অদ্ভুত প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়

অদ্ভুত প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়

মিঃ এফ. ডবলু. গ্যালওয়ে এক সময়ে বিহারের কোন জিলার পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টের পদে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় তাঁহার এলাকাস্থিত কোন থানার ভারপ্রাপ্ত এক দারোগা একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার পাইয়াছিল। এই দারোগাটি হত্যাকাণ্ডের যে সকল প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছিল, তাহা এরূপ অকাট্য যে, সেই সকল প্রমাণে নির্ভর করিয়া জজ ও জুরীরা আসামীর প্রাণদণ্ডের আদেশ দান করিতেন, এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু মিঃ গ্যালওয়ে স্বয়ং এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার গ্রহণ করিয়া যেভাবে প্রকৃত অপরাধীর অপরাধ প্রতিপন্ন করেন, তাহা গোয়েন্দাগিরিতে তাঁহার অসাধারণ দক্ষতার পরিচয়সূচক। মিঃ গ্যালওয়ে লন্ডনের কোন প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকায় এই হত্যা-রহস্যভেদের যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, পাঠকগণের মনোরঞ্জনের জন্য তাহার অনুবাদ প্রকাশিত হইল। বিবরণে মিঃ গ্যালওয়ে নিজের ও জনগণের নাম পরিবর্তন করিয়াছেন বটে, কিন্তু তিনি লিখিয়াছেন, ঘটনার প্রত্যেক বিবরণ সম্পূর্ণ সত্য, এবং তাঁহার কোন কথা অতিরঞ্জিতও নহে। এই বিবরণে তিনি থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগাকে মহম্মদ আলি এবং তাহার উপরওয়ালা পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে (অর্থাৎ নিজেকে) মিঃ রেনল্ডস্ নামে অভিহিত করিয়াছেন। মিঃ গ্যালওয়ে লিখিয়াছেন, রামপ্রসাদ নামক একটি লোক কোন গ্রামে বাস করিত। লোকটি বৃদ্ধ, এবং তাহার জীবন শান্তিতেই অতিবাহিত হইতেছিল। তাহার জীবনে কোন বৈচিত্র্য ছিল না, এবং তাহার কোন কার্যে কোন দিন গ্রামবাসীদের মনোযোগও আকৃষ্ট হয় নাই; কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সে হঠাৎ নিহত হওয়ায় তাহার হত্যাকাণ্ডে গ্রামে তুমুল আন্দোলন আরম্ভ হইল।

এই সময় গ্রামস্থ থানার কার্যভার যে দারোগার হস্তে ন্যস্ত ছিল, ধরিয়া লউন—তাহার নাম মহম্মদ আলি। সে তরুণ যুবক; কর্তব্যনিষ্ঠ দারোগা বলিয়া তাহার সুনাম থাকিলেও পুলিশের জটিল কার্যে তাহার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। যে সকল কর্মচারী পুলিশ বিভাগের নিম্নতর পদে নিযুক্ত থাকিয়া যোগ্যতাবলে দারোগার পদে উন্নীত হয়, মহম্মদ আলি সেই শ্রেণীর কর্মচারী ছিল না; সে পুলিশ-ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষালাভ করিয়া একেবারেই পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরের পদে নিযুক্ত হইয়াছিল। এ জন্য পুলিশের কার্য-প্রণালী তাহার জানা থাকিলেও কেতাবী-বিদ্যার বাহিরে হাতে-কলমে যে শিক্ষার প্রয়োজন, তাহা সে আয়ত্ত করিতে পারে নাই, এবং মনুষ্যচরিত্র অধ্যয়নের সুযোগও সে লাভ করিতে পারে নাই। এইজন্য তাহার অধীনস্থ কর্মচারীরা অনেক সময় নিজের খেয়ালেই চলিত, এবং তাহাকে যাহা বুঝাইয়া দিত, সে তাহার ত্রুটি ধরিতে পারিত না।

মহম্মদ আলি হাতে-কলমে কাজ করিতে গিয়া দেখিল—অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা বড় কঠিন ব্যাপার, এজন্য পদে পদে তাহার চেষ্টা বিফল হইত; এবং এই ভাবে সে অকৃতকার্য হওয়ায় তাহার এলাকায় অপরাধের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িয়া গেল। ইহাতে সে নিরুৎসাহ হইলেও কিছুদিন পরে তাহার হাতে এরূপ একটি ‘কে’ আসিল, যাহার তদন্ত-কার্যে সে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিবে বলিয়াই আশা করিল, এবং উৎসাহের সহিত তদন্ত-কার্যে প্রবৃত্ত হইল।

একদিন প্রভাতে গ্রাম্য চৌকিদার থানায় আসিয়া দারোগা মহম্মদ আলিকে সংবাদ দিল—রামপ্রসাদ নামক একজন লোকের মৃতদেহ একটি কূপের ভিতর পড়িয়া থাকিতে দেখা গিয়াছে। সেই ব্যক্তি কুপে লাফাইয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করে নাই—ইহার প্রমাণ এই যে, তাহার মৃতদেহে আঘাত-চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। সে কূপের ভিতর কয়েক দিন পড়িয়াছিল; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কূপটি গ্রাম হইতে কিছু দূরে থাকায় গ্রামের লোকজনকে প্রায়ই সেই কূপের জল ব্যবহার করিতে হইত না।

এই সংবাদ পাইয়া মহম্মদ আলি অবিলম্বে তদন্ত আরম্ভ করিল। তাহার পর সন্ধান করিতে করিতে সে যে সূত্র আবিষ্কার করিল, তাহা হইতে তাহার সন্দেহ হইল, সেই গ্রামেরই কোন লোক, বৃদ্ধকে হত্যা করিয়াছিল। পুলিশের কার্যে মহম্মদ আলিরও গুপ্তচর ছিল। সেই গুপ্তচরের নিকট সে জানিতে পারিল—রামপ্রসাদের পরিবারবর্গের সহিত গ্রাম্যস্থ আর একজন লোকের দীর্ঘকাল হইতে প্রবল বিরোধ চলিতেছিল— তাহার নাম ইমামবক্স।

সকল অবস্থা লক্ষ্য করিয়া ইমামবক্স সম্বন্ধে দারোগার সন্দেহ দৃঢ়মূল হইল। একজন গ্রামবাসী স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সংবাদ দিল—প্রায় দুই সপ্তাহ পূর্বে দুইজন অপরিচিত ব্যক্তিকে ইমামবক্সের ঘরে দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। আর একজন গ্রামবাসী দারোগার সঙ্গে দেখা করিয়া বলিল—সে একদিন রাত্রিকালে তাহার শস্যক্ষেত্র হইতে বুনো শুয়োর তাড়াইবার জন্য মাঠে যাইবার সময় দেখিতে পায়—তিনজন লোক ইমামবক্সের বাড়ির কাছে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল; সেই তিনজনের একজন যে স্বয়ং ইমামবক্স—ইহা সে হলপ করিয়া বলিতে পারে।

গ্রাম্য চৌকিদার যে অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ, রাত্রিকালে সে না ঘুমাইয়া সারা রাত্রি গ্রামের ভিতর চৌকি দিয়া বেড়ায়, ইহা প্রতিপন্ন করিবার জন্য সে দারোগাকে জানাইল—সে পাহারায় বাহির হইয়া সেই তিনজন লোককেই দেখিতে পাইয়াছিল; কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে তাহারা মিশিয়া যাওয়ায়, সে দীর্ঘকাল তাহাদের উপর নজর রাখিতে পারে নাই। বিশেষত, তখন পর্যন্ত কাহাকেও সন্দেহ করিবার কারণ না থাকায়, সে তাহাদিগকে চিনিবার চেষ্টা করে নাই; তবে এখন তাহার মনে হইতেছে—তাহাদের একজনকে সে খোঁড়াইতে দেখিয়াছিল; কিন্তু সে কে, তাহা কিরূপে বলিবে? ইমামবক্স খোঁড়া ছিল—ইহা সকলেই জানিত।

চৌকিদারের কথা শুনিয়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করিবার উপায় ছিল না, কিন্তু মহম্মদ আলি বুঝিতে পারিল—চৌকিদারের এই বিবৃতি তাহার সিদ্ধান্তের অনুকূল। এইজন্য সে কর্তবানুরোধে ইমামবক্সের ঘর খানাতল্লাস করিল। অবশেষে সে ইমামবক্সের গোশালায় প্রবেশ করিয়া চালের দিকে চাহিতেই ‘চালের বাতায়’ একখানি লাঠি পাইল। লাঠিখানা রক্ত-মাখা! লাঠিখানি বেশ ভারী, এবং তাহা কাষ্ঠনির্মিত, তাহার মাথা পিত্তলমণ্ডিত।

এই লাঠি পাওয়ায় দারোগার ধারণা হইল—ইমামবক্সই প্রকৃত অপরাধী; কারণ, গ্রামের পাঁচ-ছয়জন লোক সেই লাঠি দেখিয়া সনাক্ত করিল–উহা ইমামবক্সেরই লাঠি বটে। তাহারা সকলেই জানিত, সেই লাঠি ইমামবক্সের ভ্রমণের সঙ্গী। দারোগা এবার ইমামবক্সের অপরাধ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইয়া, তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া সদরে চালান দিল। মহম্মদ আলি শোণিতরঞ্জিত লাঠিখানা কাগজ দ্বারা মুড়িয়া সেইসঙ্গে সদরে পাঠাইয়া তাহার উপরওয়ালাকে অনুরোধ করিল—লাঠিখানাতে যদি অঙ্গুলি-চিহ্ন থাকে, তবে অঙ্গুলি-চিহ্নের বিশেষজ্ঞ যেন তাহা পরীক্ষা করেন; এবং তাহাতে যে রক্ত লাগিয়াছিল, তাহা যেন রাসায়নিক পরীক্ষাগারের রসায়নবিৎ দ্বারা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। —এই সকল কাজ শেষ করিয়া মহম্মদ আলি ঘটনার পরিণতির জন্য প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। তাহার তদন্তকার্য যে সম্পূর্ণ নিখুঁত হইয়াছিল, এবং ইমামবক্সের নিষ্কৃতিলাভের কোনও উপায় ছিল না, এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ হইল।

যথাসময়ে রামপ্রসাদের শব-ব্যবচ্ছেদের রিপোর্ট মহম্মদ আলির হস্তগত হইল। সেই রিপোর্ট পাঠে সে জানিত পারিল—কোন ভারী ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। লাঠিতে যে অঙ্গুলি চিহ্ন আবিষ্কৃত হইল, তাহা ইমামবক্সেরই অঙ্গুলি-চিহ্ন! সুতরাং ইমামবক্স যে-জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে, তাহা হইতে তাহার মুক্তিলাভের কোন সম্ভাবনা রহিল না। গ্রামের জনসাধারণ দারোগার সহিত একমত হইয়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিল—দায়রার বিচারে কি ফল হইবে বিচারের পূর্বেই তাহা বুঝিতে পারা গিয়াছে। ইমামবক্সের ফাঁসি হইবে—এ বিষয়ে কাহারও সন্দেহ রহিল না।

এত বড় একটা খুনের ‘কিনারা’ করিয়া ফেলিয়াছে ভাবিয়া সাব-ইন্সপেক্টর মহম্মদ আলির আনন্দের সীমা রহিল না; এই ভাবে আর দুই-একটা হত্যাকাণ্ডের অপরাধীকে ধরিয়া দিতে পারিলে তাহার প্রমোশন অপরিহার্য, এ বিষয়েও তাহার সন্দেহ রহিল না। আর কয়েক বৎসর এইরূপ কৃতিত্ব দেখাইতে পারিলে সে বহু ‘সিনিয়র দারোগাকে অতিক্রম করিয়া ইন্সপেক্টর, এবং ইন্সপেক্টর হইতে পুলিশের ডেপুটী সুপারিন্টেন্ডেন্ট হইবে।

সে মনের সুখে আকাশে কেল্লা নির্মাণ করিতে লাগিল। সে ইংরেজী ভাষা ভাল জানিত না; কিন্তু এত বড় একটা তদন্ত ব্যাপারে সে পুলিশের কর্তৃপক্ষকে তাহার ইংরেজী বিদ্যার দক্ষতায় চমৎকৃত করিবার জন্য তাহার মাতৃ-ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষায় কেস-ডায়েরী লিখিয়া সদর-অফিসে পাঠাইয়া দিল।

জিলা পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ রেনল্ডস্ তাঁহার সদর অফিসে ইমামবক্সের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ সম্বন্ধে গভীর চিন্তায় রত ছিলেন। তাহার বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছিল, সেই সকল প্রমাণ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে করিতে তাঁহার মুখ গম্ভীর ও ভ্রূ কুঞ্চিত হইল। তিনি সাব-ইন্সপেক্টর মহম্মদ আলি-প্রেরিত রিপোর্ট পুনর্বার পাঠ করিয়া, তাঁহার তামাকের পাইপটা মুখ হইতে টেবলের উপর নামাইয়া রাখিলেন এবং সাব-ইন্সপেক্টরকে লক্ষ্য করিয়া ‘মুর্খ’ বলিয়া হুঙ্কার দিলেন।

পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ রেনল্ডস্ যে বৃহৎ জিলার শান্তিরক্ষার ভার পাইয়াছিলেন, সেই জিলায় খুন-জখম নিত্যই লাগিয়া থাকিত। অপরাধী সন্দেহে যাহাদিগকে গ্রেপ্তার করা হইত, তিনি তাহাদিগকে বিচারার্থ চালান দিয়াই কর্তব্য শেষ করিতেন। আলোচ্য হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্বন্ধে তিনি যে সকল কাগজপত্র পাইয়াছিলেন, তাহা পাঠ করিয়া তাঁহার কেরানীকে ফেরত দিলেন বটে, কিন্তু তৎসম্বন্ধে কি আদেশ দিবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। ইমামবক্সের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছিল—তাহা তাহার কিরূপ প্রতিকূল, ইহা তাঁহার বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। কিন্তু কিছুকাল চিন্তা করিয়া তাঁহার ধারণা হইল—এই সকল অকাট্য প্রমাণের অন্তরালে যে গভীর রহস্য সংগুপ্ত আছে—দারোগা মহম্মদ আলি তাঁহার মর্ম বুঝিতে পারে নাই; সংগৃহীত প্রমাণগুলির উপর নির্ভর করিয়া সে ইমামবক্সকেই বৃদ্ধ রামপ্রসাদের হত্যাকারী বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছে।

এই চিন্তার পর মিঃ রেনল্ডস্‌ সমগ্র ফাইলটি পুনঃগ্ৰহণ করিয়া তাহার আদ্যোপান্ত অত্যন্ত সতর্ক ভাবে আর একবার পাঠ করিলেন, এবং আসামীর বিরুদ্ধে আরোপিত প্রমাণগুলি কি ভাবে সংগ্রহীত হইয়াছিল, তাহা মনে মনে আলোচনা করিলেন। তাঁহার ধারণা হইল—সাব-ইন্সপেক্টর এই সকল প্রমাণে নির্ভর করিয়া প্রতারিত হইয়াছে; প্রকৃত রহস্যভেদ করিয়া সত্য নির্ণয় করা তাহার অসাধ্য হইয়াছিল।

মিঃ রেনল্ডস্‌ সাব-ইন্সপেক্টরের রিপোর্ট পুনর্বার পাঠ করিয়া তাঁহার কেরানীকে উত্তেজিত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, ‘সাব-ইন্সপেক্টরকে লিখিয়া দাও—তাহার প্রেরিত রিপোর্টে তাহার নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। সে ইংরেজীতে বিদ্যা না ফুলাইয়া ভবিষ্যতে তাহার রিপোর্ট যেন উর্দুতেই লিখিয়া পাঠায়। এই মামলা এক সপ্তাহের জন্য মুলতুবি রাখিতে আদালতকে অনুরোধ কর। ইতিমধ্যেই আমি অথবা ডেপুটি সুপারিন্টেণ্ডন্ট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া সরেজমিনে তদন্ত করিব, এবং সাক্ষীগুলিকে পরীক্ষা করিব। আমি আজ অপরাহ্নের ক্লাবে যাইবার সময় জেলখানায় যাইব, এবং আসামী ইমামবক্স আত্মসমর্থনের জন্য কি বলিতে চাহে—তাহা শুনিয়া লইব।’

সুপারিন্টেণ্ডন্ট মিঃ রেনল্ডস্‌ নির্দিষ্ট সময়ে জেলখানায় প্রবেশ করিলেন। আসামী ইমামবক্স তখন জেলখানার একটি নিভৃত কক্ষে পা গুটাইয়া বসিয়াছিল। অপরাহ্নের সূর্যালোক একটি বাতায়নের ভিতর দিয়া সেই কক্ষে প্রবেশ করিতেছিল। তাহার বিরুদ্ধে সংগৃহীত প্রমাণসমূহের গুরুত্ব ইমামবক্সের অজ্ঞাত ছিল না; এই জন্যই সে জীবনের আশা ত্যাগ করিয়াছিল; ভাগ্যে যাহা আছে—ঘটিবে ভাবিয়া সে তখন সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট।

এমন সময় পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ রেনল্ডসের আদেশে কারাকক্ষের দ্বার উদ্‌ঘাটিত হইলে, ইমামবক্স উঠিয়া দাঁড়াইয়া দ্বারপ্রান্তে জেলারকে, এবং তাঁহার কিছুদূরে একজন সাহেবকে দণ্ডায়মান দেখিল। সে তাঁহাদের উভয়কে সেলাম করিলে মিঃ রেনল্ডস্ জেলারকে বলিলেন, ‘আমি কে, তাহা উহাকে জানান। আমি উহাকে বাহিরের আঙ্গিনায় লইয়া যাইতে চাই। সেখানে আমি উহার সহিত কোন কোন কথার আলোচনা করিব; অন্য কেহ তাহা শুনিতে না পায়—এইরূপই আমার ইচ্ছা। আমার নিকট কোন দেহরক্ষী থাকিবে না বটে, কিন্তু সেজন্য চিন্তার কোন কারণ নাই; আমার আত্মরক্ষার শক্তি আছে।’

ইমামবক্স পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া কোন কথাই বলিল না; সে আত্মসমর্থনেরও চেষ্টা করিল না। মিঃ রেনল্ডস্‌ বুঝিতে পারিলেন—তাঁহাদের সে আদৌ বিশ্বাস করে না। তাহার মুখে অবজ্ঞার ভাবই পরিস্ফুট হইল। মিঃ রেনল্ডস্ তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া তাহার সহিত সহানুভূতিভরে আলাপ করিতে লাগিলেন। তিনি তাহাকে নির্বাক দেখিয়া বিন্দুমাত্র অসন্তোষ বা অধীরতা প্রকাশ না করিয়া তাহাকে বলিলেন, ‘তুমি কয়েক বৎসর পূর্বে যে সকল দেওয়ানী মামলা করিয়াছিলে, সেই সকল মামলার নথিপত্র আমি পড়িয়া দেখিয়াছি। রামপ্রসাদের পরিবারবর্গকে তুমি দেখিতে পার না— আমার এই অনুমান কি সত্য নহে?’

পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের প্রশ্ন শুনিয়া ইমামবক্স কোন কথাই বলিল না; সে নতমস্তকে নির্বাক ভাবে দুই পায়ের বুড়া আঙ্গুল দিয়া মাটি খুঁড়িতে লাগিল।

মিঃ রেনল্ডস্ তাহাকে নির্বাক দেখিয়া পুনর্বার বলিলেন, ‘তোমাদের শেষ মামলার বিচার ছয় মাস পূর্বে শেষ হইয়াছে; হাকিম তোমার অনুকূলেই রায় দিয়াছিলেন। জলের দখলি-স্বত্ব তোমাতেই বর্তিয়াছিল। রামপ্রসাদ যে তাহার পর তোমার বিরুদ্ধে মামলা চালাইবে, তাহার উপায় ছিল না। এ অবস্থায় এই নিরুপায় পরাজিত শত্রুর সহিত তোমার বিরোধ চালাইবার কি কারণ ছিল?”

ইমামবক্স মাথা নাড়িয়া গম্ভীরভাবে বলিল, ‘না, কোন কারণ ছিল না।’

মিঃ রেনল্ডস্ বলিলেন, ‘দেখ ইমামবক্স, এ পর্যন্ত তুমি যে সকল মামলা চালাইয়াছ, প্রত্যেক মামলাতেই তুমি যথেষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দিয়াছ; বোকামি করিয়া কোন মামলা নষ্ট কর নাই; কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে আরোপিত এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তুমি এরকম নির্বোধের মত কাজ করিলে কেন? এই ব্যাপারে আমি তোমার বিন্দুমাত্র দূরদর্শিতার পরিচয় পাই নাই। লাঠিখানা যেখানে রাখিলে, অতি সহজেই খুঁজিয়া পাওয়া যায়—সেখানে তাহা কিজন্য রাখিয়াছিলে? সেই লাঠি তো তোমারই, না তোমার নয়?’

ইমামবক্স বলিল, ‘সাহেব, লাঠিখানা যে আমার, ইহা আমি অস্বীকার করিতে পারি না। গ্রামের বিস্তর লোক জানে, ও লাঠি আমারই। কিন্তু আমার লাঠি হারাইয়াছিল, এ কথা বলিলে কে তাহা বিশ্বাস করিত?’

মিঃ রেনল্ডস্‌ বিস্মিত ভাবে বলিলেন, ‘তুমি বলিতেছ কি? মামলার ফলাফল যে ঐ লাঠির উপরেই নির্ভর করিতেছে!’

ইমামবক্স বলিল, ‘তা জানি সাহেব! দারোগা যখন আমার লাঠির সন্ধান করে—তখন আমি তাহাকে জানাই—আমার লাঠিখানা হারাইয়া গিয়াছে। একথা শুনিয়া দারোগা হাসিয়া বলিল, তোমার লাঠি হারাইয়াছে বলিতেছ, ইহার প্রমাণ কোথায়? সত্যই তাহার প্রমাণ নাই। পরে বুঝিতে পারি—উহা কেহ চুরি করিয়াছিল। কিন্তু কে আমার কথা বিশ্বাস করিবে? আর একথা বলিয়াই বা ফল কি?’

মিঃ রেনল্ডস্ বলিলেন, ‘না, একথা বলিয়া কোন ফল নাই সত্য; কিন্তু তুমি মুখ তুলিয়া অসঙ্কোচে আমার মুখের দিকে চাহিয়া আবার ওই কথা বলিতে পারিবে? রামপ্রসাদ যে সময় মারা যায়—সে সময় লাঠিখানা তোমার দখলে ছিল না—এ কথা বলিতে তোমার সাহস হইবে কি?’

ইমামবক্স অকুণ্ঠিতভাবে তাঁহার এই আদেশ পালন করিল।

সুপারিন্টেণ্ডেন্ট বলিলেন, ‘উত্তম, এখন তুমি যাইতে পার। আমি নিজেই এই সকল ব্যাপারের তদন্ত করিব!’

অনন্তর ইমামবক্স তাঁহার ইঙ্গিতে প্রহরী কর্তৃক কারাকক্ষে নীত হইল। মিঃ রেনল্ডস্‌ সঙ্কল্প করিলেন—তাহার বিরুদ্ধে যে সকল মিথ্যা প্রমাণ সাজাইয়া রাখা হইয়াছিল—তিনি তাহার অসারতা প্রতিপন্ন করিবেন।

মিঃ রেনল্ডস্‌ পরদিন প্রভাতে অণুবীক্ষণের সাহায্যে (উইথ এ ম্যাগনিফাইং গ্লাস) লাঠিখানার প্রত্যেক অংশ সতর্ক ভাবে পরীক্ষা করিলেন। তাহার পর অঙ্গুলিচিহ্ন-পরীক্ষককে জেরা করিলেন। তিনি লাঠিতে একটি বিশেষ চিহ্ন আবিষ্কারের চেষ্টা করিতেছিলেন। তাঁহার সেই চেষ্টা সফল হওয়ায় তিনি আনন্দিত হইলেন। অঙ্গুলিচিহ্ন-পরীক্ষক তাঁহার উপদেশ শুনিয়া প্রস্থান করিল।

জিলা-পুলিশের সুপারিন্টেন্টে সরেজমিন তদন্তে আসিতেছেন শুনিয়া পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর মহম্মদ আলির আনন্দ ও উৎসাহের সীমা রহিল না। সে হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছিল, তাহা তাহার উপরওয়ালার দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে, তাহার শ্রম সফল হইবে, ইহা সে পূর্বে আশা করিতে পারে নাই। সে তাহার অফিস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া খাতা-পত্র সাজাইয়া রাখিল। পুলিশ সাহেব তদন্তে আসিয়া কোন বিষয়ে কোন ত্রুটি আবিষ্কার করিবেন—তাহার উপায় রহিল না।

দারোগা সাক্ষীগুলিকে ডাকাইয়া তাহাদিগকে শিখাইয়া-পড়াইয়া ঠিক করিয়া রাখিল। কোন্ সাক্ষী কোন্ কথার পর কি বলিবে, তাহা তাহারা মুখস্থ করিয়া রাখিল। কিন্তু এত আয়োজন, পরিশ্রম, — সকলই বিফল হইল। পুলিশ-সুপারিন্টেণ্ডন্ট তখন তদন্তে আসিলেন না। তিনি মামলা-সম্পৰ্কীয় সকল লোককে কৌশলে গ্রাম হইতে সরাইয়া দিলেন, তাহার পর একদিন হঠাৎ একজন আর্দালী সঙ্গে লইয়া সরেজমিন তদন্ত করিতে আসিলেন, এবং যে ভাবে তদন্ত আরম্ভ করিলেন—তাহা সম্পূর্ণ নূতন, এবং দারোগার কল্পনাতীত।

গ্রামের প্রধান ব্যক্তিরা একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের ছায়ায় পুলিশ-সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল বটে, কিন্তু কাহারও মুখ হইতে একটিও অনাবশ্যক কথা বাহির হইল না। সকলেই বুঝিয়াছিল—অধিক কথা বলিলে হয়তো আদালতে সাক্ষ্য দিতে হইবে; কিন্তু সাক্ষ্য দিতে কাহারও ইচ্ছা ছিল না। তাহাদিগকে স্বল্পভাষী দেখিয়া মিঃ রেনল্ডস্ খুশি হইলেন।

অতঃপর মিঃ রেনল্ডস্ গ্রামবাসীগণকে সঙ্গে লইয়া পূর্বোক্ত কূপের নিকট উপস্থিত হইলেন। গ্রামের বহু সাধারণ অধিবাসী ও বালক-বালিকারা কৌতূহলভরে তাঁহাদের অনুসরণ করিল। কৃপটি বালুকাপূর্ণ মাঠের ভিতর অবস্থিত ছিল। একটি মেঠোপথ দিয়া তাঁহাদিগকে সেই কূপের নিকট গমন করিতে হইল। সকলে কূপ হইতে কিছু দূরে থাকিতে মিঃ রেনল্ডস্‌ তাহাদিগকে সেই স্থানেই অপেক্ষা করিতে আদেশ করিলেন। তাঁহার আদেশ অগ্রাহ্য করিয়া কেহই কূপের নিকট যাইতে সাহস করিল না।

এবার মিঃ রেনল্ডস তাঁহার আর্দালীকে সঙ্গে লইয়া কুপের নিকট উপস্থিত হইলেন। আর্দালীর হাতে একটি ছোট পুঁটুলি ছিল। লোকগুলি দূরে দাঁড়াইয়া কৌতূহলভরে তাঁহাদের কাজ লক্ষ্য করিতে লাগিল।

কূপের নিকট অনেকগুলি পদচিহ্ন ছিল, অধিকাংশই স্ত্রীলোকের পদচিহ্ন বলিয়া মিঃ রেনল্ডসের ধারণা হইল। যে সকল পদচিহ্ন গ্রামের দিকে প্রসারিত ছিল, মিঃ রেনল্ডস্ সেগুলি লক্ষ্য না করিয়া, কূপ হইতে প্রায় একশত গজ দূরে গমন করিয়া অর্ধ-চক্রাকারে তাহা ঘুরিয়া দেখিলেন। সেখানে তিনি মানুষের চলিবার একটি পথ দেখিয়া, মধ্যে মধ্যে তাহা থামিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; এবং একজন গ্রামবাসীকে আহ্বান করিয়া সেই পথের নিকট দাঁড়াইতে বলিলেন। তাহার পর তিনি তাঁহার আর্দালীকে সঙ্গে লইয়া কি দেখিতে দেখিতে সেই পথে অগ্রসর হইলেন। তাঁহার এরূপ করিবার উদ্দেশ্য কি, গ্রামবাসীরা তাহা বুঝিতে না পারায় অস্ফুট স্বরে আলোচনা করিতে লাগিল।

যে স্থানে দশ-বারজন লোক দাঁড়াইয়াছিল, পুলিশ-সুপারিন্টেণ্ডেন্টের আর্দালী সেই স্থানে দুইটি সঙ্কীর্ণ পথ সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত দেখিয়া উত্তেজিত ভাবে চিৎকার করিয়া উঠিল। কিছু দূরে মাটি অত্যন্ত কঠিন থাকায় সেখানে পথ অদৃশ্য হইলেও তাহার পর নরম জমি ছিল। এজন্য পথটি পুনর্বার দৃষ্টিগোচর হইল। এই পথে খালি-পায়ের চিহ্নগুলি সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাওয়া গেল, এবং স্পষ্টই বুঝিতে পারা গেল—উভয় পথের ব্যবধানে যে সঙ্কীর্ণ স্থান ছিল—তাহার উপর দিয়া কোন ভারী দ্রব্য টানিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছিল।

মিঃ রেনল্ডস্‌ তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘আমি যাহা আশা করিয়াছিলাম—এখানে তাহার অতিরিক্ত কিছু দেখিতেছি। এখন তোমরা কাজে লাগিয়া যাও। আগুন জ্বালো, আমি জন-দুই ভদ্রলোক ডাকিয়া আনি।’

অতঃপর রন্ধনোপযোগী একটি পাত্র আনীত হইলে পূর্বোক্ত বাণ্ডিলে যে সকল দ্রব্য ছিল, তাহা সেই পাত্রে ঢালিয়া দেওয়া হইল। অগ্নির উত্তাপে তাহা তরল হইলে সেই তরল পদার্থ সুপরিস্ফুট পদচিহ্নগুলির উপর ঢালিয়া দেওয়া হইল। কিছুকাল পরে তাহা শীতল হইলে জমিয়া কঠিন হইল। কিন্তু তাহা কঠিন হইবার পূবেই দুইজন সাক্ষীর স্বাক্ষরিত এক খণ্ড কাগজ সেই পদার্থের উপরের অংশে বসাইয়া দেওয়া হইল। স্থায়ী প্রমাণরূপে সনাক্ত করিবার জন্যই এইরূপ করা হইল। অতঃপর তাহাদের উপর হইতে ময়লাগুলি ধুইয়া ফেলিয়া, সেই কঠিন পদার্থগুলি মাটি হইতে তুলিয়া লইয়া সতর্কতা সহকারে ঢাকিয়া রাখা হইল। এই কার্য শেষ হইলে মিঃ রেনল্ডস্‌ তাঁহার অশ্বে আরোহণ করিয়া থানায় চলিলেন। এবার তিনি স্থির করিলেন—সেই পদচিহ্ন কাহাদের, তাহাই তিনি আবিষ্কার করিবেন। তাহারা যে সন্দেহের পাত্র, ইহা তিনি পূর্বেই অনুমান করিয়াছিলেন।

যাহা হউক, মিঃ রেনল্ডস্ যখন সেখানে ফিরিয়া আসিলেন, তখন বেলা প্রায় শেষ হইয়াছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হইবার পূর্বেই সকল কাজ শেষ করিবার জন্য মিঃ রেনল্ডস্ ব্যগ্রভাবে ঘোড়া ছুটাইয়া আসিলেন। মহম্মদ আলি তৎপূর্বেই তাহার লোকগুলিকে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিল। মিঃ রেনল্ডস্ তাহাদের মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখিলেন মাত্র, এ বিষয়ে তাঁহার আগ্রহ লক্ষিত হইল না।

মিঃ রেনল্ডস্‌ দারোগাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সাক্ষীরা এখনও এখানে হাজির আছে কি? উহাদিগকে ও-ভাবে আর দাঁড় করাইয়া রাখিবার প্রয়োজন নাই। এই মুহূর্তেই একজন কনস্টেবলকে মোম ও রজন আনিবার জন্য বাজারে পাঠাও।’

তাঁহার আদেশ শুনিয়া সাব-ইন্সপেক্টর গভীর বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার ভাবভঙ্গি দেখিয়া মিঃ রেনল্ডস্‌ বলিলেন, ‘আমার আদেশ তুমি শুনিতে পাইয়াছ কি? এক সের মোম, এবং এক সের রজন আনাইতে হইবে; কিন্তু কনস্টেবলকে বলিয়া দাও, সে যেন বিভিন্ন দোকান হইতে তাহা ক্রয় করে। তাহাকে তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিতে বলিবে।’

মহম্মদ আলি একজন কনস্টেবলকে বাজারে পাঠাইবার জন্য ডাকিয়া আনিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সাহেব মোম আর রজন লইয়া কি করিবেন?’

কনস্টেবল বলিল, ‘খোদা মালুম! সাহেব যদি নিজের ইচ্ছায় তাহা না বলেন, তাহা হইলে ও-কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা কি গোস্তাকি হইবে না?’ —কনস্টেবল তাড়াতাড়ি বাজারে চলিয়া গেল।

কয়েক মিনিট পরে মিঃ রেনল্ডস্‌ বারান্দার টেবলের নিকট বসিয়া পড়িয়া রুমাল দিয়া কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে দারোগা মহম্মদ আলিকে বলিলেন, ‘মহম্মদ আলি, তুমি তোমার ডায়েরিতে লিখিয়াছ, ইমামবক্সের বাড়ি খানাতল্লাসীর সময় তোমার নিকট আসামী স্বয়ং, দুইজন সাক্ষী এবং চৌকিদার হাজির ছিল। সে সময় অন্য কোনও লোক সেখানে উপস্থিত ছিল কি?’

মহম্মদ আলি বলিল, ‘হাঁ সাহেব, রামপ্রসাদের পুত্র প্রতাপ আমাদের সঙ্গে গিয়াছিল। ঐ যে—সে এখন ওখানে বসিয়া আছে।’—সে অদূরবর্তী একটি যুবককে লক্ষ্য করিয়া অঙ্গুলি প্রসারিত করিল।

মিঃ রেনল্ডস্ বলিলেন, ‘খানাতল্লাসীর সময় সে কি সেই কার্যে কোন রকম সাহায্য করিয়াছিল?’

মহম্মদ আলি তৎক্ষণাৎ বলিল, ‘না সাহেব, খানাতল্লাস-সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে সে যোগদান করে নাই। আমাদের সঙ্গে যে চৌকিদার ছিল, সে গোয়াল-ঘরে চালের এলোমেলো ভাবের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।’

মিঃ রেনল্ডস্‌ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চৌকিদারের মুখের দিকে চাহিলেন।

চৌকিদার বলিল, ‘হাঁ হুজুর, প্রতাপ আমার সঙ্গে এই সকল কথা আলোচনা করিতে করিতে গোয়াল-ঘরের চালের দিকে চাহিলে সেই দিকে আমারও নজর পড়িল।

মিঃ রেনল্ডস্ দারোগাকে বলিলেন, ‘যে লাঠি পাওয়া গিয়াছিল, সেই লাঠি তুমি ভিন্ন আর কেহই হাত দিয়া স্পর্শ না করে—এ বিষয়ে তুমি কি সতর্ক ছিলে, মহম্মদ আলি?’

মহম্মদ আলি বলিল, ‘হাঁ সাহেব, ইহা আমি হলপ করিয়া বলিতে পারি। আমি নিজের হাতে তাহা টানিয়া বাহির করি, এবং সেই সময় তাহাতে রক্তের দাগ দেখিতে পাই। তাহার পর সেই লাঠি আর কেহ স্পর্শ করে নাই।’

মিঃ রেনল্ডস্‌ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘তুমি নিজের হাতে তাহা টানিয়া বাহির করিয়াছিলে বলিলে; লাঠির মাথার দিকটা ধরিয়া টানিয়াছিলে না সরু দিকটা ধরিয়াছিলে? স্মরণ করিয়া ঠিক উত্তর দাও।’

মহম্মদ আলি ধাঁধায় পড়িয়া বলিল, ‘লাঠিখানার পিতল চকচক করিতেছিল—তাহাতেই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। লাঠির অবশিষ্ট অংশ ঢাকা ছিল। আমি তাহার দুই মুড়া হাত দিয়া ধরিয়াছিলাম; উহার মধ্যস্থল স্পর্শ করি নাই। উহা দেখিয়াই আমার মনে হইয়াছিল, উহাতে অঙ্গুলি-চিহ্ন আছেই!’

মিঃ রেনল্ডস্ বলিলেন, ‘প্রতাপ কি করিল? উহা কি আসামীরই লাঠি বলিয়া সনাক্ত করিল?’

মহম্মদ আলি মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, সে তাহা করে নাই, সাহেব। কিন্তু দুইজন সাক্ষীই, এবং যাহারা দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়াছিল—তাহারাও সকলে জানিত—উহা ইমামবক্সেরই লাঠি। তা ছাড়া, বিশেষজ্ঞেরও রিপোর্ট আছে স্যার।’

পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাহার কার্যতৎপরতায় সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে পারিতেছেন না ভাবিয়া তাহার কণ্ঠস্বরে ক্ষোভের চিহ্ন লক্ষিত হইল। এই সকল অকাট্য প্রমাণ সত্ত্বেও সাহেব কোন পথে অগ্রসর হইয়াছেন? তাঁহার উদ্দেশ্যই বা কি?—দারোগা নতমস্তকে দাঁড়াইয়া এই সকল কথা চিন্তা করিতে লাগিল।

মিঃ রেনল্ডস্ দারোগাকে বলিলেন, ‘এক বালতি সূক্ষ্ম বালি আনাইয়া তাহা এক ইঞ্চি পুরু করিয়া মাটিতে ছড়াইয়া দাও। এখন আমি কোন সাক্ষীকে জেরা করিব না। উহাদের প্রত্যেকে কি সাক্ষ্য দিবে, তাহা তোমার ঠিক জানা আছে মহম্মদ আলি। যাহারা লাঠি সনাক্ত করিয়াছিল, তাহাদিগকে, চৌকিদারকে এবং প্রতাপকে ওই দল হইতে বাছিয়া লও। নামগুলি লিখিয়া সেই ভাবে পর পর উহাদিগকে দাঁড় করাও। অন্য সকলে তফাতে অপেক্ষা করিতে পারে।’

মিঃ রেনল্ডসের আদেশ অনুসারে ছয়জন লোককে শ্রেণীবদ্ধভাবে স্থাপন করা হইল। পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট অতঃপর কি করিবেন, তাহা কেহই বুঝিতে পারিল না। পুলিশের অন্যান্য কর্মচারীরা কিছু দূরে দাঁড়াইয়া রেনল্ডসের কার্য-প্রণালী লক্ষ্য করিতে লাগিল। মিঃ রেনল্ডসের আদেশে যে বালিগুলি ছড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল—সেই দিকে তাহাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। বালি আনিয়া ওইভাবে ছড়াইবার কারণ কেহই বুঝিতে পারিল না। মিঃ রেনল্ডসের পকেট হইতে কাগজ-জড়ান পার্শেলটির এক অংশ বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাই বা কোন্ কাজে লাগিবে, তাহাও কেহ স্থির করিতে পারিল না।

কিন্তু তাহাদিগকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করিতে হইল না; কারণ, অতঃপর একজনের নাম ধরিয়া ডাক পড়িতেই উক্ত ছয়জনের একজন সাড়া দিল। মিঃ রেনল্ডস্ তাহাকে প্রসারিত বালুকারাশির উপর দিয়া হাঁটিয়া যাইবার আদেশ করিলেন। সেই ব্যক্তি এই আদেশ পালন করিলে মিঃ রেনল্ডস্‌ উঠিয়া গিয়া সেই ব্যক্তির পদচিহ্নের সহিত তাঁহার পকেটস্থিত পার্শেলের ছাঁচ সতর্কভাবে মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন।

এই কার্য শেষ হইলে মিঃ রেনল্ডস্‌ সেই সাক্ষীটিকে বিদায় দান করিয়া বালিগুলি সেই স্থান হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতে আদেশ করিলেন। প্রসারিত বালুকারাশি অপসারিত হইলে আবার বালি ছড়াইয়া দেওয়া হইল, এবং দ্বিতীয় সাক্ষীকে তাহার উপর দিয়া পূর্ববৎ হাঁটিয়া যাইতে বলা হইল। সে এই আদেশ পালন করিলে তাহার পদচিহ্নও পূর্ববৎ তাঁহার পকেটের ছাঁচের সহিত তিনি মিলাইয়া দেখিলেন।

অতঃপর তৃতীয় ব্যক্তির পালা। সে ওইভাবে নূতন এক স্তর বালির উপর দিয়া হাঁটিয়া চলিয়া যাইবার পর মিঃ রেনল্ডস্‌ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকায় পদচিহ্নগুলি বিভিন্ন দিক হইতে সতর্কভাবে পরীক্ষা করিয়া, তাঁহার পকেটস্থিত পার্শেলের ছাঁচের সহিত মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর তিনি মাথা তুলিয়া দারোগা মহম্মদ আলির মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘তুমি এই সাক্ষীর অঙ্গুলির ছাপ লইবে, মহম্মদ আলি! আমি উহার দুই হাতের সকল অঙ্গুলিরই ছাপ চাই।’

এ কথা শুনিয়া দারোগা গভীর বিস্ময়ে মুখব্যাদান করিল। কিন্তু সুপারিন্টেন্ডেন্টের আদেশের প্রতিবাদ করিবে, তাহার সেরূপ সাহস ছিল না; তাঁহার আদেশ পালন না করিয়া তাহার নিষ্কৃতি ছিল না। সে তাঁহার এই আদেশ পালন করিতে যাইবে—সেই সময় মিঃ রেনল্ডসের আর্দালী কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত হইলে, সে তাঁহার ইঙ্গিতে রন্ধনযোগ্য একটি হাঁড়ি লইয়া আসিল— এবং বাজার হইতে যাহা কিনিয়া আনা হইয়াছিল—তাহার বান্ডিল খুলিতে আরম্ভ করিল। তাহা পূর্ববৎ অগ্নিতে জ্বাল দিয়া তরল হইলে মিঃ রেনল্ডস্‌ স্বয়ং সেই উত্তপ্ত তরল পদার্থ তৃতীয় ব্যক্তির পদচিহ্নের উপর ঢালিয়া দিলেন। যতক্ষণ তাহা শীতল না হইল—ততক্ষণ তিনি অধীরভাবে প্রতীক্ষা করিলেন। শীতল হইলে বাদামী রঙের সেই পদার্থটি তুলিয়া লইলেন—তাহা তখন শক্ত হইয়া গিয়াছিল। তিনি তাহার ধুলা-ময়লা ঝাড়িয়া-ফেলিয়া খানিক জল আনিতে আদেশ করিলেন। পাঁচ-সাতজন লোক জল আনিবার জন্য দৌড়াইয়া গেল।

কিন্তু মিঃ রেনল্ডসের পরীক্ষা তখনও শেষ হয় নাই। তিনি পুনর্বার বালির স্তর মুছিয়া সেখানে নূতন বালি ছড়াইয়া তাহার উপর দিয়া চতুর্থ সাক্ষীকে পরিচালিত করিলেন; কিন্তু অবিলম্বেই তাহাকে বিদায় দান করা হইল। অতঃপর পঞ্চম সাক্ষীর পালা আসিল। সে ওইভাবে বালুকা-স্তরের উপর দিয়া চলিয়া যাইবার পর প্রতাপই কেবল বাকী রহিল।

প্রতাপ ওইভাবে বালির উপর দিয়া চলিয়া যাইবার পর মিঃ রেনল্ডস্‌ উৎসাহভরে সোজা হইয়া বসিয়া, তাহাকে ফিরিয়া আসিতে আদেশ করিলেন। তখন মহম্মদ আলি তাহার আঙ্গুলের ছাপ লইবার জন্য তাহাকে টেবিলের নিকট লইয়া গেল। অতঃপর তাহার পদচিহ্ন গ্রহণের জন্য মোম ও রজন পূর্ববৎ অগ্নির উত্তাপে তরল করিয়া তাহার পদচিহ্নের উপর ঢালিয়া দেওয়া হইল।

এইবার মিঃ রেনল্ডস্ দারোগাকে বলিলেন, ‘মহম্মদ আলি, তুমি তোমাদের স্কুলে অঙ্গুলি-চিহ্ন সমূহ তুলনা করিতে শিখিয়াছিলে। তুমি অঙ্গুলির যে সকল ছাপ লইয়াছ, এইগুলির সহিত তাহাদের তুলনা কর।’—এই কথা বলিয়া তিনি একখানি লেফাফার ভিতর হইতে অঙ্গুলি-চিহ্নিত কয়েকখানি ফটো বাহির করিয়া মহম্মদ আলির হস্তে প্রদান করিলেন। তাহার পর একটি সিগারেট মুখে গুঁজিয়া ধূমপান করিতে করিতে কৌতূহলভরে দারোগার কাজ দেখিতে লাগিলেন। পাঁচ মিনিট পরে মহম্মদ আলি মিঃ রেনল্ডসের দিকে চাহিয়া দেখিতে পাইল—তিনি দুইটি পদচিহ্নের ছাঁচ পাশে রাখিয়া অন্যগুলি সরাইয়া ফেলিয়াছেন।

দারোগা তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া অত্যন্ত বিব্রতভাবে বলিল, ‘আমার ভুল হইতে পারে স্যার! কারণ, আমি এ বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞ নহি। কিন্তু আমার ধারণা, আমি শেষ লোকটির যে সকল অঙ্গুলির ছাপ লইয়াছি তাহাদের মধ্যে প্রথম দ্বিতীয় অঙ্গুলির ছাপ এই ফটোর সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে।’

মিঃ রেনল্ডস্ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ডান হাতের, না বাঁ হাতের অঙ্গুলির ছাপ?’

দারোগা বলিল, ‘ডান হাতের। কিন্তু আমি কি জিজ্ঞাসা করিতে পারি স্যার, হত্যাকাণ্ডের সহিত ইহার কি সম্বন্ধ?’

মিঃ রেনল্ডস্‌ তাহার এই প্রশ্নে কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন ‘এখন পদচিহ্নের এই ছাঁচগুলি মিলাইয়া দেখ।’

মহম্মদ আলি তাহা মিলাইয়া দেখিয়া বলিল, ‘হাঁ, ঠিক একই রকম বটে; এমনকি, বুড়ো আঙ্গুলের নিচে যে কাটা দাগটি আছে, তাহা পর্যন্ত মিলিয়া গিয়াছে স্যার! আগাগোড়া মাপেরও কোন পার্থক্য নাই।’

মিঃ রেনল্ডস্‌ বলিলেন, ‘এই সাক্ষীর কি নাম দেখিয়া রাখ; কিন্তু এখন কোন কথা প্রকাশ করিও না। উহাদের প্রত্যেকেই এখানে আসুক, তখন আমি বলিব—তোমার নিকট কি গোপন করা হইয়াছে। ইমামবক্স যে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী নহে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হইয়াছি।’

দারোগা বলিল, ‘কিন্তু আমি যথাযোগ্য সম্মান সহকারেই আপনাকে জানাইতেছি, তাহার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা অকাট্য; সেই প্রমাণ খণ্ডন করা হয় নাই স্যার!’

মিঃ রেনল্ডস্ অবিচলিত স্বরে বলিলেন, ‘কিন্তু তোমার মন সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকিয়া কার্যে ব্যাপৃত আছে মহম্মদ আলি! আমার ধারণা ছিল—এ পর্যন্ত যাহা করা হইল, তাহার ফলে সত্যের আলোকে তোমার মত নির্বোধকেও রহস্যের অন্ধকারে পথ দেখাইতে পারিবে। এখন তুমি একটু বুদ্ধি খরচ কর দেখি।’

অতঃপর মিঃ রেনল্ডস্‌ অন্য সকলের দিকে চাহিয়া উত্তেজিত স্বরে আদেশ করিলেন, ‘রামপ্রসাদের পুত্র প্রতাপ, তুমি উঠিয়া আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াও। তোমাকে আমার কোন কোন কথা বলিবার আছে। অন্য যাহারা এখানে হাজির আছে—তাহারাও আমার কথা শুনিতে পারে। কিন্তু আমার কথাগুলি বলিতে আরম্ভ করিবার পূর্বে আমি আর একটা ল্যাম্প চাই। তাহা উঁচু করিয়া ধরিতে হইবে, যেন আমি প্রতাপের মুখ সুস্পষ্ট রূপে দেখিতে পাই।’

পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টের আদেশ শুনিয়া প্রতাপ অনিচ্ছার সহিত উঠিয়া আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। ল্যাম্পের আলোক তাহার মুখের উপর পড়িল, এবং সেই আলোকে তাহার পশ্চাৎস্থিত অন্যান্য লোকগুলিকেও দেখিতে পাওয়া গেল। একজন কনস্টেবল বারান্দার ধারে দাঁড়াইয়া, হারিকেন-লণ্ঠনটা প্রসারিত হস্তে উঁচু করিয়া ধরিয়া রহিল। দারোগা মহম্মদ আলি পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টের পশ্চাতে বসিয়াছিল; তাহার মুখে ভয় ও দুশ্চিন্তা পরিস্ফুট। প্রকৃত ব্যাপার কি, তাহা সে তখনও বুঝিতে পারে নাই।

মিঃ রেনল্ডস্‌ তাঁহার মুখ হইতে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা বাহির করিয়া লইলেন। দর্শকগণ স্তব্ধভাবে প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। তাহার পর মিঃ রেনল্ডস্‌কে মুখ তুলিয়া তীব্র দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাহিতে দেখিয়া ভয়ে সকলেরই মুখ শুকাইয়া গেল, তাহাদের বুক কাঁপিতে লাগিল। প্রকৃত ব্যাপার কি, তাহা কেহই বুঝিতে পারিল না; কিন্তু প্রত্যেকেরই আশঙ্কা হইল—তাহাকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করিতে হইবে।

সুপারিন্টেন্ডেন্ট হারিকেন-লণ্ঠনের অস্ফুট আলোকে অদূরে দণ্ডায়মান প্রত্যেক ব্যক্তির মুখ একে একে দেখিতে লাগিলেন। অবশেষে তাঁহার দৃষ্টি সোপানের উপর দণ্ডায়মান প্রতাপের মুখের উপর সন্নিবিষ্ট হইল।

মিঃ রেনল্ডস্ তাহাকে লক্ষ্য করিয়া অচঞ্চল স্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘প্রতাপ, যে ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে—সে তোমার পিতা; এবং যে ব্যক্তি তোমার পিতার হত্যাকারী বলিয়া অভিযুক্ত হইয়াছে, সে তোমার শত্ৰু, তোমাদের সমগ্র পরিবারেরই শত্রু; এ কথা কি সত্য নহে? তোমরা পরস্পরকে দীর্ঘকাল হইতে শত্ৰুবোধে ঘৃণা করিয়া আসিয়াছ। এই ঘৃণার কথা তোমাদের কাহারও অজ্ঞাত নহে। তোমরা যে সকল মামলা করিয়া আসিয়াছ, সেই সকল মামলার নথিপত্রেও ইহার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। জলের দখলিস্বত্ব লইয়া যে মামলা হইয়াছিল, সেই মামলায় আদালতের বিচারে তোমাদের পরাজয় হইয়াছিল, এবং তোমাদের বিরুদ্ধে রায় প্রকাশিত হইয়াছিল। তুমি এবং তোমার আত্মীয়গণ সেই মামলার আপীলে কোন সুফলের আশা না থাকায় ইমামবক্সের অত্যাচার হইতে নিষ্কৃতি লাভের কি উপায় থাকিতে পারে, তৎসম্বন্ধে পরামর্শ করিয়াছিলে। সে গ্রামের ভিতর দিয়া যাইবার সময় তোমাদিগকে দেখিতে পাইলে তোমাদের পরাজয়ের জন্য ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত, তোমাদিগকে ক্ষেপাইয়া তুলিত; কিন্তু তোমরা ইহার প্রতিকারের কোন উপায় স্থির করিতে পারিতে না, এবং পাছে তোমাদিগকে সন্দেহ করা হয়, এই ভয়ে প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করিতে পারিতে না। অবশেষে তোমরা ভাবিয়া দেখিলে—এখানকার থানার দারোগাটি অদূরদর্শী, ছোকরা কর্মচারী, তাহার চক্ষুতে ধূলা নিক্ষেপ করা সহজ হইবে। এইরূপ চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই তোমাদের বাড়িতে তোমার যে বুড়ো বাপ ছিল, তাহার অবস্থার কথা তোমার স্মরণ হইল। তুমি ভাবিয়া দেখিলে, অক্ষম বৃদ্ধ আর লাঙ্গল বা গরুর গাড়ি চালাইতে পারে না, সে এখন সম্পূর্ণ অকর্মণ্য এবং সংসারের ভারস্বরূপ। সে বসিয়া-বসিয়া উপার্জিত অন্ন ধ্বংস করে; ইহা ভিন্ন তাহার অন্য কোন কাজ নাই। সুতরাং তাহার উপর তোমার দৃষ্টি পড়িল, এবং শয়তান আসিয়া তোমার স্কন্ধে ভর করায়—সেই অকর্মণ্য বৃদ্ধকে কাজে লাগাইবার জন্য তোমার আগ্রহ হইল। শয়তান তোমার কানে কানে বলিল—এই বুড়োকে সরাইয়া দিলে কোন ক্ষতি নাই; তাহার দ্বারাই তোমাদের কার্যসিদ্ধি হইবে।

‘কিন্তু এজন্য পথ প্রস্তুত করিতে হইবে; সুতরাং তোমাকে সুযোগের প্রতীক্ষা করিতে হইল। অবশেষে এই সুযোগ আসিল; ইমামবক্সের লাঠিখানা চুরি করিবার সুবিধা হইল। এই লাঠি চুরি করিয়াও তোমাকে কান খাড়া করিয়া প্রতীক্ষা করিতে হইল। কারণ ইমামবক্স তাহার লাঠি চুরি যাওয়া সম্বন্ধে গ্রামের লোকদের কোন কথা বলে কিনা, তাহা জানা প্রয়োজন বলিয়াই তোমার ধারণা হইল। লাঠি-চোর বলিয়া তোমাকে সন্দেহ করা হয় কিনা, তাহা জানিবার জন্য তুমি উৎসুক হইবে—ইহা তোমার পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু ইমামবক্স এ সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য না করায় তোমার আশা পূর্ণ হইল।’

এই পর্যন্ত বলিয়া মিঃ রেনল্ডস্ ক্ষণকালের জন্য নীরব হইলেন। প্রতাপ এ সকল কথা শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এই সময় কনস্টেবলটা হাত বদলাইয়া হারিকেন-লণ্ঠনটা অন্য হাতে লইল। মহম্মদ আলি অধীরভাবে এক হাঁটু অন্য হাঁটুর উপর তুলিয়া বসিল। এইবার তাহার মনে হইতে লাগিল, তদন্ত-কার্যে তাহাকে হয়তো প্রতারিত হইতে হইয়াছিল। কিন্তু তাহার অনুকূলে যে অকাট্য প্রমাণ বর্তমান, তাহা ব্যর্থ হইবার সম্ভাবনা কোথায়?

মহম্মদ আলি ভাবিল, সাহেব অনুমানে নির্ভর করিয়াই ওইসকল কথা বলিয়াছেন। অনুমান কখনও প্রমাণের স্থান অধিকার কারতে পারে না, সুতরাং চিন্তার কোন কারণ নাই বুঝিয়া, সে গ্যাঁট হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার মুখে অবিশ্বাসের ক্ষীণ হাসি ফুটিয়া উঠিল। অন্যান্য লোকও ওইরূপ ভাবিতে লাগিল। মহম্মদ আলি আশ্বস্ত চিত্তে তাহাদের মুখের দিকে চাহিল, কিন্তু তাহাদের মুখ দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না। তাহারা বুঝিয়াছিল পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট দারোগা মহম্মদ আলি অপেক্ষা অনেক অধিক সংবাদ সংগ্রহ করিয়াছেন, এবং তিনি তাহা সপ্রমাণ করিবারই ব্যবস্থা করিতেছেন।

তাহাদের অনুমান শেষ হইবার পূর্বেই মিঃ রেনল্ডস্‌ প্রতাপকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘প্রতাপ, আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইতেছি যে, তুমি তোমার বৃদ্ধ পিতা রামপ্রসাদকে তাহার নিদ্রিত অবস্থায় লাঠি মারিয়া হত্যা করিতে কুণ্ঠাবোধ কর নাই। হাঁ, ওই লাঠি দিয়াই তাহাকে হত্যা করিয়া তোমার কোন আত্মীয়ের সাহায্যে তাহার মৃতদেহ ওই কুপের নিকট টানিয়া লইয়া গিয়াছিলে। বালির উপর তোমার পায়ের দাগ পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু তোমাদের শত্রুই যে তোমার পিতাকে হত্যা করিয়াছে, ইহার উপযুক্ত প্রমাণের প্রয়োজন হইবে বুঝিয়া, তুমি তাহার সেই লাঠি তাহারই গোয়ালঘরের চালে গুঁজিয়া রাখিয়াছিলে। তুমি জানিতে, তাহা সহজেই খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। উহা যে তুমিই সেখানে লুকাইয়া রাখিয়াছিলে, তাহার প্রমাণ এই যে সেই লাঠিতে রক্তের দাগের ভিতর তোমার দুইটি অঙ্গুলির চিহ্ন পাওয়া গিয়াছে!’

এবার দারোগা মহম্মদ আলি বিস্ময়ভরে একটা হুঙ্কার দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

মিঃ রেনল্ডস্‌ তাহার বিস্ময়ের কারণ বুঝিতে পারিয়া, অঙ্গুলি-চিহ্নের ফটোর প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘এই অঙ্গুলি-চিহ্নেরই উপর সব নির্ভর করিতেছে। অঙ্গুলি-চিহ্নের বিশেষজ্ঞও উহা লক্ষ্য করে নাই। তোমাকে বেশি দোষী করিতে পারি না।’

অতঃপর মিঃ রেনল্ডস্‌ প্রতাপকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগলেন, ‘অপরাধী বলিয়া কাহাকে সন্দেহ করা হইবে—তাহা তুমি ভালই জানিতে, এজন্য কাহারও বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অভিযোগ করা তুমি আবশ্যক মনে কর নাই। যখন আসামীর বাড়ি খানাতল্লাস হয়, তখন তুমি সেখানে হাজির ছিলে। কারণ তোমার আশঙ্কা হইয়াছিল—লাঠিখানা সকলের দৃষ্টি এড়াইতেও পারে। উহা কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিলে, তাহা তোমার কৌশলেই ধরা পড়িলেও তুমি এরূপ চতুর যে লাঠিখানা নিজে সনাক্ত কর নাই। গ্রামের সকলেই জানিত, উহা ইমামবক্সেরই লাঠি। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্ক হইয়াই তুমি ভুল করিয়াছ। আমার বয়স নিতান্ত অল্প নয়, কিন্তু তোমার মত হীনপ্রবৃত্তির মানুষ জীবনে দেখি নাই, — নিজের বাপকে হত্যা করিবার জন্য লাঠি তুলিতে তোমার হাত হইতে লাঠি খসিয়া পড়িল না,—তোমার হাত আড়ষ্ট হইল না, ইহাই আশ্চর্য!’

মিঃ রেনল্ডসের কথা শুনিয়া অন্যান্য লোক সেই পিতৃহন্তার ছায়া স্পর্শ করিতে ঘৃণাবোধ করিয়া দূরে সরিয়া দাঁড়াইল।

মিঃ রেনল্ডস্‌ উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, ‘তোমার আর কি বলিবার থাকিতে পারে?’

দুইবার প্রতাপের ওষ্ঠ কম্পিত হইল, কিন্তু তাহার মুখ হইতে কোন কথা বাহির হইল না। অবশেষে সে হতাশভাবে বলিল, ‘বাবা এজন্য আমাকে অনুমতি দিয়াছিল।’

মিঃ রেনল্ডস্ তাহার দিকে অঙ্গুলি প্রসারিত করিয়া উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, ‘সে তাহাকে খুন করিবার জন্য তোমাকে অনুমতি দিয়াছিল? কি মিথ্যাবাদী!’

পিতৃহন্তা প্রতাপ চারিদিকে চাহিয়া, তাহার সাক্ষীগণকে ঘৃণায় তাহার সংশ্রব ত্যাগ করিতে দেখিয়া ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, ‘হাঁ, আমার বাপের আদেশ-পত্র আমার সঙ্গেই আছে। আমাদের মহাশত্রু ফাঁসিতে মরিবে, এই আশায় বাবা স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন করিয়াছে। তাহার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হইয়া তাহার আদেশ পালন করিয়াছি মাত্র। এই ফন্দি তাহার নিজেরই। এজন্য তাহার নিকট হইতে হুকুমনামা লিখিয়া লইয়া আমি এ কাজ করিয়াছি। পিতৃ-আজ্ঞা কি করিয়া অগ্রাহ্য করি?’

এই কথা বলিয়া প্রতাপ তাহার পাগড়ির মুড়া হইতে একখানি চিরকুট খুলিয়া তাহা মিঃ রেনল্ডসের হাতে অর্পণ করিল।

মিঃ রেনল্ডস্‌ প্রতাপের পিতা রামপ্রসাদের স্বহস্ত-লিখিত সেই আদেশলিপি পাঠে স্তম্ভিত হইলেন। তিনি জানিতেন, অনেকে ক্রোধভরে শত্রুর মাথায় লাঠি মারিয়া তাহাকে হত্যা করিয়া প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়, কিন্তু কোন ব্যক্তি শত্রুকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করিবার জন্য নিজে লাঠি খাইয়া প্রাণ বিসর্জন করে—এরূপ দৃষ্টান্ত তিনি এই প্রথম দেখিলেন।

অতঃপর প্রতাপের হাতে হাতকড়ি আঁটিবার সময় সে দুঃখ করিয়া বলিল, ‘বাবা অনর্থক মরিল! যাহাকে ফাঁসে লটকাইবার জন্য বাবা স্বেচ্ছায় প্রাণ দিল, তাহাকে তুমিই কৌশলে বাঁচাইয়া দিলে সাহেব! শেষে পিতৃহত্যার শাস্তি আমাকেই লইতে হইবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *