অধ্যায় : ষোল – অবতারদের পুনর্জন্ম
এই তৃতীয় পর্যায়ে আমরা আলোচনায় নিয়ে আসবো আক্ষরিক অর্থে আন্তর্জাতিক পরিচিতির অধিকারী ধর্মগুরুদের ঘিরে গড়ে ওঠা জাতিস্মর কাহিনীকে। এঁরা হলেন—সত্য সাঁইবাবা, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী দলাই লামা, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব, শ্রীশ্রীসারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দ।
সত্য সাঁই ও দলাই লামা নিজেদের জাতিস্মর বলে দাবি করেন, এবং দৃঢ়তার সঙ্গেই করেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব, শ্রীশ্রীসারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। রামকৃষ্ণদেব তাঁর জীবিতকালেই স্পষ্ট করে বলে গিয়েছিলেন, সপার্ষদ তিনি আবার জন্ম নেবেন এই বাংলার বুকেই। জন্ম নেবার নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত। রামকৃষ্ণদেবের কথা সত্যি হলে ওঁরা তিনজন তো বটেই, আরও অনেকেই এখন এই বঙ্গেই বেঁচে-বর্তে রয়েছেন। পূর্বজন্মে রামকৃষ্ণ, সারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন, এমন দাবি করার মানুষও মিলেছে। এইসব রোমাঞ্চকর জাতিস্মর কাহিনী নিয়েই আমরা আলোচনা করব তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে।
জাতিস্মর তদন্ত ১০ : সত্য সাঁইবাবা।
বাঙ্গালোরের কাছে ছোট্ট গ্রামে পুট্টাপরথি। এই গ্রামেই জন্মেছে সত্যনারায়ণ রাজু। জন্মের সাল ১৯২৬। তারিখ, ২৩ নভেম্বর। ছোট্ট রাজুর ছোটবেলা থেকেই ম্যাজিকের প্রতি বাড়তি টান। দিন কাটছিল, সময় গড়াচ্ছিল। শিশু রাজু কিশোর হলো। কিশোর রাজুর যখন বয়স চোদ্দ বছর, তখন একদিন গ্রামবাসীদের সামনে শূন্য হাতে মুহূর্তে নিয়ে আসছিল ফুল অথবা মিষ্টি। কিন্তু বিষয়টা সেদিন নেহাত আর জাদুর কৌশল রইল না। কারণ রাজু ঘোষণা করেছিল, এমনটা যদিও অনেক জাদুকরই করে দেখায় কিন্তু তার এই শূন্য থেকে সৃষ্টি কোনও জাদু নয়, নির্ভেজাল অলৌকিক ঘটনা। রাজু এও জানাল, ও এই অলৌকিক ক্ষমতা হঠাৎ করে অর্জন করেনি। গত জন্মেও ওর এইসব অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। গত জন্মে ও ছিল ‘সির্দির সাঁইবাবা’।
সির্দির সাঁইয়ের জন্ম সির্দিতে নয়। তিনি ছিলেন হায়দ্রাবাদ স্টেটের মধ্যবিত্ত এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। জন্ম ১৮৫৬ সালে। ছোটবেলাতেই সাঁই ঘর ছাড়েন এক মুসলমান ফকিরের সঙ্গে। ঘুরতে ঘুরতে সির্দিতে আসেন ১৮৭২ সালে। ১৯১৮-তে যখন মারা যান, তখনও পর্যন্ত তিনি সির্দিতেই ছিলেন। প্রধানত দক্ষিণ ভারতে তাঁর অনেক ভক্ত ছিলেন ও আছেন, যাঁরা মনে করেন সির্দির সাঁই ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি নাকি ছিলেন এক কল্পতরু মানুষ। তাঁর কাছে যে যা প্রার্থনা নিয়ে যেত সবই পূর্ণ হতো। কেউ কোনও দিন বিফল হয়ে ফেরেননি। (তাত্ত্বিকভাবেই এমনটা সম্ভব নয়, যদিও আমাদের এই তথাকথিত অধ্যাত্মবাদের দেশ ভারতের বহু মানুষ আজও বহু জীবিত ও মৃত তথাকথিত অবতারের এমন কল্পতরু হওয়ার শক্তিতে বিশ্বাস করেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা একবার ভাবুন তো, কোনও মামলার বাদী ও বিবাদী পক্ষ একই সঙ্গে সির্দির সাঁইয়ের মত কল্পতরু ক্ষমতার অধিকারীর কাছে মামলায় জয়ী হওয়ার প্রার্থনা করলে দু’জনের প্রার্থনা একই সঙ্গে তিনি পুরণ করবেন কি করে? তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব নয়। যখন নক-আউট ফুটবল প্রতিযোগিতায় একটি মাত্র দলই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, একাধিক দল নয়; তখন একাধিক দলের প্রার্থনা তাত্ত্বিকভাবেই পূর্ণ করার ক্ষমতা থাকতে পারে না কোনও কল্পতরু অবতারেরই। একইভাবে বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণ করা যায়—কল্পতরু হয়ে সবার প্রার্থনা পূর্ণ করার ক্ষমতা কারুরই থাকতে পারে না।)
এখনও বহু লক্ষ সির্দির সাঁইয়ের ভক্তরা বিশ্বাস করেন—সাঁইয়ের করুণায় যে কোনও রোগী নীরোগ হতে পারে, অন্ধ ফিরে পায় দৃষ্টি, বোবা বলে কথা, নিঃসন্তান লাভ করে সন্তান। একই সঙ্গে বহু জায়গায় নিজের শরীর নিয়ে হাজির হতেন ভক্তদের আহ্বানে।
যাই হোক, রাজু নিজেকে পূর্বজন্মে সির্দির সাঁই বলেই শুধু ঘোষণা করল না, সির্দির সাঁইয়ের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের নামও বলে দিল। (এমন বলতে পারাটা জাতিস্মরতার প্রমাণ হলে মহা বিপদ। যে কেউ যখন তখন আকবর কি কার্ল মার্কসের ঘনিষ্ঠ দু-চারজনের নাম বলে দিলে আমরা তাদের আকবর কি মার্কস বলে ধরে নিলে কি হবে, একবার ভাবুন তো!)
যাই হোক, ভক্ত ‘পাবলিক’ সির্দির সাঁইয়ের ওই সব অদ্ভুতুড়ে ক্ষমতাতেই শুধু বিশ্বাস করতেন না, তাঁরা রাজুকেই সির্দির সাঁই বলে ধরে নিলেন। এবং ধরে নিলেন সির্দির সাঁইয়ের যে সব অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, সে সবই রাজুর মধ্যেও আছে। রাজুর নতুন নাম হলো ‘সত্য সাঁই’ (কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’-এর মত ব্যাপার আর কি!)
আমাদের বাংলার তথা ভারতের গর্ব (!) ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও সত্য সাঁইকে জাতিস্মর বলে মেনে নিয়েছিলেন। অনেক পরীক্ষা-টরীক্ষা করে ঘোষণা করেছিলেন, ‘সত্য সাঁই’ই আগের জন্মে ছিলেন ‘সির্দির সাঁই’। কী সেইসব পরীক্ষা সত্যি সে বড়ই কঠিন পরীক্ষা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন সত্য সাঁইও সির্দির সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতাগুলোর যোগ্য উত্তরাধিকারী কি না? তারপর পরীক্ষা অন্তে জ্ঞানতাপস ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় কি মত পোষণ করেছিলেন, তা জানতে আসুন আমরা ‘জন্মান্তরবাদ :….’ বইয়ের ২০২ পৃষ্ঠার শেষ পংক্তিতে চোখ বোলাই।
“প্রতি দিন হাজার হাজার ভক্ত তাঁর আশ্রমে উপস্থিত হয় বহু দাবী ও বাসনা নিয়ে; তিনি তাদের সকলের ইচ্ছা পূরণ করেন, অন্ধকে চক্ষুদান করেন, সন্তানহীনাকে সন্তান, স্বল্পায়ুকে দীর্ঘ জীবন দেন।”
গ্রন্থে এ’কথাও বলা হয়েছে, সত্য সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতাগুলো সত্যিই আছে কি না, এ’জানার জন্য বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা দরকার এবং তার পরেই কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যেতে পারে। সত্য সাঁইয়ের ক্ষেত্রে পরামনোবিজ্ঞানীকে সিদ্ধান্তের জন্য বিভিন্ন ঘটনা, জনশ্রুতি, বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের সত্য সাঁই সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিচার করে দেখতে হয়।
প্রশ্নটা এখানেই! কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করবেন? যিনি নির্বাচন করবেন তিনি যদি নিজেকে বার বার ‘বিশ্বাস-অযোগ্য’ বলে প্রমাণ করেন, তবে? যাই হোক, ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেক প্যারাসাইকোলজিস্টই সত্য সাঁইকে পূর্বজন্মের সির্দির সাঁই বলে ঘোষণা করেছিলেন। এমন ঘোষণার পিছনে প্রধান যুক্তি ছিল—সত্য সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতা।
কিন্তু মুশকিল কি জানেন? সত্য সাঁইয়ের জীবন বাঁচাতে কয়েক শত বিশেষ শিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক-দেহরক্ষী এবং জেড ক্যাটাগরির কমান্ডোকে নিজের চোখে তৎপর দেখার পর সাধারণভাবেই সাধারণ ভাত-রুটি খাওয়া মানুষের মাথায় যে প্রশ্ন উঠে আসে, তা হলো—যিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তদের রক্ষা করছেন, তিনি নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম?
যাই হোক, প্যারাসাইকোলজিস্টদের দাবি ও সত্য সাঁইয়ের ক্ষমতা খোলা মনে দেখতে একটি খোলা চিঠি সত্য সাঁইয়ের কাছে পেশ করছি। ‘সর্বত্রগামী’ ‘সর্বদ্রষ্টা’, ‘সর্বভাষাবিদ’ সত্য সাঁই বাবা বাস্তবিকই এই বিশেষণগুলির যোগ্য হলে খোলা চিঠির মর্ম উপলব্ধি করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসবেন।
ভগবান শ্রীসত্যসাঁইবাবা
প্রশান্তিনিলায়ম
পুট্টাপরথি
জেলা—অনন্তপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ
প্রিয় সত্য সাঁইবাবা,
ভক্ত ও শিষ্য সংখ্যার বিচারে আপনিই সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়তম জীবন্ত ধর্মগুরু, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও গ্রন্থে আপনার অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে অনেক কিছুই পড়েছি এবং আপনার কিছু ভক্তের কাছে আপনার বিষয়ে অনেক কিছু শুনেছি। শুনেছি আপনি অন্ধকে চক্ষুদান করেন, সন্তানহীনাকে সন্তান দান। এবং এ’সবই করেন অলৌকিক ক্ষমতায়। এও শুনেছি এবং পড়েছি, আপনি সকলের ইচ্ছা পূরণ করেন।
আমার একটি তীব্র ইচ্ছে রয়েছে। আপনার কাছে ইচ্ছে পূরণের আবেদন রাখছি। আশা রাখি আপনার ভক্তদের কথা ও লেখাকে সত্য প্রতিপন্ন করতে আমার ইচ্ছে পূরণ করবেন।
আমার ইচ্ছে : আমার চিহ্নিত পাঁচটি অন্ধের যে কোনও একজনকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিন আপনার অলৌকিক শক্তির সাহায্যে। আপনি এই খোলা চিঠির প্রার্থনা মঞ্জুর করে চিঠির তলায় দেওয়া ঠিকানায় একটি খবর পাঠান রেজিস্ট্রি ডাকে, ‘অ্যাকনলেজমেন্ট কার্ড’ সহ। অথবা আপনি প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলনে আমার প্রার্থনা মঞ্জুরের খবর দিন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সর্বত্রগ্রামী নই, সর্বদ্রষ্টাও নই। তবু আমাদের সমিতির যে অতি সামান্য নেট-ওয়ার্ক আছে, তারই সাহায্যে খবরটা আমার কাছে আসবেই। তারপর প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের সামনেই পাঁচ অন্ধকে হাজির করব কলকাতায়। সর্বত্রগামী আপনি মাত্র একজনের দৃষ্টি দান করলেই আমার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে।
আপনি যদি আমার ইচ্ছে পূরণ না করেন, তবে অবশ্যই ধরে নেব, আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি অলৌকিক কাহিনীই মিথ্যে; আপনি যেসব ঘটনা ‘অলৌকিক’ বলে দেখান সেগুলো নেহাতই কৌশলের দ্বারা ঘটিয়ে থাকেন। সত্য প্রকাশের ভয়ে আপনি পিছু হটত বাধ্য হচ্ছেন।
শুভেচ্ছা।
প্রবীর ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি
৩৪এ, শশীভূষণ দে স্ট্রিট
কলকাতা-৭০০ ০১২
এর আগেও সত্য সাঁইবাবার ‘বিভূতি’ নিয়ে একটি সত্যানুসন্ধান চালাতে .. চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনও সহযোগিতা তাঁর কাছ থেকে পাইনি।
সাঁইবাবার নামের সঙ্গে ‘বিভূতি’র ব্যাপারটা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, সাঁইবাবা বললেই তাঁর অলৌকিক বিভূতির কথাই আগে মনে পড়ে। সাঁইবাবা অলৌকিক প্রভাবে তাঁর শূন্য হাতে সুগন্ধি পবিত্র ছাই বা বিভূতি সৃষ্টি করে ভক্তদের বিতরণ করেন। বছরের পর বছর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভক্তেরা দেখে আসছেন সাঁইবাবার বিভূতি সৃষ্টির অলৌকিক লীলা।
১৯৮৪’র ১ মার্চ, ২ এপ্রিল, ২ মে ও ১ জুন সাঁইবাবাকে চারটে চিঠি দিই। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি চিঠিরও উত্তর পাইনি। আমার ইংরেজিতে লেখা প্রথম চিঠিটির বাংলা অনুবাদ এখানে দিলাম।
ভগবান শ্রীসত্যসাঁইবাবা
প্রশান্তিনিলায়ম
পুট্টাপরথি
জেলা–অনন্তপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ
প্রিয় সত্যসাঁইবাবা,
ভক্ত ও শিষ্য সংখ্যার বিচারে আপনিই সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়তম ধর্মগুরু। বিভিন্নপত্র-পত্রিকায় আপনার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার সম্বন্ধে অনেক কিছু পড়েছি এবং আপনার কিছু ভক্তের কাছে আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি। আপনার অলৌকিক খ্যাতি প্রধানত ‘বিভূতি’ সৃষ্টির জন্য। পড়েছি এবং শুনেছি যে, আপনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে শূন্যে হাত নেড়ে ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করেন এবং কৃপা করে কিছু-কিছু ভাগ্যবান ভক্তদের তা দেন।
আমি অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে জানতে অত্যন্ত আগ্রহী। অলৌকিক কোন ঘটনা বা অলৌকিক ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তির বিষয় শুনলে আমি আমার যথাসাধ্য অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্যকে জানার চেষ্টা করি। দীর্ঘদিন ধরে বহু অনুসন্ধান চালিয়েও আজ পর্যন্ত একটিও অলৌকিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা ঘটনার সন্ধান পাইনি। আমার এই ধরনের সত্য জানার প্রয়াসকে প্রতিটি সৎ মানুষের মতোই আশা করি আপনিও স্বাগত জানাবেন; সেই সঙ্গে এ-ও আশা করি যে, আপনার অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে অনুসন্ধানে আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। আপনার পোশাক ও শরীর পরীক্ষা করার পর আপনি আমাকে শূন্যে হাত নেড়ে, ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করে দেখালে আমি অবশ্যই মেনে নেব যে, আপনার অলৌকিক ক্ষমতা আছে এবং অলৌকিক বলে বাস্তবিকই কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে।
আপনি যদি আমার চিঠির উত্তর না দেন, অথবা যদি আপনার বিষয়ে অনুসন্ধানের কাজে আমার সঙ্গে সহযোগিতা না করেন, তবে অবশ্যই ধরে নেব যে, আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি অলৌকিক কাহিনীই মিথ্যে এবং আপনি ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করেন কৌশলের দ্বারা, অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা নয়।
শুভেচ্ছান্তে
প্রবীর ঘোষ
২৮৭ দমদম পার্ক
কলকাতা-৫৫
পিন-৭০০ ০৫৫
১.২.১৯৮৪
সাঁইবাবাকে লেখা পরের চিঠিগুলোর বয়ান একই ছিল, তবে সেগুলোতে আগের যে যে তারিখে চিঠি দিয়েছিলাম এবং উত্তর পাইনি, সেই তারিখগুলোর উল্লেখ ছিল।
শূন্যে হাত নেড়ে ছাই বের করাটা ঠিকমতো পরিবেশে তেমনভাবে দেখাতে পারলে যুক্তিহীনদের কাছে অলৌকিক ক্ষমতা-প্রসূত মনে হতে পারে।
১৬.৪.৭৮ তারিখের ‘সানডে’ সাপ্তাহিকে জাদুকর পি. সি. সরকার জুনিয়র জানান তিনি সাঁইবাবার সামনে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে একটা রসগোল্লা নিয়ে আসেন। সাঁইবাবা এই ধরনের ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন।
ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছিল কি না ঘোরতর সন্দেহ আছে। সন্দেহের কারণ— এক : শ্রীসরকার যে ধরনের লাগাতার মিথ্যে বলেন স্টান্ট দিতে, তার পরিচয় একের পর পাওয়ার পর এটাকে স্টান্ট বলেই মনে হয়। দুই : সত্য সাঁইবাবা স্বেচ্ছাসেবী দেহরক্ষীদের দ্বারা যে ভাবে সুরক্ষিত, তা একবার নিজের চোখে দেখে আসার পর শ্রীসরকারের দাবিকে আর একটি বাড়তি মিথ্যে ‘স্টান্ট’ বলেই মনে হয়। এমন মস্তানি করার সাহস শ্রীসরকার দেখাতে গেলে সত্য সাঁই ভয় পেয়ে চিৎকার করে পালাতেন না, শ্রীসরকারের প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকত; যেমনটা এর আগেও ঘটতে দেখেছি আমরা।
শূন্যে হাত ঘুরিয়ে ছোটখাট কিছু নিয়ে আসা, এটা জাদুর ভাষায় পামিং। পামিং যেমন হাতের কৌশল, তেমনই আর একটা কৌশলকে জাদুর ভাষায় বলে ‘লোড’ নেওয়া। জাদুকর যখন শূন্য থেকে হাঁস-মুরগি-খরগোশ-ফুল-ফল-লাড্ডু ইত্যাদি বের করতে থাকে তখন অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকে লুকিয়ে রাখা হয় পোশাকের আড়ালে। প্রয়োজনের সময় এগুলোকে মুহূর্তে আড়াল থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসে দর্শকদের চমকে দেন জাদুকর।
যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য-সদস্যারা গ্রামে-গঞ্জে হরবখৎ এমনি বিভূতি তৈরি করে দেখাচ্ছেন। এ’ক্ষেত্রে আমরা দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করি।
এক : ছাই বেটে ছেঁকে মিহি করে তার সঙ্গে ঘন মাড় মিশিয়ে ছোট ছোট গোল গোল লাড্ডু তৈরি করি। ছাইয়ের লাড্ডু আটকে রাখি জামা, পাঞ্জাবি বা কোটের ভিতর দিকে। লাগিয়ে বা ঝুলিয়ে রাখা হয় এমন ভাবে, হাত একটু পোশাকের ভিতর দিয়ে হানা দিলেই নাগালে ছাইয়ের লাড্ডু। হাতের মুঠোয় একটা লাড্ডু মানেই একটু চাপে অনেক ছাই। লাড্ডুতে একটু সেন্ট স্প্রে করে নিলে তো কথাই নেই! একেবারে সুগন্ধী বিভূতি।
দুই : যে বিভূতি বের করে দেখাবে, তার ডান বগলে বাঁধা থাকে রাবার বা নরম প্লাসটিক জাতীয় জিনিসের ছোটখাটো ব্লাডার। ব্লাডার ভর্তি করা থাকে সগুন্ধি ছাই। ব্লাডারের মুখ থেকে একটা সরু নল হাত বেয়ে সোজা নেমে আসে হাতের কব্জির কাছ বরাবর। পোশাকের তলায় ঢাকা পড়ে যায় ব্লাডার ও নল। এবার ছাই সৃষ্টি করার সময় ডান হাত দিয়ে বগলের তলায় বাঁধা ব্লাডারটায় প্রয়োজনীয় চাপ দিলেই নল বেয়ে হাতের মুঠোয় ছাই চলে আসবে। বাঁ হাত দিয়েও ছাই বের করতে চান? বাঁ বগলেও একটা ছাই-ভর্তি ব্লাডার ঝুলিয়ে নিন। দেখলেন তো, অবতার হওয়া কত সোজা!
বোঝবার সুবিধার জন্য ছবি দেখুন।
সত্য সাঁইয়ের ছবি থেকে ঝরে যে বিভূতি
সত্য সাঁইবাবা, সম্বন্ধে এও শুনেছি যে, অনেকের বাড়িতে রাখা সাঁইবাবার ছবি থেকে নাকি পবিত্র ছাই বা বিভূতি ঝরে পড়ে। বছর কয়েক আগে কোলকাতায় জোর গুজব ছড়িয়ে ছিল যে, অনেকের বাড়ির সাঁইবাবার ছবি থেকেই নাকি বিভূতি ঝরে পড়ছে। প্রতিটি মিথ্যে গুজবের মতোই এক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব হয়নি, ব্যক্তিগতভাবে আমি যাঁদের মুখেই এইসব গুজব শুনেছি তাঁদেরই চেপে ধরেছি। আমার জেরার উত্তরের প্রায় সকলেই জানিয়েছেন যে, তাঁরা নিজের চোখে বিভূতি ঝরে পড়তে দেখেননি। যে দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়েছি, তাঁদের অনেকেই জাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের গণসম্মোহনের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতোই মিথ্যাশ্রয়ী, সেটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না। যাঁরা সত্যিই বাস্তবে ছবি থেকে বিভূতি পড়তে দেখেছেন, তাঁরা শতকরা হিসেবে সংখ্যায় খুবই কম। তাঁরা দেখেছেন ভক্তদের বাড়ির ছবি থেকে বিভূতি পড়তে বা ছবির তলায় বিভূতি জমা হয়ে থাকতে। এই বিভূতি বা ছাই সৃষ্টি হয়েছে দু’রকম ভাবে। (১) কোন সাঁইবাবার ভক্ত অন্য সাঁই ভক্তদের চোখে নিজেকে বড় করে তোলার মানসিকতায় সাঁইবাবার ছবির নিচে নিজেই সুগন্ধী ছাই ছড়িয়ে রাখে। (২) সাঁইবাবার ছবির কাচে ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল মাখিয়ে ঘষে দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল বাতাসের সংস্পর্শে এলে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে ছাইয়ের মতো ঝরে পড়তে থাকে।
ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সাঁইবাবার ওপর অনুসন্ধানের জন্য ১২ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় Saibaba Exposure Committee। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার উপাচার্য ডঃ নরসিমাইয়া ছিলেন এই কমিটির উদ্যোক্তা। সাঁইবাবার সহযোগিতার অভাবে কমিটি শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালাতে ব্যর্থ হন।
শূন্য থেকে হীরের আংটি
মেয়েদের একটি বাংলা সাময়িক পত্রিকায় ১৯৮১ সালের জুলাই মাসের সংখ্যায় লেখা হয়েছিল সাঁইবাবা শূন্য থেকে একটা হীরের আংটি সৃষ্টি করে নাকি পণ্ডিত রবিশঙ্করকে দিয়েছিলেন। শূন্য থেকে হীরে সৃষ্টির ঘটনা একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে যে কোন জাদুকরই শূন্য থেকে হীরের আংটি এনে দিতে পারেন। আর এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দেখালেই কি ওই জাদুকরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ধরে নেওয়া হবে? শূন্য থেকে সৃষ্টির ক্ষমতা যদি থাকে তবে খোলামেলা পরিবেশে একটা স্কুটার কি একটা মোটর বা বিমান সৃষ্টি করে উনি দেখান না। ব্ল্যাক-আর্টের দ্বারা জাদুকরেরা শূন্য থেকে হাতি বা জিপ-কার সৃষ্টি করেন। জাদুকরদের এই সৃষ্টির মধ্যে থেকে কৌশল। সাধু বাবাজিদের সৃষ্টির মধ্যে এই ধরনের কোনও কৌশল থাকলে চলবে না। কোনও বাবাজি যদি শূন্য থেকে এই ধরনের বড়-সড় মাপের কোনও কিছু সত্যিই সৃষ্টি করতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই প্রমাণিত হবে অলৌকিক বলে কিছু আছে, এবং তাবৎ বিশ্বের যুক্তিবাদীরাও আর এইসব নিয়ে কচকচানির মধ্যে না গিয়ে অলৌকিক বলে কিছুর বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করে নেবে।
এত কিছুর পরও কি মনে হয় সত্য সাঁই পূর্বজন্মে সির্দির সাঁই ছিলেন? মনে কি হয় – সত্য সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতাই তাঁর জাতিস্মরতার প্রমাণ? তবে বলি, সত্য সাঁই কোনও দিনই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দাবি প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা নেই, যেমন নেই কোনও অবতারেরই।
.
জাতিস্মর তদম্ভ ১১ : দলাই লামা
‘দলাই লামা’ শূন্য থেকে সৃষ্টি হননি। একটু একটু করে তৈরি হয়েছেন। এখন যিনি ‘দলাই লামা’, তিনি চতুর্দশ দলাই লামা। প্রথম দলাই লামা’র সৃষ্টি জানতে আসুন আমরা একটু পিছনের দিকে তাকাই।
তিব্বতে প্রথম বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয় অষ্টম শতাব্দীতে। শুরুতে বৌদ্ধধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল রাজপরিবার ও কিছু উচ্চবর্ণের মধ্যে। ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে তিব্বতে এলেন বৌদ্ধধর্ম-প্রচারক অতীশ। অতীশই প্রথম বৌদ্ধ ভাবনাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন।
তিব্বতের জনপ্রিয় ধর্মনেতা সং থাপা’র নেতৃত্বে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা নিজেদের নিয়ে একটি নতুন সম্প্রদায় তৈরি করেন, ‘গোলুগপা’। গোলুগপা’রা সাধারণ ভাবে ‘হলদে টুপি’ নামে পরিচিত ছিল। ৎসং-এর জীবনকাল ১৩৫৭ থেকে ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দ। তিনিই প্রথম অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের একত্রিত করে ‘হলদে টুপি’র নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করেন।
ৎসং থাপার মৃত্যুর পর ‘হলদে টুপি’ বা ‘গোলুগপা’র ধর্মীয় নেতার পদে বসেন তাঁরই ভাই টুপ্পা গেডুন। টুপ্পার জন্ম ১৩৯৯ সালে। পণ্ডিত হিসেবে টুপ্পার খ্যাতি যেমন ছিল, তেমনই ছিল জনপ্রিয়তা। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করতেন টুপ্পা তথাগত বুদ্ধের অবতার। (এই বৌদ্ধদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অবশ্য মনে করেন টুপ্পা ছিলেন অবলোকিতেশ্বরের অবতার, বুদ্ধের অবতার নন। অবলোকিতেশ্বর এক অর্ধনারীশ্বর, আধা তারা আধা শিবের রূপ।)
১৪৭৫ সালে টুপ্পা গেড়ুন মারা গেলেন। তিব্বতবাসী বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেছিলেন, তথাগত বুদ্ধ ভক্তের রক্ষার্থে ও পৃথিবীর কল্যাণে বারবার ওঁদের ধর্মগুরু রূপে জন্ম নেবেন। ফলে ওঁরা বিশ্বাস করলেন টুপ্পা আবার জন্ম নেবেন। এই বিশ্বাস থেকে খুঁজতে খুঁজতে ওঁরা পেলেন গেড়ুনকে। গেড়ুনকে তুলে এনে করলেন ‘গ্যাটসো’ বা ধর্মগুরু।
গেড়ুন গ্যাটসো একদিন সময়ের কাছে হার মেনে মৃত্যুকে বরণ করলেন। তিব্বতবাসী বৌদ্ধরা এ’বারও ধরে নিলেন, গেড়ুন গ্যাটসো তাঁদের ধর্মীয় নেতৃত্ব দিতে নবকলেবরে আবার জন্ম নেবেন। শুরু হলো খোঁজ। খুঁজে পেলেন শিশু সোনামকে। ওঁরা বিশ্বাস করলেন, গেড়ুনই জন্ম নিয়েছেন সোনাম রূপে।
সোনাম গ্যাটসো ছিলেন বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত। ১৫৭৮ সালে সোনাম মঙ্গোলিয়া যান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। মঙ্গোলিয়ার রাজা আলতান খাঁ পরিবার ও অমাত্যবর্গসহ বৌদ্ধধর্মে দিক্ষিত হন। রাজা আলতান খাঁ সোনামকে ‘দলাই লামা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘দলাই’ শব্দের অর্থ ‘সমুদ্র’।
মজাটা হলো, সোনাম গ্যাটসো যদিও প্রথম ‘দলাই লামা’ উপাধি পান এবং ‘দলাই লামা’ নামে পরিচিত হন, কিন্তু এই ‘দলাই লামা’ উপাধি সোনামের দুই পূর্বসূরী ধর্মগুরু গেডুন গ্যাটসো এবং গেড়ুন টুপ্পার উপরও প্রযুক্ত হয়। সোনামের ইচ্ছেতেই প্রযুক্ত হয়। ফলে সোনাম হলেন তৃতীয় দলাই লামা। গোড়ায় দলাই লামারা ছিলেন গোলুগপা বা ‘হলদে টুপি’ ধর্মসম্প্রদায়েরই ধর্মপ্রধান। ১৬৬২ সালে তিব্বতের অধিপতি মঙ্গোলিয়ার রাজা গুরসি খাঁ অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের লামা বা ধর্মগুরুদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেই সময়কার দলাই লামাকে (পঞ্চম দলাই লামা) গোটা তিব্বতের প্রধান ধর্মগুরুর পদে বসান। পঞ্চম দলাই লামার নাম ছিল নাগাওয়া লোলজান।
১৯৬৫-তে রাজা গুরসি খাঁ মারা গেলেন। তাঁর বংশধরেরা রাজনীতি অতটা বুঝতেন না। সেই সুযোগে দলাই লামাই হয়ে উঠলেন তিব্বতের সর্বেসর্বা—কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কি সামাজিক ক্ষেত্রে। এই ক্ষমতা ভোগ করে গেছেন ত্রয়োদশ দলাই লামা থুমটেন। থুমটেনের জন্ম ১৮৭৬ সালে। মৃত্যু ১৯৩৩ সালে।
ত্রয়োদশ দলাই লামা দেহ রাখতেই তাঁর পুনর্জন্মের খোঁজ শুরু হয়ে গেল। এই খোঁজার পদ্ধতিটি বড়ই বিচিত্র। মৃত দলাই লামার দেহ ‘পোটালা’ ভঙ্গিতে দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখা হয়। ‘পোটালা’ ভঙ্গির অর্থ বুদ্ধদেবের মূর্তিগুলোতে প্রচলিত আসনে উপবিষ্ট ভঙ্গি। কত দিন ধরে এই নির্বিকল্প সমাধিতে দালাই লামা থাকবেন, সেটা পুরোপুরি দলাই লামারই ইচ্ছাধীন (এখানকার বালক ব্রহ্মচারীর নির্বিকল্প সমাধির মতই ব্যাপার)। তারপর হঠাৎই একদিন দেখা যায় দলাই লামার মৃতদেহ পূব দিকে মুখ করে বসে আছেন। তিব্বতের ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা মনে করেন বুদ্ধ-অবতার দলাই লামার মৃতদেহ স্ব-ইচ্ছায় দক্ষিণ থেকে পূব দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেন। এমনটা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে রাজজ্যোতিষীকে গণনা করে জানাতে বলা হয়, কোথায় বুদ্ধ-অবতার দলাই লামা এখন জন্ম নিয়েছেন, বা নিতে চলেছেন। রাজজ্যোতিষী ভর-গ্রস্ত হন। (তাঁর উপর কে ভর করে? মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের গোলমাল, না বদমাইসি? কে জানে? তিব্বতের হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ যখন রোগমুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে দলাই লামার শুকনো গু খেয়েছেন, তখন রাজজ্যোতিষী-রাজপরিবার-রাজঅনুগৃহীত ধনীরা অসুখ সারাতে গু ছেড়ে চিকিৎসকের সাহায্য নিয়েছেন। এই দ্বিচারিতাই স্পষ্ট করে দেয় ওঁরা মুখে দলাই লামাকে বুদ্ধের অবতার বলে যতই শোরগোল তুলুক, নিজেরা কিন্তু সে’কথায় একটুও বিশ্বাস করেন না। কেন করেন না? সবচেয়ে দামী প্রশ্ন এটাই! কারণ ওঁরা জানেন বুদ্ধের অবতারের পুনর্জন্মের ব্যাপারটা কি বিশাল রকম ভাঁওতা।)
ত্রয়োদশ দলাই লামার মৃত্যুর পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। অনুসন্ধান চলল দু’বছর ধরে। বহু শিশুকেই পরীক্ষা করে দেখা হলো। কারুকেই তেমন মনে ধরল না ধর্মের গুরুদের অর্থাৎ লামাদের। এই খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে যেহেতু বিশাল প্রভাব ও অর্থের প্রশ্ন জড়িত, তাই খুঁজে পাওয়াটা দরকষাকষির মধ্য দিয়ে এগুবে–এটাই স্বাভাবিক।
তিব্বতের মানুষদের মধ্যে বেশির ভাগই বিশ্বাস করেন ‘চো-খোরগাই’ হ্রদের জলের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করলে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। অনেকের অনুরোধে রাজা বেরুলেন হ্রদের জলে আগামী দলাই লামার হদিস পেতে। তারপর লাসার রাজপ্রাসাদে ফিরে ঘোষণা করলেন, তিনি দেখতে পেয়েছেন দলাই লামা জন্মেছেন একটি কুঁড়েঘরে। হ্রদের জলে অলীক দর্শন না হলেও এ ছাড়া আর কি বা বলতে পারতেন প্রজাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে চাওয়া রাজা! এমন দেখলে- টেখলে প্রজাদের কাছে রাজার সম্মান বাড়ে। রাজাও এক লাফে আধা-অবতার বনে যান।
অনুসন্ধানের কাজে নতুন উদ্দমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লামারা। বহু দলে বিভক্ত হয়ে দিকে দিকে বেরিয়ে পড়লেন ওঁরা। প্রত্যেক দলের সঙ্গেই একজন করে রাজকর্মচারী ও ত্রয়োদশ দলাই লামার ব্যবহৃত কিছু জিনিস। .
একটি দল গিয়ে হাজির হলো চিনের চিখাইং প্রদেশের অমদোং জেলায়। প্রথম দলাই লামা’র দাদা এবং ‘গোলুগপা’ বা ‘হলদে টুপি’ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ৎসং থাপা এখানেই জন্মেছিলেন।
এই জেলাতে পৌঁছে অনুসন্ধানকারীরা সেইসব পুরুষ শিশুদের পরীক্ষা করতে শুরু করলেন, যাদের জন্ম ১৯৩৪ সালের পর।
এরই মধ্যে পাওয়া গেল একটি শিশুকে। গরিব কৃষক পরিবারের ছেলে। জন্ম ১৯৩৫-এর ৬ জুলাই। শিশুটি যে ত্রয়োদশ দলাই লামারই নবকলেবর, অনেক পরীক্ষা-টরীক্ষা করার পর নাকি এ বিষয়ে অনুসন্ধানকারীরা প্রায় নিশ্চিত হলেন। সাংকেতিক লিপিতে এ’খবর পাঠালেন রাজধানী লাসায়। লাসা থেকে উত্তর এলো — তোমরা শিশুটির বাবার সঙ্গে কথা বলে ওদের আর্থিক দাবি-দাওয়া মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা কর তবে খুবই গোপনে। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে তোমাদের অনুসন্ধান কাজ প্রকাশ্যে চালিয়ে যাও। এতে শিশুটির বাবা ও পরিবার চাপে থাকবে এবং তোমাদের সঙ্গে টাকা-কড়ি লেনদেনের ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। মিটে গেলে শিশুটি ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে রওনা দেবে লাসার উদ্দেশে। লাসায় আরও কিছু শিশুও হাজির হবে ইতিমধ্যে। এদের ভিতর থেকেই আমরা খুঁজে নেব আমাদের চতুর্দশ দলাই লামা’কে।
শেষ পর্যন্ত চার লক্ষ চিনা মুদ্রায় রফা হলো। এই মুদ্রা নিলেন শিশুটির পরিবার ও চিখাইং প্রদেশের শাসনকর্তা। তারপর ১৯৩৯ সালের গোড়ায় অনুসন্ধানকারীর দল শিশুটিকে ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে রাজধানী লাসার উদ্দেশে রওনা হলেন। এই দলে ছিলেন চারজন লামা, একজন সরকারি কর্মচারী ও তাদের ডজন দু’য়েক চাকর-বাকর।
তারপর এই শিশুই পেল রাজার স্বাক্ষর সম্বলিত সরকারি স্বীকৃতিপত্র—ইনিই চতুর্দশ দলাই লামা, তিব্বতের ভাগ্যনিয়ন্তা! ১৯৪০ এর ফেব্রুয়ারির নববর্ষে চতুর্দশ দলাই লামার অভিষেক হলো। পরীক্ষকরা ইতিমধ্যে নাকি নানা ভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছিলেন ইনিই পূর্বজন্মের ত্রয়োদশ দলাই লামা থেকে প্রথম দলাই লামা পর্যন্ত সবই। ইনিই বারবার নবকলেবরে ফিরে এসেছেন তিব্বত-বাসীদের রক্ষা করতে, বিশ্ববাসীকে শান্তি দিতে।
চতুর্দশ দলাই লামাকে অভিষেকের সময় বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়; যেমন : ‘অখণ্ডজ্ঞানী’, ‘সর্বদুঃখের পরিত্রাতা’, ‘সর্বরোগের পরিত্রাতা’ ‘বিশ্বনিয়ন্তা’, ‘সর্বোত্তম’, ‘পবিত্রতম’, ‘পরমকরুণাময়’ ইত্যাদি। চতুর্দশ দলাই লামাও কিন্তু অতিমাত্রায় সচেষ্ট ছিলেন, যাতে জনগণ মনে করেন একই অঙ্গে বুদ্ধের অংশ ও অবলোকিতেশ্বরেরও অংশ। তাঁর মধ্যে এই দু’য়ের অংশের সহাবস্থানের কথা তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারেই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু তিনি কি বাস্তবিকই যা জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাইতেন, তাতে আদৌ নিজে বিশ্বাস করতেন? তিনি সত্যিই কি নিজেকে তথাগত বুদ্ধ বলে বিশ্বাস করতেন? মনে করতেন অবলোকিতেশ্বর বলে?
এ’বিষয়ে যাচাই করার মত যে কিছু তথ্য আমরা হাতের কাছে পাচ্ছি, আসুন সেগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখি।
‘সর্বরোগের পরিত্রাতা’ দলাই লামা নিজের রোগমুক্তির জন্য আপন বিশ্বনিয়ন্ত্রক শক্তি প্রয়োগে বিরত থাকতেন। চিকিৎসার জন্য বিদেশেও দৌড়তেন। এই তথ্য প্রমাণ করে দলাই লামা জানতেন, বিশেষণগুলো নেহাতই বিশেষণমাত্র। বাস্তবে তাঁর ওইসব ক্ষমতা নেই।
ও’সব ক্ষমতা যে আদৌ তাঁর নেই, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেল ১৯৬৯ সালে ‘বিশ্বনিয়ন্তা’, দলাই লামা নিয়ন্ত্রণ হারালেন তাঁর লীলাক্ষেত্র তিব্বতের উপর থেকে। তিব্বতের জনগণের পরিত্রাতা দলাই তখন ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ ধরনের একটা স্থূল তত্ত্বে প্রগাঢ় আস্থা রেখে পালিয়ে এলেন ভারতে। নিয়ে এলেন তিব্বতের রত্নভাণ্ডার কাচিয়ে যতেক ধন-রত্ন; রেখে এলেন ছোবড়া জনগণকে। দলাই লামার তথাকথিত অসীম ইচ্ছেশক্তির এই পরাজয় স্পষ্টতই প্রমাণ করে দিল তাঁর উপর আরোপিত বিশেষণগুলো কত অসার।
দলাই লামার খুব ভালমতই জানা ছিল, তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দৌড় কত দূর। একজন বৌদ্ধ হওয়ার সুবাদে দলাই লামা বাস্তবিকই যদি বিশ্বাস করতেন— তথাগত বুদ্ধেরও অবলোকিতেশ্বরের ছিল অসীম অলৌকিক ক্ষমতা, তবে নিজের অলৌকিক ক্ষমতার ছিটেফোঁটাটুকু নেই, এই বোধোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই এটুকুও বুঝেছিলেন—তিনি তথাগত বুদ্ধ বা অবলোকিতেশ্বর নন।
‘পরমকরুণাময় দলাই লামার সাধ্য নেই গোটা পৃথিবীর নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের করুণা করেও বঞ্চনামুক্ত করার। গোটা বিশ্বের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তিনি কি পেরেছিলেন তিব্বতের জনগণের শোষণ মুক্তি ঘটাতে? না পারেননি। কারণ তিনি স্বয়ং এক আড়ম্বরপ্রিয়, ভোগসর্বস্ব এবং একই সঙ্গে বঞ্চনাকারী ও বঞ্চনাকারীদের হাতিয়ার।
এ’বার একটু ‘অখণ্ডজ্ঞানী’ দলাই লামার জ্ঞানের বহরের দিকে তাকানো যাক। ১৯৯৪ সালের ১২ অক্টোবর, বুধবার ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়।
দলাই লামাকে স্বপ্নাদেশ – পাথরে পুনর্জন্ম নিয়েছেন বুদ্ধ
জগদীশ ভাট, ডিসেপা (দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে ব্যবস্থাক্রমে) : প্রস্তরখণ্ডে পুনর্জন্ম নিয়েছেন বুদ্ধ! এক ঝটকায় অলীক কুসংস্কার ছাড়া কিছুই মনে হয় না। কিন্তু যখন স্বয়ং দলাই লামার কণ্ঠেও একই বিশ্বাস প্রতিধ্বনিত হয় তখন বিষয়টি কৌতূহল জাগায় বইকি।
ঘটনার সূত্রপাত মাস তিনেক আগে। কেলং থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে গোম্পাতে ভাষণ দিতে আসার কথা দলাই লামার। গোম্পার শতকরা নব্বুইজন মানুষই বৌদ্ধ। তাছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত-সহ বিদেশ থেকেও বেশকিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর আসার কথা রয়েছে। তাই আয়োজনের কোনও ত্রুটি নেই। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে বানানো হচ্ছে বিশাল মঞ্চ। মঞ্চ তৈরির কাজ মসৃণভাবে এগোচ্ছিল। একদিন ঘটে গেল এক ঘটনা। মঞ্চ বানানোর জন্য আনা একটি
পাথরকে কিছুতেই স্বস্থানে রাখা যাচ্ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে সেখানকার মানুষ ততটা মাথা ঘামাননি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ঘটল আসল চাঞ্চল্যকর বিষয়টি। গোম্পায় এসে দলাই লামা ঘোষণা করলেন, গতরাতে তিনি একটি রহস্যময়। স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নে গৌতম বুদ্ধ তাঁকে জানিয়েছেন তিনি জন্ম নিয়েছেন পাথর রূপে। সে কারণেই সিমেন্ট দিয়ে তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও সবাই ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি লামাকে নির্দেশ দেন, পাথরটিকে অবিলম্বে একটি পরিষ্কার জায়গায় স্থাপন করার জন্য।
ঘুম থেকে উঠেই দলাই লামা মঞ্চের কাছাকাছি গেলেন। পাথরটিকে সেখান থেকে তুলে এনে নিজের কক্ষে পরিচ্ছন্নভাবে রাখলেন দলাই লামা। এখন সেটিকে একটি মন্দির বানিয়ে স্থাপন করার তোড়জোড় চলছে।
এতদিন পর্যন্ত প্যারাসাইকোলজিস্টদের মাথাজাত কলমের মধ্য দিয়ে যে সব পুনর্জন্ম হয়েছে, সে সবই মানুষ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগুরুদের চিন্তায় আমরা যেসব পুনর্জন্মের কথা পাই, সে’সব জায়গায় মনুষ্যেতর বিভিন্ন জীব রূপে জন্ম নেওয়ার কথা থাকলেও জড় রূপে জন্মের একটিও দৃষ্টান্ত মেলেনি। সেদিক থেকে দলাই লামা একটা দারুণ তত্ত্ব আমাদের জানালেন—জীব থেকে জড় পদার্থ হয়ে প্রাণীর জন্ম। অর্থাৎ প্রাণী প্রাণ নিয়ে জন্মালেও প্রাণ থাকবে না, জড় থাকবে। একেবারে দারুণ রকম অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব! কিন্তু ঘোরতর সন্দেহ হয়, এই তত্ত্ব প্যারাসাইকোলজিস্টরা খাবেন কি না!
কিন্তু দলাই লামার এমনতর কথাই কি প্রমাণ করে না, দলাই লামা পূর্বজন্মে কখনই তথাগত বুদ্ধ ছিলেন না! বুদ্ধ যদি পাথর হয়েই জন্মে থাকেন, তবে তো চতুর্দশ দলাই লামা হয়ে জন্মাননি!
হে চতুৰ্দশ দলাই লামা, আপনার প্রিয় ও বিশ্বস্তদের কাছ থেকে জেনেছি, আপনার একান্ত ইচ্ছে ‘ইনস্টিটিউট অফ টিবোটিয়ান প্যারাসাইকোলজি’ নামে একটা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের। এও জেনেছি এই ইনস্টিটিউট কাজ করবে আপনারই নেতৃত্বে এবং আপনারাই পরামর্শে। ইনস্টিটিউট কাজ শুরু করলে ব্যাপারটা দারুণ জমবে। এতাবৎকালের প্যারাসাইকোলজিস্টদের সঙ্গে আপনার মতাবলম্বী প্যারাসাইকোলজিস্টদের দস্তুরমত ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে যাবে।
মজাটা কি জানেন, প্যারাসাইকোলজিস্টদের হুদো-হুদো, গাদা-গাদা বইতে দেখতে পাবেন – দলাই লামাদের চোদ্দ জনই এক্কেবারে খাঁটি জাতিস্মর। নিক, এবার জাতিস্মরের হাতের মার সামলাক প্যারাসাইকোলজিস্টরা।
.
জাতিস্মর নিয়ে ১২তম সত্যানুসন্ধান
রামকৃষ্ণদেবের কথা সত্যি হলে, রামকৃষ্ণদেব আবার জন্মেছেন। সারদা মা’র কথা সত্যি হলে, রামকৃষ্ণদের আবার জন্মেছেন। অন্নদাঠাকুরের কথা সত্যি হলে, রামকৃষ্ণদেব আবার জন্মেছেন।
শ্রীশ্রী সারদা মা স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দজী’কে বলেছিলেন, “ঠাকুর (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব) বলেছিলেন যে একশো বছর পরে আবার আসবেন। এই একশ বছর (রামকৃষ্ণদেবের তিরোধান ও আবার জন্মগ্রহণের মধ্যবর্তী সময়) ভক্তহৃদয়ে থাকবেন।” [শ্রীশ্রীমায়ের কথা, লেখক : স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দজী, প্রকাশক : উদ্বোধন কাৰ্যালয়, প্রথম প্রকাশ ৩০শে ফাল্গুন, ১৩৪৩, অষ্টম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৫৯]
আর এক প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীসারদা মা বলেছেন, ঠাকুরের থাকবে “সন্ন্যাসীর বেশ। তিনি যে বাউল বেশে আসবেন বলেছেন। বাউলবেশ—গায়ে আলখাল্লা, মাথায় ঝুঁটি, এতখানা দাড়ি। বললেন, ‘বর্ধমানের রাস্তায় দেশে যাব, পথে কাদের ছেলে বাহ্যে করবে, ভাঙা পাথরের বাসন হাতে, ঝুলি বগলে।”
“বর্ধমানের রাস্তা কেন?” প্রশ্নের উত্তরে মা বললেন, “এইদিকে দেশ (জন্মস্থান)।” (শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃষ্ঠা-৩০১)
গ্রন্থটির প্রকাশক যেহেতু রামকৃষ্ণ মিশনেরই ‘উদ্বোধন কার্য্যালয়’ তাই স্বাভাবিক কারণেই রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ-ভক্ত ও রামকৃষ্ণ মিশন-ভক্তদের কাছে সারদা মা যে এ’কথাগুলো বলেছেন তা নিয়ে সামান্যতম সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যু হয়েছে ১৮৮৬ সালের ১৩ আগস্ট। সারদা মা’র কথা সত্যি বলে ধরলে রামকৃষ্ণদের আবার জন্মেছেন ১৯৮৬ সালে। হয়তো বা ১৬ আগস্টই। অর্থাৎ নবকলেবরে রামকৃষ্ণদেবের বর্তমান বয়স সাড়ে আট বছর (এই গ্রন্থটি প্রকাশকালে)।
আদ্যাপীঠের আদ্যামা’র মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ও আদ্যাশক্তি মহামায়ার পরম ভক্ত শ্রীশ্রীঅন্নদাঠাকুর তাঁর ‘স্বপ্নজীবন’ গ্রন্থে লিখছেন, “ঠাকুর (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ) প্রফুল্ল বদনে যেন আমায় অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে দিতে বললেন, ‘অন্নদা! তুমি যখন জগতের মঙ্গলের জন্য এরূপ কঠোর ভার বহন করতে প্রস্তুত, তখন বলি শোন; তোমার ভয় নেই। আমার দেহরক্ষার বত্রিশ বছর পরে আমি আবার বাংলায় যাচ্ছি। সেই দেহরক্ষার সত্তর বছর পরে আমি আবার যাব; এইভাবে আমি আরও এগারো বার অবতীর্ণ হব। যতদিন না বাংলার জনসাধারণ আধ্যাত্মিক ভাবে অনুপ্রাণিত হয়, ততদিন আমায় এইভাবে যেতে হবে।” [স্বপ্নজীবন, অন্নদাঠাকুর, প্রকাশক : দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ, আদ্যাপীঠ, সুলভ সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৮৯, পৃষ্ঠা-220]
শ্রীশ্রীঅন্নদাঠাকুরের কথা সত্যি বলে ধরলে রামকৃষ্ণদেব জন্মেছেন ১৮৮৬+32=১৯১৮ সালে। অর্থাৎ, বর্তমানে রামকৃষ্ণদেবের বয়স ৭৭ বছর।
একটু মুশকিলে পড়েছি আমরা সব্বাই। শ্রীশ্রীসারদা মা আর শ্রীশ্রী অন্নদাঠাকুর দু’জনেরই বিপুল সংখ্যক ভক্ত। দু’জনেই ভক্তদের কাছে ‘সত্যের প্রতীক’। কিন্তু দু’জনের কথাই তো একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না! সারদা মা’র কথা সত্যি হলে রামকৃষ্ণদেবের বর্তমান বয়স সাড়ে আট বছর। আর অন্নদাঠাকুরের কথা সত্যি হলে রামকৃষ্ণদেবের এখন বয়স ৭৭ বছর।
যাই হোক, এ’জন্মে রামকৃষ্ণদেবের বর্তমান বয়স কত, এই বিতর্কে না গিয়ে আমরা শুধু এটুকু নিশ্চয়ই বলতে পারি সারদা মা ও অন্নদাঠাকুরের কথা মত রামকৃষ্ণদেব নবকলেবরে এই বাংলায় জন্মেছেন। কিন্তু আমাকে যা বিস্মিত করেছে, তা হল—এত বছর হয়ে গেল ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব জন্মালেন, তাঁকে খুঁজে বের করতে রামকৃষ্ণ মিশন উদ্যোগের কুটোটি পর্যন্ত কেন নাড়ল না? অনেকগুলো ‘তবে কি’ যে কোনও সাধারণ বুদ্ধির মানুষের মাথায় আসতে বাধ্য। তবে কি মিশন কর্তৃপক্ষ সারদা মা’র কথায় বিশ্বাস করেন না? তবে কি রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ রামকৃষ্ণদেবের কথায় বিশ্বাস করে না? তবে কি ওঁরা অন্নদাঠাকুরের কথায় বিশ্বাস করেন না? তবে কি ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’ গ্রন্থের লেখকের কথায় মিশন কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন না? এমন নয় তো, জ্ঞানের নতুন উন্মেষে রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ আত্মার অমরত্বে এবং জন্মান্তরে আর বিশ্বাস করে না? যদি জন্মান্তরে বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলেই মনে করে থাকেন, তবে এখনও এমন লেখা কতৃপক্ষ ছেপে ও বিক্রি করে চলেছেন কেন? সারদা মা’র প্রতি রামকৃষ্ণদেবের এই ধরনের বক্তব্যকে বর্তমানে মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে অসার মনে হয়ে থাকলে মিশন কর্তৃপক্ষের কি নৈতিক দায়িত্ব ছিল না, এই বিষয়ে তাঁদের মতামত স্পষ্টভাবে ভক্তদের কাছে ব্যক্ত করা? নাকি রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবরে আবির্ভাব বিষয়ে নীরবতার পিছনে ক্রিয়াশীল রয়েছে অর্থ ও কর্তৃত্ব হারাবার শঙ্কা?
‘৮৯-এর ২৭ আগস্ট আমি বেলুড় মঠে গিয়ে স্বামী ভূতেশানন্দের কাছে উপরের প্রশ্নগুলোই তুলেছিলাম। উত্তর পাইনি। সম্ভবত উত্তর দেওয়ার মত কিছু ছিল না বলেই পরিবর্তে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, এবং তাঁর সচিব আমার উপর উন্মত্তের মত ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, যুক্তির ঘাটতি মেটাতেই হাজির হয়েছিল উন্মত্ত ক্রোধ।
হায়! রামকৃষ্ণ মিশনের মহান অধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ, এই প্রসঙ্গে আপনারা কোনওভাবেই নিজেদের সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলেন না। মিশন কর্তৃপক্ষ যদি বিশ্বাস করতেন রামকৃষ্ণ, সারদা ও অন্নদাঠাকুর সত্যভাষী, যদি বিশ্বাস করতেন জন্মান্তর সত্যিই সম্ভব, যদি রামকৃষ্ণদেবের প্রতি একটুও আন্তরিকতা বা শ্রদ্ধা থাকত, তাহলে ওরা স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার শতবর্ষ পালনের রাজসূয় যজ্ঞের চেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্ব দিতেন রামকৃষ্ণকে সসম্মানে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার উপর।
যাঁরা মনে করছেন বিবেকানন্দ অনেক বেশি যুগোপযোগী বলেই রামকৃষ্ণ মিশন কৃর্তৃপক্ষের কাছে বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে এ’বার এমন প্রমাণ হাজির করব, যা শুনলে বাক্যহারা হবেনই। স্বামী বিবেকানন্দও কিন্তু ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছেন এবং তা বর্ধমানেই। না, না, এ’সব আমার মত ভক্তিরস ও বিশ্বাসরসে বঞ্চিত মানুষের কথা নয়, এ’কথা বলেছেন স্বয়ং শ্রীশ্রীসারদামা এবং শ্রীশ্রীঅন্নদাঠাকুর। ওঁদের কথামত রামকৃষ্ণদেব তাঁর পার্ষদদের নিয়েই জন্মেছেন। জন্মেছেন স্বয়ং সারদা মা’ও। রামকৃষ্ণদেব যখন সারদাকে বলছেন তিনি আবার জন্মাবেন তখন সারদা মা বলছেন, “আমি বললুম, ‘আমি আসতে পারব না।’ লক্ষ্মী বলেছিল, ‘আমাকে তামাক কাটা করলেও আর আসব না।’ ঠাকুর হেসে বললেন, ‘যাবে কোথা? কলমীর দল, এক জায়গায় বসে টানলেই সব এসে পড়বে।” [শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃষ্ঠা ২৫৯] অন্নদাঠাকুর তার ‘স্বপ্নজীবন’ গ্রন্থেই লিখেছেন, রামকৃষ্ণদেবের ১৮ জন ভক্ত ১২৮ অংশে আসবেন। তাঁর মধ্যে বিবেকানন্দ জন্মাবেন তিনটি অংশে। একটি ব্রাহ্মণ, একটি কায়স্থ, একটি বৈদ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে মিশন কর্তৃপক্ষের কি উচিত ছিল না, মৃত বিবেকানন্দের স্মৃতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞ না করে জীবত বিবেকানন্দকে খুঁজে বের করে মিশনে নিয়ে আসা?
ইতিমধ্যে রামকৃষ্ণদেবের পুনরাবির্ভাব নিয়ে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। যোগী যোগানন্দ সর্বতীর্থ বর্ধমানে একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ১০ জুলাই ‘৮৭ এক এফিডেফিট করে দাবি করেছেন, “যুগাবতার শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব লীলা সংবরণ করার পর পুনরায় নব কলেবরে সপার্ষদ একশত বৎসর গতে অবতীর্ণ হওয়ার বৃত্তান্ত আমি অপ্রাকৃতিক জ্ঞানচক্ষু দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়াছি এবং তাঁহাদের বর্তমান স্থূল শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা সংস্থা গ্রহণ করলে আমি তাঁহাদের সনাক্ত করিতে সক্ষম, ইহা আমার জ্ঞান মতে সত্য।”
শুধু এই এফিডেবিট করেই থেমে থাকেননি যোগী যোগানন্দ। তিনি যে বাস্তবিকই সপার্ষদ রামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করেছেন, তাঁর এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি পাঠালেন রামকৃষ্ণ মিশনের গম্ভীরানন্দজীকে, ‘ইসকন’-এর সেক্রেটারিকে এবং তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে।
মৌনী যোগী যোগানন্দ সর্বতীর্থ ইতিমধ্যেই পত্র-পত্রিকায় বেশ প্রচার পেয়েছেন তান্ত্রিক হিসেবে। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা চালাচালি হয়েছে। অর্থাৎ, আমি কথা বলেছি মুখে, যোগানন্দ লিখে।
যোগী যোগানন্দের কথায়, ১৯৮৫ সালে হিমালয়ে থাকাকালীন তিনি দৈব আদেশ পান, এবং তারপর শ্রীগুরু রামকৃষ্ণদেবের ইচ্ছা অনুসারেই তিনি আদালতে এফিডেবিটের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে চেয়েছিলেন, রামকৃষ্ণদেবের সপার্ষদ জন্মগ্রহণ করেছেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সপার্ষদ মানে, তাঁরা সংখ্যায় কতজন?”
লিখে উত্তর দিলেন, “ঠাকুর রামকৃষ্ণের আঠারো জন ঘনিষ্ঠ ভক্তই জন্মেছেন।”
অন্নদাঠাকুর তাঁর ‘স্বপ্নজীবন’ গ্রন্থের ২২০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, রামকৃষ্ণদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, “আমার গতবারের আঠার জন ভক্ত এক’শ আঠাশটি শরীর চালনা করে তোমার কাজের সহায়তা করতে আবার বাংলায় যাচ্ছে”। সারদা মা’ও একই কথা বলেছেন, সে নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি।
যোগানন্দের কথায়, তিনি গতজন্মে ছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভক্ত স্বামী অদ্ভুতানন্দ। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব চার অংশে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিবেকানন্দ তিন অংশে।
অর্থাৎ, বিভক্ত হওয়ার একটা নতুন তত্ত্ব আমরা এই আলোচনা থেকে পেলাম। তেমনই জানতে পারলাম রামকৃষ্ণ এ’বার জন্মেছেন চার ভাগে বিভক্ত হয়ে। বিবেকানন্দ জন্মেছেন তিনজন হয়ে।
যোগানন্দ আমাকে লিখিতভাবে বাড়তি জানালেন, তিনি তাঁর জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা দেখতে পাচ্ছেন, আমার (প্রবীর ঘোষের) এই বর্তমান জীবনের আগে আরও দুটি মনুষ্য জীবন আমি লাভ করেছিলাম। প্রথম জন্মে ছিলাম মহাকবি কালিদাস, দ্বিতীয় জন্মে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এমন রোমাঞ্চকর পূর্বজন্মবৃত্তান্ত জেনেও পুলকিত হলাম না দেখে তিনি দুঃখিত হলেন।
দুঃখ রামকৃষ্ণ মিশনও তাঁকে কম দেয়নি। তারই ফলশ্রুতিতে যোগী যোগানন্দ লিখলেন, “বিনীতভাবে জানাই হিন্দু-ধর্মের শাশ্বত অনুশাসন “ব্রহ্ম বাক্য নিষ্ফল হবে না” কি মিথ্যা বলিয়া পরিগণিত হইবে? ঠাকুর রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম যদি না হয় তাহা হইলে হিন্দুধর্ম শাস্ত্র ও রামকৃষ্ণ তত্ত্ব মিথ্যা বলিয়া পরিগণিত হইবে।”…..
… “গুরু-ভাইবোন ও যুক্তিবাদী মানুষের কাছে আবেদন, রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করুন রামকৃষ্ণ তত্ত্বের সত্যতা যাচাই-এর জন্য।”
যোগানন্দ কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন একটিই উদ্দেশ্য নিয়ে – আমি যেন যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে এই বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে নামি।
যোগানন্দের গুরুভাই তান্ত্রিক প্রভাতকুমার ভট্টাচার্যও একদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার-এর সম্পাদক, আদ্যাপীঠের সম্পাদক ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দিয়ে সপার্ষদ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে খুঁজে বের করে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার অনুরোধ জানান; আর একদিকে এ বিষয়টিকে নিয়ে সত্যানুসন্ধানের কাজে এগিয়ে আসতে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতিকে অনুরোধ জানান।
প্রভাতকুমার ভট্টাচার্য বামাখ্যাপার গুরুদেব প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসেই তাঁর তন্ত্র-সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে সপার্ষদ রামকৃষ্ণ খোঁজার সাধনা।
বর্ধমান জেলার আর এক নামী যোগী তিমিরবরণ রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতির কাছে এক লিখিত আবেদন রাখেন। আবেদনে তিমিরবরণের স্বাক্ষরের তারিখ ১৬ নভেম্বর, ১৯৮৭। আবেদনটিতে তিনি এক জায়গায় লিখছেন, “হিন্দু ধর্মের আর একটি চিরস্থায়ী সত্য ব্রহ্মবাক্য। অর্থাৎ যে মানুষ ব্রহ্মকে জানিয়াছেন, তাঁহার বাক্য বা শপথ কোন দিনই মিথ্যা হয় না। এমতাবস্থায় হিন্দুধর্মের সর্বশেষ অবতার পুরুষ “ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের” বাক্যের সত্যতা পরীক্ষা এবং তাহার মূল্যায়ণ সাপেক্ষ হিন্দু ধর্ম্মের “আত্মা তত্ত্ব” বা “জন্মান্তরবাদ”-এর সত্যতা পরীক্ষার সুযোগ বিশ্ববাসীর বিচারশালায় বর্তমানে অবস্থান করিতেছে।
“ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজে কিছু লিখে যাননি। তাঁহার শ্রীমুখ নিঃসৃত বিভিন্ন বাণী তৎকালীন তাঁহার পার্শ্বচররা যাহারা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, সেইগুলির গুরুত্ব বিচারে সর্ব্বোচ্চ স্থান দখল করিতে পারিয়াছে বলিয়াই ঠাকুর রামকৃষ্ণ আজ বিশ্ববক্ষে স্বীকৃত একজন মহাপুরুষ। সেই ঠাকুর রামকৃষ্ণই বলিয়া গিয়াছেন যে তিনি একশত (১০০) বৎসর বাদে পৃথিবীতে পুনরায় আসিবেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী শ্রীশ্রীসারদা মাতা আরও পরিষ্কারভাবে জানাইয়া গিয়াছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ বাউল বেশে বর্দ্ধমানের রাস্তা দিয়া যাইবেন এবং সপার্ষদ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইবেন। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা সংবরণ করিয়াছেন ১৮৮৬ খৃস্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট।
“অপর জায়গায় জানা যায়; ঠাকুর বলিয়া গিয়াছেন, “তাঁর মৃত্যুর পর যেদিন পঞ্চবটীর ডাল ভেঙে আসনে পড়বে সেদিন জানবি আমি জন্মেছি।”
“শোনা যায় এই পঞ্চবটীর ডাল ভাঙিয়া পড়িয়াছিল আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি (৬৫) বৎসর আগে। এমত অবস্থায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ ব্রহ্মবিদ্ মহাপুরুষ হইলে তাহার বাক্য নিষ্ফল হইতে পারে না।”
“পঞ্চবটীর ডাল ভাঙিয়া পড়িল; শ্রীশ্রী ঠাকুরের লীলা সম্বরণ করার সময়কালও একশত বৎসর অতিক্রান্ত হইল, কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের পুনরাগমন তত্ত্বের উপর কোনও হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কোন রূপ ভ্রূক্ষেপ নাই। এক্ষেত্রে শ্রীশ্রী ঠাকুরের পুনরাবির্ভাবের যদি মূল্যায়ণ না হয়, তবে সমালোচনার খাতিরে বলিতে হইবে যে, “হয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ তত্ত্ব মিথ্যা! নয়তো রামকৃষ্ণ মিশনের এমন কোনও আধিকারিক দিব্য চক্ষুর অধিকারী হইতে সমর্থ হন নাই, যাহার সাহায্যে তাঁহারা ঠাকুরের পুনরাবির্ভাব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হন! অথবা হয়ত তাহারা সকল কিছু জ্ঞাত থাকিয়াই গদীর মোহে আকৃষ্ট থাকিবার পরিপ্রেক্ষিতে ঠাকুরকে লোক সামক্ষে প্রতিষ্ঠা করিতেছেন না।”
“ঠাকুর রামকৃষ্ণের বক্তব্যের সত্যতা রক্ষা করার দায়িত্ব রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু সমাজের। কিন্তু গত ৬৫(পয়ষট্টি) বৎসরের মধ্যে তাঁহারা সে বিষয়ে কৃতকার্য্য হন নাই, তাই সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ও সমস্ত শ্রদ্ধাভাজন গুরু শ্রেণীর নিকট আরেদন, হিন্দু ধৰ্ম্মকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহারা কৃপা করিয়া তাঁহাদের যোগশক্তি দ্বারা প্রমাণ করুন, ঠাকুর রামকৃষ্ণের পুনরাবির্ভাব। আর সেই সঙ্গে সকল হিন্দুর কাছে আবেদন রাখছি, তাঁরা সমভাবে ভাবাপন্ন হইয়া চাপ সৃষ্টি করুন রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের উপর, ঠাকুরের পুনরাবির্ভাবের মূল্যায়ণের জন্য। নতুবা হিন্দু ধর্ম্মের অস্তিত্ব মিথ্যায় পর্যবসিত হইবে। আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ মিথ্যাবাদী রূপে পরিগণিত হইবেন।”
যোগী তিমিরবরণ তাঁর এই আবেদনে যে পঞ্চবটীর ডাল ভাঙার সঙ্গে রামকৃষ্ণের পুনর্জন্মকে সম্পর্কীত করেছেন, সে বিষয়ে নজর দিতে আমরা এ’বার ফিরে তাকাব অন্নদাঠাকুরের লেখা ‘স্বপ্নজীবন’ বইটির ২২৩ পৃষ্ঠায়। সেখানে আছে অন্নদাঠাকুরের সঙ্গে রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নিয়ে কথোপকথনের কিছু অংশ।
অন্নদাঠাকুর রামকৃষ্ণকে বলছেন, “আপনি আবার আছেন। তার কোন প্রমাণ আমরা পাব কি?”
‘হ্যাঁ,তার একটা ছোট খাট প্রমাণ আমি বলে দিচ্ছি : শোন–দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীমূলে বাঁধান সিদ্ধাসনের উপর দিয়ে যে একটা বড় ডাল পড়ে আছে, বাংলায় আমার পুনরাবির্ভাব হওয়ার পর; সেই ডালটি মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমার আসন মুক্ত করে দেবে’
রামকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্ত শিষ্যদের পুনর্জন্ম নিয়ে সত্যানুসন্ধানের উদ্দেশ্যে বর্ধমানে যাওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ল। বর্ধমান গেলাম ১৯৮৯-এর আগস্টে। এখানে পেলাম দুই ব্যক্তিকে, যাঁদের দাবি, তাঁরা পূর্বজন্মে রামকৃষ্ণ ছিলেন। কথা বলেছি পূর্বজন্মে স্বামী বিবেকানন্দ, সারদা মা ও নটি-বিনোদিনী ছিলেন—এমন দাবিদারদের সঙ্গে। আসুন, তাঁদের কথা আপনাদের শোনাই।
ভোলানাথ অধিকারী। তখন থাকতেন বর্ধমান শহরের ‘বাইলা পাড়া’য়। জন্ম ১৯৩৪ সালে। মাঝারি উচ্চতা। না রোগা, না মোটা। গায়ের রঙও মাঝারি; না ফর্সা, না কালো। কাঁচা-পাকা একমুখ গোঁফ-দাড়ি। মাথার চুল ঝুঁটি করে বাঁধা। পরনে আধ-ময়লা সাদা ধুতি ও সুতির পাঞ্জাবি। কথায়—গ্রাম্য-ছোঁয়া, একটা আলা- ভোলা ভাব।
আমার এক প্রশ্নের উত্তরে ভোলানাথ জানালেন, “রামকৃষ্ণই যে রামকৃষ্ণ, সেটা আবার রামকৃষ্ণকে প্রমাণ করতে হবে? ভারি মজার তো! রামকৃষ্ণ মিশন! আমার নামে মিশন! ওরা তো সব মরছে গু ঘেঁটে। মরুক ওরা ক্ষমতা আর ভোগ নিয়েই। আমাকে নিয়ে গেলে ওদের সব এক একটাকে….
এক একটাকে কি করবেন, সেটা ছাপার অযোগ্য ভাষায় বললেন ভোলানাথ। ভোলানাথ অধিকারী আরও একটি নতুন তথ্য দিলেন। জানালেন, রামকৃষ্ণের আত্মার চার অংশের এক অংশ যেমন তাঁর এই স্থূল শরীরে অবস্থান করছে, তেমনই এই শরীরেই রয়েছে সাধক বামাখ্যাপা’র আত্মা। সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী তিনি। সংসারের ঘানি টানছেন, কিন্তু মন পড়ে আছে মা’য়ের চরণে। বিয়ে করেছেন। তিন মেয়ে। দু’জনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী সাধন-সঙ্গিনী। এ’জন্মে নতুন করে দীক্ষা নিয়েছিলেন তারাপীঠের শ্রীমৎ তারাযোগী মণিবাবা’র কাছে। সংসার চালাতে চায়ের দোকান চালান। কাউকে প্রথাগত দীক্ষা দেননি। বললেন, “দীক্ষা আমি দেবার কে? আমার সঙ্গে বিভোর হয়ে নাম গান যে করে, ‘তিনিই’ তার দীক্ষা দেন। নাম গান বলতে—”জয় তারা জয় রাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম”।
আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভোলানাথের ভাব সমাধি হলো। দু’হাতে রামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত মুদ্রা। মিনিট পাঁচ-সাত পরে সমাধি ভাঙতে বললেন, “গত জন্মের ভাব-সমাধির ব্যারামটা এ’জন্মেও আমার সঙ্গ ছাড়েনি।”
—”মা’কে (কালী) চাক্ষুস কখনও দেখেছেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
— “এতো সব সময়ই দেখছি।”
—”সে তো মনের চোখে। এই যেমন আপনি আমাকে দেখছেন, সেভাবে কখনও দেখেছেন। “
—”হ্যাঁ, তাও একবার দেখা গিয়েছিল বেটিকে।”
—”ঘটনাটা যদি একটু বলেন।”
—”সে বছর কয়েক আগের কথা। গেছি মাছের বাজারে। হঠাৎ এক মেচুনির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। আরে! এতো মেছনির বেশে মা।”
—”দেখতে কেমন, মনে আছে?”
—”যুবতী সাঁওতাল মেয়েছেলের মত।”
—”তারপর কি হল?”
—”বাচ্চা ছেলের মতই দুষ্টুমী মাথায় চাপল। ইচ্ছে হল, মায়ের দুধ খাব। মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে বললাম—’মা তুই অসুর কাটা ছেড়ে মাছ কাটতে বসেছিস? আমি যে তোরই ভক্ত রামকৃষ্ণ, আমাকে চিনতে পারছিস না। আমাকে তোর কোলে নে মা।’ বেটী তো রসিক কম না। বললো এই বয়সে আমার কোলে চেপে করবি কি?’ টপ্ করে বলে ফেললাম, “তোর মাই খাব’। মা’র পরনে তো ব্লাউজ ছিল না, বুকের কাপড়টা সরিয়ে মাইটা বার করে বলল, ‘নে খা’। আমিও দু’হাতে মাইটা ধরে খেতে লাগলাম।”
ভোলানাথ তাঁর পাশে বসা সাধন-সঙ্গিনী স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে অদ্ভুত রকম লালা-ঝরানো হাসি হেসে বললেন, “বাজার ভর্তি লোক তখন আমাদের লীলা দেখছিল।”
ভোলানাথের এমনতর ব্যবহারকে কি চোখে দেখবেন প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা? শিশুর সারল্য? বদমাইসি? নাকি পাগলামো?
ভোলানাথের চিন্তার যে ঝলক একটুক্ষণের জন্য উদ্ভাসিত করেছিল তাঁর চরিত্রের একটি দিককে, তাকে আলোয় আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই এখানে হাজির করেছি, বে-আব্রু করেছি।
.
নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। চেম্বার ছিল বর্ধমানের ‘শাঁকারিপুকুর’-এ। দীর্ঘদেহী। এক সময় যে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, বোঝা যায়। রামকৃষ্ণের মত দাড়ি-গোঁফ। জন্ম ১৯৪১ সালে।
নীলমণিবাবুর ‘গোলহাট’-এর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। ঘরে দারিদ্রের চিহ্ন প্রকট। একজন পাস করা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের এমন দরিদ্রতা কিছুটা অস্বাভাবিক। তবে কি চেম্বারে বসেন না নিয়মিত? অনুমানটা মিলে গেল, যখন নীলমণিবাবু বললেন, “সংসার চালাতে প্রতিটি দিন চেম্বারে গিয়ে বসা, ইচ্ছে করে না। সংসারের ঘানিতে কলুর বলদের জীবন, ভাল লাগে না। কিন্তু যে জন্য এ’জন্ম নেওয়া, সেকাজই বোধহয় অপূর্ণ থেকে যাবে।”
“এ’জন্ম নেওয়া মানে? আপনি কি বাস্তবিকই বিশ্বাস করেন, আপনার একটা গতজন্ম ছিল?” প্রশ্ন করেছিলাম।
আমার প্রশ্নে নীলমণিবাবু রাগ করলেন না। বরং বড় করে হেসে বললেন, “এ’তো সেই ধরনের প্রশ্ন হয়ে গেল—আপনার কি জন্মদাতা বাবা ছিল? আমি যে গতজন্মে রামকৃষ্ণ ছিলাম এ’কথা প্রমাণ করে দিতে পারি। নিয়ে আসুন রামকৃষ্ণ মিশনের মাথাদের, যারা আমার নাম করে দিব্বি করে-কম্মে খাচ্ছে। ওইসব ক্ষমতালোভী, অর্থলোভীগুলোকে বিশ্বাস করি না। ওরা কখনোই আসবে না। আমি, বিবেকানন্দ, সারদা—আমার মাথার চূড়োয় বসলে ওরা যে চূড়ো থেকে গড়াতে শুরু করবে। চূড়ো ছোট্ট জায়গা তো, বেশি লোক আঁটবে কি করে? নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে চাইলে আমাদের খুঁজে নেয় কখনো ওরা। রাজীব গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত, বর্ধমানের কংগ্রেস নেতা নারায়ণ চৌধুরীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম, আপনারা সত্যিই রামকৃষ্ণভক্ত হলে একবার আসুন। প্রমাণ করে দেব আমি গত জন্মে রামকৃষ্ণ ছিলাম।”
“কি করে প্রমাণ করবেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, এই বাড়ির নিচে ছ’ফুট খুঁড়লে পাওয়া যাবে একটা শিব মন্দিরের চূড়ো। মন্দিরের ভিতরে আছে এক বিশাল শিবলিঙ্গ, লিঙ্গটি বিচিত্র। মাথায় রয়েছে তিনটি ছিদ্র। মন্দিরে আছে মোহর ভর্তি ছ’টা সোনার ঘড়া। ঘড়াগুলি চেন দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। মন্দিরে রয়েছে বহু সোনার পাত। পাতগুলোতে রয়েছে বহু বাণী ও ভবিষ্যৎবাণী। বাণীর ভাষা হিব্রু ও সংস্কৃত। এমনই একটা পাতে রয়েছে আমার ঠিক আজকের দিনটিতেই এখানে সত্যানুসন্ধানের কাজে আসার ভবিষ্যদ্বাণী। আর একটি পাতে লেখা আছে—নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায়ই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব। এরচেয়ে বড় আর কি প্রমাণ চাই? এমনি বহু সোনার পাতে লেখা আছে চার হাজার খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহু ঘটনার আগাম হদিস।
নীলমণিবাবু হাতে গরম প্রমাণ পেতে আমাকেই খোঁড়াখুঁড়ির দায়িত্বটা নিতে বললেন। আমি অবশ্য ও কাজটা রামকৃষ্ণ মিশনের জন্যেই ছেড়ে এসেছি। সাত ঘড়া সোনার হদিস নিয়ে বসে থাকা এ’জন্মের রামকৃষ্ণদেবকে বলেছিলাম, “ফিরে গিয়ে আপনার কথা জানাব রামকৃষ্ণ মিশনকে। ওঁরাই এসে খুঁজে দেখুন, এবং আপনার কথা সত্যি হলে সাত ঘড়া সোনা আর আপনাকে নিয়ে যাবে পরম সমাদরে। কিন্তু আপনি এ’সব কথা জানলেন কি করে? নিজে খুঁড়ে দেখেছেন?”
‘আত্মা’ সম্বন্ধে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে জানালেন, আত্মা সর্বত্রগ্রামী। ব্রহ্মদর্শী মহাপুরুষ মাত্রই আপন আত্মার নিয়ন্তা। নীলমণিবাবুর আত্মা বহুবার গিয়েছিলেন মন্দিরের অভ্যন্তরে। একইভাবে তিনি তাঁর আত্মাকে বিভিন্ন সময়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরেও নিয়ে গিয়েছেন।
এ’জন্মেও সাধনা করেছেন তন্ত্র মতে, মুসলিম মতে ও খ্রিস্ট মতে। ঘরের দেওয়ালে তিনটি ফ্রেমে বাঁধাই ছবি। তিনটি ছবি তাঁরই। একটিতে তিনি মোম জ্বেলে খ্রিস্টের উপাসনায় রত। একটিতে তিনি মসজিদে নামাজরত। আর একটিতে তিনি মায়ের পুজোয় বিভোর। ঘরের দেওয়ালে পাদ্রির পোশাক, বাউলের পোশাক, নামাজের টুপি সবই সাজানো রয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, “গতজন্মের কোনও পার্ষদের খোঁজ পেয়েছেন ইতিমধ্যে?”
হাসলেন নীলমণিবাবু। বললেন, “কলমীর দল। একটা ধরে টানলেই সব এসে পড়বে। যাবে কোথায়? ওদের অনেকে তো আমার সংসারে এসে উঠেছে।”
সংসার বলতে বউ, তিন মেয়ে ও দু’ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম, “এঁদের মধ্যে কে কে আপনার পার্ষদ ছিলেন?”
উত্তরে নীলমণিবাবু জানালেন, এ জন্মের বড় ছেলের কাছেই তিনি গতজন্মে ইসলাম ধর্ম মতে সাধনার পাঠ নিয়েছিলেন। ছোট ছেলে হলো সঞ্জয় গান্ধী। সঞ্জয় গান্ধীকেও এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নীলমণিবাবু। আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি সঞ্জয়। তাঁর এখানে আসার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল। আর সেই ইচ্ছেই তাঁকে টেনে এনেছে এখানে। গতজন্মের স্ত্রী সারদা এ’বার জন্মেছেন কন্যা রূপে।
—”আর আপনার পত্নী?” জিজ্ঞেস করলাম।
“ও ছিল গতজন্মে নটী বিনোদিনী।” নীলমণিবাবু বললেন।
জিভের ডগায় যে প্রশ্ন সুড়সুড় করে এসে পড়েছিল, তাহলো, “গতজন্মে আপনি কি নটী বিনোদিনীকে দেখে পত্নী রূপে মনে মনে গভীরভাবে কামনা করেছিলেন? তারই ফলশ্রুতিতে কি বিনোদিনী এ জন্মে আপনার পত্নী, এবং তাঁর গর্ভে আপনার পাঁচটি সন্তান?”
সেদিন নীলমণিবাবুকে যে প্রশ্ন না করেই বেরিয়ে এসেছিলাম, যাঁরা নীলমণিবাবুর দাবিকে সত্য বলে মনে করেন, তাঁরা সেই না করা প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পারেন। প্যারাসাইকোলজিস্টরা এই প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন, যেহেতু তাঁরাও মৃত ব্যক্তির ইচ্ছে, অনিচ্ছের সঙ্গে পরবর্তী জন্মের অনেক কিছুকেই জুতে দেন।
.
ডাঃ হেমাঙ্গশঙ্কর উপাধ্যায়। থাকেন বর্ধমান শহরের শাঁখারীপুকুর, চণ্ডীতলায়। জন্ম ১৯২৮ সালে। মাঝারি উচ্চতা, আঁটোসাঁটো চেহারা। গায়ের রঙ ফর্সা। টিপ্প থাকতে ভালবাসেন। চোখ আর হাসি, দুটিই ঝকঝকে। অনেকেই বলেন, উনি নাকি পূর্বজন্মে বিবেকানন্দ ছিলেন। সরকারি কর্মচারী যে ছিলেন, সে কথাও জানালেন। অবসর নিয়েছেন ‘৮৫-তে। বর্তমানে বিজ্ঞান সম্মত দৈব (!) চিকিৎসা করেন। সঙ্গে এ’নিয়ে গবেষণাও। এই বিচিত্র চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কারক তিনি স্বয়ং। চিকিৎসা পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ‘ডিভাইনোথেরাপি’। এ এমনই এক সর্বরোগহর চিকিৎসা পদ্ধতি, যাতে ফুসকুড়ি থেকে এইডস সবই সারে।
কথায় এমনই মিষ্টি যে কোথায় যেন একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছিল। অনর্গল সুন্দর বাচনভঙ্গিতে কথা বলেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি কি নিজেকে বিবেকানন্দের অংশ বলে মনে করেন?”
হেমাঙ্গবাবু এক রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখে উত্তর দিলেন, “কোন কোন লোক আমার সম্বন্ধে একথা বলেন, জানি। কেউ কেউ এমন কথাও বলেন, এ খবর জেনেছেন জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা। এদের কথাকে সত্যি বা মিথ্যে কোনওটাই আমি বলছি না। আমি জানি, পূর্বজন্মে আমার পরিচয় কি ছিল। কিন্তু সে পরিচয় দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। যেদিন সময় আসবে, সেদিন আপনিই প্রস্ফুটিত হবো।
“এখন আমি এই জীবনে জীবে প্রেমকেই ঈশ্বর সেবার প্রতীক করে নিয়েছি। মানুষের শরীর ও মনকে সমস্ত রোগ ও গ্লানি থেকে মুক্ত করতে যে ‘ডিভাইন রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ তৈরি করেছি, সেই ইনস্টিটিউটও একদিন বিশ্বজয় সমাধা করবে।”
বলতে না চাওয়া মুখোশের আড়ালে ঠারে ঠোরে হেমাঙ্গবাবু এ’কথাই বোঝাতে চাইছিলেন—তিনিই গতজন্মের বিবেকানন্দ।
‘ডিভাইন রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ দেখেছি। হেমাঙ্গবাবুর ছোটখাট পাকা বাড়িটির একটি ছোট্ট ঘরেই ইনস্টিটিউটের কাজ-কর্ম চলে। কাজ চালান একজনই। তিনি হলেন, ইনস্টিটিউটের ডিরেকটর ডাঃ হেমাঙ্গশঙ্কর উপাধ্যায়।
.
বিবেকানন্দের পুনর্জন্ম কোথায়, কবে হয়েছে, সে নিয়ে একটা পাকা খবর দিয়েছেন বহু মানুষের চোখে ‘শ্রেষ্ঠ অধ্যাত্মবাদী নেতা’, ‘সাধনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছান যোগী’, ‘শ্রেষ্ঠ সাধক’, ‘অবতার’, ‘অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী’ নিগূঢ়ানন্দ।
নিগূঢ়ানন্দ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ও যোগবলের সাহায্যে জানতে পেরেছেন, বিবেকানন্দ জন্মেছেন উত্তর কলকাতায়। বয়স : এই বইটির প্রথম প্রকাশকালে বছরখানেক।
আরও দুটি তথ্য নিগূঢ়ানন্দ আমাদের সামনে হাজির করেছেন। এক : স্বামী বিবেকানন্দের আত্মা এ জন্মেও পূর্ব জন্মের কোনও সাদৃশ্য নিয়েই জন্মাবেন। দুই : এই অবক্ষয়ী ধরণীতে নতুন ‘কোনও যুগ সৃষ্টিকারীর ভূমিকা নেবেন।
এ সবই নিগূঢ়ানন্দ লিখে প্রকাশ করেছেন তার ‘জাতিস্মর’ গ্রন্থের (প্রকাশকঃ নবপত্র, প্রথম প্রকাশ : কলিকাতা পুস্তকমেলা, জানুয়ারি ১৯৯৪;) ১০৩ পৃষ্ঠায়।
এইসব পাকা খবর রামকৃষ্ণ মিশন ও রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ভক্তদের খুব কাজে লাগতে পারে ভেবেই এখানে হাজির করলাম। মিশন এই খবরটি গ্রহণ করে বিবেকানন্দকে নিয়ে এসে সসম্মানে নেতৃত্বে বসাবেন, কি খবরটিকে ‘ফালতু’ বলে বর্জন করবেন, সেই শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী মিশনের বর্তমান নেতৃত্ব। বহু ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুদের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তদের কাছে বিষয়টির গুরুত্ব আরও বহুগুণ বেশি হবার সম্ভাবনাই প্রবল। এইসব ভক্তিবাদে বিশ্বাসী, অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী মানুষদের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য নীতিগতভাবেই রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের উচিত নীরবতা ভঙ্গ করে স্পষ্ট ভাষায় তাঁদের মতামত জানান। তাঁর স্পষ্ট করে বলুন—নিগূঢ়ানন্দর কথা সত্যি? না; নিগূঢ়ানন্দ মিথ্যে বলে জনগণকে প্রতারণা করছেন? নিগূঢ়ানন্দ ভক্তদেরও উচিত, রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের এই জাতীয় নীরবতার গূঢ় রহস্য জনগণের কাছে উন্মোচন করা।
.
৪ অক্টোবর, ১৯৯৪ মহালয়ার দিন কলকাতার কাছেই বালি রবীন্দ্রভবন-এ একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল ‘প্রেক্ষণ’ নামের একটি সংগঠন। আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘বিবেকানন্দের সমাজ চেতনা’। আলোচক ছিলেন বেলুড় রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরের অধিক্ষক স্বামী অচ্যুৎআত্মানন্দ, বিবেকানন্দ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির অন্যতম সম্পাদক রাজেশ দত্ত ও ভারতের মানবতাবাদী সমিতির অন্যতম সম্পাদক সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার ভূমিকা ছিল, সভা পরিচালকের।
আলোচনা তুমুল জমজমাট হয়েছিল। এই আলোচনাসভা চলাকালীনই আমি একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম স্বামী অচুআত্মানন্দ’কে। প্রশ্নটি করার আগে মার্জনা চেয়ে নিয়েছিলাম আমার জিজ্ঞাসা আলোচনার সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় সম্পর্কীত না হওয়ার কারণে। বলেছিলাম, “আজকে আমরা বিবেকানন্দকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমেছি, আপনার মত অনেকেই বোঝাচ্ছেন বর্তমান সমাজে বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয়তা। আপনারা গত বছর সেপ্টেম্বরেই বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা’র শতবর্ষ পালন করলেন কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে। আপনারা ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’ বইতে ছাপছেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, সারদামা-সহ আরও অনেক রামকৃষ্ণ সঙ্গীদের আবার পৃথিবীতে জন্ম নেবার কথা। সে জন্ম নেবার সময় তো অতিক্রান্ত, আপনাদের বইয়ের কথা অনুসারেই অতিক্রান্ত। তবে কেন আপনারা তাঁদের খুঁজে বের করতে সর্বশক্তি দিয়ে সচেষ্ট হচ্ছেন না? অথচ এটাই তো হওয়া উচিত ছিল আপনাদের পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ। এমন স্বাভাবিক ও উচিত কাজে আপনাদের এই ধরনের অদ্ভুত ধরনের নীরবতা ও নিস্পৃহতা কেন? এর পিছনে দুটি মাত্র কারণ থাকতে পারে। (এক) আপনারা রামকৃষ্ণ, সারদা ও বিবেকানন্দের চিন্তা ও ভাবধারার প্রসারের কথা মুখে বললেও কাজে উল্টোটা চান। কোনও ভাবেই নিজেদের নেতৃত্বে ও কর্তৃত্ব হারাতে ইচ্ছুক নন। তাই শত ঠেলাতেও ওঁদের বর্তমান জন্মের আধারগুলোকে খুঁজে বের করতে এতই অনীহা। আপনারা রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ প্রমুখদের নিয়ে নানাভাবে নানা কথা বলেন ও লেখেন, বিক্রি ভাল হয় বলে, লোকে ভাল খায় বলে। রামকৃষ্ণ মিশন আজ আর আপনাদের কাছে কোনও আদর্শের সম্মিলিত শক্তি নয়, ক্ষমতায় থাকার মৌচাক।
“(দুই) আপনারা জানেন, ‘আত্মা অবিনশ্বর’ এই সেকেলে চিন্তার স্থান হওয়া উচিত আঁস্তাকুড়ে। আপনারা জানেন, ‘জন্মান্তরবাদ’ আর ‘অজ্ঞানতাবাদ’ সমার্থক শব্দ। আপনারা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের নেতারা তাই জানেন রামকৃষ্ণ যতই উচ্চরবে ঘোষণা করুন, তিনি আবার সপার্ষদ জন্মাবেন—বাস্তবে কোনও দিনই তা সত্যি হয়ে উঠবে না। অতএব সপার্ষদ রামকৃষ্ণকে খুঁজে বের করার চেষ্টা নেহাতই পাগলামি। এবং আপনারা জানেন, যাঁরা রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ইত্যাদি বলে দাবি করছেন, তাঁরা বাস্তবে হয় মানসিক রোগী, নয় তো প্রতারক।
“স্বামী অচ্যুৎআত্মানন্দজী, আপনি কি আপনাদের এই নীরবতার পিছনে এই দুটির বাইরে অন্য কোনও কারণ দর্শাবেন? অথবা বর্তমানে আপনারা নীরবতা ভঙ্গ করেছেন, এমন কোনও তথ্য দেবেন?”
স্বামী অচ্যুৎআত্মানন্দজী জবাব দিলেন। এবং বিচিত্র সেই জবাব। “আজকাল কত জায়গা থেকে কত কিছু যে ছেপে বেরুচ্ছে, তাই ঠিক ঠিকানা নেই। ‘শ্রীশ্রী মায়ের কথা’ বইতে নাকি আছে রামকৃষ্ণ সপার্ষদ জন্ম নেবেন। কিন্তু এই বইটির প্রকাশক কারা? যে কেউ ‘শ্রীশ্রী মায়ের কথা’ বলে একটা বইতে যা খুশি তাই ছেপে দিলে আমাদের কি করার থাকতে পারে?”
তাঁর জবাব কেড়ে নিয়েই আমাকে বলতে হলো, “আমি যে ‘শ্রীশ্রী মায়ের কথা’ বইতে রামকৃষ্ণদেবের সপার্ষদ আবার জন্ম নেবার কথা পড়েছি, সেই বইটির প্রকাশক কিন্তু আপনাদের রামকৃষ্ণ মিশনেরই প্রকাশন বিভাগ উদ্বোধন কার্য্যালয়। এরপর নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, আপনাদের এ’বিষয়ে অনেক কিছুই করার আছে।”
স্বামী অচ্যুৎআত্মানন্দজী এমনতর কথার মুখে কিঞ্চিত ঘাবড়ে গেলেন মনে হলো। শ্রোতাদের সামনে প্রসঙ্গ চাপা দিতে বললেন, “ঠিক আছে। বিষয়টা আমার ঠিক জানা নেই। বইটা দেখে নেব। যেমনটা প্রবীরবাবু বললেন, তেমনটা লেখা থাকলে নিশ্চয় চেষ্টা করব, মিশনের তরফ থেকে যাতে এ’বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।”
.
মাননীয় স্বামী অচ্যুৎআত্মানন্দজী, আমরা সকলেই (আমি, আমার সহযোদ্ধা, প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা এবং রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তরা) অধীর আগ্রহ নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পদক্ষেপ জানার অপেক্ষায় আছি। হয় আপনারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করুন— “আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ক তত্ত্ব ও জাতিস্মর তত্ত্ব নেহাতই কল্পনা মাত্র, এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।” নতুবা চিহ্নিত করুন সপার্ষদ রামকৃষ্ণদেবকে।
আপনারা চিহ্নিত করলে আমরা যুক্তিবাদী সমিতি আবারও সত্যানুসন্ধানে নামব এবং ফাঁস করব ধর্মের নামে জাতিস্মরতার নামে জালিয়াতির এক চক্রান্তকে চ্যালেঞ্জ রইল।
দুষ্টেরা বলেন, যুক্তিবাদী সমিতির ভয়েই নাকি সপার্ষদ রামকৃষ্ণদেবকে চিহ্নিত করতে রামকৃষ্ণ মিশন সাহস করছে না। ভয়টা বুজরুকি ফাঁসের।
এই প্রসঙ্গে আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। জন্মসিদ্ধ মহাপুরুষ (!) বালক ব্রহ্মচারীর তখন নির্বিকল্প সমাধির নাটক চলছে সুখচরে। হঠাৎ সাংবাদিকরা গোপন খবর পেলেন, বালক ব্রহ্মচারীর মৃতদেহ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে নাকি খাটে পড়ে থাকবে শুধু ফুল। আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের সামনে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে জনাকীর্ণ এক সভায় ঘোষণা করেছিলাম, বালক ব্রহ্মচারীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটলে আমরা আপনাদের সামনে প্রকাশ্যে মৃতদেহকে ফুল করে দিয়ে বুঝিয়ে দেব, ফুল হওয়ার পিছনে কোনও অলৌকিকত্ব নেই। আছে কৌশল, আছে প্রতারণা।
আমাদের এই চ্যালেঞ্জ-ঠোকা ঘোষণার কথা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল বহু পত্র-পত্রিকাতেই। এবং শেষ পর্যন্ত বালক ব্রহ্মচারীর দেহ আর ফুল হয়ে ফুটে উঠল না। দুষ্টেরা বলেন, আমাদের ভয়েই নাকি ফুল ফোটা সম্ভব হয়নি।
দুষ্টের কথা গ্রহণ করবেন কি বর্জন করবেন, সেটা আপনাদের (প্রিয় পাঠক- পাঠিকাদের) ব্যাপার। কিন্তু এ’বিষয়ে রামকৃষ্ণ মিশনকে তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য রাখার জন্য চাপ দেওয়াটা আপনার, আমার, প্রতিটি যুক্তিবাদী ও ভক্তিবাদীদের ব্যাপার হয়ে ওঠা উচিত; সত্য প্রকাশের জন্যেই উচিত, সুসংস্কৃতির জন্যেই উচিত।