অদেখা ভুবনের সে

অদেখা ভুবনের সে

কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন

তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব

প্রথম প্রকাশ: ২০১৪

এক

গরমকাল। সেভেন্থ গ্রেড শুরু করব আমি, এ সময় এল চার্লি। বাথরূমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছি, তখনই আমার আয়নার প্রতিচ্ছবি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।

‘হ্যালো, মার্ক!’

জমে গেলাম আমি। ব্রাশটা ঠোঁটের পাশ দিয়ে ঝুলছে। ফুটি-ফুটি দাগে ভরা মুখটা আমার উদ্দেশে হাসতে লাগল।

‘তোমাকে দেখে মায়ানেকড়ের মত লাগছে। মুখ ভর্তি সাদা ফেনা।

‘কে তুমি?’ প্রশ্ন করলাম। পরমুহূর্তে নিজেকে বোকা মনে হলো। কেননা আয়নায় ওটা তো আমারই মুখের চেহারা। কিন্তু আসলে তা নয়।

‘না বোঝার ভান কোরো না, মার্ক। তুমি জানো আমি কে। আমি তোমার ভাই।’

টুথপেস্ট গিলে ফেললাম আমি।

‘চার্লি?’

‘হ্যাঁ!’

মা-বাবা আমাকে চার্লির কথা বলেছে। চার্লস ড্যানিয়েল হেস্টিংস থ্রি, আমার বাবা আর দাদার নামে নাম রাখা হয় ওর। আমার চাইতে দেড় মিনিট আগে জন্মেছিল ও। কিন্তু চার্লি…মারা গেছে। জন্মের পরপরই।

মা-বাবা আমার সাত বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে,

তারপর কথাটা জানায় আমাকে। কিন্তু আমি তার আগেই নানুকে চার্লির প্রশংসা করতে শুনেছি। ও নাকি খুব সুন্দর ছিল দেখতে। একবার নানু আমাকে চার্লি বলে ডাকাতে মার সে কী রাগ! আমি বুঝিনি অত রাগের কী আছে।

মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মা, চার্লি কে?’

তাকে অবাক এবং কিছুটা আতঙ্কিতও দেখিয়েছিল।

‘তুমি এইমাত্র কী বললে, মার্ক?’

‘এই চার্লিটা কে, নানু সব সময় যার কথা বলে?’

মা প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে, কিন্তু সেদিনই পরে একসময় বাবা-মা আমাকে বসিয়ে গল্পটা শোনায়। তারা বলে চার্লি এখন বেহেশতে, এবং সে আমার রক্ষাকারী দেবদূত। ও সব সময় আমার উপর নজর রাখবে, আমার ভাল-মন্দ দেখবে।

এরপর বেশ ক’বারই আমি অনুভব করেছি ও আমার সঙ্গে রয়েছে। ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না, কিন্তু আমি জানতাম আমি একা নই, এবং ব্যাপারটা আমি বেশ উপভোগই করতাম। একবার থার্ড গ্রেডে থাকতে ক্রিস রবিন্স বলেছিল স্কুল ছুটির পর ও আমাকে পিট্টি দেবে। হেঁটে বাসায় ফেরার সময় ভয় পাচ্ছিলাম আমি। হাত ঘামছিল, বুক ধড়ফড় করছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ক্রিস আড়াল থেকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ও অবশ্য দেখা দেয়নি। পরে জেনেছি ও আগেভাগে ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিল টনসিল অপারেশন করাতে।

বাড়ি ফেরার পথে, একটু পরপরই কাঁধের উপর দিয়ে চাইছিলাম আমি। ভান করছিলাম চার্লি আমার সঙ্গে রয়েছে, আমাকে পাহারা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। ও যেন আমাকে অভয় দিয়ে বলছে, ‘আমি তোমাকে দেখে রাখব, মার্ক।’

এখন সত্যি-সত্যি দেখা দিয়েছে চার্লি, আমি ওর মুখে কথা বসাচ্ছি না, কল্পনা করছি না ও এখানে থাকলে কী বলত। না। ও আসলেই রয়েছে এখানে।

‘সারাদিন এভাবে সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’

আয়নায় আমাকে ভেঙাতে লাগল ও। আমার হাঁ-মুখ নকল করছে, আমার চোখ রসগোল্লা বানাচ্ছে…দুঃখিত, আমার নয়, ওর।

কপাল ভাল, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যখন গেলাম ব্যথা পাইনি।

.

এর ক’সপ্তাহ পরের কথা। আমি আমার বন্ধু কিশোর পাশার বাসায় রাত কাটাচ্ছি। ওর সঙ্গে রবিন, মুসা আর ডুগি রয়েছে। আমরা পিৎসা অর্ডার দিয়েছি, ভিডিও গেমস খেলেছি এবং ফ্রাইডে নাইট ক্রিয়েচার ফিচার্সে বোকা-বোকা এক ডাইনোসর মুভি দেখেছি।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। কিন্তু ওদেরকে যে কোনও কারণেই হোক আমি চার্লির কথা বলিনি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটাও নয়। কিন্তু আমি ব্যাপারটা ভাবছি। গভীরভাবে ভাবছি।

‘এই ডাইনোসরগুলো দেখতে মোটেও আসলের মত নয়,’ আবারও অভিযোগ করে বলল মুসা।

‘মুসা, ভ্যাজর ভ্যাজর না করে সিনেমাটা দেখলেই তো পারো, ‘ বিরক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।

ন’টার দিকে ছবি শেষ হলো, এবং কে যেন-সম্ভবত ডুগি-ভূতের গল্পের প্রসঙ্গ তুলল।

আমরা বেসমেন্টের বাতিগুলো বন্ধ করে জড় হয়ে বসলাম। পুল টেবিলের উপর বুদ্ধাসনে বসেছি আমরা। এক কোণে গুনগুন করছে রেফ্রিজারেটরটা। অ্যাকুয়ারিয়ামের ভুতুড়ে নীল আলোয় ভাসছে ঘরটা। ওটাও মৃদু শব্দ করছে।

রবিন শুরু করল। চিবুকের নীচে ফ্ল্যাশলাইট ধরে নিজেকে ভৌতিক করে তুলল।

‘তা হলে শুরু করি…’ বলল রবিন।

‘মাছ ধরতে গিয়ে ভূতের পাল্লায় পড়ার গল্পটা তো?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

‘না। চুপ করে শোনো। এটা সত্যি ঘটনা। রিটা হাওয়ার্থের বড় বোনের কলেজে ঘটেছিল। আরেক মেয়ের সাথে ডর্মে থাকছিল ও। এক দিন লাইব্রেরিতে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে, কারণ পরদিন বড় একটা পরীক্ষা ছিল।’

‘কী ধরনের পরীক্ষা?’ কিশোর জানতে চাইল।

‘জানি না…অঙ্ক পরীক্ষা বা অন্য কিছু। সেটা কোনও ব্যাপার নয়, বুঝেছ? যা ঘটেছিল-গভীর রাত, ডর্মে হেঁটে যেতে ভয় পাচ্ছিল ও, কারণ এক পলাতক ম্যানিয়াক এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল…’

‘আবার সেই খুনের গল্প,’ বলে উঠলাম আমি।

‘গল্পটা বলতে দেবে, নাকি দেবে না?’

‘সরি, বলো,’ বললাম।

রবিন মুখের কাছ থেকে ফ্ল্যাশলাইট সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কোথায় ছিলাম ভুলে গেছি। এত বাধা দিলে হয়?’

‘এক পলাতক ম্যানিয়াক এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল,’ জুগিয়ে দিল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ বলল রবিন।

রবিন বুক ভরে শ্বাস টেনে বলে চলল।

‘ডর্মে ফিরে নিজের রূমে যায় ও। কিন্তু রুমমেটের ঘুম ভেঙে যাবে বলে বাতি জ্বালেনি। আঁধার ঘরে জানালা দিয়ে এক চিলতে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। রুমমেট এক পাশে কাত হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে…

ডুগির দিকে চোরা চাউনি বুলালাম। হাত কচলাচ্ছে ও। মুসার চোখজোড়া বিস্ফারিত। কিশোর একদৃষ্টে চেয়ে রবিনের দিকে।

‘পা টিপে-টিপে ঘরে ঢোকে ও, জিনিসপত্র রেখে আঁধারে পাজামা খুঁজে নেয়। বিছানায় উঠতে যাবে, এ সময় শুনতে পেল…ঘরের ওপাশ থেকে খসখসে একটা শব্দ আসছে। ‘লিসা,’ রুমমেটকে ফিসফিসিয়ে ডাকল। ‘লিসা’…জবাব পেল না।

‘ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না ও। ভাবল ঘুমের মধ্যে উসখুস করছে লিসা। বাতি জ্বালতে চাইল। সব কিছু ঠিক আছে কি না শিয়োর হওয়ার জন্যে। কিন্তু এটাও জানে ঘুম ভেঙে গেলে খেপে উঠবে লিসা। মেয়েটার ঘুম খুব পাতলা।

‘কাজেই শুয়ে থাকল ও, চিবুক পর্যন্ত চাদর টেনে। শব্দটা আবারও শোনার চেষ্টা করল, পেল না। জানালার বাইরে শুধু ঝিঁঝির ডাক।

‘ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায়…এ সময় আবার। খসখসে একটা শব্দ। শুনে মনে হলো লিসার বিছানার তলা থেকে আসছে।’

‘ইঁদুর-টিদুর আরকী, বলল কিশোর।

‘রবিন, তুমি বলো,’ বলল ডুগি। ‘গল্পটা জমে উঠেছে।’

কথার খেই ধরল রবিন।

‘বাতি জ্বালার ইচ্ছা, কিন্তু ভয়ে জ্বালল না, কী না কী দেখে। তাই চুপ করে শুয়েই রইল। কান খাড়া। অপেক্ষা করছে। শ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছে। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ল….

