বিশ
ছোট্ট শহর হ্যারিসভিল। প্রধান সড়কের দুই পাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো দোকানপাট আর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো। যানবাহনের ভিড় নেই তেমন রাস্তায়।
সেই রাস্তা ধরে পরদিন সকালে গায়ে রোদ মাখতে মাখতে ক্যাথলিক চার্চটা পেরিয়ে এল টনিদের গাড়িটা। একটা লেখা চোখে পড়ল ওদের চার্চের সামনের দিকে ঈশ্বরের কৃপায় মঙ্গল হোক তোমার।
পরবর্তী ব্লকটার উদ্দেশে চালিয়ে নিয়ে গেল টনি প্লিমাথটা। স্কালি’স ড্রাই গুডস লেখা একটা দোকানের সামনে এনে রাখল ওটা।
একখানা প্রবেশদ্বারের দু’পাশে বড় দুটো জানালা নিয়ে অতি সাধারণ এক দোতলা দালানে দোকানটা।
টনি আর তাহিতি যখন প্রবেশ করছে দালানটায়, কোথায় যেন বেজে উঠল একটা ঘণ্টি। শুকনো খাবারের পাঁচমিশালি গন্ধে ভরে আছে ভিতরটা।
লম্বা এক কাউন্টারের ওপাশে দেখতে পেল ওরা দু’জন নারীকে। একজন দোকানের মালকিন, ত্রিশোর্ধ্ব মিসেস ক্যারেন স্কালি। অপর জন কৈশোর পেরিয়েছে।
দোকানের সামনের দিক থেকে পিছনের উপরতলায়- চলে-যাওয়া সিঁড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ কাউন্টারটা। একখানা লাভা- ল্যাম্প শোভাবর্ধন করছে রেজিস্টারটার পাশে।
কাস্টমারের জন্য কাপড় কাটায় ব্যস্ত ছিল, আগন্তুকদের দিকে চোখ তুলে তাকাল স্কালি।
‘মিস্টার আর মিসেস ডায়েস?’ জিজ্ঞেস করল মহিলা।
স্মিত হাসল দু’জনেই।
‘আলাপের অনুমতি দেয়ার জন্য ধন্যবাদ,’ বলল টনি উষ্ণ কণ্ঠে।
পাশের টিনেজ মেয়েটির দিকে তাকাল স্কালি। ‘ম্যাণ্ডি, মিসেস অ্যানডারসনের জন্য রেডি করো কাপড়টা, ঠিক আছে?’
মাথা ঝাঁকিয়ে কাজ বুঝে নিল মেয়েটি। মিসেস স্কালির হাত থেকে কাঁচিটা নিলেও একটুর জন্যও চোখ সরছে না দোকানে আসা দম্পতিটির উপর থেকে। বুঝতেও পারছে না, ঠিক কী কাজে এসেছে ওরা।
যুবক-যুবতীর দিকে দৃষ্টি দিল আবার মিসেস স্কালি। ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
কাউন্টারের উপর থেকে কফির বড়সড় মগটা তুলে নিল মহিলা। রওনা হলো সিঁড়ির দিকে।
টনি আর তাহিতি অনুসরণ করছে দোকানিকে।
‘পাত্তা না দিলেও চলবে আমার ভাতিজিকে,’ বলল মহিলা চলতে চলতে। ‘কুপারদের মেয়েদের সাথে স্কুলে যায় ও। শুনেছে, কী হচ্ছে ওদের ওখানে।’
উপরে উঠছে, আবার বলল মহিলা: ‘কুপাররা কিনে নেয়ার আগে খালিই পড়ে ছিল বাড়িটা। আমি অন্তত ও- বাড়িতে থাকতে দেখিনি কাউকে।’ প্রসঙ্গ পাল্টাল মহিলা। ‘মাফ করবেন… অগোছাল হয়ে আছে এখানটা। ..পারকিনসন’স-এ আক্রান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত প্রায় ষাট বছর ধরে ইতিহাসবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন আমার নানি। অসুস্থ হওয়ার পর… বুঝতেই তো পারছেন… সেরকম আর যত্ন নেয়া হয়নি ওঁর জিনিসগুলোর…..
শেষ ধাপটা পেরিয়ে বিরাট এক অবিন্যস্ত কামরায় পা রাখল ওরা। বইপত্র, ফাইলিং ক্যাবিনেট, ছবি আর পুরানো খবরের কাগজ ডাঁই করে রাখা ঘরটায়।
‘… কাজটা শুরু করেছিলাম বটে,’ ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলল স্কালি। ‘কিন্তু খুব বেশি সময় দিতে পারিনি!’
কাজ মানে, টনিদের জন্য দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা।
কাছের এক টেবিলের দিকে এগিয়ে চলল মহিলা। ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা টেবিলটায় ম্যাপ, ছবি, জার্নাল আর অন্যান্য দলিল-দস্তাবেজ স্তূপ করে রাখা বড়সড় দুটো প্যাকিং বাক্সের মধ্যে।
‘…যা যা পাওয়া গেছে, সব কিছুই একসাথে করেছি আপনাদের জন্য,’ জানাল মহিলা। ‘সব পাওয়া যায়নি অবশ্য। বেশ কিছু ডকুমেন্ট মিসিং আছে কোনও কোনও সময়ের। তার পরও খোঁজা বন্ধ করিনি আমি। পেলেই জানাব আপনাদেরকে।’
.
বিছানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে রোজমেরি, এ সময় জানালায় ঝলসে উঠল আলো।
নিচের ড্রাইভওয়ে থেকে আসছে আলোটা।
জানালার কাছে গিয়ে বাইরে চাইল রোজমেরি।
ফিরে এসেছে অ্যালবার্ট! আলোটা ওর গাড়ির হেডলাইটের।
.
স্পষ্টই ত্যক্ত দেখাচ্ছে অ্যালবার্টকে। হাত বাড়াল কিচেন- ক্যাবিনেটে রাখা স্কচের বোতলটার দিকে।
কাউন্টারে হেলান দিয়ে মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করছে রোজমেরি কুপার। দুই হাত বুকের উপরে জড়ো করা।
‘বিশ্বাস করতে পারছি না,’ তিক্ত স্বরে বলল ওর স্বামী। ‘আমাকে না জানিয়ে করেছ তুমি এসব!’
‘কিছু একটা তো করতেই হবে আমাদের, তা-ই না?’ মরিয়ার মতো বলল রোজমেরি। ‘দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে পরিস্থিতি!’
‘কী বলেছিলাম তোমাকে… এসব বুলশিট আর শুনতে চাই না আমি!’
‘ওঁরা বলেছেন, তুমি কিছু দেখতে পাচ্ছ না, তার কারণ, ওরাই চাচ্ছে না যে, তুমি কিছু দেখো। আমাদের মধ্যে অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে ওটা।’
হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েও থমকে গেল লোকটা মাঝপথে। বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে মন্তব্য করল, ‘সেটা অবশ্য করতে পেরেছে ওরা।
নির্জলা পানীয় ঢালল সে গেলাসে।
‘তা, তদন্ত করার জন্য কত নিচ্ছেন ওনারা?’
‘এক পয়সাও না।’
স্বামীর কাছে এগিয়ে গেল রোজমেরি। গেলাসটা মুখের কাছে নেয়ার আগেই ধরে ফেলল অ্যালবার্টের হাতটা।
‘কী যে ভয় পাচ্ছি, বলে বোঝাতে পারব না তোমাকে!’ কাতর স্বরে বলল মহিলা। ‘খালি মনে হচ্ছে, হার্টফেল করব যে-কোনও মুহূর্তে। আর মেয়েদের অবস্থা তো বলারই বাইরে। যেসব কাণ্ড ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে ওটা, একটুও পছন্দ করতে পারছি না আমি!’ স্বামীর চোখে চোখ রাখল রোজমেরি। ‘প্লিজ, অ্যালবার্ট! আমার জন্য হলেও রাজি হয়ে যাও, প্লিজ!’
.
ঘুম জড়ানো চেহারা নিয়ে কিচেনে ঢুকল টনি সাতসকালে। কফিপটটা টারগেট ওর।
‘একটু বেশি করে বানাতে হবে তোমাকে,’ শুনতে পেল তাহিতির গলা।
কিচেন সংলগ্ন অ্যালকোভের (Alcove: কোনও কামরার আংশিক পরিবেষ্টিত বর্ধিতাংশ, যেখানে অনেক সময় শয্যা বা আসন রাখা হয়।) দিকে চাইল টনি। দেখতে পেল বউটাকে। ছোট এক ডেস্কে ইতিহাসবিদ বুড়ির জড়ো করা যাবতীয় তথ্য নিয়ে কাজ করছে মহিলা। হাতে লেখা একটা জার্নাল ওর এক হাতে।
‘কখন উঠেছ?’ জিজ্ঞেস করল টনি।
‘চারটার দিকে। ঘুম আসছিল না আর।’ গভীর দৃষ্টিতে চাইল মহিলা স্বামীর দিকে। ‘বিস্ময়ের কিছু নেই যে, এসব অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পরিবারটা!’
.
কুপার ফার্মের অতি পুরানো এক রং জ্বলা ছবি হাতে নিয়ে দেখছে টনি ডায়েস। আরেক হাতে কাপ ভর্তি কফি, একটু পর পর চুমুক দিচ্ছে পেয়ালায়।
পাশেই আরও অনেক ছবি গাদা করে রাখা।
‘আসল ফার্মহাউসের ছবি এটা,’ জানাচ্ছে তাহিতি। ‘জোনা ওয়াইল্ডার নামে এক লোক তৈরি করে বাড়িটা, আঠারো শ’ তেয়াত্তর সালে। রোজামাও ইস্টি নামে এক নারীকে বিয়ে করে লোকটা। বিয়ের সময় উনিশ বছর বয়স ছিল মেয়েটার। কি জানো, ম্যারি ইস্টি-র সরাসরি উত্তরসুরি এই রোজামাণ্ড।’
‘শোনা শোনা মনে হচ্ছে নামটা…’ ভুরু কুঁচকে গেছে টনির।
‘হ্যাঁ, টনি। ও হচ্ছে প্রথম ডাইনি, সালেম উইচ ট্রায়ালে যাকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়।’
স্ত্রীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল টনি। দারুণ কৌতূহলী, মনে হচ্ছে ওকে।
‘একটা ছেলে হয়েছিল জোনা আর রোজামাণ্ডের। বাচ্চাটার যখন সাত বছর বয়স, এক রাতে বাড়ি ফিরে দেখতে পায় জোনা, ফায়ারপ্লেসের সামনে, শয়তানের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে ছেলেটাকে।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না টনি।
‘….ধারণা করছি,’ বলে চলেছে তাহিতি। ‘উল বোনার কাঁটা দিয়ে খুন করা হয়েছিল বাচ্চাটাকে। এর পর যেটা বোঝা যাচ্ছে… ঘর থেকে বেরিয়ে গোলাঘরে ছুটে যায় রোজামাণ্ড, রশি বাঁধে বার্নের আড়া থেকে। শয়তানের প্রতি নিজের আনুগত্যের ব্যাপারে শপথ করে মহিলা। তার পর যে ওর জমি দখল করার চেষ্টা করবে, তার উদ্দেশে অভিশাপ বর্ষণ করে ফাঁস নেয় গলায়।’
পার্চমেন্ট পেপারের উপর রাখা পুরানো এক নিউজপেপার ক্লিপিং ঠেলে দিল তাহিতি টনির দিকে। ক্লিপিংটা তুলে নিলে বলল, ‘এই সেই মহিলা।’
তাকাল টনি ছবিটার দিকে। গোলাঘরের আড়া থেকে ঝুলছে এক মহিলার মৃত দেহ।
‘একেই দেখেছ তুমি গোলাঘরে?’ টনির জিজ্ঞাসা।
ঘাড় নাড়ল তাহিতি।
‘ভোর পাঁচটা বিশে আত্মহত্যা করে মেয়েটা!’
