সেক্টরের একটিতে মেজর শফিউল্লাহ ছিলেন ২-ইবির দায়িত্বে এবং খালেদ মোশাররফ ৪-ইবির দায়িত্বে। এই তিনজনের কারোরই একক দায়িত্বে ব্যাটালিয়ান পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এই পাঁচটি ব্যাটালিয়ানের প্রতিটিরই সৈন্য সংখ্যা প্রয়োজনীয় লোকবলের (৯১৫ জন) তুলনায় ছিল অনেক কম, কোন কোন ক্ষেত্রে এক তৃতীয়াংশেরও কম। ফলে পুরাতন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে ইপিআর আনসার এবং কিছু নতুন রিক্রুট যোগ করে এই ব্যাটালিয়ানগুলির সৈন্যবল বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
লোকবল ছাড়াও এই পাঁচটির সব কটি ব্যাটালিয়ানেই অফিসারের স্বল্পতা ছিল প্রকট সমস্যা। একটি ব্যাটালিয়ান পরিচালনার জন্য যেখানে ১৫/১৬ জন অফিসার প্রয়োজন সেখানে বাস্তবক্ষেত্রে অফিসার ছিলেন অর্ধেকেরও কম। এই অফিসার-ঘাটতি পূরণের জন্য জুলাই মাস থেকে তিন মাস দীর্ঘ এক সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন ৬০ জন অফিসার তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতি ঘটে সামান্যই। কেননা ‘তুরা ব্রিগেড’ গঠনের পর পরই ত্রিপুরার অপর দুই সেক্টর থেকে ‘জেড ফোর্সের অনুরূপ দুটি ব্রিগেড তথা ‘কে ফোর্স’ এবং ‘এস-ফোর্স’ গঠনের জন্য তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়। ঊর্ধ্বতন কমান্ড এই দাবী অনুযায়ী তিনটি নতুন ব্যাটালিয়ান গঠন এবং তিনটি আর্টিলারী ব্যাটারী গঠনের আবশ্যকতা জোরেশোরেই ব্যক্ত করেন। এই সব দাবীর প্রেক্ষিতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার এই সব নতুন সংযোজনের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিতকরণে সহায়তা লাভের জন্য পুনরায় ভারত সরকারের দ্বারস্থ হন।
সাধারণ অবস্থার একটি নতুন ব্যাটালিয়ানের রিক্রুটিং-এ প্রায় ছ’মাসের মত সময় লাগে এবং ট্রেনিং-এ সময় লাগে আরও প্রায় এক বছর। সেখানে মাত্র দু’মাসের মধ্যে নতুন তিনটি ব্যাটালিয়ান রিক্রুট ও যুদ্ধোপযোগী করে তোলার পরিকল্পনা অত্যন্ত অবাস্তব ছিল। ফলে নভেম্বরের মাঝামাঝি যখন এই তিন ব্যাটালিয়ানকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করার কথা, তখন বাস্তবক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করতে দেখা যায়। খালেদ মোশাররফের উপর দায়িত্ব ছিল ১০-ইবি এবং ১১-ইবি গঠনের। ১৫ই নভেম্বর নাগাদ ১০-ইবির জন্য প্রায় ৭০০ এবং ১১-ইবির জন্য ৭০০ জনের কিছু বেশী সৈন্য হাজির করা হয়। ৯-ইবি গঠনের দায়িত্ব ছিল সফিউল্লাহর উপর কিন্তু ১৫ই নভেম্বরে পাওয়া গেল সম্ভবত ৩০০ জনের মত সৈন্য। সিলেট জেলা থেকে বাকীদের সংগ্রহ করে আনার প্রতিশ্রুতি ওসমানী স্বয়ং দিয়েছিলেন। সিলেটের শত্রু অধিকৃত এলাকা থেকে বাকীদের হাজির করা হলো ২০শে নভেম্বরের দিকে, কিন্তু দেখা গেল তাদের বেশীরভাগই প্রায় আনাড়ি। এই তিনটি ব্যাটালিয়ান গঠন করার ফলে মুক্তিযুদ্ধ সবিশেষ সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে এমন দাবী করার উপায় নেই। বরং একের পর এক এই সব অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অধিকাংশ সেক্টর অধিনায়কেরই যতটুকু বা লড়াইয়ের ক্ষমতা ছিল, তা নিঃশেষিত হতে থাকে।
দেশকে শত্রুমুক্ত করার কোন সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসাবে নয়, অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আক্রমণ ধারাকে উন্নত করে মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নয়, বরং প্রতীয়মান হয় প্রধানত নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির তাগিদেই নিয়মিত বাহিনীর আয়তন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। তুরায় প্রথম ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত কতখানি যুক্তিসংগত ছিল তা পর্যালোচনা করলে অবস্থাটা আরও কিছু পরিষ্কার হয়। জুলাই মাসে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এই ব্রিগেড গঠনের পিছনে তিন ধরনের চিন্তা পাশাপাশি বিরাজমান ছিল। ওসমানীর পরিকল্পনা ছিল এই ব্রিগেডের সাহায্যে সীমান্তের নিকটবর্তী কোন বড় এলাকা শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি নিরাপদ অবস্থান অঞ্চল’ (lodgement area) গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে শত্রুমুক্ত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা যদি সত্যই পাওয়া যায়, তবে সে আক্রমণের পুরোভাগে বাংলাদেশের অন্যূন একটি নিয়মিত ব্রিগেড রাখা আবশ্যক বলে বাংলাদেশের নেতৃত্বের অনেকেই মনে করতেন। তৃতীয় চিন্তা ছিল, স্বাধীনতা-উত্তরকালের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারিত করার। প্রত্যেকটি চিন্তা অবশ্যই ছিল বিতর্কমূলক। প্রথমটি তো বটেই। সেপ্টেম্বর মাসের শেষে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রধান সেনাপতি ওসমানী নিজেই তাঁর ‘Ops plan’-এ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান: “যে কাজের জন্য ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল, তা অর্জনের ক্ষেত্রে এ যাবত ব্রিগেডকে ব্যবহার করা যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও করা যাবে বলে মনে হয় না।” পরিবর্তিত পরিকল্পনায় ওসমানী তাই স্থির করেন: “বর্তমানে যেহেতু ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়ানের উপযোগিতা অতি নগণ্য, সেহেতু নিয়মিত বাহিনীকে বরং কোম্পানী/প্লেটুন গ্রুপে বিভক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতার জন্য নিয়োগ করা উচিত।” অথচ এর মাত্র দু’সপ্তাহ আগে আরো দুটি বিগ্রেড গঠনের জন্য সম্পূর্ণ নতুন তিনটি ব্যাটালিয়ান গঠন ও প্রস্তুত করার কাজ তার জোরাল সমর্থনের ফলেই শুরু হয়ে গেছে। কাজেই এ কথা বলার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সম্প্রসারণ মুক্তিযুদ্ধের কোন সুচিন্তিত রণনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সম্পন্ন হয়েছিল। যে কারণেই এই সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকুক, তাকে কার্যকর করতে গিয়ে অন্তত কয়েকটি অঞ্চলের সেক্টর অধিনায়কদের লড়াইয়ের ক্ষমতা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পায়।
কেবল ভরসা ছিল এই যে, আলোচ্য সময়ে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সশস্ত্র ছাত্র ও তরুণদের বিকাশ ঘটতে থাকে আশাব্যঞ্জকভাবে। গোপন আক্রমণের নিত্য নতুন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ পাকিস্তানী সেনাদের গর্বিত মনোবল ও শৌর্যের দম্ভকে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে থাকে। পাকিস্তানের সমরোন্মত্ত সৈনিকেরা সীমান্তে ও অভ্যন্তরে ক্রমশ শ্রান্ত ও হতোদ্যম হয়ে উঠতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের অদৃশ্য আঘাতে আঘাতে।
কিন্তু ব্যাপক সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিতকরণ যে সব রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি সমাবেশের ফলে সম্ভব হয়েছিল, পুনরায় সে আলোচনায় ফিরে যাওয়া যায়।