অধ্যায় চার – সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন
নীল নদীর উপত্যকায় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালে স্করপিয়ন রাজা উত্তর ও দক্ষিণ মিসরকে একীভূত করেন এবং প্রথম রাজবংশের প্রতিনিধি নারমার এই একীভূতকরণকে চিরস্থায়ী রূপ প্রদান করেন।
সুমেরের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে, ভূমধ্যসাগরের তীরে, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী ব্যক্তিটি নীল নদের উপত্যকা ধরে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসেন।
সুমেরের রাজাদের মতো স্করপিয়ন রাজার কাহিনিটিও ইতিহাস ও শ্রুতির মাঝামাঝি একটি ব্যাপার। তাকে কোনো রাজার তালিকায় পাওয়া যায় না; তার অস্তিত্ব পাওয়া যায় শুধু একটি আলংকারিক অস্ত্রের উপর খোদিত ছবি হিসেবে। কিন্তু স্করপিয়ন রাজার গল্প লিখিত ইতিহাসের মাঝেই পাওয়া যায়; তার উপাখ্যানটি সুমেরের প্রথম রাজার মতো অস্পষ্ট নয়। তিনি তার চারপাশের পৃথিবীকে দখল করে নেওয়ার প্রয়াস চালান খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালে।
স্করপিয়ন রাজা ছিলেন আফ্রিকান মানুষদের বংশধর যারা এক সময় নীল নদের উপত্যকার দুপাশে বসবাস করতেন। তার জন্মের শত শত বছর আগে, যখন কালজয়ী আলিলুম রাজত্ব করতেন সোঁদা এবং শীতলতর সুমেরে, তখন এই এলাকা মনুষ্য বসতির উপযোগী ছিল না। প্রতি বছর যখন দক্ষিণের পাহাড়গুলোতে তুমুল বৃষ্টি নেমে আসত, সে পানি নীল নদের মাধ্যমে উত্তরের ভূমধ্যসাগরের দিকে ধেয়ে যেত এবং তার চারপাশের ভূমিকে বন্যায় ভাসিয়ে দিত। এই বন্যা এতটাই প্রবল ছিল যে শুধু স্বল্পসংখ্যক শিকারি ও আহরণকারী ছাড়া কেউ আর সেখানে থাকত না। বন্যা চলাকালীন তারা সেখানে না থেকে বরং পূর্ব ও পশ্চিমে অবস্থিত রেড সি-র তীরবর্তী আরামদায়ক এলাকায় চলে যেত। কিছু লোক সাহারা মরুভূমিতেও ঘুরে বেড়াত। সেসব নাতিশীতোষ্ণ বছরগুলোতে সাহারা ছিল ঘাসাচ্ছাদিত এবং আর্দ্র। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ সাহারার বালির নিচে গাছ, গাছের পাতা এবং শিকারযোগ্য পশুর দেহাবশেষ আবিষ্কার করেছেন।
কিন্তু উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু মেসোপটেমীয় সমতলভূমির রূপ পরিবর্তন করেছিল, যা পরবর্তীতে একইভাবে সাহারাকেও ক্ষতবিক্ষত করেছে। সাহারার বাসিন্দারা পূর্বদিকে যাত্রা করে নীল নদের উপত্যকার জলপূর্ণ অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। ততদিনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গিয়ে নীল নদের বন্যার প্রকোপ অনেকটাই কমে গিয়েছে এবং শরণার্থীরা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে প্রতি বছর আসা জলাবদ্ধতার সমস্যাকে তারা খুব সহজেই ব্যবস্থাপনা করতে পারে- খালবিল খনন ও জমিয়ে রাখা পানি দ্বারা সেগুলোকে ভরাট করার মাধ্যমে। তারা নদীর তীরে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছিল; শস্যের বীজ বুনেছিল নদীর পানিতে বয়ে আনা উর্বর পলিমাটির বুকে। তারা বন্য গরু-ছাগল, কুমির, জলহস্তী, মাছ ও পাখি শিকার করত আশেপাশের জলাভূমি থেকে। অন্য মানুষরা রেড সি-র পশ্চিম তীর থেকে যাত্রা করে এসে তাদের সাথে বসবাস করত। তারাই ছিল নীল নদের উপত্যকার প্রথম অধিবাসী-তারাই ছিল প্রথম মিশরীয়।
নীল নদের উপত্যকায় ছিল শিকার করার মতো পশুপাখি, মাছ, পাথর, তামা, সোনা, শণ ও প্যাপিরাস, যার প্রায় কিছুই সুমের অঞ্চলে ছিল না। তাদের কাছে ছিল না শুধু কাঠ। মিশরীয়রা পশ্চিমের সাথে হাতির দাঁত, পূর্বের সাথে ঝিনুক এবং উত্তরের সাথে মূল্যবান পাথরের জন্য বাণিজ্য করত কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য নীল নদই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল।
মিশর যদি একটি মানুষ হতো তা হলে নীল নদ হতো তার রক্তপ্রবাহ। নীল নদের দৈর্ঘ্য ছিল ৫০০ মাইল, যার কিছু অংশ ছিল পাহাড় ঘেরা আর কিছু অংশ ছিল সমতলভূমি দ্বারা বেষ্টিত।
প্রতি বছর বন্যার পানি স্রোতের উপরের দিকে অবস্থিত পাহাড়ি এলাকা (এখনকার ইথিওপিয়া) থেকে প্রথমে দ্বিতীয় জলপ্রপাত এবং তারপর প্রথম জলপ্রপাতের দিকে প্রবাহিত হতো এবং তারপর কাঁত হয়ে এমন একটি জায়গায় পৌঁছাত যেখানে রাজাদের কবর দেওয়া হতো; এবং সব শেষে তা বজ্রের গতিতে একটি সমতলভূমির দিকে এগিয়ে যেত এবং এক ডজন ভাগে বিভাজিত হয়ে নীল বদ্বীপে গিয়ে পৌঁছাত।
যেহেতু নীল নদ দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে প্রবাহিত হতো, মিশরীয়দের কাছে এটি পরিষ্কার ছিল যে অনেক নদীই তার উৎপত্তিস্থলের উলটোদিকে প্রবাহিত হয়। তাদের লিখে রেখে যাওয়া হায়েরোগ্লিফিক্স থেকে জানা যায় যে তারা একই শব্দ দিয়ে উত্তর, নিম্নমুখী স্রোত ও মাথার পেছনের দিককে বোঝাত এবং আরেকটি শব্দ ব্যবহার করত ঊর্ধ্বমুখী স্রোত, দক্ষিণ ও মুখ বোঝানোর জন্য। একজন প্রাচীন মিশরীয় ব্যক্তি দাঁড়ানোর সময় সব সময়ই দক্ষিণদিকে ফিরে অর্থাৎ নীল নদের স্রোতের দিকে মুখ করে থাকতেন।
প্রাচীনতম জনবসতির সময় থেকে মিশরীয়রা তাদের মৃতদের মরুভূমির প্রান্তে কবর দিত—তাদের মাথাকে দক্ষিণামুখী করে এবং মুখকে পশ্চিমের সাহারা মরুভূমির দিকে হেলিয়ে রেখে। তাদের মতে, জীবন এসেছিল দক্ষিণ থেকে কিন্তু মৃতদের ভূমি ছিল পশ্চিমে, মরুভূমির দিকে, যেখানে তারা পলায়ন করত যখন তাদের বাসস্থান থেকে ঘাস ও পানি উধাও হয়ে যেত।
প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের দেশকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকত। যেখানে বাৎসরিক বন্যার কারণে পলিমাটি এসে জমা হতো তার নাম ছিল ‘কেমেট’ বা কালো ভূমি; কারণ কালো ছিল জীবন ও পুনরুজ্জীবিত হওয়ার রং। এই কালো ভূমি পেরিয়ে আসলে পাওয়া যায় ‘ডেশরেট’ বা মারাত্মক লাল ভূমি। জীবন ও মৃত্যুর মাঝের এই পার্থক্য এতটাই পরিষ্কার ছিল যে একজন মানুষ নিচু হয়ে একপাশের উর্বর কালো ভূমিতে এক হাত আর অপর হাতটি সূর্যের তাপে ভাপানো লাল মরুভূমিতে রাখতে পারত।
এই দ্বৈততা, দুটি চরম পর্যায়ের মাঝে অবস্থিত অস্তিত্বের ধারণাটি, মিশরের ক্রমবিকাশমান সভ্যতার কেন্দ্রীয় ধারণা ছিল। সুমেরের শহরগুলোর মতো মিশরীয় শহরগুলোতেও খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সাল নাগাদ অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক মানুষের আগমন ঘটে। নুবট (নাদাকা নামেও পরিচিত) শহরটি ছিল পূর্ব-পশ্চিমমুখী রাস্তাটির উপরে অবস্থিত, যা স্বর্ণখনি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খুব কম সময়ের মধ্যেই এটি দক্ষিণের সবচেয়ে শক্তিশালী শহরে পরিণত হয়। ১০ হাজার মানুষের বাসস্থান হিয়েরাকনপলিসও খুব বেশি দূরে ছিল না।
এসব দক্ষিণের শহর নিজেদেরকে স্বায়ত্তশাসিত কিংবা স্বাধীন হিসেবে দাবি না করে বরং একটি বড়ো রাজত্বের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, যা ‘সাদা রাজত্ব’ কিংবা ‘উচ্চ মিশর’ (যেহেতু এটি ভূমধ্যসাগর থেকে উপরের দিকে অবস্থিত ছিল) হিসেবে পরিচিত ছিল। এই রাজ্যটি একটি রাজা দ্বারা শাসিত হতো যিনি একটি সিলিন্ডারের মতো দেখতে সাদা মুকুট পরতেন। উত্তরে ‘নিম্ন মিশর’-এর শহরগুলো জোট বেঁধে নিজেদেরকে ‘লাল রাজত্ব’ হিসেবে কায়েম করে এবং হেলিওপোলিস ও বুটো শহর বিশেষ গুরুত্ব পায়। নিম্ন মিশরের রাজা একটি লাল মুকুট পরতেন যার সামনের দিকে একটি অজগর খোদিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে প্রথমবারের মতো চিত্রিত এই মুকুটটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ছিল অজগর দেবী, যে রাজার শত্রুদের দিকে থুতু দেওয়ার মতো করে বিষ নিক্ষেপ করত।
চিত্র-২ : স্করপিয়ন রাজার গদা
দুটি রাজত্ব—সাদা ও লাল-লাল ভূমি ও কালো ভূমির মতো মিশরের প্রাথমিক চিন্তাধারাকে তুলে ধরেছিল, যার মূলমন্ত্র ছিল যে গোটা পৃথিবীটা দাঁড়িয়ে আছে বিপরীতমুখী শক্তির ভারসাম্যের উপর।
সুমেরীয় রাজাদের তালিকার মতো মিশরের রাজার তালিকায় নেই সাদা ও লাল রাজত্বের কোনো বিস্তারিত বর্ণনা। এ থেকে বোঝা যায় যে মিশরীয়রা সুমেরীয়দের মতো পৃথিবী সৃষ্টির সময় থেকে তাদের ইতিহাসকে গণনা করত না।
তবে স্করপিয়ন রাজার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা খুঁজে পেয়েছি একটি ভিন্নধর্মী প্রমাণ : হিয়েরাকনপোলিসের মন্দির থেকে খনন করে পাওয়া একটি গদা। এই গদাটির মাথায় খোদিত রয়েছে একটি দৃশ্যপট যেখানে সাদা রাজা তার বিখ্যাত সাদা মুকুটটি পরে লাল রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়কে উদযাপন করছেন। তার হাতে রয়েছে একটি সেচযন্ত্র যা তার প্রজাদের উপর তার প্রভাবের পরিচায়ক। ডানপাশে হায়েরোগ্লিফিক্সের মাধ্যমে তার নাম লিপিবদ্ধ করা আছে, যা হচ্ছে ‘স্করপিয়ন’।
স্করপিয়ন রাজা সম্ভবত নিজেই হিয়েরোকনপোলিসের বাসিন্দা ছিলেন, যা আসলে একইসাথে দুটি শহর ছিল। হিয়েরোকনপোলিস নীল নদ দ্বারা বিভক্ত ছিল দুই ভাগে। পশ্চিম তীরে ছিল নেহকেন—বাজপাখি দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি শহর এবং পূর্ব তীরের নেহকেবের সুরক্ষার ভার ছিল শকুনি দেবীর হাতে। সময়ের প্রয়োজনে দুটি শহর ধীরে ধীরে এক হয়ে যায় এবং বাজপাখি দেবতাকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করে শকুনি দেবী। হয়তো বা এই দুটি শহরের একীভূতকরণ দেখেই স্করপিয়ন রাজা প্রথম চিন্তা করেন সাদা ও লাল রাজত্বকে একই রাজার শাসনাধীন করার ব্যাপারটা।
তিনি বিজয়ী হন খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালের দিকে; কিন্তু সেই জয় ছিল সাময়িক।
আরেকটি খোদিত নথি থেকে আরও একশ বছর পরের একজন সাদা রাজার কথা জানা যায় যিনি স্করপিয়ন রাজার মতো এই দুটি রাজত্বকে একীভূত করতে পেরেছিলেন। স্করপিয়ন রাজার গদার মতো এই নথিও পাওয়া গিয়েছিল হিয়েরোকনপোলিসের একটি মন্দির থেকে। এই তথ্যটি খোদিত ছিল একটি পাথরের প্যালেটের উপর যা ক্যানভাস হিসেবে কাজ করেছিল খোদাইকারকের জন্য। প্যালেটের উভয়পাশেই খোদাই করা ছিল। সেখানে একজন রাজাকে চিত্রিত করা হয়েছে—যিনি ক্যানভাসের সামনের দিকে তিনি লাল মুকুট পরে আছেন আর পেছনের দিকে সাদা মুকুট। হায়েরোগ্লিফিক্সে তার নাম লেখা আছে ‘নারমার!’
নারমার শব্দটির মানে হচ্ছে ‘উন্মাদ মাগুর মাছ’ অথবা আরও কাব্যিকভাবে বলতে গেলে ‘বিপর্যয়কর মাগুর মাছ’। এটি একটি প্রসংশাসূচক উপাধি, কারণ মাগুর মাছ ছিল সবচেয়ে সাহসী ও আক্রমণাত্মক মাছ। নারমার প্যালেটের পেছনের দিকে, সাদা রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাকে দেখা যাচ্ছে লাল রাজত্বের একজন যোদ্ধাকে তার চুল ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতে। প্যালেটের সামনের দিকে, নারমার সাদা মুকুট ফেলে লাল মুকুট মাথায় দিয়ে মস্তকবিহীন যোদ্ধাদের লাশের সামনে দিয়ে বিজয়ীর বেশে প্যারেড করছেন।
অবশেষে তিনি সাদা রাজত্বের আওতায় লাল রাজত্বকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
খুব সম্ভব নারমার হচ্ছে মেনেস-এর আরেকটি নাম, যিনি মিশরের প্রথম মানব রাজা হিসেবে মিশরীয় রাজাদের তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। তার ব্যাপারে মিশরীয় পুরোহিত মানেথো বলেন-
‘দেবতা এবং অর্ধদেবতার পর
প্রথম রাজবংশের আবির্ভাব হয়, যাদের ছিল আটজন রাজা
মেনেস ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম।’
তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের অগ্রভাগে থেকে সুনিপুণ নেতৃত্বের মাধ্যমে বড়ো বড়ো জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। দুটি রাজত্বের মাঝের সীমানাটি দখল করে নেওয়ার মাধ্যমে তিনি তৈরি করেছিলেন প্রথম সাম্রাজ্যটি, যা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা রাজত্বের মাঝে একটি। এটি ছিল অনেক বড়ো গৌরবের উৎস।
প্রকৃত ঘটনাগুলো ঘটার অনেকদিন পরে মানেথো সেগুলোর বর্ণনা লিখেন। প্রায় তিন শতক পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ সালের দিকে, মানেথো হেলিয়োপোলিস শহরে সূর্যদেবতা ‘রা’-এর মন্দিরে কাজ করতেন। তিনি মিশরীয় রাজাদের বিভিন্ন তালিকাকে সমন্বিত করার কাজটি নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। ‘তুরিন কামান’ নামক একটি প্যাপিরাসে মেনেসকে মিশরের প্রথম রাজা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। তিনি এই প্যাপিরাস এবং আরও কিছু নথি ব্যবহার করে সমন্বিত তালিকাটি প্রস্তুত করেছিলেন; যেখানে খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ সাল থেকে শুরু করে ততদিন পর্যন্ত যত রাজা রাজত্ব করেছিলেন তাদের সবাইকে ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করে বিন্যস্ত করেছিলেন। তিনি এক-একটি ভাগ বা দলকে ‘ডাইনেসটিয়া’ নামে অভিহিত করেন, যা ছিল একটি গ্রিক শব্দ (রাজত্ব করার ক্ষমতা)। মানেথোর বর্ণিত রাজবংশ বা ডাইন্যাস্টিগুলো সম্পূর্ণরূপে সঠিক ছিল না কিন্তু তাদেরকেই মিশরীয় ইতিহাসে রাজা ও রাজত্বের প্রথাগত চিহ্নরূপে ব্যবহার করা হয়।
মানেথোর হিসেবমতে প্রথম রাজবংশের আবির্ভাব ঘটে যখন মিশরের দুটি অংশ একীভূত হয়। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে মেনেস/নারমার তার বিজয় উদযাপন করেছিলেন মেমফিসে একটি নতুন রাজধানী তৈরি করার মাধ্যমে, যেটি ছিল নতুন রাজত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে। মেমফিস মানে হচ্ছে সাদা দেওয়ালসমূহ’। দেওয়ালগুলো এমনভাবে প্লাস্টার করা হয়েছিল যাতে সূর্যের আলো পড়লে তা জ্বলজ্বল করতে থাকে। সাদা শহরে বসে একীভূত মিশরের রাজা দক্ষিণের উপত্যকা এবং উত্তরের বদ্বীপ-দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন অনায়াসে।
আরেকটি গদার মাথায় খোদাই করা দৃশ্যপটে দেখা যায় নারমার কিংবা মেনেস লাল মুকুট মাথায় দিয়ে কোন একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন যা দেখতে অনেকটা বিবাহের অনুষ্ঠানের মতো। সম্ভবত প্রথম রাজবংশের গোড়াপত্তনকারী বিজয়ী বীর লাল রাজত্বের রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন, যাতে তিনি একাই দুটি রাজত্বের অবিসংবাদিত রাজা হিসেবে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করতে পারেন এবং তার বংশধররা দ্বৈত রাজত্বের উত্তরাধিকারী হতে পারে।
মিশরের বাকি ইতিহাসজুড়ে রয়েছে এই দ্বৈততার ছাপ যা তাদের রাজাদের মাঝে সর্বদা বিদ্যমান ছিল। তাকে বলা হতো দুই ভূমির অধিপতি এবং তার মুকুটটিও তৈরি হতো উচ্চ মিশরের সাদার উপর নিম্ন মিশরের লাল রং দিয়ে। দক্ষিণের শকুন এবং উত্তরের অজগর; একজন পৃথিবীর বুকে গড়াতে গড়াতে ধাবমান, আরেকজন আকাশের বুক চিরে তীব্র বেগে উড্ডয়মান—দুজনই ছিল একীভূত রাজত্বের রক্ষাকর্তা। দুটি বিপরীতধর্মী ক্ষমতাকে একসাথে এনে একটি শক্তিশালী এবং ভারসাম্যযুক্ত রাজত্বের গোড়াপত্তন হয়েছিল তখন।
নারমার প্রায় ৬৪ বছর রাজত্ব করেছিলেন। সেই যুগে রাজারা তাদের শত্রুদের উপর আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে জলহস্তী শিকারে যেতেন। মানেথোর মতে, এরকম একটি প্রমোদ শিকার চলাকালীন একটি জলহস্তী নারমারকে কোণঠাসা করে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে।