অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়
মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায়।
এই ‘দেশ’ পত্রিকাতেই আমার এক সতীর্থ কিছুদিন পূর্বে ‘ফরেন ডিগ্রি’-ধারীর দম্ভের প্রতি ক্ষণতরে ঈষৎ ভ্রুকুটিকুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মর্মঘাতী আপন মূল বক্তব্যে চলে যান। হয়তো সে স্থলে এ বিষয় নিয়ে সবিস্তর আলোচনা করার অবকাশ ছিল না, অর্থাৎ তিনি শেখ চিল্লির মতো মূল বক্তব্যের লাভ এবং ঈষৎ অবান্তর বক্তব্যের ফাউ দুটোই হারাতে চাননি।
ওহ! গল্পটি বোধ হয় আপনি জানেন না, কারণ শেখ শ্রীযুক্ত চিল্লি জাতে খোট্টা এবং বাংলা দেশে কখনও পদার্পণ করেননি। যদ্যপি শ্ৰীযুক্তা সীতা এবং শান্তা এবং খুব সম্ভব তাদের অগ্রজও মিয়া শেখ চিল্লির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন উপকথার মারফতে– স্বর্গত রামানন্দের পরিবার যে খোট্টাই দেশে বাল্যকাল কাটিয়েছেন সে কথা আগে জানা না থাকলেও তার শতবার্ষিকী উপলক্ষে লিখিত প্রবন্ধাদি পড়ে বহু বাঙালিই জেনে গিয়েছে। কিন্তু এ স্থলে আমার যে গল্পটি স্মরণে এল সেটি বোধ হয় তারা ইতোপূর্বে সবিস্তর বয়ান করে আমাকে পরবর্তী যুগের ‘চোর’ প্রতিপন্ন করার সুব্যবস্থা করে যাননি– এই ভরসাতেই সেটি উল্লেখ করছি। করে গেলেও ঝুটমুট ‘ঝেপবার ভয় নেই কারণ গল্পটি ক্লাসিক পর্যায়ের, অর্থাৎ এর বিষয়বস্তু সর্বসাধারণের কার্যকলাপে নিত্য নিত্য সপ্রকাশ হয় বলে এটি নিত্যদিনের ব্যবহার্য গল্প।
মা সরস্বতীর বর পাওয়ার পূর্বে কালিদাস যে আক্কেল-বুদ্ধি ধারণ করতেন, হিন্দি-উর্দু ভাষীদের শেখ চিল্লিও সেই রকম আস্ত একটি ‘পন্টক’ (‘কণ্টক’ থেকে ‘কাঁটা’, সেই সূত্রানুযায়ী ‘পন্টক’ থেকে কী উৎপন্ন হয় সে তত্ত্ব সুচতুর পাঠককে বুঝিয়ে বলতে হবে না; আসলে এই গূঢ় তত্ত্বটি আবিষ্কার করার ফলেই শ্রীযুক্ত সুনীতি চট্টো অস্মদ্দেশীয় শব্দতাত্ত্বিকদের পঙক্তিতে আপন তখৎ-ই-তাউসে গ্যাঁট হয়ে বসবার হকক কব্জা করেন।)
সেই শেখ চিল্লিকে তাঁর মা হাতে একটি বোতল আর পয়সা দিয়ে বাজার থেকে তেল কিনে আনবার আদেশ দিলেন এবং পুত্রের পেটে কী পরিমাণ এলেম গজগজ করছে সেটা জানতেন বলে পইপই করে স্মরণ করিয়ে দিলেন, আসল তেলটা পাওয়ার পর সে যেন ফাউ আনতে না ভোলে। শেখ চিল্লি একগাল হেসে বললেন, ‘তা-ও কখনও হয়!’
আমি জানি, আজকের দিনের পাঠক কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না যে, কোনও জিনিসের দাম বাজারে কস্মিনকালে কখনও কমে। কিন্তু কমতেই হবে, এই হালের সুকুমার রায়ের যুগেও ‘বাড়তি’ ‘কমতি’ ছিল– এমনকি বয়সের বেলাও। আমি যে যুগের বয়ান দিচ্ছি সেটা তারও বহু পূর্বেকার। তাই মিয়া চিল্লির আম্মাজানের অজানতেই বাজারে তেলের দর হঠাৎ কমে গিয়েছিল! হয়তো কোনও ‘রাধা’কে নাচাবার জন্য নবাব সাহেবের ‘ন মণ তেলে’র প্রয়োজন হওয়াতে তিনিও শায়েস্তা খানের মতো তেলের দর সস্তায় বেঁধে দিয়ে বাজার শায়েস্তা করেছিলেন। সেটা এ যুগের ‘সন্দেশ’ শায়েস্তা করতে গিয়ে স্বহস্তে স্বপৃষ্ঠে ভূতের কিল খাওয়া নয়।
তা সে যা-ই হোক, তেল সস্তা হয়ে যাওয়ার দরুন মূল তেলেই বোতল কানায় কানায় ভরে গেল। শেখ চিল্লির ঘটে বুদ্ধি কম ছিল সত্য কিন্তু তার স্মৃতিশক্তিটি আমাদের ‘দাদখানি তেল, মসুরির বেল’-এর মতো ছিল না। তিনি দোকানিকে বললেন, ‘ফাউ?’
দোকানি বললে, ‘কী আপদ, বোতলে জায়গা কোথায়?’
শেখ বললেন, ‘বট্যে! চালাকি পেয়েছ? এই তো জায়গা।’ বলে তিনি বোতলটি উপুড় করে বোতলের তলার গর্তটি দেখিয়ে দিলেন। মেরি মাগডেলেন যে খ্রিস্টের পদদ্বয় তৈলাক্ত করেছিলেন সেটাকেও হার মানালেন শেখ– অবশ্য স্বহস্তে। দোকানি মুচকি হেসে সেই গর্তটি এক কাচ্চা তেল নিয়ে ভরে দিয়ে শেখের ফাউয়ের খাইও ভরে দিল।
বোতলটি অত সন্তর্পণে ‘স্টাটুস কুয়ো’ বজায় রেখে ধরে ধরে শেখ বাড়ি পৌঁছে মাকে বললেন, ‘এই নাও আম্মা, তোমার ফাউ।’ তার পর বোতলটি উল্টে খাড়া করে ধরে বললেন, ‘আর ভেতরে তোমার আসল।’
আম্মা-জানের পদদ্বয় অবশ্য খ্রিস্টের তুলনায় অল্পই অভিষিক্ত হল।
***
দেশ থেকে যে বোতলটি নিয়ে এ-দেশের ছাত্র বিদেশে বিদ্যার তেল–না ভুল বললুম, ডিগ্রির তেল কিনতে যায়, সেটি নিয়ে সে কোনও শেখ চিল্লির মতো কী বেসাতি করে সে তত্ত্বটি অনেকেরই জানা নেই। না জানারই কথা, কারণ ইংরেজ আমলের পূর্বে এ-দেশে কখনও এই ‘ফরেন’ ভূতের উপদ্রব হয়নি। মুসলমান আমলে কী হয়েছিল সেটা পরের কথা। তার পূর্বে কোনও ভারত-সন্তান ফরেন ডিগ্রির জন্য কামচাটকা থেকে কাসাব্লাঙ্কা কোথাও গিয়েছে বলে শুনিনি। তবে জাতক পড়লে পাই, ওই যুগে তক্ষশিলা ছিল বৌদ্ধজ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এবং বারাণসী ছিল সনাতন ধর্ম-জ্ঞানবিজ্ঞান-চর্চার জন্য সর্বপ্রসিদ্ধ তীর্থ। তাই জাতকের একাধিক গল্পে পাই, বৌদ্ধ কিংবা বৌদ্ধভাবাপন্না বারাণসী গৃহী পুত্রকে তক্ষশিলায় বিদ্যার্জনের জন্য পাঠাতেন। তদ্রূপ কাশী সর্বকালেই সনাতন ধর্ম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি থাকা সত্ত্বেও হয়তো বিক্রমাদিত্যের যুগে সারা-ভারতের কোনও কোনও অঞ্চল থেকে কিছু ছাত্র উজ্জয়িনীতে বিদ্যাভ্যাস করতে গিয়েছে।
মুসলমান আমলে রাজকার্য তথা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ফার্সিতে হত। (বৌদ্ধধর্ম লোপ পাওয়ার ফলে বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লোপ পায়; কিন্তু কাশী ও পরবর্তী যুগে বৃন্দাবনে হিন্দুশাস্ত্র চর্চার ব্যাপক ব্যবস্থা ছিল এবং এখনও আছে।) কিন্তু ফার্সি যদিও পারস্যের ভাষা, তবু এ দেশের কোনও ফার্সি শিক্ষার্থী তেহরান বা মেশেদ শহরে ফার্সি শিখতে যেত না। ধর্ম-চর্চার জন্য ছাত্রেরা পড়ত আরবি, কিন্তু তারাও মক্কা, মদিনা বা কাইরোতে গিয়ে ফরেন ডিগ্রি নিয়ে আসত না। অবশ্য কোনও কোনও ছাত্র এ দেশে পাঠ সমাপন করে মক্কায় গিয়ে হজ করার সময় কাবার চতুর্দিকে যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া হয়, সেগুলো শুনে নিত। অধীনের মাতামহ তাই করেছিলেন।
বিদেশে না যাওয়ার কারণ এ-দেশেই আরবি-ফার্সির মাধ্যমে উত্তম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা ছিল। এবং পাঠান-মোগল যুগেও কাবুল, কান্দাহার বা মজার-ই-শরীফে কোনও বড় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি উঠেছিল দেওবন্দ, রামপুর, সুরট অঞ্চলের রাঁদেরে, হায়দ্রাবাদে, ঢাকায়, সিলেটে। বস্তুত কাবুল অঞ্চলের মেধাবী ছাত্র মাত্রই আমানুল্লার আমল পর্যন্ত দিল্লি অঞ্চলেই পড়াশুনো করতে আসত। আমি কাবুলে যাই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। তখন যে কয়টি আরবি-ফার্সিজ্ঞ পণ্ডিতের সঙ্গে সেখানে আমার আলাপ-পরিচয় হয় তারা সকলেই উর্দুও জানতেন, কারণ সকলেই বিদ্যাভ্যাস করেছিলেন ভারতে। ঠিক সে রকম বৌদ্ধ যুগে চীনা তথা অন্যান্য বৌদ্ধধর্মাবলম্বী শ্ৰমণরা এদেশে শিক্ষালাভের জন্য আসতেন, এখনও অল্পবিস্তর আসেন।
এমনকি, যে কাইরোর আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় এক হাজার পনের বছর ধরে ধীরে ধীরে মুসলিম শাস্ত্রচর্চার সর্বশ্রেষ্ঠ সর্ববৃহৎ সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী কেন্দ্ররূপে স্বীকৃত হয়েছে, সেখানেও ভারত থেকে কখনও খুব বেশি ছাত্র যায়নি। আমি যখন (১৯৩৪-৩৫) কাইরোতে ছিলুম তখন পাক (বর্তমান)-ভারত উভয় মিলিয়েও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনারও বেশি ছাত্র ছিল না। পক্ষান্তরে, সেখানে আরবি দর্শনের যে পাঠ্যপুস্তক সম্মানিত ছিল, সেটি জনৈক ভারতীয় মৌলানা দ্বারা লিখিত।
এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে উল্লেখ করি, সাত শ বছর আরবি-ফার্সির কঠিন একনিষ্ঠ সাধনা করে ভারতীয় মৌলবিরা জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সত্য, কিন্তু আরবি দূরে থাক, ফার্সি সাহিত্যেও কোনও কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। তার একমাত্র কারণ মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় সাহিত্যের কুবৃমিনার গড়া অসম্ভব। তাই যখন দেখি, মাত্র এক শ বছর ইংরেজি চর্চার পর এদেশে কেউ কেউ সে সাহিত্যে টিপি তৈরি করে ভাবছেন সেটি মিনার তখন বড়ই বিস্ময় বোধ হয়। তারা কি সত্যই ভাবেন, সেই সাত শ বছরের তাবৎ গুণীজ্ঞানীরা এবং তারা রাজার্থানুকূল্য পেয়েছিলেন চেরাপুঞ্জির বর্ষণের চেয়েও বেশি এদের তুলনায় অতিশয় কুকুট মস্তিষ্কধারী ছিলেন? তখন যখন দেখি র্যাঁবোর বদলে হ্র্যাঁবো–তা হলে ‘rare’ অর্থাৎ ‘বিরল’ হবে ‘হ্রাহ’, France হবে ফৃহাঁস এবং সেখানে ‘r’ অক্ষরের সঙ্গে উ-কার যুক্ত, যেমন ‘প্রুস্ত’, সেখানে গতি কী? কারণ ‘প’র নিচে হ’ তারও নিচে উ-কার দিয়ে তৈরি কোনও হাঁসজারুই’ (হাঁস+সজারু+রুই) জাতীয় অক্ষর তো বাংলা ছাপাখানায় নেই- তখন শুধু সবিনয় সকাতর সভয়ে প্রশ্ন শুধোতে ইচ্ছা করে, ‘আপনারা তরুণরা, যে নানাবিধ ভাষা শিখেছেন সেটা বড়ই আনন্দের কথা, কিন্তু একবার একটু ভেবে নিলেই তো হয় যে মাইকেল, জ্যোতি ঠাকুর, বীরবল, ধ্বনিবিদ সুনীতি চট্টো, শহীদুল্লা এঁরা কেউই এই বিদকুটে ফরাসি ‘র’ ধ্বনি যে আলাদা সেটা লক্ষ করলেন না, এটা কী প্রকারে সম্ভবে?’ এবং শেষ নিবেদন জানি আপনারা পেত্যয় যাবেন না, ফরাসি জর্মন এমনকি ইংরেজি ও বাংলা ‘র’-এর মতো নয় সেটা সত্য, কিন্তু তাদের ‘r’-এর সঙ্গে যে আমাদের ‘র’ মিলছে না সেটা আমরা ‘র’-এর উচ্চারণ করার সময় মুখগহ্বরের অন্য জায়গা থেকে করি বলে নয়–তাদের আপত্তি আমরা ‘r’ উচ্চারণের সময়ে সেটিকে ‘ট্রিল’ করি বলে, অর্থাৎ আমরা যখন বলি ‘পারি’ (প্যারিস) তখন ফরাসি শুনতে পায় যেন আমরা ‘r’-টা তিনবার উচ্চারণ করে বসে আছি। বিচক্ষণ ফরাসি শুরু তদ্দণ্ডেই বলেন, ‘কিন্তু মসিয়ো, Paris শব্দে মাত্র একটি “r “, আপনি তিনটে “r” উচ্চারণ করলেন যে?’ আমি আরও জানি– আপনারা আরও পেত্যয় যাবেন না। যদি বলি, ফরাসি-জর্মন উভয় অভিনেতাই [এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে ধ্বনিবিদ পণ্ডিতের চেয়ে এরাই সর্বসাধারণের কাছে অধিকতর সম্মান লাভ করেন–ইংলন্ডেও বার্নার্ড শ-কে যে বিবিসি উচ্চারণ-বোর্ডে সসম্মানে নিমন্ত্রণ করা হত তার কারণ তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি নয়, নাট্যে উচ্চারণ বাবদে তার ওয়াকিবহালত্ব]। চেষ্টা করেন বাঙালির ‘র’-র মতো আপন ‘r’ উচ্চারণ করতে!!! –কিন্তু ট্রিল না করে। অর্থাৎ জৰ্মনে যাকে বলে হ্যাল(১)– উজ্জ্বল, ফরাসিতে যাকে বলে ক্ল্যার– ক্লিয়ার, পরিষ্কার, স্বচ্ছ ‘r’ উচ্চারণ করাটাকে আদর্শ ‘r ‘ উচ্চারণ মনে করেন। তাই মোটামুটি ভাবে বলা যায় ফরাসি বা জর্মন এমন ইংরেজি ‘r’ উচ্চারণ করার সময় যদি জিভটাকে মুখের ভিতর ঝুলিয়ে রেখে অর্থাৎ সেটাকে তালু, মূর্ধা বা দাঁতের পিছনে ছুঁতে না দিয়ে, এবং কাজে কাজেই কোনও প্রকারের ট্রিল বা ফ্ল্যাপ করবার সুযোগ না দিয়ে বাংলা ‘র’ ধ্বনি উচ্চারণ করা হয় তবে ওই তিন ভাষায় ধ্বনিবিদ পণ্ডিতরাই আদর্শ ‘r’ উচ্চারিত হয়েছে বলে মনে করেন। তার পর অবশ্য যদি কেউ সেটাকে খাঁটি প্যারিসিয়ান করতে চান তবে সেটা গলা থেকে আরবি ‘গাইন’ ঘেঁষা করবেন, দক্ষিণ-ফ্রান্সের মতো করতে হলে ফার্সি ‘খে’ ঘেঁষা করবেন এবং জর্মন বলার সময় কলোন-বন্ অঞ্চলের ‘r’ উচ্চারণ করতে হলে সেটাকেও ওই ফার্সি ‘খ’ ঘেঁষা করবেন। কিন্তু সর্বক্ষণ সাবধান থাকতে হবে যে, ট্রিলিং দুষ্কর্মটি যেন করা না হয়। বীরভূম অঞ্চলে যখন ‘রাম’-এর পরিবর্তে আম উচ্চারণ শোনা যায় তখন ওই ট্রিলটি করা হয় না বলে এবং রেডুকৎসিয়ো আড আবসুর্ডুম হয়ে যাওয়ার ফলে ‘r’-এর সর্বনাশ হয়ে ‘অ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। ইংরেজিতেও তাই, কিংবা প্রায় তাই হয় যখন ‘r’ কোনও স্বরবর্ণের পরে আসে। যথা hard’; এস্থলে ‘r’ শুধু আগের a-টিকে দীর্ঘ করে। ‘r’-এর পরিপূর্ণ ব্যঞ্জনধর্ম লোপ পায় কি না সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বলে কোনও কোনও ধ্বনিবি উচ্চারণ দেখাবার সময় তাই ‘r’ হরফটি উল্টো করে দিয়ে লেখেন এবং ছাপাখানায় হরফটি উল্টো করে ছাপা হয়– লাইনো বা টাইপ রাইটারে অবশ্য সেটা সম্ভব নয়। আর ‘r’ বলার সময় যদি বাংলার মতো সেটাকে ট্রিল করতে চান, তবে প্রাণ ভরে করা যায় ইতালির ‘r’ উচ্চারণ করার সময়। ইংরেজিতে যে স্থলে ‘Irregular’ বলার সময় প্রথম যে দুটো ‘r’ একসঙ্গে এল, সে দুটো দু বার উচ্চারণ করতে তো দেয়ই না, একবারই বাংলার হিসেবে প্রাণভরে করতে দেয় কই? সেখানে ইটালিয়ান ‘birra’ (বিয়র) বলার সময় যদি ‘r’টা প্রেমসে ট্রিল না করেন কম-সে কম দু বার– তবে বিয়ারের বদলে সেই যে ফুটোয় ভর্তি একরকম পনির হয়, বেয়ারা তারই ফুটোগুলো শুধু প্লেটে করে হয়তো নিয়ে আসবে! এবং শেষ কথা : ফরাসি-জর্মন ধ্বনিবিদ যে তাঁদের ‘r’ পরিষ্কার ক্ল্যার হ্যাল উজ্জ্বল রাখতে চান, তার অন্যতম কারণ, গ্রিক এবং লাতিনে যে ‘r’ আছে সেটা সংস্কৃত ‘র’-এরই মতো পরিষ্কার উজ্জ্বল এবং জানা-অজানাতে ইয়োরোপীয় পণ্ডিত মাত্রই গ্রিক-লাতিন থেকে খুব দূরে চলে যেতে চান না। (এরই উদাহরণ ‘গুডবাই, মি. চিপস’ ফিল্মে আছে।)।
সত্যলাভের জন্য তৃষ্ণার্ত জন যুগে যুগে বিদেশে গিয়েছে, বিধর্মীর কাছে গিয়েছে। পয়গম্বর বলেছেন, ‘জ্ঞানলাভের জন্য যদি চীন যেতে হয় তবে সেখানে যেয়ো, বলা বাহুল্য, তাঁর আমলে চীন দেশে কোনও মুসলমান ছিলেন না এবং তাই ধরে নিতে পারি বিধর্মী ‘কাফেরে’র কাছ থেকে জ্ঞানসঞ্চয় করতেও তিনি আপত্তিজনক কিছু পাননি।
কিন্তু এই যে ‘ফরেন’ যাওয়ার হিড়িক আরম্ভ হল প্রায় শ’খানেক বছর আগে এবং স্বরাজ পাওয়ার পর কিমাশ্চর্যমতঃপরম এখনও বাড়তির দিকে, তার বেশিরভাগই ছিল “ইস্টাম্বো’ নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে পেটকে এলেমে ভর্তি করার জন্য নয়। পাঠান এবং মোগল রাজারা এ দেশেই বাস করতেন, এইটেই তাঁদের মাতৃভূমি, কাজেই বিদেশের ইস্টাম্বোর প্রতি তাঁদের কোনও অহেতুক মোহ ছিল না– যদিও বিদেশাগত হুনুরি গুণীকে তারা আদর করে দরবারে স্থান দিতেন। কিন্তু ইংরেজ কলকাতায় বসেও চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে থাকত লন্ডনের দিকে, Kedgeree (কেজরীঃ– খিচুড়ি– কৃশর, কৃশরান্ন?) খাওয়ার সময় চিন্তা করত আল্লায় মালুম কিসের!
অতএব সেখানে থেকে যদি কপালে একটি ‘ইস্টাম্বো’ মারিয়ে নিয়ে আসা যায় তবে পেটে আপনার এলেম গজগজ করুক আর নাই করুক, আপনি ‘ফ্রেশ ফ্রম্ ক্রিস্ট্রিয়ান হোম’, আপনিও এখন গোরা রায়। তাই স্বরাজ লাভের পরও।
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়।
দিবাভাগে মন্দ ভাগ্যে তার মার খায়।
১৬।১০।৬৫
———-
১. কথাটা জর্মনে hell, কিন্তু বাংলায় আমি ‘হেল’ না লিখে হাল কেন লিখলুম সে বিষয় নিয়ে সুদূর ভবিষ্যতে আলোচনা করবার আশা রাখি। কারণ জনৈক পত্ৰলেখক ইটিকে আমার ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’ পর্যায়ে ফেলেছেন।