অধ্যায় চৌদ্দ – প্রথম পরিকল্পিত শহরসমূহ
খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ সালের অল্প কিছুদিন আগে সিন্ধু নদের তীরবর্তী গ্রামগুলো হরপ্পার শহর ‘মেলুহহা’-তে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেখান থেকে সার্গনের সাথে বাণিজ্য করার জন্য জাহাজ এসেছিল। ততদিনে ভারতে একটি জাঁকজমকপূর্ণ সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
মানু বিষ্ণু ও সার্গনের সময়পর্বের মাঝে সাতশ বছর পার হয়ে গিয়েছে এবং এর মাঝে সিন্ধু নদের তীরবর্তী গ্রামগুলো মিলে একটি বড়ো শহরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। এই শহরে বসবাসরত মানুষদের সাথে এলামাইটদের যোগসূত্র ছিল।
এমোরাইট ও আক্কাদীয়রা একই যাযাবর দলের বংশোদ্ভূত এবং একইভাবে আরব সাগরের উত্তরে অবস্থিত সমতলভূমির এলামাইটদের থেকেই সিন্ধু নদের বাসিন্দাদের আগমন।
আমরা এটুকুই জানি। ‘হরপ্পা সভ্যতা’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ব্যাপারে আমরা জানতে পারি হরপ্পা শহরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার পর। সেখানে পাওয়া গিয়েছে কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের অংশবিশেষ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক পণ্যের চিহ্ন হিসেবে বানানো কিছু সিলগালা এবং কিছু শিলালিপি যার মর্ম কেউ উদ্ধার করতে পারেনি অদ্যাবধি। হরপ্পার সবচেয়ে বড়ো দুটি শহর হচ্ছে সিন্ধু নদের উত্তরদিকে প্রবাহিত শাখাসংলগ্ন ‘হরপ্পা’ শহর এবং দক্ষিণের মহেঞ্জোদারো। কল্পনার সাহায্যে আমরা এই দুটি শহরে অজ্ঞাতনামা শিল্পী, বণিক ও দিনমজুর ছিল বলে ধারণা করতে পারি কিন্তু এই প্রসঙ্গে কোনো লিপিবদ্ধ নথি নেই। নেই তাদের যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষমতার লড়াই কিংবা বীরত্বের গাথাসম্পর্কিত কোনো লিপিবদ্ধ তথ্য।
এই ব্যাপারটি প্রত্নতত্ত্ববিদ কিংবা পুরাতত্ত্ববিদদের কোনোভাবে বিচলিত করে না কিন্তু একজন ইতিহাসবিদের জন্য ব্যাপারটি অস্বস্তিকর। এই প্রসঙ্গে জন কিয়েই অভিযোগ করেন, ইতিহাস স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে আনুমানিক দিন-তারিখ, শহর, শিল্প ও কলাসংক্রান্ত তথ্যের মাধ্যমে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা কোনো লিপিবদ্ধ ঘটনার সন্ধান পাইনি, শুধু পেয়েছি কিছু মালিকের পরিচয়হীন হাড়গোড় যা কোনো কাজেই আসেনি।’
আমরা ধারণা করতে পারি যে শহরগুলোর রাজা ছিল। ধ্বংসস্তূপের মাঝে একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যার পরনে ছিল অলংকৃত পোশাক এবং একটি মাথার মুকুট। তার চোখ অর্ধেক বোজা ছিল এবং তার মুখে ছিল না কোনো আবেগের ছাপ।
সম্ভবত তিনি ছিলেন মহেঞ্জোদারোর রাজা, কেননা সেখানেই এই মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। শহরটিতে বেশ কিছু দালান আছে যা দেখে সৈন্যদের ব্যারাক অথবা ভৃত্যদের বাসভবন বলে মনে হয়। এ থেকে ধারণা করা যায় যে একজন রাজা কিংবা প্রধান পূজারির প্রশাসনিক কাজে সাহায্য করার জন্য এই কর্মচারীরা নিয়োজিত ছিল। এর স্বপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই আসলে; এমনও হতে পারে যে সেখানে কোনো রাজাই ছিলেন না।
হরপ্পার ধ্বংসস্তূপে কোনো কাদামাটির ট্যাবলেট, প্যাপিরাস অথবা অন্য কোনো ধরনের নথির খোঁজ পাওয়া যায়নি। যদিও এই ধরনের নথি তৈরি করার মতো একটি সুনির্দিষ্ট লিপি দেখা যায় সেখান থেকে প্রাপ্ত দুর্বোধ্য শিলালিপিতে। এই ব্যাপারটাও ভাবা দুষ্কর যে পূজারি, রাজা ও আমলারা তাদের দৈনন্দিন কার্যধারা পরিচালনা করে গিয়েছেন কোনো ধরনের নথি রাখার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই।
শাসনতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, হরপ্পার বণিকরা অনেক দূরের শহরগুলোর সাথে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। উর শহরের ধ্বংসাবশেষে হরপ্পার সিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে—সার্গনের আমলের। খুব সম্ভব এই দুটি সভ্যতার প্রথম দেখা হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব আরবে, যেখানে তারা উভয়েই মাগানের খনি থেকে তামা ক্রয় করেছিল; এবং তারপর তারা নিজেদের মাঝে সরাসরি পণ্যের আদানপ্রদান শুরু করে।
পারস্যের উপসাগরের তীরে অবস্থিত উর ভারতীয় ও আক্কাদীয় পণ্যের আদান-প্রদানের জন্য উপযুক্ত শহর ছিল। ভারতীয় বণিকরা সিন্ধু নদ থেকে জাহাজ চালিয়ে আরব সাগরে প্রবেশ করত। সেখান থেকে তারা ওমান উপসাগর হয়ে আরও উত্তরে পারস্য উপসাগর হয়ে ইউফ্রেটিস নদীতে পৌঁছে যেতেন। এই পথ অবলম্বনের কারণে তারা উত্তরের সমতলভূমির সামনে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা কিরথার পর্বতমালাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। এলামাইটদের এলাকায় খুব কাছে অবস্থিত সুতকাগেন দোর নামক একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
ধারণা করা হয় যে এই দুটি কৃষ্টির মাঝে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিরাজ করছিল।
কিছুদিনের জন্য ধারণা করা হয়েছিল যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়া সেখানে আর কোনো শহর ছিল না। তবে এরপর প্রায় আরও সত্তরটি হরপ্পা শহর আবিষ্কৃত হয়েছে যা সিন্ধু নদের মুখ থেকে শুরু করে একেবারে উত্তরের জলপ্রবাহের সাথে সাথে এগিয়েছে এবং পশ্চিমের সুতকাগেন দোর থেকে শুরু করে পূর্বের নর্মদা নদী পর্যন্ত গিয়েছে। হরপ্পার সভ্যতাটি সম্ভবত পাঁচ লাখ স্কয়ার মাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল।
শহরগুলো নিচু এবং প্রশস্ত। এগুলো তৈরি হয়েছে চুল্লিতে সেঁকা কাদামাটির ইট দিয়ে।
বাড়িগুলো কদাচিৎ দোতলার চেয়ে বেশি উঁচু এবং পাশাপাশি দুটি গরুর গাড়ি চলতে পারে এরকমভাবে নির্মিত সড়কগুলোর দুই পাশে তাদের অবস্থান ছিল। গোলাঘরগুলোতে খাদ্যশস্য জমানো থাকত এবং সেগুলো সুপরিকল্পিতভাবে বড়ো শহরগুলোর কাছে নির্মিত হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাতে আরামদায়কভাবে ত্রিশ হাজার করে মানুষ থাকতে পারত।
সম্ভবত হরপ্পার বাসিন্দাদের কাছে ধোয়ামোছার ব্যাপারটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রতিটি রাস্তায় নর্দমা এবং দূষিত ও ময়লা পানি নিষ্কাষণের কার্যকরী ব্যবস্থা করা ছিল এবং প্রতিটি ঘরেই বাথরুম ছিল। বড়ো শহরগুলোর কিছু বাড়িতে অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে সুইমিং পুল আকৃতির সুবিশাল গোসলের জায়গা ছিল এবং তার চারপাশে ছোটো ছোটো ঘর ছিল যা সম্ভবত কাপড়চোপড় বদলানোর কাজে ব্যবহৃত হতো।
কেউ হলফ করে বলতে পারবে না যে তাদের এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মূলে কী ধর্ম ছিল, না তাদের ব্যক্তিগত শুচিবায়ু কাজ করছিল। মজার ব্যাপার হলো, হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এমন কোনো দালান উদ্ধার করতে পারেননি যেটাকে মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
হরপ্পার শহরগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের দুর্গগুলো—উঁচু উঁচু দালান, যার চারপাশে ছিল প্রাচীর এবং প্রহরা মিনার। এই দুর্গগুলোর পেছনে আরও অনেক বাড়ি খুঁজে পাওয়া যেত যেগুলো মূলত পূর্বদিকে ছড়িয়ে যেত।
শহরের চারপাশে আরেকটি কাদামাটি দিয়ে বানানো ইটের মোটা প্রাচীর ছিল। শত্রুরা এই প্রাচীরটি ভেদ করতে পারলেও শহরের বাসিন্দারা পিছিয়ে গিয়ে দুর্গে আশ্রয় নিতে পারত, যা ছিল তাদের শেষ আশ্রয়।
এ থেকে মনে চিন্তার উদ্রেক হয়, হরপ্পার বাসিন্দারা কী নিয়ে এত ভীত ছিলেন যে তাদের দুই স্তরের প্রাচীরযুক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন পড়েছিল? সুমেরীয় কিংবা এলামাইটরা কেউই এত দূরে সৈন্যবাহিনী পাঠায়নি। সেই এলাকায় বর্বর যাযাবর জাতিদের অস্তিত্বের ব্যাপারেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপরও আমরা দেখতে পাই যে দুই স্তরের প্রাচীরগুলো ছিল অনেক উঁচু ও মোটা এবং শত্রুকে দূরে রাখার জন্য তার মাঝে ছিল প্রহরা মিনার এবং র্যাম্পার্ট।
এসব শক্তিবর্ধক ব্যবস্থা থেকে হরপ্পার বাসিন্দাদের মন-মানসিকতা নিয়ে আমরা একটি স্পষ্ট ধারণা পাই।
দীর্ঘদিন ধরে আমরা এটাই ভেবেছি যে প্রাচীন গ্রামভিত্তিক সমাজগুলো প্রাকৃতিকভাবেই দুর্গে ঘেরা শহুরে ব্যবস্থায় উন্নিত হয়েছে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে। তবে আরও একটি সম্ভাবনার কথাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না; মহেঞ্জোদারো থেকে ত্রিশ মাইল দূরে সিন্ধু নদের অপর প্রান্তে কোট দিজি নামের একটি শহর দাঁড়িয়ে আছে।
কোট দিজিরের ধ্বংসাবশেষ খনন করে দেখা যায় যে হরপ্পার শহরগুলো তৈরি হওয়ার শত শত বছর আগেই সেখানে শক্তিবর্ধক প্রাচীর বানানো হয়েছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। হরপ্পার স্বর্ণযুগের প্রথমদিকে এই প্রাচীরগুলোকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। তারপর একটি বড়ো আকারের অগ্নিকাণ্ডে শুধু প্রাচীরগুলোই নয়, পুরো শহরটিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
পুরানো কোট দিজি শহরের উপর নতুন একটি শহর বানানো হয়েছিল। সেই শহরে প্রশস্ত রাস্তা, ইটের তৈরি নর্দমা এবং গোসলখানা-সংবলিত বাড়ি ছিল। এটি ছিল পুরোদস্তুর একটি হরপ্পা শহর; এর সাথে পূর্বের কোট দিজির তেমন কোনো মিল ছিল না।
হরপ্পার সময়ে কোট দিজিই একমাত্র শহর ছিল না যেটি জোরপূর্বক অধিগ্রহণের শিকার হয়েছিল। সিন্ধু নদের তীরে, মহেঞ্জোদারো থেকে আরও একশ মাইল দক্ষিণে, আমরি নামক স্থানে একটি প্রাচীন উপনিবেশ থেকে হঠাৎ করেই অর্ধেক মানুষ পালিয়ে যায়। সেই জায়গায় পরবর্তীতে হরপ্পার মতো নকশায় নতুন একটি শহর গড়ে ওঠে; যেখানে ছিল একই ধরনের রাস্তা, নর্দমা ও গোসলখানা-সংবলিত বাড়িঘর।
হরপ্পার খুব কাছেই, সামান্য উত্তরে, কালিবাঙ্গানে আরেকটি প্রাচীন এবং ভঙ্গুর শহর থেকে বাসিন্দারা অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল এবং সেখানেও ধ্বংসস্তূপের উপর হরপ্পার মতো আরেকটি শহর গড়ে ওঠে।
এখানে আলোচিত প্রতিটি শহরের ক্ষেত্রেই জোরদখল কিংবা যুদ্ধবিগ্রহের তেমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ধারাটি খুবই সন্দেহজনক; হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার সর্বদা প্রাকৃতিকভাবে হয়নি। অন্তত কিছু শহরের ক্ষেত্রে তা জোরপূর্বক অধিগ্রহণের মধ্য দিয়েই হয়েছে; সম্ভবত কোনো একটি যুদ্ধংদেহি ভারতীয় গোত্রের হাত ধরে। অন্যদেরকেও নিজেদের মতো ভেবে (কিংবা পরাজিত গোত্রদের প্রতিশোধপরায়ণতাকে ভয় পেয়ে) তারা দুই স্তরবিশিষ্ট প্রাচীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
অস্ত্রের মাধ্যমে ভূদখল কোনো অসাধারণ ঘটনা ছিল না কিন্তু হরপ্পা থেকে প্রায় পাঁচ লাখ বর্গমাইল দূরের জনবসতিগুলোতেও একই ধরনের স্থাপত্যকলার নিদর্শন দেখা গিয়েছে, যা খুবই আশ্চর্যজনক। প্রতিটি শহরের প্রাথমিক নকশা একইরকম—শহরের ভেতরে থাকা দুর্গটি বাড়িঘর ও দোকানগুলো থেকে দূরে এবং সর্বদাই পশ্চিমদিকে থাকত। বাড়িঘর ও দোকানগুলোকে একত্রে ‘নিম্ন গ্রাম’ নামে অভিহিত করা হতো এবং সেটির চতুর্দিকে সুপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট বানানো হতো।
কোন রাস্তাকে কতখানি ভার বহন করতে হবে সেই অনুযায়ী তাদেরকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছিল সেখানে। প্রধান সড়কগুলো চব্বিশ ফুট চওড়া, সাধারণ সড়ক আঠারো ফুট আর এই দুই ধরনের রাস্তা ব্যতীত বাকি গলিগুলো বারো ফুট চওড়া ছিল, যা প্রধান সড়কের অর্ধেক। রাস্তাগুলো পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত ছিল; সেগুলো উত্তর থেকে সরাসরি দক্ষিণ কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। শহরগুলোতে ওজন মাপার প্রমিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো, যেটাতে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই, কেননা সার্গনের আক্কাদীয় সাম্রাজ্য এবং মিশরীয়রা একই পথে হাঁটছিলেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই প্রমিতকরণ কাদামাটির ইটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়েছিল এবং মাপ ছিল দৈর্ঘ, প্রস্থ ও উচ্চতায় যথাক্রমে ১৭.৫, ১৫ ও ৩০ ফুট।
এই পরিমাপটি খুবই কার্যকরী, যা বাচ্চাদের খেলনা লেগোর ব্যাপারে উৎসাহী যে-কোনো ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবেন। সাথে সাথে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে কোনো এক অজানা উপায়ে প্রাচীন যুগের মানুষগুলো এই একই মাপকে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করার এক বিচিত্র নজির স্থাপন করেছিল। জন কিয়েই এই ব্যাপারটিকে এক ধরনের খেয়ালি ব্যাপার বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন যে দালান বানানোর যন্ত্রপাতিগুলোও একই মাপে তৈরি ছিল এবং সেগুলোকে সব সময় একইভাবে সাজিয়ে রাখা হতো মিস্ত্রিদের ব্যবহারের জন্য। সুতরাং এই কাঠমিস্ত্রির বাক্সটির চেহারা সব জায়গায় একরকমই থাকত—সেটিকে দেখলেই যে-কেউ বলতে পারত যে এই বাক্স হরপ্পা থেকে এসেছে; তা সে আরব সাগরের তীরে থাকুক কিংবা দুর্গম দক্ষিণ পাঞ্জাবেই হোক না কেন।
খুব সম্ভব দৈনন্দিন জীবনধারা এক-একটি শহরে এক-একরকম ছিল। হরপ্পা সভ্যতার বিস্তারটি স্টার ট্রেক সিরিজের বর্গ নামক ভিনগ্রহের প্রাণীদের আগ্রাসনের মতো আক্রমণাত্মক ছিল না। তবে এটা নিশ্চিত যে বেশ দূরে দূরে অবস্থিত শহরগুলোর মধ্যে এরকম প্রমিতকরণের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগাযোগব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব যোগাযোগের কোনো নমুনা কিংবা প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সময়ে হরপ্পার লিপিটিও একটি নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে-তার মানে যা-ই হোক না কেন।
এত কিছুর পরও আমাদের জন্য হরপ্পার বাসিন্দারা কোনো বার্তা রেখে যাননি। হরপ্পার শহরগুলোর কোনো ব্যক্তিত্ব নেই আমাদের চোখে। তারা যদি ভিনগ্রহের প্রাণীদের মতো হয়ে থাকে, তার মূল কারণ হচ্ছে তাদের কোনো শব্দ সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই—সমষ্টিগতভাবেও না, আবার ব্যক্তিগত পর্যায়েও না।