অধিকার করে অধিকারী হতে হয়
যে লেখায় মজা আছে, যে লেখা পড়ে পাঠক হেসে ওঠেন, রঙ্গ, ব্যাঙ্গ, বিদ্রূপ ও শ্লেষের খোঁচায় জ্বলে ওঠেন, সেই ধরনের লেখা অন্যের অনুকরণে লেখা যায় না। এই ধরনের লেখা সম্পূর্ণ প্রজাত। এই জাতীয় লেখার জন্মস্থান শরীরের শীর্ষভাগ। এই লেখা বুকের কাছ থেকে আসে না। সবটাই মাথার ব্যাপার। দুটো চোখ আর মাথা। দেখার একটা মস্ত বড় ভূমিকা আছে। দুচোখ মেলে দেখতে হবে। দেখতে হবে চরিত্র। এই দেখাটা হবে মনস্তাত্বিকের দৃষ্টিতে। দেখার পেছনে যে অ-দেখাটা আছে, সেইটাকে টেনে বের করতে হবে। সেইখানেই আছে যাকে দেখছি, তার চরিত্র। স্বামীজি একবার একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, মানুষ হল সমস্ত পশুর সমাহার। কেউ পাখির মতো ফুরফুরে। এডাল, ওডাল, সেডাল উড়ে বেড়ানোই স্বভাব। কেউ শৃগালের মতো ধূর্ত। কাহুয়া বলে আসবে, হিস্যা বুঝে নিয়ে চম্পট দেবে। যা নয়, যা হয় না তাই বুঝিয়ে যাবে। কেউ হল ফেউয়ের মতো। বড় মানুষের পেছন পেছন ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার করে ঘোরে। কিছুই না, যদি কিছু পাওয়া যায়। অনেকে আবার বড় মানুষের সঙ্গে গা-ঘষাঘষি করতে ভালোবাসে। বেজি যেমন ধুলোয় ওলটপালট খায়। একটু ছোঁয়া পেলেই জীবনধন্য। পাঁচজনকে বলা যায়, তাতে নিজের গৌরব বাড়ে। আসলে এরা খুব দু:খী। ধারকরা আলোয় আলোকিত হতে চায়। নিজে একটা কিছু হতে চেয়েছিল, এলেমে কুলোয়নি। সেই শূন্যতাটা ভেতরে রয়েছে। সকালে বাজারে গিয়ে আলুওয়ালাকে বলছে, চোখ দুটো জ্বালা করছে। জ্বালা করছে কেন? চোখে লঙ্কার হাত দিয়েছেন বুঝি!
আরে না! সে অনেক ব্যাপার। রহস্যের হাইফেন মেরে দাঁড়িয়ে রইল। আলুবিক্রেতার জ্বালার কারণ জানার সামান্যতম ইচ্ছে নেই। ফলে কোনও প্রশ্নও নেই। হাইফেন তো হাইফেন। আলু পটলের দুনিয়া অনেক বড়। কয়েক হাজার আলু গড়াগড়ি যাচ্ছে। বাটখারা সাজিয়ে, দাঁড়িপাল্লা খাটিয়ে যে বসে আছে তার জ্বালাযন্ত্রণা অন্য। হরিপালের আলু। মাঠ থেকে কোল্ড স্টোর। সেখান থেকে আলুপোস্তা। ভদ্রলোক যদি বলতেন, সুগার হয়েছে, তাহলে একটু চিন্তার ছিল। আলু খাওয়া বন্ধ হল।
ভদ্রলোক তখন জের টানলেন, আর বলো কেন, আমার হয়েছে মহা জ্বালা, কাল তো সারারাত ঘুম নেই। থানার ও.সি. এসে হাজির। বললেন, মশাই! আড্ডা মারতে এলুম। আপনার সঙ্গে বসলে অনেক জ্ঞান বাড়ে। এ-তল্লাটে আপনার মতো নলেজ কজনের আছে। লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া! হবে না কেন! খাই না খাই, মাসে পাঁচ-সাতশো টাকার বই আমি কিনবই। মুখ্য থেকে মরব না কি! টিভি ফিভি দেখি না আমি। আমার হল বই। বুঝলে, যেখানে যাব সেখানেই আমি জমিয়ে দেব। লোকে আমাকে ছাড়তে চায় না। কী জ্বালায় যে পড়েছি।
কিছু মানুষ আছেন, সব ব্যাপারেই প্রতিবাদ করবেন। বিনা প্রতিবাদে, বিনা তর্কে কোন কিছু মানতে চাইবেন না। যদি বলা হয়, জিনিসপত্রের দাম কী বেড়েছে! সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, কী এমন বেড়েছে। সেই অনুপাতে মাইনেও তো বেড়েছে। যখন মাইনে ছিল তিরিশ টাকা তখন এক আনায় একটা বড় শাঁখ-সন্দেশ পাওয়া যেত। এখন তুমি মাইনে পাচ্চ তিন হাজার আর সন্দেশটা পেতে চাইছ সেই এক আনায়। আনুপাতিক হারটা দ্যাখো। ক্যালকুলেট দি রেশিও। দুম করে বললেই তো হল না, দাম বেড়েছে। সব বেড়েছে। বাপ-ছেলে হাত ধরে বেড়াতে বেড়িয়েছে—আয় আর ব্যয় তর্কাতর্কি ধস্তাধস্তি ঠুকে কংগ্রেস সি.পি.এম., বি. জে. পি, ক্লিন্টন, ইয়েলতসিন। তৃতীয় শ্রোতা বললেন, ভাই! কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে— সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা-আলু-পটল-বেগুন, মেয়েরা মেয়েই আছে, ছেলেরা ছেলেই। এই শেষ কথাটাই কাল হল। কে বলেছে, মেয়েরা মেয়েই আছে, আপনি মশাই, মেয়েও দ্যাখেননি, ছেলেও দ্যাখেননি। মাইকেল জ্যাকসান দেখেছেন? ও তো ইংলিশ মিডিয়াম। আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি—আমার বিদ্যে মাইকেল মধুসূদন। মেঘনাদবধ। তাহলে আর কথা বলবেন না। কিপ সাইলেন্ট। বোনলেস চিকেনের মতো, সেকসলেস মহিলা। রবীন্দ্রনাথের প্রথম লাইন, ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ’—তাহলে কী! সংজ্ঞাটা কী! নারীর সংজ্ঞা—তাহলে কী হবে! তিনটে শব্দ। তো, তাই, ভাই। নারী নয়, তো তাই, ভাই। একজন বলছেন আর একজন শুনছেন—’সেই রাত এগারোটার সময় মেসোমশাই এলেন যাদবপুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে।’
—তো।
—সেই আবার রান্না চাপানো হল।
—তো।
—খাওয়া তো হল। কোথায় শোবেন। একস্ট্রা মশারি তো নেই।
—তো।
—মা চৌকির চারপাশে বড় বড় চাদর, মেঝে পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে, তলায় বিছানা করে দিয়ে, বললে, ঢুকে পড়ো।
—তো।
এই ‘ তো’ একটা লক্ষণ। দ্বিতীয় হল ‘তাই’।
—আমরা তো পুজোর সময় গোয়া যাচ্ছি। জানিস না! মিঠুদাও তো যাচ্ছে।
—তাই-ই! এই বলার সময় চোখ বড় বড় হবে। দাঁত দেখা যাবে। —গোয়া থেকে মাদ্রাজ। —তাই-ই! —সোমা তো ওই ছেলেটাকে বিয়ে করছে না। দীপককে বিয়ে করবে। —তাই-ই। গৌরীর ছেলেটা তো আত্মহত্যা করেছে। —তাই-ই। এই তাই-তাই নারীর লক্ষণ।
মার্ক টোয়েনের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতাই ছিল তাঁর হিউমারের মূল উপাদান। মেয়েদের সম্পর্কে তাঁর দেখা যেমন মজার, তেমনি উপভোগ্য। দি অ্যাডভেঞ্চারস অফ হাকলবেরি ‘ফিন’ -এক জায়গায় আছে, হাক ফিন আর টম সয়ার, দুই কিশোর অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। একটা ডিঙিতে চেপে মিসিসিপি নদীতে ভেসে পড়েছে। এক শহরে ডিঙি বেঁধে মেয়ে সেজে হাক ফিন এক প্রৌঢ়ার বাড়িতে ঢুকেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বৃদ্ধার কছে ধরা পড়ে গেছে। বৃদ্ধা তাকে বোঝাচ্ছেন, মেয়েরা কী করে আর ছেলেরা কী করে। বৃদ্ধা বলছেন, একটু আগে তুমি ছুঁচে সুতো পরাবার চেষ্টা করছিলে। ছেলেরা কী করে! সুতোটা ধরে ছুঁচটাকে এগিয়ে আনে। মেয়েরা ঠিক এর উলটোটা করবে। তারা ছুঁচের ফুটোর দিকে সুতোটা এগিয়ে নিয়ে যাবে। তা তুমি আমার ছুঁচে সুতো পরাচ্ছিলে। দেখেই বুঝে গেলুম, মেয়ে সাজালেও এ ছেলে। তখন আমি কায়দা করে একটা পরীক্ষা নিলুম। বললুম, এই ভারী সিসের টুকরোটা ছুঁড়ে ইঁদুর মারো। মেয়ে হলে কি করতে, আঙুলে ভর রেখে শরীরটাকে তুলে কাঁদের কাছ থেকে হাত ঘুরিয়ে বিকট ভঙ্গিতে ছুঁড়তে আর যাকে মারতে চাইছ তার থেকে ছ-সাত ফুট দূরে গিয়ে পড়ত। ছেলেরা কী করবে! সহজ ভঙ্গিতে হাতটাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে দেবে, যেমন তুমি করলে। ইঁদুরটা আর একটু হলেই মরত। প্রায় ঠিক জায়গাতেই ফেলেছিলে তুমি। মেয়েদের দিকে কোনও কিছু ছুঁড়ে দিলে, সে যদি বসে থাকে তাহলে কীভাবে ধরবে জানো! জিনিসটা লোফার সময় হাঁটু দুটো ফাঁক হয়ে যাবে। ছেলে হলে হাঁটু দুটো জোড়া হয়ে যাবে। পোশাক পালটালেও রমণীর রমণীয়ত্ব অবিনাশী। হাসির লেখা, মজার লেখা লিখতে হলে, এই অবজার্ভেশনের খুব প্রয়োজন। যাঁরা লিখে গেছেন, যাঁরা লিখছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই মাথার ছাঁদ আলাদা আলাদা। বিষয় এক হলেও প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন। ত্রৈলোক্যনাথের সঙ্গে পরশুরামের মিল নেই, কেদার বন্দ্যোপাধ্যায় ভিন্ন গোত্রের। কারো প্রভাব কারো ওপর নেই। শিবরাম সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এঁদের সকলেরই মাথার ছাঁচটা একই রকমের ছিল। মানুষের চালচলন, আচার-আচরণ, স্বভাব নিরীক্ষণ করে, উইট, হিউমার ও স্যাটায়ারে প্রকাশ করা। রাজশেখর ছিলেন বিজ্ঞানের মানুষ, পরিবারে সাইকোলজি ও সাইকোঅ্যানালিসিসের একটা ধারা ছিল, পুরাণাদি পড়েছিলেন, সংস্কৃত জানতেন। ফলে তাঁর লেখায় ভিন্ন ধরনের একটা স্বাদ এসেছিল। বুদ্ধির ছাঁচের ঢালা সরস লেখা। হাসির লেখা শব্দটাই হাস্যকর। আসল কথা হল, প্রকাশ। এই প্রকাশ কখনও আসে মাথা থেকে সেরিব্র্যাল ওয়ার্ক হাউস থেকে, কখনও আসে বুকের কাছে মানুষের আবেগের যে পীঠভূমি আছে, সেইখান থেকে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—ডন জুয়ানের জীবন এক-একজনের হাতে এক-এক রূপ পেয়েছে, যেমন, মলিয়ের ও বানার্ড’শ নাটক লিখেছেন, বায়রন লিখেছেন ব্যঙ্গকাব্য, মোৎসাট তৈরি করেছেন গীতিনাট্য। অভিনব গুপ্ত বলছেন, রস চিত্তবৃত্তিবিশেষ। এই চিত্তবৃতি যার যেমন তার তেমন। রস অ-লৌকিক। আর রসের উপাদান আসে লৌকিক জগৎ থেকে। লৌকিক জগৎ অর্থাৎ জীবনকে পুরোপুরি অনুকরণ করা সম্ভব নয়। অ্যারিস্টটল বলছেন, ইতিহাস ব্যাক্তিবিশেষের অনুকরণ করে, কাব্যের অনুকরণের বিষয় সর্বজনীন সত্য। ‘বাস্তবজীবনে গনেরিল ও রিগ্যানের মতো মেয়ে থাকা সম্ভব কি না, বাস্তবজীবনে কোনও উত্তমর্ণ শাইলকের মতো সুদের পরিবর্তে ঋণীর দেহের অর্বিসের মাংস দাবি করতে পারে কিনা…’ —এই সব তর্ক অর্থহীন। এই বিষয়ে অভিনব গুপ্ত অনেক স্পষ্ট—’রস চিত্তবৃত্তি বিশেষ এবং চিত্তবৃত্তির প্রধান লক্ষণ তাহার প্রবাহধর্মিতা; যাহা স্রোতের মতো বহিয়া চলিয়াছে শিল্পী কেমন করিয়া তাহাকে ধরিয়া রাখিবে?’ রবীন্দ্রনাথে সমস্যার সমাধান—
‘কহিলা বাল্মীকি, ‘তবু নাহি জানি সমগ্র বারতা,
সকল ঘটনা তার—ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।
পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে।’
নারদ কহিলা হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
সত্য ও জীবন, জীবনের যাবতীয় তামাশা ও জীবন-দর্শনই হল উত্তাল সমুদ্র। এইবার যে যেভাবে ঘট ভরে নিতে পারেন। স্যাটায়ারিস্ট, হিউমারিস্ট-এর সম্বল বিমল করের কথায় একেবারে পরিষ্কার—ভালো, ভালো, সিচুয়েসান তৈরি করতে হবে। হর্টিকালচারিস্ট যেমন এক এক গাছের জন্য এক এক রকম পাটি তৈরি করেন। সেই সিচুয়েসানে চরিত্র আসবে। তারপর তাদের কথোপকথন। ইন্টেলিজেন্ট ডায়লগ। সেই পথেই চরিত্র ফুটবে, উইট আর হিউমার ঝরবে। অক্ষর দিয়ে শরীর তৈরি করতে হবে। চ্যাপ্টা শরীর বইয়ের পাতায় নেচে উঠবে না। নাচবে অক্ষর। মনোভূমিতে জাগবে, কথায়, বলায়, চলায়। লেখকের জ্ঞান যত বিস্তৃত হবে, ইন্টেলেকট যত খোলতাই হবে, ততই লেখা হয়ে উঠবে চকমকি—ত্রৈলোক্যনাথ, কেদারনাথ, পরশুরাম, সৈয়দ মুজতবা আলি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, টোয়েন, শেখভ, জেরোম কে জেরোম, ডিকেনস, সার্ভেন্টিস, আরও অনেকে। এঁদের দেখা সেই একই জীবন প্রকাশ ভিন্ন। প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনস সম্পর্কে যা বলা হয়, সেইটাই হল হাসির লেখার চরিত্রগুণ—[A master of risque wit and humor, sublime lyric poetry and brilliant comic invention.] এই গুণাবলী অনুকরণ করা যায় না, অধিকার করে অধিকারী হতে হয়।