অদৃশ্য বস্তু – অদ্রীশ বর্ধন

অদৃশ্য বস্তু – অদ্রীশ বর্ধন

মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল নন্দবাবুর।

সম্পাদক ভ্রূক্ষেপ করলেন না। কাচের চেম্বারে তিনি বসে আছেন। নীচের রাস্তার পিচ গলে গেছে। কিন্তু তাঁর ঘর দার্জিলিং-এর মতোই মোলায়েম শীতল। এয়ার কন্ডিশনার চলছে ফুরফুর করে। হাতের কাছেই তিনখানা টেলিফোন। বাড়িতে টেলিফোন, চবিবশঘন্টার ড্রাইভার সমেত গাড়ি মাসে পাঁচ অঙ্কের বেতন—এ সবই তে কোম্পানি দিচ্ছে। কাজেই একসময়ে তিনিও যে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরেছেন হাতে লেখা নিয়ে, তা মনের কোণে কোথায় চাপা পড়ে গেছে। লেখকদের তিনি এখন কীটাণুকীট মনে করেন।

নন্দবাবু অবশ্য নতুন লেখক নন। বয়স তাঁর পঞ্চাশ পেরিয়েছে। যদিও চুলে পাক না ধরায় আর মুখের চামড়া কোথাও কুঁচকেও বা ঝুলে না যাওয়ায় তাঁকে অনেক কমবয়সি মনে হয়। মনের দিক দিয়ে তরুণ বয়েসে যতখানি তরুণ ছিলেন, এই প্রৌঢ় বয়েসেও ততখানি তরুণ। সেটা তাঁর সাহিত্য কর্ম দেখলেই ধরা যায়। তাঁর গল্পের প্লট সবসময়ে অ্যাডভেঞ্চারে ঠাসা, তাঁর গল্পের চরিত্ররা সবসময়ে দুরন্ত ফুটন্ত প্রাণবন্ত। বেগে এগিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা তাঁর শিরায় উপশিরায় বয়ে চলেছে বালক বয়স থেকেই। তাঁর কাহিনিগুলোয় এই চরৈবেতি-র আভাস পাওয়া যায় মুহুর্মুহু। তাঁর ভাষা আরবি ঘোড়ার মতোই টগবগে।

অথচ অন্তরে তিনি কবি। তিনি দার্শনিক। বৈরাগ্য তাঁর সত্তায় মিশে রয়েছে। লোভ বা মোহ—টাকা অথবা মনের—তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি সবসময়ে নতুনের পূজারি—যা নেই, তাকে সৃষ্টি করার আনন্দেই বুঁদ হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। তার বেশি কিছু চান না। তাই কিছু পানওনি।

একটা সময় গেছে, যখন তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ বলা হয়েছে। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে তিনি এক্কেবারে নতুন ধরনের পত্রিকা বের করেছিলেন সেই পত্রিকার লেখক ছিল না, পাঠকও ছিল না। নিজেই লিখে গেছিলেন প্রতিটি সংখ্যায়, ছবিও এঁকে দিয়েছিলেন, এজেন্টদের কাছে পৌঁছে দিতেন, পোস্ট অফিসে দাঁড়িয়ে বুক প্যাকেট বাইরের এজেন্টদের কাছে পাঠাতেন।

সাহিত্যের সেই নতুন শাখা এখন পল্লবিত হয়ে উঠেছে। অনেক কুঁড়ি ফুটে ফুল হয়ে গেছে। যে বিষয় নিয়ে বাণিজ্য করার কল্পনাও কেউ করেনি এখন তা নিয়ে পুরোদস্তুর বাণিজ্য চলছে।

নন্দবাবু তাই সরে এসেছিলেন। কাজ তাঁর শেষ এখন বিশ্রাম কিন্তু বিশ্রাম চাই বললেই কী বিশ্রাম নেওয়া যায়। মাঝে মাঝেই অনুরোধ এসেছে কলম ধরার জন্যে। তিনি ধরেছেন তখনই যখন আনন্দ পেয়েছেন। সৃষ্টিকরার আনন্দ। নইলে নীরব থেকেছেন। যেখানে মনের চাহিদা মেটে না, শুধু বাইরের চাহিদা মেটানোর জন্যে সেখানে তিনি যান না। এই রকমই একটা আহ্বান এসেছিল ‘খেয়া’ পত্রিকা থেকে।

‘খেয়া’ বড়ো গোষ্ঠীর বড়ো কাগজ। এক্কেবারে কমার্শিয়াল কাগজ। এখানে কোনো এক্সপেরিমেন্ট করা চলে না। লোকে যা চায়, তাই দিতে হবে। লোকে যা মনে মনে চায় অথচ মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারে না তাও দিতে হবে তা সে যতই গলিত ক্ষতিকারক হোক না কেন, পাঠকদের মনের গোপন চাওয়াটা মার্কেট রিসার্চ করে জানা হয়। তার ওপর স্কিম তৈরি হয়।

চাকচিক্যের যুগে ‘খেয়া’ পত্রিকা তাই বাজার ধরে রেখেছে। ‘পহেলে দর্শনধারী পিছে গুণবিচারি’র যুগে ‘খেয়া’ বাজার মাত করেছে।

‘খেয়া’র বর্তমান সম্পাদক বাণিজ্যের এই গুপ্ত কৌশলটা বোঝেন। একসময়ে তিনি নন্দবাবুর কাগজে লিখেছিলেন। তখন তিনি নেহাতই বালখিল্য ছিলেন। নন্দবাবু সম্বন্ধে হয়তো একটু শ্রদ্ধা ছিল। তার চেয়েও বেশি ছিল চাপা রাগ। কেন না, নন্দবাবু ছিলেন লেখা নির্বাচনের ব্যাপারে অতীব নিষ্ঠুর। বিশেষ করে পুজোসংখ্যার লেখা বাছাইয়ের সময়।

‘খেয়া’র ঠান্ডাঘরে বসে এই সব কথা নিশ্চয় মনে পড়েছিল সম্পাদকের। তাই তিনি টেলিফোন করেছিলেন নন্দবাবুকে। অনেক আমড়াগাছি করেছিলেন। একদিন পায়ের ধুলো দিয়ে যেতে বলেছিলেন। সন্ন্যাসী প্রকৃতির নন্দবাবু সরল মনেই এই আহ্বানকে সম্মান দিয়েছিলেন। এই বয়েসে লেখা নিয়ে নিয়ে ফেরি করতে কোথাও যাওয়া শোভন নয়। তাঁর মতো মানুষের পক্ষে তো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু যেখানে আমন্ত্রণ ঘটে শুধু আড্ডামারার জন্যে, সেখানে তিনি কাছা খুলে দৌড়োন।

এসেছিলেন ‘খেয়া’র সম্পাদকের ঘরেও। তিনটে গল্প আর একটা উপন্যাস চেয়েছিলেন সম্পাদক। নন্দবাবু তথাকথিত প্রথম শ্রেণির জাত লেখক নন। কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি আছে। চামড়া ফুটো করে ভেতর পর্যন্ত যেন দেখতে পান। সম্পাদকের ভেতরটা তাঁর কাছে খুব অস্পষ্ট থাকে কিন্তু তা নিয়ে আর ভাবেনওনি। কমার্শিয়াল কাগজের সম্পাদকদের তো এই রকমই বাঁকাচোরা হতে হয়। নইলে যে, কাগজের কাটতি কমবে—চাকরিও থাকবে না।

গল্প তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উপন্যাসটা হাতে করে নিয়ে গেছিলেন।

কাচের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভুরু কুঁচকে চেয়েছিলেন সম্পাদক। যেন, নন্দবাবুকে তিনি চেনেন না। তাতেও আহত হননি নন্দবাবু। বড়ো কাগজের সম্পাদকদের মাথায় কখন যে কী দুশ্চিন্তা থাকে, তা কী বলা যায়। তাই ছোট্ট হেসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছিলেন।

বলেছিলেন—’আপনার কথামতো উপন্যাসটা লিখে আনলাম।’

তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেছিলেন সম্পাদক ‘আমার কথা মতো। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমার মেমরি বোধ হয় আজকাল ফেল করছে। আপনি লিখতে চেয়েছিলেন—আমি বলেছিলাম, লিখুন। প্রেসাইসলি এই বলেছিলাম।’

নন্দবাবু থ হয়ে গেলেন। আর তখনই তাঁর মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। কোনো কথা বলতে পারলেন না। সম্পাদকের কাজ হয়ে গেছিল। এবার বললেন—’লেখা এনেছেন? রেখে যান।’

নন্দবাবু বলেছিলেন—’আর একবার মেজেঘষে দিই।’

লেখা নিয়ে তিনি বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন রাস্তায় যেখানে পিচ গলছে।

নন্দবাবুর জীবনের আর এক অধ্যায়ের শুরু এই ঘটনার পর থেকেই।

ছাতা আর উপন্যাস নিয়ে সোজা কার্জন পার্কে চলে এসেছিলেন নন্দবাবু। ঘিঞ্জি শহরের এই ছোট্ট ফুসফুসটা তাঁর চিরকাল ভালো লাগে। কখনো পার্কের কোণে দাঁড়িয়ে ইঁদুরদের মস্ত পাতালকেল্লা দেখেন। ভারতে যত লোক আছে, ইঁদুর আছে তার সাত গুণ। কলকাতায় যত লোক আছে, ইঁদুর আছে তার আট গুণ। যদি কোনোক্রমে ইঁদুরদের মধ্যে মিউটেশন ঘটে, জিন-বিকৃতির ফলে তারা অবিশ্বাস্য রকমের মেধাবী আর কুচক্রী হয়ে ওঠে—তাহলে কাতারে কাতারে ইঁদুর কী ঘটাতে পারে শহর জুড়ে, এই প্লট নিয়ে একখানা উপন্যাসও ফেঁদেছিলেন।

নন্দবাবুর এই এক দোষ। বিজ্ঞানের পাতায় যে কথা লেখা নেই, বিজ্ঞান যাকে অপবিজ্ঞান বলে—তা নিয়ে তিনি ভাবেন। তাঁর কবিসত্তা আর দার্শনিকসত্তা অনিয়মের মধ্যে নিয়মকে অন্বেষণ করে অদৃশ্য জগতের মধ্যে দৃশ্যমান জগতের শেকড়ের খোঁজ করেন। উনি কখনো বাঁধাধরা ছকের মধ্যে চলেননি। ওঁর মনের খোরাক যুগিয়ে এসেছে প্রকৃতি। কারণ, প্রকৃতি কখনো প্রশ্ন করে না। বরং অসম্ভবের ব্যাখ্যা যুগিয়ে যায় সন্ধানী মনের কাছে।

কার্জন পার্কের স্নিগ্ধ প্রকৃতি তাই সেদিন টেনে নিয়ে এসেছিল নন্দবাবুকে গরম পিচের রাস্তা থেকে। গাছতলায় তিনি বসলেন। বেশ ছায়া এখানে। নীচে ঘাস। মনটা একটু জুড়িয়ে এল। তারপর বাঁ কুনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া হলেন। মাথার ঝাঁ-ঝাঁ ভাবটা কমে আসছিল। একটু পরে সটান শুয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুম যখন ভাঙল, তখন সন্ধে হয়েছে। বড়ো রাস্তায় হ্যালোজেন ল্যাম্পের তীব্র আলোকেচ্ছ্বাসে ঝিলমিল ঢেউ তুলে ছুটছে নানারঙের গাড়ি। এই শহরের বিত্তশালীদের দম্ভ ওরা। শুয়ে থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তা দেখছিলেন নন্দবাবু। এবার উঠে বসলেন। তখনই মনে হল, কে যেন তাঁর সামনে বসে আছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না। কেননা, গাছের ছায়া এখানে নিরেট। আলোও নেই এদিকে। অথচ, বেশ মনে হল, ওই অন্ধকার পুঞ্জের মধ্যে একজন বসে আছে।

এবং চেয়ে আছে তাঁর দিকে। আশ্চর্য হলেন না নন্দবাবুর। এরকম ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে। তাঁর জীবনেও ঘটেছে। পেছন ফিরে না তাকিয়েও বোঝা যায়, পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

নন্দবাবু হাই তুললেন। গরম এখন নেই। ঝিরঝিরে হাওয়ায় গাছের পাতা শিরশির করছে। নিকষ আঁধারকে চোখে সইয়ে নেওয়ার জন্যে তিনি চোখ পাকিয়ে সেদিকে চেয়েই রইলেন।

তবুও কাউকে দেখা গেল না। কার্জন পার্ক ইদানীং কুখ্যাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সন্ধের পর। তাই নন্দবাবু ঠিক করলেন, উঠে পড়া যাক।

বড়ো খামে মোড়া লেখাটা, মাথার তলায় দিয়ে শুয়েছিলেন। এখন সেটা কুড়িয়ে নিলেন। গায়ের ঘাস আর পাতা ঝেড়ে নিলেন। এবার তিনি উঠবেন।

কিন্তু উঠতে গিয়েই মাথাঘুরে গেল নন্দবাবুর। আস্তে আস্তে তিনি শুয়ে পড়লেন। তখন যদি তাঁর নাড়ি চেপে ধরে বসে থাকতেন কোনো ডাক্তার, তিনি দেখতেন নাড়ির ধুকপুকুনি যেন একটু একটু করে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।

ধুকপুকুনি কিন্তু নিতল থেকেও আবার ফিরে এল। স্বাভাবিক হয়ে গেল। চোখ মেললেন নন্দবাবু। সে চোখে এখন অন্য চাহনি।

রাত নটায় বাড়ি ফিরলেন নন্দবাবু। বাসে নয়, ট্যাক্সিতে। নন্দবাবু কিন্তু ট্যাক্সি ডাকেননি। তিনি ট্যাক্সি চড়েন না। কেউ গাড়ি চড়াতে এলেও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।

সেই সন্ধ্যায় কিন্তু ধীর স্থির, পদক্ষেপে কার্জন পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সির জন্যেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পকেটে ছিল মোটে দুটাকা ষাট পয়সা। তিনি তা জানতেন।

এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে ট্যাক্সিওয়ালারা প্যাসেঞ্জার বোঝে। বিশেষ করে সন্ধের পর তাদের মেজাজ তেরিয়া হয়ে যায়। শাঁসালো যাত্রী ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয় না।

নন্দবাবুর শ্রীহীন পোশাক দেখেও কিন্তু একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে। ড্রাইভার পেছনে হেলে পড়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। কোনো কথা নয়। উঠে বসেছিলেন নন্দবাবু। ড্রাইভার মিটার ডাউন করেনি। এমন কী নন্দবাবু কোনদিকে যাবেন, তাও জিজ্ঞেস করেনি। ঝড়ের বেগে লেনিন সরণি দিয়ে মৌলালি পেরিয়ে বেলেঘাটা রোড ধরে চাউলপট্টির সি-আই-টি বিল্ডিংস-এর একটা ব্লকের সামনে এসে ব্রেক কষেছিল। দরজা খুলে দিয়েছিল।

নন্দবাবু নেমে গেছিলেন ভাড়া না দিয়ে। ড্রাইভার চলে গেছিল ভাড়া না চেয়ে। এইটাই যেন স্বাভাবিক। মিটার ডাউন করা হয়নি এই কারণেই।

ছোট্ট এই ওয়ান-রুম ফ্ল্যাটে একা থাকেন নন্দবাবু। তিনি সংসার করেননি। একা থাকতে ভালোবাসেন। একা রেঁধে খান। এন্তার বই পড়েন। ফ্রিজ আর টেলিফোন ছাড়া আধুনিক কলকবজা তাঁর ঘরে আর নেই। ল্যাচ খুলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালেন নন্দবাবু। আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। চেয়ে রইলেন নিজের দিকে। তারপর চাইলেন আয়নার পাশেই ঝোলানো ফ্রেমে বাঁধাই নিজের ছবির দিকে।

মিলিয়ে দেখলেন আয়নার প্রতিকৃতি আর ছবির প্রতিকৃতি। একই মানুষ। অথচ কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে গেছে। খু-উ-ব সূক্ষ্ম। পরিবর্তনটা ভেতরের। তাই বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না।

পালটেছে শুধু চাহনি। ওঁর চাহনি চিরকালই শান্ত।

এখনও তা শান্ত। তবে মনে হচ্ছে, ওই চাহনির নীচ থেকে আর একটা চাহনি মেলে ধরেছে নিজেকে। সে যে কী চাহনি, তা বলে বোঝানো যায় না।

পালটেছে তাঁর হাঁটাচলার ভঙ্গিমা, তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার পোজ। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্য অকস্মাৎ যেন তাঁকে আশ্রয় করেছে আরও কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন নন্দবাবু। একটা আঙুলও নাড়লেন না। কিন্তু যেন শরীরের সমস্ত এনার্জি সংহত হল চাহনির মধ্যে। সেই চাহনি যেন নিঃশব্দে অদৃশ্য বিস্ফোরণ ঘটাল বাতাসের মধ্যে।

বেজে উঠল টেলিফোন। মেপে পা ফেলে টেবিলেন দিকে এগিয়ে গেলেন নন্দবাবু। খানদানি পদক্ষেপ। টেলিফোনের বাদ্যি বাজলেই তাড়াহুড়ো করতেন আগে। এখন সে অভ্যেস তিরোহিত হয়েছে আচমকা।

রিসিভার তুলে নিয়ে খুব আস্তে বললেন—’হ্যালো।’

গলা শুনে নন্দবাবুকে নিশ্চয় চেনা গেল না। কেন না, এত আস্তে এত দানা-দানা গলায় তিনি তো কখনো কথা বলেন না।

তাই অপর পক্ষ বললেন—’নন্দবাবুকে দিন।’

‘আমিই নন্দ নাগ।’

‘আপনি!’ যেন চমকে উঠল অপরপক্ষ—’আ-আপনি অমনভাবে চলে গেলেন—’

‘কে বলছেন?’ গলা শুনেই নন্দবাবু বুঝেছিলেন, কার টেলিফোন। তবুও প্রশ্ন করলেন নিরুত্তেজ নিষ্পম্প গলায়। এ গলার উত্থান-পতন নেই কিন্তু আছে ছোটো ছোটো দানার কারুকাজ—যা শ্রোতার কানের মধ্যে দিয়ে ব্রেনের মধ্যে ঝড় সৃষ্টি করে।

এই শ্রোতার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটল। ক্ষণেকের জন্যে কথা আটকে গেল। তারপর আমতা আমতা করে বললে—’আ-আমি নির্ঝর সেন।’

‘ও। কী ব্যাপার?’

‘আপনার উপন্যাসটা—’

‘বললাম তো, একটু মেজে ঘসে দেব।’

‘আর ইয়ে,…কাল সকালে কি ফ্রি থাকবেন?’

‘কটায়?’

‘আপনিই বলুন।’

‘ধরুন নটা?’

‘জহরবাবু আপনার সঙ্গে কথা বলতে যাবেন। খুব দরকার।’

—’ঠিক আছে,’ রিসিভার নামিয়ে রাখলেন নন্দবাবু। অবিচল মুখে এসে বসলেন সোফায়। একঠেঙে ঘেরাটোপ বাতির আলোয় তাঁর ঝাঁকড়া চুলের ছায়া এসে পড়েছে চোখের ওপর। অদ্ভুত চাহনি, এখন, প্রায় অদৃশ্য!

জহর মল্লিক সবচেয়ে শক্তিমান পত্রিকা গোষ্ঠীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এ যুগে তার শক্তিই সবচেয়ে বেশি, যে জনমত তৈরি করে দিতে পারে। সে ক্ষমতা আছে জহর মল্লিকের। প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে সমীহ করেন।

সকাল ঠিক নটায় ঘটল সেই অভাবনীয় ব্যাপার। জহর মল্লিকের পথ চেয়ে বসেছিলেন না নন্দবাবু। তাঁর অগোছালো ঘর অগোছালোই ছিল। মশারিও ঝুলছিল দেওয়ালের হুকে। এক কাপ কফি বানিয়ে তিনি বসেছিলেন উপন্যাসকে মাজাঘষা করতে।

বেল বাজল দরজায়। সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন নন্দবাবু।

দরজা কিন্তু আগেই খুলে গেছে। পাড়ার সবচেয়ে পাওয়ার ফুল পার্টির এক তরুণ নেতা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। দৌড়ে এসে নন্দবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বললে চোখ বড়ো বড়ো করে—’কাকু, জহর মল্লিক এসেছেন।’

জহর মল্লিককে এরা চেনে।

নন্দবাবু ছেলেটির চোখে চোখ রাখলেন। আর কিচ্ছু বললেন না। ছেলেটির ভেতর পর্যন্ত নড়ে গেল সেই চাহনির ধাক্কায়। সে এই পাড়াতেই জন্মেছে, এই পাড়াতেই বড়ো হয়েছে নন্দবাবুকে সে চেনে।

কিন্তু আজ মনে হল যেন অন্য কাউকে দেখছে।

খোলা দরজা থেকে ভেসে এল অমায়িক কণ্ঠস্বর—’আসতে পারি?’

জহর মল্লিক। খর্বকার। বয়স বড়জোর চল্লিশ। তবে না-আঁচড়ানো একগাদা চুলের বেশির —ভাগই রুপোলি হয়ে উঠেছে। নিখুঁতভাবে শেভ করার ফলে টকটকে ফর্সা রং যেন ফেটে পড়ছে। পরনে খদ্দরের ঢিলে হাতা পাঞ্জাবি আর পায়জামা।

পত্রিকা জগতের ‘টাইফুন’ জহর মল্লিক এই বেশেই পৃথিবীর সর্বত্র সম্মান পান।

নন্দবাবু কিন্তু শশব্যস্ত হলেন না। দু’পা এগিয়ে গিয়ে শুধু বললেন—’আসুন।’

শীতল অভ্যর্থনার জন্যে বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন না জহর মল্লিক। নির্ঝর সেনকেও দেখা গেল পেছনে। বশংবদ ভৃত্যের মতো। দেশের তাবৎ বুদ্ধিজীবীরা চুল পর্যন্ত বিকিয়ে বসে আছে যাঁর কাছে, সেই তিনি তাঁর দুর্লভ পদধূলি দিয়ে ধন্য করলেন নন্দবাবুর শ্রীহীন এককক্ষ ফ্ল্যাটকে—অথচ নন্দবাবু এত নির্বিকার!

সুট করে উধাও হল পার্টির ছেলেটি। জহর মল্লিক সপারিষদ ঘরে ঢুকলেন। নির্ঝর সেন তাঁর সঙ্গে এক গাড়িতে আসতে পেরে কৃতার্থ হয়ে গেছেন। বিগলিত হাসি হেসে নার্ভাসনেসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

হাত বাড়িয়ে খাটের পেছনে রাখা ডবল সোফা দেখিয়ে দিলেন নন্দবাবু। সোফার এক কোণে পাহাড় করা বাসি জামাকাপড়। হপ্তায় একদিন এগুলো কাচেন। জহর মল্লিক তৎক্ষণাৎ বসে পড়লেন না। নির্ঝর সেন বসতে গিয়েও বসতে পারলেন না, ‘টাইফুন’ দাঁড়িয়ে আছেন দেখে।

ঘরের চেহারা ঝিলমিল হিরে চাউনি দিয়ে জরিপ করে নিলেন জহর মল্লিক।

তারপর বসলেন। ভণিতা করলেন না। তাঁর কাছে সময় মানেই টাকা, বললেন—’নন্দবাবু আপনাকে আমাদের চাই।’

‘বেশ তো।’

‘কিন্তু এমন জায়গায় থাকা আপনাকে মানায় না।’

‘তা বটে,’ বললেন নন্দবাবু, অথচ এই জায়গাই তাঁর সবচেয়ে পছন্দ। এককোণে, সবার চোখের আড়ালে, অজানা বুনোফুল হয়ে ফুটে থাকতেই তিনি ভালোবাসেন। জহর মল্লিকের সামনে কিন্তু সেই ইচ্ছের প্রতিধবনি শোনা গেল না।

‘টাইফুন’ বললেন— ‘আপনার জন্যে আমরা পুষ্পক প্যালেসে ব্যবস্থা করছি।’

‘ভালোই তো,’ পুষ্পক প্যালেসে থাকতে হবে শুনে একটুও ভাবান্তর দেখালেন না নন্দবাবু। অথচ, এই প্যালেস নিয়ে এর মধ্যেই প্রচুর ঢক্কা নিনাদ শোনা গেছে গোটা বিশ্বে। এই প্রাসাদ নির্মাণ যখন শেষ হবে, তখন তা হবে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাসাদ। রাশিয়ার হারমিটেজ মিউজিয়ামে আছে 1000 ঘর। এখানে থাকবে দেড়হাজার ঘর, গোটা পৃথিবীর সংস্কৃতির ইতিহাসকে ধরে রাখা হবে ঘরে ঘরে।

জহর মল্লিকও লক্ষ করলেন নন্দবাবুর নিরুত্তাপ সম্মতি। বিস্ফারিত হল নির্ঝর সেন-এর চক্ষুযুগল।

টাইফুন বললেন—’আপনি যা চাইবেন, তাই পাবেন।’

‘কি শর্তে?’ এই প্রথম প্রশ্ন করলেন নন্দবাবু।

‘আপনার সমস্ত ক্রিয়েশন হবে আপনাদের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে।’

‘অর্থাৎ আমার সমস্ত ক্রিয়েশন হবে আপনাদের পণ্য দ্রব্য?’

হিরে-চোখের ওপর পাতা কেঁপে গেল জহর মল্লিকের। এভাবে স্পষ্ট কথা কেউ তাঁকে বলেনি।

কাষ্ঠ হেসে বললেন—’তা কেন ভাবছেন। দেশের প্রতিভাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারলে আমরা ধন্য হব।’

‘ধন্যবাদ। তাই হবে।’

নমস্কার করে উঠে পড়লেন সপারিষদ জহর মল্লিক। এরপর থেকেই যেন আরব্য উপন্যাসের নতুন নতুন কাহিনি শোনা গেল নন্দবাবুকে ঘিরে। তিনি এখন আছেন পুষ্পক প্যালেসের সবচেয়ে ওপর তলায়। এ প্যালেস যেখানে নির্মিত হচ্ছে, তার একদিকে গভীর জঙ্গল, আর একদিকে ধু ধু সমুদ্র। ম্যাগনেটিক মনোরেলের বুদ্ধি বাতলে দিয়েছেন নন্দবাবু সস্তায় যাত্রী পরিবহণের জন্যে। মাটি থেকে তিরিশফুট উঁচু দিয়ে নক্ষত্র বেগে মনোরেল ছুটিয়ে নিয়ে যায় রোবট চালক। সমুদ্রের ধারে কয়েক মাইল জায়গা ঘিরে তিনটে প্রকাণ্ড অ্যাকুয়ারিয়াম বানানো হয়েছে। তিমি, ডলফিন আর সিন্ধুঘোটক থাকে তিন অ্যাকুয়ারিয়ামে। ভাষা শেখানো হচ্ছে ডলফিনদের।

নন্দবাবুকে আর দেখা যায় না। তিনি এখন সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। পুষ্পক প্যালেসের যে অংশে তিনি থাকেন তার ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না।

আর এখান থেকেই তাঁর লেখা টাইডাল ওয়েভ-এর মতোই ধেয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র। তিনি লেখেন বাংলায়। কিন্তু পৃথিবীর 5000 ভাষার বাছাই করা ভাষাগুলোয় সেই লেখার অনুবাদ হয়ে যায় ওই প্যালেসেই। ফলে, বাংলার লেখা পৃথিবীময় আলোড়ন তুলে চলেছে দিবস-রজনীর প্রতিটি মুহূর্তে।

তাঁর লেখার বিষয় আর ধাঁচও পালটে গেছে। বিচিত্র এক বস্তুকে বারংবার তিনি তাঁর সব লেখার মধ্যে টেনে এনেছেন। যে বস্তুকে দেখা যায় না।

পাঁচ বছর পরে তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেলেন। তারপরের বছরই পেলেন নোবেল পুরস্কার।

প্রফেসর নাট বল্টুর টনক নড়ল তখনই।

বাংলার সাহিত্যিক নন্দ নাগ রাতারাতি পৃথিবীর সাহিত্য বাজার দখল করে নেওয়ায় টনক নড়েছিল অনেকেরই। রাশি রাশি পুরস্কার পেয়েছেন, আমন্ত্রণ পেয়েছেন, কিন্তু পুষ্পক প্যালেসের ঘর ছেড়ে তিনি এক ইঞ্চিও নড়েননি। বিদেশের মোহ তাঁর কোনো কালেই ছিল না।

তারপরেই নোবেল পুরষ্কার। হইচই পড়ে গেল গোটা দুনিয়ায়। শুরু হল কানাঘুষো কে এই ভুঁইফোঁড় সাহিত্যিক সবচেয়ে হিমালয় প্রতিম হল বাঙালিদের জল্পনাকল্পনা হেথায়-হোথায় মাঝে মাঝে যাঁর কলমচালনা ঘটেছে গত তিরিশ বছর ধরে, আচমকা তিনি রকেট স্পিড অর্জন করলেন কী করে?

বেশি করে নড়ে বসেছিলেন বৈজ্ঞানিকরা। তার কারণও আছে। নন্দ নাগ বিজ্ঞানী নন। অথচ বিজ্ঞানকে ঢুকিয়াছেন তাঁর সাহিত্যে। কিন্তু তা নির্জলা বিজ্ঞান নয়। তার মধ্যে আছে কবিত্ব, আছে দর্শন, আছে ফ্যানট্যাসি, স্রেফ লেখার মুনসিয়ানা আর পরিবেশনার অভিনবত্বে, তিনি যা বলতে চেয়েছেন—তা পাঠকের মনের ভেতরে ঢুকে গেছে। এমন একটা তত্ত্বে বিশ্বাস এনে দিচ্ছে, যার প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। তামাম দুনিয়ার মানুষ এখন বিশ্বাস করে, বৈজ্ঞানিকদের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখেন নন্দ নাগ। কারণ, তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী দিয়ে বারে বারে বলেছেন একটাই কথা—ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বিরাজ করছে একটা আশ্চর্য বস্তু। সে বস্তুকে দেখা যায় না, কিন্তু তার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য।

বৈজ্ঞানিকরা আরও অবাক হয়েছেন, নন্দ নাগের লেখা একবার যে পড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে সে লোকটার চামচে হয়ে গেছে, এটা কী করে হয়? তাঁর সমালোচক একজনও নেই। না-পড়ে সমালোচনা করে যারা, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু পুরস্কার দেওয়ার কমিটির প্রত্যেক সদস্য তাঁর বই পড়েই একমত হয়েছে হ্যাঁ, এ লোককে পুরস্কার না দিলেই নয়।

একই ঘটনা ঘটেছে নোবেল কমিটিতেও। তরঙ্গ বেগে নন্দ নাগের উপন্যাস সবার সম্মতি পেয়েছে—দ্বিমত পোষণ করেননি একজনও। আশ্চর্য নয় কী?

কিন্তু এ প্রশ্ন নিয়ে তো প্রকাশ্য আলোচনা করা যায় না। বিশেষ করে গোটা পৃথিবীটাই যখন নন্দ নাগের ‘ফ্যান’ হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ তাঁর মুণ্ডুপাত করতে গেলে নিজেদের মুণ্ডু উড়ে যেতে পারে। বৈজ্ঞানিকরা খ্যাপাটে হতে পারেন, খামখেয়ালি হতে পারেন—কিন্তু নির্বোধ নন। তাঁদেরও অনেক সমিতি আছে। প্রথমে সেইসব সমিতিতে গোপন আলোচনা হল, তারপর প্রফেসর নাট বল্টু চক্রর সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। তাঁকে বলা হল, তিনি কী দয়া করে তাঁর দেশওয়ালি নন্দ নাগের প্রহেলিকা সমাধানের ভার নেবেন?

প্রফেসর এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তার মূলে ছিলাম আমি। দীননাথ।

ব্যাপারটা আমার মনেও খটকা জাগিয়েছিল অনেক দিন ধরে। অল্পসল্প লিখি বলেই নন্দবাবুকে আমি চিনতাম। নিরহঙ্কার বলে তাঁর সঙ্গে বসে কত খোশগল্পও করেছি। যখন টেলিফোন করেছি, তখন হয়তো লিখছেন। কিন্তু একবারও বিরক্ত হতেন না। টেলিফোনেই গল্প চালিয়ে যেতেন।

পাঁচ বছর আগে প্রথম তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। বেলেঘাটার ফ্ল্যাটে ওঁকে পাইনি। ঘর বন্ধ। কেউ জানে না কোথায় গেছেন। অথচ লেখার পর লেখা ছাপা হয়ে চলেছে একটাই শক্তিশালী গোষ্ঠীর কাগজগুলোয়।

তখন একটু গোয়েন্দাগিরি করেছিলাম। ওঁর ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম। টেলিফোন নম্বরও বের করেছিলাম—যদিও পুষ্পক প্যালেসে নন্দ নাগ-এর নামে কোনো টেলিফোন নেই।

কিন্তু দেখা করতে পারিনি। ফোনে কথাও বলতে পারিনি। নিশ্ছিদ্র প্রাচীর তুলে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন নন্দবাবু।

অভিমান হয়েছিল। কৌতূহলও হয়েছিল। অত্যন্ত কাছের মানুষটা হঠাৎ অনেকদূরে চলে যাওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলাম প্রফেসরের সামনে। তাঁর কাছে তো আর কোনো ব্যাপারে ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নেই।