‘খাইছে, কী ঘটল তা তো বললে না,’ কাঁপা গলায় বলল মুসা।

‘পরদিন সকালের রোদ গায়ে মেখে ঘুম থেকে উঠল ও। গত রাতের কথা ভুলেই গেছে। দিনের আলোয় আর ভয় কী…তেমনটাই ভাবল।’

এ সময় চলন্ত এক গাড়ির হেডলাইটের আলো বেসমেন্টের ছোট এক জানালা গলে ঢুকে আমাদের ভাসিয়ে দিল। সবার আত্মা চমকে উঠল। আমার অন্তত।

‘তারপর?’ জানতে চাইল ডুগি।

রবিন শিউরে উঠে বলে চলল।

‘বিছানায় এক গড়ান দিয়ে ঘরের ওপাশে চোখ রাখল। চোখ সয়ে আসতে দু’মুহূর্ত সময় লাগল। তারপর দেখতে পেল ওটাকে।’ রবিন হঠাৎই গলা চড়িয়ে বলে উঠল, ‘ওখানে!’

আচমকা বাতিগুলো জ্বলে উঠল। ডুগি আর্তনাদ ছেড়ে কামরার ওপ্রান্তের কর্কের বুলেটিন বোর্ডটার দিকে তর্জনী তাক করল। বড়, বড়, লাল অক্ষরে ওতে লেখা: ‘বাতি না জ্বেলে ঠিক করেছিলে, তাই না?’

দুই

‘খাইছে!’ মুসা অস্ফুটে বলে উঠল।

ডুগি সোজা হাঁটা ধরেছিল সিঁড়ির দিকে, কিন্তু রবিনের হাসির শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিশোরকে দেখলাম পুল টেবিল আর লাইট সুইচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দে কর্কের বুলেটিন বোর্ডটার কাছে হেঁটে গেল, লেখাটার উপরে একটা আঙুল রেখে গন্ধ নিল।

‘লিপস্টিক,’ বলল।

রবিন পেটের এক পাশ চেপে ধরে হাসছে।

‘কেমন বোকা বানালাম?’

‘আমরা সারা দিন প্ল্যান করে এটা করেছি,’ জানাল কিশোর। খুব ভয় পেয়েছ, তাই না?’

এ সময় সিঁড়ির দরজাটা খুলে গেল। মেরি চাচী দাঁড়িয়ে। উঁকি দিচ্ছেন আমাদের দিকে।

‘কী হচ্ছে এখানে?’ জানতে চাইলেন।

‘এই একটু মজা করছি আরকী, চাচী,’ বলল রবিন।

মেরি চাচী ডুগিকে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনলেন।

‘তুমি তো দেখি কাঁপছ, ডুগি,’ বললেন।

‘আমি ঠিক আছি,’ বিড়বিড় করে বলল ডুগি। ‘আমি ভয় পাইনি,’ শেষের কথাগুলো বলল রবিনকে উদ্দেশ্য করে।

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি,’ ব্যঙ্গ করে বলল রবিন।

মুসা কামরার ওপাশে হাতড়াচ্ছে, ঠোকর খাচ্ছে এটা-সেটার সঙ্গে।

‘মুসা, শান্ত হও, ভয়ের কিছু নেই,’ বললেন চাচী।

‘আমরা ভূতের গল্প করছিলাম,’ বলল কিশোর। বুলেটিন বোর্ড থেকে লিপস্টিকের লেখাটা মুছে ফেলল।

‘ভূতের গল্প কেউ সিরিয়াসলি নিয়ো না,’ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন চাচী, কোমরে দু’হাত রেখে। ‘ভূত-টুত বলে কিছু নেই।’

মেরি চাচী উপরে চলে গেলেন এবং আমরা সবাই আবার স্বাভাবিক হলাম। আমি আরও ভিডিও গেমস খেলার প্রস্তাব করলাম, কিন্তু ডুগি রবিনের কাছে হার মানতে রাজি নয় বলে মনে হলো।

‘আমি একটা গল্প বলব,’ বলল ও।

‘মার্ক ঠিকই বলেছে, আমরা বরং ভিডিও গেমস খেলি,’ বলতে গিয়ে ভেঙে গেল মুসার গলা। ‘ভূতের গল্প আর ভাল্লাগছে না।’

‘ভয় পাচ্ছ?’ বাঁকা হেসে বলল ডুগি।

‘ন-না। ভয় পাচ্ছি না। বিরক্তি ধরে গেছে,’ জানাল মুসা। ‘হুঁ, ভয়ে কাঁপছ সে কথা বলো না কেন?’ বলল ডুগি।

‘বাদ দাও, ডুগি। কেউ তোমার পচা গল্প শুনতে চায় না,’ বললাম আমি।

‘এটা গল্প নয়। এক ধরনের পরীক্ষা। তোমরা মে ওয়ার্থের নাম শুনেছ?’

কিশোর বলল, ‘মে কে?’

চোখ ঘুরাল রবিন।

‘আয়নার গল্পটা তো?’ বলল।

কেউ কি ‘আয়না’ বলল? আমি আর আয়নার দিকে তাকাই না। আমি জানি আমি দেখতে কেমন। মা কি আমাকে ডাকছে? উঠে পড়ব?

কিন্তু আমরা পুল টেবিলের উপরে গোল হয়ে বসা। বাতি নিভু- নিভু। ডুগি ব্যাখ্যা করছে, শুনছি আমরা। মে ওয়ার্থ নামের মহিলাটি প্রায় একশো বছর আগে বেঁচে ছিল। তখন পাড়ায় ছিল ভুতুড়ে সব প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান দালান, আর রাস্তায় চলত ঘোড়ার গাড়ি। মহিলা ডাকিনীবিদ্যা চর্চা করত, মারা গেছিল, তারপরও নাকি তাকে দেখা যেত।

রাশেদ চাচা আর মেরি চাচী উপরতলায় টিভিতে কোন্ অনুষ্ঠান দেখছেন কে জানে। কারও সঙ্গ পেলে হয়তো তাঁদের ভাল লাগত। যাব নাকি?

ডুগি বলছে, ‘তুমি কোনও আয়নার দিকে তাকিয়ে যদি তিনবার বলো, ‘আমি মে ওয়ার্থকে বিশ্বাস করি’, তা হলে তার প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে।’

‘বাজে কথা, বলল কিশোর।

‘সত্যি,’ জোর দিয়ে বলল ডুগি। ‘আমাদের ক্লাসের জেনিফার চেষ্টা করেছে। কাজও হয়েছে।’

ধীরে-ধীরে আমাদের সব ক’টা মাথা ঘুরে গেল কোনার বাথরূমের দরজাটার দিকে।

রবিন বলল, ‘যে চেষ্টা করবে তাকে এক ডলার দেব।’

পরস্পর মুখ তাকাতাকি করলাম আমরা। কারও মুখে কথা নেই। ‘কী ব্যাপার?’ প্রশ্ন করল ডুগি। ‘কেউ না?’

‘তুমি করছ না কেন?’ ওর কোর্টে বল ছুঁড়ে দিলাম। ‘তুমিই তো এটা আমদানী করেছ।’

‘আমরা সবাই করব,’ বলল কিশোর। কিন্তু তার আগে লটারি করা হবে।’

সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল ও। ক’মিনিট বাদে এক মুঠো পুরানো নাম্বার ২ পেন্সিল নিয়ে ফিরে এল।

ডুগি একটা পেন্সিল তুলে নিল। দেখে আবার রেখে দিল।

আমরা পেন্সিলগুলো ভেঙে ফেললাম। তারপর পুরানো এক স্কুলবক্সের ভিতরে রেখে ঝাঁকি দেয়া হলো। রবিন সবার সামনে বাক্সটা ধরল। আমাদেরকে না তাকিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তুলতে হবে। আমরা জোড়া বেঁধে যাব ঠিক করলাম। যারা সবচাইতে ছোট টুকরো দুটো পাবে তাদেরকে আগে যেতে হবে।

কারা গেল?

বাথরূমের আয়নার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর মুসা। দরজা বন্ধ। ওপাশ থেকে ওদের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ফিসফিস করে কথা বলছে।

‘ফালতু ব্যাপার,’ ওদেরকে শোনানোর জন্য গলা চড়িয়ে বললাম। ‘কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?’

‘যতক্ষণ না মে ওয়ার্থকে দেখছ,’ পাল্টা চেঁচাল কিশোর। ‘ওকে চিনব কীভাবে? কেমন দেখতে তা-ও তো জানি না।’ ভয়টাকে দমাতে আসলে এসব কথা বলছি আমি।

‘তুমি ঠিক আছ তো, মুসা?’ শব্দ পাচ্ছি আঁধারে দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে ওর।

‘আমি দেখব না, দেখব না…’ বারবার একই কথা আওড়াচ্ছে ও কর্কশ, ফিসফিসে সুরে—কাঁপছে।

‘ও, হ্যাঁ,’ চেঁচালাম আমি। ‘এই যে, দেখতে পাচ্ছি। কী ভয়ঙ্কর! এবার বেরিয়ে আসি?’

‘শব্দগুলো শুনতে চাই আমরা,’ চেঁচিয়ে বলল কিশোর, ‘না বললে ও আসবে না।’

আমি ব্যাপারটা শেষ করতে চাই, কাজেই বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললাম। ঝটপট। তিনবার।

‘আমি মে ওয়ার্থকে বিশ্বাস করি…আমি মে ওয়ার্থকে বিশ্বাস করি…আমি মে ওয়ার্থকে বিশ্বাস করি…

আয়নার দিকে চেয়ে দম বন্ধ করে থাকলাম। অপেক্ষা করছি। বৃথা। মাত্র দুটো মুখ। আমার আর… মুসার মাথার উপরের অংশ। মাথা নুইয়ে রেখেছে ও, চিবুক বুকের কাছে, চোখ বন্ধ। সব কিছু স্থির, শুধু ফসেটের একটানা পানি পতনের শব্দ।

‘দেখতে পাচ্ছ?’ ফিসফিস করে বলল মুসা। ‘দেখতে পাচ্ছ?’

আমার প্রতিবিম্ব আমার দিকে চেয়ে পাল্টা হাসল।

‘চোখ খুলতে পারো, মুসা। ও এখানে এসে থাকলেও এখন আর নেই।’

মে ওয়ার্থের সেখানেই ইতি।

.

সে রাতে, বেসমেন্টে স্লিপিং ব্যাগে ক্যাম্প করলাম আমরা। রবিন আর ডুগি ঘুমাল কিশোরের ঘরে। সব কিছু স্বাভাবিক। এমনকী মুসার নার্ভও শান্ত হয়ে এসেছে। কাঠের গুঁড়ির মতন ঘুমাল ও। আর কিশোর নাক ডাকল সি লায়নের মত।

আমি জেগে রইলাম, কিশোরের মাছগুলোকে ট্যাঙ্কের ভিতরে সাঁতরে বেড়াতে দেখলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ, তাই উঠে বাথরূমে গেলাম পানি খেতে। ফসেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজের কাপ ভরছি।

‘হ্যালো, মার্ক।’

হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল। পাজামার সামনেটা ভিজে গেল পানির ছিটে লেগে। চার্লি আয়নার ভিতর থেকে আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। হাত তুলে আঙুল কিলবিল করছে।

‘কে এই মে ওয়ার্থ?’ বলল ও।

তিন

ও যেমন দ্রুত এসেছিল তেমনি চট করে উধাও হয়ে গেল সে রাতে। কিন্তু ওর দেখা পেতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না।

পরদিন সকালে বাড়ি ফিরলাম। আয়নার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে থাকলাম। কথা বললাম নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে।

‘ফিরে এসো, চার্লি। ফিরে এসো। আমি আর ভয় পাচ্ছি না। আমি কথা বলতে চাই। তোমাকে অনেক প্রশ্ন করার আছে আমার!’

কিন্তু ও দেখা দিল না।

মা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি সুস্থ আছি কি না।

‘জ্বর নেই,’ কপালে হাত রেখে বলল।

‘আমি ভাল আছি। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।’

‘বল না।’

‘চার্লি সম্পর্কে।’

মার কপালে ভাঁজ পড়ল। ধপ করে বসে পড়ল আমার বিছানার এক কোণে।

‘বল।’

‘তুমি কি শিয়োর…?’

অপেক্ষা করল মা। ‘কোন্ ব্যাপারে?’

‘কিছু না। এমনি।’

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানল। ‘তোর সমস্যাটা কী আমাকে বল, মার্ক।’

কী বলব বুঝে পেলাম না।

‘আমি আরকী…আজকাল ওর কথা খুব বেশি ভাবছি।’

‘আমিও ভাবি। রোজই।’

আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল মা। চিবুক দেখাল জানালার দিকে।

‘দেখ। সূর্য ডুবছে দেখতে পাচ্ছিস?’

মার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনের উঠনের দিকে চাইলাম। ওয়েদার ভেন আর বার্ড ফীডার শেডের ছাদে অদ্ভুত শোভা সৃষ্টি করেছে। হাজার বার ওদিকে চেয়েছি, কিন্তু কখনও মন দিইনি।

‘দেখ কী সুন্দর,’ বলল মা। ‘মন দিয়ে দেখলে সব রং দেখতে পাবি। মন কেড়ে নেবে। তারপর দেখবি নেই।’

মার দিকে চাইলাম।

‘ব্যাপারটা রোজ রাতে ঘটছে, মা।’

‘আমি বলতে চাইছি প্রকৃতির চরিত্র অপূর্ব সুন্দর। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী, তারপর চলে যায়। চার্লির মতন।’

সূর্যাস্তের দিকে আবারও চাইলাম। দ্রুত ডুবছে, শেডের আর বেড়ার আড়ালে। আঁধার ঘনাচ্ছে। এবার হারিয়ে গেল ওটা।

আমি বাইকে করে স্কুলে যাব। গরমকালে ট্রায়াল দিয়েছি আমরা, রেইলরোড ট্র্যাকের পাশ দিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরে বাইক চালিয়েছি।

সকালে তৈরি হয়ে নাস্তা সারলাম। আয়নায় চার্লিকে দেখা যায় কি না দেখলাম। অভ্যাস হয়ে গেছে।

কিশোরকে পেলাম ফ্লেচার পার্কে। বাইকে চেপে বাস্কেটবল কোর্টে চক্রাকারে ঘুরছিল।

‘চলো যাওয়া যাক,’ বললাম। ‘এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে।’

ওকে দেখার আগে ওর গলা শুনলাম।

‘অ্যাই যে তোমরা।’

জমে গেলাম। বুকের ভিতরে ধড়াস করে উঠল।

‘তোমরা চলে যাও! এখুনি!’

বাবল-আই, পার্কের পাহারাদার। আমরা ওকে এ নামে ডাকি কারণ ওর একটা চোখ অন্যটার চাইতে বড়। ও রেগে গেলে কার্টুন ছবির চরিত্রের মতন জুলজুল করে চোখটা। ওকে অন্য কোনও রূপে দেখিনি আমি। আগুন-ওগরানো দানোর মত ছোট অফিসটা থেকে ধেয়ে আসে সে, বড় ছেলেরা যারা স্লাইড আর সুইঙে চাপে তাদেরকে তাড়া করে। বারো বছরের বেশি বয়স হলে ওগুলোতে চড়া নিষেধ। সাইন লাগানো রয়েছে। কিংবা কখনও হয়তো দেখা যায় বাস্কেটবল কোর্টে বাইক চালানোর দায়ে ধাওয়া করছে ছেলে-মেয়েদের। ওটাও আরেকটা সাইন-সঙ্গে রয়েছে থুথু ফেলা, গালাগালি করা, এবং পানির ফোয়ারা থেকে পোষা কুকুরদের পানি পান নিষেধ।

বাবল-আই সোজা আমাদের দিকে ধাঁই-ধাঁই করে এগিয়ে আসছে। হাতে ময়লা সরানোর বড় লাঠিটা।

‘তোমরা পড়তে জানো না? বাইক এনেছ কেন? দূর হও!’

কিশোর আর আমি আর কালবিলম্ব করলাম না। বাইকে প্যাডেল মেরে পাঁই-পাঁই পালালাম।

‘ধরতে পারলে পিঠে লাঠির বাড়ি পড়ত,’ নিরাপদ দূরত্বে সরে আসার পর বলল কিশোর।

‘হ্যাঁ,’ সায় জানিয়ে বললাম আমি।

দুই সারি রেলপথ দু’দিকে পাশাপাশি চলে গেছে। হলিস্টার টানেলের ভিতর দিয়ে কয়েক মাইল বিস্তার পেয়েছে। কিশোর এক পাশে আর আমি অন্য পাশে বাইক চালাচ্ছি।

‘যদি দুটো ট্রেন আসে?’ বলল কিশোর। ‘একটা এদিক থেকে আর একটা পিছন দিয়ে। কী করবে তুমি?’

‘সরে যাব।’

‘যদি সময় না পাও?’

ব্যাপারটা উল্টেপাল্টে ভেবে শিউরে উঠলাম।

‘দুই লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ব।’

কিশোর মাথা নেড়ে চোখ ঘুরাল।

‘তা হলে মারা পড়বে। ট্রেনে কাটা পড়ে। আমার এক আত্মীয় রেইলরোডে চাকরি করে, সে বলেছে ট্রেন তোমাকে নীচে টেনে নেবে। অসম্ভব শক্তি কি না।

আমাদের সামনে হলিস্টার টানেল হাঁ করে রয়েছে, গিলে খাওয়ার অপেক্ষায়…কিংবা হয়তো ঢেকুর তুললেই কোনও ট্রেন বেরিয়ে আসবে। হঠাৎই এই শর্টকাটটা সম্পর্কে খারাপ অনুভূতি হলো আমার।

কিশোরের দিকে ঘুরে চাইলাম।

‘বিপজ্জনক মনে হচ্ছে,’ বললাম।

‘চিন্তা কোরো না,’ বলল ও। ‘আমার আত্মীয় রেইলরোডে কাজ করে। আমার কাছে শিডিউল আছে। সোম, বুধ আর শুক্রবার সকালে ট্রেন চলে না।’

‘সত্যিই!’

‘হ্যাঁ।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম আমরা। তারপর প্রশ্ন করলাম কিশোরকে, ‘কিশোর, যমজ ব্যাপারটা কীরকম জানা আছে তোমার?’

‘কেন?’

শ্রাগ করলাম।

‘এমনি।’

আমার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল কিশোর।

‘তুমি আজকাল কেমন যেন অন্যরকম আচরণ করছ,’ বলল ও। কী বলব বুঝলাম না। ওকে চার্লির কথা জানাব? বেশ কিছুদিন ওকে দেখি না। হয়তো চলে গেছে। থাক, দরকার নেই।

‘এসো,’ টানেলের কাছে এসে বললাম আমি। ‘রেস দিই।’

‘ঠিক আছে, চালু।’

প্যাডেল মেরে গতি তুললাম দু’জন। সোজা ঢুকে পড়লাম আঁধারের রাজ্যে। মুখে ঝাপটা মারছে বাতাস। দাদুর সঙ্গে একবার টানেলের ভিতর দিয়ে মাছ মারতে উইলো ক্রীকে গিয়েছিলাম। জায়গাটা এখান থেকে দু’শো গজ দূরে। দাদু মারা গেছেন। উনি কি বেহেশতে আছেন? চার্লিও কি আছে সেখানে?

আমি এসব চিন্তায় মগ্ন এসময় মাটিতে সামান্য কাঁপুনি টের পেলাম। প্রথমটায় তেমন একটা মাথা ঘামালাম না। এবার টানেলটা জোরে কাঁপতে শুরু করল। কিশোরের আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম: ‘ট্রেন! হায়, খোদা! মাৰ্ক, ট্রেন!’

চার

বুকের ভিতরে রক্ত চলকে উঠল। একই সঙ্গে হুইসলের শব্দ পেলাম। তীক্ষ্ণ শব্দটা ক্রমেই জোরাল হলো। কাঁধের উপর দিয়ে চাইতেই দেখতে পেলাম টানেলের মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আঁধার ভেদ করে আলোর আভা দেখা যাচ্ছে।

‘জোরে,’ চেঁচাল কিশোর। ‘জোরে!’

আমরা সুড়ঙ্গের মাঝামাঝির চাইতে সামান্য আগে রয়েছি। খোলা মুখটার শেষ প্রান্ত, প্রথমে খুদে এক আলোর চক্র, বড় হয়ে উঠেছে, নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে ওপাশে। সজোরে প্যাডেল চাপলাম। পা ব্যথা করছে, এক্সিটের দিকে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে চলেছি।

আমার চাকায় কিছু একটা আটকাল! না প্যাডেলে, গতি কমিয়ে দিল। ডান দিকে কিছু একটা টানছে আমাকে–..মনে পড়ল কিশোরের কথাগুলো। ট্রেন তোমাকে নীচে টেনে নেবে। অসম্ভব শক্তি কি না।

আতঙ্কিত আমি এক পাশে ঢলে পড়লাম, সুড়ঙ্গের দেয়ালে ধাক্কা খেলাম। এ সময় টের পেলাম আমার জুতোর ফিতে জড়িয়ে গেছে ডান প্যাডেলে। আর রক্ষে নেই, আমি শেষ। ট্রেন আমাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। আর্তচিৎকার করতে লাগলাম।

কিশোর ইতোমধ্যে সুড়ঙ্গ থেকে সরে গেছে। আমার নাম ধরে ডাকছে শুনলাম।

‘মার্ক! মার্ক! কোথায় তুমি?’

ট্রেনটা ক্রমেই কাছিয়ে আসছে, তাপ অনুভব করছি, গন্ধ লাগল নাকে। এ সময় পায়ে টান অনুভব করলাম। চার্লি আমার পাশে গুটিসুটি মেরে বসা। আমার জুতো চেপে ধরে রেখেছে। হ্যাঁ, চার্লি।

‘দৌড়াও,’ চেঁচাল ও। ‘দৌড়াও!’

উঠে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলাম। মুখে আছড়ে পড়ল সূর্যকিরণ। পিছনে হুইসল শুনতে পেলাম। কানে তালা লেগে গেল। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ধাতব কোনও কিছু। আমার সাইকেলটাই হবে। আমি ডান দিকে পড়ে গিয়ে লম্বা ঘাসের বুকে গড়িয়ে গেলাম। প্রায় বিশ সেকেণ্ড বাদে, সগর্জনে পাশ কাটাল ট্রেনটা—ভয়ঙ্কর কোনও দানবের মত।

সটান উঠে দাঁড়ালাম। সারা শরীর ঘামে জবজবে। গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। ট্রেনটা ঝম ঝম করে চলে গেল, বগিগুলোর মাঝখানের ফাঁক দেখতে পেলাম এক ঝলকে। কিশোর ওপাশে দাঁড়িয়ে। পঞ্চাশ ফীট দূরে।

‘মার্ক! তুমি বেঁচে আছ!’ চিৎকার করে উঠল সে। নিজেও কাঁপছে।

ভূতগ্রস্তের মত টলতে টলতে পা বাড়ালাম। আমার পায়ে মাত্র এক পাটি জুতো।

.

ক’দিন বাদে, সযত্নে আয়না পরীক্ষা করলাম। চার্লির জন্য নয়, আমার মাথার চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে কি না দেখতে। হয়নি। অন্তত এখন অবধি নয়। ট্রেনের ঘটনাটায় চুল পেকে যেতে পারত।

বলাবাহুল্য, ঘটনাটা শুনে বাবা-মা মুষড়ে পড়েছে। নতুন সাইকেলটা এবং নতুন ব্যাকপ্যাকটা হারিয়েছি আমি। ব্যাপারটা সুখকর নয়।

‘আমি তোকে হাত ধরে বাস স্টপে নিয়ে যাব,’ বাবা বলেছে। ‘তোকে আর বাইক চালাতে দেব না।’

প্রায় এক সপ্তাহ লাগল ঘোর কাটতে। স্কুলে নানাজন এ ঘটনার নানা ব্যাখ্যা দিল। রং চড়ানো গল্পগুলোর কোনওটিই সত্যের কাছাকাছি নয়। ওরা জানবে কী করে আমার যমজ ভাইয়ের ভূত আমার জীবন বাঁচিয়েছে? বাবা-মা ঠিকই বলত। চার্লি আমার রক্ষাকারী দেবদূত।

.

হ্যালোইনের এক সপ্তাহ বাকি। স্কুল ক্যাফেটেরিয়াতে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে বসে ছিলাম। টেবিলে আমরা তিনজনই শুধু। মুসার জল বসন্ত হয়েছে। ও এক সপ্তাহ ধরেই গরহাজির।

কথায় কথায় রবিনের আমাণ্ডা খালার কথা উঠল। তিনি কাছে- পিঠে এক প্রাচীন বাড়িতে থাকেন। জিপসিদের মতন গয়না পরেন, আর ট্যারট কার্ড পড়ে স্থানীয় মেলায় মানুষের ভাগ্য গণনা করেন। এই সপ্তাহান্তে একটা মেলা আসছে।

আমরা ঠিক করলাম আমাণ্ডা খালার কাছে যাব। সামনে আরও কোনও বিপদ-আপদ আছে কি না জানতে।

ঘণ্টা বাজল। আমরা ক্লাসে যাওয়ার জন্য বই-পত্র গুছিয়ে নিলাম। আচ্ছা, আমাণ্ডা খালা কি চার্লির কথা জানেন? তিনি যদি জানেনও, আমি কি জানতে চাইব?

.

সিক্সথ পিরিয়ড। স্পেশাল স্টাডি ক্লাসে বসে বোস্টন টি পার্টি নিয়ে মিসেস হ্যামিল্টনের একঘেয়ে বক্তৃতা শুনে যাচ্ছি। দুই সারি সামনে টিমি ক্যাম্পবেল ডেস্কে মাথা রেখে, নোটবুকে লালা ঝরাচ্ছে। ভাবতেও পারিনি এ সময় ঘরের পিছন দিকের কাঁচের দরজার শার্সির আড়াল থেকে উঁকি দেবে চার্লি।

আমাকে ভেংচি কাটছে ও, জিভ বের করে দেখাচ্ছে, চোখ ট্যারা করছে। কাঁচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে রেখেছে ও, কিন্তু ‘ অবাক কাণ্ড—কাঁচে শ্বাস-প্রশ্বাসের ছাপ পড়ছে না। এবার ভয়ঙ্কর এক কাজ করল ও; এক পাশে ঘাড় কাত করে মাথার উপরে অদৃশ্য এক দড়ি ধরে থাকল, ভঙ্গিটা এমন যেন গলায় ফাঁস নিয়েছে। চোখজোড়া ঠেলে বেরিয়ে আসছে, জিভ ঝুলে পড়েছে আধ হাত।

রক্ত জমাট বাঁধার দশা আমার। হিমস্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। আমার টেক্সটবইটা ডেস্কের কিনারা দিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল।

সবাই চমকে তাকাল আমার দিকে। টিমি ক্যাম্পবেল ডেস্ক থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। আবোল-তাবোল বকতে লাগল ও।

‘আমি উঠে পড়েছি, মা! উঠে পড়েছি!’

কামরার সামনে থেকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন মিসেস হ্যামিল্টন।

‘কোনও সমস্যা? মার্ক?’ প্রশ্ন করলেন।

অনুভব করলাম ত্রিশজোড়া চোখ বিদ্ধ করছে আমাকে।

‘আমি কি একটু টয়লেটে যেতে পারি?’ বললাম।

‘যাও। জলদি এসো, চশমা খুলে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন মিসেস হ্যামিল্টন।

শশব্যস্তে তাঁর ডেস্কের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে একটা হল পাস দিলেন। টিমি ক্যাম্পবেল এখন পুরোপুরি সজাগ। হাত তুলল সে-ও।

‘আমারও যাওয়া দরকার,’ জানাল।

‘মার্ক ফিরুক তারপর যাবে। আমরা যেন কোথায় ছিলাম?’

হল-এ পা রাখলাম আমি। পিছনে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। চার্লিকে খুঁজলাম। নেই ও, চলে গেছে।

‘এই যে, মার্ক, এদিকে।

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম। গাঢ় সোনালি একটা মাথা উঁকি দিচ্ছে হলের শেষপ্রান্তের কোনা দিয়ে। খিলখিল করে হেসে উঠল চার্লি!

পাঁচ

হলটা ফাঁকা। শুধু ও আর আমি।

ওকে ধাওয়া করলাম। বাঁক ঘুরতেই কিঁচ করে উঠল স্নিকার্স। থমকে দাঁড়াল ও। আমাকে কয়েক ফীট এগোতে দিল। তারপর ঘুরেই দিল দৌড়। ও বয়েয রূমে ঢুকে পড়ার সময় খিলখিল হাসির শব্দ পেলাম।

ওর পিছনে ডাইভ দিলাম। ওকে পালাতে দেব না। বাথরূম শূন্য দেখে খিস্তি করলাম। স্টলগুলো নিরীখ করলাম, আয়নাটা!…বৃথা। আমাকে ফাঁকি দিয়েছে চার্লি।

‘বু!’

দু’ফীট লাফিয়ে উঠলাম, বোঁ করে ঘুরে গেলাম গোড়ালির উপরে। হ্যালো, মার্ক।’

ও ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে। হাসছে। ডান হাত থেকে ঝুলছে এক ইয়ো-ইয়ো। একদম বাস্তব দেখাচ্ছে ওকে। ফ্যাকাসে, কিংবা স্বচ্ছ নয়—যেমনটা দেখা যায় কার্টুন কিংবা কমিক বইতে। রক্ত-মাংসের তৈরি মানুষ মনে হচ্ছে। পরনে আমার পোশাক। আমি যেন আয়না দেখছি।

‘বোকার মত সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’ বলল ও।

‘চা-চার্লি?’

‘না, মে ওয়ার্থ!’ খিলখিল করে হাসতে লাগল ও। ‘তোমার বন্ধু- বান্ধবগুলো সত্যিই চিড়িয়া একেকটা।’

‘তুমি এখানে কী করছ?’

ওর চোখজোড়া ইয়ো-ইয়োর উপর স্থির।

‘তোমাকে দেখতে এসেছি।’

‘কিন্তু কেন?’

আমার চোখের দিকে চাইল ও।

‘সেদিন রেইলরোডে আমি থাকাতে তোমার ভাল হয়েছে।’ ভাবনাটা মাথায় আসতেই শিউরে উঠলাম

‘হ্যাঁ, ধন্যবাদ…মনে হয়।’

আমাকে ভেঙাল ও। ‘ধন্যবাদ, মনে হয়…’

আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল ইয়ো-ইয়োটা। লাল রঙা, সামনে নকশা করা। এমনটা আমি আগে দেখিনি।

‘কোথায় পেয়েছ ইয়ো-ইয়োটা?’

‘এটা দাদুর।’ এমনভাবে বলল যেন পৃথিবীর সবচাইতে স্বাভাবিক ব্যাপার ওটা।

‘দাদু তোমাকে ইয়ো-ইয়ো দিয়েছে?’ খানিকটা ঈর্ষা অনুভব করলাম।

‘দাদুর ছোটবেলার জিনিস। এরকম এখন আর বানায় না। এটা একটা ভিনটেজ ফরেস্টার।’

ইয়ো-ইয়ো নিয়ে কসরৎ দেখাতে শুরু করল ও। বাহুর উপর দিয়ে গড়িয়ে নিচ্ছে, কাঁধের উপর দিয়ে, পিঠের দিকে।

‘এর নাম ওয়াকিং দ্য ডগ,’ বলল।

‘দাদু তোমাকে শিখিয়েছে?’

‘হুঁ।’

‘দাদুর সাথে অনেক কথা হয় তোমার, না?’

‘মাঝে মাঝে।’

আমার ভাল লাগছে না।

‘তুমি এখানে কেন এসেছ, চার্লি?’

ও এমন মুখভঙ্গি করল যেন ধৈর্য হারাচ্ছে।

‘বললাম না, তোমাকে দেখতে?’ ইয়ো-ইয়োটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘চেষ্টা করে দেখো।’

ইয়ো-ইয়োটা নেয়ার সময় ওর আঙুলগুলো স্পর্শ করলাম আমি। বরফ ঠাণ্ডা।

‘পারবে, চেষ্টা করো,’ বলল ও।

আমি ‘ওয়াকিং দ্য ডগ’ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কবজিতে জড়িয়ে গেল রশিটা।

‘দাও!’ হেসে উঠল ও, ইয়ো-ইয়োটা কেড়ে নিয়ে কীভাবে করতে হয় দেখাল।

‘ফুটানি,’ বললাম আমি।

‘পারছ না বলে রেগে যাচ্ছ।’

‘শেখালে পারব।’

জিভে টক-টক শব্দ করে ভ্রূ কুঁচকাল ও, গভীরভাবে ভাবছে যেন।

‘শেখালে আমার কী লাভ?’

‘মানে?’

‘কী দেবে?’

‘কু-কী চাও?’

মুহূর্তখানেক ভেবে নিয়ে হড়বড় করে বলল ও, ‘তোমার ক্যাচার্স দস্তানা।’

‘ওটা দিয়ে কী করবে তুমি?’

‘তোমার কী মনে হয়?’

‘কিন্তু তুমি তো…মৃত!’

হাসি মুছে গেল চার্লির। বেদনার ছায়া ঘনাল দু’চোখে। ‘আমি দুঃখিত,’ কী বলা উচিত বুঝতে না পেরে এটাই বললাম। সেভেন্থ পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজল। হল মনিটর মিস্টার হার্ডি ভিতরে এলেন। বেল্টে বাঁধা চাবির গোছা টুংটাং শব্দ করছে।

‘মনে হলো কথা-বার্তার শব্দ পেলাম। মার্ক, তোমার কাছে হল পাস আছে?’

ঘুরে তাকালাম চার্লির দিকে, কিন্তু নেই ও’। ঢোক গিললাম। ও দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গাটার দিকে চাইলাম।

‘মার্ক?’

মিস্টার হার্ডির উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়ালাম।

‘বলুন?’

তাঁর মুখের চেহারায় কঠোর অভিব্যক্তি, কোমরে দু’হাত।

‘তোমার হল পাস আছে?’

তুলে ধরলাম ওটা। উনি মাথা ঝাঁকিয়ে আমার উদ্দেশে চোখ টিপলেন। মি. হার্ডি বুঝদার মানুষ। দরজার দিকে রওনা দিয়ে থমকে দাঁড়ালেন।

‘তুমি ঠিক আছ তো, মার্ক?’ প্রশ্ন করলেন।

‘জি…কেন বলুন তো?’

‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভূত দেখেছ।’

.

শুক্রবার রাতে, কিশোর আর রবিনের সঙ্গে মেলায় গেলাম। মা আমাদেরকে পাঁচটার দিকে নামিয়ে দিয়েছে। দেড় ঘণ্টা পর নিতে আসবে। আমাকে কথা দিতে হয়েছে তিনজনে একসঙ্গে থাকব।

মেলার মাঠ লোকে লোকারণ্য। গত রাতের বৃষ্টির ফলে মাটি খানিকটা ভেজা। সামনের রবিবার হ্যালোইন। হাই স্কুলের ছেলে- মেয়েরা কস্টিউম পরে ঘুরছে। কয়েকটা ভূত-ভ্যাম্পায়ার-দানো চোখে পড়ল আমাদের। একটা ভূতও চার্লির মত নয়।

‘চলো টিল্ট-আ-ওয়ার্লে যাই,’ প্রস্তাব করল কিশোর।

রবিন নাকচ করে দিল।

‘লম্বা লাইন। তা ছাড়া আমি আগে আমাণ্ডা খালার সাথে দেখা করতে চাই।’

ফানহাউস আর বাম্পার কারের কাছে ছোট্ট এক তাঁবু বসিয়েছেন খালা। ভারী শরীরের মহিলা। অনেকগুলো সোনার চেইন আর মেডেলিয়ন পরেছেন। ধূসর চুল চুড়ো করে বাঁধা। মৃদুভাষী আমাণ্ডা খালা আমাদেরকে ছোট এক কার্ড টেবিল ঘিরে বসতে দিলেন। মখমলের কালো এক কাপড় দিয়ে ঢাকা টেবিলটা।

‘আমাণ্ডা খালা, কিশোর জানতে চায় ওর বউ কেমন হবে!’ বলল রবিন।

ওর কাঁধে ঘুষি মারল কিশোর। আরেকটু হলেই চেয়ার থেকে পড়ে যেত রবিন।

‘ও মাঝে মাঝে ভীষণ জ্বালায়,’ বলল কিশোর।

‘কিন্তু তারপরও তুমি ওকে ভালবাস,’ বললেন আমাণ্ডা খালা। তাঁর মত এমন সম্মোহনী নীল চোখ আমি আর দেখিনি।

মুখ বাঁকাল কিশোর।

‘সেজন্যেই তো লাই পেয়ে গেছে।’

নানান আলোচনা চলছে, আমি লক্ষ করলাম খালার চোখজোড়া বারবার আমার দিকে ঘুরে ঘুরে আসছে। আমি নার্ভাস বোধ করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে আমার অন্তরটা দেখতে পাচ্ছেন তিনি। আমি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়তে চাইছি।

আমরা একটু পরে বিদায় নিলাম। কার্নিভাল উপভোগ করার জন্য বেরোতে উদ্যত হলাম। আমি তাঁবুর বাইরে একটা পা রেখেছি এসময়ে আমাণ্ডা খালা তাঁর কথা দিয়ে আমাকে কাঠ-পুতুল করে দিলেন।

‘রবিন, তোরা একটু বাইরে অপেক্ষা কর। আমি মার্কের সাথে একা একটু কথা বলতে চাই।’

মুহূর্তে বুঝে গেলাম। চার্লি! উনি চার্লির কথা জানেন!

ছয়

আমি আবারও কার্ড টেবিলে আমাণ্ডা খালার মুখোমুখি বসলাম। আমার উপর স্থিরদৃষ্টি ধরে রেখে এক গাদা ট্যারট কার্ড বাটছেন তিনি।

‘আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি,’ বললেন তিনি। কিন্তু আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা জ্বালাতন করছে তোমাকে। বুঝতে পারছিলাম কিশোর আর রবিনের সামনে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছিলে তুমি।’

কাঁধ ঝুলে পড়ল আমার। সামান্য শিউরে উঠলাম। শ্বাস নিলাম বুক ভরে।

‘ট্রেনের ঘটনাটা এখনও ভুলতে পারছি না আমি।’

কিশোর ওঁকে বিষয়টা বলেছে।

মাথা নাড়লেন আমাণ্ডা খালা।

‘না, এটা অন্য কিছু। ভয় পেয়ো না, মার্ক। তুমি বন্ধুদের মাঝে রয়েছ।’

উনি ‘বন্ধু’ বলেননি, বলেছেন বন্ধুদের। খালা নিশ্চয়ই কিশোর আর রবিনকে বোঝাননি। চারধারে দৃষ্টি বুলালাম আমি। ‘বন্ধুদের’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন উনি ভেবে ভয় হলো।

‘আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারো,’ বললেন খালা।

ঢোক গিললাম আমি।

‘আমার একটা ভাই আছে। তার নাম চার্লি।’

‘আছে নাকি ছিল? যমজ ভাই?’

ভদ্রমহিলার এলেম আছে, মনে মনে স্বীকার করলাম। কিশোর আর রবিন চার্লির কথা জানে না…এখন পর্যন্ত না। কাজেই আমাণ্ডা খালার জানার কোনও উপায়ই নেই।

‘হ্যাঁ, ইদানীং দেখা দিচ্ছে সে, কিন্তু অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না।’

খালা চোখ বুজে আমার একটা হাত টেনে নিলেন। কোমল আর উষ্ণ। চার্লির মত হিমশীতল নয়।

‘ভয় পাওয়া উচিত কি না বুঝতে পারছি না,’ তাঁকে বললাম। ‘ও আমার জীবন বাঁচিয়েছে…কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক নয়।’

উনি চোখ খুললেন।

‘মুক্তি না পেলে আত্মা কখনও কখনও দেখা দেয়।’

‘ভয়ের কিছু আছে?’

আবারও চোখ বুজে সজোরে আমার হাত চেপে ধরলেন তিনি। ‘তোমার সাবধান থাকা দরকার। ও এমন কিছু চায় যা পাওয়া সম্ভব নয়।’

‘কী?’

‘….তোমার জায়গা।’

ঘোরের মধ্যে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। কিশোর আর রবিন সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করল আমাকে।

‘কী হলো? খালা কী বললেন?’

‘কিছুই না।’ মাটির দিকে চেয়ে একটা সোডা ক্যানে লাথি মারলাম।

‘উনি কী বললেন বললে না?’ কিশোরের কণ্ঠে তাগিদ।

‘আমার আর কিশোরের সম্পর্কে?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘না,’ বললাম। ‘উনি বলেছেন…

ওকে দেখে জমে গেলাম। চার্লি! শ’খানেক ফীট দূরে ভুতুড়ে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। ভীত। কাঁপছে ও।

‘চার্লি!’ ডাকলাম গলা ছেড়ে। দেখতে পেলাম সন্ত্রস্ত খরগোশের মত এক ছুটে ভুতুড়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়ল ও।

‘চার্লি?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘চার্লি কে?’

ওকে উপেক্ষা করে মৃত ভাইয়ের পিছু নিলাম। সাইড এন্ট্রান্সে অপেক্ষারত ছেলে-মেয়েদের · লাইন এড়িয়ে গেট টপকালাম। অ্যাটেনডেন্ট চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাই, টিকিট কোথায়?’

কিশোর আর রবিন অনুসরণ করল আমাকে। পাত্তা দিল না টিকেট চেকারকে। অন্যান্যরা এটা দেখে ভাবল টিকেট ফ্রী, দৌড় দিল গেটের দিকে। অ্যাটেনডেন্ট হতাশ ভঙ্গিতে দু’হাত শূন্যে ছুঁড়ল। প্রায় দুই ডজন ছেলে-মেয়ে তাকে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ভুতুড়ে বাড়িটার দিকে ছুটল।

বাড়ির ভিতরটা গোলকধাঁধার মতন। হলগুলো আঁধার আর সরু, আঁকাবাঁকা আর সারিবদ্ধ ফানহাউস আয়না দিয়ে সাজানো। ছাদ থেকে মাকড়সার জাল ঝুলছে। এক মুণ্ডহীন পিয়ানোবাদক তার থেকে ঝোলা কঙ্কাল-হাত দিয়ে প্রাচীন এক যন্ত্র বাজাচ্ছে। ভুতুড়ে শব্দ ভেসে আসছে ঝুলন্ত একজোড়া স্পিকার থেকে। গোপন এক প্রজেক্টর দেয়ালে ফুটিয়ে তুলেছে সাদা ভূতেদের।

মাকড়সার জাল সরিয়ে পথ করে নিলাম। ভাঙাচোরা এক সার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম দ্বিতীয় স্তরে, হোঁচট খেলাম এক তারে। এ সময় দাঁড়ানো এক কফিন খুট করে খুলে গেল এবং যান্ত্রিক এক কাউন্ট ড্রাকুলা বেরিয়ে এল আমার সঙ্গে মোলাকাত করতে। ড্রাকুলার হাতজোড়া বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রাখা। চোখজোড়া জ্বলে উঠে হলদে আভা ছড়াল। আমি ওটাকে ফের কফিনে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে হল ধরে তীরবেগে দৌড়ে চললাম।

‘চার্লি! চার্লি, কোথায় তুমি?’

ছেলে-মেয়েদের শোরগোলে ভরে উঠেছে জায়গাটা। কিশোর আর রবিন আমার নাম ধরে ডাকছে শুনতে পেলাম।

‘মার্ক! মার্ক, কোথায় তুমি? মার্ক!’

ছেলে-মেয়েদের ভিড় ঠেলে এগোলাম আমি। আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছি। বিকৃত গোটা বারো হাসি মুখ দেখতে পেলাম। মোটা ছেলে-মেয়েরা শুকিয়ে কাঠি, শুকনো লিকলিকেরা হোঁতকা। ফ্যাকাসে, ভুতুড়ে আমার মুখখানা। চোখজোড়ায় ফাঁকা দৃষ্টি। আমি…মারা গেছি!

সাত

আর্তচিৎকার ছেড়ে লাফিয়ে পিছু হটলাম। মেঝেটা খুলে গেল। ট্র্যাপডোর! আঁধার ভেদ করে পড়ে যাচ্ছি আমি। ফাঁকা জায়গাটা ভরে উঠল কর্কশ, নারকীয় হাসির প্রতিধ্বনিতে: সাবধান!…যে ভুতুড়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছ…সাবধান!… যে ভুতুড়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছ…সাবধান!

ভাঙা রেকর্ড!

স্লাইডের পায়ের কাছে পড়লাম আমি। ছলাত! কাদার গর্তের মধ্যে পড়েছি।

‘অ্যাই!’

বিশাল এক ছায়া ঢেকে দিল আমাকে। শক্তিশালী এক হাত চেপে ধরল আমার উইণ্ড ব্রেকার। টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। বাবল-আই। ওকে অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে।

‘খুদে বিচ্ছু কোথাকার! পয়সা ছাড়া ভুতুড়ে বাড়িতে ঢুকেছ! তোমার বাবা-মা কই?’

ক্লান্ত চোখে বাবল-আইয়ের দিকে চাইলাম। এই মুহূর্তে ওকে নিয়ে মাথা ঘামালাম না।

.

রবিবার রাত। হ্যালোইন।

কিশোর কাউবয়ের পোশাক পরেছে, আর রবিন জাদুকরের। আমি? আমি কিছু পয়সা বাঁচিয়ে নিজের পোশাক পরে যেতে পারতাম। কেউ প্রশ্ন করলে বলতাম, চার্লির মত ‘ট্রিক-অর-ট্রিট’ করছি।

‘চার্লি কে?’ প্রশ্ন করত ওরা।

‘আমার যমজ ভাইয়ের ভূত,’ বলতাম। কিন্তু লোকে এর মধ্যেই আমাকে পাগল ঠাওরাতে শুরু করেছে। কাজেই লাল নাক, সাদা মুখ নিয়ে ক্লাউন সাজলাম।

শেষ বিকেলে কিশোরদের বাসায় মিলিত হলাম আমরা। আমাদের ব্লকের সব ক’টা বাসায় ঢুঁ মেরে প্ল্যাট স্ট্রীটের দিকে গেলাম। শুক্রবার মেলায় কী ঘটেছে সে নিয়ে কথা বলতে চাই না আমি, তাই কিশোর আর রবিনকে ভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছি, যেগুলোর জবাব জানার কোনও আগ্রহ নেই আমার।

‘মুসার পক্স সারেনি?’

‘সেরে উঠছে, কিন্তু এখনও ছোঁয়াচে। কাল রাতে ফোনে কথা হয়েছে। ওকে বলেছি ওর কস্টিউমের দরকার নেই, পক্স নিয়েই হ্যালোইন করতে পারে,’ বলল রবিন।

‘ডুগির কী খবর?’

‘দেশে কাজিনদের কাছে গেছে। ওদের সাথে ট্রিক-অর-ট্রিট করবে।’

আমরা হেঁটে চলেছি, ব্লকের শেষ মাথায় চলে এলাম। বৃদ্ধা মিসেস ডেনভারের বাসাটা সবার শেষে। আমরা তাঁর বাসায় এলাম। সামনের বারান্দায় কাকতাড়ুয়া বসিয়েছেন তিনি এবং সামনের জানালায় বাবা- মা-বাচ্চা জ্যাক-ও’-ল্যান্টার্ন। কিশোর হেঁটে গিয়ে বেল বাজাল।

মিসেস ডেনভার সদালাপী মহিলা। মিনিট পাঁচেক ধরে আমাদের সাজের প্রশংসা করলেন।

‘রবিনকে দারুণ দেখাচ্ছে! ওহ, হোপালং ক্যাসিডিকে দেখলে চোখ ফেরানো যায় না!’

কিশোর বলল, ‘হপি কে?’

মিসেস ডেনভার আমার দিকে চোখ পিট পিট করে চাইলেন। ‘মার্ক না?’

‘হ্যাঁ, ম্যা’ম।’

মহিলা চুক-চুক শব্দ করলেন জিভে। মাথা ঝাঁকিয়ে দু’হাত ভাঁজ করলেন বুকের কাছে।

‘মার্ক, তুমি কি আমার চোখে ধুলো দিতে চাইছ?’

‘কী বলছেন বুঝলাম না, মিসেস ডেনভার,’ বললাম। ‘তুমি তো একটু আগেই এসেছিলে।’

আট

ব্যাপারটাকে আর হালকা করে দেখার উপায় নেই। চার্লি আমার গোটা দুনিয়া উল্টে দিচ্ছে। ও আমাকে অপদস্থ করছে। এবং সবচেয়ে খারাপ বিষয়, আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। ভুতুড়ে বাড়ির আয়নাগুলোর কথা মনে পড়ল। হোঁতকারা শুঁটকি, শুঁটকিরা হোঁতকা….মৃতরা জীবিত, জীবিতরা মৃত!

চার্লি ছাড়া মাথায় আর কিছু ঢুকছে না আমার। অন্য কোনও কিছুতে মন দিতে পারছি না, এমনকী টিমি ক্যাম্পবেলের ফাস্টবলেও না। আমার মাথায় লাগিয়েছে ও, একেবারে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। চিত হয়ে শুয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখছি আমি।

কোচ রবসন আমার উপরে দাঁড়িয়ে, সূর্যটাকে ঢেকে দিয়েছেন।

‘তুমি ঠিক আছ? শেক ইট অফ।’ আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। আমার হাতে হেলমেটটা দিলেন। ‘একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও, মার্ক।’

ব্যাটার্স বক্সে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, প্যান্টের পিছনটা ঝেড়ে নিচ্ছি। টিমি ক্যাম্পবেল পিচার্স মাউণ্ডে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে। সহখেলোয়াড়রা ওর পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। অসুস্থ বোধ করলাম।

কিশোর সেকেণ্ড বেস ধরে ছিল।

‘তুমি ভাল আছ, মার্ক?

‘হ্যাঁ।’ লকার রূমে গেলাম মুখে পানির ছিটে দিতে। আয়নায় তাকিয়ে একাগ্রতা আনার চেষ্টা করলাম। ‘চার্লি, তুমি কোথায়, চার্লি? দেখা দাও!’

‘হ্যালো, মার্ক।’ আমার কাঁধের উপর উদয় হলো ও

চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর মুখোমুখি হলাম। ওর কাছে তখন সেই ইয়ো-ইয়োটা রয়েছে।

‘তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়ছ, জানো সেটা?’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।

জবাব দিল না ও।

‘ঠিক আছে, তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত,’ বললাম।

সামান্য হাসল ও।

‘টিমি ক্যাম্পবেল ছেলেটা কিন্তু নিজেকে যা ভাবে অতটা ভাল খেলে না।’

‘ঠাট্টা করছ? ওর ফাস্টবল মানুষ খুন করে!’

‘ও আমাকে আউট করতে পারবে না।’

হঠাৎই একটা চিন্তা ঘাই মারল মাথায়।

‘প্রমাণ দাও।’

এবার ওর অবাক হওয়ার পালা।

‘মানে!’

‘তুমি আমার জায়গা নাও। ওখানে গিয়ে তোমার কেরামতি দেখাও।’

কথাটা মনে হলো পছন্দ হয়েছে ওর।

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ, সত্যি। তুমি মিসেস ডেনভারের ওখানে তো আমি সেজে গিয়েছিলে।’

একটু অভিমানী দেখাল ওকে।

‘আমি আগে কখনও ট্রিক-অর-ট্রিট করিনি কি না। ব্যাপারটা খুব মজার।’

ওর হাত থেকে ইয়ো-ইয়োটা কেড়ে নিলাম।

‘টিমি ক্যাম্পবেলকে সামলানোর পর, সোমবার তুমি আমার হয়ে ম্যাথ টেস্ট দিতে পারো। কী বলো?’

হঠাৎই অনিশ্চয়তা ভর করল ওর চোখে-মুখে।

‘জানি না।’

‘কেন, তুমি না আমার জীবন যাপন করতে চাও?’

মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল চার্লি। এবার মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার ব্যাট কই?’

স্ট্যাণ্ডে লুকিয়ে রইলাম আমি। চার্লিকে আমার ১৮ নং ইউনিফর্ম পরে ব্যাটার্স বক্সে পা রাখতে দেখলাম। বার কয়েক প্র্যাকটিস সুইং করে নিল ও। টিমি ক্যাম্পবেলের এক বন্ধুর ব্যঙ্গ উপেক্ষা করল।

‘অ্যাই, ব্যাটার-ব্যাটার!’ বলেছিল ছেলেটি

টিমি ক্যাম্পবেল সর্বশক্তিতে পিচ করল। আলোর গতিতে বাতাসে বাঁক খেয়ে ভেসে এল ওটা।

চার্লি দু’পা দৃঢ়ভাবে মাটিতে রেখে আসতে দিল ওটাকে। এবার ব্যাট ঘুরাল ও। ফট! গাছের ডাল ভাঙার মত শব্দ। চোখ পিটপিট করে চেয়ে দেখি বলটা হাওয়া হয়ে গেছে। অতিকষ্টে হাততালি দেয়া থেকে বিরত থাকলাম, কেউ দেখে ফেলে যদি।

মানুষকে বোকা বানানো নিশ্চয়ই খুব মজার, যেমন একসময় দু’জায়গায় উপস্থিত থাকা। আমি যা বুঝতে পারছি, চার্লি চেয়েছিল ছেলেবেলার আনন্দ উপভোগ করতে অন্যান্য সমবয়সীরা যা করে থাকে আরকী।

কেউ পার্থক্যটা ধরতে পারেনি। প্রথমটায়।

সপ্তাহান্তে আমার যাওয়ার কথা ছিল নানুর বাড়িতে, কিন্তু আমি কিশোর আর রবিনের সঙ্গে ক্যাম্পিং করতে চাইলাম, আর চার্লি গেল আমার বদলে। পরের সোমবার নানু মাকে বলল, ‘মার্ককে এবার কেমন অন্যরকম লাগল।

‘তারমানে?’

‘ও তো খুব শান্ত-শিষ্ট,কিন্তু এবার…’

বেডরূমের ফোনে ওদের কথাবার্তা শুনছিলাম আমি।

নানু বলছিল, ‘সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়িয়েছে, পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছে খাঁচা থেকে, বেড়ালটাকে এমন খেপিয়েছে যে স্যাডির দেয়া ল্যাম্পটা ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে। মার্ককে সামলায় কার সাধ্য।

‘তুমি নানুর পাখিটাকে খাঁচা থেকে ছেড়ে দিয়েছ বলে আমি বিপদে পড়েছি!’

চার্লি আমার বিছানায় বসে ইয়ো-ইয়ো দিয়ে ওয়াকিং-দ্য-ডগ খেলছে।

‘কেন করলে অমন কাজ?’

‘শশশ…’ আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল ও। ‘নিজে নিজে কথা বলছ দেখলে লোকে পাগল ভাববে।’

রেগে গেছি আমি।

‘তুমি সব গুবলেট করে দিচ্ছ, চার্লি! ম্যাথ টেস্টে প্রায় সব অঙ্ক ভুল করেছ! টিচার তো আমাকে ধরবে!’

‘তা হলে নিজে করলেই পারতে,’ বলল চার্লি। ‘তুমি যেমন অলস, ঠিক হয়েছে।’

‘প্রায় সব ক’টা অঙ্ক ভুল করলে কীভাবে? গাধা নাকি তুমি?’ হাসি মুছে গেল ওর। চোখের দৃষ্টি শীতল।

‘না, আমি স্রেফ…মৃত।’

পরমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল ও।

নয়

আমাকে এক সপ্তাহের জন্য গৃহবন্দি করা হলো। সময়টা পেরিয়ে গেলে ভয়ানক কেবিন ফিভার হলো আমার। আমি বাইরে বেরোতে এবং বন্ধুদের দেখা পেতে উন্মুখ…কিন্তু বন্ধুরা আমাকে চায় না।

কিশোর আমার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিচ্ছিল, আমি পা বাধিয়ে ঠেকালাম।

‘কী হয়েছে তোমার?’

‘আজকে আমি তোমার জন্যে ডিটেনশন পেয়েছি!’

‘কী বলছ তুমি? আজকে তো স্কুলে আমাদের এমনকী দেখাও হয়নি।’

কিশোর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পায়ে তাল ঠুকছে, বাহুজোড়া বুকের কাছে ভাঁজ করা।

‘বায়োলজি ক্লাসে তুমি দরজা দিয়ে উঁকি মারছিলে। নানারকম মুখ বানিয়ে আমাকে হাসিয়েছ তুমি। এই সপ্তাহে এবার নিয়ে তিনবার। মিস্টার স্টুয়ার্ট পরের সপ্তাহের জন্যে আমাকে ডিটেনশন দিয়েছেন।’

‘কিশোর, ওটা আমি ছিলাম না।’

‘তা হলে কে? তোমার যমজ?

দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল ও। মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে এলাম। এরপর ঘটনা আরও খারাপের দিকে মোড় নিল।

বাসায় ঢুকতেই টের পেলাম কোনও গড়বড় হয়েছে। বাবা-মা লিভিংরূমে বসে ছিল আমার অপেক্ষায়। অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাদেরকে।

‘এবার কী করেছে ও?’ প্রশ্ন করলাম।

আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তারা।

প্রশ্নটা পরক্ষণে শুধরে নিলাম।

‘আমি কী করেছি?’

মা সোফার কোনায় বসে ছিল। রাগে ঠোঁট চেপে রেখেছে।

‘আমি তোমার কাছে এমনটা আশা করিনি, মার্ক। মিসেস রুশো বিকেলে ফোন করেছিলেন।’ উনি টিনার মা। ‘তুমি নাকি টিনাকে আজ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছ। শুধু তাই নয়, গালিও দিয়েছ… এমন গালি…মুখে আনা যায় না!’

বাবা এগিয়ে এল আমার দিকে।

‘এসব ভাষা কোথায় শিখেছ তুমি? আর তোমাকে মারামারি করতে নিষেধ করেছিলাম না? তাও আবার মেয়েদের সাথে!’

কী ভাষা? ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে উঠেছে।

.

সে রাতে বিছানায় শুয়ে ছিলাম আমি। সাত-পাঁচ ভাবছিলাম। কিশোর আমাকে অপছন্দ করছে। টিনাও। আমার বাবা-মা আমার উপর মহা বিরক্ত। অঙ্কেও ডাব্বা খেয়েছি আমি। মনে মনে চাইতে শুরু করেছি চার্লিই বেঁচে থাকুক। অবশ্য ও ইতোমধ্যেই আমার জীবনটা দখল করে নিয়েছে। এটা এখন হয়তো ওরই জীবন।

আমার ভাবনার জবাব দিতেই যেন, আমার বিছানার কিনারে উদয় হলো চার্লি। কবজি থেকে ঝুলছে ইয়ো-ইয়োটা। খেলনাটাকে এখন অসহ্য লাগছে আমার।

‘ঠিক আছে, ‘মার্ক,’ বলল ও। ‘আমি তোমাকে বিপদে ফেলেছি, আমিই বের করে আনব।’

বিছানায় উঠে বসল।

‘কিন্তু কীভাবে?’

‘সোজা। আমি তোমার জায়গা নেব, আমরা যা করছি আরকী। ঝড়-ঝাপ্টা আমার ওপর দিয়েই যাক।’

আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। বরফস্রোত নামল মেরুদণ্ড বেয়ে।

‘তারমানে….?’

শীতল হাসল ও।

‘আর এখন থেকে ইয়ো-ইয়োটা তুমি রাখতে পারো। অদল- বদল। এর আর কোনও অন্যথা হবে না। নো ট্রেড-ব্যাক।’

মৃতরা জীবিত হবে, জীবিতরা মৃত!

দশ

বেশ রাত হয়েছে। রবিনের বাসায় ফোন করলাম। কামনা করছি আঙ্কল-আণ্টি ধরবেন না। রবিনই ভাগ্যক্রমে ফোন ধরল।

‘হ্যালো?’

‘রবিন, আমি মার্ক।’

‘আমি অন্য লাইনে টিনার সাথে কথা বলছিলাম,’ বিরক্ত শোনাল ওর কণ্ঠ।

‘দেখো, রবিন,’ বললাম। ‘আমার সাহায্য দরকার। মনে আছে তুমি বলেছিলে আমাণ্ডা খালা মাঝে মাঝে সিয়াস বসান, মানুষের মৃত আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করেন।

‘হ্যাঁ?’

‘আমি তাঁর সাহায্য চাই। আজ রাতেই! ব্যাপারটা খুবই জরুরি!’

‘ব্যাপারটা কী?’

‘ফোনে বলতে পারছি না। তুমি বাসা থেকে বেরোতে পারবে?’

‘এখন প্রায় দশটা বাজে।’

অনুনয় করলাম।

‘প্লিজ, রবিন! এটা জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার। প্লিজ, কিশোরকে নিয়ে চলে এসো।’

দীর্ঘ বিরতি, তারপর আমার প্রতি করুণা হলো ওর।

‘ফ্লেচার পার্কে এসো। আমি কিশোর আর মুসাকে ফোন করছি। ওদেরকে নিয়ে পৌঁছে যাব।’

ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। জানালার পাশের বুড়ো ওক গাছটা বেয়ে নেমে এলাম। হাতে সময় কম। ঠাণ্ডায় জবুথুবু হয়ে পড়েছি। শীত আসছে। উইণ্ড ব্রেকারের দু’পকেটে হাত ভরতেই ইয়ো-ইয়োটার স্পর্শ পেলাম। ও ওটা রেখে গেছে।

ফ্লেচার পার্কের প্রবেশমুখে কিশোর, মুসা আর রবিন অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। মুসার অসুখ সেরে গেছে। বাইক এনেছে কিশোর আর রবিন। কিশোর আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত T

‘তোমরা মিটমাট করে নাও,’ মৃদু কণ্ঠে বাতলে দিল নথি।

‘ও আমাদের তিনজনকেই এযাত্রা বিপদে ফেলবে,’ বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

‘কাম অন।’ কাঁধ দিয়ে কিশোরকে আলতো গুঁতো দিল মুসা।

ঝাঁকিয়ে দেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিশোর চোখ ঘুরাল।

‘ঠিক আছে। ব্যাপারটা কী তা তো বললে না,’ বলল কিশোর।

‘যেতে যেতে বলব।’

বাইকের দিকে চোখ নামিয়ে তাকাল কিশোর।

‘চলো যাওয়া যাক।’

রওনা হলাম আমরা। রবিন ওর বাইকটা চালাচ্ছে। পিছনে বসেছে মুসা। আমি বসেছি কিশোরেরটার পিছনে। আমাণ্ডা খালার বাসা পনেরো মিনিটের পথ। মেলার মাঠের কাছেই। পুরানো এক বাড়িতে থাকেন তিনি। সামনের বারান্দায় বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন খালা। জানাই ছিল ওঁর!

আমাণ্ডা খালার বেসমেন্টে, একটা টেবিল ঘিরে বসেছি আমরা, হাতে হাত রেখে। খালার চোখ বোজা। মোমবাতির কাঁপা-কাঁপা আলোয় চার্লির নাম ধরে ডাকলেন তিনি।

‘চার্লি, এসো, চার্লি।’

আমার চোখ ঘরটা জরিপ করল। ওকে খুঁজল। নেই।

‘চার্লি? আমাদের সাথে কথা বলো।’

‘এটা ঠিক নয়! কথা ছিল নো ট্রেড-ব্যাক!

চার্লি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, আমার ক্যাচার্স দস্তানা হাতে, দু’হাতে মোচড়াচ্ছে ওটাকে, দস্তানাটা যেন জীবনের সঙ্গে ওর শেষ যোগসূত্র। হয়তো তাই।

রবিনের চোয়াল ঝুলে পড়ল।

‘মার্ক, ওটা তো তুমি!’

‘খাইছে!’ অস্ফুটে বলে উঠল মুসা।

‘না, ওটা চার্লি,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।

আমাণ্ডা খালা চোখ খুলে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। নিজের আসনে ঘুরে বসে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন চার্লিকে।

‘তোমার চলে যেতে হবে, চার্লি। মার্কের জীবন মার্কই যাপন করবে। অন্য কেউ নয়।’

কেঁপে উঠল চার্লির ঠোঁটজোড়া।

‘কথার নড়চড় হওয়ার কথা ছিল না।’

আমাণ্ডা খালা বললেন, ‘এটা খেলা নয়, চার্লি। মার্কের জীবনের প্রশ্ন, এবং তোমার এটা ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তোমাকে অন্য ভুবনে চলে যেতে হবে। তুমি ওখানে শান্তিতে থাকবে।’

দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে চার্লি

‘কিন্তু আমি তো শান্তিতে নেই!’

‘শান্তি আসবে, চার্লি। শান্তি আসবে।’

‘আমি ওর জীবন বাঁচিয়েছিলাম! বাঁচিয়েছিলাম যাতে আমি বাঁচতে পারি!’

আমাণ্ডা খালা টেবিল ছেড়ে উঠে চার্লির দিকে হেঁটে গেলেন। —তুমি ওকে সেদিন বাঁচিয়েছিলে কারণ তুমি ওকে ভালবাস এবং চাওনি ওর খারাপ কিছু ঘটুক।’

মাথা নুয়ে পড়ল চার্লির। দস্তানাটায় শিথিল হয়ে এল ওর মুঠো। ওটা ওর উরুর পাশ দিয়ে ঝুলছে এখন।

আমাণ্ডা খালা হাঁটু গেড়ে নিজেকে চার্লির উচ্চতায় নামিয়ে আনলেন।

‘দাদুর কী হবে? তোমার দাদু আছে, মার্কের নেই। তুমি দাদুর সাথে থাকতে পারবে, ‘ বললেন।

চার্লি মুখ তুলে চাইল। ওর মুখে হাসি ফুটল।

‘দাদু,’ পুনরাবৃত্তি করল ও।

আমাণ্ডা খালার চোখে অশ্রু।

‘তুমি আবারও জীবন পেতে পারো, চার্লি…কিন্তু মার্ক হিসেবে নয়।’

কামরাটা নিথর হয়ে গেল। নীরব। এবার আমার দিকে দৃষ্টিস্থির করল চার্লি। মাথা ঝাঁকিয়ে দস্তানাটা বাড়িয়ে দিল। আমি নিজের আসনে জমে বসে আছি।

আমাণ্ডা খালা আমার দিকে চাইলেন।

‘একমাত্র তুমিই ওটা নিতে পারো, মার্ক।’

টেবিল ছাড়লাম। এগিয়ে গেলাম। উইণ্ড ব্রেকারের পকেট থেকে ইয়ো-ইয়োটা বের করলাম। দাদুর ভিনটেজ ফরেস্টার। চার্লির ইয়ো- ইয়ো। হাত বাড়িয়ে ওকে নিতে বললাম ওটা।

‘আমি তোমাকে কখনও ভুলব না, চার্লি,’ বললাম।

স্মিত হেসে ইয়ো-ইয়োটা নিল ও। আমাকে দিল দস্তানাটা।

‘নো ট্রেড-ব্যাকস,’বলল।

অদৃশ্য হয়ে গেল ও।

.

সে রাতের পরে আমরা আর ওটা নিয়ে আলোচনা করিনি। আমাণ্ডা খালা ওদের বাইক দুটো তাঁর স্টেশন ওয়াগনের পিছনে তুলে আমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। রাতে মড়ার মত ঘুমিয়েছি আমরা।

আমাণ্ডা খালা আমাকে শেষ যে কথাটা বলেছেন তা হলো: ‘জীবন হচ্ছে জীবিতদের জন্যে, মার্ক।’ চার্লিকে যে জন্য চলে যেতে হয়েছে, এবং যে জন্য আমার ওকে যেতে দিতে হয়েছে।

বড়দিনের কাছাকাছি সময়ে মা জানাল আমার আবার ভাই-বোন হবে। ন’ মাস পরে আমার বোন চার্লিনা জন্মাল। আমাণ্ডা খালা হয়তো ঠিকই বলেছিলেন চার্লি নিজের মত একটা জীবন পাবে। এক হিসেবে।

ওহ, আমি ম্যাথ টেস্টে পাস করেছি। শুধু তাই নয়, টিমি ক্যাম্পবেলের ফাস্টবল দু’-একবার পার্কের বাইরেও পাঠিয়েছি। তিন গোয়েন্দার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। আমার চরম বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা। আর আমাণ্ডা খালার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব। ওঁর জন্যই তো এখন আমি নিজের জীবন যাপন করতে পারছি। তাঁর ঋণ কি ভোলা যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *