অধ্যায় ছয় – দার্শনিক রাজা

অধ্যায় ছয় – দার্শনিক রাজা 

খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৫২ ও ২২০৫ সালের মাঝে ইয়েলো নদীর উপত্যকায় চীনদেশের প্রাথমিক গ্রামগুলো রাজাদের স্বীকার করে নেয় কিন্তু তাদের উত্তরাধিকারীদের নয়। 

চীনকে দূর প্রাচ্যের মেসোপটেমিয়া ও ভারত বলা যায়, কেননা সেখানেও একই ধারায় সভ্যতার বিকাশ ঘটে। 

সেখানে ইয়েলো নদীর (হোয়াং হো) পাশে জনবসতি গড়ে ওঠে। এই নদীটি পূর্বের উঁচু মালভূমি থেকে উৎপন্ন (বর্তমানে এর নাম কিং জাং গাওইউয়ান) হয়ে তিব্বতের মালভূমি হয়ে এসে ইয়েলো সমুদ্রে পতিত হয়েছিল। আরও দক্ষিণে ইয়াংজি নদীও বয়ে যেত পূর্বদিকের উপকূল দিয়ে। 

যে সময় সাহারা মরুভূমি সবুজ রঙে রাঙানো ছিল এবং থার মরুভূমির মধ্য দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছিল, তখন চীনদেশের এই দুই বিশাল আকৃতির নদীর মাঝখানের অংশটি সম্ভবত ছোটোখাটো খাল, বিল, নালা, হ্রদ এবং কাদায় ভরা ছিল। সেখানে অবস্থিত শ্যানডং উপদ্বীপটি মূলত একটি দ্বীপই ছিল। 

শিকারি ও আহরণকারীরা হয়তো বা জলাভূমির ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াত কিন্তু তারা সেই জলাবদ্ধ ভূমিতে বসতি গড়তে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। 

এদিকে সাহারা উষ্ণ হতে লাগল, নীল নদের বন্যার প্রকোপ কমে আসলে এবং যে নদীর পানিতে থার মরুভূমি আর্দ্র হতো তা বিলুপ্ত হয়ে গেল। মেসোপটেমিয়ার বিনুনীযুক্ত পানির উৎসগুলো ধীরে ধীরে দুটি ভিন্ন নদীতে বিভক্ত হয়ে গেল—জমাট বাঁধা পলিমাটির কল্যাণে। কিন্তু চীনদেশের দুটি বৃহৎ নদীর মাঝের ভূমিটি একেবারেই শুকিয়ে গেল। 

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ সাল আসতে আসতে এই জায়গাটি একটি বড়ো আকারের সমতলভূমিতে রূপান্তরিত হলো এবং তার উঁচু অংশগুলোতে গাছপালা জন্মে তা বনজঙ্গলে পরিণত হলো। যাযাবররা এসে বসতি গড়তে শুরু করল এবং তারা নদীর পার্শ্ববর্তী আর্দ্র ভূমিতে ধান চাষ করতে লাগল। বাড়িঘরের সংখ্যা বাড়তে লাগল এবং গ্রামগুলো বর্ধিত হতে লাগল। প্রত্নতত্ত্ব থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ইয়েলো নদীর তীরেই বিশ্বের প্রথম পরিকল্পিতভাবে গুচ্ছ বাঁধা বাড়িঘর দেখা যায়। এখানের জনবসতিগুলোতে এক ধরনের সংস্কৃতির জন্ম নেয়, কেননা সব মানুষ সেখানে একই ধরনের আচার আচরণ অনুসরণ করত, একই পদ্ধতিতে বাড়িঘর বানাত; কুমারদের মাটির জিনিসপত্র বানানোর কৌশলও এক রকম ছিল এবং ধারণা করা হয় যে তাদের ভাষাও একই ছিল। 

এই ইয়েলো নদীর সংস্কৃতিই (যাকে আমরা বর্তমানে ইয়াং-শাও বলে থাকি) সেই যুগের চীনের একমাত্র গুচ্ছ উপনিবেশ ছিল না। দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে, পূর্ব চীন সমুদ্রের তীরে, ডাপেনকেং নামের আরেকটি সংস্কৃতি আবির্ভূত হয়। এ ছাড়া আরও দক্ষিণে, ইয়াংসি নদীর উপত্যকায়, কিংলিয়াংগাং সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। 

ইয়েলো নদীর দক্ষিণের বৃহৎ বাঁকের নিচ দিয়ে চতুর্থ একটি উপনিবেশ গড়ে ওঠে—যার নাম ছিল লংশান। মাটি খুঁড়ে দেখা গিয়েছে যে ইয়াং-শাও-এর ধ্বংসাবশেষের উপরে লংশানের ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে, যা থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে লংশান সংস্কৃতি হয়তো বা শান্তিপূর্ণভাবেই ইয়েলো নদীর অন্যান্য গোষ্ঠীকে গ্রাস করে নিয়েছিল 

এই চার গোত্র বা সংস্কৃতির মানুষদের জীবন ধারণের পদ্ধতি ও আচারব্যবহার সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। আমরা শুধু তাদেরকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত করতে পেরেছি, কেননা তাদের কুমারদের কাজের ধারা ভিন্ন ছিল এবং জিনিসপত্র তৈরি ও চাষ করার পদ্ধতিও ভিন্ন ছিল। একটি ইয়াং- শাও উপনিবেশের চারিদিকে খাল কাটা হতো আর লংশান গ্রামগুলোকে চারপাশের আবর্জনা থেকে আলাদা করতে তাদের চতুর্দিকে প্রাচীর বানানো হতো। এসকল সাধারণ তথ্য ছাড়া চীনের প্রাথমিক ইতিহাস জানার জন্য আমাদের হাতে কোনো নথি নেই। তবে ইয়েলো নদীর দক্ষিণ উপকূলে একটি কবরস্থান খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যেখানে আমরা পূর্বসূরিদের পূজা করা এবং তাদের কবরে খাবার দিয়ে দেওয়ার নিদর্শন দেখতে পাই। এ থেকে ধারণা করা যায় যে তারা পুনর্জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। 

মহাভারতের কাহিনিগুলোর মতো চীনদেশের প্রথম যুগের গল্পগুলো হাজার হাজার বছর পরে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। সেখানে প্রথম রাজা হিসেবে ফু-জি নামের একজনের কথা বলা হয়েছে, যার নিয়ন্ত্রণে ছিল সমগ্র চীন। 

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ান চীনদেশের বিভিন্ন লোককথা সংগ্রহ করে সেখানকার প্রাচীন ইতিহাস সংকলন করেছেন। তিনি বলেন যে ফু-জি তার রাজত্ব শুরু করেন খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৫০ সাল থেকে। তিনি এইট ট্রাইগ্রাম উদ্ভাবন করেন, যেটি সরল ও বক্ররেখার এক ধরনের বিন্যাস। এর মাধ্যমে হিসাবরক্ষণ, ভবিষ্যদ্বাণী এবং বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণের কাজ করা যেত। 

ফু-জি পশু ও পাখিদের অবয়ব নিয়ে ধ্যান করতে করতে এই আটটি ট্রাইগ্রাম তৈরি করেন, যাতে ঐশ্বরিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কথা বলা যায় এবং বিভিন্ন জীবিত প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। 

এই আটটি ট্রাইগ্রামের বিন্যাস করা হয়েছে কচ্ছপের খোলসের উপর অবস্থিত চিহ্নগুলোর মতো করে। প্রথম চৈনিক রাজা তার দেশের মানুষদেরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করেননি, স্বর্গ থেকে আধিপত্য পাননি কিংবা দুটি দেশকেও একীভূত করেননি। দেশের জন্য তার সবচেয়ে বড়ো অর্জন ছিল ব্যক্তি ও পৃথিবীর মাঝে একটি সংযোগ খুঁজে পাওয়া। তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানকে সুন্দর করে বিন্যস্ত করার যে স্বাভাবিক মানবপ্রবৃত্তি রয়েছে সেটা পূরণ করেছেন। 

চৈনিক পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ফু-জির পরে দ্বিতীয় রাজা হিসেবে এসেছিলেন শেনং, যিনি প্রথম কাঠ দিয়ে লাঙল তৈরি করেছিলেন এবং মাটি খুঁড়তে শুরু করেছিলেন। হুয়াইনানজু পুস্তক থেকে জানা যায় যে তিনি মানুষকে কীভাবে চাষ করার জন্য সবচেয়ে সেরা জমি খুঁজে পাওয়া যায় তা শিখিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি জীবন ধারণকে সহজতর করার জন্য পাঁচ ধরনের বীজ বপন এবং ফসল উৎপাদন করা, সেগুলোকে মাড়াই করা এবং কীভাবে ভালো ভালো ভেষজ উদ্ভিদ ভক্ষণ করা যায় (বিষাক্তগুলোকে বাদ দিয়ে) তাও শিখিয়েছিলেন। 

কৃষক রাজার পর তৃতীয় মহারাজের আবির্ভাব হয়, যিনি সম্ভবত সর্বকালের সর্বসেরা রাজা ছিলেন। তার নাম ছিল হুয়াংদি বা হলুদ সম্রাট। 

ধারণা করা হয় যে হুয়াংদি খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯৬ সাল থেকে ২৫৯৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তিনি তার ভাই অগ্নিশিখা রাজের রাজত্বকে দখল করে নিয়েছিলেন। এরপর দক্ষিণের যুদ্ধবাজ নেতা চি ইউ হুয়াংদির বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। তিনি অগ্নিশিখা রাজের প্রতি অনুগত ছিলেন। চি ইউ খুবই অপ্রীতিকর একজন মানুষ ছিলেন। তিনি যুদ্ধ করতে খুবই পছন্দ করতেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ধাতব অস্ত্রের প্রচলন করেছিলেন। তিনি নুড়ি ও পাথর চিবিয়ে চিবিয়ে খেতেন তার অভঙ্গুর দাঁত দিয়ে এবং তার অধীনে অপরাধী ও দানবরা যুদ্ধ করত। তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে কুয়াশাছন্ন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে হুয়াংদির বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দু খুঁজে পাওয়ার জন্য হুয়াংদিকে একটি কম্পাসসমৃদ্ধ জাদুকরি রথ ব্যবহার করতে হয়েছিল। যুদ্ধে তিনি শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করেন। 

উপরে বর্ণিত কাহিনিটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কেননা ২৬৯৬ সালে চীনদেশে কোনো কম্পাসের অস্তিত্ব ছিল না, তা সে জাদুকরিই হোক কিংবা সাধারণ। সেই সময় কোনো শহরেরও অস্তিত্ব ছিল না। মেমফিস আর কিশ যখন সমৃদ্ধ শহর হিসেবে গড়ে উঠছে, সেই একই সময়ে ইয়েলো নদীর উপনিবেশগুলো কাঠ, কাদামাটি ও অন্যান্য প্রাথমিক উপকরণ দিয়ে তৈরি ঘরে পূর্ণ ছিল। ঘরগুলোর চারপাশ ঘিরে ছিল প্রাকৃতিক নালা এবং কাদামাটির দেওয়াল। যারা এখানে থাকতেন তারা মাছ শিকার করা শিখেছিলেন এবং তারা ফসলের বীজ বপন করতে আর খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে জানতেন। তারা কীভাবে আক্রমণকারীদের ঠেকাতে হয় সেটাও জানতেন। হুয়াংদি যদিও বা তার ভাই এবং তার যুদ্ধবাজ সহযোগীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও থাকেন, সেখান থেকে তিনি কোনো লোভনীয় রাজত্ব দখল করতে পারেননি; সেখানে প্রগতিশীল শহর কিংবা লোভনীয় বাণিজ্যিক কাঠামোর পরিবর্তে ছিল ছোটো ছোটো গ্রাম্য এলাকা এবং কাঠের তৈরি বাড়িঘর, যার চারপাশ ঘিরে ছিল ধান ও ভুট্টার খেত। 

হুয়াংদির অভ্যুত্থানের পর চীনদেশের সরকারব্যবস্থায় এক ধরনের আমূল পরিবর্তন আসে। সুমেরে ততদিনে বংশগত ক্ষমতার ধারণাটি বেশ জেঁকে বসেছে। চীনদেশেও একই ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল। 

হুয়াংদি ছিলেন তিনজন মহান রাজার মধ্যে সর্বশেষ। তার পরে ইয়াও নামক একজন রাজা হয়েছিলেন। ইয়াও ছিলেন তিনজন ঋষি রাজার মাঝে প্রথম। তিনি ছিলেন বিশেষ জ্ঞানী এবং তার কাছে প্রত্যাশা ছিল যে তার বাবা হুয়াংদির মতো তিনিও তার সন্তানের হাতেই রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে যাবেন। তবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে তার সন্তান রাজ্যভার নেওয়ার উপযুক্ত ছিলেন না। সে কারণে তিনি তার উত্তরসূরি হিসেবে শুন নামের একজন গরিব কিন্তু বিজ্ঞ কৃষককে পছন্দ করেন। শুন শুধু তার প্রজ্ঞার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন না, তিনি তার পিতার প্রতি আনুগত্যের জন্যও পরিচিত ছিলেন। 

দ্বিতীয় ঋষি রাজা শুন একজন বিজ্ঞ ও ন্যায়নিষ্ঠ শাসক হিসেবে হুয়াংদির দেখানো পথে হাঁটেন এবং তিনিও নিজ সন্তানের পরিবর্তে ইউ নামের একজন যোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইউ ছিলেন তৃতীয় এবং সর্বশেষ ঋষি রাজা যাকে চীনদেশের প্রথম রাজবংশ ‘জিয়া ডাইন্যাস্টি’-র গোড়াপত্তনকারী হিসেবে স্মরণ করা হয়ে থাকে। 

বস্তুত এটাই পরিলক্ষিত হয় যে চীনদেশে রাজত্বের উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে রক্তীয় সম্পর্ক অতটা মুখ্য ছিল না, প্রায়শই বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার স্বদিচ্ছার কারণে অযোগ্য ও মূর্খ সন্তানরা বঞ্চিত হতেন বিনা পরিশ্রমে মসনদ পাওয়ার আনন্দ থেকে 

তারা রাজার ক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতেন কিন্তু সেটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না। 

ক্ষমতা ভালো একটি বিষয়, কিন্তু কোনো মানুষের ভাবা উচিত নয় যে শুধু জন্মগত কারণে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে। একজন মানুষের রাজত্ব করার সামর্থ্য তার জ্ঞানের উপর নির্ভর করে, সে কার সন্তান তার উপর নয়। কিশের নাগরিকরা হয়তো বা রাজা ইটানার কোনো ছেলেপিলে নেই দেখে মাতম করেছেন কিন্তু ইয়েলো নদীর তীরের বাসিন্দাদের মাঝে সেরকম কোনো কামনা ছিল না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *