অদেখা ভুবন – পূর্বকথা

পূর্বকথা

টগবগিয়ে ছুটছে ঘোড়া কর্দমাক্ত, কাঁচা রাস্তাটার বুকে খুর দাপিয়ে। একখানা ওয়াগেন টানছে ঘোড়াগুলো। সদ্য বিশে পা দেয়া জোনা ওয়াইল্ডার রয়েছে চালকের আসনে।

ওয়াইল্ডারের পাশাপাশি রাইড করছে ওরই বয়সী এক র‍্যাঞ্চহ্যাণ্ড।

সময়টা আঠারো শ’র শেষ দিকে।

ছাউনি দেয়া পোর্চঅলা, দ্বিতল একখানা ইংলিশ ধাঁচের ফার্মহাউসের দিকে ছোটাচ্ছে জোনা ঘোড়াগুলোকে। এখনও বেশ দূরে রয়েছে বাড়িটা।

মেইপল আর হিকরি গাছ মাথা তুলেছে খামারবাড়িটার চারপাশে। আবছা আলোর আভাস গোটা কতক জানালায়। ধোঁয়ার মেঘ বেরোচ্ছে ফায়ারপ্লেসের চিমনি দিয়ে। বাড়িটা থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে বড়সড় এক গোলাঘর।

ভয় জাগানিয়া, কালো আকাশের বুক চিরে দিল বিজলির নীলচে শিখা।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে দিগন্তের ওপার থেকে উঁকি দিতে আরম্ভ করল ভোরের সূর্যটা।

সোনালি পকেট-ওয়াচটা বের করে সময় দেখল জোনা। সোয়া পাঁচটা।

ঘড়িটা আবার পকেটে ভরে রাখতেই কিছু যেন শুনতে পেল লোকটা। যেদিক থেকে শব্দটা আসছে বলে মনে হলো, সেদিকটায় ঘুরে গেল ওর মাথা। থেমে গিয়েছিল, তক্ষুনি আবার শোনা গেল আওয়াজটা।

কাঁদছে কোনও শিশু।

খিদের কারণে কাঁদছে বলে মনে হলো না ওয়াইল্ডারের কাছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে যেন ওই চিৎকার।

কষে লাগাম আছড়াল জোনা। পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঘোড়াগুলো। পরক্ষণেই কামান থেকে বেরোনো গোলার মতো ছুটল দ্রুত বেগে। দূরের ওই বাড়িটা ওগুলোর লক্ষ্য।

ওয়াইল্ডারের সহ্যের সীমা যেন ছাড়িয়ে গেছে কান্নার আওয়াজটা। সদর দরজাটার ডান দিকে নিয়ে গেল সে ওয়াগেনটাকে। রাশ টানল সজোরে। গাড়িটা পুরোপুরি থেমে দাঁড়ানোর আগেই লাফিয়ে নামল ওয়াগেন থেকে।

কিন্তু যে মুহূর্তে ফ্রন্ট-পোর্চে উঠে এল, জাদুমন্ত্রের বলে থেমে গেল যেন কান্না।

থামল না জোনা। এগোচ্ছে সে সদর দরজাটার দিকে। হাট করে খুলে দিল পাল্লা।

ধূসর এক ধুমসো বিড়াল ভূতের মতো উদয় হলো কোত্থেকে জানি। ভিতরে পা বাড়িয়েছিল জোনা, আরেকটু হলেই হোঁচট খাচ্ছিল ওটার গায়ে পা বেধে। সামলে নিল কোনও মতে।

বাড়ির প্রবেশ-কক্ষে এসে দাঁড়াল জোনা। তৎক্ষণাৎ ওর মনোযোগ চলে গেল ডান দিকের বৈঠকখানায়। ফায়ারপ্লেসের আগুনের বিচিত্র ছায়া নাচছে সেখানে।

ভয়ের ছায়া পড়ল ওয়াইল্ডারের চেহারায়। স্থির দৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। কী যে দেখছে, নিজেও ঠিক বলতে পারবে না।

ফাটছে কাঠ পটপট আওয়াজে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল ওয়াইল্ডারের। মন্থর পায়ে আরও ভিতরে সেঁধোল বাড়ির। সময় যেন থমকে গেছে বলে মনে হচ্ছে ওর।

অগ্নিকুণ্ডটার যতই নিকটবর্তী হলো জোনা, কমলা আলোর উজ্জ্বলতা বাড়ল ওর চেহারায়। জোরাল হলো কাঠ পোড়ার আওয়াজটা।

আগুনটার ঠিক সামনে এসে থেমে গেল লোকটা। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। ওর পায়ের কাছে, কাঠের মেঝেতে, রক্তের পুকুরের মধ্যে লুটাচ্ছে দীর্ঘ, সরু এক জোড়া উল বোনার কাঁটা!

কী যেন ধরা পড়ল চোখের কোণে। নড়াচড়া একটা। চট করে কিছু একটা সরে গেল কামরার এক জানালার বাইরে দিয়ে।

ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠল ওয়াইল্ডারের চেহারা। ঘুরল ও পাঁই করে। ছিটকে বেরিয়ে এল বাইরের দরজাটা দিয়ে।

পোর্চে পড়েই লাফিয়ে নামল সে ওখান থেকে। এক ছুটে চলে এল র‍্যাঞ্চহ্যাণ্ডের পাশে। চমকে যাওয়া ঘোড়াগুলোকে সামলাতে ব্যস্ত ওর সঙ্গী ছেলেটা।

পায়ে যেন পাখা গজাল ওয়াইল্ডারের। বাড়িটার পাশ ঘুরতেই দেখতে পেল মহিলাকে।

লম্বা, ধূসর পোশাক মেয়েটির পরনে। পা জোড়া খালি। দিঘল চুল কুচকুচে কালো।

সুড়ত করে সেঁধিয়ে পড়ল গোলাঘরে। দড়াম করে পিছনে লেগে গেল দরজাটা।

গোলার দরজায় পৌঁছে গেছে জোনা। খোলার চেষ্টা করল সে দরজাটা। এক চুল নড়ল না পাল্লা।

পাগলের মতো দরজার হাতল ধরে টানতে লাগল লোকটা। কাজ হচ্ছে না। দ্রুত পরীক্ষা করল লকটা আর কবজাগুলো। শেষমেশ নিজেকে ছুঁড়ে দিল দরজার উপরে। কাজে লাগল পদ্ধতিটা। কাঁধের এক ধাক্কাতেই পুরানো কবজা ভেঙে হাট হয়ে খুলে গেল কবাটটা।

ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঢুকে পড়ল জোনা গোলার ভিতরে। ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। শুনতে চেষ্টা করছে কান পেতে।

প্রাগৈতিহাসিক গুহার মতো অন্ধকার গোলাঘরটার ভিতরে। খোলা দরজা থেকে প্রথম কয়েক ফুট পর্যন্ত ভিতরে প্রবেশ করছে কেবল ভোরের আলো।

এক কদম আগে বাড়তে গেল জোনা। কিন্তু এগোনো আর হলো না। কালিগোলা অন্ধকার থেকে সাঁই করে উদয় হলো ভারি এক বেলচা।

ধাম করে ওটার পিছনদিকটা আছড়ে পড়ল জোনা ওয়াইল্ডারের মুখের উপর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *