অধ্যায় একুশ – জিয়া রাজবংশের পতন
ইয়েলো রিভার উপত্যকার দুর্নীতিগ্রস্ত জিয়া রাজবংশ খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৬৬ সালে শ্যাং রাজবংশের কাছে পরাজিত হয়।
ইতোমধ্যে চীনের প্রাচীন রাজারা বাস্তবতা ও পুরাণের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসে থেকেছেন। মহান ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী, জিয়া রাজবংশ প্রায় চারশো বছর ধরে চীনের সিংহাসন দখল করে রেখেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০৫ থেকে ১৭৬৬ সালের মাঝে ১৭ জন সম্রাট দেশটিকে শাসন করেছেন বিভিন্ন মেয়াদে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা জিয়া রাজপ্রাসাদ এবং রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু আজ প্রায় ১৫০০ বছর পরে সিমা কিয়ানের বর্ণিত চরিত্রগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চিত করার মতো কোনো নিরেট প্রমাণ আমরা হাতে পাইনি।
জিয়া রাজবংশের কাহিনিকে আমরা কথ্যভাষায় প্রচলিত গল্প হিসেবে ধরে নিলেও এটুকু ভালো করেই বোঝা যায় যে প্রাচীন চীনের শাসকদের সংগ্রামগুলো মেসোপটেমিয়ার সমতলভূমির সংঘর্ষগুলো থেকে বেশ খানিকটাই ভিন্ন ছিল। চীনে তখনও সভ্য মানুষদের আক্রমণ করার মতো কোনো যাযাবর বাহিনী ছিল না এবং জাতিগত বিদ্বেষও অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল সেখানে। সেই সময় জনজীবনের উপর সবচেয়ে বড়ো হুমকি ছিল তাদের নিজ শাসকের চারিত্রিক দৃঢ়তা কিংবা দুর্বলতা। বহিঃশত্রু নয়, শাসকের কোনো ধরনের দুর্বলতার কারণেই তার সিংহাসনের উপর বিপদ নেমে আসত।
জিয়া রাজবংশের আবির্ভাবের আগে যে তিনজন মনীষী রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা তাদের উত্তরসূরি হিসেবে সন্তানদের নয় বরং যোগ্য ও নিরহংকারী মানুষদের নির্বাচন করেছিলেন। শুধু শাসনের যোগ্যতার ভিত্তিতে তৃতীয় রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ইউ। সিমা কিয়ানের বর্ণনামতে, তিনি ছিলেন একজন সুশাসক যাকে তার পূর্বসূরি নির্বাচন করেছিলেন ইয়েলো রিভারের বন্যা সমস্যার সমাধান করার জন্য।
‘বন্যার পানি এত ভয়ংকর ও হিংস্র ছিল যে তা উপচে উঠে স্বর্গের দিকে ধাবিত হতো এবং তা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তা পাহাড় পর্বতকে ভরিয়ে তুলত’, বলেন কিয়ান। ইউ পরবর্তী ১৩ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করলেন। তিনি খাল ও বিল খনন করলেন, নদীতে বাঁধ তৈরি করে দিলেন এবং তীরকে প্রতিরক্ষা দিলেন এবং ইয়েলো রিভারের প্রবাহকে পরিবর্তন করে জমিতে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলেন। এভাবে তিনি সমগ্র ভূখণ্ডকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করলেন এবং বহু বছরের পরিশ্রম শেষে তিনি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেন। এসব কারণে তাকে একইসাথে পরিশ্রমী ও ক্লান্তিহীন রাজা বলা হতো। তাকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হয়নি; এই সময়টা তিনি অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার কাজে ব্যয় করেছেন।
ইউ-র শাসিত ভূখণ্ডটিতে চৈনিক রাজবংশের আগমনের আগে লংশান নামের একটি সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল। তারা ইয়েলো রিভারের দক্ষিণ প্রান্তে প্রাচীর ঘেরা গ্রাম বানিয়েছিলেন।
এই গ্রামগুলো সম্ভবত গোত্রপ্রধানদের দ্বারা পরিচালিত হতো। তারা এক- একটি পরিবারের ‘মাথা’ হিসেবে কাজ করতেন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক কিংবা যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে অন্যান্য গ্রামের গোত্রপ্রধানদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করতেন। জিয়া রাজবংশের প্রথম যুগের দলিলগুলোতে ‘সামন্ত প্রভু’ কিংবা ‘ডিউক’দের কথা বলা হয়েছে যারা জিয়া রাজাদের বিভিন্ন সময়ে পীড়া দিয়েছেন। এই উপাধিগুলো লংশান গোষ্ঠীপতিদের এনাক্রোনিস্টিকভাবে দেওয়া হয়েছে।
ইউ রাজার রাজধানী শহরটি কোথায় ছিল তা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ থেকে ১৭৬৬ সালের মাঝে কোনো এক সময়ে ইয়েলো রিভারের দক্ষিণের বাঁকের কাছাকাছি জায়গায় জিয়াদের রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল। সেখানে মাটির নিচে খনন করে বড়ো বড়ো দালান খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যেগুলো দেখতে কিছুটা রাজকীয় প্রাসাদের মতো
খুব সম্ভব রাজধানী শহর আর্লিটোউ স্থাপিত হয়েছিল ইয়েলো রিভারের দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে আরও দক্ষিণ থেকে লো নদী এসে এর সাথে মিশেছে। দুই নদীর মিলে যাওয়ার স্থানে একটি উর্বর উপত্যকা তৈরি হয়েছিল। দুই নদীর বয়ে আনা পলিমাটির কারণে এখানে ফসল উৎপাদন করা খুব সহজ ছিল এবং এর তিনদিকে পাহাড় থাকায় শহরটিকে বাইরের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষা করাও অনেক সহজ ছিল। সব মিলিয়ে এটিই রাজধানীর জন্য আদর্শ স্থান ছিল।
আর্লিটোউ শহরে দুর্গের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও আশেপাশের বেশ কিছু প্রাচীর ঘেরা গ্রাম তাদের নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল এবং তারা নির্বিঘ্নে অন্যান্য গ্রামের সাথে ব্যাবসাবাণিজ্য চালিয়ে যেত। তাদের ছোটোখাটো সৈন্যদলও ছিল। তবে এই উপত্যকায় কিছুটা হলেও রাজার শাসন প্রযোজ্য হতো। রাজা ইউ ইয়েলো রিভারের বন্যা সমস্যা নিয়ে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছিলেন দেখে তাকেই সবাই অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। বন্যা সমস্যা মোটামুটি উপত্যকার সকল বাসিন্দাকেই বিপদগ্রস্ত করে রেখেছিল।
বার্ধক্য যখন রাজা ইউ-কে গ্রাস করছিল তখন তিনি তার পূর্বসূরি মনীষী রাজাদের মতো করে একজনকে উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন করেন যিনি তার মৃত্যুর পরে দেশ শাসন করবেন। এক্ষেত্রে তিনি রক্তীয় সম্পর্ককে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেন। নিজের ছেলে ‘কি’-র বদলে একজন যোগ্য মানুষকেই তিনি নির্বাচন করেছিলেন। তবে দুঃখজনকভাবে গ্রামের শক্তিশালী গোত্রপ্রধানরা তার পছন্দ করা ব্যক্তিকে গ্রহণ করলেন না; তারা তার ছেলে ‘কি’-র সমর্থনে দলবদ্ধ হলেন। তারা রক্তীয় সম্পর্কভিত্তিক উত্তরাধিকার পন্থাকে বেশি পছন্দ করছিলেন। এই বিদ্রোহমূলক কাজের মাধ্যমে ইয়েলো রিভারের গ্রামগুলোকে আবারও মনীষী রাজাদের রেখে যাওয়া সুশাসনের ব্যবস্থা থেকে রক্তীয় সম্পর্কভিত্তিক উত্তরাধিকারের যুগে নিয়ে গেল।
এই নতুন ব্যবস্থাটি সবাই এক বাক্যে মেনে নিলেন না। ইউহু গ্রামের বাসিন্দারা পরিবারের এক সদস্য থেকে আরেক সদস্যের কাছে সরাসরি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি একেবারেই মেনে নিতে পারলেন না। এই কারণে তারা নতুন রাজা কি-র অভিষেকের ভোজে অংশ নেননি। রাজা কি এই ধরনের অবাধ্যতাকে সহ্য করার মতো মানুষ ছিলেন না। তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের ধরপাকড় করল এবং ইউহু গ্রামের প্রতিরোধকে ভেঙে দিলো। তারা পুরো গ্রামকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে দাবি করল যে তাদেরকে বিদ্রোহ করার জন্য ‘স্বর্গীয় শাস্তি’ দেওয়া হয়েছে।
তবে রক্তীয় সম্পর্কের উত্তরাধিকার ব্যবস্থার প্রাথমিক যুগটি ঝামেলাহীন ছিল না। কি মারা যাওয়ার পর তার পাঁচ ছেলে রাজত্বের জন্য নিজেদের মাঝে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। তখনও জিয়া রাজ্যে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা হয়নি। পাঁচ ছেলের মাঝে যিনি শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে সিংহাসনে বসলেন তিনি ইউহু গ্রামবাসীদের উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে ক্ষমতা দখলসংক্রান্ত সব ধরনের ভয়ভীতিকে সত্য বলে প্রমাণ করে ছাড়লেন। জয়লাভের পরপরই তিনি দেশ শাসনের বদলে মেতে ওঠেন মদ, নারী, নাচগান ও অন্যান্য মউজ-মাস্তিতে। ফলস্বরূপ একটি শক্তিশালী গ্রামের গোষ্ঠীপ্রধান প্রাসাদে আক্রমণ চালিয়ে মসনদের দখল নিয়ে নিলেন। তবে অল্পদিন পরেই তাকে হত্যা করলেন তারই এক সভাসদ এবং নিজে সিংহাসন দখল করে নিলেন।
মনীষীদের পছন্দ করা রাজার অভাবে সারা রাজ্যে চলছিল চরম বিশৃঙ্খলা। এক সময় মনে হচ্ছিল যে এর চেয়ে রক্তীয় সম্পর্কের উত্তরাধিকার ভালো ছিল। এবং শেষ পর্যন্ত যিনি জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করা রাজার বিরুদ্ধে লড়ার মতো যথেষ্ট সৈন্যসামন্ত ও সহায়তা জোগাড় করতে পারলেন তিনি হচ্ছে প্রয়াত রাজা কি-র তিন প্রজন্ম পরের এক যোদ্ধা—শাও ক্যাং।
রাজধানী শহরে যখন রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল তখন শাও ক্যাং পালিয়ে যান পাশের এক গ্রামে। সেখানে তিনি তার সহযোগীদের জড়ো করে এর্লিটোউ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করলেন এবং সেই সভাসদ থেকে রাজায় পরিণত হওয়া দখলদারকে পরাজিত করে সিংহাসনে জেঁকে বসলেন।
এভাবে জিয়া রাজবংশের রাজত্ব ভালো করে শুরু হওয়ার আগেই তাদেরকে উদ্ধার করার প্রয়োজন পড়েছিল।
ঝামেলার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে জিয়া রাজবংশ প্রায় একশ বছর ধরে চীন শাসন করেছে।
তবে চীনা ইতিহাসবিদরা আমাদের জানান যে জন্মগতভাবে দেশ শাসনের অধিকার পেয়ে রাজারা দুর্নীতিপরায়ণ হতে শুরু করে। জিয়া রাজারা এক অদ্ভুত চক্রে প্রবেশ করেন, যে চক্রটি চীনের প্রাচীন ইতিহাসের পুরোটা সময়জুড়ে বারবার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। নতুন কোনো রাজবংশের প্রথমদিকের রাজারা তাদের জ্ঞান ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্ষমতা পেতেন। তারপর তারা তাদের সন্ত নিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতেন। যত দিন যেত, কোনো কাজ না করেই রাজা হয়ে যাওয়া এই ছেলেগুলো ধীরে ধীরে অলস ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে যেতেন এবং এই স্বেচ্ছাচারিতার কারণে রাজবংশের পতন ঘটত। তারপর আবারও একজন শক্তিমান ও জ্ঞানী মানুষ সিংহাসন দখল করে নিতেন, নতুন রাজবংশের উদ্ভব হতো এবং একই ধারার পুনরাবৃত্তি হতো। প্রতিবার একজন করে স্বৈরশাসকের পতনের মাধ্যমে নতুন করে একজন নীতিবান শাসকের আবির্ভাব হতো কিন্তু উত্তরাধিকারভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তরের কারণে ভালো নীতিগুলো বেশিদিন টিকতে পারত না। এই চক্র চলতেই থাকত।
সিমা কিয়ান বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘এটি এমন এক চক্র যা শেষ হয়েও শেষ হয় না। যেখানে তার সমাপ্তি সেখান থেকেই নতুন করে চক্রের পুনরাবৃত্তি হয়।’ তার ভাষায়, পারস্পরিক সুসম্পর্ক পর্যবসিত হয় অবিশ্বাসে, ধর্মবিশ্বাস রূপান্তরিত হয় কুসংস্কারে, সংস্কার পরিণত হয় অহংকার ও নিচু মানসিকতায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে সিমা কিয়ান তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রধান ক্রাইব বা লেখকের কাজটি পেয়েছিলেন। তবে বিভিন্ন কারণে সমগ্র পৃথিবীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বিষিয়ে গিয়েছিল। তিনি সম্রাটের পিতাকে নিয়ে উলটাপালটা মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার জন্য শাস্তি হিসেবে ধার্য করা হয় শিরশ্ছেদ অথবা লিঙ্গ কর্তন। স্বভাবতই পৈত্রিক প্রাণ হারানোর চেয়ে ‘লিঙ্গ-হারা লেখক’ হিসেবে নিজের চাকরি টিকিয়ে রাখাই তার কাছে শ্রেয় হয়।
তিনি যে চক্রের কথা বর্ণনা করেছেন তা দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। চৈনিক রাজাদের শাসনের মূলমন্ত্র ছিল প্রজ্ঞা; কিন্তু যখনই একজন রাজা ইয়েলো রিভারের তীরের সেই গ্রামগুলোর শাসনভার পেতেন তখনই তারা ধীরে ধীরে দুর্নীতি, শোষণ ও সশস্ত্র যুদ্ধের নেশায় জড়িয়ে যেতেন।
জিয়া রাজবংশের রাজা জিই-এর আমলে শাসক ও শোষিতের মাঝে বিভাজনটি সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। জিই রাজকোষের সব অর্থ খরচ করে নিজের জন্য বড়ো বড়ো প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। তিনি রক্ষিতা হিসেবে সুন্দরী কিন্তু জনপ্রিয় নয় এরকম একজন মহিলাকে গ্রহণ করেছিলেন। এসব কাজের মাধ্যমে তিনি সভাসদ ও দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিলেন। তিনি এবং তার সঙ্গিনী দুজনেই ছিলেন নির্দয় এবং খারাপ ধরনের মানুষ। তারা সারাদিন মদ খেয়ে হইহুল্লোড় করে সময় কাটাতেন, দেশ শাসনের ব্যাপারে তেমন একটা মনোযোগ দিতেন না। কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলেই তিনি তাদের ধরে এনে জেলে ভরে রাখতেন অথবা তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিতেন। এভাবে তিনি তার প্রজাদের কাছে খুবই অজনপ্রিয় হয়ে যান।
সিমা কিয়ান জিই-এর শাসনামলকে তুলনা করেছেন সামরিক শাসনের সাথে। তার মতে, তিনি নীতিবান শাসক ছিলেন না।
শ্যাং গোত্রের ট্যাং (শুনতে হাস্যকর হলেও নামগুলো এরকমই ছিল) নামের এক ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হাজতে আটকে রেখেছিলেন জিই। তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় ও শক্তিশালী গোত্রপ্রধান। তিনি এলিটোউর পূর্ব প্রান্তের কিছু এলাকার প্রভাবশালী ও স্বাধীন শাসক ছিলেন। তার ক্ষমতা ও প্রভাব দ্রুত বাড়ছিল দেখে তাকে সিংহাসনের প্রতি হুমকি হিসেবে নিয়েছিলেন জিই। তবে কিছুদিন পর হঠাৎ করেই ট্যাংকে ছেড়ে দেন জিই। ধারণা করা হয় যে গভীর রাতে মদের প্রভাবে আবেগী হয়ে তিনি এই কাজটি করেছিলেন।
ছাড়া পেয়েই ট্যাং শুরু করেন তার নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার কাজ। তিনি প্রচুর পরিমাণে কূটনীতির আশ্রয় নেন এবং একজন অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেন। এভাবে তিনি আরও প্রভাব ও শক্তিমত্তা সঞ্চয় করছিলেন। সিমা কিয়ানের ভাষায়, তিনি ‘ন্যায়পরায়ণতার চাষ’ করছিলেন।
অবশেষে ট্যাং দাবি করলেন যে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তার স্বর্গীয় অধিকার রয়েছে। তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন এবং সহজেই জয়লাভ করলেন।
জিই রাজধানী শহর থেকে পালিয়ে গেলেন এবং খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৬৬ সালে ট্যাং প্রথম শ্যাং সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হলেন।
নির্বাসিত অবস্থায় জিই মারা যান। তার শেষ কথাটি ছিল এরকম : ‘সুযোগ থাকতে ট্যাং-কে আমার নিজ হাতে হত্যা করা উচিত ছিল।’
শ্যাংদের জয়লাভের মাধ্যমে নতুন কোনো রাজবংশের আবির্ভাব হয়নি। এটি শুধু ছিল একই অঞ্চলের শাসকদের মাঝে ক্ষমতার হাতবদল। বেশ কয়েক যুগ ধরে শ্যাং পরিবার জিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী এলিটোউর পূর্ব প্রান্তে শক্তি সঞ্চয় করছিল। লংশ্যান, জিয়া ও শ্যাং—এই তিনটি পরিবার একে অপরের জায়গার দখল নিয়ে বছরের পর বছর সংগ্রাম করে গিয়েছে। জিয়া রাজত্বের মূল সংগ্রামগুলো অভ্যন্তরীণ ছিল; বহিঃশত্রুর আক্রমণ তাদেরকে মোকাবিলা করতে হয়নি বললেই চলে।
রাজধানীর পতনের হাত ধরে পূর্ববর্ণিত চক্রটি আবারও চালু হলো। ট্যাং-এর শাসনামলটি ন্যায়পরায়ণতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ট্যাং সকল গোত্রপ্রধানকে আদেশ দিয়েছিলেন মানুষের জন্য ভালো ভালো কাজ করতে এবং এই বলে শাসিয়েছিলেন যে মানুষের ভালো করতে না পারলে তাদেরকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তিনি তার প্রাচীন পূর্বসূরি ইউ-র মতো বন্যা সমস্যাকে ভালো করে সামলেছিলেন। সিমা কিয়ান বর্ণনা করেছেন, তিনি চারটি ঝামেলাপ্রদ পানির উৎসকে বশ মানিয়েছিলেন, নতুন ফসলি জমি খুঁজে বের করেছিলেন এবং নতুন নতুন গ্রাম নির্মাণ করেছিলেন।
শ্যাং রাজবংশের ন্যায়পরায়ণতা আর কঠোর পরিশ্রমের হাত ধরে চীন এগিয়ে যেতে লাগল।