প্রফেসর সব শুনতেন। শুধু শুনতেন। কথা বলতেন না। পাঁচ বছর ধরে শুধু শুনেই গেছেন। নন্দ নাগের গল্প-উপন্যাসের সমস্ত প্লটই প্রফেসর জেনে ফেলেছিলেন। আমি তো হাউ-হাউ করে বলেই খালাস হয়েছি। উনি যে মনে মনে তৈরি হচ্ছেন, তা বুঝিনি। বুড়ো ভারি ঘোড়েল এই সব ব্যাপারে।

বিদেশেও বৈজ্ঞানিকরা তাঁর দ্বারস্থ হতেই উনি আমার শরণাপন্ন হলেন। বললেন ‘দীননাথ, এখান থেকেই একটা ফোন করো তোমার নন্দবাবুকে।’

মুখ গোঁজ করে আমি বলেছিলাম—’উনি ফোন ধরবেন না। ল্যাজ খুব মোটা হয়ে গেছে।’

ধরবেন ধরবেন। ওঁর হয়ে যে টেলিফোন ধরে তাকে শুধু বলবে, প্রফেসর নাট বল্টু চক্র কথা বলতে চান। ‘ওয়ার্ল্ড সায়েন্স কনফারেন্স অন ডার্ক ম্যাটার’-এর তরফ থেকে।’

তোতাপাখির মতো তাই বলেছিলাম টেলিফোনে। আমার বক্তব্য ‘রিলে’ হয়ে চলে গেছিল নন্দবাবুর কাছে। সেকেন্ড কয়েক পরেই শুনেছিলাম দানা-দানা মন্থর কণ্ঠস্বর ‘দীননাথ নাকি?’

আবেগে গলা বুঁজে এসেছিল আমার। বলেছিলাম চিনতে পেরেছেন তাহলে!

অবিচলিত গলায় নন্দবাবু বলেছিলেন—’প্রফেসর কথা বলতে চান?’

রিসিভার দিয়েছিলাম প্রফেসরকে। উনি শুধু বললেন— ‘অভিনন্দন নিন নন্দবাবু। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। কবে কখন যাব?’

সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে প্রফেসরকে নিয়ে গেলাম পুষ্পক প্যালেসে।

পাঁচ বছরে খুব একটা পালটাননি তো নন্দবাবু। শুধু চাহনি পালটেছে। আর পাল্টেছে হাবভাব। অভ্রভেদী আভিজাত্যের শিখরে বসে যেন চেয়ে রয়েছেন আমাদের দিকে। যে ঘরে বসে কথা হয়েছিল, সে ঘরের বর্ণনা দিয়ে কাহিনির কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না।

কাটছাঁট গলায় বলেছিলেন প্রফেসর নাট বল্টু চক্র—’কাদের তরফে কথা বলতে এসেছি, টেলিফোনে তা শুনেছেন। কী নিয়ে কথা বলতে চাই তাও নিশ্চয় বুঝেছেন।’

‘ডার্ক ম্যাটার নিয়ে,’ খুব আস্তে বললেন নন্দবাবু।

‘যা নিয়ে লিখে আপনি নোবেল প্রাইজ পেলেন।’

‘তার চাইতেও বড়ো পাওয়া তো পেয়েছি আগেই, একটু থেমে ফের বললেন নন্দবাবু—’পৃথিবীর সব মানুষ এখন জেনে গেছে, ডার্ক ম্যাটার আছে। এইটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।’

‘এ ধারণা হঠাৎ আপনার মাথায় এল কী করে?’

‘ধারণা?’ একটু ভুরু তুললেন নন্দবাবু। দুই চোখে নিঃশব্দ তিরস্কার—’এটা আমার বিশ্বাস।’

‘প্রমাণ ছাড়া?’

‘আরও প্রমাণ চান?’

‘আরও মানে? কোনো প্রমাণই আপনি দিতে পারেননি।’

ঝুঁকে বসলেন নন্দবাবু। উনি আমাদের সামনে দশফুট দূরের সোফায় বসেছিলেন। অভিজাত পুরুষের মতোই। দূর থেকেই মনে হল তার চোখের মধ্যে দিয়ে অন্য একটা সূচাগ্র চাহনি মেলে ধরেছে আমাদের দিকে।

বললেন মন্দ্রমন্থর কণ্ঠে—’তিব্বতি তুল্প-র নাম নিশ্চয় শুনেছেন?’

আরও হেলাম দিয়ে বসলেন প্রফেসর—’দেখাবেন নাকি?’

এই প্রথম হাসলেন নন্দবাবু। পাঁচ বছর আগের সেই শিশুর মতো সরল হাসি নয়। মেপে হাসি। দাঁত দেখা গেল না। বললেন—’আপনার জন্যে তাকে আনিয়ে রেখেছি।’

বলে, ওয়াকি-টকি তুলে নিলেন পাশের টিপয় থেকে। বললেন—’মধুমতী, কফি দিয়ে যাও।’

ওয়াকি-টকি, নামিয়ে রেখে আমাদের দিকে চাইলেন নন্দবাবু। আবার মনে হল, ওঁর চোখের মধ্যে দিয়ে অন্য কেউ চেয়ে আছে।

বললেন—’তন্ত্রের যোগিনী সাধনার সঙ্গে তিব্বতের তুল্প সৃষ্টির মধ্যে খুব একটা অমিল আছে কি?’

প্রফেসর বললেন—’তন্ত্রকেও এনে ফেললেন?’

নন্দবাবু পলকহীন চোখে চেয়ে থেকে বলে গেলেন—’তন্ত্রে একে উপবিদ্যা, বলা হয়েছে। কুবের নাকি যোগিনীর অর্চনা করে ধনাধিপতি হয়েছিলেন, এদের অর্চনা করলে নাকি মানুষ রাজত্ব পর্যন্ত লাভ করে থাকে।’

শুকনো গলায় প্রফেসর বললেন—অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস। এ নিয়ে একটা উপন্যাসও লিখেছেন—শুনেছি দীননাথের কাছে।’

চোখের পাতা না কাঁপিয়ে বলে গেলেন নন্দবাবু—’যোগিনীদের মধ্যে প্রধানা হল আটজন। এঁদের মধ্যে সব সেরা হল মধুমতী।’

‘যে আসছে কফি নিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি তন্ত্র সাধনা করেন?’

‘না। কিন্তু তন্ত্র পড়েছি। তন্ত্রসরি গ্রন্থে মধুমতীকে আহ্বান করবার মন্ত্র শুনবেন?’

বলে, সম্মতির অপেক্ষা না রেখে উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করে গেলেন নন্দবাবু :

‘দেবাশ্চ সেবকাঃ সর্বাং পরং চাত্রাধিকারিণঃ।

তারকব্রহ্মণোঃ ভৃত্যং বিনাপ্যত্রাধিকারিণঃ।’

‘ফাইন’ বললেন প্রফেসর।

ঘরে ঢুকল পরমাসুন্দরী একটি মেয়ে। হাতে রুপোর রেকাবি তার ওপর কফির কাপ। তার পরনে গরদের লাল পাড় শাড়ি। চুল খোলা ফর্সা কপালে জ্বলজ্বল করছে লাল টিপ। চোখে আর ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। রেকাবি নামিয়ে রেখে দুহাত তুলে আমাদের নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েটি।

নন্দবাবু বললেন—’এই হল মধুমতী। ডার্ক ম্যাটারে গড়া।’

কফির কাপ তুলে নিয়ে বললেন প্রফেসর ‘ডার্ক ম্যাটার তো দেখা যায় না।’

চোখ নাচিয়ে বললেন নন্দবাবু—ওটা তো আপনাদের আন্দাজি কথা প্রফেসর। ডার্ক ম্যাটার তো আজও মিসিং ম্যাটার। আপনারা সন্দেহ করছেন, গোটাব্রহ্মাণ্ড জুড়ে রয়েছে এটা বস্তু। সে বস্তু লুমিনাস নয়। তাই তাকে দেখা যায় না। কিন্তু সবই আপনাদের অনুমান। ব্ল্যাক হোল যে সত্যিই তেমন ব্ল্যাক নয়, এমন কথাও তো বলেছেন, হকিন্স।’

প্রফেসর যেন একটা ধাক্কা খেলেন—’আপনি কি বলেন ডার্ক ম্যাটার তাহলে নিউট্রিনো?’

আবার সেই মাপা হাসি হাসলেন নন্দবাবু—’মহাবিস্ফোরণের প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই বস্তুকণা আর বিকিরণের সুরুয়ার মধ্যে আবির্ভাব ঘটেছিল ডার্কম্যাটারের। তারপর 15 বিলিয়ন বছর কেটে গেছে। আপনাদের চেনা জানা। বস্তুগূলোর মধ্যে বিবর্তন ঘটেছে। পৃথিবীর প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে। মহাবিশ্বের কোথাও কোথাও ডার্ক ম্যাটারেরও ক্রমবিবর্তন ঘটেছে। মানুষের চাইতেও শক্তিশালী সত্তার আবির্ভাব ঘটেছে।’

‘ও সব উপন্যাসিকের কল্পনায় মানায়,’ অম্লানবদনে গাল খুঁটতে খুঁটতে বলে গেলেন প্রফেসর।

চোখ জ্বলে উঠল নন্দবাবুর ‘ডার্ক ম্যাটার কিন্তু মাহবিস্ফোরণের প্রথম মুহূর্ত থেকে আজও বিরাজমান ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র’—

‘মহাবিস্ফোরণ।’ বিদ্রূপের স্বরে বললেন প্রফেসর—’এ তত্ত্বের বিরোধী বলেই ফ্রেড হয়েল ব্যঙ্গ করে Big Bang নাম দিয়েছিলেন সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তকে। বোবার মতো ফেটে গিয়ে সৃষ্টি শুরু হয়নি। গালগল্প ছাড়ুন নন্দবাবু।’

নিমেষহীন নয়নে চেয়ে রইলেন নন্দবাবু। বললেন আস্তে আস্তে ‘গালগল্প। সাংখ্যদর্শন তাহলে মিথ্যে বলেছে! বৈজ্ঞানিকরা বলছেন না, অনন্ত ঘনত্ব আর অনন্ত তাপমাত্রার মধ্যে আবার ফিরে যাবে এই ব্রহ্মাণ্ড তখন আয়তন হবে জিরো? গুটিয়ে যাওয়ার শেষে শুরু হয়েছিল ছড়িয়ে পড়া—ছড়িয়ে পড়ার শেষে আবার শুরু হবে গুটিয়ে যাওয়া? তখন সময়ের তীর ঘুরে যাবে পেছন দিকে আগামী কালের ঘটনা আজ হবে স্পষ্ট? ভবিষ্যৎ হবে অতীত? অথবা এক হয়ে যাবে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ? তাতে কী প্রমাণিত হল ডার্ক ম্যাটার আছে? নির্লজ্জের মতো খুঁচিয়ে গেলেন প্রফেসর।

‘ছিল, আছে, থাকবে,’ শান্তগলায় বললেন নন্দবাবু।

‘ধরাছোঁয়ার বাইরে?’ প্রফেসরের টিপ্পনি।

নন্দবাবুর চোখের চাহনিতে আবার দেখলাম অন্য সত্তার উগ্র প্রকাশ। কথা বললেন কিন্তু সহজ গলায় ‘হ্যাঁ। ডার্ক ম্যাটার চিরকালই অদৃশ্য থাকবে।’

‘তাহলে মধুমিতাকে দেখা যাচ্ছে কী করে? মধুমিতা না ছাই—রক্তমাংসের মেয়েকে দেখিয়ে গুল মারছেন।’

উগ্রতর হল উগ্র চাহনি। চিবিয়ে বললেন, ‘নন্দবাবু তাহলে দেখুন।’ তুলে নিলেন ওয়াকি-টকি ‘মধুমিতা চলে এস।’

ওয়াকি-টকি নামিয়ে রেখে বললেন—’ডার্ক ম্যাটারের ঘনীভূত রূপ দেখিয়েছিলাম—এবার দেখুন তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া।’

মধুমিতা ঘরে ঢুকে দাঁড়াল দেওয়াল ঘেঁষে। মুখে আর চোখে সেই হাসি। এবার যেন নিবিড় ব্যঙ্গ প্রচ্ছন্ন রয়েছে হাসির মধ্যে।

নন্দবাবু বললেন, ‘তন্ত্রের একটা মন্ত্র শোনাই, অদৃশ্যকারিণীং বিদ্যাং লক্ষজাপ্যে প্রযচ্ছতি। মানে জেনে দরকার নেই, শুধু জেনে রাখুন, ডার্ক ম্যাটারে বিলীন করে দেওয়ার উপায় জেনেছিলেন তান্ত্রিক গুরুরা। মধুমিতা, তুমি যাও।’

মধুমিতার নিরেট দেহ যেন গ্যাসের দেহ হয়ে গেল। শরীরের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে পেছনের দেওয়াল। তারপরে শুধু দেওয়ালই দেখলাম, মধুমিতাকে দেখলাম না।

গাল চুলকে প্রফেসর বললেন—’ম্যাজিকটা ভালোই। কিন্তু তুল্প ম্যাজিকটা যে এখনও দেখলাম না।’

নন্দবাবু একইভাবে বসে রইলেন। চাহনি আবার শান্ত। কিন্তু অন্য সত্তা বিলক্ষণ জাগ্রত। থেমে থেমে বললেন—’বাংলার তন্ত্রই তিব্বতে মদত জুগিয়েছিল। অনেক চেষ্টায় চিন্তার কারাগ্রহণ সম্ভব করেছিল। আমি অত সময় নিই না। কার চিন্তা করছেন?’ বলে, আমার দিকে চাইলেন—’দীননাথ, তুমি বরাবর নিজেকে নিয়েই বড্ড বেশি চিন্তা কর। দেখো তোমার সেই চিন্তার চেহারা।’

পলক ফেলার আগেই দেওয়ালের সামনে দেখলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি। আর এক দীননাথ। কিন্তু একি মুখভাব। ভয়ে পাংশু উদবেগে কাঠ।

প্রফেসর বললেন—’থাক, থাক, আপনার ম্যাজিকের নমুনা অনেক দেখলাম। এর জন্যে আসিনি, পিসি সরকারের কাছে গেলেই পারতাম।’

প্রফেসর থামলেন। দ্বিতীয় দীননাথ বিলীন হয়ে গেল। নন্দবাবু বললেন—কী জন্যে এসেছেন?’

‘কে আপনি?’

‘আমিই ডার্ক, ম্যাটার।’

‘আপনি তো নন্দ নাগ।’

‘নন্দ নাগের শরীর ছেয়ে আছি আমি। অণু পরমাণুর মধ্যে ফাঁক তো অনেক। আমি সেই ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে বসে আছি। নন্দবাবুর শরীরকে ধার নিয়েছি।’

‘কেন?’

‘প্রফেসর, আমি আমরা ব্রহ্মাণ্ডের দূর দূরান্তে যে চেহারা, এসে দাঁড়িয়েছি পনেরো বিলিয়ন বছরের ক্রমবিবর্তনের পর তা আপনাদের চোখে অদৃশ্য। অথচ আমাদের অনেক নীচের ধাপের ডার্ক ম্যাটার এই পৃথিবী ছেয়ে রয়েছে তাও আপনাদের চোখে অদৃশ্য। মানুষ সাইকিক ফোর্স দিয়ে মাঝে মাঝে সেই ডার্ক, ম্যাটারকে কাজে লাগায়—তখন আপনারা অবিশ্বাস করেন তাই আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের অবিশ্বাস্য শক্তি ধার দিয়ে আপনাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে—কিন্তু পারলাম না।’

‘হেঁয়ালি ছাড়ুন,’ কড়া গলা প্রফেসরের।

এই প্রথম নন্দবাবুর চোখে মুখে হতাশার ছাপ দেখলাম। গলার সুরেও যেন ক্লান্তি ফুটে উঠল—’নন্দ নাগ মেধাবী। কিন্তু এ বৈরাগ্য নিয়ে কি চলে? গোটা পৃথিবী জুড়ে শুধু ঈর্ষা। কেউ কারও ভালো দেখতে পারে না। আমি বসেছিলাম পার্কে। নন্দবাবুর লাঞ্ছিত মনের চেহারা দেখলাম। তাঁর যা পাওনা, তাই তাঁকে পাইয়ে দেব ঠিক করলাম। তাঁরই কলম দিয়ে সবাইকে বিশ্বাস করাতে চাইলাম। ডার্ক ম্যাটার আছে, এই পৃথিবীর দৃশ্যমান বস্তুর চাইতে অদৃশ্য এই বস্তুর শক্তি অনেক বেশি। নন্দবাবু অভাবনীয় কৃতিত্ব দেখালেন। কিন্তু লাভ কী? ক্রমবিবর্তনের পথে বহু লক্ষ বছরে আসবে—জোর করে তা চাপিয়ে দিয়ে কিছু তো হল না। আমি যতক্ষণ থাকব, নন্দবাবু ততক্ষণ সাহিত্য সম্রাট হয়ে থাকবেন। আমরা চলে গেলেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন।’

‘আমরা? মানে?’ প্রফেসরের প্রশ্ন। নন্দবাবুকে এই অবস্থায় নিয়ে আসতে আমরা অনেকেই কোমর বেঁধে লেগেছিলাম, প্রফেসর।’

‘কি ভাবে?’

‘যে মুহূর্তে আমি ঠিক করলাম, নন্দবাবুকে এবার স্বীকৃতি দেওয়া দরকার, সেই মুহূর্তে আমাদেরই একজন নির্ঝর সেনের শরীর দখল করে তার চিন্তাকে কবজায় এনেছিল। একই সঙ্গে জহর মল্লিককে দখল করেছিল আর একজন। ট্যাক্সি ড্রাইভারের শরীরও দখল করেছিল আমাদের একজন।’

‘পুরস্কার দেওয়ার সময়েও তাই ঘটেছে?’

‘হ্যাঁ। নোবেল কমিটির বিচারকদের কেউই আর স্বশরীরে ছিলেন না। এখনও নেই। ওঁদের মগজ এখন আমাদের মগজ, আমাদের চিন্তা এখন ওদের চিন্তা, এখন গোটা পৃথিবীর যে সব মানুষ নন্দবাবুর বই পড়েছে, তাদের প্রত্যেকের শরীর দখল করে রয়েছি। তাই তারা নন্দবাবুর অনুরাগী—তাই নন্দবাবুর কোনো সমালোচক নেই।’

‘তারপর?’

‘হ্যাঁ, তারপর,’ বিষণ্ণ গলায় বলে গেলেন নন্দবাবুরূপী ডার্ক ম্যাটার ‘আমরা তো চিরকাল এভাবে শরীরের খাঁচায় বন্দি হয়ে মানুষের মঙ্গল করে যেতে পারব না।’

‘কি করবেন?’

‘চলে যাব।’

‘কোথায়?’

‘অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে যেখানে আছে মানুষের চাইতেও সেরা জীব।’

‘নন্দবাববুর কী দশা হবে?’

‘তার মানে?’

‘আপনারা চলে গেলেই তো সবাই যে যার চিন্তা ফিরে পাবে। আবার শুরু হবে নোংরামি, ঈর্ষা, ইতরোমি, ভালো মানুষ নন্দবাবুর অবস্থাটা তখন কল্পনা করেছেন? কেন তাকে নোবেল প্রাইজ পাইয়ে দিলেন?’

স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন নন্দবাবুরূপী ডার্ক ম্যাটার।

তারপর বললেন ক্ষীণ কণ্ঠে—’তবে তাই হোক। নন্দবাবুকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর প্রতিনিধি হয়ে তিনি থাকবেন আমাদের সঙ্গে। আমরা যেমন মানুষের শরীর দখল করেছিলাম তাদের ভালো করব বলে, তিনিও তেমনি আমাদের শরীর দখল করে থাকবেন পৃথিবীর স্মৃতি হিসেবে।’

‘এই রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে?’

‘না, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়ে।’

সত্যিই বিলীন হয়ে গেলেন নন্দ নাগ আমাদের চোখের সামনেই কী করে, তা লিখতে আমার কষ্ট হয়েছ। তবে নোবেল পুরস্কার প্রাপকের অকস্মাৎ অন্তর্ধানের পর পৃথিবীময় যে হট্টগোল চলেছিল, তা কারও অজানা নয়।

কষ্টটা মিলিয়ে যায় যখন ভাবি, বেঁচে আছেন নন্দবাবু। নিরাকার অবয়ব নিয়ে ব্রহ্মাণ্ড চক্কর মেরে বেড়াচ্ছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *