অদৃশ্য বলয় – এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

অদৃশ্য বলয় – এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

বিকেলের রোদ নরম হয় এসেছে। রাস্তাটা পার হতে হতে বাগচি একবার অভ্যেস-বশে সামনে তাকালেন। বিশাল আটকোনা একটি তারা যেন হঠাৎ আকাশ থেকে খসে ইট পাথর-কাচে মোড়া চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বলছে, ‘আমায় দেখো। কী সুন্দর আমি।’

এই বাড়িটি বাড়ি, না বলে একে বাড়ির সমষ্টি বলাই উচিত—বাগচির মানস কন্যা। এর চিন্তা, নকশা থেকে শুরু করে প্রত্যেক ধাপে ধাপে তিনি ছিলেন জড়িত। যখন লোকে ষাট-সত্তর তলার বেশি যেতে ভয় পেত, মনে করত প্রগতির চূড়ান্ত হল একশো তলা, সমর বাগচি তখন মেটিরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সদ্য পিএইচডি করে নতুন উপাদান নিয়ে আশ্চর্য, অভিনব, ভবিষ্যৎমুখী সব পরিকল্পনা করছেন।

এইভাবে জেট ফাউন্ডেশনের ওপর জন্ম নিল আকাশছোঁয়া ঘেঁষাঘেষি আটটি বাড়ি। একটি কেন্দ্র থেকে সাইকেলের স্পোকের মতো বেরিয়ে আছে। এখানে বাস করার ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে অফিস, কলেজ, বাজার, খেলার মাঠ, ক্যান্টিন, স্টেডিয়াম, কী নেই! এমনকী, একটি চিড়িয়াখানাও। বলতে গেলে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শহর। তাই কাজকর্মে যাবার জন্য কাউকে আর বাড়ি ছেড়ে বেরোতে হয় না।

এইসব প্রাসাদগুচ্ছ, এমনকী, শক্তি উৎপাদনের ব্যাপারেও অন্য কারও মুখ চেয়ে নেই। সৌরশক্তি ও জৈব গ্যাস, এই দুভাবে এদের প্রয়োজন মেটাবার ব্যবস্থা এরা নিজেরাই করেছে। কাজকর্মের জন্য কাউকে বাসে ঝুলে-ঝুলে দূরে যেতে হয় না। পথঘাট তাই ফাঁকা-ফাঁকাই থাকে। ব্যক্তিগত মালিকানায় গাড়ি নেই বললেই হয়। সরকারি গাড়ি অবশ্য আছে, তা ছাড়া আছে বড়ো-বড়ো কোম্পানিদেরও নিজস্ব গাড়ি। দূরে যাবার একান্ত দরকার হলে ট্রেন, বাস, পাতাল-রেল আছে। বাড়িগুলি ওপরে উঠে যাওয়ায় এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় অনেক খালি জায়গা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে সবুজ মাঠ, পার্ক ছোটোখাটো জঙ্গল।

বাগচি চোখ নামিয়ে আবার হাঁটা দিলেন। মনটা খুব ভালো লাগছিল না। কংক্রিটের চত্বরে ইচ্ছে করে ফুটো করা আছে যাতে ফাঁকে ফাঁকে ঘাস গজাতে পারে ঘাস মাড়িয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে মনে হল, কেউ তাঁর কাজে বাগড়া দেবার চেষ্টা করছে না তো! একেই তো চৌম্বক বলয়ের জন্য এক শ্রেণির লোকে খুব চটেছে। আজ হঠাৎ তাঁর বেতার-টেলিফোন জ্যাম হয়ে গেল। অন্য শহরের এক কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন চৌম্বক বলয়ের আর একটি নতুন প্রয়োগ নিয়ে। ঠিকভাবে ডেভেলপ করতে পারলে ইস্পাতের প্রচুর সাশ্রয় হয়।

ভাবতে ভাবতে বাড়ির আরও কাছে পৌঁছে গেছেন বাগচি। এখন আর আটকোনা তারার মতো লাগছে না, মনে হচ্ছে দৈত্যাকার একটি মৌচাক। বিকেলের পড়ন্ত রোদ জানালার কাচে-কাচে ঝলসাচ্ছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাঁর মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল, ‘বাঃ।’ বলতে বলতেই পায়ে কীসের ঠোক্কর খেলেন, পড়ে যেতে-যেতে সামলে নিয়ে আছাড় খাওয়া থেকে বাঁচালেন নিজেকে। রোদ-ঝলসানো জানলাগুলি থেকে মাটির দিকে দৃষ্টি ধাতস্থ হতে একটু সময় নিল। যখন ভালো করে নজর পড়ল, আঁতকে উঠে আবার স্বগতোক্তি করলেন, ‘বিষ্ণু!’

বিষ্ণু তাঁর ছোটো ছেলে। তাকে নিয়ে বাগচি-পরিবারে মহা দুশ্চিন্তা। কারণ সে চায় এমন একটি পেশা, যা বহুদিন ভদ্রসমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না। তাদের তেমন খাতিরও নেই। সে ছিল এককালে, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। এমন সব ছেলেই হতে চায় পেশাদার ফুটবলার। সেইরকম ট্রেনিং-এরও ব্যবস্থা আছে ছোটোবেলা থেকেই বিষ্ণু চায় ক্রিকেট খেলোয়াড় হতে, সুনীল গাওস্কর হতে, যার নাম জিজ্ঞেস করলে ওর বয়সের ছেলেরা মাথা চুলকে বলবে, ‘কে জানে, শিবাজির কোনো সেনাপতি-টতি হবে হয়তো। বাগচির মাথার মধ্যে নিজের কাজ ছাড়াও এই দুর্ভাবনাটা তো জমা হয়ে ছিলই, এখন দপ করে মেজাজটা চড়ে গেল। কারণ, আর কিছু নয়, যে-বস্তুটি পায়ে লেগে তিনি চিতপটাং হচ্ছিলেন, সেটি একটি লাল গোলমতো জিনিস, এক সময় যা খুবই প্রসিদ্ধ ছিল ক্রিকেট-বল নামে।

এখনও অবশ্য একে ক্রিকেট-বলই বলে। যদিও এর গঠন ও উপাদানে কিছুটা বদল হয়েছে। একে নিয়ে ছেলেপিলেরা আব একদম মাতামাতি করে না। বলটা এখানে কোথা থেকে এল? যতই জিনিসটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে পরখ করতে থাকেন, ততই তাঁর ভুরু দুটো কাছাকাছি আসতে থাকে। বিষ্ণু আবার ক্রিকেটে হাত দিয়েছে বলে শুধু নয়, এই সব উঁচু বাড়িতে এখন ক্রিকেট খেলা আইন করে বারণ। প্রচণ্ড স্পিডে যে-সব খেলা হয়, যেমন হকি, টেনিস, তাও বারণ। তবে অন্য সব খেলার মাঠ এখন ছাদে। একশো আশি তলা থেকে ক্রিকেট বা হকির বল নীচে পড়লে কী হতে পারে তা চিন্তা না করাই ভালো। এখন এখানে ইনডোর কোর্ট ছাড়া খোলা ছাদে শুধু খেলা হয় ফুটবল। ফুটবল আটকাবার জন্য উঁচু রেলিং ছাড়াও আছে দুর্ভেদ্য চৌম্বক বলয়।

আজ একবার বিষ্ণুকে পেলে হয়। রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে বাগচি লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন লম্বা-লম্বা পা ফেলে। পাশাপাশি অনেকগুলি লিফট। কোনোটা উঠছে, কোনোটা নামছে। যেটা সবচেয়ে কাছে ছিল, সেখানে গিয়ে বোতামটা টিপলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খাঁচাটা নেমে এল, দরজা খুলে যেতেই গোটা পাঁচ-ছয় বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এদিক-ওদিক ছিটিয়ে গেল, একজন ছাড়া। যে ছেলেটির বয়স আট-নয়, কোঁকড়া চুল, সপ্রতিভ চেহারা, সে বাগচিকে দেখে থমকে গিযে বলল, ‘মেসোমশাই!

‘কী রে পিন্টু!’ অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিয়েই বাগচি লিফটের ভেতরে ঢুকেছেন। লক্ষই করেননি যে, পিন্টুও পিছনে পিছনে আবার ঢুকছে। ‘তিপ্পান্ন তলায় চল,’ একটু রাগী-রাগী গলায় বলা সত্ত্বেও খাঁচা চুপ। এবারে স্পিকারের একটু বেশি কাছে মুখ নিয়ে আবার বললেন বাগচি, ‘কী, হল কী? তিপ্পান্ন তলা।’ প্রায় হুমকির মতো শোনাল এবার। লিফট নট-নড়ন-চড়ন। তার দোষ কী। তার কম্পিউটার মেমারিতে প্রত্যেকটি বাসিন্দার গলার প্যাটার্ন ধরা আছে। তার বাইরে কোনোও গলার আদেশে লিফট চলতে পারেই না, এমনই এর ব্যবস্থা। আজেবাজে লোক বাইরে থেকে যাতে ঢুকে না পড়ে, তাই এই ব্যবস্থা।

ক্রমশ মেজাজ চড়তে থাকে বাগচির। আজ কি সবাই মিলে তাঁর পিছনে লেগেছে! প্রথমে রেডিয়ো টেলিফোনে বিভ্রাট, তারপর এই নিষিদ্ধ বল। এখন লিফট। রেগে প্রায় বেরিয়ে আসতে যাচ্ছেন, এমন সময় পিছন থেকে একটি সরু গলা বলল, ‘দাঁড়ান মেসোমশায়, আমি বলে দিচ্ছি। তিপ্পান্ন তলায় যাব আমরা।’ গোঁগোঁ করে উঠতে লাগল খাঁচাটা।

বাগচি বুঝলেন, তাঁর গলা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, তাই প্যাটার্ন মিলছিল না। একটু হাসি-হাসি মুখে তিনি এবার পিন্টুর দিকে ফিরলেন। ছেলেটিকে তিনি খুবই স্নেহ করেন। চুয়ান্ন তলার হলেও সব সময় বিষ্ণুর সঙ্গে আঠার মতো লেপটে আছে। বিষ্ণুদার ফাই-ফরমাশ ঘাটতে পেলে পিন্টু যেন হাতে স্বর্গ পায়।

‘এ কী, তুই আবার উঠছিস যে!’ জিজ্ঞেস করলেন বাগচি।

‘না, মানে, বিষ্ণুদা বলল,’ থেমে গেল পিন্টু। মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস না থাকলে যা হয়। তার মুখ দেখে মনে হল, প্রাণপণে সে কিছুটা একটা অজুহাত ভাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু লাগসই কিছু মনে আসছে না।

লাল ক্রিকেট-বলটা পকেট থেকে বার করে বাগচি বললেন, ‘এটার জন্যে তো?’

মুখ সাদা হয়ে গেল পিন্টুর। কী বলবে বুঝতে না পেরে পিন্টু বলল, ‘মানে, আমি ফিলডিং করছিলাম তো, এমন সময়…’

‘এমন সময় কী?’ বাগচি গলাটা গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বিষ্ণুদাকে বাঁচাবার প্রাণপণ চেষ্টা দেখে মজাও লাগছিল তাঁর।

কোনো উত্তর নেই।

‘এমন সময় বলটা বেড়া টপকে নীচে চলে এল?’

বাগচি নিজের মুখেই এমন একটি অসম্ভব কথা বললেন, যার কোনো অর্থ হয় না। কারণ যে চৌম্বক বলয় দিয়ে সমস্ত ছাদের আকাশটা মোড়া আছে, তাকে ভেদ করে ধাতুর সামান্যতম ছোঁয়া আছে, এমন জিনিস বেরিয়ে আসতেই পারে না। এরই বাজারে চালু নাম বাগচি-বলয়। ছোটোবেলায় পড়া একটি কল্পবিজ্ঞানের বই থেকে। আইডিয়াটা পেয়েছিলেন তিনি, তার পরে এখনকার প্রযুক্তি ও মেটিরিয়াল বিজ্ঞানের ভেলকি যোগ করে তিনি এটিকে গ্রহণযোগ্য, কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন। এখন সমস্ত উঁচু বাড়ির ছাদে চৌম্বক বলয় থাকা বাধ্যতামূলক তবে হ্যাঁ, তার জন্য নানারকম নিত্যব্যবহার্য উপকরণে কিছু বদল আনতে হয়েছে, যেমন খেলার ব্যাট, বল, ডান্ডা, সবকিছুতেই ভেতরদিকে সূক্ষ্মভাবে লোহার একটা আস্তর থাকে। খেলোয়াড়দের জুতো ও জামাকাপড়েও তাই। বলয়টি একেবারে নিখুঁত করার জন্য প্রতিহত করার ব্যবস্থাও আছে। তার কাছাকাছি কোনো লোহার সাঁড়াশি হাতে কেউ গেলে সাঁড়াশিটি শাঁ করে বলয়ের গায়ে ছুটে গিয়ে ঝুলতে থাকবে না। তবে কেউ সাঁড়াশিটি ছুঁড়ে ছাদ থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করে, তা হলে ওই চৌম্বকক্ষেত্রে মৃদু শব্দ হবে, আর সাঁড়াশিটার গতি ওখানেই থেমে যাবে। সেটা পিছলে গড়িয়ে পড়বে ছাদের মেঝেতেই। এই বলয় ভেদ করে আজ অবধি কোনো ফুটবল মাটিতে পড়েনি, পড়লে সেটা হবে আপেল গাছ থেকে মাটিতে না-পড়ে আকাশে উড়ে যাওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনা।

দুজনেই চুপ। পিন্টু যতটা না চমকে গেছে, ভয় পেয়েছে তার চেয়ে বেশি। ছাদে ক্রিকেট খেলার জন্য না জানি বিষ্ণুদার কী শাস্তি আছে কপালে। আসলে সে মোটেই খেলছিল না, বিষ্ণুদাই তাকে ছক্কা মারার একটা কায়দা দেখাচ্ছিল। এমন সময় বলটা উড়ে বাইরে চলে গেল। ছাদে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। দুজনেই এই অসম্ভব ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা। ছাদে তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও যখন পাওয়া গেল না, তখন বিষ্ণুদাকে বাঁচাবার জন্য সে ইচ্ছে করেই নীচে আসছিল। কে জানত যে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়।

বাগচি ভাবছিলেন অন্য কথা। চৌম্বকক্ষেত্রের দুর্ভেদ্য বর্মে কী করে ফাটল ধরল। অসম্ভব। তা হতেই পারে না। কিন্তু বলটা তা হলে…।

লিফট ততক্ষণে তিপ্পান্ন তলায় পৌছে গেছে। তিনি একাই বেরিয়ে এলেন। করিডরে শুনলেন পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা হচ্ছে, ‘দয়া করে সকলে শুনুন, সদস্যদের অবহিত করা হচ্ছে যে, পূর্ব ও ঈশান ব্লকের মাঝখানের চত্বরে সরকারি দুগ্ধ-দফতরের ভ্যানটির মাথা কোনো অজানা উড়ন্ত বস্তুর আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা যে যেখানে থাকেন, অতি অবশ্য যেন কমিটি-রুমে চলে আসেন। এমার্জেন্সি মিটিং-এ ডাকা হয়েছে।

নিজের ফ্ল্যাট অবধি পৌঁছতে-পৌঁছতে বারকয়েক ঘোষণাটার পুনরাবৃত্তি হল। শেষবারে একটা বাড়তি খবর, ‘গাড়িটির ভিতরে পাওয়া গেছে দোমড়ানো অবস্থায় একটি ফুটবল। সুতরাং এ-টিমের ক্যাপটেনকেও তলব করা হয়েছে কমিটি-রুমে।’

কোনো সন্দেহ নেই যে, অসম্ভব ঘটনাটাই সত্যি-সত্যি ঘটেছে। চৌম্বক বলয়ে ফাটল। মেঘের মতো থমথমে মুখে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন বাগচি। সামনেই টেলিভিশনের চাবি টিপছে বিষ্ণু তার মা কিংবা দিদি কেউ ধারে-কাছে নেই। ঘোষণা অবশ্য বাড়ির মধ্যেও শোনা যাচ্ছে, বসার ঘরের স্পিকার থেকে।

বাবাকে দেখে লাফিয়ে উঠল বিষ্ণু।

‘কী হল?’ ক্লান্ত, নিরাসক্ত গলা তার বাবার।

‘এ-টিমের ক্যাপটেনকে কমিটি রুমে ডাকছে। শুনেছ? বাগচি ভাবলেন, একেই বলে ছেলেমানুষ।

এ-টিম আর বি-টিমের রেষারেষি এদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আজ যদি যুদ্ধ হয়ে সমস্ত শহর ধবংস হয়, ওরা হিসেব করতে বসবে বি-টিমের কজন মাটি-চাপা পড়েছে। গত ওলিম্পিকে ইস্ট জার্মান মেয়ে-ফুটবল-দল আর্জেন্টিনার ছেলে-ফুটবল-টিমকে হারাবার পর থেকে মেয়েদের মনোবল একেবারে তুঙ্গে। এ-টিম ছেলেদের টিম। মেয়েরা যাকে আড়ালে বলে এলেবেলে টিম। ছেলেরাও নিজেদের মধ্যে মেয়েদের বি-টিমকে বলে বোকা টিম, কেউ বলে বিচ্ছিরি টিম। আজ এ-টিমের এই বিপদে সব ছেলেই উত্তেজিত, তাদের কাছে সেটা মান-সম্মানের প্রশ্ন। এতই উত্তেজিত বিষ্ণু যে, বাবাকে দেখে লুকিয়ে পড়ার বদলে সে দৌড়ে এসে জরুরি খবরটা শুনিয়ে দিল।

‘হ্যাঁ, শুনলাম। কিন্তু হয়েছে কী?’

‘কমিটি মিটিং বসছে। নীচে কী অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাই। শোনোনি? ইশ, দিদিটা যদি শুনে থাকে।’

‘শুনবেই। সব জায়গায়ই তো আওয়াজ পৌঁছুবে।’

‘ইশ!’ মুখটা কাতর হয়ে গেল বিষ্ণুর।

ঘোষণাটা রেকর্ডের মতো চলছিল। বাগচি রিমোট বোতাম টিপে বন্ধ করলেন। তাঁর চিন্তা এখন বিষ্ণুর থেকে সম্পূর্ণ অন্য দিকে চলে গেছে। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে কপালে একবার হাত বুলোলেন। চশমাটা খুলে রাখলেন। বিষ্ণু তখনও চাবি নিয়ে ঘোরাচ্ছে।

‘কী আছে দ্যাখ তো রান্নাঘরে। আর কফির জলটা চাপিয়ে দে।’

বিষ্ণু উঠে গেল। ফিরে এল এক প্লেট ঘুগনি আর কফি নিয়ে। মা সব গুছিয়েই রেখে গিয়েছিলেন। ক্রিলের ঘুগনি আজকাল খুব চলছে। কুমেরু থেকে চালান আসছে। খেতে চিংড়ি মাছের মতো, দামেও সস্তা।

এক চামচ মুখে দিলেন বাগচি অন্যমনস্ক ভাবে। মনে হল, কাগজ খাচ্ছেন।

‘বাবা, দ্যাখো তো টিভিতে কী হল? কোনো আওয়াজ নেই, ছবিও আসছে না।’

‘একটু চুপ করবি বিষ্ণু, আমি ভাবছি।’

‘কী ভাবছ?’

বাবার সঙ্গে এরকমভাবেই কথা বলে সে। এর জন্য মার কাছে বকুনিও কম খায় না। বাবা যে শহরের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, তাঁর মাথায় যে-সব চিন্তা-ভাবনা ঘোরে সেগুলি যে খুব দামি, বিষ্ণুর তাতে কিছু যায় আসে না।

‘ভাবছি, বলটা পড়ল কী করে?’

‘বল!’ দারুণ চমকে গেল বিষ্ণু। ‘কোন বল?’ ঘোষণার শেষ অংশটা সে ভালো করে শোনেনি।

‘ফুটবল। ভ্যানের ছাদ ফুটো করে গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেছে। পড়ল কী করে বলটা।’

‘বাবা।’ উঠে দাঁড়াল বিষ্ণু, ‘একটা কথা বলব?’

‘জানি। তোমার ক্রিকেটবল তো?’

‘ওটা কী করে উড়ে গেল, আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না। তারপর এখন এই টিভিতে গড়বড়। এরকম তো কখনো হয় না।’

আস্তে-আস্তে সোজা হয়ে বসলেন বাগচি। তারপর নিজের মনে বলে যেতে লাগলেন, যেন গল্প শোনাচ্ছেন কাউকে। ‘পিন্টুকে ফিলডিং করছে, বিষ্ণু লুফে নেবে বলে রেডি, কিন্তু হঠাৎ পাখির মতো বলয়ের জাল ছিঁড়ে বলটা উড়ে গেল। ভাগ্যিস তখন নীচে কেউ ছিল না। তবে একটু পরেই সেখান দিয়ে হেঁটে আসছিলাম আমি। বলটা আর কেউ দেখার আগেই তুলে নিই।

চোখ দুটো গোল হয়ে থাকে বিষ্ণুর। সে তৎক্ষণাৎ প্রতিজ্ঞা করে, আর কোনোদিন ক্রিকেট ব্যাটে হাত দেবে না। আজ আর একটু হলেই তার বাবার মাথায় বলটা লাগতে পারত। উহ, চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।

বাগচি বলে চলেছেন, ‘ঠিক সেই সময় এ-টিমের ফুটবল প্র্যাকটিস চলছিল ঈশান ব্লকের ছাদে। একটা উঁচু ভলি, তারপর একই ঘটনা। জাল ফুটো করে, চৌম্বক টানকে কলা দেখিয়ে ফুটবল একশো আশি তলা থেকে দুধের ভ্যানের মাথায়। দুটো ঘটনা ঘটছে প্রায় একই সময়।’

বিষ্ণু বাবাকে এরকম ভাবে বিড়বিড় করতে দেখে কেমন ঘাবড়ে যাচ্ছিল। সে তাঁর মনটা অন্যদিকে করার জন্য বলল, ‘আর ঠিক একই সময়ে উপগ্রহ থেকে টিভি ট্রান্সমিশন বিগড়ে গেল!’

‘আর আমার রেডিয়ো টেলিফোন চলল না।’

‘তার মানে কোনো চৌম্বক গোলমাল?’

‘চৌম্বক ঝড়।’

মুখের চেহারা বদলে গেল বাগচির। কোঁচকানো ভুরু সোজা, গোঁফের ফাঁকে হাসি। কফির কাপ প্রায় উলটে ফেলে তিনি বিষ্ণুর হাত ধরে নাচতে লাগলেন, ‘মিল গিয়া, মিল গিয়া!’

ফ্ল্যাটের খোলা দরজা দিয়ে কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছে পিন্টু। ঘরে এরকম খুশির আবহাওয়া দেখে সে ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘কী পেয়েছেন মেসোমশাই।’

মেসোমশাই তখন নেচে চলেছেন। সেই অবস্থায় তিনি বললেন, ‘উত্তর! উত্তর!’

একটু পরে চেয়ারে বসে বাকি কফিটা এক চুমুকে শেষ করে তিনি বিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুঝেছিস ব্যাপারটা? এর উৎস আছে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক দূরে…’

বিষ্ণু বলল, ‘সোলার অ্যাকটিভিটির কথা বলছ?’

‘একদম ঠিক। সৌরোৎপাত। এই সময় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে চৌম্বক ঝড় হয়, বা হতে পারে। শর্টওয়েভ রেডিয়ো যোগাযোগ এই সময় ব্যাহত হতে পারে। এবং আরও কী কী হতে পারে, সেটা আমরা আজকেই দেখলাম।’

পিন্টু বেচাবার মাথায় এসব কিছুই ঢুকছিল না। কেবল বিষ্ণুদা যে বাবার কাছে বকুনি খাচ্ছে না তাতেই সে খুশি।

ঠিক সেই সময় বন্ধ টিভি সেটটিকে শব্দ ফিরে এল, ফুটে উঠল ঘোষিকার মুখ।

‘একটি বিশেষ ঘোষণা। আবহাওয়া-অফিস থেকে এই মাত্র জানান হল যে, আজ ভারতীয় সময় বিকেল পাঁচটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে পাঁচটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট দশ সেকেন্ড অবধি সমস্ত পৃথিবীতে বেতার ও উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যায়। অত্যন্ত প্রবল চৌম্বক ঝড়ই এর কারণ বলে তাঁরা জানিয়েছেন। এ-বিষয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আজ রাত আটটায় প্রচারিত হবে…’

বাগচি পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললেন ‘এই যে পিন্টু, তোর জন্যে টফি।’ কিন্তু হাত বার করতেই বেরিয়ে এল একটি ক্রিকেট-বল।

পিন্টু বোকার মতো হাসল। বাগচি, দরাজ গলায় ‘হাঃ হাঃ’ করে উঠতেই বিষ্ণু কটমট করে তার ভক্তের দিকে তাকাল। বাগচি হেসে বললেন, ‘আরে, প্যাকেটটা গেল কোথায়? আচ্ছা, ততক্ষণ তুই এটা ধর তো। আমি দেখি।’

এক ঝটকায় পিন্টুর কাছ থেকে বলটা ছিনিয়ে নিয়ে বিষ্ণু বলল, ‘বাবা, আমি আর…’

বাগচি বললেন, ‘ও ব্যাপারে পরে কথা হবে। এখন আমি কমিটি মিটিঙে যাচ্ছি।…এই নে পিন্টু।’ ততক্ষণে হারানো টফির মোড়ক পাওয়া যাচ্ছে।

একটু পরের ঘটনা। কমিটি-রুমের উত্তেজনা একটু কমেছে। দু-একজন কিন্তু এখনও বাগচির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন।

তিনতলার মৈত্র বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম, মি. বাগচি। আপনি বলছেন এটা একটা দৈব-দুর্বিপাক। রেয়ার ঘটনা। প্রত্যেক দিন ঘটার নয়।’

বাগচি বললেন, ‘গত দুশো বছরে, মানে দুই শতাব্দীতে এই প্রথম। 1845 সাল থেকে এশিয়াটিক সোসাইটিতে যা রেকর্ড আমরা পাচ্ছি, তার মধ্যে এ-রকম প্রবল চৌম্বক ঝড়ের উল্লেখ নেই।’

মৈত্র তবু তর্ক করে যান, ‘দুশো বছরে হয়নি। মানলাম। কিন্তু আবার যে হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আপনি দেবেন?’

ইতিমধ্যে সিকিউরিটি থেকে খবর এসে গেছে যে, ছেলেদের টিমকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বাগচির অনুমানই ঠিক। বলয়ের ফাটল আবার জুড়ে গেছে।

হাসি-হাসি মুখে বাগচি বললেন, ‘দেখুন, বেঁচে থাকতে গেলে কিছু-কিছু ঝুঁকি নিয়ে আমাদের চলতেই হয়। মনে করুন, এটাও সেরকম।’

বাকিরা সমস্বরে বললেন, ‘যা বলেছেন?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *