গ. অদ্বৈতপ্রকাশ : সংশয় ও প্রাসঙ্গিক
অদ্বৈতপ্রকাশের প্রামাণিকতা নিয়ে বিভিন্ন সময় কিছু বিতর্কের উত্থাপন হয়েছে। মূলত: বিশিষ্ট গবেষক ও বিশেষজ্ঞ বিমানবিহারী মজুমদার শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান-এ ‘গ্রন্থের অকৃত্রিমতায় সংশয়’ অংশে বেশ কিছু তথ্য উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। পরবর্তীকালে আরও কোন কোন আলোচক এই তথ্যের অনুকূলেই মত প্রকাশ করেছেন। বিমানবিহারী লিখছেন :
ঈশান নাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ যদি অকৃত্রিম গ্রন্থ হয়, তাহা হইলে শ্রীচৈতন্যের জীবনী ও ধৰ্ম্মমত-সম্বন্ধে ইহার প্রামাণিকতা মুরারি গুপ্তের কড়চার তুল্য, এমন কি কোন কোন বিষয়ে উহার অপেক্ষাও বেশী বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত। শ্রীচৈতন্যকে স্বচক্ষে দেখিয়া তাঁহার জীবনী লিখিয়াছেন তিনজন—মুরারি, কবিকর্ণপুর ও জয়ানন্দ। কবিকর্ণপুর ও জয়ানন্দ উভয়েই বাল্যকালে শ্রীচৈতন্যকে দর্শন করিয়াছিলেন।…
ঈশান মুরারির কড়চা, বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত বা কবিকর্ণপুরের কোন বই পড়েন নাই, এমন কি এগুলি যে তাঁহার গ্রন্থরচনার পূৰ্ব্বে লিখিত হইয়াছিল তাহাও তিনি জানিতেন না। তিনি অদ্বৈতের জীবনী-সম্বন্ধে একখানি মাত্র বই পড়িয়াছিলেন; আর সব ঘটনা নিজের চোখে দেখিয়া বা অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, অচ্যুত প্রভৃতির ন্যায় প্রামাণিক ব্যক্তির নিকট শুনিয়া লিখিয়াছেন।’ বিমানবিহারী মজুমদার।৪৩২
বিমানবিহারীর সংশয়ের প্রধান কারণ এখানেই। যিনি চৈতন্যচরিতের আকরগ্রন্থগুলি স্বয়ং পড়েন নি, অথবা গ্রন্থগুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসংশয় নন, তিনি সাল-তারিখের ক্ষেত্রে এতখানি সতর্ক হতে পারলেন কী ভাবে? বিমানবিহারী প্রশ্ন তুলছেন :
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে যে এই গ্রন্থ অকৃত্রিম হইলে, ইহার প্রামাণিকতা মুরারির গ্রন্থের তুল্য হওয়া উচিত।
‘কিন্তু এক হিসাবে মুরারির গ্রন্থের অপেক্ষাও ইহা মূল্যবান। মুরারি কোথাও সন-তারিখ উল্লেখ করেন নাই। কবিকর্ণপুর, বৃন্দাবনদাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ কতকগুলি ঘটনার সময় নিদের্শ করিয়াছেন। তবু আমরা জানি না যে নিত্যানন্দ, অদ্বৈত ও হরিদাস কবে জন্মিয়াছিলেন, শ্রীচৈতন্য অপেক্ষা কতদিনের বড় ছিলেন, শ্রীচৈতন্য কত দিন কি কি বিষয় পড়িয়াছিলেন, অদ্বৈত কবে তিরোধান করিলেন। ঈশান নাগর-এ সমস্ত ঘটনার তারিখ ত দিয়াছেনই, অদ্বৈতের পুত্রেরা কে কবে জন্মিয়াছিলেন তাহাও লিখিয়াছেন।’ বিমানবিহারী মজুমদার, ৪৩৩-৪৩৪
রঙ্গপুর সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা (১৩১৪/২/২) থেকে জানা যায় যে ‘পুস্তকখানি বটতলার কৃপায়’ ছাপা হয়েছিল।
সংশয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে আর বেশির ভাগের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র লেখকের উপর বর্তায়। তাঁর সূত্র ও তথ্যের নিখুঁত হিসাব স্বয়ং তিনিই দিতে পারবেন। মহাকালের বিচারে তা অসম্ভব। আমাদের কাছে যে কিছু তথ্য, তা যৌক্তিকতার কতখানি আনুকূল্য করতে পারে, সে বিষয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। আমাদের মনে হয়, বিতর্ক সরিয়ে আলোচনায় আসা অনেক সংগত ও সুসমঞ্জস হবে।
বিমানবিহারী মজুমদার ‘ষোড়শ শতাব্দীতে বাঙ্গালায় বেদের চর্চা ছিল কিনা সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অথচ অদ্বৈতপ্রকাশে ঈশান লিখলেন, ‘কেহ পড়ে ব্যাকরণ কেহ পড়ে বেদ।’ এই সংশয় নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
ক) অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘তাঁর (শ্রীচৈতন্যের) পিতা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ। তিনি বিদ্যার্জনের জন্য নবদ্বীপে বসবাস করেন এবং এখানেই শচীদেবীকে বিবাহ করে এদেশেই বরাবরের জন্য রয়ে যান।’ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত। পৃ. ৭৮
খ) ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতম্-এ পেলাম :
‘তত্র চ ব্রাহ্মণাদীনাং বেদধ্বনিভি : সূতমাগধবন্দিপ্রভৃতীনাং স্তোত্রপাঠৈর্ণ্যায়সীমাংসাদি শাস্ত্রবিদাং’—ইত্যাদি।
ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতম/(সংস্কৃত)।পৃ ২৩৪
ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতে আরও পাই, ‘ব্রাহ্মণের নিত্যকর্তব্য যজ্ঞবিশেষ। বেদাধ্যয়নের পর গুরুগৃহ থেকে প্রত্যাবর্তন করে ব্রহ্মচারী বিবাহ করে গৃহস্থ হয়ে নিজগৃহের একস্থানে এক পৃথক অগ্নিশালা বা অগ্নাগার স্থাপন করবেন।’ ক্ষিতীশ বংশাবলিচরিতম্। পৃ. ১৮৮
গ) চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ‘সপ্তমদিবস : দিবার বণিকখণ্ডে (ধনপতি-শ্রীমন্ত উপাখ্যান) পাই :
‘সমাপ্ত করিয়া আগে নিজ অধ্যয়ন।
কৌতুকে শুনেন জত পড়েন আখ্যান।।
কেহ পড়ে বেদবিদ্যা আগমপুরাণ।
শ্রীপতি সভার পাঠে করে অবধান।।’ চণ্ডীমঙ্গল। মুকুন্দরাম। সুকুমার সেন সম্পাদিত। পৃ ২২৩
ঘ) চৈতন্যচরিতামৃতে আছে—
‘যদদ্বৈতং ব্রহ্মোপনিষদি তদপাস্য তনুভা।
য আত্মান্তর্যামী পুরুষ ইতি সোহস্যাংশড়িবিভব:।।’ চৈতন্যচরিতামৃত/১/১/৩
‘ব্রহ্মোপনিষদে’র উল্লেখ আমাদের ধারণাকে কথঞ্চিৎ পুষ্ট করে।
ঙ) শ্রীজীব গোস্বামী উপনিষদের টীকাভাষ্য প্রদান করেছেন।
চ) বৃন্দাবনদাস লিখছেন ‘বেদের নিগূঢ় নানামত ক্রীড়া করে’। চৈ.ভা/আদি/৩৬
অথবা ‘চারি বেদে যে প্রভুরে করে অন্বেষণ।’ ঐ/৩১
ছ) আমাদের প্রিয় বন্ধু বেদ-গবেষক ড. শ্রীমন্ত চট্টোপাধ্যায়-এর সুনির্দিষ্ট অভিমত, ‘দেশে সর্বপ্রকার সংস্কৃত অর্থাৎ সাহিত্য-ব্যাকরণ-ন্যায়, প্রায় সবই পড়ানো হতো কিন্তু চতুষ্পাঠীতে শুধুমাত্র বেদ-ই পড়ানো হতো। তাই চতুষ্পাঠীকে বলা হয় ‘চতুর্বেদাধ্যয়নস্থানম্।’ ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে আমরা অনেক চতুষ্পাঠীর সন্ধান পাই।’
জ) শ্রীশ্রীগৌড়ীয়বৈষ্ণব-সাহিত্য গ্রন্থে বৈদিক ও বৈষ্ণবীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর সমন্বয় প্রকাশ করা হয়েছে। যথা, ‘বৈদিক সম্প্রদায় বিশেষই বৈষ্ণব সম্প্রদায়। …. বৈদিক সম্প্রদায় কি, তাহাই বলিতেছি। যাহারা বেদ ও বেদমূলক পুরাণাদি শাস্ত্রের অপৌরুষেয়ত্ব স্বীকার করেন ও তত্তং শাস্ত্রবাক্যে যাঁহাদের অচল বিশ্বাস, অলৌকিক তত্বের স্বরূপ-নিৰ্ণয় ও উপাসনাদি বিষয়ে একমাত্র বেদই যাঁহাদের মুখ্য প্রমাণ, লৌকিক প্রত্যক্ষাদি প্রমাণনিচয়ের অত্যন্ত অবিষয় পরমতত্ত্বই যাঁহাদের আরাধ্য, কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি—এই বৈদিক তত্ত্বত্রয়ে বা তাহাদের অন্যতমে যাঁহারা একান্ত পরিনিষ্ঠিত, বৈদিক আচার্যের চরণাশ্রয়ই যাঁহারা তত্ত্বজ্ঞান-লাভের প্রধান উপায় বলিয়া একমত—তাঁহারাই বৈদিক সম্প্রদায়।’ ….অতএব ‘ব্রহ্মসম্প্রদায়’ নূতন নহে, অবৈদিকও নহে।’ শ্রীশ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণবসাহিত্য।পৃ. ১৫
ঝ) ‘পঞ্চদশ শতাব্দীতে ঐ গ্রামবাসী বাসুদেব সাৰ্ব্বভৌম নামা একজন অদ্বিতীয় অধ্যাপক। নবদ্বীপের সন্নিহিত বিদ্যানগর গ্রামে, এক চতুষ্পাঠী করেন।’ চতুষ্পাঠীতে চার বেদের চর্চা হত এ বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যেতে পারে। কার্তিকেয় চন্দ্র রায়। ক্ষিতীশবংশাবংশাবলিচরিত।পৃ. ৩৬
ঞ) ‘বৈদিক সম্প্রদায় বিশেষই গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজ। ….অনাদি বেদ-কল্পতরু হইতে যাহার আবির্ভাব….সেই সম্প্রদায়ের উৎকর্ষ স্বতঃসিদ্ধ।’ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য। পৃ. ১৫
মধ্যযুগে বেদ-চর্চা, কুবেরের নির্দেশ অদ্বৈতকে ‘পড় বেদ চারিখান’, বা অদ্বৈতের ‘বেদপঞ্চানন’ উপাধিলাভ (অদ্বৈতপ্রকাশ, পৃ. ১) – পূর্বাপর আলোচনায় প্রশ্ন থাকার কথা গুরুত্ব পায় না।
অদ্বৈতপ্রকাশের প্রমাণিকতা নিয়ে যে প্রশ্নাবলি উত্থাপিত হয়েছে তার একটি হল গৌরমন্ত্রের সুকৌশল অনুপ্রবেশ। এবিষয়ে পূর্বেই কিছু আলোচনা উত্থাপিত হয়েছে। বিতর্ক আজও চলছে। বিতর্কের অবসান হয়নি। তবে শুধুমাত্র সুকৌশলে গৌরমন্ত্র চালিয়ে দেবার জন্য একশো পাঁচ পাতার একটি চরিতকথা লেখার প্রয়োজন পড়ল! ভাবলেই আশ্চর্য হতে হয়। দশাক্ষর, চতুরাক্ষর, গৌরমন্ত্র, গৌরগোপালমন্ত্র, গৌরপারম্যবাদ প্রভৃতি প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। অনেকে ‘….কৃষ্ণ অপেক্ষা গৌরাঙ্গকে অধিক ভক্তি করেন ও অনেকে কৃষ্ণমন্ত্রের পরিবর্তে গৌরমন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই মতে শ্রীগৌরাঙ্গমহাপ্রভুর পৃথক ধ্যান ও মন্ত্রে উপাসনা ও তদীয় জন্ম তিথিতে উপবাস-ব্যবস্থা আছে। … প্রথম প্রথম গৌরাঙ্গবাদ ঢাকা, শ্রীহট্টাদি দেশে হীন শূদ্রাদি মধ্যে প্রচারিত হয়।’ ‘বৈষ্ণবসাহিত্য’। রাসবিহারী সাংখ্যতীর্থ। বিমানবিহারী। ৪৬০
যে ‘নবদ্বীপ হেন গ্রাম ত্রিভুবনে নাঞি’, যে ‘নবদ্বীপে বৈসে বৈষ্ণবাগ্রগণ্য/অদ্বৈত আচার্য’, সেই নবদ্বীপে কোন মত, পথ ও মন্ত্রে বৈষ্ণবগণ জপাদি করতেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা প্রাসঙ্গিক। ‘যে দেশ হরিনামশূন্য’, যে দেশ ‘কৃষ্ণনাম-ভক্তিশূন্য’, যে দেশে ‘ধৰ্ম্মকৰ্ম্ম লোক, সভে এইমাত্র জানে।/মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।। সেই দেশে শ্রীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্বে কোন মন্ত্রে বৈষ্ণবগণ আশ্রয় পেতেন সে বিষয়েও প্রশ্ন স্বাভাবিক। মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পঞ্চাশ বছর পূর্বে অদ্বৈত আচার্য প্রকট হন। প্রাক্-যৌবনে নবদ্বীপ আসেন গৌরলীলার পট-প্রস্তুতকারী এই বৈষ্ণবচার্য। ঈশান স্পষ্টই বলেছেন অদ্বৈত ‘দয়া করি মায়ে দিলা কৃষ্ণমন্ত্র।’ অতঃপর ঈশানকে ‘হরিনাম দিয়া করিলা পবিত্র।’ এই ঘটনা চোদ্দশো উনিশ শকের। গৌরাঙ্গ প্রকট হন ‘চোদ্দশত সাত শকের ফাল্গুনী পূর্ণিমা।’ জন্মের পর স্তন্যপান না করার কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে মন্ত্র বিস্মরণ। মন্ত্র বলতে ‘চতুরাক্ষর শ্রীগৌরগোপাল মহামন্ত্র!’ গৌরাঙ্গের আবির্ভাবের পূর্বে প্রদত্ত এই গৌরগোপালমন্ত্র হেমাভ গোপালমন্ত্র বলেই প্রত্যয় হয়।
বিমানবিহারী মজুমদারের এই প্রসঙ্গে উক্তি তুলে ধরা যাক :
অদ্বৈত-প্রকাশের” স্বপক্ষীয়গণ হয়ত বলিবেন যে গৌরগোপাল-মহামন্ত্র মানে গৌরমন্ত্র নহে। যদি গৌরমন্ত্র হয় তাহা হইলে পিতামাতার সম্বন্ধ থাকে না, “শুদ্ধ বাৎসল্য ভাবের ব্যাঘাত হয়। অদ্বৈতপ্রভু হেমাভ গোপালের মন্ত্রে শচী-জগন্নাথকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। “যদি বল মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীশিবানন্দ সেন চতুরক্ষর বালগোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন, মন্মথবীজ পুটিত কৃষ্ণরূপ চতুরক্ষর বালগোপাল মন্ত্রকেই চরিতামৃত গ্রন্থে গৌরগোপাল মন্ত্র নামে উক্ত করিয়াছেন। ঐ মন্ত্রের প্রতিপাদ্য শ্রীবালগোপাল দেবের ধ্যানে হেমাভ শব্দ থাকাতেই ঐ মন্ত্র গৌরগোপাল মন্ত্র নামে অভিহিত হইয়াছে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদগণের মধ্যে অনেকে বালগোপালের উপাসক ছিলেন।
চৈতন্যমতবোধিনী, ৪০০, আষাঢ়, ১/৭, পৃ. ১৫২
মহাপ্রভুর আবির্ভাবের অর্ধশতাব্দী পূর্বে ঠিক কোন মন্ত্রে বঙ্গসমাজ বিষ্ণুর উপাসনা করতেন, সে নিয়ে মতভেদ আছে। দক্ষিণী বৈষ্ণবসমাজ, মুখ্যত আচার্য শঙ্কর, আচার্য রামানুজ, শ্রী নিম্বার্ক, শ্রীমধ্ব, শ্রীবল্লভ প্রমুখ যে মতাদি পোষণ ও পরিবেশন করেছেন তার সঙ্গে চৈতন্যপূর্ব বঙ্গীয় বৈষ্ণব-ধারনার মিল খোঁজা সমিচীন হবে না। চৈতন্যভাগবতে বৃন্দাবনদাস উল্লেখ করেছেন, বঙ্গের ভক্তিরসের আদি রূপকার মাধবেন্দ্রপুরী। যথা-
ভক্তিরসে আদি মাধবেন্দ্র সূত্রধার।
গৌরচন্দ্র ইহা কহিয়াছেন বারবার।।—চৈ.ভা.। আদি, ৬
এই মতেরই অনুগামী কবিরাজ গোস্বামী। যথা-
জয় জয় মাধবপুরী কৃষ্ণপ্রেমপুর।
ভক্তিকল্পতরুর তিঁহো প্রথম অঙ্কুর।।—চৈ.চ.। আদি, ৯
মাধবেন্দ্রপুরী বাঙালি। ‘ভক্তিকল্পতরুর’ ‘প্রথম অঙ্কুর’ এই বঙ্গীয় সাধকের সম্পর্কে নিত্যানন্দ দাস প্রেমবিলাসে লিখেছেন, শ্রীহট্ট জেলার পূর্ণিপাট গ্রামে ব্রাহ্মণবংশে মাধবেন্দ্রপুরীর জন্ম। ‘পরে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে যায় ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন। বেদান্তী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী হয়েও বাৎসল্যভাব অবলম্বন করে ভক্তিধারার প্রধান দিশারী ছিলেন। তিনি মথুরায় স্তূপ খুঁড়ে প্রাচীন মূর্তি উদ্ধার করে কৃষ্ণগোপালের পূজা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে চৈতন্যের জন্মের কিছুকাল আগে থেকে বালগোপালের উপাসনা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। তাঁর ছাত্র শিষ্য ও অনুরাগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অদ্বৈতআচার্য, ঈশ্বরপুরী, শ্রীবাস পণ্ডিত ও পুণ্ড্ররিক বিদ্যানিধি।’ অদ্বৈতের সম্পর্কে বৃন্দাবনদাস বলেছেন : মাধবেন্দ্ৰ অদ্বৈতে যদ্যপি ভেদ নাঞি। তথাপি তাঁহার শিষ্য অদ্বৈতগোসাঞি। (চৈতন্যভাগবত/অন্ত্য/৪)। চতুরাক্ষর-দশাক্ষর যে মন্ত্রের কথাই বলা হোক, তার সঙ্গে বালগোপাল (গৌরগোপাল?) মন্ত্রের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক মাধবেন্দ্রপুরীর অভিজ্ঞানে।
‘ভক্তিহীন ধর্মাচরণ’ মুখরিত বাংলাদেশে তখন আচরণ বলতে ‘মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।।/দেবতা জানেন সবে ষষ্ঠী বিষহরি।’ নবদ্বীপ-কাটোয়ায় গঙ্গার ঘাটে ঘাটে তখন মঙ্গলচণ্ডী, ষষ্ঠী, মনসা, ওলাইচণ্ডী, তান্ত্রিকদের ধর্মপ্রকাশের ছড়াছড়ি। চৈতন্যজন্মের বহু আগে মাধবেন্দ্র ও অদ্বৈতকে যে সংগ্রাম করে চৈতন্যপ্রকাশের পাদপীঠ প্রস্তুত করতে হচ্ছিল তা সাধারণ্যে অসম্ভব। বঙ্গে, মূলত: নদীয়ায় তখন যে মতগুলি প্ৰকট :
ক) বৌদ্ধ তন্ত্র ও লোকাচার। তন্ত্রের নামে অনেক সময় যুক্তিহীন তত্ত্বহীন আচারসর্বস্বতা। মহাযান, বজ্রযান, সহজবাদের প্রভাব কমে এলেও অপ্রকট নয়। চর্যাচর্যনিনিশ্চয়ে বিধৃত। উপনিষদের ‘আনন্দ ব্রহ্মেতি ব্যাজানাৎ’ সরে গিয়ে ‘মহাসুখবাদ’ জায়গা করে নিচ্ছে। যথা ‘জয়তি সুখরাজ এষ কারণরহিতে জগতাং। যস্য চ নিগদনসময়ে বচনদরিদ্র বভুব সর্বজ্ঞ।। পূর্ণতার (পূর্ণমদং…) স্থলে শূন্যময়। ভৈরব, দেহতত্বা যোগ-যোগিনী। চক্র-পদ্ম-মূলাধার-কায়-অঙ্গ।
খ) শক্তিউপাসনা ও লোকদেবতার আচার বিচার। ‘পঞ্চমকার সাধনা, শ্রীবিদ্যা অনুশীলন, ষটকর্ম ইত্যাদি লোকনীয় ব্যাপারের প্রতি সাধারণ লোকে আকৃষ্ট তো হইবেই।’ ‘কুলার্ণব তন্ত্রের এই শ্লোকটি সাধারণ লোকের মনে কোন্ ভাব জাগাত তা সহজেই অনুমেয় :
‘অ্যামিসাসব-সৌরভহীনং যস্যা মুখং ভবেৎ।
প্রায়শ্চিত্তী স বৰ্জ্জাশ্চ পশুবে ন সংশয়।।’ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়/খণ্ড-২/পৃ ২৮
অর্থাৎ যার মুখে মদ-মাংসের গন্ধ নাই, সে প্রায়শ্চিতের ও বর্জনের যোগ্য। সে সাক্ষাৎ পশু। এর পরে ছিল পঞ্চমকার–মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। এই আচারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণসমাজ দিদিশারী স্বরূপ।
গ) শুধুমাত্র লোকাচারসর্বস্ব প্রায় ধর্মহীন নিম্নবর্গীয় শূদ্রাদির জীবনচর্চা;
ঘ) ইসলামের প্রভাব। জাতিভেদহীন, নিরাকারের উপাসনা করলে অন্তত সামাজিক-আর্থিক স্বাচ্ছন্দ ও পুনধাসন সম্ভব;
ঙ) রঘুনন্দন-কৃত ‘অষ্টবিংশতিতত্ত্বের’ তথা স্মৃতির সুকঠোর বাঁধন—শুদ্ধিতত্ব, প্রায়শ্চিত্ব প্রভৃতি বিধানে সমাজে দ্বিমুখী ফল। স্মৃতিশাসিত ও তন্ত্রাচারী মানুষের বৃহৎ অংশ বৈষ্ণবভাবাদর্শকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ ছিলেন। অবশ্য ‘বৈষ্ণবসমাজের এই যে অংশ স্মৃতির শাসন, দার্শনিক প্রত্যয়, শুদ্ধ যতিজীবনের আদর্শ, ভাগবতাশ্রয়ী ভক্তিধর্ম—ইহাদের মূলে ছিল ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতির প্রভাব।’ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়/২/২৬
অন্যদিকে ‘কৌলাচার ও সহজিয়া মতের প্রভাবে বৈষ্ণবমতের উপর কোথাও কোথাও তন্ত্রের প্রভাব পড়িয়াছে।’ তদেব/২৯
আর একটি সাধারণ বিতর্কিত উল্লেখ্য। বঙ্গদেশে যখন শ্রীমদ্ভাগবতের প্রারম্ভিক চর্চা শুরু হয়, সাধারণ হিন্দুসমাজে তার ফল হয় দ্বিবিধ। মহাভারতের গল্প, গীতার ‘ধর্মসংস্থাপনার্থায়’ ইত্যাদিতে সাধারণের আগ্রহ থাকলেও ভাগবতে সমকালীন বঙ্গসমাজ প্রথমদিকে (অদ্যাবধি) তেমন উৎসাহ দেখাননি। তার একটাই কারণ, হিন্দুধর্মে বহু ঈশ্বরবাদের ধারণাটি ক্রমেই পুষ্ট হয়েছে। ভাগবতে ভগবান একজনই, স্বয়ং বিষ্ণু/কৃষ্ণ। আর কেউ ভগবান নন। শিবাদি দেবগণ আছে, নরসিংহাদি অবতারগণও আছেন। কিন্তু ভগবানের অবস্থান প্রশ্নাতীত। এখান থেকেই উদ্ভূত হবে অবতার-অবতারীতত্ত্ব। গ্রিক-রোমান দেবগণের একটা গণতান্ত্রিক অবস্থান আছে। হিন্দুদেবদেবীরও দপ্তর বিভাজিত। শিব-দুর্গা-কালী-কৃষ্ণ-মনসা-ষষ্ঠী—সকলকে মোটামুটি স্থান দিয়ে ‘বহুরূপ’ তত্বটিকে মান্যতা দিতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু ‘ভগবান’ বলতে একমাত্র বিষ্ণু/কৃষ্ণ, এই তত্ত্ব মানতে বৈষ্ণবাদি বাকি সমাজ অদ্যাপি নারাজ। শিবকে যখন পরম বৈষ্ণব বলা হল, অথবা দেবকীগর্ভে আবির্ভাবে মহামায়াকে যখন শ্রীকৃষ্ণ শর্তাধীন আবির্ভাবের কথা বললেন—শৈব ও শাক্তসমাজ সহজে মানতে পারেন নি। ভাগবতের দশম স্কন্দের রাসলীলা পর্বে ‘….যোগামায়ামুপাশ্রিতা’ পশ্য।
পরম ভাগবত অদ্বৈত ‘ধর্মীয় ও সামাজিক অবক্ষয় দেখে’ স্থির থাকতে পারেন নি। ‘প্রবলভাবে উদ্বিগ্ন অদ্বৈত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ‘ধর্মসংস্থাপনার্থায়’ ঈশ্বরের পুনরায় আবির্ভাব ঘটবে। সম্ভবত বালগোপালের উপাসক হিসাবে নবদ্বীপের বালকদের ভেতর তাই অপ্রাকৃত গুণ সম্পন্ন কোন বালকের সন্ধান মেলে কিনা, এ ব্যাপারে তাঁর অপরিসীম আগ্রহ ছিল।’ বাণীপ্রসাদ মিশ্ৰ/৬১
বালক গৌরকে বালগোপাল রূপে ভজন করার মধ্যে অপ্রাকৃত কিছু মেলে না। ‘অদ্বৈতাচার্যই প্রথম চৈতন্যকে অবতার বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন এবং ভক্তদের নিয়ে সর্বপ্রথম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সংকীর্তন’ করেন। তদেব/৬৫। চৈতন্যভাগবতে বৃন্দাবনদাস বলছেন ‘শ্রীচৈতন্যনারায়ণ’। প্রথমদিকে গৌরাঙ্গ ‘নবদ্বীপে অদ্বৈতের সামনে নিজেকে ঈশ্বরের অবতার বলে প্রকাশ’ করেছিলেন। নিজেই ভক্তদের বলেছিলেন,
‘…..সভে অদ্বৈতেরে বল ধরি।
গায়েন নিৰ্ভয় হৈয়া চৈতন্য শ্রীহরি।’ চৈ.ভা/অন্ত্য-১০
সেই তিনিই আবার নিজেকে ‘কৃষ্ণ-অবতার’ বললে নীলাচলে বিরক্ত হয়েছেন,
‘কৃষ্ণ কেনে দরশন দিবেন কলিকালে।
নিজ ভ্রমে মূর্খলোক করে কোলাহলে।।’ চৈ.চ/মধ্য-১৮
অদ্বৈত গৌরাঙ্গের প্রথম ভাবকেই গ্রহণ করেন। চৈতন্যের প্রতিবাদকে স-জ্ঞানে সরিয়ে রাখলেন। ‘কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গপাঙ্গস্ত্র পার্ষদম’ অথবা মহাভারতের ‘সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গ বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী’ ইত্যাকার শ্লোকাবলি অদ্বৈতাদি বৈষ্ণবদের দৃঢ় করাই স্বাভাবিক। কৃষ্ণদাস আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, জগন্নাথ কৃষ্ণের আত্মস্বরূপ। কিন্তু দারুব্রহ্মে তিনি স্থাবর। আর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ‘সব লোক নিস্তারিল জঙ্গমব্রহ্ম হইয়া।’ চৈ.চ./অন্ত্য ৫
সেই ‘জঙ্গমব্ৰহ্ম’ চৈতন্যের পূজা পদ্ধতির বিধান দিচ্ছেন অদ্বৈত :
তেঁই গোপালের দশাক্ষরী মন্ত্র ধ্যানে।
মহাপ্রভুর পূজা হৈব কহিনু সন্ধানে।।’ অ.প্র./২০
শ্রীজগদীশচরিত্রবিজয় : দশমবর্ণে উল্লেখ আছে :
‘আমি এক গৌর আর এ গৌরগোপাল।’ বাণীপ্রসাদ, ৮৩
চৈতন্য-উপাসনার তিনটি ধারার বিবরণ নিম্নরূপ :
‘বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর চৈতন্য উপাসনা দয়িতের কাছে দয়িতার আত্মসমর্পণ, গৌরীদাস পণ্ডিতের পূজা সখ্যভাবে, আর জগদীশের গৌরগোপাল বাৎসল্যরসে আপ্লুত।’ তদেব, ৮৪
রমাকান্ত চক্রবর্তী পরবর্তিকালের গৌর-ভজনার বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন :
চৈতন্যের মৃত্যুর পরে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপকভাবে চৈতন্যপূজন প্রচারিত হয়েছিল। তার প্রধান ধারাগুলি ছিল নিত্যানন্দ প্রবর্তিত ‘সখ্য’ ভাবমূলক চৈতন্যপূজা, নরহরি সরকার প্রবর্তিত ‘নাগর’ ভাবে গৌরাঙ্গের উপাসনা; চৈতন্যের এবং গদাধর পণ্ডিতের রাধাকৃষ্ণের অবতার রূপে পূজা এবং কাশীর প্রবোধানন্দ সরস্বতীর ‘পরমদেব’ রূপে গৌরপূজা।
—রমাকান্ত চক্রবর্তী, পৃ. ২০৬
চৈতন্যদেব অপ্রকটের প্রায় দুশো বছর পর নদীয়ায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰ ( ১৭২৮-৮২) এবং মহারাজ গিরীশচন্দ্র (১৭৮২-১৮৪২) গৌর-ভজনাসহ বৈষ্ণব সমাজের সাধনভজন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। অদ্বৈত অনুগামী ও অন্যান্য গৌরভক্তগণকে লুকিয়েচুরিয়ে গৌরবন্দনা করতে হত। কয়েকজন রাজানুগত্যের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে কিছু আপোসে রাজি হন। কৃষ্ণচন্দ্রের বংশের জীবনীকার তথা বাংলাভাষায় প্রথম ইতিহাস রচয়িতা হিসাবে বিবেচিত, দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, পোষ্টা মহারাজের মতই, বৈষ্ণবধর্ম ও চৈতন্যদেব সম্পর্কে যথেষ্ট বিরূপতা পোষণ করেছেন :
চৈতন্যের জন্মের পূর্ব্বে বঙ্গদেশবাসীদিগের মধ্যে অত্যল্প লোক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ছিলেন (অদ্বৈতআচার্য ও শ্রীনিবাস প্রভৃতি ভক্তগণ)। ইদানিং তাঁহাদিগের তৃতীয়াংশ বৈষ্ণব হইয়াছেন। কিন্তু যে উৎকৃষ্ট ফলোদ্দেশে চৈতন্য এই ধর্মবিস্তার করণে এত যত্ন করিয়াছিলেন, সে ফল উৎপন্ন হয় নাই।
—ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত।৪২
কার্তিকেয়চন্দ্রের মন্তব্য বহুস্থলে বৈষ্ণবসমাজের প্রতি বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে, ‘যে সকল দোষ দর্শনে, চৈতন্যের শাক্ত ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মে, সেই সকল দোষ ইহাদিগের মধ্যে বহুল পরিমাণে রহিয়াছে, এবং এ ধর্ম ব্যভিচার দোষের একপ্রকার আশ্রয়স্থল হইয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ….নবদ্বীপের রাজা বা পণ্ডিতগণ চৈতন্যকে অবতারের মধ্যে কখন গণ্য করেন নাই।’ তদেব।
গণ্য তো করেন নাই, বরং চৈতন্যপূজন যাতে নিষিদ্ধ হয় সে বিষয়ে তৎপর ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে বহু বৈষ্ণব, চৈতন্যপরিবারের বংশধরগণ স্বধাম নবদ্বীপ ত্যাগ করে বাংলার নানা প্রান্তে পালিয়ে যান। পরে শ্রীপাটের নব ধারণা, পদ্ধতি, উপচারে কৃষ্ণ-গৌর উপাসনা শুরু হয়। গৌরপারম্যবাদ অস্বীকৃত হলে গৌরপূজনও রাজাধিকারে অস্বীকৃত হয়। গৌরবিষয়ক বহু গ্রন্থাদি লুকিয়ে ফেলা হয়। বিনষ্ট হয়। অর্ধলুপ্ত-অর্ধলুপ্ত হয়। শুধুমাত্র বিগ্রহ, শালগ্রাম ও পুঁথি নিয়ে দেশত্যাগ করেন অনেকানেক বৈষ্ণব। বঙ্গদেশে অনেক শ্রীপাটের জন্ম নয়।
‘শ্রীচৈতন্য মাধব সম্প্রদায়-ভুক্ত ছিলেন কিনা’ এবিষয়ে বিমানবিহারী মজুমদার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে দেখা যায় শ্রীচৈতন্য মাধ্ব ও তত্ত্ববাদীদের সহিত বিচার করিয়াছিলেন, অথচ গৌরগণোদ্দেশদীপিকায় শ্রীচৈতন্যকে মাধ্ব সম্প্রদায়ভুক্ত বলা হইয়াছে। ঈশান বলিতেছেন, অদ্বৈত তীর্থভ্রমণ কালে “মধ্বাচার্যস্থানে” মাধবেন্দ্রপুরীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন ও তাঁহার নিকট শ্রীমদ্ভাগবত ও মাধ্বভাষ্য পাঠ করিয়াছিলেন। ঈশানের কথাকে প্রামাণিক মনে করিলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে মাধ্বসম্প্রদায়ের শাখা বলিতেই হইবে।’ বিমানবিহারী, ৪৪০
ড. রমা বসু লিখেছেন, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের হরিব্যাসদেবজী মাধ্ব এবং চৈতন্য দর্শনের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। দুটি ‘ভিন্নধর্মী’ মতের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যুক্তি হৃদয়গ্রাহ্য হয় না। ড. বসু বলছেন,
Harivyasadeva was deeply influenced by the Madhva and Chaitanya school of thought. -Doctrines of Nimbarka & his followes. Dr. Rama Bosu, Vol-III, P.P. 133-40
আচার্য রাধাকৃষ্ণণ আবার গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মত ও পথ সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারার কথা বললেন,
Though some of the writers belonging to this school call themselves the followers of Madhva, in their thought they are nearer to Ramanuja, since they emphasise identically, even when they admit differences.
Radhakrishnan : Indian Philosophy, Vol – II, P. 764
রামানুজ থেকে বল্লভাচার্য পর্যন্ত বৈদান্তিক বৈষ্ণবধারা অনেকাংশে রূপান্তরভেদে শ্রীচৈতন্যের মতবাদে সংযুক্ত হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অচিন্ত্যভেদাভেদতত্বের সঙ্গে শ্রী নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্তের নানাবিধ মিল লক্ষ্যণীয়। এদিক দিয়ে দেখলে শ্রীমধ্বের বিষ্ণু-পারম্যবাদ গৌড়ীয় শ্রীচৈতন্যের ভক্তিবাদ থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলা কতটা যৌক্তিক সে বিষয়ে সংশয় থাকবেই। যদি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে মহাভারত ও শ্রীমদভাগবতের রূপকার হিসাবে ধরা হয়, ব্যাসপুত্র শুকদেবের উত্তর ও হস্তিনাধিপতি পরীক্ষিতের প্রশ্নাবলিকে যদি যৌক্তিক মনে হয় তাহলে সংশয়ের কথঞ্চিৎ নিরসন হতে পারে। শ্রীমধ্ব মহাভারতকে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র বলে মানতেন। চৈতন্য শ্রীমদভাগবতকে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র বলে মানলেও মহাভারত সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিশেষত সন্ন্যাস গ্রহণের আগের পর্বে। মধ্ব শ্রীরাধা সহ গোপীদের ভক্তিকে গুরুত্ব দেন নি। ব্রহ্মাকেই শ্রেষ্ঠ বিষ্ণুভক্ত বলে দেখিয়েছেন। অন্যদিকে চৈতন্যের মত, ব্রজগোপীগণই শ্রেষ্ঠ ভক্ত। শ্রীমদ্ভাগবতের, মূলত: দশম স্কন্ধের (ভাগবতের বৃহত্তম স্কন্ধ, নব্বইটি অধ্যায় আছে) তন্বিষ্ঠ পাঠক ও গুণগ্রাহী ছিলেন মহাপ্রভু। এছাড়া মধ্বের বিষ্ণুপারম্য, সর্বাবতারবাদ, সকাম ভক্তি, দাস্যানুভব, ঐশ্বর্যপ্রাধান্য ইত্যাদির সঙ্গে চৈতন্যের শ্রীকৃষ্ণপারম্য, কৃষ্ণের পূর্ণাবতারত্ব (তিনি একমাত্র ভগবান, অবতারগণ তাঁর অংশ বিশেষ), শুদ্ধাভক্তি, দাস্য-শান্ত-সখ্য-বাৎসল্য-মধুর—সকল ভক্তিই গ্রহণীয়, মাধুৰ্য্যপ্রাধান্য ইত্যাদি আপাত: পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়। যে বিষয়টি দুই মতবাদের মূল বাধা হিসাবে পরিগণিত হতে পারে তা হল, মধ্ব বিশ্বাস করতেন জ্ঞান, চর্চা, অনুশীলন সবই উচ্চবর্ণের ও প্রজ্ঞাশীলের সম্পদ। বিষ্ণুকৃপা লাভের প্রধান সোপান। চৈতন্য যে কারণে দেশব্যাপী আন্দোলনে উত্তাল করতে পেরেছিলেন, তা হল অচণ্ডালে নাম বিতরণ। ‘হরেনার্স হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম।’ উত্তরকালে এক সাধিকার কন্ঠে এই সুর শোনা যাবে, “বিনা প্রেমসে না মিলে নন্দলালা।’ সব তত্ত্বকে ছাপিয়ে ভক্তিধারায় শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে উঠবে প্রেম মধুররসের আকর। দ্বারকাধিপতির থেকে ব্রজেশ্বর, রুক্মিনীপতির থেকে রাধামাধব একাধারে শ্রেয় এবং প্রিয় হয়ে উঠবেন। শোনা যায়, ব্রজাঙ্গনাকাব্য পাঠ করার সময় আধা-সাহেব মাইকেল মধুসূদন যখন বলতেন ‘গোপীভর্তুবিরহবিধুরাউন্মত্তেব’—তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠত।
.
ঈশাননাগরের “মধ্বচার্য্যস্থানে” রহস্যের সমাধাসূত্র কিছুটা পাওয়া গেলেও সন্দেহের নিরসন হল না।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের মতে অদ্বৈত মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে মন্ত্রপ্রাপ্ত হন। যথা-
শান্তিপুর আইল অদ্বৈতাচার্যের ঘরে।
পুরীর প্রেম দেখি আচার্য আনন্দ অন্তরে।।
তাঁর ঠাঞি মন্ত্র লৈল যতন করিয়া।
চলিলা দক্ষিণে পুরী তাঁরে দীক্ষা দিয়া।—চৈতন্যচরিতামৃত। মধ্য। ১৮২
ঈশানও লিখছেন,
তবে লোক শিক্ষাইতে প্রভু সযতনে।
কৃষ্ণ-রাজ মন্ত্র কৈল পুরীরাজ স্থানে।। অ.প্র./১৮
গৌরাঙ্গ ‘প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবভক্ত ঈশ্বরপুরীর নিকট দশাক্ষর গোপালমন্ত্র নিলেন, ভক্তি-ভাবে উন্মত্ত হয়ে গৃহে ফিরলেন—কৃষ্ণপ্রেম তাঁকে (গৌরাঙ্গকে) প্রবলভাবে কোন দিগন্তে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।’ বাংলাসাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ৭৯
মাধবেন্দ্রপুরী ঈশ্বরপুরীর গুরু। অদ্বৈতের গুরু মাধবেন্দ্র। চৈতন্যের গুরু ঈশ্বরপুরী। পরে ‘অবৈষ্ণব হিন্দুসমাজের প্রবল বাধার সামনে সিদ্ধান্ত করলেন এবং মাতা ও পত্নীকে ত্যাগ করে কাটোয়ায় গিয়ে কেশবভারতী নামক প্রসিদ্ধ আচার্যের কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিলেন। তদেব, পৃ. ৮০।
পুরী, তীর্থ, আচার্য, ভারতী—ইত্যাদি উপাধিগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পরিচয়বাহী। পুরী ও ভারতী শ্রীশঙ্কর প্রবর্তিত দুইটি দশনামী সম্প্রদায়।’ সুধীররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। পৃ. ১২২
এদিকে দেখলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ মাধবেন্দ্রপুরীর দর্শন ও মতের অনুগামী হওয়াই বাঞ্চনীয়। শ্রীমধ্বের চিন্তন ও দর্শনের সঙ্গে এই মতের সাযুজ্য কম। প্রথমত, ‘মধ্বাচার্যের সন্ন্যাসী শিষ্য সকলেই ছিলেন ‘তীর্থ’ উপাধিকারী। তাঁহার গৃহস্থ শিষ্যদের উপাধি হইত ‘আচার্য’তে।’ সুধীররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, ১১৯
দ্বিতীয়ত, মধ্বের পঞ্চবিধ ভেদ-তত্ত্ব প্রসঙ্গত স্মর্তব্য। মধ্ব জীব, জগৎ ও ব্রহ্ম সম্পর্কে পাঁচটি ভেদের কথা বলেছেন, ক) জীব ও ঈশ্বরে ভেদ। খ) এক জীব থেকে অন্য জীবের ভেদ। গ) ঈশ্বর ও জড়ের মধ্যে ভেদ। ঘ) জীব ও জড়ের মধ্যে ভেদ। ঙ) জড় ও জড়ের মধ্যে পারস্পরিক ভেদ। এই পাঁচটি ভেদের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মধ্বমতকে ‘দ্বৈতবাদ’ বা নামান্তরে ‘স্বতন্ত্রাস্বতন্ত্রবাদ’ নামে পরিচিত।
মধ্বের “দ্বৈতাবাদের প্রেক্ষিতে অন্যান্য মতাদর্শ নিম্নরূপ :
আচার্য শঙ্কর : অদ্বৈতবাদ বা কেবলাদ্বৈতবাদ
আচার্য রামানুজ : বিশিষ্ট + অদ্বৈতবাদ
আচার্য নিম্বার্ক : দ্বৈত + অদ্বৈতবাদ
বল্লভাচার্য : শুদ্ধ + অদ্বৈতবাদ
বলদেব প্রমুখ গৌড়ীয় বৈষ্ণবের : অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদ বা অচিন্ত্যদ্বৈত+অদ্বৈতবাদ।’ সুধীররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, ১১৩
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ মধ্ব সম্প্রদায়ভুক্ত কিনা এই বিভ্রান্তি দীর্ঘদিনের। শ্রীমন্মহাপ্রভু তাঁর কথা বা রচনায় (যথা শিক্ষাষ্টক) কোথাও নিজেকে পূর্বাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলেন নি বলেই প্রত্যয় হয়। যত কিছু বিতর্কের সূত্রপাত মহাপ্রভুর অপ্রকটের পর, যখন বহুধা শাখায় বিস্তৃত হয় বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজ। মন্ত্র নিয়ে কিছু বিসম্বাদ থাকলেও পন্থা নিয়ে বা সম্প্রদায় নিয়ে বিশেষ বিতর্ক ছিল না। কবি কর্ণপুর ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ নাটকে শ্রীচৈতন্যকল্পতরুর একটি অনুপম চিত্র এঁকেছেন :
আচার্যো যস্য কন্দো যতিমুকুটমণিমাধবাখ্যো মুনীন্দ্ৰঃ।
শ্রীলাদ্বৈত: প্ররোহস্ত্রিভুবনাবিদিতঃ স্কন্ধ এবাবধূত :
শ্রীমদবক্রেশ্বরাদ্যা রসময়বপুষঃ স্কন্ধ শাখা-স্বরূপা। বিস্তারো ভক্তি-যোগঃ কুসুমথফলং প্রেমনিষ্কৈতবং যৎ।।
—শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়। ১।৬-৮
সংক্ষেপে, মাধবেন্দ্র যে বৃক্ষের মূল, অদ্বৈত যার অঙ্কুর, নিত্যানন্দ যার স্কন্ধ, বক্রেশ্বর আদি মহাজনগণ যার শাখা-প্রশাখা ভক্তি যার ফুল, অকৈতব প্রেম যার ফলক সেই চৈতন্যকল্পতরু পৃথিবীতে প্রতিভাত হয়েছে।
এই শ্লোকটি পড়লে কোন সংশয় থাকার কথা নয়। থাকলে ঈশানের ‘মাধ্বচার্য্যস্থানে’ বিষয়ক তথ্য জটিলতর হয়ে ওঠে। মাধবেন্দ্র ও মাধ্ব নামের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে কী না বিচার করা যেতে পারে। তবে মধ্ব-মতে দীক্ষা নেওয়ার কোন সূত্র পাওয়া যায় না অদ্বৈতপ্রকাশে। মধ্ব প্রসঙ্গে ঈশানের বিবরণটুকু দেখা যাক।
কমলাক্ষ ‘ক্রমে বহুতীর্থ ক্ষেত্র ভ্রমণ করিলা।
তবে মাধবাচার্য স্থানে স্থানে প্রভু উত্তরিলা।।
মধ্বাচার্য সম্প্রদায়ী বহু সাধুগণ।
তাঁহা রহি করে ভক্তিরস আস্বাদন।। – অ.প্র. পৃ. ১১
দুটি বানান অপরিবর্তিত রাখা হল। পাঠকের সংশয় নিরসন হতে পারে।
শাণ্ডিল্য সুত্রে আর শ্রী নারদ সূত্রে।
ভক্তির ব্যাখ্যান করে প্রেমপূর্ণ চিত্তে।।
তাহা শুনি প্রভুর হৈল প্রেম উদ্দীপন।
ভক্তিদেবি দয়া কর বলে ঘনে ঘন।।
………………………………………
প্রেমভক্তির ঢেউ ক্রমে বাঢ়িয়া চলিল।
মূৰ্চ্ছিত হইহা প্রভু ভূমিতে পড়িল।।
তাহা দেখি মহোপাধ্যায় মাধবেন্দ্রপুরী।
কহে ইহ ভক্তিবর্তের উত্তমাধিকারী।।—তদেব। পৃ. ১১
কমলাক্ষ মাধবেন্দ্র স্থলে প্রেম ও শুদ্ধাভক্তিই প্রার্থনা করেছেন। প্রেমের বন্যায় সাধুদের ভেসে যেতেও দেখা গেল।
হরিনাম মহৌষধি কর্ণদ্বারে পিয়া।
ভক্তি দেহ বলি প্রভু বলে গর্জিয়া।।
প্রেম বন্যায় সাধু সব ভাসিতে লাগিলা।
প্রেমোল্লাসে কত ভাব প্রভু প্রকাশিলা।।
তবে কতক্ষণে তিঁহো মনস্থির কৈলা।
ভক্তি কল্পবৃক্ষ পুরীরাজে প্রণমিলা।। — তদেব, ১২
কবি কর্ণপুরের রচনায় মাধবেন্দ্রকে ‘কল্পবৃক্ষের’ মূল হিসাবে দেখেছি। ঈশানে ব্যতিক্রম নেই। এরপর দেখতে পাচ্ছি, কমলাক্ষ ‘শুদ্ধ প্রেম’’ভক্তিতত্ব’’শুদ্ধ প্রেমভক্তি’ প্রসাদ চাইছেন মাধবেন্দ্রর কাছে। শুদ্ধা ভক্তি ও প্রেম-মাধুর্য চৈতন্য মতানুগামী। মধ্বমতে সকাম ভক্তি, দাস্যভক্তি ও ঐশ্বর্যপ্রধান। মধ্বমতে ‘ব্রজগোপী অপেক্ষা (রুক্সিনী-জাম্ববতী-সত্যভামাদি) দ্বারকার অষ্ট মহিষী শ্রেষ্ঠা, মহিষীগণ হইতে শ্রী যশোদা, যশোদা হইতে শ্রী দেবকী, দেবকী হইতে শ্রী বসুদেব শ্রেষ্ঠ। বসুদেব হইতে অর্জুন শ্রেষ্ঠ, অর্জুন হইতে শ্রী বলরাম শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্রহ্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ।’ সুধীররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, পৃ ১২৪
মাধবেন্দ্র কমলাক্ষকে কী বলেছিলেন তার চুম্বক নিম্নরূপ :
শ্রীমদ্ভাগবত মাধ্বাচার্য-ভাষ্য আর।
প্রভুকে শুনায় পুরী করিয়া বিস্তার।’
…………………………………………..
এবে সাক্ষাৎ পরমব্রহ্মের আবির্ভাব বিনে।
অন্যদ্বারে জীবোদ্ধার নাহিক সুগমে।।
ধর্ম সংস্থাপন হেতু এই কলিযুগে।
স্বয়ং ভগবান প্রকট হইবেন অগ্রে।।
অনন্তসংহিতা যার সাক্ষী শ্রেষ্ঠতম।
মধ্যস্থ শ্রীভাগবত ভারত আগম।।
প্রভু কহে নন্দসুত ষড়ৈশ্বৰ্য্য পূৰ্ণ।
গৌররূপে নবদ্বীপে হৈব অবতীর্ণ।।— অপ্ৰ. ১২
বিমানবিহারী মজুমদার লিখেছেন, ‘ঈশান বলিতেছেন, অদ্বৈত তীর্থভ্রমণকালে ‘মধ্বাচার্য্য স্থানে মাধবেন্দ্রপুরীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন ও তাঁহার নিকট শ্রীমদ্ভাগবত ও মাধ্বভাষ্য পাঠ করিয়াছিলেন। ঈশানের কথা প্রামাণিক মনে করিলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে মাধব সম্প্রদায়ের শাখা বলিলেই হইবে।’ বিমানবিহারী, পৃ. ৪৪০
অদ্বৈতপ্রকাশের পূর্বোক্ত বিবরণ পাঠে অদ্বৈতকে বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজকে মাধ সম্প্রদায়ের শাখা বলা যায় কিনা এ বিষয়ে তর্ক উঠবে। অন্তত ঈশান এই মতের অনুকূলে কোন স্পষ্ট নির্দেশ দেন নি। দিলে বলতে পারতেন না,
গৌর মোর প্রাণপতি যাহা তারে পাঙ
বেদধৰ্ম্ম লঙ্ঘি মুই তাহা চলি যাঙ।—অ.প্র. ১২
সুধীররঞ্জন চট্টোপাধ্যায় মধ্ব-তর্কের উপর আলোকপাত করে লিখেছেন, ‘বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে, শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের অনেকেই নিজ সম্প্রদায়কে ‘মাধ্ব-গৌড়ীয়’ অথবা ‘ব্রহ্মমাধ্ব গৌড়ীয়’ সম্প্রদায় নামে পরিচয় প্রদান করেন। …. গৌড়ীয় বৈষ্ণবসম্প্রদায় প্রচার করেন। উৎকলবাসী শ্রীবলদেব চিল্কাহ্রদের অপর পারে কোন স্থানে ব্যকরণ ও অলঙ্কারাদি অধ্যয়ন পূর্বক ন্যায়শাস্ত্র ও বেদপাঠের পর মহীশুরে গিয়া বেদান্তপাঠ করেন।’ সুধীররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, ১২৭
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সঙ্গে মধ্বমতের যোগ নিয়ে একটি তথ্য প্রদত্ত হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোবিন্দপূজার অধিকারী ছিলেন ষট্-গোস্বামীর সময় থেকে। ম্লেচ্ছ ভয়ে শ্রীবৃন্দাবন থেকে বিগ্রহ রাজস্থানের জয়পুরে স্থানান্তরিত হয়। এখানেও পূজাধিকারী ছিলেন গোস্বামীয সমাজ। অষ্টাদশ শতকে বিতর্ক ওঠে, চার সম্প্রদায় ছাড়া কেউ গোবিন্দপূজার অধিকারী হতে পারেন না। যথা-পদ্মপুরাণে—
সম্প্রদায় বিহীনা যে মন্ত্রাস্তে বিফলা মতা:।
শ্রী-ব্রহ্ম-রুদ্র-সনকা বৈষ্ণবা ক্ষিতিপাবনা:।।
রামানুজং শ্রী স্বীচক্রে মধ্বাচার্যং চতুর্মুখ:।
শ্রী বিষ্ণুস্বামিনং রুদ্রো নিম্বাদিত্যং চতু:সন:।
চৈতন্য সম্প্রদায় যেহেতু এই চার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই গোবিন্দ-পূজনের অধিকারী হতে পারে না। এতদবিষয়ে এক বিতর্ক সভা আহুত হয়। সেই সভায় বলদেব বিদ্যাভূষণ ঘোষণা করেন, চৈতন্যপ্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ মধ্ব-সম্প্রদায়ভুক্ত। আপাতত: সংকটমুক্ত হলেও বিতর্কের অবসান হল না।
.
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নানা সময় উঠে এসেছে। সেটি হল ঈশানের জন্মস্থান, পরিচিতি এবং সম্বন্ধে প্রক্ষিপ্ত কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও তা প্রতুল নয়। আমি গত এক দশকে অন্তত পনের-ষোল বার শিলচর এবং বর্তমান সিলেটে গিয়ে তথ্যানুসন্ধানের চেষ্টা করি। একটি বিষয় খুব নাড়া দিয়েছিল। শ্রীহট্টের বর্তমান প্রজন্মের বৈষ্ণবগণ ‘চৈতন্য অপেক্ষা ‘নিমাই’কে ঘরের মানুষ বলে মনে করেন। শচীনন্দন গৌরসুন্দর তাঁদের খুব কাছের। এছাড়া জনমদুখিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্য তাঁদের বেদনার স্থলটি বড় কোমল। তাছাড়া, গৌর-এর শ্রীহট্টে আগমন তাঁদের কাছে এক মহান দিশা।
এতে অবশ্য ঈশান বিতর্কের অবসান হয় না। শ্রীহট্টীয় বৈষ্ণবগণ ও ইতিহাসবেত্তাগণ লাউড় ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেন।। ইতিহাসের দিক দিয়ে লাউড় ধ্বংসের বিবরণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্বীকৃত। আমরা এই প্রসঙ্গে আলোকপাত এবং অদ্বৈত-জন্মভূমি উদ্ধারের উল্লেখ করব।
লাউড় যে শ্রীহট্টে বিস্তৃত জনপদের মধ্যে অবস্থিত তার নাম বাণিয়াচঙ্গ। ‘নগরের নাম হইতে পরগণার নামকরণ হয়। …একসময় শ্রীহট্টের উত্তরসীমা হইতে দক্ষিণে ভেড়ামোহনা নদী পর্যন্ত স্থান ব্যাপী তাঁহাদের (বানিয়াচঙ্গের রাজাদের) রাজ্য ছিল। ….বর্তমানে বানিয়াচঙ্গ কসবা ও জোয়ার ভেদে দুইটি পরগণায় বিভক্ত হইয়াছে।’ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।৩।৩৯৪
অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির বর্ণনায় :
‘কেশব মিশ্র হইতে রাজা পদ্মনাভ পর্য্যন্ত সকলেই বাণিয়াচঙ্গে অবস্থিতি করিয়া নগরের সৌষ্টব বৃদ্ধি করেন। পদ্মনাভ ইহার মধ্যদেশে সুবৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করান ও রাজবাটী প্রস্তুত করেন। পদ্মনাভ ঐ বংশে দাতাকর্ণ ছিলেন, তিনি বাণিয়াচঙ্গে বহুতর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে স্থাপন করেন। কাত্যায়ন ব্যতীত জাতুকর্ণ ভরদ্বাজ ও কাশ্যপ প্রভৃতি গোত্রীয় বহুতর প্রধান বংশীয়গণ বাণিয়াচঙ্গে আছেন। গৌতম গোত্রীয়দের শিষ্য সম্পদ ঢাকা জিলা পৰ্যন্ত বিস্তৃত, ইহারা বলেন যে তাঁহারা রাজার গুরুবংশ। অনেকে অনুমান করেন তাহারা রাজার বৈদিক ক্রীয়া কলাপের ঋত্বিক ছিলেন, তাই আজিও শ্রাদ্ধকালে দব্বী উপহার পান। ইঁহাদের মধ্যেই মহাদেব পঞ্চানন প্রাদুর্ভূত হন, তাহার নামে বাণিয়াচঙ্গের যশ দেশ-দেশান্তর পর্য্যন্ত বিস্তারিত হইয়াছে। জাতুকর্ণ গোত্রীয় মুরারি বিশারদের নাম পূর্ব্বে করা গিয়াছে, সুসঙ্গ মহারাজের গুরু বাকলজোড়ের ভট্টাচার্য্যগণ বাণিয়াচঙ্গের এই জাতুকর্ণ বংশীয়। রাজার জামাতৃবংশ ভরদ্বাজ গোত্রীয় শততুজ মিশ্রের সন্ততিগণও বিশেষ মান্যস্পদ। তদ্ব্যতীত কাশ্যপ গোত্রীয় দ্বিজগণ এবং রাজার সেনাপতি চুরঙ্গ বংশ ও বিশেষ প্রতিষ্ঠিত। স্থলান্তরে ইঁহাদের বংশ বিবরণ বর্ণিত হইবে। প্রজাবর্গের জলকষ্ট নিবারণার্থে রাজা পদ্মনাভ সহস্রসংখ্যক দীর্ঘিকা খনন করিয়াছিলেন বলিয়া কথিত আছে। এই জনহিতকর কার্য্যের জন্যই তিনি সৰ্ব্বপ্রথম ‘খাঁ’ উপাধি প্রাপ্ত হন।
‘তৎপুত্র গোবিন্দ খাঁ, সমতল ক্ষেত্রে অবস্থিত নগরটিকে মোসলমান হইতে সুরক্ষিত করিবার জন্য ইহার চতুপার্শ্ব প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত করেন। তিনি বীরপুরুষ ছিলেন, রাজ্যবৃদ্ধির প্রতি তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। গোবিন্দ মহিষী বাণিয়াচঙ্গে পৃথক বাটী প্রস্তুত করত: বাস করেন, বলা গিয়াছে জাত্যন্তরিত হওয়ার পর রাজা বাণিয়াচঙ্গে অবস্থিতি করিতে ভাল বাসিতেন না, নিকটে থাকিয়া ধৰ্ম্ম পরায়ণা পত্নীর মন:কষ্ট বৃদ্ধি করিতে তাঁহার ইচ্ছা হইত না। তদবধি তিনি নবাধিকৃত লাউড়ের বাড়ীতেই অধিক সময় বাস করতেন; বিশেষ কার্য্য ব্যতীত বাণিয়াচঙ্গে আসিতেন না। পুত্র মজলিস পিতৃসন্নিধানেই বাস করিতেন, কাজেই তিনিও লাউড়বাসী ছিলেন।’ তদেব, ৩১৫
বণিয়াচঙ্গ ও লাউড়ের একটি দীর্ঘ বিবরণ পাওয়া গেল। এবার প্রশ্ন আসে ইতিহাসখ্যাত তথা পুণ্যভূমি লাউড়-এর কী হল? কোথায় হারিয়ে গেল তার ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক অবস্থান? দেশবিভাগের পূর্বে প্রকাশিত একটি মানচিত্র প্রাসঙ্গিক হিসাবে প্রদত্ত হল।
আবার আসছি অচ্যুতচরণের বিবরণে পাই। আমরা হাবিন খাঁ-র দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ আলম খাঁর পুত্র আনওয়ার খাঁ। ‘ইহার সময়ে এক আকস্মিক উৎপাতে লাউড় নগর বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত হয়। খাসিয়াপর্ব্বতের কয়েকটি রাজা (সর্দ্দার) একত্র মিলিত হইয়া লাউড় আক্রমণ করে। পঙ্গপালের ন্যায় বন্য খাসিয়া সৈন্য পৰ্ব্বত হইতে আপতিত হইল, মুহূর্তে পথ ঘাট ছাইয়া ফেলিল। যে অল্পসংখ্যক রাজসৈন্য ছিল, নিমেষের মধ্যে তাঁহাদের চিহ্ন লোপ পাইল। অধিবাসীদিগের যে যথায় পারিল, প্রাণ লইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাইল। তাহাদের পশুবৎ অত্যাচারে অবশিষ্ট বালবৃদ্ধ সকলেই নিহত হইল, লাউড় একরূপ জনশূন্য হইয়া পড়িল।
অদ্বৈতচার্য্যের বিষয় বর্ণনা করা গিয়াছে। অদ্বৈতাচার্য্য শ্রীহট্ট পরিত্যাগ করিয়া গেলেও তাঁহার জন্মগৃহ তদীয় ভক্তগণ ধ্বংসমুখে পতিত হইতে দেন নাই। এই খাসিয়া বিপ্লবের কালে আচার্য্যের পীঠরক্ষক নাগরবংশীয়গণ (ঈশানের উত্তরাধিকারী) পলাইয়া গোয়ালন্দের নিকটবর্তী ঝাকপাল গ্রামে চলিয়া যান, তদ্যাপি ঐ বংশীয়গণ তথায় অবস্থিতি করিতেছেন।
এইরূপে লাউড় একরূপ জনশূন্য হইয়া পড়িল—নবগ্রাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হইল এবং পাৰ্ব্বত্যভূমি বলিয়া অতি অল্পকাল মধ্যে জঙ্গলাবৃত হইয়া উঠিল। যে স্থানে পূর্ব্বে দিব্যসিংহ রাজত্ব করিয়াছেন, ব্যাঘ্র ভল্লুক এখন তথাকার রাজা; নাগরিকগণ নবভূষায় সজ্জিত হইয়া সগর্ব্বে যথায় ভ্রমণ করিত, এখন তাহা মৃগমাতঙ্গের বিচরণ ক্ষেত্র। জনকোলাহলের পরিবর্তে বিহঙ্গকলরবে সে স্থল এখন প্রতিধ্বনিত। জগতের বৈচিত্রই এই—সে উত্তর কোশলও নাই, সে দ্বারাবতীও নাই।’ তদেব, ৩৯৬
এই বিবরণের অনুকূলে তথ্য পাওয়া যায়,
‘In 1744 A.D.Laur was burned by the Khasis, and many of the people moved to Baniyachang’. Assam Dist. Gazetteers, Vol – III, (Sylhet), Chap. II, P. 25
ইতিহাসবিদ হান্টার পূর্বোক্ত মতের বিপরীত কথা বলেছেন। Statistical Ac- counts গ্রন্থে তাঁর মত ‘খ্রিষ্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গোবিন্দ খাঁর পৌত্র আবিদ রেজা লাউড় পরিত্যাগ করেন এবং বানিয়াচঙ্গ নগর নির্মাণ করেন।’ অন্য ইতিহাসবিদ গেইট সাহেবও এই মতের সমর্থন করেন ‘Hisotry of Assam’ গ্রন্থে। এই মতের (লাউড় থেকে বানিয়াচঙ্গ) তীব্র বিরোধিতা করেন পদ্মনাভ বিদ্যাবিনোদ। পূর্বের মতটি নিম্নরূপ :
The traditon current among the Hindoo families of Baniyachang is that Kasava Mishra, the Bramhin ancestor of Gobinda, came from north west and settelted at Banipachang and that his descendents grew in power they occupied Laur and built a residential fortess three to pre- vent Khasia raid. (Mr. Gait’s History of Assam – a critical study, P. 20)
এত করেও লাউড় রক্ষা করা যায় নি। খাসিয়া আক্রমণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ঈশানের পরিবারবর্গ প্রাণের তাগিদে নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। দলিল, নথিপত্র, জৈতসাদি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অন্যান্য বৈষ্ণব পরিবারেরও একই অবস্থা হয়। কোনক্রমে বিগ্ৰহ অথবা শালগ্রাম শিলা গলার গামছায় ঝুলিয়ে পালিয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের দিকে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লিখছেন :
‘যে লাউড় রাজ্য (পং লাউড় ও বাণিয়াচঙ্গে) পৌরাণিকযুগে ভগদত্ত নৃপতি কর্তৃক শাসিত হইয়াছিল, খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে যে দেশে বিজয়মাণিক্যের সিংহাসন স্থাপিত ছিল, দ্বিজ জগন্নাথের মহিমায় যে রাজ্যের একাংশ আজও তন্নামে পরিচিত, যে দেশের সুসন্তানের বৃদ্ধিবলে খৃষ্টীয় চতুদ্দর্শ শতাব্দীতে বঙ্গভূমে হিন্দুশৌর্যের ঈষৎ মাত্র বিকাশ লক্ষিত হইয়াছিল, সে দেশের কাহিনী কম গৌরবাত্মক নহে। যে দেশে বৈষ্ণব মান্য সন্ন্যাসীবর মাধবেন্দ্রের সতীর্থ বিজয়পুরীর পূর্ব্বাশ্রম, যে দেশ সুবিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য্য অদ্বৈতপ্রভুর জন্মভূমি, তাঁহারই মহিমায় যথায় পূণ্যতীর্থ ‘পণ্য’ অবস্থিত যে স্থানে কবিবর ঈশানের কবিতা কদম্ব বিকশিত হইয়াছিল, নারায়ণ দেবের সংগীতধ্বনি উত্থিত হইয়াছিল, এবং রাধামাধবের সরল সংস্কৃতের মধুর ঝঙ্কার উচ্চারিত হইয়াছিল, ইদানীং যে দেশে ভট্টকবি মকরন্দের সুধাস্রোত ছুটিয়াছিল, সাহিত্য ক্ষেত্রেও সে স্থান পরিচিত থাকার যোগ্য। যে স্থানে কর্ণখা দানে ও জনহিতৈষণায়, গোবিন্দ খাঁ সাহস ও শৌর্য্য, জয়সিংহ সারল্যে এবং বিজয়সিংহ কৌটিল্যে খ্যাত, সে স্থানের কাহিনী আলোচনায় লাভ আছে। সেই লাউড় রাজ্যের (পং লাউড় ও বাণিয়াচঙ্গ) বিবরণ এস্থলে সংক্ষেপে সমাপন করা গেল।’ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, ২/২, পৃ. ৪০২
নবদ্বীপে ও মায়াপুরে গৌরাঙ্গের জন্মস্থান, বসতবাটি, পাঠশালা ও লীলাক্ষেত্রের বিভিন্ন নিদর্শন আজও বিরাজিত। শান্তিপুরে অদ্বৈতের গৃহাবশেষ ও মন্দির, বীরচন্দ্রপুর (একচক্রা) ও খড়দহে নিত্যানন্দের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্মারক বর্তমান। অথচ অদ্বৈত সহ বহু মহাত্মার জন্মস্থান লাউড়ের অস্তিত্ব ও স্মারক বিষয়ে ইতিহাস অনেকাংশে নীরব। যে লাউড়কে ঈশান বলছেন ‘শ্রীলাউড় ধাম কারণ রত্নাকর হয়’ অথবা যে পণাতীর্থ সম্পর্কে অদ্বৈতপ্রকাশে এত গৌরবোচ্ছাস, তার কী হল?
তীর্থগণ কহে মোরা সত্য কৈল পণ।
তব শ্রী মুখের আজ্ঞা নাহবে লঙ্ঘন।।
তদবধি পণাতীর্থ হৈল তার নাম।
পণাবগাহনে সিদ্ধ হয় মনস্কাম।। অদ্বৈতপ্রকাশ। ২য় অধ্যায়
অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি পণাতীর্থ ও শ্রীঅদ্বৈতের আখড়ার কিছুটা সন্ধান দিয়েছেন শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে।
‘যে অদ্বৈতাচার্য্যের বাসস্থান বলিয়া শান্তিপুর বৈষ্ণবগণের কাছে এক দর্শনীয় স্থানে পরিণত হইয়াছে, সে মহাত্মার জন্মস্থানের সন্নিধানেই পণাতীর্থ বিরাজিত। ষ্টিমারে সুনামগঞ্জে অবতরণ পূর্ব্বক পণাতীর্থে যাওয়া সুবিধাজনক।
“অদ্বৈতপ্রকাশ” গ্রন্থে লিখিত আছে যে একদা রজনীযোগে অদ্বৈত প্রভুর জননী স্বপ্নে দর্শন করেন যে, তিনি নানা তীর্থ জলে স্নান করিতেছেন। প্রভাতে ধৰ্ম্মশীলা নাভাদেবী স্বপ্ন কথা স্মরণ করত: ও তীর্থ গমনের বিবিধ অসুবিধার বিষয় চিন্তা করিয়া বিমর্ষভাবে অবস্থিতি করিতেছিলেন, এমন সময়ে পুত্র অদ্বৈতাচার্য্য তথায় আগমন করত: মাতার বৈমর্শের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।
‘জগতে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই যে, কেহ জন্য হইতেই অতুল্য প্রতিভা, কেহ বা অমানুষিক শারীরিক শক্তি ও কেহ বা দৈববল লইয়া ভূমিষ্ঠ হয়। অদ্বৈতাচার্যও ঐরূপ এক অদ্ভূত বালক ছিলেন। তিনি মাকে বিষন্ন দেখিয়া ‘পণ’ (প্রতিজ্ঞা) করিলেন যে, এই স্থানেই তাবৎ তীর্থের আবির্ভাব করাইবেন। মনঃশক্তির প্রভাব অসীম, যোগবলের শক্তি অসাধারণ, অদ্বৈতাচার্য্য এই শক্তির বলে তীর্থ সমূহকে আকর্ষণ করত: লাউড়ের এক ক্ষুদ্র শৈলীর উপরে আনয়ন করিলেন। ঐ শৈল খণ্ডের একটি ঝরণা তীর্থবারি পরিপূরিত হইয়া ঝর ঝর করিয়া পড়িতে লাগিল। অদ্বৈত জননী তাহাতে স্নান করত: পরিতৃপ্তা হইলেন। প্রায় চারশত ষষ্টি বর্ষ হইল, এইরূপে লাউড়ে এক তীর্থের উৎপত্তি হয়।
‘অদ্বৈতের ন্যায় তীর্থসমূহও ‘পণ’ করিয়াছিলেন যে, প্রতি বারুণীতেই এস্থলে তাঁহাদের আবির্ভাব হইবে। এই ‘পণ’ শব্দ হইতেই পণাতীর্থ নাম হইয়াছে। পণাতীর্থে বারুণী যোগে বহুলোকের সমাগম হয়। বারুণী ব্যতীত জন্য সময়ে পণাতীর্থ দর্শনে যাওয়ার সুবিধা অল্প। এই তীর্থের একটা আশ্চর্য্য সংবাদ এই যে, শঙ্খধ্বনি বা উলুধ্বনি করিলে অথবা করতালি দিলে, পৰ্ব্বত হইতে তীব্রবেগে জলরাশি পতিত হয়।’ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, ১/১, ১১৮
Assam District Gazetteers-এ এই তথ্যের সমর্থন মেলে :
There are places revered by all Hindus alike, irrespective of their sect. A certain portion of Panatirtha river, near the village Ghatia becomes as sacred as the Ganges on the occasion of Baruni and pilgrimins flock in numbers to bathe in the holy waters.
—Assam District Gazetteers Vol. II (Sylhet) Chap III, P. 89.
শ্রীহট্টের বৈষ্ণব সমাজ অদ্বৈতের জন্মস্থানের সন্ধানের জন্য প্রভূত চেষ্টা করেন। বিভিন্ন শতকে এই প্রয়াস হয়। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ভক্ত ও অনুসন্ধিৎসুগণ সফল হন।
At Nayagaon in Sunamganj, a akhra has recently been started in the honour of Adwaita, one of Chaitanya followers.
-Assam District Gazetteers Vol. II (Sylhet) Chap III, P. 88.
অচ্যুতচরণ বিশদ বিবরণ দিয়েছেন অদ্বৈতাশ্রম উদ্ধারের :
‘লাউড়ের নবগ্রামে অদ্বৈতাচার্য্যের জন্ম হয়, এই স্থানেই তাঁহার বাড়ী ছিল। অদ্বৈত প্রকাশ, অদ্বৈত মঙ্গল, ভক্তি রত্নাকর প্রভৃতি প্রাচীন বহু বৈষ্ণব গ্রন্থে তাহা লিখিত আছে। অদ্বৈতের জন্মস্থান বৈষ্ণবগণের নিকট তীর্থরূপে খ্যাত। কালপ্রভাবে যখন লাউড় রাজ্য ধ্বংসমুখে পতিত হয়, তখন অদ্বৈত প্রভুর বাড়ীও জঙ্গলাবৃত হইয়া পড়ে। তদবস্থায় অদ্বৈতের জন্মস্থান লাউড় পরগণায় কোন অংশে অবস্থিত, তাহা নির্দ্ধারণ করিতে না পারিয়া ভক্ত বৈষ্ণবগণ ক্ষুন্ন হইতেন।
‘প্রায় পঞ্চাশ বর্ষ হইতে চলিল, এই বিষয়ের অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। অদ্বৈত বংশোদ্ভব উথলিবাসী স্বর্গীয় বৃন্দাবনচন্দ্র গোস্বামী ইহার সূত্রপাত করেন। তাঁহার অনুরোধ ও আদেশে সুনামগঞ্জের তহশীলদার শ্রীযুক্ত রুক্ষ্মিণীকান্ত আচার্য একান্তমনে ঐ কাৰ্য্যে নিযুক্ত হন। এই জন্য তাঁহাকে হিংস্র জন্তুপূর্ণ কন্টকাবৃত জঙ্গলে কত দিন ভ্রমণ করিতে হইয়াছে, কত নিশা জঙ্গলের বৃক্ষমূলে অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তিনি নিরুৎসাহ হন নাই, অধ্যবসায় ত্যাগ করেন নাই। গুরুবাক্যে বিশ্বাস রাখিয়া, ভক্তিবল হৃদয়ে ধরিয়া, মাস মাস, বৎসর বৎসর, লাউড়ের জঙ্গল তন্ন তন্ন করিয়া দেখিয়াছেন; সফলকাম হইতে পারেন নাই। ১২৭৯ বঙ্গাব্দে তিনি প্রাচীন দীর্ঘিকা, গৃহাদির ভগ্নাবশেষ, ভগ্ন কৌড়ির স্তূপ চিহ্নাদির নিদর্শনে রাজবাটিকার স্থান নির্দেশ করিতে পারিয়া উৎসাহিত হন, কিন্তু তাঁহার অভীষ্ট তখনও সুসিদ্ধ হয় নাই। তারপরে ধাম ধরা দিলেন, সেই জনমানবহীন নিবিড় কাননে এক রাত্রে তিনি হঠাৎ শঙ্খ করতাল ধ্বনি শুনিয়ে পাইয়া বিস্মিত হইলেন। অনেকেই তাহা ভৌতিক ব্যাপার বলিয়া ব্যাখ্যা করিল, কিন্তু তাঁহার মনে অন্য ধারণা জন্মিল। যাহা হউক, প্রভাতে সেই দিকে ভ্রমণ করাই তাঁহার উদ্দেশ্য হইল এবং অল্পায়াসেই রাজবাটীর পার্শ্বে-সেই গহন বনে, একস্থানে অগণ্য তুলসীবৃক্ষ বেষ্টিত অদ্বৈতাচার্য্যের জন্মবাটিকা ও তীরে বহু প্রাচীন মাধবীবেষ্টিত বিশাল আম্রবৃক্ষ সমন্বিত পুষ্করিণী প্রভৃতি প্রাপ্ত হন। (ইহাই যে অদ্বৈতাচার্য্যের জন্মস্থান, তৎপক্ষে অনেক অকাট্য আধ্যাত্মিক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল।) ফলত: এই স্থানই যে, অদ্বৈতের জন্মস্থান, সে বিষয়ে কাহারও মনে অনুমাত্র সন্দেহ রহে নাই। এই স্থানে রেঙ্গুয়া নামে নদী প্রবাহিত, এই নদীতীরেই রাজবাটী ছিল। সুনামগঞ্জের তদানীন্তন মুন্সেফ্ শ্রীযুক্ত নৃত্যগোপাল গোস্বামী ও পূর্ব্বোক্ত তহশীলদার বাবুর বিশেষ উদ্যোগে গোকুলচন্দ্র দাস পুরকায়স্থ মহাশয় কর্তৃক নবগ্রামে অদ্বৈতচার্য্যের বাড়ীতেই ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে ‘অদ্বৈতের আখড়া’ স্থাপিত হয়।’ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।১।৯।পৃ. ১১০
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনিশশো সাতচল্লিশ-এ দেশ ভাগের পর শ্রীহট্টের (অধুনা শিলেট) বড়ো অংশ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্গত) এবং কিছু অংশ ভারতের আসাম প্রদেশে যুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বৈষ্ণব চিন্তন ও চর্চায় আনুকূল্য করে থাকেন।
শ্রীহট্টের বৈষ্ণব সমাজ সম্পর্কে যাঁর রচনার কথা বারবার উল্লেখিত হয়েছে সেই অচ্যুতচরণ চৌধুরীকে (১৮৬৫-১৯৫৩) বৈষ্ণব মহামণ্ডলের পণ্ডিতবর্গ ‘তত্বনিধি’ উপাধিতে ভূষিত করেন।’ আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর নিঃস্বার্থ চারিত্রিক মহত্ব ও বৈষ্ণবীয় শাস্ত্রে অসাধারণ বুৎপত্তি দর্শন করে তাঁকে ‘গৌরভূষণ’ অভিধায় সম্মানিত করেন।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (আমেরিকা) বিশিষ্ট বৈষ্ণবধারা গবেষক রেবেকা জে ম্যানরিঙ্ তাঁর গ্রন্থ Reconstruction Tradition : Advaita Acharya and Goudiya Vainavism at the Cusp of 20 Century (প্রকাশ ২০০৫, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস) এই বিতর্কের একটি সমাধান সূত্র দেবার চেষ্টা করেছেন :
“… the proclamation that Advaita Prakash is an ancient and authentic Vaisnava book, written by a man who spent the better part of fifty years like a shadow to the early greats of the Gaudiya Vaisnava movement. The author finished the book in 1568 and it remained hidden for nearly 350 years thereafter. Mitra gives Advaita Prakash’s pub- lication history, and thanks Caudhuri for all his help in putting out this edition.
He then begins a lengthy discussion about Isana Nagara’s family history, providing much more detail than did Caudhuri. Mitra says he does not know where the Nagaras were originally from but speculates that they had immi- grated to Bengal from Karnataka, like Rupa and Sanatana’s ancestors. Isana’s father Padmanabha Cakrabvartti was from Navagrama, his mother’s name was Padmani Devi; both parents were siddha srotriyas of the Sandilya gotra. Mitra quotes Caudhuri on Isana’s arrival at Advaita house. Mitra goes on to detail Isana’s life after Advaita ‘s death, when he travelled east to Gopalpur, got married, and began his family. During this time many disciples came to him, and he initiated them. The local nawab was so impressed with his devotion that he gave him a large piece of land in Jhakpal, near Dhaka. But Isana knew he could not die until he had fulfilled Sita request that he start a family, so he went to Lauda and, in 1568, at the age of seventy-six, finally completed the AP. He died shortly thereafter. Mitra provides a great deal about Isana’s descendants, which he says he learned from Bhuvana Mohana Majumdara of Daulatpur College. For example, Isana eledest son Purusottama eventually acquired quite a few followers himself and the famiy came to be known as the Nagara-Advaitas and weee considered part of Sita and Advaita’s family. Reconstruction, P. 156
শ্রীহট্ট থেকে প্রকাশিত শ্রীভূমি পত্রিকায় সুন্দরীমোহন দাস শ্রীহট্টের মহিমাকীর্তনের মঙ্গলাচরণে গৌরাঙ্গ, নাড়া (অদ্বৈত) ও ঈশানের প্রসঙ্গ এনেছেন সুললিতভাবে :
নমোনমঃ গৌরাঙ্গ রঙ্গিয়া।
করিলে কত যে রঙ্গ, সঙ্গে লয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ,
অন্তরঙ্গ তব শ্রীহট্টিয়া।
সেই তব বুড়া-নাড়া, যার ডাকে দিয়ে সাড়া,
উজলিলা নদীয়া-আকাশ।
বেড়ল তারানিকর, মুরারি চন্দ্রশেখর,
শ্রীরাম-পণ্ডিত শ্রীনবাস।।
লাউড়িয়া কৃষ্ণদাস, নমঃ অদ্বৈত প্রকাশ
ঈশাননাগর সেবাচার্য্য।
উপবীত করি ছিন্ন, ভজেছিলা শ্রীচৈতন্য,
জাতিকূল নাহি করি ধার্য্য।।