‘হুম… কিছু কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তা হলে।
এর পর পুরানো এক সাদাকালো ছবি ঠেলে দিল তাহিতি স্বামীর দিকে। বেতের চেয়ারে বসা পৃথুল এক মহিলার ছবি ওটা। চশমা পরা এক বালক আর এক বালিকা বসেছে চেয়ারের দুই হাতলে। দু’জনেরই বয়স দশের আশপাশে।
‘…আর যে-মহিলাকে দেখেছি আমি বেইসমেন্টে, যে কিনা নিজেই গুলি করেছে নিজেকে… আমার ধারণা, ও হচ্ছে মোটা এই মহিলা। পদবি হচ্ছে অ্যানিসটন। তিরিশের দশকে থাকত মহিলা কুপারদের ফার্মহাউসে। দুটো বাচ্চা ছিল ওর, রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে। পাওয়াই যায়নি আর ওদের। শোক সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে মহিলা। দৃঢ় বিশ্বাস আমার… ওরাই উৎপাত করছে রোজমেরিদের।
‘ওয়াও…. কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না টনি।
‘কথা কিন্তু শেষ হয়নি এখনও। পাঁচ শ’ একর সম্পত্তি ছিল রোজামাওদের। ভাগ ভাগ করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে সেটাকে…’ পাশে রাখা পুরানো এক গোটানো ম্যাপ খুলল তাহিতি। আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল এক জায়গায়। ‘এই যে, এখানটায়… একটা ছেলে ডুবে গিয়েছিল এই পুকুরটায়। রোজামাও ইস্টির সম্পত্তির সীমানার মধ্যে পড়ে, এমন এক বাড়িতে থাকত ছেলেটা।’
কাছাকাছি আরেক জায়গায় সরে গেল তাহিতির তর্জনি। ‘একইভাবে, মহিলার সম্পত্তির পরিধির মধ্যে বাস করত, এমন এক শিকারিও অপঘাতে পটল তুলেছে জঙ্গলে।’
এবার আরেক জায়গায় দেখাল তাহিতি। ‘এটা দেখো… একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল এই রাস্তাটায়… একটা স্কুল- বাস…’ চোখ রাখল টনির চোখে। বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবারের কথাটায়। ‘একটা মাত্র বাচ্চা মারা গিয়েছিল ওই দুর্ঘটনায়। যথারীতি রোজামাওদের সীমানায় বাস করত চারজনের ওই পরিবারটা।’
‘…যে ওর জমি দখল করার চেষ্টা করবে…’ বিড়বিড় করে আওড়াল টনি ডায়েস।
একুশ
রোড আইল্যাণ্ডের দুই লেনের আঁকাবাঁকা, কাঁচা রাস্তাটা ধরে ছুটে চলেছে বিদায়ী সূর্যের অপার্থিব আলোয় সিক্ত ডায়েসদের প্রিমাথটা।
থামল এসে কুপারদের ড্রাইভওয়েতে উঠে।
টনি, তাহিতি আর পিটার পারকার বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
তৃতীয় জনের বয়স পঁয়তিরিশ। খাকি পোশাক পরা, নিখুঁত গড়নের অধিকারী। জিমে যাতায়াত করে নিয়মিত। পেশির কারণে সামান্য আঁটো হয়েছে শার্টটা।
গাড়ি ঘুরে পিছনদিকে চলে এল তিনজনে।
টনি ডায়েস ডালাটা খুলে ধরতেই বড় বড় চারটে গ্রোসারির ব্যাগ আর কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স দেখা গেল ট্রাঙ্কের ভিতরে। ওর টেপ রেকর্ডার আর কুপারদের ঘড়িটা ছাড়াও একখানা বাইবেল, ক্যামেরার একটা খাপ, ক’টা নোটপ্যাড আর ডজন কয়েক ফিল্ম-ক্যানিস্টার ঠাঁই পেয়েছে বাক্সটার মধ্যে।
আগে আসেনি এখানে পিটার। তাকিয়ে দেখছে চারপাশটা।
‘সুন্দর জায়গা,’ মন্তব্য করল ঘাড় নেড়ে।
মাত্র ড্রাইভওয়েতে ঢোকা অপর গাড়িটার দিকে মনোযোগ চলে গেল তাহিতির। একটা ফোক্সভাগেন ভ্যান ওটা, এগিয়ে আসছে বাড়িটার দিকে
একটা স্টিকার সাঁটা গাড়িটার সামনের কাচে। স্টিকারে লেখা:
মানুষ হইতে সাবধান!
‘গুড,’ সন্তুষ্টির স্বরে বলল তাহিতি। ‘এসে গেছে মাইকেল।’
ওদের প্লিমাথটার পাশে ভ্যানটাকে পার্ক করাল মাইকেল রডম্যান। লাফ দিয়ে নেমে এল গাড়ি থেকে। বড়সড় এক কুকিতে ভর্তি ওর মুখটা, চিবোচ্ছে কুড়মুড় করে। ওই অবস্থাতেই গর্বিত আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেঁতো হাসি নিয়ে তাকাল ওদের দিকে।
‘ভুলেই গিয়েছিলাম, কী রকম খতরনাক জায়গা এই ঢ আইল্যাণ্ড,’ প্রথম ডায়ালগ মাইকেলের। লক্ষ করছে ডায়েসদের সঙ্গীটিকে। ‘তোমাদের সহকারী হিসেবে কাটাতে আর ভাল্লাগছে না আমার। নিজেই কিছু একটা করতে যাচ্ছি সম্ভবত।’
‘মাইকেল, উনি হচ্ছেন পিটার পারকার, সহকারীর রসিকতাকে পাত্তা না দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল তাহিতি ডায়েস। ‘আমাদের–‘
‘ওহ, দারোগা সাহেব…’ নামটা পরিচিত মাইকেলের। ‘নাইস টু মিট ইউ, ম্যান।’
হাত মেলাল দু’জনে।
‘শুনেছি, ঈশ্বর-টিশ্বরে নাকি বিশ্বাস নেই আপনার খুব একটা?’ মাইকেলের প্রশ্ন পারকারকে।
‘তা আপনি বলতে পারেন,’ মৃদু হেসে জবাব দিল পারকার।
‘বুঝতে পারছেন তো, গুলি কিন্তু লাগাতে পারবেন না ভূতপ্রেতের গায়ে! চেষ্টা করে লাভ নেই।’
‘ত্যক্ত কোরো না ওঁকে,’ মৃদু শাসনের সুরে বলল টনি। ‘…আসুন, নামাতে হবে জিনিসপত্রগুলো।’
.
বিপর্যস্ত চেহারায় দরজা মেলে ধরেছে রোজমেরি; হুড়োহুড়ি করে ভিতরে ঢুকে পড়ল মাইকেল, টনি আর পিটার পারকার। মনিটর, ভিসিআর, মাপযন্ত্র আর ক্যামেরার নানান যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি বইছে ওরা ভাগাভাগি করে। একটা বাক্স হাতে ওদের পিছন পিছন ঢুকল তাহিতি।
উপরের ল্যাণ্ডিঙে দাঁড়িয়ে নিচের কর্মতৎপরতা দেখতে লাগল সিলভিয়া-সিনথিয়া—দুই বোন।
‘মেইন সেটআপটা লিভিং রুমে বসাতে চাই আমরা,’ অনুমতি চাইল টনি। ‘যদি কোনও সমস্যা না হয়।’
‘না-না, সমস্যা কীসের?’ সেটআপ-টেটআপ কিছু না বুঝেই অনুমতি দিয়ে দিল রোজমেরি।
‘ইনি হচ্ছেন মাইকেল রডম্যান। আর ইনি—অফিসার পারকার,’ বাকি দু’জনের পরিচয় জানাল টনি।
‘শুধু পিটার বললেই চলবে।’ বিনয়ের অবতার যেন অফিসার।
হ্যালো-সূচক নড করল ওরা গৃহকর্ত্রীর উদ্দেশে, তার পর ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের কাজে।
কিচেনে ছিল, বেরিয়ে এসে ড্রইং রুমে চলে এল অ্যালবার্ট।
‘আমার স্বামী,’ দলটার উদ্দেশে বলল রোজমেরি। ‘অ্যালবার্ট কুপার।’
গৃহস্বামীর চোখে সংশয় দেখতে পাচ্ছে টনি, তা-ও বলল, ‘আশা করি, সাহায্য করতে পারব আপনাদের।’
‘ইয়াহ্… আমিও তা-ই আশা করি।’ স্ত্রীর দিকে চাইল ।কুপার। ‘গোলাঘরে পাবে আমাকে।’
এগোল লোকটা বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে।
মাইকেল আর পিটারের সঙ্গে হাত লাগাল টনি।
তাহিতি তাকাল রোজমেরির দিকে। চাউনিতে প্রকাশ পাচ্ছে আন্তরিকতা।
‘আমরা যাওয়ার পর ঠিকঠাক চলেছে তো সব কিছু?’ জানতে চাইল ও।
রোজমেরির বিমর্ষ অভিব্যক্তিই জানিয়ে দিল উত্তরটা।
.
কিচেন-কাউন্টারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে তাহিতি, শুনছে মিসেস কুপারের কথা।
‘…চুইয়ে চুইয়ে নাকি পানি বেরোচ্ছিল ছেলেটার মুখ দিয়ে!’ থামল মহিলা।
‘দ্যাট’স গুড,’ সন্তুষ্টির মন্তব্য করল তাহিতি।
দৃষ্টিতে বিস্ময় ফুটল রোজমেরির।
‘বাড়িটায় যে ভূতের আছর হয়েছে, প্রমাণ করতে হবে তো সেটা,’ ব্যাখ্যা করল প্রেত-বিশেষজ্ঞ। ‘ওদের এসব অ্যাকটিভিটিই হচ্ছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্ৰমাণ।’
গ্রোসারির ব্যাগ হাতে পিটার পারকার ঢুকল কিচেনে। ঢুকেই বিব্রত। বুঝতে পারছে না, কোথায় রাখবে জিনিসগুলো।
কিচেন-টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করল তাহিতি। ভাঁজ করা কাপড় রাখা দুটো ঝুড়ি রয়েছে টেবিলে।
বিদায় নিল পারকার জিনিসগুলো রেখে।
গ্রোসারিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে রোজমেরি।
‘…এসব আনার কি কোনও দরকার ছিল আদৌ?’ জিজ্ঞেস করল বিব্রত মুখে।
‘বলছেন কী আপনি!’ চোখ কপালে তোলার ভঙ্গি করল তাহিতি। ‘দেখেছেন না মাইকেলকে? রাক্ষস একটা! খেতে শুরু করলে ভাঁড়ার সাফ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ছেলেটা। …না না, হাসবেন না! ওর খাঁইটা মেটাতে হবে তো!’
তা-ও হাসছে রোজমেরি। ভাপসা অনুভূতির মাঝে খানিকটা স্বস্তি হয়ে এসেছে তাহিতির এই রসিকতা।
‘রাখবেন কোথায় কাপড়গুলো— উপরে?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস ডায়েস।
.
দরজাটা খুলে গেল গোলাঘরের। বাইরের সূর্যালোকের একটা টানেল তৈরি হলো ভিতরে, পিছনদিকে পার্ক করে রাখা শেভি পিকআপটাকে সুড়ঙ্গটা স্পর্শ করল কি করল না।
ভিতরে ঢুকল অ্যালবার্ট। হাত বাড়াল দেয়ালের সুইচের দিকে। লক্ষও করল না, কে-এক মহিলা বসে রয়েছে ট্রাকের ভিতরে। সোজা তাকিয়ে আছে সে অ্যালবার্টের দিকে।
কিন্তু যে মুহূর্তে জ্বলে উঠল বাতি, উধাও হয়ে গেল মহিলা চোখের পলকে!
ফাঁকা এখন গাড়ির ভিতরটা!
বাইশ
কিছুক্ষণ পর ট্রাইপড আর পঁয়তিরিশ মিলিমিটারের একখানা ক্যামেরা নিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল টনি। সে-ও এগোচ্ছে গোলাঘরের দিকে।
নাটাই থেকে তারের প্যাচ ছাড়াতে ছাড়াতে কি পিছনে বেরোল পিটার পারকার।
.
পিকআপের সামনের দিকটায় জ্যাক সেট করেছে অ্যালবার্ট। টায়ার-রেঞ্চের এক প্রান্ত জ্যাকে আটকে ঘোরাচ্ছে সেটা টায়ার উঁচু করার জন্য। ছোট এক টুলবক্স পাশে রাখা জ্যাকটার।
‘চমৎকার গাড়ি,’ প্রশংসা শোনা গেল কারও। ‘ফিফটি- ফাইভ?
কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল অ্যালবার্ট। মিস্টার টনি ডায়েস।
‘সিক্স,’ শুধরে দিল মডেল।
‘টু-এইটি-থ্রি স্মল ব্লক?’
ইমপ্রেসড দেখাচ্ছে মিস্টার কুপারকে। ট্রাক চেনেন আপনি, মিস্টার।’ সত্যি হয়েছে ইঞ্জিন সম্পর্কে টনির অনুমান।
ট্রাক উঁচু করা শেষ হয়েছে অ্যালবার্টের। জ্যাকের সেফটি লেভারটা লক পজিশনে সেট করল এবারে।
‘বড় ব্যাক-উইণ্ডোঅলা একটা সাইড-স্টেপ ছিল আব্বুর,’ ওকে বলল টনি। ‘প্রত্যেক শনিবার ওটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আমরা। …কী করছেন আপনি?’
‘কিছু না… রিপ্যাক করছি বিয়ারিংগুলো।’
এই পর্যায়ে গোলাঘরে ঢুকল পারকার। এখনও কেইবল ছাড়াচ্ছে টনির দিকে এগোতে এগোতে।
‘আ… কিছু মনে করবেন না… অল্প কিছুক্ষণ সময় নেব আমরা,’ বলল টনি অ্যালবার্টের দিকে চেয়ে।
‘যতক্ষণ ইচ্ছা, নিন।’ সমস্যা নেই অ্যালবার্টের। ট্রাকের লাগ-এর স্ক্রু খুলতে আরম্ভ করল ও।
ট্রাইপডের উপরে ক্যামেরাটা বসাল টনি। পিটারের কাছ থেকে নিল কেইবলের অন্য প্রান্তটা, জুড়ে দিল সেটা ক্যামেরার পাশে জায়গামতো।
‘মাইকেল কি ইএফডি (ElecTronIc FIscal DevIce) দিয়েছে আপনাকে?’ পিটারকে জিজ্ঞেস করল টনি।
‘যদি এটার কথা বলে থাকেন…. ছোট এক হ্যাণ্ড-হেল্ড মিটার বের করল পিটার পকেট থেকে। টনির হাতে দিতে দিতে বলল, ‘কী কাজ করে এটা?’
জিনিসটা ক্যামেরার সঙ্গে সংযুক্ত করতে করতে বলল টনি, ‘কাছাকাছি কোনও অপশক্তির উপস্থিতি থাকলে ওঠানামা করতে আরম্ভ করবে কাঁটাটা, সচরাচর এক দশমিক সাত থেকে তিন মেগাহার্টজের মধ্যে। আর তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুট করতে শুরু করবে ক্যামেরা।’
‘আপনারা কি সত্যি সত্যিই ছবি তুলতে চাইছেন ওটার?’ জিজ্ঞেস না করে পারল না অ্যালবার্ট।
‘হুম, ঠিকই ধরেছেন।’
বিস্ময়াভিভূত লোকটা কী মন্তব্য করবে, বুঝতে না পেরে মনোযোগ ফেরাল নিজের কাজে। লক্ষ করল, তেল চোয়াচ্ছে দূষিত ফ্লুইড বের করে দেয়ার ড্রেইনটা থেকে।
চিত হয়ে শুয়ে শরীরটাকে ঠেলে ট্রাকের নিচে নিয়ে গেল অ্যালবার্ট সমস্যাটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
আচ্ছা, এই জায়গায় সেট করছি কেন মিটারটা?’ জানতে চাইল পিটার-কানে এল অ্যালবার্টের।
‘কারণ, এখানেই আত্মহত্যা করেছিল ডাইনিটা। উপরের আড়াগুলো দেখছেন না? ওখান থেকেই ঝুলিয়ে দিয়েছিল নিজেকে।’
‘যেখানটায় মৃত্যু হয়েছে,’ উপরদিকে তাকিয়ে আছে পিটার, বলে চলল টনি: ‘সে-জায়গার আশপাশে সময়ে সময়ে দেখা দেয় অপচ্ছায়ারা।’
আর ঠিক তক্ষুনি—ধড়াম!
কথা নেই, বার্তা নেই, সোজা মেঝের দিকে নেমে এসেছে পিকআপটা। শোনা গেল বিচ্ছিরি একটা মড়মড় আওয়াজ।
আওয়াজের উৎসের দিকে ঝট করে ঘাড় ঘুরে গেছে টনি আর পিটারের। দেখতে পেল, ট্রাকের পাশের দশ ইঞ্চিমতো ফাঁকটা দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে অ্যালবার্টের পা জোড়া। চুরমার হতে থাকা টুলবক্সটার কারণে সৃষ্টি হয়েছে ফাঁকটা, কোনও মতে ঠেকিয়ে রেখেছে বাক্সটা গাড়িটাকে।
ছুটে গেল ওরা।
‘মিস্টার কুপার!’ টনির গলার স্বর চড়ে গেল শঙ্কায়।
তেইশ
চেসিসের তলা থেকে এক চুল মাত্র দূরে এক পাশে কাত হয়ে থাকা অ্যালবার্টের আতঙ্কিত মুখটা! আর এক মিলিমিটার নেমে এলেই দেখতে হতো না আর!
‘ঠ-ঠিক… ঠিক আছি আমি!’ বলল লোকটা কম্পিত গলায়। ‘ব্-বের করতে পারবেন আমাকে?’
‘দেখছি…’ ভেসে এল টনির গলা।
ও আর পিটার একটা করে পা ধরল অ্যালবার্টের, টান লাগাল একসঙ্গে।
একটু একটু করে পুরোপুরি বেরিয়ে এল দেহটা। আতঙ্ক এখনও মোছেনি লোকটার চাউনি থেকে।
‘শ্-শুকরিয়া!’ খসখসে গলায় বলতে পারল কোনও রকমে।
টুলবক্সটার অবস্থা দেখল ওরা।
‘…ক্-কানের পাশ দিয়ে… ব- বেরিয়ে গেছে গুলি!’ নিজেকেই শোনাল যেন অ্যালবার্ট ফাঁপা কণ্ঠে। সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছে পায়ের উপরে।
পরীক্ষা করল পড়ে যাওয়া জ্যাকটা তুলে নিয়ে। অফ দেখাচ্ছে এখন সেফটি লকটা।
‘মনে হচ্ছে, লুজ হয়ে গেছে তালাটা…’ উচ্চারণ করল অ্যালবার্ট অস্ফুট কণ্ঠে।
টনি কিন্তু পুরোপুরি একমত নয় লোকটার সঙ্গে। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, আরও কিছু রয়েছে যেন দুর্ঘটনাটার পিছনে!
.
লণ্ড্রির ঝুড়ি থেকে কাপড়গুলো সিলভিয়ার ড্রয়ারে রাখছে ওর মা। তাকিয়ে দেখছে তাহিতি।
‘…মা কীভাবে হত্যা করতে পারে নিজের বাচ্চাকে?’ ফার্মহাউসটার অতীত নাড়া দিয়ে গেছে রোজমেরিকে। প্রশ্ন রাখল মহিলা বিহ্বল গলায়।
‘বাচ্চাটাকে কখনোই নিজের বলে মনে করত না মহিলা,’ বোঝাচ্ছে তাহিতি। ‘ঈশ্বরের দেয়া উপহারকে ওঁরই বিরুদ্ধে স্রেফ কাজে লাগিয়েছে মেয়েটা। ওটা ছিল শয়তানের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত অবমাননা। ডাইনিরা বিশ্বাস করে, এসবের মাধ্যমে নেক নজর কাড়া যায় শয়তানের।
.
স্প্যাগেটির মতো জড়াজড়ি করে থাকা কেইবলের জট নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, আর ফাঁকে ফাঁকে পটেটো চিপসের প্যাকেট থেকে চিপস তুলে মুখে পুরছে মাইকেল। আলাদা আলাদা সাতটা ভিসিআর থেকে সাতটা মনিটরে গেছে তারগুলো। অবস্থান অনুযায়ী লেবেল সাঁটা মনিটরগুলোতে:
বেইসমেন্ট
উপরের হলওয়ে
নিচের হলওয়ে
মাস্টার বেডরুম
লিভিং রুম
গোলাঘর
মেয়েদের শোবার ঘর
মাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সিলভিয়া। কেমন একটা কৌতুকের ছায়া ওর চেহারায়।
রোল থেকে এক ফালি টেপ কেটে নিল মাইকেল কাঁচি দিয়ে। কয়েক পরত পেঁচাল টেপটা এক তারের চারপাশে।
‘…কী জিনিস ওটা?’ দেখাল সিলভিয়া আঙুল দিয়ে।
‘ভিসিআর,’ বলল মাইকেল। ‘ভিডিয়ো রেকর্ড করা হয় যন্ত্রটা দিয়ে। বলা হচ্ছে, সবার ঘরে ঘরে থাকবে নাকি একদিন এই জিনিস…’
‘সত্যি? কী জন্য?’
‘এই ধরো… টিভিতে যা দেখছ, রেকর্ড করে রাখলে। তার পর যখন ইচ্ছা, দেখতে পারবে প্রোগ্রামগুলো।’
‘তা-ই নাকি? দারুণ তো!’
‘দারুণের চাইতেও বেশি। ভুল বললাম?’
উজ্জ্বল হাসল সিলভিয়া।
.
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে তাহিতি আর রোজমেরি। একটা করে খালি ঝুড়ি বইছে দু’জনে।
থামল ফয়ারে এসে। সিলভিয়া আর মাইকেলকে লিভিং রুমে কথা বলতে দেখে মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে সেদিকে।
‘দেখে মনে হচ্ছে, কেউ কারও ভক্ত হয়ে উঠেছে,’ স্মিতহাস্যে মন্তব্য করল তাহিতি।
কৌতুকের হাসিতে বেঁকে গেল রোজমেরির ঠোঁটের প্রান্ত।
‘ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে—কী করছেন, ভালো করেই জানেন তিনি,’ তারিফের দৃষ্টিতে দেখছে মাইকেলকে ভদ্রমহিলা।
‘এমআইটি ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিল আমাদের মাইকেল,’ বলল তাহিতি।
….আর মিস্টার পারকার? পুলিসের লোক তিনি?’
‘হুম। সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিয়ে এসেছে ওঁকে টনি। পুলিসের বক্তব্য বিশ্বাস করবে লোকে।’ কী যেন চিন্তা করল তাহিতি। ‘টনির বাবাও পুলিস ছিলেন… সেটাও একটা কারণ হতে পারে। সেজন্যই ভরসা করছে হয়তো।’
‘মা!’ ডাকল সিনথিয়া ওদের পিছন থেকে। ‘বেণি করে দেবে না চুলগুলো?’
ঘুরে তাকিয়ে সিঁড়িতে দেখতে পেল মেয়েকে রোজমেরি, চুলের ব্রাশ আর ফিতে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ওহ, মামণি!’ বিপন্ন আর্তি ফুটে উঠল মহিলার দৃষ্টিতে। ‘ডিনারের জোগাড়যন্ত্র করতে হবে যে এখন!’
‘আমাকে দাও… আমি করে দিচ্ছি।’ হাত বাড়াল তাহিতি। ‘আমার মেয়েটাকেও বেণি করে দিই আমি।’
নিজের ঝুড়িটা সিনথিয়ার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে শেষ ধাপের আগের ধাপটায় বসে পড়ল তাহিতি। সুবোধ বালিকার মতো তাহিতির সামনে বসে গেল সিনথিয়া পিছন ফিরে।
দেখে, কিচেনের দিকে রওনা হয়ে গেল রোজমেরি।
মেয়েটার হাত থেকে ব্রাশটা নিল তাহিতি। চিরুনি চালাতে শুরু করল ছোট্ট সিনথিয়ার দিঘল চুলে।
‘নাম কী আপনার মেয়ের?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
‘এমিলি,’ বলল তাহিতি পিছন থেকে। ‘তোমারই মতো হবে বয়স।’
‘ওরও কি পছন্দ চুলে বেণি করা?’
‘উম? …হুম। প্রতি রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে বেণি করে দিই আমি।’
লিভিং রুম ছেড়ে সিঁড়িতে এসে বসল এ সময় সিলভিয়া, তাহিতির পাশেই। দেখছে চুলে ব্রাশ করা।
‘আপনি কি সব সময়ই ভূত দেখতে পান?’ জিজ্ঞেস করল সিনথিয়ার বড় বোন।
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ… দেখেন নাকি?’ ছোট্ট মেয়েটাও উৎসুক হয়ে উঠল জানার জন্য। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে।
জড়ো করা চুলগুলো তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে বিনুনি করতে শুরু করল তাহিতি। সূক্ষ্ম একটা হাসি লেগে রয়েছে মুখে।
‘যদ্দূর মনে পড়ে, তখন থেকে,’ জবাব দিল কাজ করতে করতে।
‘কী দেখেছিলেন প্রথম বার?’
‘…একটা আভা।’
‘আভা??’ একসঙ্গে প্রশ্ন করল সিলভিয়া আর সিনথিয়া।
‘সূক্ষ্ম এক ধরনের দীপ্তি, যেটা ঘিরে রয়েছে তোমার শরীরকে…. ‘
‘সবাইকেই?’ জিজ্ঞেস করল কৌতূহলী সিলভিয়া। ‘হ্যাঁ। সমস্ত প্রাণীর শরীর থেকেই নিঃসৃত হয় এই আভা।’
দু’জনের দিকেই তাকাল তাহিতি পালা করে। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল মেয়ে দু’টিকে।
বাই দ্য ওয়ে, তোমাদের দু’জনের শরীর থেকেই কিন্তু চমৎকার আভা ছড়াচ্ছে…’
হাসি ফুটল দুই বোনের মুখে।
সদর দরজাটা খুলে গেল এ সময়। টনি আর পিটার প্রবেশ করল বাড়ির ভিতরে।
‘…হলওয়ের শেষ মাথায় বসাচ্ছি আমি অন্যটা,’ বলল অফিসার টনির উদ্দেশে।
গন্তব্যের দিকে রওনা হচ্ছে, চোখাচোখি হতে স্বামীর উদ্দেশে হাসি পাঠাল তাহিতি।
চলে গেল পারকার। আরও একটা ক্যামেরা ট্রাইপডে সেট করা বাকি হলওয়েতে।
যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছে টনি। কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করছে বাচ্চাদের সামনে।
অনিশ্চিত চেহারা হলো তাহিতির। ছুঁড়ে দিল নীরব জিজ্ঞাসা: কী হয়েছে?
একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল ওর স্বামী। অপেক্ষা করছে স্ত্রীর জন্য।
বাইরে থেকে এসে হলওয়ের দিকে চলল অ্যালবার্ট কুপার।
‘বসো একটা সেকেণ্ড,’ বলল তাহিতি মেয়েদেরকে। উঠে দাঁড়িয়ে পা চালাল ও টনির উদ্দেশে।
‘করছ কী তুমি?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মহিলার স্বামী।
‘কী জানতে চাইছ, টনি?’ পাল্টা ফিসফিসাল তাহিতি।
‘অত মাখামাখির দরকার আছে ওদের সাথে?’
‘স্রেফ বেণি বেঁধে দিচ্ছি আমি, টনি!’
‘কী বলতে চাইছি, ভালো করেই বুঝতে পারছ তুমি।’
‘…হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। চিন্তা কোরো না, টনি। ঠিকই থাকবে সব কিছু। সামান্য এই সাহায্যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
টনির চেহারাই বলে দিচ্ছে, ঠিক নিশ্চিত নয় ও এ ব্যাপারে। কিন্তু আপাতত মাথা ঘামাল না আর বিষয়টা নিয়ে।
‘সেটআপ কমপ্লিট গোলাঘরের?’ জানতে চাইল তাহিতি।
‘হুম। …ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটেছে ওখানে…’
চব্বিশ
হাতে খোদাই করা অলঙ্করণসমৃদ্ধ কাঠের একটা বাক্স নিয়ে লিভিং রুমে এল টনি। দৃষ্টি চলে গেল ওর মাইকেলের দিকে। একটা মনিটরের কনট্রাস্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট অংশে ঝালাইয়ের কাজে ব্যস্ত লোকটা। অন্য মনিটরগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন এলাকা ফুটে উঠেছে বাড়িটার।
‘সব ঠিকঠাক আসছে তো?’ জানতে চাইল টনি।
‘সেলার আর হলওয়ের ক্যামেরাগুলোতে লাগানো ইএফডির সিঙ্ক্রোনাইজেশন বাকি আছে এখনও। ওটা হলেই রেডি হয়ে যাবে যন্ত্র। পাছায় খালি যন্ত্রণা দিচ্ছে এটা!’
শুনে বিকট একটা ভেটকি দিল টনি। কফি-টেবিলটার কাছে গিয়ে হাত থেকে নামিয়ে রাখল বাক্সটা। ভেলভেটে মোড়ানো বেশ কিছু ক্রুশ বের করতে লাগল বাক্স খুলে।
ঘরের নানান জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল টনি ক্রুশগুলো। কাজের ফাঁকে খেয়াল করল, সদর দরজা থেকে ফয়ার পেরোচ্ছে অ্যালবার্ট।
‘ধরতে পারলেন তেল লিকের কারণটা?’ সামান্য গলা চড়িয়ে জানতে চাইল টনি।
‘হ্যাঁহ্,’ জবাব এল অ্যালবার্টের। দেখছে ও ক্রুশগুলো। কৌতূহলভরে চাইল টনির দিকে। ‘এত ক্রুশ কেন?’
‘ভালো মতন একটা ঝাঁকি দিতে চাই আমরা ওগুলোকে, ‘ হেসে বলল টনি। আরেকটা ক্রুশ তুলে নিয়ে স্থাপন করল ও ফায়ারপ্লেসের উপরের ম্যান্টলে। ‘ধর্মীয় প্রতীকের উপস্থিতি সচরাচর কিছু-না-কিছু প্রতিক্রিয়া ঘটায় অশুভ কোনও কিছুর উপরে… খারাপটাই আরকী।’
গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের উপরে স্থান পেল আরেকটা ক্রুশ।
‘ভ্যাম্পায়ারের সামনে পবিত্র যোগচিহ্ন তুলে ধরার মতো?’ আধা-কৌতুকের স্বরে বলল অ্যালবার্ট।
‘ঠিক তা-ই। অবশ্য ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস করি না আমি।’
তথ্যটা অবাক করল অ্যালবার্টকে। বেরিয়ে গেল ও কামরা ছেড়ে।
কফি-টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল টনি, ওখানেও রাখল একটা ক্রুশ।
‘…টনি,’ ডাক দিল মাইকেল।
এমন কিছু ছিল লোকটার গলার স্বরে, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হলো টনি ডায়েসকে।
‘দেখে যাও এদিকে,’ মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই কথা বলছে মাইকেল। ‘নিচের হলওয়ে’
দেখল টনি নির্দিষ্ট মনিটরটায় এসে।
যদিও ফাঁকা দেখাচ্ছে হলওয়ে, তার পরও আস্তে-ধীরে খুলে যাচ্ছে সেলারের দরজাটা!