অদৃষ্ট ফল

অদৃষ্ট ফল

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বিজয়নগর একখানি বর্দ্ধিষ্ণু পল্লিগ্রাম। সেই গ্রামে অনেকগুলি কারবারি লোকের বাস। ওই গ্রামে একটি বাজার আছে, বাজারের চারিধারে সারি সারি অনেকগুলি দোকান ও আড়ত। বাজারের নিকটেই একটি ক্ষুদ্র নদী প্রবাহিত। ওই গ্রামে দিন দিন ব্যবসার উন্নতি হইবার প্রধান কারণই ওই নদী। দূরবর্তী স্থান হইতে তরণী যোগে দ্রব্যাদি ওই স্থানে আনীত হয় ও মহাজনগণ ওই স্থান হইতেই ওই সকল দ্রব্যাদি খরিদ করিয়া কলিকাতা প্রভৃতি প্রধান প্রধান বাণিজ্য স্থানে প্রেরণ করেন। এই নিমিত্তই বিজয়নগরের উন্নতি। 

ওই গ্রামে যে সকল লোক বাস করেন, তাঁহারা সকলেই যে ব্যবসাদার তাহা নহে, তাঁহাদিগের মধ্যে চাকরী করিয়া জীবনধারণ করেন এরূপ অনেক লোক আছেন, কৃষিকার্য্য ও নিজের নিজের জাতি-ব্যবসা করিয়া দিনপাত করিয়া থাকে এরূপ লোকেরও অভাব নাই। 

রামহরি ঘোষ ওই স্থানের একজন প্রধান আড়তদার। অনেক দিন পর্যন্ত এই কার্য্য করিয়া তিনি গ্রামের মধ্যে একজন প্রধান লোক হইয়া দাঁড়াইয়াছেন, অর্থও বিস্তর হইয়াছে, মান সম্ভ্রমও কম নহে। গ্রামের সমস্ত লোকই তাঁহাকে মান্য করিয়া থাকে। গবর্ণমেন্টের বা থানা পুলিসের সেই স্থানের নিমিত্ত কোন কার্য্যের প্রয়োজন হইলে, তাঁহারই সাহায্য সর্বাগ্র গৃহীত হইয়া থাকে। 

রামহরি ঘোষ এখন বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন, আড়তের ভার তাঁহার পুত্র ও কর্ম্মচারীগণের হস্তে ন্যস্ত করিয়াছেন; কিন্তু দোকানে আসা একেবারে বন্ধ করিতে পারেন নাই। তিনি একটি হরিনামের ফুল হস্তে লইয়া দোকানের এক পার্শ্বে বসিয়া মালা ফেরাইতে থাকেন। হস্তে মালা ফিরান কিন্তু মুখে আগন্তুকদিগের সহিত গল্প করিতে কিছুমাত্র বিরত হন না। 

গদিঘরে বসিয়া দুইটি বাক্স সম্মুখে রাখিয়া, দুইজন গোমস্তা সৰ্ব্বদা কাজ করিয়া থাকেন। সমস্ত দিবস যে সকল অর্থের আমদানি হয়, তাহা ওই বাক্সের ভিতর রক্ষিত হইয়া থাকে, রাত্রি নয়টার পর হিসাব নিকাশ করিয়া যে অর্থ উদ্বৃত্ত হয়, তাহা ওই গদিঘরের মধ্যস্থিত একটি লোহার সিন্দুকে চাবি বন্ধ করিয়া রাখিয়া দেওয়া হয়। 

একদিন ১২টার সময় রামহরি ঘোষ আপন বাড়ীতে আহারাদি করিবার নিমিত্ত চলিয়া গেলেন। তাঁহার পুত্র ও একজন কর্মচারী তাহার পূর্ব্বেই আহারাদি করিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিলেন। দিবা প্রায় একটার সময় সেই কৰ্ম্মচারী আহারাদি করিয়া গদিতে প্রত্যাগমন করিলে, দ্বিতীয় কৰ্ম্মচারী স্নানাদি করিবার নিমিত্ত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। প্রথম কর্ম্মচারী সেই গদির উপর যে দুইটি বাক্স ছিল তাহার একটি উপাধান করিয়া শয়ন করিলেন, ও একখানি বাঙ্গালা সংবাদ পত্র পড়িতে পড়িতে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। 

দ্বিতীয় কৰ্ম্মচারী আহারাদি সমাপন করিয়া গদিতে প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলেন, প্রথম কর্ম্মচারী এখনও পর্যন্ত নিদ্রা যাইতেছেন। গদির উপর যে দুইটি বাক্স ছিল, তাহার একটি তাহার উপাধানের কার্য্য করিতেছে, অপরটি সেই স্থানে নাই। 

ইহা দেখিয়া তিনি সেই কৰ্ম্মচারীকে উঠাইলেন ও বাক্সের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি কহিলেন, যখন তিনি শয়ন করেন, সেই সময় সেই বাক্স সেই স্থানেই ছিল, তাহার পর কি হইল তাহা তিনি বলিতে পারেন না। 

হিসাব করিয়া দেখা গেল, সেই বাক্সে নগদ ও নোটে প্রায় পাঁচ শত টাকা ছিল। পাঁচ শত টাকার সহিত একটি বাক্স গদিঘর হইতে অপহৃত হইয়াছে, এই সংবাদ রামহরি ঘোষের নিকট প্রদত্ত হইল। সংবাদ পাইবামাত্র রামহরি ও তাঁহার পুত্র সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা ওই অপহৃত বাক্সের অনেক অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। 

বিজয় নগরে একটি থানা ছিল। ওই থানায় একজন দারোগা থাকিতেন, তাঁহার সহিত রামহরি ঘোষের বিশেষ আলাপ ছিল। কোনরূপ প্রয়োজন হইলেই দারোগা রামহরির নিকট আগমন করিতেন। বিনা প্রয়োজনেও সময় সময় তাঁহাকে রামহরির গদিতে দেখিতে পাওয়া যাইত। 

রামহরি নিজে অনুসন্ধান করিয়া যখন ওই অপহৃত বাক্সের কোনরূপ সন্ধান করিতে পারিলেন না তখন তাঁহার পরিচিত দারোগাবাবুর নিকট সংবাদ প্রদান করিলেন। 

সংবাদ পাইবামাত্র দারোগাবাবু ওই বাক্স চুরির অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। যে স্থান হইতে ওই বাক্স অপহৃত হইয়াছিল, সেই স্থান দেখিলেন। ভগ্নাবস্থায় ওই বাক্স যদি কোন স্থানে পাওয়া যায় তাহার নিমিত্ত ওই গদিস্থ বা গদির সমস্ত স্থান এবং তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলেন কিন্তু কোন স্থানেই সেই বাক্সের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। গদিতে যে দুইজন কর্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগকেও উত্তমরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন, কিন্তু বাক্সের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। তথাপি অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন যে, বিজয় নগরে যেমন ধনবান ব্যক্তির বাসস্থান ছিল, সেইরূপ অনেক দরিদ্র ব্যক্তিও বাস করিত। অভয় হালদার ও তাহার স্ত্রী যশোদা উভয়ে একত্রে রামহরি ঘোষের আড়তের নিকটবর্ত্তী একখানি ঘরে বাস করিত। দরিদ্রতা নিবন্ধন তাহাদিগের অবস্থা অতিশয় শোচনীয় ছিল। 

অভয় হালদার পূর্ব্বে রামহরির আড়তে কয়ালির কার্য্য করিত। রামহরি তাহাকে মাসিক আটটি করিয়া টাকা বেতন দিতেন, তাহা হইতেই কোনরূপে অভয় ও তাহার স্ত্রীর দিনপাত হইত। আট টাকা বেতনে অভয় কোনরূপ সংসারের খরচ নির্বাহ করিয়া উঠিতে পারিত না। এক দিবস অভয় সময় মত রামহরির নিকট নিজের দুঃখের কথা জানাইল, আট টাকায় যে সে কোনরূপে আপনার সংসারের খরচ নির্ব্বাহ করিতে পারে না, সে কথাও সে তাহাকে কহিল ও কিছু বেতন বৃদ্ধির প্রার্থনা করিল কিন্তু রামহরি তাহার কোন কথা শুনিলেন না, কহিলেন, কয়ালের বেতন আট টাকা যথেষ্ট, ইহা অপেক্ষা অল্প বেতনে ওই কার্য্য করিয়া অনেকে বড় মানুষ হইয়া গিয়াছে; আর তোমার অন্নের সংস্থান হইতেছে না, ইহা কি কখন হইতে পারে? 

রামহরি নিতান্ত অন্যায় কথা বলেন নাই, সামান্য বেতনে কয়ালি করিয়া অনেক কয়াল অনেক অর্থ যে উপার্জ্জন করে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহারা উপরি লাভ করে কি করিয়া? মনিবের সর্ব্বনাশ বা মাল বিক্রয়কারীর সর্ব্বনাশ ভিন্ন উপরি লাভ হয় না। যাহারা মাল বিক্রয় করিতে আসে, তাহাদের মাল ওজন করিয়া লইবার সময় খরিদদারের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া অধিক করিয়া ওজন লিখাইয়া লয়, বা বিক্রয়কারীর সহিত বন্দোবস্ত করিয়া কম করিয়া ওজন লিখাইয়া দেয়। এই উপায়েই তাহারা অর্থ উপার্জ্জন করিয়া থাকে। কেনা-বেচার সময় নিঃস্বার্থ ভাবে কার্য্য করিয়া, ঠিক ঠিক ওজন করিয়া দিলে, খরিদকারী বা বিক্রয়কারী কেহই বিক্রয়কারীকে কিছুই প্রদান করে না। সুতরাং যে কয়াল ধর্ম্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া কর্ম্মক্ষেত্রে অবতরণ করে, তাহার উপরি লাভের সম্ভাবনা নাই। 

অভয় কিন্তু সে প্রকৃতির কয়াল ছিল না; এক দিবসের জন্যও সে কখনও অন্যায় কার্য্য করে নাই, জানিয়া শুনিয়া এক কপদকও খরিদকারী বা বিক্রয়কারীর নিকট হইতে সে কখন গ্রহণ করে নাই। সুতরাং ওই আটটি মাত্র টাকার উপরই তাহার সম্পূর্ণরূপে নির্ভর ছিল। অভয়ের অবস্থা খারাপ ছিল বলিয়া সে তাহার স্ত্রী যশোদাকে কিন্তু কোন স্থানে দাস্যবৃত্তি বা অপর কোন হীনকার্য্য করিতে দিত না। এইরূপে প্রায় পাঁচ বৎসর কাল অভয় রামহরির নিকট কার্য্য করিল। 

যখন অভয় বুঝিতে পারিল যে, তাহার মনিবের নিকট হইতে বেতন বৃদ্ধি হইবার আর কোনরূপ আশা নাই, তখন অন্য কোন স্থানে চাকরীর চেষ্টা করিতে লাগিল। সেই সময় আর একজন মহাজন ওই বাজারে একটি নূতন আড়ত খুলিলেন। পূৰ্ব্ব হইতে তিনি অভয়কে জানিতেন, তিনি দশ টাকা বেতনে তাঁহার আড়তে কয়ালির কার্য্য করিতে অভয়কে নিযুক্ত করিলেন। দুই টাকা বেতন বৃদ্ধি হওয়ায় অভয়ের কষ্ট অনেক পরিমাণে দূর হইল, কিন্তু তাহার দুর্ভাগ্য বশতই হউক বা সৌভাগ্য বশতই হউক, ওই নূতন মহাজন তাঁহার আড়তে বিশেষরূপ লাভ করিতে পারিলেন না; এক বৎসর পরেই ওই আড়ত উঠিয়া গেল, সুতরাং অভয়ের চাকরী গেল। 

অভয় কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিবার পর রামহরি ঘোষ, তাহার পদে আর এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। অভয়ের কর্ম্ম যাইবার পর পুনরায় সে তাহার পুরাতন মনিবের নিকট কর্ম্ম পাইবার আশায় আগমন করিল, কিন্তু রামহরি তাঁহার নূতন নিয়োজিত কয়ালকে বিদায় দিয়া, সেই স্থানে অভয়কে আর স্থান প্রদান করিলেন না। 

অভয় নিজের চাকরী হারাইয়া একেবারে নিরুপায় হইয়া পড়িল। অনেক স্থানে অনেকরূপ চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনরূপ কার্য্যের সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিল না, ক্রমে তাহার দিনপাতের উপায় বন্ধ হইয়া গেল। ঘরে যে দুই-একখানি সামান্য তৈজসপত্র ছিল তাহা বিক্রয় করিয়া প্রথমতঃ কয়েক দিবস চলিল। তাহার পর যখন আর কোনরূপ উপায় রহিল না, তখন যশোদা প্রতিবেশীর গৃহে দাস্যবৃত্তি করিতে আরম্ভ করিল। পল্লিগ্রামে একজন দাস্যবৃত্তি করিয়া সামান্য যাহা কিছু প্রাপ্ত হয়, তাহাতে দুইজনের অন্ন সংস্থান হওয়া দূরে থাকুক, একজনেরই সম্পূর্ণ উদরান্নের সংস্থান হয় না, তাহার উপর শারীরিক অসুখ আছে। 

ক্রমে অভয় ও যশোদার কষ্টের পরিসীমা রহিল না, একদিবস আহার হইত তো দুই দিবস অনাহারে কাটিয়া যাইত। যশোদা পূৰ্ব্বে কখনও হাটে বা বাজারে গমন করিত না, এখন আর সে লজ্জা রক্ষা করিতে পারিল না। অভয় পূর্ব্বে রামহরি ঘোষের আড়তে চাকরী করিত, আড়তের কোন কোন লোক তাহাকে চিনিত, এইজন্য সময় সময় যশোদা ভিক্ষাপ্রার্থী হইয়া সেই স্থানে গমন করিত। রামহরিকে দেখিতে পাইলে নিজের অবস্থা জানাইত, ও সময় সময় সেই স্থান হইতে কিছু চাউল ডাউল প্রভৃতি ভিক্ষা করিয়া আনিয়া সে দিবস উদরান্নের সংস্থান করিত। 

এইরূপে বিশেষ কষ্টে পড়িয়া কোনরূপে যদি কিছু সংস্থান করিতে পারে বা কোনরূপ চাকরীর যোগাড় করিতে পারে, এই আশায় অভয় একদিবস নিজের গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া গ্রামান্তরে গমন করিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

বিশেষ কষ্টে পড়িয়া কোনরূপে উদরান্নের সংস্থান করিবার নিমিত্ত যেদিবস অভয় গ্রামান্তরে গমন করিয়াছিল, সেইদিবসই রামহরির গদি ঘর হইতে বাক্স অপহৃত হয়। 

দারোগাবাবু অনুসন্ধান করিতে করিতে অভয়ের বিষয় অনেক জানিতে পারিলেন। জানিতে পারিলেন, কোনরূপ চাকরী বা উপার্জ্জনের অপর কোনরূপ উপায় না থাকায়, তাহার বিশেষ কষ্ট হইয়াছে। আরও জানিতে পারিলেন, যে দিবস রামহরি ঘোষের বাক্স চুরি হইয়াছে, সেই দিবসই অভয় সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন স্থানে গমন করিয়াছে। কোথায় গিয়াছে তাহা কেহই অবগত নহে। দারোগাবাবু যশোদাকে জিজ্ঞাসা করেন, সে তাহার কিছুই বলিতে পারিল না। 

অভয় সম্বন্ধে দারোগাবাবুর মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। যে ব্যক্তিকে সময় সময় দুই তিন দিন অনশনে থাকিতে হয়, সে নিতান্ত সৎ লোক হইলেও পেটের জ্বালায় বাধ্য হইয়া তাহাকে যে অপর কার্য্য করিতে হয় এরূপ দৃষ্টান্ত সহস্ৰ সহস্ৰ দেখিতে পাওয়া যায়। অভয়কে এখন প্রায়ই অনশনে দিনযাপন করিতে হয়, পূর্ব্বে অনেক দিবস সে রামহরির গদিতে চাকরী করিয়াছে, কোন্ সময়ে কিরূপ অবস্থায় ও কোথায় ওই গদির অর্থাদি রক্ষিত হয়, তাহা অভয় বিশেষরূপে অবগত আছে। তাহার উপর চাকরী যাইবার পর সে নিজের চাকরী পাইবার নিমিত্ত রামহরির নিকট কত উমেদারি করে। কিন্তু রামহরি কিছুতেই তাহাকে চাকরী প্রদান করেন না, ইঁহার নিমিত্তও অভয় রামহরির উপর অসন্তুষ্ট থাকিতে পারে, ও তাহার প্রতিহিংসা লইবার ইচ্ছাও বলবতী হইতে পারে। এই সকল কারণে যে এই কার্য্য অভয়ের দ্বারা হয় নাই, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? কর্ম্মচারী অভয় সম্বন্ধে এই প্রকার নানারূপ ভাবিয়া তাহার সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে কৃতসংকল্প হইলেন। 

দারোগাবাবু অভয় সম্বন্ধে যখন অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই সময় রামহরি ঘোষের দ্বিতীয় কর্ম্মচারীর নিকট হইতে জানিতে পারিলেন যে, যে সময় স্নান আহার করিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার বাড়ীতে গমন করিতেছিলেন, সেই সময় দেখিতে পান, অভয়ের পত্নী যশোদা আড়তের দিকে আসিতেছে, সে কোথাও না কোথাও যাইতেছে, বলিয়া তাঁহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হয় নাই। আহারাদি করিয়া যখন তিনি রামহরি ঘোষের আড়তে আসিতেছিলেন, সেই সময়েও তিনি যশোদাকে আড়তের দিক হইতে তাহার গৃহাভিমুখে গমন করিতে দেখিতে পান। যেস্থানে সেই দ্বিতীয় কর্ম্মচারীর সহিত যশোদার সাক্ষাৎ হয়, সেই স্থান রামহরির আড়ত হইতে অধিক দূরে নহে। উহার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পর তিনি গদিতে আসিয়া দেখেন যে, গদি হইতে বাক্স অপহৃত হইয়াছে। সেই সময়েও যশোদা সম্বন্ধে তাঁহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় নাই, বা এ কথা তিনি কাহাকেও বলেন নাই। দারোগাবাবু যে সময় অভয় সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, সে সময় যশোদার কথা তাঁহার মনে হয়, ও তিনি দারোগাবাবুকে ওই কথা বলেন। যশোদা সম্বন্ধে এই কথা জনিতে পারিয়া, অভয় প্রতি দারোগাবাবুর মনে আরও সন্দেহ বদ্ধমূল হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ যশোদাকে ডাকাইয়া পাঠান। 

সে সময় একজন চৌকিদার দারোগাবাবু কর্তৃক প্রেরিত হইয়া যশোদাকে ডাকিবার নিমিত্ত তাহার বাড়ীতে গিয়াছিল, সেই সময় যশোদা অনশনে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া আপনার ঘরের দাওয়ায় শুইয়াছিল। দারোগাবাবু তাহাকে ডাকিতেছেন, ইহা চৌকিদারের নিকট হইতে অবগত হইয়া সে তখনই সেই চৌকিদারের সহিত দারোগাবাবুর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার জীর্ণ, শীর্ণ ও কঙ্কাল বিশিষ্ট দেহ দেখিয়া দারোগাবাবুর অন্তরে একটু দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি তাহাকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। যশোদা বসিলে পর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার নাম যশোদা?” 

যশো। হাঁ মহাশয়। 

দারো। অভয় তোমার স্বামী? 

যশো। হাঁ। 

দারো। অভয় এখন কোথায়? 

যশো। তাহা আমি বলিতে পারি না, দুই দিবস অনশনে কাটাইয়া আজ প্রাতে তিনি বাড়ী হইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। যাইবার সময় আমাকে কেবল এই মাত্র বলিয়া যান যে, যদি কোনরূপে তাঁহার ও আমার অন্নের যোগাড় করিতে পারি তবেই ফিরিয়া আসিব, নতুবা যে কি করিব তাহা এখন বলিতে পারি না। আমি কাঁদিয়া কাটিয়া তাঁহাকে গ্রাম পরিত্যাগ করিতে অনেক নিষেধ করিলাম কিন্তু তিনি কিছুতেই আমার কথা শুনিলেন না, আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। 

দারো। দুই দিবস তাহার আহার হয় নাই? 

যশো। আজ দুই দিবস হইতে তিনি উপবাসী আছেন। 

দারো। তুমি কোথায় আহার করিলে? 

যশো। আমার দশা আমার স্বামী অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক। আমি তিন দিন উপবাসী। 

দারো। তোমার স্বামী কোন কায কৰ্ম্ম করে না কেন? 

যশো। অনেক চেষ্টা করিয়াছেন, কোন স্থানে কোনরূপ কর্ম্মের যোগাড় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। বিশেষ প্রায়ই উপবাস করিয়া তাঁহার শরীরের অবস্থা এরূপ হইয়াছে যে, পরিশ্রমজনক কোন কার্য্য তাঁহার দ্বারা হইতে পারে না। সুতরাং কোন ব্যক্তি তাঁহাকে কোনরূপ কার্য্য যাহাতে পরিশ্রমের প্রয়োজন, তাহা তাঁহাকে প্রদান করে না। কাযেই অন্নের সংস্থান হয় না, সুতরাং অনশনে দিন অতিবাহিত করিতে হয়। 

দারো। তুমি কোন কায কর না কেন? 

যশো। আমি কি কায করিব? 

দারো। কাহারও বাড়ীতে পরিচারিকার কার্য্য করিলেও তো তোমার উদরান্নের জন্য ভাবিতে হয় না? 

যশো। তাহাও করিয়াছি। যখন যে বাড়ীতে কৰ্ম্ম করিয়াছি, তখন সেই বাড়ীতে বসিয়া উদর পূরিয়া কখনও আহার করিতে পাই নাই। আমি অন্ন তাঁহাদিগের বাড়ীতে বসিয়া না খাইয়া নিজের বাড়ীতে লইয়া আসিতাম; ও উহা আমার স্বামীকে আহার করিতে দিতাম। আপন স্বামীকে উপবাসী রাখিয়া কোন স্ত্রী নিজে বসিয়া আহার করিতে পারে? আমার আনীত অন্ন তাঁহাকে তিন চতুর্থ অংশ প্রদান করিয়া আমি এক চতুর্থ অংশ আহার করিতাম, ইহাতে তিনিও উদর পূরিয়া আহার পাইতেন না, আমিও কোনরূপে জীবনধারণ করিতাম। এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইবার পর ক্রমে আমি হীনবল হইয়া পড়িতে লাগিলাম, ক্রমে দাস্যবৃত্তি করিতে অসমর্থ হইলাম। কাজ করিতে না পারিলে কোন্ মনিব কেবল বসাইয়া রাখিয়া অন্ন দেয়? সুতরাং আর কেহই আমাকে দাস্যবৃত্তি করিতে দিত না। দাস্যবৃত্তি করিয়া দুইজনে যে একমুঠা অন্ন পাইতাম, তাহাও ক্রমে বন্ধ হইয়া গেল। তখন যে দিবস ভিক্ষা করিয়া কিছু সংগ্রহ করিতে পারিতাম, সেইদিবস উভয়েই কিছু আহার পাইতাম নতুবা অনশনেই দিন অতিবাহিত করিতাম। 

দারো। তোমাদিগের এত কষ্ট দেখিয়া গ্রামের লোক তোমাদিগকে কোনরূপে সাহায্য করিত না? 

যশো। করিতেন বৈ কি, অনেক দিবস তাঁহারা সাহায্য করিয়াছেন, কিন্তু মহাশয়, যাহাদিগের অদৃষ্টে এইরূপ কষ্ট লেখা আছে, গ্রামের লোক কি সেই কষ্ট কখনও দূর করিতে পারেন? তাঁহারা অনেক সময় আমাদিগকে অনেক সাহায্য করিয়াছেন, কিন্তু যাহাদিগকে নিত্য সাহায্য করিতে হয়, তাহাদিগকে নিত্য কে সাহায্য করিতে পারে? 

দারো। অভয় বাড়ী হইতে চলিয়া যাইবার পর আজ তুমি তোমার বাড়ী হইতে কোন স্থানে গিয়াছিলে?

যশো। একবার বাড়ী হইতে বাহির হইয়া রামহরিবাবুর ওই গদিতে আসিয়াছিলাম। 

দারো। এখানে তুমি কি নিমিত্ত আসিয়াছিলে? 

যশো। রামহরিবাবু আমাদিগের পুরাতন মনিব। সময় সময় যখন দেখিতে পাই, কোন স্থান হইতে কোনরূপে অন্নের সংস্থান হইল না, তখন আমি ও আমার স্বামী রামহরিবাবুর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হই। তিনিও আমাদিগকে দেখিলে আমাদিগের অভিপ্রায় বুঝিতে পারেন, ও সময় সময় কিছু চাউল বা নগদ পয়সা দিয়া আমাদিগকে সাহায্য করিয়া থাকেন। তিন দিবসের জঠর জ্বালা আর কোনরূপেই সহ্য করিতে না পারিয়া, ভাবিলাম, রামহরিবাবুর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াই, তিনি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু দিয়া সাহায্য করিবেন, তাই তাঁহার গদিতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ রামহরিবাবু ও তাঁহার পুত্র সেই সময় চলিয়া গিয়াছিলেন, কেবল একজন সরকার গদি-ঘরে শুইয়া নিদ্রা যাইতেছিল, অপর লোকজন কেহই সেই স্থানে ছিল না, কাজেই ক্ষুণ্নমনে আমাকে সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিতে হয়। 

যশোদার কথা শুনিয়া দারোগাবাবুর মনে হইল, এ কার্য্য যশোদা দ্বারা কখন সম্পন্ন হয় নাই, তাহার অবস্থা দেখিয়া তাঁহার মনে দয়ার উদয় হইল, তিনি যশোদাকে চারি আনা পয়সা দিয়া কহিলেন, তুমি এখন ঘরে যাও, এই পয়সা দ্বারা কিছু চাউল ডাউল খরিদ করিয়া অগ্রে কিছু আহার কর, পরিশেষে যদি প্রয়োজন হয়, ডাকিলে আসিও, ও অভয় আসিলে তাহাকে আমার নিকট পাঠাইয়া দিও। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

অভয় নিতান্ত দরিদ্র হইলেও, অনশনে দিন অতিবাহিত করিলেও সে একেবারে শত্রুহীন ছিল তাহা নহে। এ জগতে শত্রুহীন মানব নাই। তুমি কাহারও কোনরূপ সংশ্রবে না থাকিলেও, কাহারও ভাল মন্দের দিকে দৃষ্টি না রাখিলেও, কাহারও কোনরূপ অনিষ্টের চেষ্টায় না ফিরিলেও তুমি তোমার শত্রু দেখিতে পাইবে। যদি তুমি কিছু সংস্থান করিতে পারিলে, পরের দ্বারস্থ না হইয়া দুই বেলা দুই মুঠা অন্নের সংস্থান করিতে সমর্থ হইলে, অমনি তোমার শত্রু জুটিয়া গেল। যেখানে সেখানে সে তোমার নিন্দা করিতে, তোমার কুৎসা গাহিতে প্রবৃত্ত হইল। যদি তুমি একটু বড় হইয়া দাঁড়াইলে, একটু মান সম্ভ্রম হইল, একটু খ্যাতি-প্রতিপত্তি বাড়িল, তাহা হইলে আর কোন কথাই নাই, শত্রুর সংখ্যাও সেই সঙ্গে উত্তরোত্তর বাড়িতে আরম্ভ হইল। ইহাই এই সংসারের নিয়ম। 

দরিদ্র অভয় আপন উদরান্নের জ্বালায় অস্থির, নিজের অন্ন চিন্তা ভিন্ন অপর কোন দিকে তাহার লক্ষ্যই নাই, তথাপি সে শত্রুর হস্ত হইতে একেবারে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে নাই। রামহরি ঘোষের আড়তে যে ব্যক্তি তাহার স্থলে কয়ালি করিতে নিযুক্ত হইয়াছে, সেই এখন অভয়ের একজন শত্রু হইয়া দাঁড়াইল। 

অভয়ের উপর শত্রুতা সাধন করিতে যে সে কোনরূপে পরাঙ্মুখ হইত না, তাহার বিশেষ কারণ ছিল। সে মনে করিত, অভয়ের অবস্থা দেখিয়া যদি রামহরিবাবুর দয়ার উদ্রেক হয়, ও যদি তিনি তাহাকে পুনরায় তাহার চাকরী দেন, তাহা হইলে, তাহার চাকরীটি যাইবে, সুতরাং যাহাতে অভয় আর কোনরূপ ওই গদিতে প্রবেশ করিতে না পারে, তাহার চেষ্টা করা সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া কিসে যে অভয়ের সর্বনাশ সাধন করিতে সমর্থ হইবে, তাহারই চেষ্টা দেখিত। 

দারোগাবাবু যে সময় ওই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই নূতন কয়াল তাঁহার নিকট থাকিয়া তাঁহাকে সাহায্য করিতেছিল। ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল, দারোগাবাবু ওই বাক্সের কোনরূপ সন্ধান করিতে না পারিয়া সন্ধ্যার পর থানায় প্রত্যাগমন করিলেন। যাইবার সময় রামহরিবাবুকে বলিয়া গেলেন, কল্য প্রত্যুষে আসিয়া পুনরায় অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইব। আরও বলিয়া গেলেন, অভয়ের দিকে যেন একটু দৃষ্টি রাখা হয়, সে যেমন বাড়ীতে আসিবে, তৎক্ষণাৎ যেন সেই সংবাদ আমাকে প্রদান করা হয় 

অভয়ের প্রত্যাগমনের সংবাদ রাখিবার ভার রামহরি তাঁহার সেই নূতন কয়ালের উপর প্রদান করিলেন। রাত্রি নয়টার পর সেই কয়াল আসিয়া রামহরিকে সংবাদ প্রদান করিল যে, অভয় তাহার নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছে। রামহরিও সেই সংবাদ তৎক্ষণাৎ দারোগাবাবুর নিকট প্রেরণ করিলেন। 

দারোগাবাবু একজন চৌকিদারকে পাঠাইয়া দিয়া তৎক্ষণাৎ অভয়কে থানায় লইয়া গেলেন। সেই স্থানেই অনেক সময় রাত্রি অতিবাহিত করিল। 

প্রাতঃকালে দারোগাবাবু অভয়কে আপনার নিকট ডাকাইলেন ও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “অভয়! কাল তুমি কোথায় গিয়াছিলে?” 

অভয়। নিকটবর্ত্তী এক গ্রামে গিয়াছিলাম। 

দারো। সেই গ্রামে তুমি কি জন্য গমন করিয়াছিলে? 

অভয়। কাজের চেষ্টায়। 

দারো। কোনরূপ কাজের যোগাড় করিতে পারিয়াছ কি? 

অভয়। না মহাশয়, কোনরূপ যোগাড় করিয়া উঠিতে পারি নাই তবে একটি লোক একটু আশ্বাস দিয়াছে মাত্র। কিন্তু মহাশয়, আমার আজ-কাল যেরূপ সময় পড়িয়াছে, তাহাতে কিছু হইবে বলিয়া আমার মনে হয় না। 

দারো। কাল তোমার আহার হইয়াছিল? 

অভয়। হাঁ মহাশয়। যিনি আমাকে আশ্বাস দিয়াছেন, তিনিই কল্য আমাকে আহার দিয়াছিলেন। 

দারো। তুমি যে বক্সটি লইয়া গিয়াছিলে, সে বাক্সটি কোথায় রাখিয়াছ? 

অভয়। কিসের বাক্স মহাশয়? 

দারো। রামহরি ঘোষের গদি হইতে যে বাক্স তুমি ও তোমার স্ত্রী যশোদা উভয়ে মিলিয়া চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছ, সেই বাক্স ও তাহার মধ্যে যে টাকা ছিল আমি তাহারই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। 

অভয়। মহাশয়, রামহরি ঘোষ আমার পুরাতন মনিব, তাঁহার অন্নে অনেক দিবস প্রতিপালিত, এখনও সময় সময় তিনি আমাদিগকে সাহায্য করিয়া থাকেন, তাঁহার কোন দ্রব্য আমা কর্তৃক কোনরূপ লোকসান হইবে না। আমি অন্নকষ্টে মরিতেছি, অনেক দিবস উপবাসে দিনযাপন করিয়াছি, কিন্তু চুরি করিতে শিখি নাই। যদি আমি চুরি করিতাম, তাহা হইলে আমার এরূপ অবস্থা কখনই ঘটিত না। কয়াল কার্য্যে বিস্তর চুরি আছে সুতরাং কয়ালি করিয়া অনেকে বড় মানুষ হইয়া যায়। ঈশ্বর আমাকে সেরূপ মতিগতি দেন নাই বলিয়াই আমার এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে। 

দারো। কাল তুমি যে গ্রামে ও যে যে ব্যক্তির নিকট গমন করিয়াছিলে, তাহা আমাকে দেখাইতে পারিবে?

অভয়। কেন পারিব না? আমি যেস্থানে গমন করিয়াছিলাম ও যাহার যাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল তাহার সমস্তই আমি আপনাকে দেখাইয়া দিব। 

অভয়ের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু তাহার একটা জবানবন্দী লিখিয়া লইলেন। কোন্ সময় অভয় বাড়ী হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নিকট গমন করিয়াছিল, কাহার সহিত কোন সময় সাক্ষাৎ হইয়াছিল, কাহার সহিত কি কি কথাবার্তা হইয়াছিল, কোন্ স্থানে আহার করিয়াছিল, কোন্ সময় সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিয়াছ প্রভৃতি সমস্ত অবস্থা একখানি কাগজে বিস্তারিত রূপে লিখিয়া লইয়া তাহার কথা সত্য কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত অভয়কে সঙ্গে লইয়া থানা হইতে প্রস্থান করিলেন, ও অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন, অভয় যাহা যাহা বলিয়াছে তাহার একটি কথাও মিথ্যা নহে। 

এই সমস্ত অনুসন্ধান করিয়া যখন দারোগাবাবু রামহরি ঘোষের গদিতে প্রত্যাগমন করিলেন, তখন সন্ধ্যা হইতে অতি অল্প মাত্র দেরী আছে। 

দারোগাবাবু অভয়ের সহিত প্রত্যাগমন করিয়া সেই স্থানে একটু বিশ্রাম করিবার পরই রামহরি ঘোষের সেই নূতন কয়াল আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল ও রামহরি ঘোষকে একান্তে লইয়া গিয়া চুপি চুপি তাঁহাকে কি কহিল। রামহরি তাহার সমস্ত কথা স্থির ভাবে শুনিয়া দারোগাবাবুকে সেই স্থানে ডাকিলেন। দারোগাবাবু সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলে কি বলিতেছে, তাহা একবার বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করুন ও দেখুন, তাহার কথা কতদূর সত্য। 

রামহরির কথা শুনিয়া দারোগাবাবু সেই কয়ালকে কহিলেন “কি হে, তুমি কি বলিতে চাহ?” কয়াল। মহাশয় আমি সংবাদ পাইয়াছি, রামহরিবাবুর বাক্স অভয় চুরি করিয়াছে! 

দারো। কাহার নিকট হইতে তুমি এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ? 

কয়াল। যে অভয়কে বাক্স লইয়া যাইতে দেখিয়াছে তাহারই নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছি।

দারো। তিনি কে? 

কয়াল। তিনি কোন গৃহস্থ ঘরের বউ, আমি তাহার নাম বলিব না। 

দারো। তাহার নাম না বলিলে আমরা কিরূপে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিব যে, তিনি কিরূপে অভয়কে বাক্স লইয়া যাইতে দেখিয়াছেন ও কোথাই বা দেখিয়াছেন? 

কয়াল। আপনি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন না, সে গৃহস্থ ঘরের বউ, সে কোনরূপেই আপনার সম্মুখে আসিবে না বা জিজ্ঞাসা করিলেও সে আপনার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিবে না। আমি তাহার নিকট হইতে সমস্তই জিজ্ঞাসা করিয়া লইয়াছি, আপনি যাহা জানিতে চাহেন, বোধ হয় তাহার সমস্ত কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিব, আর যে কথার উত্তর দিতে পারিব না, সুযোগমত তাহা তাহার নিকট হইতে জানিয়া আপনাকে বলিব। 

দারো। সে তোমাকে কি বলিয়াছে বল দেখি? 

কয়াল। সে আমাকে বলিয়াছে, দিবাভাগে একটি জঙ্গলের ভিতর সে শৌচ পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিল, সেই স্থান হইতে সে দেখিতে পায়, একটি বাক্স হস্তে অভয় সেই জঙ্গলের নিকট দিয়া গমন করিয়া একটি খড়ের গাদার মধ্যে সেই বাক্স লুকাইয়া রাখে, এবং তথা হইতে অতি সন্তর্পণে প্রস্থান করে। 

দারো। যে খড়ের গাদার ভিতর অভয় বাক্সটি লুকাইয়া রাখিয়াছে, সেই খড়ের গাদাটি কি অভয়ের?

কয়াল। অভয় খড় কোথা পাইবে, সে খড়ের গাদা অপর লোকের। 

দারো। সেই খড়ের গাদা আমাদিগকে কে দেখাইয়া দিবে ও সেই বাক্সই বা ওই গাদার কোন্ স্থানে রাখিয়াছে, তাহাই বা কে দেখাইয়া দিবে? 

কয়াল। অভয়কে একটু পীড়াপীড়ি করিলে সেই দেখাইয়া দিবে। আর সে যদি নিতান্তই না দেখাইয়া দেয়,, তাহা হইলে আমি দেখাইয়া দিব। আমাকে সেই স্ত্রীলোক সমস্তই দেখাইয়া দিয়াছে। 

দারো। যদি সেই খড়ের গাদার মধ্যে সেই বাক্স পাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই স্ত্রীলোকের নাম আমাদিগের কাছে প্রকাশ করিতেই হইবে। 

কয়াল। তা মহাশয় আমি কিছুতেই পারিব না, ইহাতে রামহরিবাবুর বাক্স পাওয়া যাক আর না যাক।

দারো। সে বিষয় পরে দেখা যাইবে, এখন চল, কোন্ স্থানে অভয় ওই বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছে, তাহাই দেখাইয়া দিবে। 

কয়ালকে এই বলিয়া দারোগাবাবু তখনই অভয়কে আনিবার নিমিত্ত একজন চৌকিদার পাঠাইয়া দিলে। কিয়ৎক্ষণ পরে চৌকিদার অভয়কে আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত করিল। 

অভয় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলে দারোগাবাবু তাহাকে কহিলেন “অভয়, তুমি রামহরিবাবুর বাক্স চুরি করিয়াছ, তাহা জানিতে পারা গিয়াছে, ও বাক্স যেস্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছ, তাহাও এখন প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। এরূপ অবস্থায় এখন আর কোন কথা গোপন করা তোমার কর্তব্য নহে। চল ওই বাক্স এখন আমাদিগকে দেখাইয়া দাও।” 

দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া অভয় নিতান্ত বিস্ময়ের সহিত কহিল “সে কি মহাশয়, আমি বাক্স চুরি করিব কেন? আমি যেস্থানে ছিলাম, তাহা আপনি নিজে অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছেন, সেই স্থান হইতে আসিয়া আমি চুরি করিলাম কি প্রকারে?” 

অভয়ের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু কহিলেন “সে বিষয় পরে দেখা যাইবে, এখন আইস, যেস্থানে তুমি বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছ, তাহা আমরাই তোমাকে দেখাইয়া দিতেছি।” এই বলিয়া দারোগাবাবু অভয়কে লইয়া সেই কয়ালের সঙ্গে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। রামহরি ও অপরাপর সে সকল ব্যক্তি সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহারাও তাঁহাদিগের সঙ্গে গমন করিল। 

কয়াল তাঁহাদিগের সকলকে সঙ্গে লইয়া গ্রামের প্রান্তভাগে একটি জঙ্গলের নিকট গমন করিল। সেই স্থানে চারি পাঁচটি খড়ের গাদা ছিল, উহার একটি দেখাইয়া কহিল, ইহার মধ্যে অভয় সেই অপহৃত বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছে ও যেস্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছে সেই স্থানটিও দেখাইয়া দিল। 

দারোগাবাবু সেই স্থান অনুসন্ধান করিবামাত্র সেই অপহৃত বাক্স প্রাপ্ত হইলেন। ওই বাক্সটি বাহির করিয়া সকলের সম্মুখে উত্তমরূপে দেখিলেন, কিন্তু উহার ভিতর কোন অর্থ বা অপর কোন দ্রব্য প্রাপ্ত হইলেন না, সকলই অপহৃত হইয়াছে। কেবল যে সকল কাগজ বা চিঠিপত্র ছিল তাহাই রহিয়াছে। বাক্সটি ভাঙ্গা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না, কোন চাবি দ্বারাই উহা খোলা হইয়াছে। 

বাক্সের অবস্থা দেখিয়া সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, যে ব্যক্তি ওই বাক্স অপহরণ করিয়াছে, সে উহা খুলিয়া উহার মধ্যস্থিত সমস্ত মূল্যবান দ্রব্য বাহির করিয়া লইয়া খালি বাক্সটি ওই স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছে। 

দারোগাবাবু অভয়কে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু অভয় কিছুতেই কোন কথা স্বীকার করিল না, কিন্তু দারোগা বাবু রামহরি ঘোষ ও সেই স্থানে যে সকল ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন সকলেরই বিশ্বাস হইল যে অভয়ই এই কার্য্য করিয়াছে।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

দারোগাবাবু অভয়কে গ্রেপ্তার করিয়া সেই বাক্স সমেত থানায় লইয়া গেলেন। দেখিতে দেখিতে গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িল, রামহরি ঘোষের গদি হইতে যে বাক্স চুরি হইয়াছিল, তাহা পাওয়া গিয়াছে। অভয়ই চুরি করিয়াছিল। দারোগাবাবু থানায় গিয়া এই মোকদ্দমার ডায়েরি লিখিতে বসিলেন। ডায়েরি লিখিতে আরম্ভ করিয়া কতকগুলি চিন্তা তাঁহার মনে উদয় হইল। 

১ম চিন্তা, – অভয়কে এই মোকদ্দমার আসামী করিয়া বিচারার্থ প্রেরণ করিলে তাহার দণ্ড হইবে কি প্রকারে? যে দিবস ও যে সময় ওই বাক্স রামহরি ঘোষের গদি হইতে অপহৃত হয়, সেহদিবস ও সেই সময় অভয় বাড়ীতে ছিল না, যে গ্রামে ছিল সেই গ্রামের লোক আমার নিকট সে কথা বলিয়াছে ও আবশ্যক হইলে আদালতে গিয়াও তাহারা সে কথা বলিবে। 

২য় চিন্তা,—যে স্ত্রীলোক অভয়কে বাক্স লুকাইয়া রাখিতে দেখিয়াছে, তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না। কয়াল কিছুতেই তাহার নাম প্রকাশ করিতে চাহে না। 

৩য় চিন্তা,—অভয় কোন কথা স্বীকার করিতেছে না, ও যেস্থানে সে বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছিল তাহাও সে আমাদিগকে দেখাইয়া দিল না, ও অপহৃত মূল্যবান দ্রব্যাদি কিছুই পাওয়া গেল না। এরূপ অবস্থায় বিচারক কোন্ প্রকারের উপর নির্ভর করিয়া অভয়কে দণ্ড প্রদান করিবেন? অথচ বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, অভয়ই এই চুরি করিয়াছে। এরূপ অবস্থায় অভয় যে বিনা দণ্ডে অব্যাহতি পাইবে তাহা ত বাঞ্ছনীয় নহে। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া দারোগাবাবু পরিশেষে স্থির করিলেন, যখন বুঝা যাইতেছে যে, অভয় কর্তৃক এই বাক্স অপহৃত হইয়াছে, তখন সে যে বিনা দণ্ডে অব্যাহতি পাইবে তাহা বাঞ্ছনীয় নহে। অভয়ের উপর এই মোকদ্দমা ঠিক করিয়া তাহাকে বিচারার্থ প্রেরণ করাই কর্ত্তব্য। 

এইরূপ স্থির করিয়া দারোগাবাবু যেমন তাহার কাগজপত্র লইয়া ডায়েরি লিখিতে আরম্ভ করিলেন, অমনি যশোদা আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। 

যশোদা পূৰ্ব্বেই শুনিতে পাইয়াছিল যে, অভয় চৌর্য্যাপরাধে ধৃত হইয়া থানায় আনীত হইয়াছে। নূতন কয়াল ষড়যন্ত্র করিয়া বিনা দোষে তাঁহাকে ধরাইয়া দিয়াছে। যশোদা জানিত, অভয়ের যতই কেন দোষ থাকুক না, সে চোর নহে। বিনা অপরাধে সে জেলে যাইবে ইহা যশোদা কোনরূপেই সহ্য করিতে পারিবে না। বিনা দোষে দারোগাবাবু যদি তাঁহাকে জেলে পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে সেই বা এই স্থানে থাকিয়া কি করিবে? একে তাহারা দারিদ্র্য নিবন্ধন বিশেষরূপ কষ্ট পাইতেছে, তাহার উপর আবার এই যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবে, এরূপ অবস্থায় অভয় যাহাতে পরিত্রাণ পায়, তাহার উপায় করা কর্তব্য, অভয়ের পরিবর্তে হয় সে নিজে জেলে যাইবে, না হয় উভয়েই জেলে বাস করিবে। অবশেষে তাহারা যেরূপ কষ্ট পাইতেছে তাহাতে তাহাদিগের জেলে বাস করাই মঙ্গল। সেই স্থানে তাহারা যতদিন থাকিবে, ততদিন পেট ভরিয়া তো খাইতে পাইবে! 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া যশোদা দারোগাবাবুর সম্মুখে গিয়া কহিল “মহাশয়, আপনি আমার স্বামীকে চুরির অপরাধে ধরিয়া আনিয়াছেন; সে চুরি করে নাই, তাহাকে ছাড়িয়া দিন। চুরি আমি করিয়াছি, আমাকে দণ্ড প্রদান করুন।” 

যশোদার কথা শুনিয়া দারোগাবাবু তাঁহার ডায়েরি লেখা বন্ধ করিলেন ও যশোদার দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন “তুমি কি বলিলে? অভয় চুরি করে নাই, চুরি করিয়াছ তুমি?” 

যশো। হাঁ মহাশয়, আমার স্বামী চুরি করে নাই, আমিই চুরি করিয়াছি। আমার স্বামী চোর নহেন। 

দারো। তুমি কোন্ সময়ে চুরি করিলে? 

যশো। যে সময় আমি রামহরিবাবুর আড়তে গিয়াছিলাম, সেই সময়েই আমি ওই বাক্স অপহরণ করি। 

দারো। সে সময় আড়তে কি কেহ ছিল না? 

যশো। আমি অপর কাহাকেও সেই সময় সেই স্থানে দেখিতে পাই নাই, কেবল একজন গোমস্তা গদির উপর শয়ন করিয়া একটি বাক্সের উপর মাথা রাখিয়া ঘুমাইতে ছিল। সেই সময় অপর বাক্সটি আমি উঠাইয়া লইয়া যাই।

দারো। যে সময় তুমি রামহরিবাবুর গদি হইতে আসিতে ছিলে, সেই সময় তাঁহার আর একজন গোমস্তার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু সে সময় তোমার নিকটে ত কোন বাক্স ছিল না। 

যশো। বাক্স দিনমানে হাতে করিয়া আনিলে কোন না কোন লোকে দেখিতে পাইবে এই ভাবিয়া আমি এক স্থানে উহা লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম, সন্ধ্যার পর আমি উহা বাহির করিয় আনি। 

দারো। ওই বাক্স তুমি খুলিলে কি প্রকারে? 

যশো। উহা খোলা ছিল। 

দারো। উহার ভিতর যে সকল টাকা কড়ি ছিল তাহা কোথায়? 

যশো। তাহা আমি আমার ঘরের পশ্চাৎ ভাগে এক স্থানে রাখিয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে কে উহা লইয়া গিয়াছে। 

দারো। খালি বাক্সটি কোথায় রাখিয়া দিয়াছিলে? 

যশো। গ্রামের বাহিরে একটি জঙ্গলের নিকট। 

দারো। একটি বিচালি গাদার মধ্যে কি? 

যশো। হাঁ মহাশয়। 

দারো। তুমি ওই স্থান আমাকে দেখাইতে পারিবে? 

যশো। পারিব। 

যশোদার এই কথা শুনিয়া দারোগাবাবু তাঁহার ডায়েরি লেখা বন্ধ করিয়া উঠিলেন ও যশোদাকে কহিলেন, আমার সহিত আইস আমি ওই সকল জায়গা তোমার নির্দেশমত দেখিতে চাই। 

দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া যশোদা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। প্রথমেই রামহরির গদিতে গিয়া যেস্থানে তাঁহার একজন গোমস্তা বাক্স উপাধান করিয়া নিদ্রা যাইতেছিল, সেই স্থানে সেই বাক্স ও সেই গোমস্তাকে যশোদা দেখাইয়া দিল। যশোদা নিজ চক্ষে যাহা দেখিয়া গিয়াছিল, তাহা দেখাইয়া দেওয়া যশোদার পক্ষে কিছুমাত্র কষ্টকর হইল না। 

যে স্থানে অপহৃত বাক্সটি থাকিত, তাহা যশোদা উত্তমরূপে জানিত, যখন সে রামহরিবাবুর নিকট কিছু সাহায্যের নিমিত্ত আসিয়াছিল, তখনই সে ওই বাক্স দেখিয়াছিল। সুতরাং অনায়াসেই সে সেই স্থান দেখাইয়া দিয়া কহিল “এই স্থান হইতে আমি বাক্সটি অপহরণ করিয়াছিলাম।” 

আড়তের মধ্যবর্তী একটি স্থানে কতকগুলি অব্যবহার্য্য দ্রব্য রক্ষিত ছিল, সেই স্থান দেখাইয়া দিয়া যশোদা কহিল, এই স্থানে সেই সময় সে ওই বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছিল, রাত্রিকালে সময়মত সে ওই বাক্স সেই স্থান হইতে বাহির করিয়া লইয়া যায়। বলা বাহুল্য এটি যশোদার মিথ্যা কথা। 

যেস্থানে অপর গোমস্তার সহিত যশোদার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেই স্থান যশোদা দারোগাবাবুকে দেখাইয়া দিল। পরিশেষে যশোদা দারোগাবাবুকে তাহার বাড়ীতে লইয়া গেল, বাড়ীর পশ্চাতে এক স্থানে একটি ছাইর গাদা ছিল, ওই স্থান দেখাইয়া দিয়া যশোদা কহিল, ওই বাক্সের মধ্যে যাহা কিছু ছিল, তাহার সমস্ত একখানি নেকড়ায় বাঁধিয়া সে ওই ছাই গাদার ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু পরে যখন সে উহার অনুসন্ধান করে, তখন আর দেখিতে পায় না। সেই স্থান হইতে কে উহা চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। যশোদার এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, সে কোন দ্রব্য অপহরণ করিয়া ছিল না বা ওই ছাই গাদার মধ্যে কোন দ্রব্য লুকাইয়া রাখিয়াছিল না। 

এই সমস্ত স্থান দেখাইয়া দিয়া সৰ্ব্বশেষে যেস্থানে সেই অপহৃত বাক্স পাওয়া গিয়াছিল সেই স্থানে দারোগাবাবুকে লইয়া সে গমন করিল, কিন্তু যে খড়ের গাদার ভিতর ওই বাক্স পাওয়া গিয়াছিল সেই খড়ের গাদা দেখাইয়া দিতে পারিল না। ওই স্থান হইতে একটু দূরে আর একটি খড়ের গাদা ছিল, সেইটি দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই খড়ের গাদার ভিতর সে বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছিল। 

যে স্থানে যশোদা কখন কোন বাক্স রাখে নাই, সেই স্থানে সে কিরূপে দেখাইবে! 

এই সমস্ত অবস্থা দেখিয়া দারোগাবাবু যশোদাকে লইয়া থানায় গমন করিলেন। যশোদা যখন নিজ মুখে তাহার সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া লইতেছে তখন দারোগাবাবু তাহাকে একেবারে অব্যাহতি দেনই বা কি প্রকারে? তাহাকেও ধৃত করিয়া ওই বাক্স চুরি-মোকদ্দমার আসামী করিলেন। এখন এই মোকদ্দমার আসামী হইল দুইজন-অভয় ও যশোদা। 

দারোগাবাবু থানায় আসিবার পরই এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ডায়েরি তাঁহাকে শেষ করিতে হইবে। কিরূপে তিনি তাঁহার ডায়েরি লিখিয়া এই মোকদ্দমা খাড়া করিবেন এখন সেই চিন্তা আসিয়া তাঁহার মনে উদয় হইল। 

সেই মোকদ্দমা সম্বন্ধে তিনি অনেক ভাবিলেন। ভাবিলেন যেরূপ অবস্থায় বাক্স পাওয়া গিয়াছে তাহাতে অভয়ের কোনরূপে দণ্ড হইবে না। যশোদা নিজে চুরি করিয়াছে বলিয়া, এখন স্বীকার করিতেছে, তাহার স্বীকার বাক্য ব্যতীত তাহার উপরই বা এমন কি প্রমাণ আছে যে, তাহার উপর নির্ভর করিয়া তাহাকে চালান দিতে পারি। সে যদি বিচারকের নিকট গিয়া তাহার দোষ স্বীকার করিয়া না লয় তাহা হইলে তাহারও দণ্ড হইবে না। 

এরূপ অবস্থায় আমি যাহার উপর যেরূপ প্রমাণ পাইতেছি, তাহার কিছু না কিছু পরিবর্তন না করিয়া দিলে অভয় ও যশোদার উপর এই মোকদ্দমা কোন রূপেই দাঁড়াইতে পারিবে না। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া তিনি ডায়েরি লিখিবার সময় নিজের ইচ্ছামত ওই মোকদ্দমা সাজাইয়া লইলেন। তাঁহার উপরিতন কৰ্ম্মচারিগণ তাঁহার ডায়েরি পড়িয়া বুঝিতে পারিলেন:- 

১। যে সময় রামহরি ঘোষের গদি হইতে বাক্স অপহৃত হয় তাহার কিছু পূর্ব্বে এক ব্যক্তি যশোদাকে রামহরি ঘোষের গদির দিকে যাইতে দেখিয়াছিল। 

২। রামহরি ঘোষের দ্বিতীয় কর্মচারী আহারাদি করিয়া যখন গদিতে প্রত্যাগমন করিতেছিল সেই সময় সে যশোদাকে সেই স্থান হইতে বাহির হইতে দেখে, তাহাকে দেখিয়া যশোদা দ্রুতগতি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে, সেই সময় তাহার বাম বাহুর নিম্নে বস্ত্রদ্বারা আচ্ছাদিত বাক্সের ন্যায় কি একটি দ্রব্য ছিল। যখন সেই কৰ্ম্মচারী গদিতে আসিয়া দেখে, গদির একটি বাক্স নাই তখন যশোদার উপর তাহার সন্দেহ হয়, ও সে তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত তখনই বাহির হইয়া যায় কিন্তু যশোদাকে কোন স্থানে খুঁজিয়া পায় না, এ কথা তিনি দারোগাবাবুকে প্রথমেই বলিয়াছিলেন। 

৩। রামহরি ঘোষের নূতন কয়াল রাত্রিকালে অভয়কে গ্রামের বাহিরে বিচালি গাদার দিকে গমন করিতে দেখিয়াছিল, সেই সময় অভয়ের হস্তে বস্ত্রাচ্ছাদিত বাক্সের ন্যায় কি একটি দ্রব্য ছিল। 

৪। অভয় ধৃত হইবার পর সমস্ত কথা স্বীকার করে ও কয়েকজন সাক্ষীর সম্মুখে সে দারোগবাবুকে লইয়া গিয়া গ্রামের প্রান্তস্থিত বিচালি গাদার মধ্য হইতে বাক্স বাহির করিয়া দেয়। 

৫। যশোদা সমস্ত কথা পুলিসের নিকট স্বীকার করে ও যেস্থানে সে অপহৃত অর্থাদি লুকাইয়া রাখিয়াছিল তাহা সাক্ষীগণের সম্মুখে দেখাইয়া দেয়। 

এইরূপভাবে ডাইরি লিখিতে আরম্ভ করিয়া ডাইরি লেখা শেষ হইবার পূর্ব্বে দারোগাবাবু যশোদাকে লইয়া তাহার স্বীকার বাক্য লিখাইয়া লইবার নিমিত্ত নিকটবর্ত্তী একখানি গ্রামে একজন অনারেরি মাজিষ্টেটের নিকট গমন করিলেন। দারোগাবাবুর নিকট যশোদা যেরূপ বলিয়াছিল তাঁহার নিকটও সেইরূপ বলিল তিনি যশোদার স্বীকার বাক্য লিখিয়া লইয়া দারোগাবাবুর হস্তে অর্পণ করিলেন। 

এই সমস্ত প্রামাণের উপর নির্ভর করিয়া দারোগাবাবু যশোদাকে ওই বাক্স চুরির অপরাধে এবং অভয়কে ওই চুরির সাহায্য করা অপরাধে বিচারার্থ প্রেরণ করিলেন। উহারা বিনা বাক্যব্যয়ে জেলের হাজতে গমন করিল 

দারোগাবাবু তাঁহার ডায়েরিতে যেরূপ লিখিয়াছিলেন রামহরি ঘোষের কর্ম্মচারী, তাঁহার নূতন কয়াল প্রভৃতি সকলেই সেইরূপ ভাবে সাক্ষ্য দিতে স্বীকার করিল। 

দারোগাবাবু যে কেন এইরূপ প্রমাণাদির যোগাড় করিয়া দিয়া সেই নিরপরাধী দরিদ্র স্বামী ও স্ত্রীকে জেলে দিবার বন্দোবস্ত করিলেন তাহা তিনিই বলিতে পারেন। লেখক কেবল এইমাত্র বলিতে পারেন যে কোন কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারীর স্বভাবই ওইরূপ, ওইরূপ কার্য্য তাঁহাদিগের উপরিতন কর্মচারীর অনুমোদিত না হইলেও কোন কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী ওইরূপ কার্য্য করিয়া আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন। নিজের বাহাদুরি ও কার্য্যপটুতা দেখাইবার নিমিত্ত বড় মোকদ্দমার কিনারা করিতে না পারিলে এইরূপ ভাবেই ওই সকল মোকদ্দমার কিনারা করিয়া থাকেন ও তাঁহার উপরিতন কর্মচারিগণের মনে এইরূপ প্রতীতি জন্মাইয়া থাকেন যে তিনি একজন অতিশয় কার্যদক্ষ কৰ্ম্মচারী। এইরূপ কৰ্ম্মচারীর উন্নতিও অতি শীঘ্র হইয়া থাকে; ও পরিশেষে তাঁহার পতন হইতেও কিছুমাত্র বিলম্ব হয় না। সুখের বিষয় এই যে ওইরূপ কর্মচারীর সংখ্যা অতি অল্প কিন্তু এই অল্প সংখ্যক কর্ম্মচারীর জন্যই পুলিস-কর্মচারীগণের এত বদনাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যে বিচারকের নিকট অভয় ও যশোদা বিচারার্থ প্রেরিত হইল তিনি একজন এ দেশীয় বিচারক, বিচার বিভাগে তিনি অল্প দিবস প্রবিষ্ট হইলেও তাঁহার বিচারে অনেকেই সন্তুষ্ট, যাহাতে তিনি যথার্থ বিচার করিতে পারেন, সেইদিকে তিনি বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিয়া থাকেন। 

ধার্য্য দিনে অভয় ও যশোদা বিচারার্থ তাঁহার সম্মুখে আনীত হইল। কোর্ট ইনস্পেক্‌টার তাহাদিগের মোকদ্দমা বিচারককে বুঝাইয়া দিলেন। বিচারক আসামীদ্বয়ের দিকে দৃষ্টি করিয়া কহিলেন “ইহাদিগের অবস্থা এরূপ শোচনীয় কেন?” 

কোর্ট ইঃ। ইহারা নিতান্ত দরিদ্র, সকল দিবস ইহাদিগের অন্নের সংস্থান হয় না। প্রায়ই অনশনে ইহাদিগকে দিন অতিবাহিত করিতে হয়, সেইজন্যই ইহাদিগের অবস্থা এইরূপ দেখিতেছেন। 

বিচারক। ইহাদিগের উকীল কে? 

কোর্ট ইঃ। উকীল ত কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না। বোধ হয় ইহারা কোন উকীল দেয় নাই। 

বিচারক। (অভয়ের দিকে লক্ষ্য করিয়া) তোমাদিগের কোন উকীল আছে? 

অভয়। অন্নের সংস্থান করিতে পারি না উকীল দিব কোথা হইতে? 

বিচারক। এ আদালতে অনেক উকীল আছেন যাঁহারা নিজের কার্য্য করিয়া পরের কার্য্য করিতে অনেক সময় পান, তাঁহাদিগের কাহারও কর্তব্য যে তিনি দরিদ্রের পক্ষ সমর্থন করেন। 

কোর্ট ইঃ। আপনি যাহা বলিতেছেন তাহা সত্য, আসামীর পক্ষ কোন আইনজীবীর দ্বারায় সমর্থিত হইলে, উভয় পক্ষ হইতে সকল কথা বাহির হইয়া পড়ে সুতরাং তাহাতে সুবিচারের বিশেষ সুবিধা হয়। 

বিচারকের সহিত কোর্ট ইনস্পেক্‌টারের যখন এইরূপ কথা হইতেছিল সেই সময় সেই স্থানে একজন নূতন উকীল বসিয়াছিলেন। তিনি বিচারকের কথা শুনিয়া কহিলেন “যদি অনুমতি হয় তাহা হইলে আমি ইহাদিগের পক্ষ সমর্থন করিতে প্রস্তুত হই।” 

উকীলের কথায় বিচারক সম্মত হইলেন, সেই উকীল অভয় ও যশোদার পক্ষ হইতে উকীল নিযুক্ত হইয়া তাহাদিগের পক্ষ সমর্থন করিতে প্রস্তুত হইলেন। বলা বাহুল্য ওকালত নামার খরচা সেই উকীলবাবুকেই বহন করিতে হইল। 

মোকদ্দমা আরম্ভ হইলে ফরিয়াদীর পক্ষে যে সকল সাক্ষী ছিল তাহাদিগের সকলের সাক্ষ্য গৃহীত হইল। দারোগাবাবু যেরূপ ভাবে এই মোকদ্দমার ডায়েরি লিখিয়াছিলেন সাক্ষিগণও সেইরূপ ভাবে সাক্ষ্য প্রদান করিল। এই মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত দারোগাবাবুকেও সেই স্থানে উপস্থিত হইতে হইয়াছিল। তিনি অবলীলা ক্রমে সাক্ষ্য প্রদান করিলেন যে অভয় তাঁহার নিকট সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া তাঁহাকে গ্রামের প্রান্তভাগে লইয়া যায় এবং সাক্ষিগণের সম্মুখে বিচালি গাদার মধ্য হইতে ওই বাক্স বাহির করিয়া দেয়। 

ফরিয়াদীর পক্ষীর সাক্ষিগণের জবান বন্দী হইয়া যাইবার পর উকীলবাবু একে একে ওই সকল সাক্ষীর জেরা করিতে আরম্ভ করিবেন। জেরার সমস্ত প্রকৃত কথা বাহির হইয়া পড়িল। 

জেরার বাহির হইল রামহরি ঘোষের কর্মচারী যশোদাকে গদি হইতে বাহির হইতে দেখে নাই, তাহার বাম বাহুর নিম্নে কাপড়ের মধ্যে লুক্কায়িত কোন দ্রব্য সে দেখে নাই। 

জেরায় বাহির হইয়া পড়িল, যে দিবস রামহরি ঘোষের গদি হইতে ওই বাক্স অপহৃত হয় সেইদিবস অভয় সেই গ্রামেই ছিল না। অপর একখানি গ্রামে ছিল ও সেই গ্রামের অনেকেই তাহা অবগত আছে। 

জেরায় বাহির হইল বিচালি গাদার মধ্য হইতে ওই বাক্স অভয় বাহির করিয়া দেয় না, উহা বাহির করিয়া দেয় রামহরি ঘোষের সেই নূতন কয়াল। 

জেরায় বাহির হইল সেই নূতন কয়ালের সংবাদ মত দারোগাবাবু অভয়কে গ্রেপ্তার করিয়াছিলেন। 

জেরায় বাহির হইল অভয় দারোগাবাবুর নিকট এই চুরি সম্বন্ধে কোন কথা স্বীকার করে নাই বরং প্রথম হইতেই সে বলিয়া আসিতেছে সে ইহার কিছুমাত্র অবগত নহে। 

জেরায় বাহির হইল দারোগাবাবুর ডায়েরিতে যে সকল কথা লিখিত হইয়াছে তাহা প্রকৃত নহে, প্রকৃত কথা গোপন করিয়া ওই ডায়েরি লিখিত হইয়াছে। 

জেরায় বাহির হইল আপন স্বামীকে জেল হইতে বাঁচাইবার নিমিত্ত যশোদা মিথ্যা করিয়া সমস্ত দোষ নিজের উপর লইয়াছে ও অনারেরি মাজিষ্ট্রেটের নিকট পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলিয়াছে। 

ক্রমান্বয়ে তিন দিবস কাল এই মোকদ্দমার জেরা চলিল। নূতন উকীল মহাশয় সুযোগ পাইয়া নিজের ক্ষমতা তাঁহার সাধ্যমত প্রকাশ করিতে লাগিলেন। জেরায় যখন ওইরূপ নানা কথা বাহির হইতে লাগিল সেই সময় আদালত গৃহ লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল, সকলেই আপনাপন কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া সেই মোকদ্দমা শুনিতে লাগিলেন। অপরাপর উকীলগণের মধ্যে অনেকেই আসিয়া ওই আদালত গৃহ পূর্ণ করিয়া বসিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই ওই উকীলবাবুকে পরামর্শ প্রভৃতি দানে ও জেরার বিষয় সকল বলিয়া দিয়া সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

এই মোকদ্দমার কথা ক্রমে চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। জেরায় এই মোকদ্দমা ক্রমে অন্যরূপ ধারণ করিতেছে, এই কথা কোর্ট ইনস্পেক্‌টার সেই ডিবিজানের ইনস্পেক্‌টারকে লিখিলেন। ইনস্পেক্টারবাবু সংবাদ পাইবামাত্র সেই আদালতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও সেই স্থানে বসিয়া এই মোকদ্দমার অবস্থা দেখিতে লাগিলেন। 

তিন দিবস পরে জেরা শেষ হইয়া গেল, বিচারকের বিশেষরূপ প্রতীতি জন্মিল যে, অভয় ও যশোদা কর্তৃক এই চুরি হয় নাই তাহারা বিনা দোষে বিচারার্থ প্রেরিত হইয়াছে। তাঁহার আরও মনে হইল, রামহরি ঘোষের নূতন কয়াল এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের সময় যেরূপ ভাবে পুলিসকে সাহায্য করিয়াছে ও অভয় ও যশোদার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিতে যেরূপ চেষ্টা করিয়াছে, সেরূপ প্রায় কেহই করে না। এরূপ অবস্থায় সে নিজে ওই চুরি করিয়া যাহাতে তাহার উপর পুলিসের কোনরূপ সন্দেহ না হয়, তাহাই ঢাকিবার নিমিত্ত এই রূপ করিয়া থাকিবে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া ৭ দিবসের জন্য এই মোকদ্দমা মুলতুবি করিলেন ও ইনস্পেক্টারবাবু যিনি সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাকে তাঁহার মনের ভাব বলিয়া তাঁহাকেই ওই মোকদ্দমার পুনরায় অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত উপরোধ করিলেন, ও আরও বলিয়াছিলেন, তিনি যেন সেই দারোগাবাবুর দ্বারা ইহার পুনরনুসন্ধান না করাইয়া নিজেই যেন, ইহার অনুসন্ধান করেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

ইনস্পেক্টারবাবু বিচারকের আদেশ প্রতিপালন করিলেন সেই কয়ালকে সঙ্গে লইয়া তখনই তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

ইনস্পেক্টারবাবুর সৰ্ব্ব প্রথম কাৰ্য্য হইল সেই কয়ালের বাড়ীতে খানাতল্লাসি করা। পাড়ার কয়েক জন প্রতিবেশীকে ডাকাইয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে তিনি উহার ঘর অনুসন্ধান করিলেন, তাহার ঘরে কাষ্ঠের একটি বড় বাক্স ছিল, ওই বাক্সের চাবি কয়াল সর্ব্বদাই নিজের নিকট রাখিত। ইনস্পেক্টারবাবু ওই বাক্সটি অনুসন্ধান করিবামাত্র তাহার ভিতর হইতে রামহরির তোড়া সহিত সমস্ত অর্থ প্রাপ্ত হইলেন। তদ্ব্যতীত একখানি নেকড়ায় বাঁধা এক জোড়া সোণার বালাও পাইলেন। এই সমস্ত দ্রব্য বাহির হইলে ওই বাড়ীর খানাতল্লাসি করিবার আর প্রয়োজন হইল না। তিনি তখনই রামহরি ঘোষকে সেই স্থানে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সংবাদ পাইবামাত্র রামহরি ঘোষ তাঁহার পুত্র ও গোমস্তাদ্বয়ের সহিত সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও অর্থপূর্ণ তোড়া দেখিয়া তাঁহার সকলেই চিনিতে পারিলেন ও কহিলেন, যে বাক্স বিচালি গাদার মধ্য হইতে পাওয়া গিয়াছে উহার মধ্যেই এই তোড়া সমেত এই অর্থ ছিল। সেই সমস্ত অর্থ সেই স্থানে সকলের সম্মুখে গণিয়া দেখা গেল যে উহা হইতে কেবলমাত্র দশটি মুদ্রা কম পড়িয়াছে। 

নেকড়ায় বাঁধা যে সোণার বালা পাওয়া গিয়াছিল তাহা দেখিয়া তাঁহারা উহাও চিনিতে পারিলেন ও কহিলেন যে সময় গদি হইতে বাক্স অপহৃত হয় সেই সময় এই বালাও ওই বাক্সের ভিতর ছিল। ওই বালা যে উহার ভিতর ছিল এ কথা পূর্ব্বে কাহার মনে ছিল না। ওই বালা রামহরি ঘোষের নহে, বহু দিবস পূর্ব্বে গ্রামের একটি ভদ্রলোক ওই বালা জোড়াটি তাঁহার নিকট বন্ধক রাখিয়াছিল, সেই পৰ্য্যন্ত উহা লোহার সিন্ধুকের ভিতরই থাকিত। এই চুরি হইবার প্রায় এক মাস পূর্ব্বে যাঁহার বালা তিনি উহা বাহির করিয়া রাখিতে বলেন ও কহেন তিনি সুদ সমেত সমস্ত টাকা প্রদান করিয়া ওই বালা খালাস করিয়া লইয়া যাইবেন। এই নিমিত্ত ওই বালা লোহার সিন্ধুক হইতে বাহির করিয়া বাক্সের ভিতর রাখা হয়; তাহার পর এই পর্যন্ত তিনি আর ওই বালা লইতে আসেন নাই, সুতরাং ওই বালা ওই বাক্সের ভিতরই রহিয়া গিয়াছিল। 

ইনস্পেক্টারবাবুর অনুসন্ধান এক দিবসেই শেষ হইয়া গেল, গ্রামস্থ সমস্ত লোক এই অবস্থা দৃষ্টে বিশেষরূপ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন, সকলেই অভয় ও যশোদার নিমিত্ত দুঃখ প্রাকশ করিতে লাগিলেন ও কয়ালকে যৎপরোনাস্তি গালি দিতে লাগিলেন। 

রামহরি ঘোষের যে কর্মচারী মিথ্যা কথা বলিয়াছিলেন তিনি এখন ভাবিতে লাগিলেন, দারোগাবাবুর পরামর্শে তিনি কি অন্যায় কাৰ্য্যই করিয়াছেন? ইনস্পেক্‌টারবাবু সেই কয়ালকে ধৃত করিলেন, ও তাহাকে লইয়া সেই বিচারকের নিকট উপস্থিত হইলেন ও যে সকল অবস্থা ঘটিয়াছিল, ও যেরূপে অপহৃত দ্রব্য পাওয়া গিয়াছিল, তাহার সমস্ত অবস্থা তাঁহাকে কহিলেন, তিনি সেই কয়ালের নামে সেই চুরি মোকদ্দমা দায়ের করিয়া তাহাকে চালান দিতে কহিলেন। ইনস্পেক্‌টারবাবু বিচারকের আদেশ প্রতিপালন করিলেন সেই কয়ালকে আসামী করিয়া বিচারার্থ প্রেরণ করিলেন। তিনি যে কেবল সেই কয়ালকেই বিচারার্থ প্রেরণ করিয়া ক্ষান্ত হইলেন তাহা নহে, এই স্থানে তাঁহার আর যেটুকু কৰ্ত্তব্য ছিল তাহাও তাঁহাকে করিতে হইল। তিনি তাঁহার উপরিতন কর্মচারীর নিকট ওই দারোগাবাবু সম্বন্ধীয় সমস্ত কথা রিপোর্ট করিলেন ও পরিশেষে ওই মোকদ্দমার অবস্থা কিরূপ দাড়াইয়াছে তাহাও তিনি লিখিলেন। তাঁহার প্রেরিত রিপোর্ট প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার উপরিতন ইংরাজ কর্মচারী দারোগাবাবুকে তাঁহার কার্য্য হইতে অস্থায়ী ভাবে অবসারিত করিলেন। অর্থাৎ এই আদেশ হইল যে, যে পর্য্যন্ত ওই মোকদ্দমার চূড়ান্ত বিচার শেষ না হয় সেই পর্যন্ত দারোগাবাবু তাঁহার কোন কার্য্য করিতে পারিবেন না। মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেলে বিচারক কি রূপ আদেশ প্রদান করেন তাহা দেখিয়া পরিশেষে আদেশ প্রদান করা যাইবে যে তাঁহার বিপক্ষে কোন মোকদ্দমা চালান হইবে কি নিজের বিভাগ হইতে তাঁহাকে কোনরূপে দণ্ডিত করা যাইবে বা বিনা দণ্ডে তাঁহাকে অব্যাহতি প্রদান করা যাইবে। আরও আদেশ হইল যে পর্য্যন্ত তিনি অপর আদেশ প্রাপ্ত না হইবেন, সেই পর্যন্ত তিনি অপর কোন স্থানে গমন করিতে পারিবেন না। 

ধার্য্য দিবসে পুনরায় মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল, অভয় ও যশোদা হাজত হইতে আসিল। কয়ালকেও সেই স্থানে আনা হইল। 

এই মোকদ্দমা দেখিবার নিমিত্ত ইহার পূর্ব্বে এই বিচারগৃহ যেরূপ লোকারণ্য হইয়াছিল, আজ তাহা অপেক্ষা আরও অধিক লোকের সমাগম হইল। আদালতের উকীলগণ আপনাপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আদালতের অপরাপর কার্য্য এক রূপ স্থগিত রহিল। 

বিচারক অভয় ও যশোদার মোকদ্দমা আরম্ভ না করিয়া সেই কয়ালের মোকদ্দমা প্রথমেই আরম্ভ করিলেন। অভয় ও যশোদার মোকদ্দমায় যে সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল তাহাদিগের অনেককেই এই মোকদ্দমায় সাক্ষ্য প্রদান করিতে হইল। যাহারা ইতিপূর্ব্বে হলপ করিয়া মিথ্যা কথা বলিয়াছিল তাহাদিগের মধ্যে সকলেই এখন কহিল “দারোগাবাবুর আদেশ মত তাহারা ওইরূপ বলিয়াছিল।” কয়ালের উপর এই মোকদ্দমা উত্তমরূপে প্রমাণিত হইলে বিচারক তাহাকে কঠিন পরিশ্রমের সহিত দুই বৎসরের জন্য জেলে প্রেরণ করিলেন, অভয় ও যশোদাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। এই মোকদ্দমার রায় লিখিবার সময় তিনি দারোগাবাবুর উপর বিশেষ তীব্র মন্তব্য প্রকাশ ও সেই উকীলবাবুকে যথেষ্ট প্রশংসা করিলেন। 

পুলিস বিভাগের উপরওয়ালা, দারোগাবাবুকে সহজে অব্যাহতি দিলেন না, মিথ্যা মোকদ্দমা সাজান ও মিথ্যা সাক্ষী প্রস্তুত করা অপরাধে দারোগাবাবুকে ফৌজদারি সোপরদ্ধ করিলেন। এই মোকদ্দমার বিচার করিলেন অপর আর একজন ইংরাজ বিচারক। বিচারে দারোগাবাবু ছয় মাসের জন্য কারারুদ্ধ হইলেন। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

আদালত হইতে বহির্গত হইয়া অভয় ও যশোদা আর সেই স্থানে দাঁড়াইল না, বা গ্রামের মধ্যেও প্রবেশ করিল না। উভয়ে কি পরামর্শ করিয়া, তাহাদিগের সেই স্থানের চির দিবসের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, সেই স্থানের চির পরিচিত ও বন্ধু বান্ধবদিগের মায়া ছিন্ন করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। তাহাদিগের সেই সামান্য কুটীরখানির দিকে একবারের জন্যও দৃষ্টিপাত না করিয়া, জন্মভূমির মায়া একেবারে পরিত্যাগ করিয়া চির দিবসের নিমিত্ত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। তাহারা যে কোথায় ও কোন্ পথে যাইবে তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই, কি খাইয়া জীবন ধারণ করিবে তাহার কিছুমাত্র উপায় নাই, তথাপি তাহারা চলিতে লাগিল। তাহারা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, যেস্থানে দরিদ্রের দুঃখ কেহ বোঝে না, বিনা দোষে দরিদ্রকে জেলে দিতে যেস্থানের লোক প্রস্তুত, অপর স্থানে অনশনে মরিলেও, সেই স্থানে আর এক দিবসের জন্যও বাস করা কর্ত্তব্য নহে। 

তাহাদিগের চলিবার সামর্থন ছিল না তথাপি তাহারা ধীরে ধীরে সেই স্থান হইতে চলিতে লাগিল। সম্মুখে যে সুদীর্ঘ রাজবর্ণ দেখিতে পাইল তাহাই অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিল। যে পৰ্য্যন্ত সূর্য্যদেব অস্তমিত হইলেন না, সেই পর্যন্ত তাহারা চলিল। সন্ধ্যার পর একখানি গ্রামে আসিয়া তাহারা উপস্থিত হইল। ওই গ্রামে একঘর উগ্রক্ষত্রিয়ের অবস্থা ভাল ছিল, তাঁহার পাঁচ সাতখানি লাঙ্গলের চাষ হইত, রাখাল, কৃষাণ ও চাকর-চাকরাণী অনেকগুলি ছিল, এক বৎসর সুজন্মা হইলে, দুই তিন বৎসর আর কাহারও অন্ন চিন্তা থাকিত না, তাঁহার ঘরে ধান, চাউল, গম, ছোলা প্রভৃতি আহারীয় দ্রব্য অপর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহ থাকিত। স্থল কথায় অনেকগুলি লোক তাঁহা দ্বারা প্রতিপালিত হইত। 

অভয় ও যশোদা সেই স্থানে তাঁহারই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইল, ও সেই স্থানে আহারাদি করিয়া শয়ন করিয়া রহিল। যাঁহার বাড়ীতে তাহারা সেই রাত্রি অতিবাহিত করিল তাঁহার সহিত অভয়ের সাক্ষাৎ হইলে কিরূপ বিপদে পড়িয়া তাহারা দেশত্যাগ করিতেছে তাহা তিনি অবগত হইয়া অতিশয় দুঃখিত হইলেন ও তাহাদিগকে কলিকাতায় যাইবার পরামর্শ দিয়া কহিলেন সেই স্থানে গমন করিলে অনায়াসেই কোন না কোন কর্ম্মের সুবিধা হইবে, সেই স্থানে অনশনে মরিতে হইবে না, বিশেষ অভয় যখন করালের কার্য্য জানে তখন হাটখোলা অঞ্চলের মহাজনপটীতে তাহার অনায়াসেই অন্নের সংস্থান হইবে। এই বলিয়া তিনি তাহাদিগকে সেই দিবস সেই স্থানে যত্ন করিয়া রাখিলেন। পরদিবস প্রত্যূষে তাহারা সেই স্থান পরিত্যাগ করিল, যাইবার সময় পাঁচ সাত দিবস অনায়াসেই চলিতে পারে এই পরিমিত চাউল ডাউল প্রভৃতি তিনি উহাদিগকে প্রদান করিলেন। 

সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া অভয় ও যশোদা পদব্রজে কলিকাতা অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। দুই দিবস চলিবার পর সন্ধ্যার প্রাক্কালে তাহারা যেস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই স্থান হইতে দুই ক্রোশের মধ্যে রাস্তার ধারে কোন গ্রাম ছিল না। একটি লোকের নিকট জানিতে পারিল যে ওই রাস্তা পরিত্যাগ করিয়া অৰ্দ্ধক্রোশ গমন করিলে একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম পাওয়া যাইতে পারে। 

সেই সময় আকাশ হঠাৎ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল ও প্রবল ঝড়বৃষ্টি হইবার উপক্রম হইল, তখন তাহারা রাস্তা পরিত্যাগ করিয়া সেই ক্ষুদ্র গ্রামের অভিমুখে গমন করিতে লাগিল কিছুদূর গমন করিতে না করিতেই ভয়ানক অন্ধকার হইয়া গেল, প্রবল বেগে ঝড় উত্থিত হইল, ও সেই সঙ্গে বৃষ্টিও আসিয়া উপস্থিত হইল। অভয় অগ্রে অগ্রে গমন করিতেছিল, যশোদা সেই সময় তাহার প্রায় এক শত হস্ত পশ্চাৎ পড়িয়াছিল। নিকটে একটি বৃহৎ বৃক্ষ দেখিতে পাইয়া অভয় দ্রুতপদে গমন করিয়া সেই বৃক্ষতলে দণ্ডায়মান হইল। 

অভয় সেই বৃক্ষতলে দণ্ডায়মান হইয়া যশোদাকে বার বার ডাকিল, কিন্তু সেই ঝড় জলের মধ্যে তাহার কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, সে কিয়ৎদূরে ফিরিয়া আসিয়া যশোদার অন্বেষণ করিল কিন্তু কোন স্থানে তাহাকে দেখিতে না পাইয়া সে পুনরায় বৃক্ষতলে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। 

সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে যশোদা অভয়কে আর দেখিতে পাইল না, সে যে কোথায় গেল তাহা জানিতে না পারিয়া অভয় অগ্রে অগ্রে যাইতেছে, এই বিবেচনায়, সেই অন্ধকারের মধ্যে সে ক্রমে অগ্রসর হইতে লাগিল। অভয়ও জানিতে পারিল না যে যশাদা কোথায় গেল। প্রায় একঘণ্টা পরে ঝড় জল থামিয়া গেল, আকাশ পরিষ্কার হইল। অভয় যশোদাকে দেখিতে না পাইয়া মনে করিল, যে গ্রামে তাহারা গমন করিতেছিল যশোদা তাহাকে দেখিতে না পাইয়া সেই গ্রামেই গমন করিয়াছে এই বিবেচনা করিয়া অভয় সেই গ্রামে গমন করিল, সেই স্থানে তাহার স্ত্রীর অন্বেষণ করিল কিন্তু কোন স্থানে তাহার কোনরূপ সন্ধান পাইল না। অভয় সেই গ্রামে দুই দিবস কাল অবস্থিতি করিয়া নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহে ও অপরাপর স্থানে যশোদার অনুসন্ধান করিল কিন্তু কোন স্থানে তাহার কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক কলিকাতা অভিমুখে গমন করিল। 

যশোদা সেই ঝড় জলের সময় সেই নিকটবর্তী গ্রামে তাহার স্বামী গমন করিতেছে ভাবিয়া সে সেই দিকে গমন করিতেছিল কিন্তু সেই প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে অন্ধকারের মধ্য দিয়া গমন করিবার কালীন তাহার দিকভ্রম জন্মিল, সে সেই গ্রামের দিকে গমন করিবার পরিবর্তে অন্য দিক অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিল, ক্রমে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ।

প্রান্তরের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল, সমস্ত রাত্রি একটি বৃক্ষতলে উপবেশন করিল, ও দেখিতে দেখিতে সে নিদ্রায় অভিভূতা হইয়া সেই স্থানেই পড়িয়া রহিল, যখন তাহার নিদ্রা ভাঙ্গিল তখন বেলা হইয়া গিয়াছে। সে গাত্রোত্থান করিল, দেখিল যেস্থানে সে শয়ন করিয়াছিল সেই স্থান হইতে একটু দূরে একটি রাজবর্থ। সে সেই রাজবর্তের উপর গিয়া উপস্থিত হইল। ওই রাজবর্মের উপর দুই একজন লোক দেখিতে পাইল, তাহাদিগের নিকট জানিতে পারিল, সেই রাস্তা দিয়া গমন করিলে কলিকাতায় যাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু যেরূপ ভাবে যশোদা চলিতেছিল তাহাতে ১০/১২ দিবস না চলিলে সে কোন ক্রমেই সেই স্থানে উপনীত হইতে পারিবে না। 

যশোদা ভাবিল অভয় যেস্থানেই থাকুক সে কলিকাতায় যাইবে, সুতরাং কলিকাতায় গেলেই তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। যশোদা জানিত না যে কলিকাতা কিরূপ স্থান। তাহার বিশ্বাস ছিল, যেরূপ গ্রামে যশোদা এতদিবস বাস করিয়া আসিয়াছে কলিকাতাও সেই প্রকারের একখানি গ্রাম হইবে, সুতরাং সেই স্থানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলে সে অভয়ের নিশ্চয়ই ঠিকানা করিতে পারিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া যশোদা সেই রাস্তা অবলম্বনে কলিকাতা অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। 

যাইতে যাইতে রাস্তায় তাহার একজন সঙ্গী জুটিয়া গেল। সে তাহার এক জাতি ও সেও কলিকাতায় গমন করিবে এই পরিচয় দিয়া যশোদার সহিত প্রায় চারি-পাঁচ ঘণ্টা কাল গমন করিল। দিবা আন্দাজ বারটার সময় যশোদা দেখিতে পাইল যে, যেদিক হইতে তাহারা আসিতেছিল সেই দিক হইতে একটি লোক দ্রুতবেগে তাহাদিগের নিকটবর্তী হইতেছে, ক্রমে সে আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিল ও যশোদার সঙ্গে যে ব্যক্তি গমন করিতেছিল তাহাকে চুপে চুপে কি বলিয়া সে সেই স্থান হইতে ওই রাস্তা পরিত্যাগ করিয়া অন্য দিকে গমন করিল। 

যে ব্যক্তি যশেদার সহিত গমন করিতেছিল, তাহার নিকট একটি ছোট গাঁটরি ছিল, সে উহা যশোদার হস্তে প্রদান করিয়া কহিল “সম্মুখে ওই একখানি দোকান দেখা যাইতেছে ওই স্থানে আমাদিগকে আহারাদি করিতে হইবে। তুমি ওই স্থানে গমন করিয়া রন্ধনাদির যোগাড় কর, আমি এখনই আসিয়া তোমার সহিত মিলিত হইব। আমি না আসিলে তুমি ওই স্থান হইতে অপর কোন স্থানে গমন করিও না।” 

এই বলিয়া সে সেই রাস্তা পরিত্যাগ পূর্ব্বক একদিকে গমন করিল, সে যে কেও কোথায় গেল তাহার কিছুই যশোদা জানিতে পারিল না, সে তাহার গাঁটরিটি লইয়া সেই দোকানাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। ওই স্থান হইতে ওই দোকান বোধ হয় সহস্র হস্তের অধিক ছিল না। যশোদা ধীরে ধীরে গমন করিয়া ক্রমে সেই স্থানে উপস্থিত হইল, ও সেই দোকানের সম্মুখে একটি আম্রবৃক্ষের নিম্নে উপবেশন করিল। 

যশোদা সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই একদল পুলিস-কৰ্ম্মচারী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের মধ্যে একজন প্রধান পুলিস-কৰ্ম্মচারী ছিলেন, তিনি সেই মুদিকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন যে কোন অপরিচিত লোককে সে সেইদিবস সেই স্থান দিয়া গমন করিতে দেখে নাই, কেবলমাত্র এই স্ত্রীলোকটি এখনই আসিয়া ওই স্থানে উপবেশন করিয়াছে। কর্ম্মচারী যশোদাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন, একটি লোক তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছিল, অপর আর একটি লোক আসিয়া তাহাকে কি বলিয়া যায়। সেও পরিশেষে তাহার একটি ছোট গাঁটরি যশোদাকে দিয়া এই দোকান দেখাইয়া দেয়, ও যশোদাকে এই স্থানে আগমন করিয়া আহারাদির বন্দোবস্ত করিবার উপদেশ দিয়া সেও শীঘ্র আসিতেছে এই বলিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। 

যশোদার নিকট হইতে এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া কৰ্ম্মচারী বুঝিতে পারিলেন তাঁহারা যাহার অনুগমন করিতেছিলেন সে অগ্রেই তাহা জানিতে পারিয়া পলায়ন করিয়াছে। 

যশোদার নিকট তাহার যে গাঁট্‌রিটি ছিল তাহা সেই কৰ্ম্মচারী সর্ব্ব সমক্ষে খুলিলেন ও দেখিলেন তিনি যে ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছিলেন ও তাহাতে যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছিল তাহার সমস্তই ওই ছোট গাঁরি ভিতর ছিল। 

যে দিবস ওই লোকটি আসিয়া যশোদার সহিত মিলিত হয় তাহার পূর্ব্ব রাত্রে একখানি গ্রামে একটি ডাকাইতি হয় ও যে সকল অলঙ্কার যশোদার নিকট পাওয়া গেল সেই সকল অলঙ্কার অপহৃত হয়। পুলিস এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে করিতে অবগত হইতে পারেন যে গয়ারাম দাস নামক এক ব্যক্তি ওই ডাকাইতিতে সংমিলিত ছিল ও সমস্ত অলঙ্কার তাহার নিকট জমা ছিল, পরিশেষে সে সেই সকল অলঙ্কার কলিকাতায় বিক্রয় করিবার নিমিত্ত বাড়ী হইতে প্রস্থান করিয়াছে। 

এই সংবাদ পাইয়া উহাকে ধরিবার নিমিত্ত পুলিস-কর্ম্মচারিগণ উহার অনুসরণ করিতেছিল, কিন্তু গয়ারাম রাস্তায় এই সংবাদ পাইয়া গহনাগুলি যশোদার নিকট রাখিয়া নিকটবর্তী একটি জঙ্গলে আশ্রয় করে। সে ভাবিয়াছিল তাহাকে দেখিতে না পাইলেই পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ প্রস্থান করিবে। যশোদা যে ধৃত হইবে ও তাহার নিকট হইতে যে অলঙ্কারগুলি বাহির হইয়া পড়িবে তাহা গয়ারাম একবারের জন্যও ভাবিয়াছিল না। 

গয়ারাম দূর হইতে দেখিতে পাইল যশোদা ধৃত হইল অলঙ্কারগুলিও পুলিসের হস্তগত হইল সুতরাং সেও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পুলিস পরিশেষে নিকটবর্ত্তী স্থানে তাহার অনুসন্ধান করিলেন কিন্তু তাহাকে আর পাইলেন না। গয়ারামকে ধরিবার নিমিত্ত ইহার পরও অনেক চেষ্টা হইয়াছিল কিন্তু কোনরূপ সুফল ফলে না। 

এবার আর যশোদা নিষ্কৃতি পাইল না এই মোকদ্দমায় দোষ না থাকিলেও বিনা দোষে সে দুই বৎসরের জন্য কারারুদ্ধ হইল। 

নবম পরিচ্ছেদ 

যে রাত্রিতে অভয়া যশোদাকে হারাইয়া ছিল সেই রাত্রিতে তাহার কোনরূপ সন্ধান করিতে না পারিয়া সেই প্রদেশে দুই তিন দিন থাকিয়া সে তাহার অনেক অনুসন্ধান করিল কিন্তু কোন স্থানেই যশোদার সন্ধান না পাইয়া অনন্যোপায় হইয়া সে নিতান্ত মনের কষ্টে ক্রমে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইল। 

ইহার পূর্ব্বে অভয় আর কখন কলিকাতায় আইসে নাই। জিজ্ঞাসা করিতে করিতে সে ক্রমে গিয়া হাটখোলায় উপস্থিত হইল। সেই স্থানে একটি আড়তে গমন করিয়া সে আশ্রয় গ্রহণ করিল। 

আড়তের প্রধান কর্ম্মচারী তাহাকে দেখিয়া সে কে, কোথা হইতে আসিতেছে, কি কার্য্যের নিমিত্ত আসিয়াছে তাহার সমস্ত পরিচয় গ্রহণ করিলেন। তাহার সমস্ত অবস্থা শুনিয়া, তাহার স্ত্রীর অবস্থা শুনিয়া তাঁহার দয়া হইল, তিনি তাঁহার প্রধান কয়ালকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন এই ব্যক্তি কয়ালির কার্য্য অবগত আছে বলিতেছে ইহার দ্বারা যদি তোমার কোনরূপে সাহায্য হয়, তাহা হইলে ইহাকে তোমার নিকট রাখিয়া দেও। 

সদার-কয়াল প্রধান কর্মচারীর কথামত অভয়কে লইয়া তাহার নিজ স্থানে গমন করিল। সেই দিবস যে যে স্থানে তাহার কার্য্য হইল, সে নিয়মমত সেই সেই স্থানে এক একজন কয়ালকে পাঠাইয়া দিল, যেস্থানে সে নিজে গমন করিল সেই স্থানে সে অভয়কে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেল ও তাহার সম্মুখে অভয়কে কয়ালির কার্য্যে নিযুক্ত করিল। অভয় যেরূপ ভাবে তাহার কার্য্য সমাপন করিল, তাহা দেখিয়া সদার কয়াল বিশেষরূপে সন্তুষ্ট হইল। সেইদিবস হইতেই অভয়ের বেতন ধার্য্য হইয়া গেল। 

সকলেই অভয়ের কার্য্যে দিন দিন বিশেষ রূপ সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। 

অভয়ের দরিদ্রতা দূর হইল ও তাহার কিছু অর্থেরও সংস্থান হইল সত্য কিন্তু তাহার মনের কষ্ট কিছুতেই অন্তর্হিত হইল না, যশোদার চিন্তাতেই সৰ্ব্বদা তাহাকে অস্থির করিত। অনশনে সেদিন অতিবাহিত করিয়াছে আজ সুখের দিবস সে দেখিতে পাইল না। এক মুষ্টি অন্নের জন্য যে দ্বারে দ্বারে ফিরিয়াছে, আজ সেই অন্ন সে অপরকে দিতে পারিল না, ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? এই প্রকারের নানারূপ চিন্তাতেই অভয়কে দিন অতিবাহিত করিতে হইত। অভয় নানা স্থানে, এমন কি গ্রামে পর্য্যন্ত যশোদার অনেক অনুসন্ধান করিল কিন্তু কোন স্থানেই যশোদার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিল না। 

এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইবার পর বিশেষ কোন কার্য্যের নিমিত্ত সদার-কয়ালকে দেশে গমন করিতে হইল। অভয়ই তাহার স্থানে কার্য্য করিতে লাগিল। দেশ হইতে সেই সর্দ্দারকে আর ফিরিতে হইল না, সেই স্থানে হঠাৎ সে মৃত্যুমুখে পতিত হইল। অভয়ও সেই সর্দ্দার-কয়ালের কার্য্যে নিযুক্তই থাকিল। ক্রমে অভয়ের ভাগ্য লক্ষ্মী প্রসন্ন হইল, এক এক করিয়া ক্রমে তাহার চারিখানি খোলার বাড়ী হইল, পরিশেষে একটু জায়গা খরিদ করিয়া তাহার উপর দুইটি পাকা ঘরও প্রস্তুত করিয়া সে তাহাতেই বাস করিতে লাগিল। দুই বৎসরের মধ্যে অভয়ের অবস্থার এত দূর পরিবর্ত্তন হইল। 

এইরূপে দুই বৎসর অতীত হইবার অতি অল্প দিবস বাকী থাকিতে অভয়ের অধীনস্থ একজন কয়ালের একটি মারপিট মোকদ্দমায় ১০ দিবসের নিমিত্ত জেল হয়। অভয় তাহাকে অতিশয় ভালবাসিত ও তাহার মোকদ্দমায় নিজ হইতে কিছু খরচও করিয়াছিল কিন্তু তাহাকে কোনরূপে বাঁচাইতে পারে না। 

যে দিবস সেই কয়ালের জেল হইতে খালাস হইবার দিন ছিল সেইদিবস তাহাকে আনিবার নিমিত্ত অভয় অতি প্রত্যূষে হরিণবাড়ীর জেলের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। অভয়ের ইচ্ছা ছিল সেই কয়ালকে যেমন জেল হইতে ছাড়িয়া দেওয়া হইবে, অমনি সে তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিবে। 

কিয়ৎক্ষণ সেই স্থানে অপেক্ষা করিবার পর অভয় দেখিল কয়েকজন স্ত্রীলোক কয়েদীকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। উহারা বাহিরে আসিবামাত্র কেহ না কেহ উহাদিগকে লইয়া চলিয়া গেল, কেবল একটি স্ত্রীলোক সেই স্থানে রহিয়া গেল। সে জেল হইতে বাহিরে আসিয়া জেলের সম্মুখে একটি বৃক্ষতলে গিয়া উপবেশন করিল। বোধ হইল সে কোথায় গমন করিবে তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া সেই স্থানে আসিয়া উপবেশন করিল। 

অভয় দূর হইতে তাহাকে দেখিতে পাইল তাহার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল সে ধীরে ধীরে তাহার নিকট গমন করিয়া দেখিল তাহার মনে যে সন্দেহ উদয় হইয়া ছিল তাহা ঠিক। দেখিল ওই স্ত্রীলোক আর কেহই নহে তাহার স্ত্রী যশোদা, যশোদাও অভয়কে দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইল কিন্তু তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না, চক্ষু হইতে প্রবল বেগে জল ধারা পতিত হইয়া তাহার পরিধেয় বস্ত্র ভিজিয়া যাইতে লাগিল। অভয়ও কোনরূপে অশ্রুজল সংবরণ করিয়া তাহাকে আলিঙ্গন পূৰ্ব্বক, কয়ালকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে গাড়ি আনিয়াছিল তাঁহাতেই যশোদাকে উঠাইয়া লইল ও অল্পকথায় তাহার অবস্থা অবগত হইয়া সেই সময় তাহাকে কোন কথা বলিতে নিষেধ করিয়া দিল। দেখিতে দেখিতে সেই কয়ালও জেল হইতে বাহির হইয়া আসিল। অভয় তাহাকে কহিল “তোমাকে জেল হইতে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আসিবার কালীন দেখিতে পাই আমার স্ত্রী এই গাড়িতে আমার বাসায় যাইতেছে সুতরাং আমিও সেই গাড়িতে উঠিয়া ভাবি তোমাকেও একেবারে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই, তাই আমার স্ত্রীর সহিত তোমাকে লইতে আসিয়াছি, আমার স্ত্রী গাড়ির ভিতর আছে। আইস একত্রে এক গাড়িতে গমন করিয়া অগ্রে তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছিয়া দি।” 

কয়াল অভয়ের কথায় বিশ্বাস করিয়া সেই গাড়ির উপর উঠিল অভয় গাড়ির ভিতর তাহার স্ত্রীর সহিত উপবেশন করিল। কয়ালকে তাহার বাসায় নাবাইয়া দিয়া যশোদার সহিত অভয় আপন বাড়ীতে উপনীত হইল। যশোদা যে জেলে গিয়াছিল এ কথা কলিকাতায় আর কেহই জানিতে পারিল না। কয়েদিগণকে এক জেল হইতে অন্য জেলে বদলী করিবার নিয়ম আছে বলিয়া যশোদা ক্রমে হরিণবাড়ীর জেলে আসিয়াছিল বলিয়াই ঈশ্বরের অনুগ্রহে সে তাহার স্বামীর সাক্ষাৎ পাইল। 

এতদিবস পরে যশোদার সমস্ত দুঃখ দূর হইল তাহার আর কোনরূপ কষ্ট রহিল না নিজের পাকা বাড়ীতে বাস করিয়া খোলার বাড়ীর ভাড়া সংগ্রহ করিয়া এবং অভয়ের উপার্জিত অর্থ সঞ্চয় করিয়া সে এখন মনের সুখে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল। দিন দিন তাহার যেরূপ সংস্থান হইতে লাগিল, দিন দিন দরিদ্রদিগকে অন্ন প্রদান করিয়া আপনাদিগের পূর্ব্বকার অনশনের কষ্ট কিয়ৎ পরিমাণে লাঘব করিতে লাগিল। এইরূপে প্রায় পঁচিশ বৎসর কাল যশোদা কলিকাতায় বাস করিয়া একটি বিশ বৎসরের পুত্র রাখিয়া স্বামী ও পুত্রের সম্মুখে হাটখোলা ঘাটে গঙ্গামৃত্তিকার উপর শয়ন করিয়া গঙ্গা দর্শন করিতে করিতে সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করিল। 

সম্পূর্ণ 

[ শ্রাবণ, ১৩১৮ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *