অধ্যায় বারো – প্রথম সংস্কারক
খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৫০ সালের দিকে একজন সুমেরীয় রাজা দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে সিংহাসন হারিয়ে ফেলেন।
এটা চিন্তা করা খুবই কঠিন যে সুমেরীয়রা মিশরীয়দের মতো তাদের শাসকের হাতে ফারাওসুলভ ঐশ্বরিক ক্ষমতা তুলে দেবে।
সুমেরীয় নাগরিকরা নিশ্চিতভাবেই বিদ্রোহ করত, যদি তাদেরকে বলা হতো বিশ বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে হবে যার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে তাদের শাসকের মাহাত্ম্যকে প্রকাশ করা। সুমেরীয় রাজাদেরও তাদের প্রজাদের উপর এই ধরনের প্রভাব ছিল না। গিলগামেশের আমলে চারটি শহরের সমন্বয়ে তৈরি জোটটিই ছিল একীভূত সুমেরের সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ এবং সেটির স্থায়িত্বও গিলগামেশ জীবিত থাকা অবস্থাতেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। তার পুত্র উর-লুগাল উত্তরাধিকারসূত্রে রাজত্ব পেয়েছিলেন এবং সেটিকে অবিভক্তও রাখতে পেরেছিলেন; কিন্তু প্রায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে শহরগুলো অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মিশর বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয়নি বললেই চলে। কিন্তু সুমেরীয়দের সেই সুখ ছিল না; তাদেরকে গ্রাস করে নেওয়ার জন্য পূর্বের এলামাইটরা অপেক্ষমাণ ছিল।
যতদিন সুমেরীয়রা মেসোপটেমিয়ার সমতলভূমি দখল করে রেখেছিল ঠিক ততটা সময় ধরে এলামাইটরা উপসাগরের পূর্বে অবস্থিত তাদের নিজস্ব ছোটো ছোটো শহরে বসবাস করছিল। বেশির ভাগ প্রাচীন জাতি বা গোষ্ঠীর মতো তাদেরও মূল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; কিন্তু তাদের শহরগুলো শুধু কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণেই গড়ে উঠেনি বরং জাগরোস পর্বতমালার পূর্বে অবস্থিত বড়ো লবণাক্ত মরুভূমির পূর্বদিকের মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ সালের দিকে এলামাইটদের মাঝেও রাজাদের আবির্ভাব ঘটে। দুটি যমজ শহর—সুসা ও আওয়ান-তাদের সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করত। এদের মাঝে আওয়ান (যার প্রকৃত অবস্থান অজ্ঞাত) ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ানের রাজার হাতেই ছিল এলামাইটদের সর্বময় কর্তৃত্ব—অনেকটা কিশের রাজার মতো।
গিলগামেশের আমলের প্রায় দুইশ বছর পরের শিলালিপি থেকে আমরা সুমেরের চারপাশে অবস্থানরত প্রতিযোগীদের ব্যাপারে জানতে পারি। এলামাইটগণ, সুমেরীয় সমতলভূমির দুই শহর উরুক ও কিশ এবং এর সাথে ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তার পরিচায়ক শহর উর, লাগাশ ও উম্মা—অনেকগুলো অমীমাংসিত যুদ্ধ লড়েছিল নিজ নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংকল্পে।
সুমেরের রাজার তালিকায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নাম বাদ পড়েছে। এই তালিকায় কিছু রাজার নাম এমনভাবে এসেছে যাতে দেখে মনে হয় তারা পরপর এসেছেন কিন্তু আদতে তারা সবাই একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শহরের শাসনকর্তা ছিলেন আলাদা আলাদাভাবে। এই অবিন্যস্ততার কারণেই একটি সঠিক কালানুক্রম প্রতিষ্ঠা করা এত কষ্টকর। তবে আমরা এটুকু জানি যে গিলগামেশের পুত্র তার পিতার রাজত্ব পেয়েছিলেন; উরুককে দখল করে নিয়েছিলেন উর; এবং আওয়ান, যুদ্ধের মাধ্যমে উর শহরের দখল নিয়ে নিয়েছিলেন। এই তথ্য থেকে মনে হয় এলামাইটরা একটি বড়োসড়ো আক্রমণ চালিয়েছিল সুমেরের উপর। সম্ভবত এই কারণেই কিশের পরবর্তী রাজাদের মাঝে আমরা এলামাইটদের নাম খুঁজে পাই।
তবে সুমেরের প্রতিটি শহর এলামাইটদের দখলে যায়নি। এলামাইটদের আক্রমণের অল্প কিছুদিন পরে, সুমেরের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে, মেসোপটেমীয় সমতলভূমিতে অবস্থিত আদাব শহরের রাজা এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
রাজা লুগুলান্নেমুন্ডু খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের আশেপাশের কোনো একটি সময়ে রাজত্ব করতেন। সুমেরকে বহিঃশত্রু থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি তেরোটি এলামাইট নিয়ন্ত্রিত শহরের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে তৈরি এক সুবিশাল মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তার নিজস্ব শিলালিপিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি এই যুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন এবং তিনি নিজেকে ‘চার-চতুর্থাংশের রাজা’ (অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীর রাজা) হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি সেখানে আরও উল্লেখ করেন যে তিনি সকল বিদেশি শক্তিকে বাধ্য করেন তাকে নিয়মিত উপঢৌকন পাঠানোর ব্যাপারে এবং তিনি তার দেশের জনগণের জন্য শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন সুমেরকে স্বাধীন করার মাধ্যমে।
এই বর্ণনা সঠিক হলে তার খণ্ডকালীন সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি গিলগামেশের সময়ের সুমেরের চেয়েও বড়ো ছিল। তবে লুগুলান্নেমুণ্ডু হয়তো সুমেরকে এলামাইটদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং তাদের স্বাধীন সত্তা ও কৃষ্টিকে সুরক্ষা প্রদান করেছিলেন বেশ কিছুদিনের জন্য; কিন্তু তার সেই কীর্তিগুলো গিলগামেশের মতো মহাকাব্যিক হতে পারেনি এবং তার রাজত্বের স্থায়িত্বও গিলগামেশের চেয়ে অনেক বেশি ছিল না।
সুমেরের সমতলভূমিকে ঘিরে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল লাগাশ ও উম্মা শহরের সীমানার নিকটবর্তী একটুকরো মালিকানাবিহীন, বিস্মরণযোগ্য জমি নিয়ে সংঘাত। এই যুদ্ধের ফলে সুমেরীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির যবনিকাপাত ঘটে।
যে শিলালিপিতে এই সীমান্ত-সংঘাতের বিবরণটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল সেটি রচিত হয়েছিল লুগুলান্নেমুন্ডুর দু-তিন প্রজন্ম পরে এবং ততদিনে তার রাজত্বটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। সুমেরীয় রাজারা অস্ত্রের ঝংকার এবং ব্যক্তিগত কারিশমার মাধ্যমে রাজ্য শাসন করতেন; তাদের ছিল না কোনো প্রতিষ্ঠিত শাসনতন্ত্র।
স্বভাবতই, যখন রাজার মুকুটটি একজন প্রগতিশীল যোদ্ধা রাজের কাছ থেকে তার অনভিজ্ঞ এবং তুলনামূলকভাবে অযোগ্য পুত্রের কাছে স্থানান্তরিত হতো, সে সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারত না এবং রাজত্বের অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ত।
লুগুলান্নেমুণ্ডুর রাজত্ব এত দ্রুত ভেঙে পড়েছিল যে তার শহর আদাব সবচেয়ে শক্তিশালী সুমেরীয় শহরদের তালিকা থেকেও বাদ পড়ে গিয়েছিল। যখন লাগাশ আর উম্মা যুদ্ধ করছিল তখন পুনরায় ক্ষমতাবান হওয়া কিশের রাজা সেখানে নাক গলাতে আসলেন। প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি শহর একে অপরের ভূমিতে অনুপ্রবেশ করছিল সেই সময়। কিশের রাজা মেসিলিম সেখানে হস্তক্ষেপ করলেন এবং ঘোষণা দিলেন যে সুমেরীয় বিচারের দেবতা সাতারান তাকে পথ দেখিয়েছেন, কীভাবে শহর দুটির সঠিক সীমানা নির্ধারণ করতে হবে সেই ব্যাপারে। তিনি একটি স্টেলে (শিলালিপিসমৃদ্ধ পাথর) তৈরি করলেন এবং তাতে লিখলেন : ‘মেসিলিম, কিশের রাজা, সাতারানের বার্তা অনুযায়ী এই সীমানা নির্ধারণ করলেন।’ সম্ভবত দুটি শহরই মেসিলিমের এই বিচার মেনে নিয়েছিলেন। আপনি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সরাসরি বার্তা পেয়েছেন এই ব্যাপারটিকে ভুল প্রমাণ করা এখন যেমন দুষ্কর, তখনও সেরকমটিই ছিল।
তবে এই শান্তিচুক্তি বেশিদিন টিকেনি। মেসিলিমের মৃত্যুর পর উম্মা শহরের নতুন রাজা এসে এই স্টেলেটিকে গুঁড়িয়ে দেন এবং তিনি সেই বিতর্কিত জমিটিকে তার শহরের বর্ধিত অংশ হিসেবে দখল করে নেন। এ থেকে বোঝা যায় যে দেবতা সাতারান নয় বরং রাজা মেসিলিমের ভয়েই তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানটি মেনে নিয়েছিলেন। উম্মা দুই প্রজন্ম ধরে জমিটির দখল নিয়ে রেখেছিল। এরপর ইয়ান্নাতুম নামের লাগাশের একজন মিলিটারি মেজাজের রাজা পুনরায় ভূখণ্ডটি নিজেদের দখলে নেন।
আমরা অন্য অনেক সুমেরীয় রাজার চেয়ে ইয়ান্নাতুমের ব্যাপারে বেশি জানি, কেননা তিনি শিলালিপি ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি সুমেরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মাঝে একটি তৈরি করে রেখে গিয়েছেন, যার নাম ‘দ্য স্টেলে অব ভালচার্স’ (শকুনের স্টেলে)। এই পাথরের বড়ো টুকরোটির উপরে কমিক্স বইয়ের মতো করে খোদাই করা আছে উম্মার বিরুদ্ধে ইয়ান্নাতুমের বিজয়ের গল্পগাথা। শত্রুপক্ষের পরাজিত যোদ্ধাদের লাশের উপর দিয়ে বর্শা ও ঢালে সজ্জিত ইয়ান্নাতুমের সৈন্যবাহিনীর পদযাত্রাকে চিত্রিত করা হয়েছে মুনশিয়ানার সাথে।
সাথে আরও দেখানো হয়েছে যে শকুনরা মৃতদেহ ঠোকরাচ্ছে আর তাদের ছিন্ন মস্তক মুখে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। একটি শিলালিপিতে ব্যাপারটাকে পরিষ্কার করা হয়েছে এভাবে : ‘সেই সমতলভূমিতে অসংখ্য মরদেহ স্তূপ করে রেখেছিল’ এবং তারা মারা যাওয়ার আগে ‘হাঁটু গেড়ে কাঁদতে কাঁদতে তাদের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল’।
শকুনের স্টেলেতে আমরা দেখতে পাই এক নতুন ধরনের যুদ্ধের স্বরূপ। ইয়ান্নাতুমের বাহিনীর হাতে শুধু বর্শাই ছিল না, তাদের সাথে ছিল যুদ্ধ-কুঠার এবং কাস্তের মতো বাঁকানো তরবারি এবং তারা প্রত্যেকে একইভাবে অস্ত্রসজ্জিত ছিল। এ থেকে আমরা সুসংহত সেনাবাহিনীর একটি ধারণা পাই যা পূর্বের ছন্নছাড়া, ভাড়াটে সৈন্যের ধারণা থেকে ভিন্ন। পরবর্তীকালে সম্রাট আলেকজান্ডারের পদাতিক বাহিনীর অতীব কার্যকরী ফ্যালাংক্স নামক প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে এই সৈন্যদেরকে পদযাত্রা করতে দেখা গিয়েছে এই পাথরের স্টেলেতে। ইয়ান্নাতুমকে দেখা যায় একটি খচ্চর-টানা যুদ্ধযানে (চ্যারিওটে ) বসে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে।
লাগাশের রাজা ইয়ান্নাতুম তার এই সুসংহত বাহিনী ব্যবহার করে শুধু উম্মার সাথেই যুদ্ধ লড়েননি বরং সমতলভূমিতে অবস্থিত সকল সুমেরীয় শহরের সাথেই লড়েছিলেন। তিনি কিশ ও মারি শহরের বিরুদ্ধে লড়েন এবং হামলাকারী এলামাইটদেরও ঠেকান। সারা জীবন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে দিতে যুদ্ধক্ষেত্রেই সম্ভবত তার মৃত্যু হয়। তার ভাই তখন রাজত্বের ভার গ্রহণ করেন।
পরবর্তী চার প্রজন্ম ধরে লাগাশ ও উম্মা সেই সীমানা নির্ধারক জমিটিকে ঘিরে যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত থাকে; যা ছিল একটি তিক্ত এবং রক্তাক্ত অভ্যন্তরীণ কলহ। মাঝে মাঝে বহিরাগত এলামাইটদের হামলার কারণে সেই গৃহযুদ্ধ বাধাগ্রস্ত হতো।
উম্মার পরবর্তী রাজা সেই স্টেলেগুলোকে পোড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন—মেসিলিমেরটা এবং সাথে শকুনেরটাও। তবে এটি একটি প্রতীকী প্রক্রিয়া ছিল, কেননা আমরা সবাই জানি যে পাথরকে পোড়ানো যায় না। তবে তিনি এই কাজের মাধ্যমে তার মনোভাবকে পরিষ্কার করে বোঝাতে পেরেছিলেন। ইয়ান্নাতুমের নাম না জানা ভাই লাগাশের মসনদটি তার ছেলের কাছে স্থানান্তর করে দিয়ে যান, যাকে একজন দখলদার এসে উৎখাত করেন।
সীমান্ত নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি শুরু হওয়ার শতবর্ষ পূরণ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তবু তার মিটমাট হয়নি।
ততদিনে লাগাশের শাসনভার এসেছে উরুকাগিনা নামক একজন রাজার হাতে। উরুকাগিনাকে প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের জিমি কার্টার হিসেবে অভিহিত করা যায়, কারণ তিনিই ছিলেন প্রথম বিবেকবান সুমেরীয় রাজা। তার সবচেয়ে ভালো এই গুণটি একইসাথে তার দুর্বলতাও ছিল।
উম্মার সাথে যুদ্ধই লাগাশের একমাত্র সমস্যা ছিল না। উরুকাগিনার রাজত্বের সময়ে নির্মিত একগাদা শিলালিপি থেকে আমরা সেই সময়ের করুণ অবস্থার কথা জানতে পারি। সেই সময় শহরটি ছিল দুর্নীতিবাজ পূজারি আর বড়োলোকদের হাতে জিম্মি এবং গরিব ও দুর্বলরা ক্ষুধার্ত ও ভীত অবস্থায় জীবনযাপন করত। অসাধু কর্মচারীরা মন্দিরসংলগ্ন খাসজমিগুলো দখল করে নিয়েছিল নিজেদের স্বার্থে। এই জমিগুলো লাগাশের নাগরিকদের মঙ্গলের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটা খানিকটা বন বিভাগের কর্মীদের অবৈধভাবে জঙ্গল সাফ করে ফেলার মতো একটি ঘটনা ছিল।
অভিজ্ঞ কর্মীদেরকে এক টুকরো রুটির জন্য ভিক্ষা করতে হতো আর শিক্ষানবিশ কর্মীদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে যেতে হতো; তারা আস্তাকুঁড়ে অন্যের ফেলে দেওয়া খাবারের অংশবিশেষ খুঁজে খুঁজে নিজেদের পেট ভরাতে বাধ্য হতো। সরকারি কর্মচারীরা সব কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ মাশুল দাবি করতেন এমনকি সাদা ভেড়ার চামড়া ছাড়ানো থেকে শুরু করে মরদেহের সৎকার পর্যন্ত তা বিস্তৃত ছিল। কেউ তার মৃত বাবাকে কবর দিতে চাইলে তাকে সাত জগ বিয়ার এবং চারশো বিশটি পাউরুটি দিতে হতো মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থাকারী ব্যক্তিকে। এই করের বোঝা এত বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকে তাদের সন্তানকে দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতেন। একটি শিলালিপিতে অনুযোগ লেখা আছে, ‘দেশের সীমান্ত থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত, কর আদায়কারীদের আনাগোনা ছিল সর্বত্র’; যে অভিযোগ একই ধারাবাহিকতায় বর্তমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উরুকাগিনা বেশির ভাগ কর আদায়কারীকে বিদায় করে দিয়েছিলেন এবং করের হার কমিয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি সাধারণ সেবাগুলোর জন্য সকল মাশুল মওকুফ করে দিয়েছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারী ও পূজারিদেরকে এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিলেন যাতে কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করতে না পেরে তার জমি কেড়ে না নেওয়া হয়। তিনি বরং অনেকের ঋণ মাফ করে দিয়েছিলেন। তিনি লাগাশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিলেন; সব অপ্রয়োজনীয় এবং আলংকারিক পদকে (যেমন : প্রধান নৌকাচালক, মাছ চাষের নিরীক্ষক, শস্যের গুদামের ব্যবস্থাপক ইত্যাদি) বিলুপ্ত করে দেন। এ ছাড়া তিনি ধর্মীয় ও শাসনের ক্ষমতাকে আলাদা করে দিয়ে পূজারিদের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন, যাতে আর কেউ মেসিলিমের মতো নিজেকে সাতারান দেবতার বার্তাবাহক হিসেবে দাবি করে বসতে না পারে। তার কাহিনিকারের লেখনী থেকে আমরা জানতে পারি যে ‘পূজারি-বিচারকদের দৌরাত্ম্যের কথা আর শোনা যায়নি; এবং আমরা ধারণা করে নিতে পারি যে পূজারিদের সাধারণ মানুষের বাগানে অনাহুত অনুপ্রবেশও থেমে গিয়েছিল একইসাথে।
উকাগিনার উদ্দেশ্য ছিল লাগাশের বিচারব্যবস্থাকে দেবতাদের দেখিয়ে দেওয়া পথে নিয়ে যাওয়া। কাহিনিকার আরও লিখেছিলেন, ‘তিনি লাগাশের বাসিন্দাদের মুক্তি দেন সুদখোর, ক্ষুধা, চুরি ও হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এমেজাই। অনাথ ও বিধবাদের আর ক্ষমতাবানদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়নি; তাদের দেখভালের জন্য উরাকাগিনা বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন এমেজাই ছিল এক ধরনের কুনেইফর্ম। এই লেখনী লাগাশের নাগরিকদের জন্য স্বাধীনতার চিহ্নস্বরূপ ছিল। এটি সেই আত্মবিশ্বাস প্রদান করত যে লাগাশকে শাসন করা হয় একটি নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনশীল শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে, কোনো ক্ষমতাবান শাসকের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতার উপর ভিত্তি করে নয়।
তর্কসাপেক্ষে বলা যায় যে এটিই মানবজাতির স্বাধীনতার ধারণার ব্যাপারে প্রথম লিখিত দলিল। এমেজাই, যার আক্ষরিক অর্থ ‘মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া’, উরুকাগিনার লাগাশ শহরকে পূর্বের পবিত্র অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিলাষকে প্রকাশ করে। উরুকাগিনার লাগাশ এমন একটি শহর হবে যেখানে দেবতাদের ইচ্ছাকে সর্বদা সম্মান জানানো হবে বিশেষ করে নগরদেবতা নিনগিরসুর ইচ্ছাকে। এই লাগাশ হবে অতীতের লাগাশের মতো; একেবারে প্রাচীন যুগ থেকেই ঝকমকে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাল্পনিক, মহান এক অতীতকে সামনে এনে সামাজিক পুনর্বিন্যাসের আহ্বান জানানো হতো।
এসব চিন্তাধারা ও মতবাদে উরুকাগিনার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিল না। পাঁচ হাজার বছর আগের একজন শাসকের মনে কী চলছিল তা আর আজ সঠিকভাবে জানার কোনো উপায় নেই, তবে তার নেওয়া ধাপগুলো দেখে মনে হয় তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে বিসর্জন দিয়ে তার ধার্মিক সত্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই কাজগুলো করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তবে তার এই বিবেকবান নীতি ছিল রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের জন্য আত্মহত্যাস্বরূপ। পূজারিদের ক্ষমতা খর্ব করার কারণে তিনি সমগ্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে চরম অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন। গরিবের স্বার্থ রক্ষার্থে নেওয়া ধাপগুলোর কারণে তিনি তার নিজ শহরের ধনীমহলের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিলেন।
প্রতিটি সুমেরীয় রাজা তার রাজ্য শাসন করতেন নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে তৈরি দ্বিকক্ষীয় সংসদের মাধ্যমে; এবং স্বভাবতই, প্রবীণদের সমাবেশের বেশির ভাগ সদস্যই আসতেন শহরের ধনীমহল থেকে। লাগাশের লুগাল কিংবা ‘বৃহৎ বাড়ির মালিক’রা উরুকাগিনার নেওয়া গরিবি স্বার্থ রক্ষার নীতির চরম সমালোচনা করা শুরু করলেন। তিনি সবার সামনে যেভাবে ধনীদেরকে গরিবের উপর
অত্যাচার করার জন্য বকাঝকা আর অপমান করতেন তা তারা সহজভাবে নেয়নি–তারা উরুকাগিনাকে ঘৃণা করত।
অপরদিকে, লাগাশের পুরানো শত্রু উম্মার সিংহাসনটি উত্তরাধিকারসূত্রে লোভী ও উচ্চাভিলাষী লুগালজাজ্ঞেসির হাতে গিয়েছিল। তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে লাগাশের দিকে যাত্রা করলেন এবং তার আক্রমণের ফলে উরুকাগিনার শহরের পতন ঘটল।
লুগালজাজ্ঞেসির অভিযানটি খুব সহজেই সফল হয়েছিল; লাগাশ শহর থেকে তাকে তেমন কোনো বাধার মোকাবিলা করতে হয়নি। বিজয়গাথার শিলালিপি থেকে জানা যায় : ‘যখন সমগ্র ভূখণ্ডের রাজা এনলিল তার রাজত্বটি লুগালজাজ্ঞেসির হাতে ছেড়ে দিলেন এবং তাকে দেখালেন সূর্যোদয়ের প্রান্ত থেকে সূর্যাস্তের প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র ভূমি এবং তার তরে সকল মানবগোষ্ঠীকে অর্পণ করলেন, তখন সকলে জয়োল্লাসে ফেটে পড়ল এবং তিনি হলেন সমগ্র সুমেরের অধিপতি এবং তার সামনে সকল নেতৃবৃন্দ নতজানু হলেন।”
এই শিলালিপিটি পড়ে মনে হয় শুধু লাগাশের পূজারিরাই নয় বরং এনলিলের পবিত্র শহর নিপ্পুরের পূজারিরাও নতুন সম্রাটের সাথে একতাবদ্ধ হয়েছিলেন। নিপ্পুরের ক্ষমতাবান পূজারিরা কোনো অবস্থাতেই লাগাশের পূজারিদের ক্ষমতা কমে যাওয়াতে খুশি হননি। এটি ছিল একটি খারাপ উদাহরণ। প্রবীণ সভার ধনী সদস্যরা উরুকাগিনার পতনে সরাসরি ভূমিকা না রাখলেও তারা যে যুদ্ধের সময় তাকে উচ্ছ্বসিত সহায়তা প্রদান করেননি তা পরিষ্কার ছিল। সামাজিক পুনর্গঠনের ধাপগুলো তার রাজনৈতিক অভিলাষ এবং সাথে তার জীবনকেও শেষ করে দিয়েছিল।
একজন লিপিকার নিশ্চিত ছিলেন যে উরুকাগিনার নীতিই সঠিক ছিল এবং তিনি অঙ্গীকার করেন যে ভালো রাজার জীবনদানের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। তিনি সতর্ক করেন : ‘যেহেতু উম্মার লোকেরা লাগাশের ইটগুলোকে ধ্বংস করার মাধ্যমে নিনগিরসুর বিরুদ্ধে পাপ করেছে, নিনগিরসু তার বিরুদ্ধে উঠানো প্রতিটি হাতকে ধ্বংস করবে।’ লেখাটি শেষ হয় লুগালজাজ্ঞেসির নিজস্ব পালনকর্তার কাছে আর্জির মাধ্যমে, যেখানে লেখক দেবীকে অনুরোধ করেন লুগালজাজ্ঞেসিকে তার পাপের জন্য শায়েস্তা করতে।
লাগাশের বিরুদ্ধে সহজেই জয়লাভ করাতে লুগালজাজ্ঞেসির উৎসাহ বেড়ে যায়; তিনি তার দখলদারির জাল বিস্তার করেন আরও বেশি করে। তিনি বিশটি বছর ব্যয় করেন সুমেরের বিভিন্ন প্রান্ত আক্রমণ করে। তার নিজ বর্ণনা অনুসারে তার রাজত্বের বিস্তার ছিল ‘নিম সাগর থেকে শুরু করে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের তীর ধরে একেবারে উচ্চ সাগর পর্যন্ত’। তবে এই সমগ্র এলাকাকে তার নিজের সাম্রাজ্য বলাটা অবশ্যই অতিরঞ্জন ছিল। লুগালজাজ্ঞেসির উচ্চ সাগরে রাজত্ব করার দাবিটি সম্ভবত কালো সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারা কিছু বিচ্ছিন্ন বাহিনী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে লুগালজাজ্ঞেসি ছিলেন প্রথম রাজা যিনি সুমেরের সকল ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা শহরকে একটি বড়ো সাম্রাজ্যের মাধ্যমে নিজ দখলে রাখার উচ্চাভিলাষী কাজে হাত দিয়েছিলেন।
লুগালজাজ্ঞেসি যখন তার নতুন সাম্রাজ্যে নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন এবং তার পিঠ উত্তরমুখী ছিল তখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শত্রুর আগমন ঘটে সম্পূর্ণ অন্যদিক দিয়ে।