অদৃশ্য সাহায্যকারী

অদৃশ্য সাহায্যকারী

প্রেতাত্মা সম্পর্কে মানুষের ধারণা অনেকটাই বদলে দিয়েছে কানাডার ল্যাব্রাডরের এক অশরীরী। প্রেত মানুষের ক্ষতি করে এটাই সাধারণ ধারণা। কিন্তু ল্যাব্রাডরের ওই প্রেতাত্মা বিপদে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে, তাদের পথ দেখায়।

শুরুতে বরং ফ্রেড কর্কবির কাহিনীটি শোনা যাক। পারট্রিজ হিলের দুর্গম এক পথে চলছিল কৰ্কবি। দশটা কুকুর তার স্লেজ গাড়িটা টেনে নিয়ে চলছিল। হঠাৎ পুব দিক থেকে ধেয়ে এল তুষার ঝড়। চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কর্কবি। ভেজা স্কার্ফটা দিয়ে ঢেকে মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করল। এদিকে ঝড়ে স্লেজটা নিয়ে কুকুরগুলো দিগ্বিদিক্ দৌড়চ্ছে।

তুষারকণাগুলো মুখে বিঁধছে সূচের মত। শীতল বাতাসে চোখ খুলে রাখা মুশকিল। হঠাৎই একটা খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়ে গেল কুকুরেরা। কয়েক পা এগুলেই খাদে পড়ে মৃত্যু হত সবার। পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব শিকারি কর্কবির মনোবল অসাধারণ। এই পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রাখল। বুঝতে পারল পথ হারিয়েছে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে না পড়লে খারাপি আছে কপালে। ঝড়ো বাতাসে হয়তো গিয়ে পড়বে খাদে।

এসময়ই জোরে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করল কুকুরগুলো। ছুটে যেতে চাইল। ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য স্লেজের কাছে এগিয়ে গেল কর্কবি। এসময় কাছেই আরও কিছু কুকুরের শব্দ কানে এল। ভালভাবে চারপাশে তাকাতেই দেখল তুষারের মধ্যে চোদ্দ-পনেরোটা কুকুর অপর একটি স্লেজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্লেজের পেছনে দাঁড়িয়ে সাদা ফারের পোশাক গায়ে চাপানো বিশালদেহী এক লোক। হাতে চাবুক। চিৎকার করে লোকটাকে ডাকল কর্কবি। কিন্তু ঝড়ে হারিয়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। লোকটার কোন দিকে খেয়াল নেই, কুকুরগুলোর শরীরে চাবুকের বাড়ি কষাতে কষাতে দ্রুত চলে যাচ্ছে। মনস্থির করে ফেলল কর্কবি। ওদের পেছনেই যাবে। তাছাড়া লোকটার আচরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে এই এলাকা হাতের তালুর মতই চেনে। অতএব দেরি না করে

রগুলোকে ছোটাল ওই লোকটা এবং তার স্লেজটানা *সুরগুলোর পেছনে। মোটামুটি এক ঘণ্টাটাক পরে ফ্রেঞ্চম্যান’স আইল্যাণ্ডে সৈনিকদের ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌছে গেল। যে দলটাকে অনুসরণ করছিল একটা বাঁক নিয়ে ওটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে বলতে পারবে না।

একটু পরে গ্রামের একমাত্র সরাইখানাটায় পৌছল। ভেতরে ঢুকে কিছু পান করতে করতে শরীর গরম করতে লাগল আগুনে। এই ফাঁকে সরাইমালিককে জিজ্ঞেস করল, ‘একটু আগে একটা কুকুরের দল নিয়ে আসা ওই লম্বা-চওড়া লোকটাকে চেনো?’

‘কী বললে? তুমিই প্রথম। তোমার আগে অন্য কোন আগন্তুক গ্রামে আসেনি আজ।’

‘ধুর, এটা হয় নাকি? সেই ল্যাব্রাডর থেকে তার পেছন পেছন এসেছি। হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কীভাবে?’

‘যার পিছু নিয়ে এসেছ সে মানুষ নয়, অশরীরী। তোমার বিপদ দেখে সাহায্য করেছে। ওর নাম স্মোকার।’

অল্প কিছুদিন হলো কুইবেক থেকে ল্যাব্রাডর এসেছে কর্কবি। মোটেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নয় সে। কিন্তু কথা বলতেই বুঝতে পারল এখানে স্মোকারকে নিয়ে যেসব গল্পগাথা প্রচলিত সেগুলো একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। ইজু ডিলিংহ্যামের প্রেতই এখানকার লোকেদের কাছে স্মোকার নামে পরিচিত। তুষার ঝড়ে বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করে এই উপকারী প্রেতটি.

আশ্চর্য ব্যাপার, কেবল দুর্যোগের সময় দেখা যায় স্মোকারকে। গত অর্ধ শতাব্দী কিংবা এর বেশি সময়ে অসংখ্য শিকারি, অভিযাত্রী তাকে দেখেছে, বিপদে তার সাহায্য পেয়েছে।

কে এই ইজু ডিলিংহ্যাম? তার ব্যবসা ছিল মদ চোলাই করা। গোটা ল্যাব্রাডর এলাকায় তার মদের খ্যাতি ছিল। যারা মদ চোলাই করে তাদের বলে স্মোকার। তাই ইজু ডিলিংহ্যামের প্রেতাত্মার নাম হয়ে যায় স্মোকার। সে কোথা থেকে এসেছে নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা হয় কুইবেকের গাসপে উপদ্বীপ থেকে ল্যাব্রাডরে এসেছিল শিকার করতে। কেউ আবার বলে সে এসেছিল নিউ ফাউণ্ডল্যাণ্ড থেকে। যেখান থেকেই আসুক এই জায়গাটার প্রেমে পড়ে যায়। রাতারাতি, মদের ব্যবসায়ও খ্যাতি পেয়ে যায়। ফলে এখানেই থিতু হয়। ব্রুস গাছের ফল, চিনিসহ নানান জিনিস মিশিয়ে একেবারেই অন্য ধরনের একটা মদ বানাত। গোপন এক জায়গায় ছিল তার ভাটিখানা। ১৯১০ সালে এই অঞ্চলে আসে সে, মারা যায় ১৯২০ সালে। এই দশ বছর মদের ব্যবসাই করে। প্রথম কয়েক বছর দারুণ ব্যবসা করে সে। শীতের সময় স্লেজ গাড়িতে করে মদ নিয়ে নানান জায়গায় বিক্রি করত। গরমে মদ পরিবহনে ব্যবহার করত নৌকা। তারপরই ১৯১৬ সালে ঘটল একটা দুর্ঘটনা। ডিলিংহ্যামের মদগুলো ছিল বেশ কড়া। একবার ওগুলো খেয়ে কয়েকজন মদ্যপ প্রচণ্ড মারামারি করে এবং এতে একজন মারাও যায়। এই ঘটনায় ডিলিংহ্যামেরও এক বছরের কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সে জেলারকে বলে তাকে আর কখনও কয়েদখানায় ঢোকাতে পারবে না কেউ।

আবার মদ তৈরিতে মন দিল। এবার শিকারও শুরু করল। তবে সাদা প্রাণীর দিকেই ঝোঁক। তুষারসাদা আর্কটিক শিয়াল ছাড়া অন্য কোন প্রাণী শিকার করত না। ওগুলোর চামড়া দিয়ে সাদা একটা ফারের পোশাক বানাল নিজের জন্য। সাদা এক দল কুকুর জোগাড় করল কোথা থেকে। নতুন স্লেজটার রংও সাদা। বরফে লুকিয়ে পড়তে ভারী সুবিধা হলো এতে। কয়েকবার তাড়া করে বোকা বনল পুলিস।

১৯১৯ সালের ঘটনা। এক গুপ্তচর এসে পুলিসকে বলল স্মোকারের মদের ভাটি আছে ব্রাজিল’স পিঞ্চ বলে একটা জায়গার কাছে জঙ্গলের ভেতর। এদিকে মদ তৈরির উপকরণের খোঁজে স্মোকার তখন এসেছিল ফ্রেঞ্চম্যান’স আইল্যাণ্ডে। তাকে সেখানেই ধরল পুলিস। তার সঙ্গে রফা করার চেষ্টা করল পুলিস। বলল সে যদি তাদের মদের ভাটিখানায় নিয়ে যায় কেবল এক বছরের জেল হবে। না হলে হবে তিন বছর। জবাবে স্মোকার বলল, ‘বেশ তো, জঙ্গলে গিয়ে তবে খুঁজে বের করো আমার ভাটিখানা।’ পুলিস কর্মকর্তাটি এবার কনস্টেবলদের জঙ্গলে গিয়ে ভাটিখানা খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলেন। তারা যখন রওয়ানা দেবে এসময় পেছন থেকে ডেকে স্মোকার বলল, ‘আমার ভাটিখানার চারপাশে অন্তত পঞ্চাশটা ভালুক ধরার ফাঁদ আছে। ওগুলো এমনভাবে লতা-পাতা দিয়ে লুকানো, না পড়লে টেরই পাবে না। ভালুক ধরার ফাঁদ যে কতটা ভয়ঙ্কর তা তো জানোই। ওটায় পড়লে পা বাদ দিতে হবে সন্দেহ নেই।’ কনস্টেবলরা ভয় পেল। পা হারালে খাওয়াবে কে? অনেক বকাঝকা করেও তাদের জঙ্গলে পাঠাতে পারলেন না অফিসার। এদিকে স্মোকারের কাছ থেকেও একটি কথাও উদ্ধার করা গেল না। উপায়ান্তর না দেখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো পুলিস। এরপর আর তার পিছু নেয়নি।

কিন্তু স্মোকার দিনকে দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। এক মহিলাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাইল আত্মীয়-স্বজনের কাছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিতে ব্যর্থ হলো পরিবারটি। মহিলাকে নিজের সব উগ্র মদ খাইয়ে পাগল বানিয়ে ফেলল সে। ওই অবস্থায় শহরে পাঠিয়ে দিল। দিনকে দিন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে লাগল স্মোকার। সাদা কুকুর দেখলেই চুরি করে। নিজেও এখন আচ্ছাসে মদ গেলে। একদিন এক আদিবাসীর সঙ্গে জোর লড়াই বাধল তার। একপর্যায়ে লোকটাকে খুন করে পালাল। কেউ যেন তাকে ধরতে না পারে সেজন্য জঙ্গলে পেতে রাখল একের পর এক ভালুক ধরার ফাঁদ।

সব কিছুরই একটা শেষ থাকে। অবশ্য স্মোকারের বেলায় এটাকে শেষ বলা মুশকিল। তবে অন্তত তার খারাপ রূপটির শেষ হলো এর মাধ্যমে। অনেক উঁচু এক মাচায় বসে মাছ ধরছিল নিচের এক খালে। হঠাৎ পা ফস্কে নিচে পড়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যায় তার। লোকজন ধরাধরি করে নিয়ে যায় পুলিসের তাঁবুতে। সেখানে বেশ যত্নআত্তি করা হলেও মোটে তিন দিন আর বাঁচল স্মোকার। তবে মারা যাওয়ার আগে খুব অনুশোচনা হয়। বলে তার এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে কুকুরের পাল নিয়ে মানুষের বিপদে সাহায্য করে। মৃত্যুর পর কবর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপা পড়ে যায় তার এই প্রতিজ্ঞাও। লোকে ভুলে যেতে বসে তাকে।

ছ’হপ্তা পরের ঘটনা। এক শিকারি ফ্রেঞ্চম্যান’স আইল্যাণ্ডের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ প্রবল তুষার ঝড়ের মধ্যে পড়ে পথ হারায় সে। এসময়ই দেখে সাদা ফারের পোশাক পরা বিশালদেহী এক লোক কুকুরেটানা স্লেজ নিয়ে ছুটছে। তাকে অনুসরণ করে লোকটাও পৌছে যায় নিরাপদ জায়গায়। সরাইখানায় পৌঁছে গা গরম করতে করতে খুলে বলে ঘটনা। কিন্তু সেখানে উপস্থিত সরাইমালিকসহ অন্যরা জানায় আজ আর কেউ ওই দিকে যায়নি। তখনই সবার মনে পড়ে স্মোকারের প্রতিজ্ঞার কথা। তবে তখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিল না। তারপর যখন একের পর এক শিকারি ওই দীর্ঘকায় সাদা পোশাকের রহস্যময় লোকটির কারণে বৈরী আবহাওয়ায় পথের দিশা পেতে লাগল, তখন আর কারও বুঝতে বাকি রইল না স্মোকার তার কথা রেখেছে।

কত মানুষকে সে বাঁচিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। এমনকী জীবিত থাকা অবস্থায় যে পুলিস সদস্যরা ছিল তার দুশমন তাদেরও বাঁচায় স্মোকার। দু’জন পুলিস কর্মকর্তা এমনই এক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। জর্জ বেটসন ও এড রিয়োপল তাঁদের নাম। ১৯৪৯ সাল। এই দুই কর্মকর্তা তুষার ঝড়ে পথ হারান। এসময়ই প্রবল ঝড়ের মধ্যে কুকুরের একটা দলকে স্লেজ টানতে দেখেন। ওটার সঙ্গে আছে সাদা পোশাকের দীর্ঘদেহী এক লোক। দেরি না করে দলটাকে অনুসরণ শুরু করেন তাঁরা। দুই ঘণ্টা ওদের পিছন পিছন যাবার পর দেখেন পুলিসের একটা ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছেন। এদিকে ওই কুকুরের দল, স্লেজ এবং লোকটা অদৃশ্য হয়েছে। মজার ঘটনা যে স্মোকার জীবিত থাকা অবস্থায় ছিল মানুষের আতঙ্ক, এমনকী বাচ্চাদের ভয় দেখাতেও ব্যবহার করা হত তার নাম, মারা গিয়ে সে হয়ে গেল উপকারী এক প্রেতাত্মা। লোকেরা বলে স্মোকারের দেখা পেয়েছ মানে তুমি বেঁচে গেছ। সে তোমাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে না দিয়ে যাবে না।

পিটার অ্যানডোনি ছিলেন বুড়ো এক শিকারি। স্মোকার সম্পর্কে তাঁর বিস্তর জ্ঞান। তাঁর কথা হলো, ‘ঝড়ের সময় খুব বিপদে পড়েছ, এসময় তোমার কুকুরগুলো যদি হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করে বুঝবে স্মোকার ধারেকাছেই আছে। তাকে খুঁজে বের করে অনুসরণ করো, ব্যস, তোমার আর কোন সমস্যা হবে না। এ পর্যন্ত হাজারের বেশি মানুষকে বাঁচিয়েছে এই ভাল প্রেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *