পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

অদৃশ্য বন্ধু

অদৃশ্য বন্ধু

ফটিক এর মনটা ভালো নেই। একা চুপচাপ বিলের ধারে বসে আছে। স্কুলের সেরা ছাত্র ফটিক। ওরা খুব গরিব, ওর বাবা গদাধর নিরীহ ভালো মানুষ। গদাধরের এককালে ভালো অবস্থা ছিল। পাকা বাড়ি—ওদিকে সেরেস্তাঘর, নাটমন্দির, দুর্গামণ্ডপ, বেশ কিছু ধানজমি, বাগান, পুকুর সবই ছিল! তখন নামডাকও ছিল গদাধর ঘোষের বাবার।

কিন্তু বাবা মারা যাবার পর গদাধরকে ভালোমানুষ পেয়ে ওর জ্ঞাতি ভাই হরিশবাবুই ক্রমশ মিথ্যা দেনার দায়ে ওদের জমি জায়গা, বাগান, পুকুর মায় জমিদারির দুটো মহলও সেই দখল করে নিল।

গদাধরবাবুও কোর্টঘর করেছিল, কিন্তু হরিশ ঘোষ অতি ধুরন্ধর লোক। সে কাগজপত্র এভাবে কৌশলে তৈরি করিয়েছে যে সেখানে আইনের কোনো ফাঁকই ছিল না। আর পয়সার জোর হরিশের বেশি, এ অঞ্চলের বহু লোকের প্রচুর বিষয় আশয় ছলে-বলে-কৌশলে জবরদখল করেছে, তার পোষা লাঠিয়াল গুণ্ডার দলও আছে।

গুণ্ডার দলের সর্দার নীরু ঘোষ এ অঞ্চলের ত্রাস। কত লোককে সে খুন করেছে তার সীমা সংখ্যা নেই। তার দলবলকেও সবাই ভয় করে।

এ হেন হরিশবাবুই তাই সব মামলাতেই জেতে। শহরের সব চেয়ে নামীদামি উকিলদের সে কিনে রেখেছে। তারা ওর টাকার জোরে সত্যকে আইনের নানা ফাঁক দিয়ে মিথ্যে করে তোলে। আর জয়ী হয় হরিশবাবুই।

আজ হরিশবাবুই এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি ধনী, প্রতিপত্তিশালী লোক। সারা এলাকার মানুষের সর্বস্ব লুট করে সে ধনী হয়েছে।

ফটিকদের আজ সব নিয়েছে সে। ফলে ফটিকদের সেই চকমিলানো বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত প্রায়। কাছাড়ি বাড়িতে লোকজন নেই, নাটমন্দির ধসে পড়েছে। কোনোমতে বিগ্রহের পূজাটুকুই হয় ।

গদাধর ঘোষ, এককালের সেই অর্থবান সৎ মানুষটি, আজ বাজারে নটবর দত্তের গদিতে হিসাব-এর খাতা লেখে, মুহুরিগিরি করে যা পায় তাতে কোনোমতে কষ্টে সৃষ্টে সংসার চালায় ।

ফটিক তখন ছোট ছিল—সবটা বুঝতে না পারলেও দেখেছে তার খাবার দুধের বরাদ্দ কমতে কমতে উঠে গেল। তখন পুকুরের মাছ ধরা হত, তার মনে পড়ে তাজা রুইমাছগুলো উঠোনে লাফাত, মাছ খেতে ভালোবাসে ফটিক। তখন পাতে মাছের অভাব হত না, ক্ৰমশ পুকুরগুলোও হরিশ ঘোষ দখল করে নিতে মাছও আর জোটে না।

এখন কালেভদ্রে চিংড়ি না হয় পুঁটি মাছ বাবা আনে। বাজার থেকে। ফটিক আগে ঝোঁক ধরত।

– মাছের মুড়ো কই? দুধ নাই ?

ওর মায়ের চোখে জল নামত। ওর মা দেখেছে তাদের সংসারের প্রাচুর্য। নিজেরা দুধ মাছ খেয়ে শেষ করতে পারত না, পাড়ার লোককে বিলাত । এখন নিজেদের তো দূরের কথা, একটা ছেলেকেও এতটুকু দুধ মাছ দিতে পারে না ।

ওদের বাগানে ছিল রকমারি কলমের আমগাছ, বোম্বাই, হিমসাগর, ল্যাংড়া, পেয়ারাফুলি, ফজলি সব জাতের আমগাছ লাগিয়েছিলেন গদাধরের বাবা, তাছাড়া হত পেয়ারা, সবেদা, লিচু, কাঁঠাল, নারকেল নানা ফল।

সেই সাজানো বাগানটাকেও আটকাতে পারেনি। বাগানের আমগাছে সেবার প্রচুর আম ফলেছে, বোম্বাই আম পাকছে, রং ধরেছে মধুর মিষ্টি আর রসাল হিমসাগরে, লিচুগুলোর সবুজ পাতায় ছেয়ে এসেছে সিন্দুরের মত লাল আভা, ফটিক বাগানে এসেছে বাবার সঙ্গে, আম পাড়া হবে। বাগানে খুশিভরে ছুটছে ফটিক। কলমের গাছগুলো ফলভারে নুইয়ে পড়েছে, হাতে করে নীচে থেকে পাকা টুকটুকে আম পাড়া যায় ৷

হঠাৎ কাদের চিৎকার আর গর্জনে চাইল ।

হরিশ ঘোষ এসেছে সঙ্গে সেই নীরু সর্দার। ইয়া গোঁফ, চোখদুটো লাল, মাথায় একরাশ ঝাঁকড়া চুল লাল ফিতে দিয়ে বেঁধেছে। হাতে একটা রুপো বাঁধানো লাঠি। সঙ্গে আর দু’চারজন শাকরেদ আছে।

হরিশ ঘোষ বলে—গদাধর কোর্টের ডিক্রি পেয়েছি, এ বাগান আমার ! দখল নিতে এসেছি। গদাধর চমকে ওঠে—সে কি! মামলার শুনানিই হয়নি, রায় পেয়ে গেলে। বিচার হয়ে গেল এর মধ্যে? এ আমার বাগান, তোমার দলিল মিথ্যে।

ফটিক চিৎকার করে ওঠে।

হরিশের ইঙ্গিতে নীরু সর্দার তার বাবার উপর লাফ দিয়ে পড়েছে, লাঠির আঘাতে ছিটকে পড়ে তার বাবা, কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছে। ফটিক বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদে কেঁদে ওঠে—আমার বাবাকে মেরো না!

ছোট দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে বাবাকে ।

গর্জাচ্ছে নীরু সর্দার-মারবে না? বেরোও বাগান থেকে!

হরিশের লোক বাগানের সদ্যপাকা আম লিচুগুলোকে পাড়ছে। নারকেল পাড়ছে ধুপ ধাপ করে, কাঁঠাল গাছে হানা দিয়েছে।

ফটিক বাধা দিতে যায় ।

ধমকে ওঠে হরিশ, এটাকেও দু’ঘা দে! আবার আম নেওয়া হয়েছে। কেড়ে নে।

ওর হাতের দুটো পাকা আমও কেড়ে নেয় তারা। ধাক্কা দিয়ে ফটিককেও ছিটকে ফেলেছে। ওদের চোখের সামনে ওই হরিশ কৌশলে আর জোর করে বাগানটাও কেড়ে নিল। সেদিনের কথা ফটিক ভোলেনি।

তারপর থেকেই তাদের সংসারে এসেছে কঠিন দুঃখ আর অভাবের ছায়া।

দেখেছে ফটিক কাছাড়ি বাড়ি নিঝুম হয়ে গেল, লোকজন গোমস্তা, কাজের লোক দারোয়ানরাও চলে গেল। মায়ের চোখে জল দেখেছে। দেখেছে, বাবার মত হাসিখুশি লোকটা কেমন বদলে গেল। খাবার সময় মায়ের চোখেও জল আসত।

দুধ নেই, মাছ নেই, লাল মোটা চালের ভাত, একটু আলু বড়ির ঝোল, সঙ্গে খামারবাড়িতে গজানো কচুশাক, না হয় বুনো ডুমুরের ছেঁচকি।

ছোটবোন রূপা মাঝে মাঝে বায়না ধরত।

—মাছ নেই, দুধ নেই, জামাগুলো ছিঁড়ে গেছে। লতু সোনাদের কেমন সুন্দর জামা আছে। আমার নেই কেন ?

মায়ের চোখে জল নামে।

ফটিক তখন সবে স্কুলে যাচ্ছে। ফটিক বুঝতে পারে তাদের সংসারের অবস্থাটা। বাবা এখন নটবর দত্তের গদিতে কাজ করতে যায় ময়লা কাপড় জামা পরে।

বোনকে ফটিক বলে আড়ালে, আমরা গরীব হয়ে গেছি রে, এখন ওই পর। আমি বড় হলে তোকে নতুন জামা কিনে দেব।

দাদা ।

রূপা খুশি হয়। ডাগর চোখ মেলে বলে—ঠিক তো! তাহলে তাড়াতাড়ি তুই বড় হয়ে যা

ফটিক বোনের বোকামিতে হাসে।

—পাগলি! বড় হতে সময় লাগবে তো। তবে এবার প্রাইমারিতে দেখবি বৃত্তি পাব। পণ্ডিতমশাই বলেছেন। ফার্স্ট হবই রে। সেই বৃত্তির টাকায় তোকে নতুন জামা কিনে দেব । রূপা খুশি হয়, ঠিক তো?

ফটিক পড়াশোনাতে খুবই ভালো। সেবার মহকুমার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিল। দশটাকা করে বৃত্তিও পেয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হয় ।

হেডমাস্টারমশায় নিজে বলেন—জীবনে সবেতেই ফার্স্ট হতেই হবে ফটিক।

ফটিক তখন থেকেই স্কুলের সেরা ছাত্র। তারপর নতুন হেডমাস্টারমশাই এলেন। তিনি খুব হাঁকডাক করেন স্কুলে।

সেইবার থেকেই হরিশবাবুর ছেলে বসন্তও তাদের ক্লাসে ভর্তি হল। হরিশ ঘোষ এখন স্কুলের প্রেসিডেন্ট হয়েছে। তার ছেলের জন্য সকাল বিকাল দুটো তিনটে মোট পাঁচজন টিউটর রাখা হয়েছে। স্কুলেও তার জন্য আলাদা বেঞ্চ। ফটিক ছিল ফার্স্ট বয়। সব সাবজেক্টেই সে প্রথম হত, তারপর ছিল শৈলেন। দুজনেরই পাল্লা চলত। কিন্তু এবার এসে হাজির হয়েছে

বসন্ত।

মাস্টারমশাইদের নজর তার উপর। চাকর তার বই নিয়ে আসে। বসন্ত দামি র‍্যালে সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসে। টিফিনের সময় ফটিকের খাওয়া তো কিছু জোটে না। অনেকেরই সেই অবস্থা।

ওদিকে কৌটোয় সন্দেশ, লুচি-ফ্লাস্কে দুধ সব আসে বসন্তর জন্য, এরা চেয়ে চেয়ে

দেখে।

এ হেন বসন্ত অঙ্ক আর ইতিহাসে হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট হয়ে গেল। সেকেন্ড হল ফটিক। অবাক হয় ফটিক।

সে সব অঙ্কের ঠিক উত্তর মিলিয়েছে। ইতিহাসের সব প্রশ্নও ভালো লিখেছে। কিন্তু কি যেন হয়ে গেল ।

প্রথম আঘাতে তার চোখ দিয়ে জল নামে। তার স্কলারশিপ, বৃত্তি সব চলে যাবে।

সেকেন্ড টিচার সন্তোষবাবুও দেখেছেন ব্যাপারটা। ফটিককে তিনিও খুব ভালোবাসেন।

ইংরেজি পড়ান ক্লাসে, স্বাধীনচেতা যুবক। তিনি বলেন, এতেই মুষড়ে পড়বি না ফটিক। তুই পড়াশুনা যেমন করছিস কর। আমার কাছেও পড়তে আয়। তুই ফার্স্ট হবিই।

ফটিক-এর দু’চোখে জল নামে।

বলে সে, স্কলারশিপ, বৃত্তির টাকা চলে গেলে পড়া হবে না স্যার।

সন্তোষবাবু বলেন— পাগল এসব ভাবছিস কেন?

গেমটিচার গজেনবাবুও ফটিককে খুব ভালোবাসেন। ফটিক শুধু পড়াশুনাতেই নয় খেলাধূলাতেও স্কুলের সেরা। ফুটবল মাঠে ফটিক একাই একশো। ক্রিকেট টিমও শুরু হয়েছে। টাউন ক্লাবের হয়ে জুনিয়ার টিমে খেলে সে। বলও ভালো করে, ব্যাটও সমান চলে তার। তার জন্যই স্কুলের টিম এখানের বহু ট্রফি জেতে। গজেনবাবু তাই ফটিককে ভালোবাসেন। বলেন তিনি—খেলায় হার জিত আছে ফটিক। তাই বলে ভেঙে পড়লে চলবে না। লাইফ ইজ এ স্পোর্টস। এখানে খেলার মালিক তুই, খেলে যাবি প্রাণ দিয়ে, দেখবি জয় একদিন হবেই ।

ফটিক এই আঘাতটা মেনে নিয়ে নতুন উদ্যমে পড়তে শুরু করে ।

বাড়িতে ওর বাবাও শুনেছে খবরটা। গদাধরবাবু বলে,—মন দিয়ে পড়। ফার্স্ট তুই হবিই। ওর মা বলে,—ফটিক ফার্স্ট হতই, শুনলাম শৈলেনের মা বলছিল হরিশবাবুই নাকি মাস্টারদের বলেছে বসন্তকে ফার্স্ট করতে।

গদাধর জীবনে বহু কিছু হারিয়েছে। সব বিষয় আশায় হারিয়ে পথের ভিখারি হয়ে গেছে। তবু বিশ্বাসটুকু হারাতে চায় না সে। বলে গদাধর,—না, না। বিদ্যামন্দির। সেখানে এমন অপবিত্র কার্য হতে পারে না ফটিকের মা। হয়তো বসন্ত ভালো পরীক্ষা দিয়েছে।

ফটিকের মা সুধাময়ী দেবী স্বামীর কথাটাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। ভাবে হয়তো তাই হবে। তবু তার মনের সন্দেহ যায় না। ফটিকও কথাটা শুনেছিল স্কুলে।

শৈলেন, রবি আরও দু একজন বলে—নৃপতিস্যার বসন্তকে অঙ্ক শেখান। ও কে সব অঙ্ক, জিওমেট্রির প্রবলেম, থিওরেম, মায় করোলারী অবধি বলে দিয়েছিলেন। ক্লাসের বোর্ডে সাধারণ সরলই কষতে পারে না, সে হবে ফার্স্ট। ইতিহাসের গোবিন্দ স্যারও ওকে পড়ান ৷ না হলে হুমায়ুনের বাবার নাম জানে না, রোমের সম্রাটের নাম বলতে পারে না সে হল ফার্স্ট। কই—ইংরেজিতে তো সন্তোষ স্যারের হাতে পেয়েছে মাত্র বিয়াল্লিশ, ওকে কায়দা করতে পারে নি।

ফটিক চুপ করে থাকে।

মনে পড়ে, হরিশবাবুর সেই বাগান পুকুর দখল নেবার দৃশ্যটা। তার বাবাকে লাঠির ঘায়ে আহত করে তাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে ওরা বাগান কেড়ে নিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছে তাদের সবকিছু। বাবাকে পথের ভিখারির মত অবস্থা করেছে। আজ ফটিক নিজের পরিশ্রম, চেষ্টায় আর ঈশ্বরের আশীর্বাদে স্কুলে ফার্স্ট হয়ে চলেছে। ভালোবাসা, সুনাম পেয়েছে। সেখানেও এবার হাত বাড়িয়েছে হরিশবাবু। তার ছেলেকেই ফার্স্ট করাতে হবে। তার জন্য হয়তো এইসব পথই নিয়েছে।

ফটিকের মনে পড়ে সন্তোষস্যার, গজেনবাবুর কথা। জীবনে এত সহজে সে ভেঙে পড়বে না। পড়াশোনায় আরও মন দেয়।

স্কুলের টিম এবার ফাইনালে উঠেছে।

ফটিকের ক’দিন জলে ভিজে জ্বর মত হয়েছিল। সামনে ফাইন্যাল খেলা। ফটিক সেরে উঠে স্কুলে এসে চমকে ওঠে।

বোর্ডে ফাইন্যালের টিম সিলেকশন হয়ে গেছে।

ফটিক খেলে সেন্টার পজিশনে। রাইট এ-ও খেলে। কিন্তু এবারে তার নামের বদলে

বসেছে নতুন নাম। বসন্ত ঘোষ।

এখানেও সেই বসন্ত। ফটিককে ওরা খেলার জগৎ থেকেও যেন সরিয়ে দিতে চায়। খবর নিয়ে, জানতে পারে গজেন স্যার নেই, বি-এড পরীক্ষা দিতে চলে গেছেন, এখন গোবিন্দস্যারই স্কুলের গেম টিচার-এর কার্য দেখছেন।

ফটিক তার কাছেই গেছে।

গোবিন্দস্যার হরিশবাবুর বৈঠকখানাতে রোজ সকালে যায়, আরও অনেকে যায় ওখানে, নৃপতিস্যার নতুন হেডমাস্টার ত্রিদিববাবু তো ওরই লোক। সেখানে স্কুলের নানা বিষয়ে ও আলোচনা হয়। খেলার ব্যাপারেও ফাইন্যাল হয়েছে সেখানে।

গোবিন্দবাবু ফটিককে দেখে চাইল।

গম্ভীরস্বরে বলে, কি চাই ?

ফটিক বলে ভয়ে ভয়ে, এবার ফাইন্যাল খেলায় আমার নাম দেখলাম না স্যার। ফটিকের কথায় গোবিন্দবাবু ধমকে ওঠে।

-তার জন্য তোর কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে? চুপ করে যায় ফটিক। কোনোমতে জানায় সে,—এতদিন স্কুলের সব খেলাতেই খেলেছি। ট্রফিও এনেছি।

গোবিন্দবাবু বলে, তোর চেয়ে ভালো প্লেয়ার পেলে তাকেই খেলাবে কমিটি। যা তো। ভারি আমার প্লেয়ার রে। হাওয়ায় উড়ছে পুঁটি মাছের মত জিলজিলে চেহারা নিয়ে। ফুটবল খেলবে।

ফটিক বের হয়ে এল। দু’চোখ তার জলে ভরে আসে।

বাইরে টিমের ক্যাপটেন ভূতনাথ, রমাই, হলধর সকলেই অপেক্ষা করছিল। তারাও শুনেছে গোবিন্দস্যারের কথাগুলো। ওরাও এবার বুঝেছে খেলা কি হবে।

ভূতনাথ বলে, দাঁড়িয়ে হারব। ওখানে কেউ খাতির করবে হরিশবাবুর ছেলে বলে। ফটিক চুপ করে থাকে ।

লজ্জায় অপমানে তার দু’চোখে জল নামে। আজ সারা স্কুলের ছেলেদের সামনে, পাড়ার সকলের চোখে ফটিক যেন হেয় প্রতিপন্ন হয়ে গেছে। ওই হরিশ ঘোষ তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েও খুশি হয়নি। আজ ফটিকের কিশোরমনেও নিষ্ঠুর আঘাত হেনেছে। এবার শেষ করে দেবে তাকে।

বৈকালে বাড়ি ফিরেছে।

সুধাময়ী ছেলের দিকে চেয়ে বুঝতে পারে তার বেদনাটা। শুধোয় সে–কি হয়েছে রে ফটিক?

ফটিক কান্নায় ভেঙে পড়ে। আজ পড়ার ব্যাপারও নয়, খেলার ব্যাপারেও তার সব খ্যাতি প্রতিষ্ঠাকে কেড়ে নিয়েছে। হরিশবাবু ষড়যন্ত্র করেছে। তার টাকা আছে। তাই সেসব পাবার অধিকার আছে তার ছেলেরই।

সুধাময়ীও ছেলের দুঃখে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে—দুঃখ করিসনি বাবা। নিজে নিজে চেষ্টা কর। ভগবান একদিন নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন। এত সব কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারি করেছে ও, তবু বেঁচে আছি বাবা। সব সয়েছি। তোর মনেও এসব সইবার ক্ষমতা ভগবানই দেবেন। আমরা গরিব, গরিবের মতই থাকব। কাজ কি ওসবে।

ফটিক আজ খেলার মাঠেও যায়নি। সেখানে আজ ফাইন্যাল সিলেকশনের প্লেয়াররা খেলছে। এর মধ্যে মাঠে সাড়া পড়ে গেছে। হরিশবাবু নিজে মাঠে যাবেন। তার ছেলে বসন্ত ও খেলবে আজ। ওই আনন্দ অনুষ্ঠানে আজ ফটিকের আমন্ত্রণ নেই ।

বৈকালে একা একা এসে বসেছে ফটিক বিলের ধারে। এদিকটা এখনও নির্জন।

এককালে নদীর গতিপথই বোধ হয় এদিকে ছিল। এখন নদী সরে গেছে অন্যদিকে। এখন এই অর্ধচন্দ্রাকারে বিস্তৃত দেহটা রয়ে গেছে। জেলেরা মাছ টাছ ধরে।

এই জলার ধারে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে শিমুল, তেঁতুল, বট, অশ্বত্থ, পিটুলি গাছের ঘন বন গজিয়ে উঠেছে। দু’চারটে আম গাছে লতার বেষ্টনি। জায়গাটার এদিকে এ সময় কেউ একটা আসে না। বলে এখানে নাকি অপদেবতার রাজ্য। মাঝে মাঝে অনেকেই রাত্রির অন্ধকারে আলো দেখেছে, কিসের শব্দ শুনেছে। এই ঠাঁইটাকে তারা এড়িয়ে চলে বৈকালের পর থেকেই ।

ফটিক একাই বসে আছে।

মাঠে এখন পুরোদমে খেলার আনন্দ কলরব চলেছে।

হঠাৎ ফটিক চমকে ওঠে। বনের ওদিকে একটা ঘূর্ণিঝড় উঠেছে। গাছ-গাছালির মাথাগুলো ঝড়ে আলোড়ন তোলে, একটা ধোঁয়ার মত কি যেন ওই ঝড়ের মাঝ দিয়ে চলে গেল, শোঁ শোঁ শব্দ করে।

ঝিলের জলে ঢেউ ওঠে।

সারা জায়গাটা যেন সেই ঝড়ের বেগে মেতে উঠেছে। ভয় হয় ফটিকের। পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেছে। উজ্জ্বল একটা আলোর বিন্দু যেন ওই বনের মাথায় স্থির হয়ে আবার হারিয়ে গেল।

ঝড়ও থেমে আসে। আকাশে দু চারটে তারা দেখা যায়। শান্তি নামে বনে, ঝিলের জলে। কি যেন দেখছে সে, বিচিত্র একটা দৃশ্যকে। মনে হয় স্বপ্নই। কেন না সেই তাণ্ডবের কোনো চিহ্নই আর নেই।

ফিরে যাবে ফটিক। হঠাৎ কার ডাক শুনে চাইল-ফটিক।

ফটিক এদিকে ওদিকে চাইল। হয়তো তার কোনো বন্ধুই এসেছে এখানে তার সন্ধানে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না। আবার যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে। সেই ডাক শুনে চমকে ওঠে।

একটা নীলাভ মূর্তি তার সামনে ফুটে ওঠে। মাথাটা চকচক করছে। চুল নেই, কানের বদলে ছোট দুটো শুঁড় যেন উপরে তোলা। মুখচোখগুলো দেখা যায়, পা হাত দুটো ঠিক মানুষের মত নয়। যেন কোনো ধাতুরই, শক্ত আর চক চক করছে ওর কপালের মৃদু আলোর দীপ্তিতে।

ফটিক দেখছে তাকে। শুধোয় ফটিক,—কে তুমি? তোমাকে আমি চিনি না, তুমি আমাকে চিনলে কি করে? নামই বা জানলে কেমন করে?

মূর্তিটা হাসে।

ওর চোখদুটোয় মৃদু দীপ্তি ফুটে ওঠে। মাথার শুঁড় দুটো নড়ছে। বাতাসে যেন কিসের সন্ধান করছে ওর শুঁড় দুটো।

বলে মূর্তিটা—আমরা সব বুঝতে পারি, জানতে পারি। তোমাকে জোর করে সেকেন্ড করে দিয়েছে, টিম থেকে বের করে দিয়েছে ওই হরিশবাবুরা, না?

চাইল ফটিক। অবাক হয় সে।

-তুমি জানলে কি করে? কোথায় থাক তুমি ?

হাসে সেই প্রাণীটি। বলে সে—তুমি খুব ভালো ছেলে। তোমার দুঃখে হঠাৎ এখানে এসে

পড়লাম।

তোমার বাড়ি কোথায়? ফটিক শুধোয়।

বলে সে-তোমাকে এর আগে কখনও দেখিনি।

মূর্তিটি বলে, কাউকে বলো না, আমার দেশ ওই দূর আকাশের কোনো এক নক্ষত্রলোকে। মানুষ এখনও মহাকাশ যান পাঠিয়ে আমাদের নক্ষত্রের কোনো সন্ধান পায়নি। আমরা আমাদের মহাকাশ যানে করে তোমাদের পৃথিবীতে আসি। সব খবরই রাখি। আমাকে সিরিন বলেই ডাকতে পারো ।

ফটিক এর আগে লাইব্রেরিতে দু’ একটা বই পড়েছে মহাকাশ সম্বন্ধে । পৃথিবীর জানা চেনা গ্রহমণ্ডল ছাড়াও মহাকাশ জগতে বহু লক্ষ নক্ষত্র গ্রহ আছে। তাদের সকলের আলো এখনও অবধি পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়নি। মানুষও মহাকাশ যান পাঠিয়ে সন্ধান করছে। আজ সেই দূর অচেনা গ্রহের কোনো মানুষকে তার সামনে দেখে অবাক হয়েছে ফটিক। সিরিন বলে,খুব অবাক হয়েছ না? ভয় পাওনি তো!

ফটিক মাথা নাড়ে।

সিরিন বলে,—আমাকে বন্ধু বলেই জানবে।

ফটিক শুধোয়,—কিন্তু এখানে থাকবে কোথায় ?

হাসে সিরিন। নিমেষের মধ্যে আবার তাকে দেখাও যায় না। কেউ নেই। ফটিক চমকে ওঠে। তাহলে সে কি ভূতটুতই দেখেছিল। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে।

হঠাৎ তার সামনে দেখা যায় সিরিনকে। হাসছে। সে বলে,– আমাদের এখানে থাকার কোনো সমস্যাই নেই। তোমাদের পৃথিবীর মূল উপাদান ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম। অর্থাৎ মাটি জল আলো বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চভূত। মানুষ মরে গেলে তার দেহটা এই পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায়। আর ফেরে না। আমরা ইচ্ছে করলেই পঞ্চভূতে মিলিয়ে যেতে পারি আবার যে কোনো রূপই নিতে পারি ইচ্ছামত। সুতরাং থাকার কোনো সমস্যা আমাদের নেই। ইচ্ছা করলে তোমাকেও অদৃশ্য করে দিতে পারি, আবার ফিরিয়ে আনতে পারি এই রূপে

ফটিক ঘাবড়ে গেছে।

বলে সে—ওসবে কাজ নেই ।

ফটিক বলে—সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ি যেতে হবে। আজ চলি। আবার দেখা হবে তো?

সিরিন বলে,—নিশ্চয়ই। আমার নাম ধরে তিনবার ডাকবে তাহলেই আমি এসে যাব । দুজনে আসছে। ফটিকের সন্দেহ হয়, ভয়ও হয়, ওই রকম বিচিত্র দর্শন একটি সঙ্গীকে দেখলে শহরের অনেকেই সন্দেহ করবে। আর সত্যিই যে সিরিন মহাকাশের কোনো নক্ষত্রবাসী না আর কেউ তাও জানে না সে।

ফটিক ফিরছে বাড়ির দিকে। সামনে গিরিধারীর চায়ের দোকান ।

অবাক হয় ফটিক, সিরিনকে না দেখে ।

এখন একাই ফিরছে সে বাড়ির দিকে।

তাদের বাড়িটার বাইরের দিকের কাছারি ঘরগুলোর বারান্দা এখন মেরামত অভাবে জীর্ণ হয়ে গেছে। লোকজন কেউ থাকে না।

বাড়ি ঢুকেছে, সামনেই সিরিনকে দেখে চাইল।

—— তুমি !

সিরিন বলে—তোমাদের বাড়িটা তো বিরাট, এখন ধসে পড়েছে। ত এখানেই থাকা যাবে । খুশি হয় ফটিক। বলে, বেশ তো, থাকো। হঠাৎ মাকে দেখে চাইল ফটিক।

ছোটবোন রূপাও রয়েছে। মা বলে—কার সঙ্গে কথা বলছিলিরে ?

চমকে ওঠে ফটিক—মা বোধহয় সিরিনের খবর জেনে গেছে। কিন্তু দেখে ফটিক সিরিন এর কোনো চিহ্নই আর নেই। ফটিকও ওসব কথা মাকে জানাতে চায় না। বসে সে, কই কার সঙ্গে কথা বলব? ও, তুমি ভুল শুনেছ মা।

সুধাময়ী চুপ করে যায়। ওসব কথা না তুলে বলে,–এত দেরি অবধি বাইরে থাকিস না, তাই ভাবছিলাম বাবা

ফটিক বলে,–গোলস্যারের ওখানে গেছিলাম মা। চলো।

ফটিকের ঘরটা আলাদা। একটা খাট রয়েছে। সেকালের খাট। দুটো চেয়ার টেবিলও রয়েছে। ফটিক হাতমুখ ধুয়ে ঠাকুর প্রণাম করে এসে পড়তে বসে।

বাবাও দোকান থেকে ফিরেছে। রূপা এর মধ্যে শুধোয়—এবার তুই নাকি ফাইন্যালে খেলবি না দাদা?

রূপা ওর দাদার খুব ভক্ত। সেও শুনেছে কথাটা। ফটিক এতক্ষণ ওসব ভুলেছিল সিরিনকে নিয়ে। এবার মনে পড়ে খেলার কথাটা। বলে সে।

—না রে। যাঃ অঙ্কগুলো শেষ করি।

রূপা চলে যেতে ফটিক অঙ্ক নিয়ে বসেছে। আলজেবরার কঠিন অঙ্ক সহজে মাথায় ঢোকে না। আর নৃপতিস্যার এবার ট্রিগনমেট্রিও পড়াচ্ছে। কস্ আলফা কবিটা—এসব তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে।

প্রাইভেট টিউটর রাখার সামর্থ্যও তার বাবার নেই।

এবার যেন সত্যিই হেরে যাবে ফটিক ।

হঠাৎ সামনে সিরিনকে দেখে চাইল। সিরিন বলে,—ওমা, এত সোজা সোজা অঙ্ক কষো তোমরা?

ফটিক চটে ওঠে। বলে সে–যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো না সিরিন। পারবে এসব কষতে? দারুণ কঠিন ।

হাসল সিরিন। বলে সে—এবার দ্যাখো, তোমার কাছেও এসব জলবৎ তরল হয়ে যাবে। চমকে ওঠে ফটিক—সিরিনের মাথার শুঁড় দুটো শূন্যে ঘুরছে। ওর গা থেকে মৃদু নীলাভ জ্যোতি বের হয়। ফটিকের মাথার জটগুলো যেন খুলে যাচ্ছে।

ওই দারুণ কঠিন অঙ্কগুলোর মূলতত্ত্ব সে জেনে ফেলেছে। চটপট করে নিজেই এবার ট্রিগনমেট্রির সেই চ্যাপ্টারের সব অঙ্ক কষে ফেলেছে।

জিওমেট্রির দুরূহ থিয়োরেম-এর মূলতত্ত্বটা তার কাছে সহজ হয়ে ওঠে।

—খেতে আয়। মায়ের ডাকে ফটিক চাইল।

তন্ময় হয়ে অঙ্ক কষছিল তৃপ্তিতে। রাত্রি হয়ে গেছে। মায়ের কথায় ফটিকের মনে পড়ে সিরিনের কথা। সত্যিই তার বন্ধু সিরিন।

ফটিক বলে মাকে-খাবারটা রেখে দাও মা, এগুলো শেষ করেই খেয়ে শুয়ে পড়ব। খিদে বেশি লেগেছে মা—দুখানা রুটি বেশি দিও ।

মা বলে—ঠিক আছে। তবে বেশি রাত্রি জাগিস না বাবা।

খাবার বলতে কয়েকখানা রুটি, কুমড়ো আলুর তরকারি আর একটু গুড়। আগে রুটি খেত না সে। ভাত ভাজাভুজি, মাছের তরকারি, দুধ সন্দেশ বাগানের পাকাকলা এসবই খেত। এখন এই জোটাতে বাবাকে কি পরিশ্রম করতে হয় তা জানে ফটিক। ডালও সব দিন জোটে না। ডালের দাম নাকি অনেক ।

রাত্রি হয়ে গেছে। ফটিক হাতমুখ ধুয়ে খাবারটা বের করে ডাক দেয়—সিরিন—

দুবার ডাকতেই দেখা যায় সিরিনকে সত্যি সত্যি। ইট কাঠের বেড়া তাকে আটকাতে পারেনি। এসে পড়েছে সে।

ফটিক বলে,–এসো খেয়ে নাও।

সিরিন দেখছে খাবারগুলোকে। ফটিকের মনে হয় বোধহয় এ খাবার সিরিনের পছন্দ হয়নি। বলে ফটিক।

—আমরা খুবই গরিব সিরিন। আমাদের সবকিছু জমি বাগান জমিদারি সব হরিশবাবু কেড়ে নিয়েছে মিথ্যা মামলা করে—ভুয়ো কাগজপত্র দেখিয়ে। এ ছাড়া আর কিছুই খেতে পাই না আমরা। এসব খাবে না?

সিরিন দেখছে ওকে। বলে সে—কেন খাবো না? বসছি।

দুজনে ওই ক’খানা রুটি তরকারি ভাগ করে খায় বন্ধুর মতোই। দুটি ভিন গ্রহের জীব, তবু অদৃশ্য এক প্রীতির বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। ভালোবাসা প্রীতির সীমানা বোধহয় কোনো গ্রহের প্রভাব পার হয়ে সারা ব্রহ্মাণ্ড—বিশ্ব চরাচরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তার কোনো দেশ বা কাল এর সীমারেখার বন্ধন নেই।

নৃপতিস্যার বসন্তকে ফার্স্ট করেছে। কিন্তু ফটিকই ভালো ছেলে। এরকম কথা ওঠে। একমুখ থেকে অন্যমুখে ছড়ায় ।

হরিশবাবুর ওখানে ইদানীং যাতায়াত করে নৃপতিবাবুও, হরিশ ঘোষ ছোট শহরের আজ নামকরা লোক। বিরাট সম্পত্তি, বাগান, পুকুর বড় বড় দীঘিতে তার লাখ টাকার মাছের ব্যবসা চলে। ফার্ম ফলের বাগানের সরেস জাতের আম কলকাতা ছাড়িয়ে প্লেনে বিলেতেও চালান যায়। শহরের একদিকে বিরাট জুট মিল গড়েছে, তাছাড়া লোহা সিমেন্টের বড় ব্যবসা ফেঁদেছে। গ্রাম আজ শহর হচ্ছে, তেমনি হরিশ ঘোষও ফুলছে।

নৃপতিবাবু কৌশলে বসন্তকে অঙ্কে ফার্স্ট করিয়েছে, হরিশবাবু চতুর লোক। তার ইঙ্গিতেই এসব হয়েছে, অথচ সেই কড়া স্বরে বলে,– এসব কথা শোনাও অন্যায়। এর বিহিত দরকার।

নৃপতিস্যার হেডমাস্টার ত্রিদিববাবুকে বলেন—একদিন ক্লাসের বোর্ডে নিজে দেখুন গিয়ে কে ভালো অঙ্ক কযতে পারে? ওই ফটকে না বসন্ত? সর্বজনসমক্ষে সেই পরীক্ষা দিয়ে আজ বসন্তের প্রাধান্য দেখাতে চায় হরিশবাবুও।

ফটিক, অন্য ছেলেরা এসবের কিছুই জানে না। আজ ক্লাসে হরিশবাবু, অন্য টিচাররা হেডস্যার সকলেই এসেছে।

নৃপতিস্যার ট্রিগনমেট্রির জটিল দুটো অঙ্ক বোর্ডে দিয়ে বলে-তোমাদের কেউ এটা করতে পারবে? এনিবড়ি?

নৃপতিস্যার এই অঙ্ক দুটো কাল বসন্তকে বার বার করিয়ে মুখস্থ করিয়ে রেখেছে। তারপর এই পরীক্ষার আয়োজন হয়েছে। ক্লাসে সবাই নীরব। জটিল অঙ্ক। নৃপতিবাবু ডাকছেন—ইউ, ইউ ।

ফটিক দেখছে অঙ্ক দুটো। এ তার জানা নেই ।

হঠাৎ বোর্ডের পাশেই দেখা যায় সিরিনকে। চকচক করছে মাথাটা, শুঁড় দুটো নড়ছে। ডাকছে ফটিককে ইশারায়।

ফটিক চমকে ওঠে। কে জানে হেডস্যার অন্যরা তাকে দেখেছে কিনা। কিন্তু মনে হয়, ওকে কেউই দেখতে পায়নি। সেই আলোকতরঙ্গ ওদের দুজনের মধ্যেই বিস্তৃত ছিল আর কারোর ওকে দেখার উপায় নেই।

নৃপতিবাবু বলে—ফটিক, ব তো ফার্স্ট হও, করো অ

ফটিক উঠে বোর্ডের দিকে চলেছে। অবাক হয় সকালেই। নৃপতিতাবৃত্ত। বই ঘেঁটে হায়ার ম্যাথামেটিকস্ এর অঙ্ক দুটো বের করেছে, স্কুলের ছাত্রের পক্ষে করা অসম্ভব

কিন্তু ফটিক তখন বোর্ডে গিয়ে চটা হাতে নিয়েছে। ওর চোখের সামনে সিরিন–সেই অঙ্কের প্রতিটি স্টেপ তারই নির্দেশে লিখে চলেছে অবলীলাক্রমে। তারপর উত্তরটা সঠিক করেছে। অন্য অঙ্কটাকেও।

সন্তোষবাবুও ছিলেন। তিনি অবাক হন—সাবাস !

নৃপতিবাবু ভেবেছিল ফটিকও পারবে না। এবার সেই অঙ্ক বসন্তকে দিয়ে করিয়ে তার যে ফার্স্ট হবার যোগ্যতা আছে সেটাই প্রমাণ করবে। হরিশবাবুও এটা ভেবেছিল। কিন্তু ছেঁড়া বিবর্ণ জামা পরা ছেলেটা সব কিছু ভেস্তে দিল।

সিরিনই যেন অঙ্কটা তার মাথায় বাতলে দেয়।

বোর্ডে একটা আরও জটিল অঙ্ক লিখে ফটিক বলে নৃপতিস্যারকে—স্যার এই অঙ্কটা আমি কষতে পারিনি। এটা যদি একটু দেখিয়ে দিতেন।

এই বলে ফটিক বিনীতভাবে এসে বেঞ্চে বসলো।

এবার ঘামছে নৃপতিবাবু। জব্বর অঙ্ক। নৃপতিবাবুরও এখন হায়ার ম্যাথামেটিকস-এর চর্চা নেই। ফলে প্রায়ই ভুলে গেছেন। এদিকে হেডস্যার, হরিশবাবুরাও রয়েছে। তাদের সামনে আজ ফটিক তাকেই এমনি বিপদে ফেলবে ভাবতে পারেনি।

সারা ক্লাস স্তব্ধ, নৃপতিস্যার শুকনো মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে বলে—এটা পারিসনি? এ তো সোজা অঙ্ক রে-

ভগবান রক্ষা করেছেন। পিরিয়ড শেষ হবার ঘণ্টা পড়ে যেতে নৃপতিবাবু বলে—পরে ওটা দেখিয়ে দেব।

হরিশবাবু ব্যাপারটা বুঝে অবাক হয়। অবাক হয়েছে হেডস্যার, নৃপতিবাবুও ।

ভূতনাথ, রবি অন্যান্য সকলেই বলে, –দারুণ অঙ্ক কষেছিস ফটিক। ও ক্লাসে আর কেউ পারত না।

বসন্তের কৃতিত্ব দেখাবার অবকাশ দেয়নি ফটিক। আগেই সে অঙ্কদুটো কষে দিয়েছে। বসন্তকে তার প্রাপ্য খ্যাতি থেকে বঞ্চিত করেছে। নৃপতিবাবু নিজের জালেই নিজে জড়িয়ে পড়েছেন। আড়ালে হরিশবাবু গজগজ করে, এটা ঠিক করলে না নৃপতি! ফটিকই তো খ্যাতি কুড়িয়ে নিল। বসন্তকে সুযোগই দিল না। ছেলেটার সম্বন্ধে সাবধান থেকো মাস্টার।

নৃপতিবাবুও আজ অবাক হয়েছে। ফটিক যে এমনি অঙ্ক কষে দেবে তা ভাবেনি। বলে সে—দেখছি স্যার ওটাকে।

ফটিক তার হৃত সম্মান কিছুটা আজ ফিরে পেয়েছে। সন্তোষবাবু বলে—নিজের পড়াশুনা করে যা, দেখবি তুই ফার্স্ট হবিই ।

ফাইনাল খেলার দিন এগিয়ে আসছে।

মাঠে জোর প্র্যাকটিস চলছে। স্কুলের মান ইজ্জত নির্ভর করছে এই খেলার উপরও, এই খেলায় স্কুল জিতলে জেলার সেরা স্কুলের সম্মান পাবে। এখান থেকেই খেলোয়াড় বাছাই হতে পারে কলকাতায় জাতীয় দলে খেলার জন্য।

হরিশবাবুর ইচ্ছা বসন্ত জাতীয় দলে খেলবে। তার জন্য দু’চারজন মাতব্বরকেও আনছে নিজের খরচায়, সেইদিন। যাতে বসন্তকে তারা বাছাই করেন।

ভূতনাথ টিমের ক্যাপ্টেন, গোবিন্দবাবু এখন টিমের সর্বাধ্যক্ষ। তবু ভূতনাথ আড়ালে বলে—কি হবে বুঝছি না। বসন্তকে সব বল দিতেই হবে। আর ও তো দেখি গোলকানা। কিছুই করতে পারে না। ওদিকের ব্যাক এর তাড়ায় সরে আসে।

রবি বলে—সোজা বল গোলে মারতে গেলে গোবিন্দস্যার বলে-পাস দাও বসন্তকে। অর্থাৎ যা গোল হবে সব বসন্তই করবে, না পারলে অন্য কেউ গোলদাতা হয়ে যাক, এটা

চায় না এরা। ভূতনাথ বলে—খেলা পড়েছে জেলা স্কুলের সঙ্গে।

দারুণ মারকুটে টিম। এসবে ফটিকের বলার কিছুই নেই। সে আজ এদের টিমের যেন কেউ নয়। রবি বলে—ফটিক তুই থাকলে ভরসা পেতাম। তোকে ওদের ডিফেন্স আটকাতে পারত না ।

কিন্তু কি করবে সে। মনের দুঃখ চেপেই বলে—আমি কি করব বল? গোবিন্দস্যার হরিশবাবুরা আমাকে কোনো চান্সই দেবে না ৷

সারা মাঠটাকে সাজানো হচ্ছে। একপাশে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সকাল থেকেই আয়োজন চলছে। লাইন মার্কিং করা হচ্ছে চুন দিয়ে। গোলপোস্টে নেট টাঙানো হয়েছে। ঘোষ পাড়ার ব্যান্ড পার্টিও আসবে। আর প্রাইজগুলোও আনা হয়েছে। রুপোর কাপ হবে বেস্টম্যান প্রাইজ।

একাই ফিরছে ফটিক। বৈকালে আজ ছোট শহর জেগে উঠবে। দুপুরের বাসেই জেলা সদরের টিম, কর্মকর্তারা এসে পড়বে। হরিশবাবুর বিরাট বাড়ির এক দিকের কয়েকটি ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও চলছে। পাঁঠার মাংস, সন্দেশ এসবের ত্রুটি নেই। প্লেয়ারদেরও খাওয়ানো হবে। এত আনন্দ অনুষ্ঠানে ফটিকের কোনো ঠাঁই নেই ৷

আনমনে আসছে, হঠাৎ পাশেই দেখা যায় সিরিনকে। সিরিন বলে—খুব কষ্ট হচ্ছে, না ? খেলতে পারবে না ।

ফটিক ধরা গলায় বলে—কাউকে এই কষ্টের কথা বলিনি সিরিন। আমাকে ওই হরিশবাবুই জোর করে বসিয়ে দিল, ওর ছেলেকে বেস্টম্যান করার জন্য। ও আমাদের কেন, বহু লোকের এমনি সর্বনাশ করেছে। সৎ লোকেদের নানা লোভ দেখিয়ে অসৎ করে তুলেছে। আমারও সর্বনাশ করেছে ও। আমিই বেস্টম্যান হতাম আজ। কিন্তু—আমরা গরিব।

ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

নিস্তব্ধ পথ। বকুল গাছের ছায়া নেমেছে। সিরিন এর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। মাথায় ছোট শুঁড় দুটো নড়ছে।

বলে সে,—তুমি কিটব্যাগ, জুতো নিয়ে তৈরি হয়ে মাঠে এসো ফটিক।

ফটিক অবাক হয় সে কি? টিমে তো নাম দেয়নি।

হাসে সিরিন-না দিক্। আমি বলছি তুমি খেলবে। দেখে নিও।

ওর দিকে চেয়ে থাকে ফটিক।

কারা আসছে এদিকে। সিরিন এ বিষয়ে খুবই সাবধানী। ওর শুঁড় দুটো খুবই সজাগ। নিমেষের মধ্যে আর তাকে দেখা যায় না।

বৈকালে মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে।

ফটিকও গেছে দর্শকের মতই। তবু ব্যাগটা নিতে ভোলেনি, ওদিকে মাঠে টিম নেমেছে। বসন্তের পায়ে দামি বুট, হরিশবাবু অতিথিদের, কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছে সামিয়ানার নীচে। ওদিকে জেলা স্কুলও নেমেছে। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে গোবিন্দবাবু ঘোরাফেরা করছে, প্লেয়ারদের কি বলছে ।

গজেনবাবুও খেলার খবর পেয়ে ক’দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে সদর থেকে। কিন্তু টিমে ফটিককে না দেখে অবাক হয়। বলে সে—এ কি করেছ গোবিন্দ? স্ট্রাইকারই রাখোনি দলে? ফটিককে বসালে?

কর্মব্যস্ত গোবিন্দস্যার জানত গজেনবাবু দু’দিনের জন্য এসে ঝগড়া বাধাবেন, সে খুশি হয়নি ওর কথায়। বলে—ট্রায়ালে বসন্তকেই চাইলেন সবাই।

-সে কি! ওর মত প্লেয়ার বা আছে কে? গজেনবাবু বলে।

গোবিন্দস্যার বলে—আমাকে এ নিয়ে কিছু বলবেন না। দেখবেন বসন্ত ইজ দি বেস্ট সিলেকসান ।

খেলা শুরু হয়েছে। ভূতনাথ ব্যাক, ওদিকে ফরোয়ার্ড লাইনে রবি, উৎপল গণেশ রমাপতি আর বসন্ত তাদের মধ্যমণি।

জেলা স্কুল টিমও কড়া। তবু ওর মধ্যে ভূতনাথ একটা বল থ্রু করেছে রবিকে, রবি বসন্তকে দিয়েছে, ফাঁকা সামনে। চিৎকার করে ওঠে গোবিন্দস্যার। কিন্তু বসন্ত পজিশন নিতে নিতে ততক্ষণে ওদের ব্যাক নিশ্চিত গোলের বলটাকে অনায়াসে ক্লিয়ার করে দিয়েছে।

ওদিকে জেলা স্কুলই চেপে ধরেছে তাদের। ওদের ডিফেন্সও দারুণ বল জোগাচ্ছে। তাদের আক্রমণ শুরু হয়েছে এবার এদের গোলে। ভূতনাথ, বিমল আর দু’তিনজন হিমশিম খেয়ে যায় ৷

তার মধ্যেই জেলা স্কুল একটা গোল দিয়েছে। ভূতনাথও মরিয়া, আবার বল পেয়েছে- এদের ফরোয়ার্ড রবি, গোলের কাছেই রবি শট নেবার আগেই চিৎকার করছে গোবিন্দস্যার-বসন্তকে দে! অ্যাই।

রবিও ঘাবড়ে গেছে। ফাঁকা গোল, বসন্ত ছুটে এসে বলটাকে গোলের দিকে না মেরে সোজা আউট-এ পাঠিয়ে দিল উত্তেজনার বশে।

আবার জেলা স্কুল চেপে ধরেছে।

এদের ডিফেন্স তবু প্রাণপণে খেলছে। আবার বল পেয়েছে এদের ফরোয়ার্ড। ভূতনাথ, বিমল এর মধ্যেও আক্রমণের বল জোগাচ্ছে, জানে গোল দিতে পারলে জেলা স্কুল দমে যাবে । এদের ফরোয়ার্ড লাইন আজ ফটিকের অভাবে কানা হয়ে গেছে।

আবার ফাঁকা গোল, আবার বসন্ত মারার আগেই ওদের ব্যাট বল ছিনিয়ে নেয়। তিন তিনটে নিশ্চিত সুযোগ হারালো এদের স্কুল, ওদিকে জেলা স্কুল এর মধ্যেই দুগোলে জিতছে। সারা মাঠে এবার চাপা প্রতিবাদ ওঠে দর্শকদের মধ্যে—বসন্তকে বসিয়ে দাও ।

হরিশবাবু এদিকে ওদিকে চাইছে। গোবিন্দস্যারও খুঁজছে সেই দর্শকদের। ওদিকে কারা চিৎকার করে বলে বসন্তকে—বসে পড় বসন্ত। বাড়ি যা বাপ্

বসন্তও এবার ঘাবড়ে গেছে। সেও বুঝেছে তিনটে গোল দিতে পারলে তাদের স্কুলই জিতত। আর এই পরাজয়ের জন্য সেইই দায়ী।

এবার বসন্ত বল পেয়েছে আবার, কিন্তু দৌড়বার আগেই কার প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মুখ থুবড়ে, ডানপায়ের হাঁটুতেও চোট লেগেছে। ওঠার সাধ্য নেই। বল অবশ্য জেলা স্কুলের ব্যাক আগেই ক্লিয়ার করে দিয়েছে, আর সেই বলটাকে এনে ওদের লেফট উইঙ্গার সোজা গোলে শট করতে কে হেড দিয়ে গোলও করেছে।

হাফটাইমের বাঁশি বেজে যায়। হাফটাইমের আগেই তিনগোল খেয়েছে এদের টিম। ওদিকে বসন্তকে মাঠের বাইরে নিয়ে গেছে।

দর্শকরা চিৎকার করে ওকে বসিয়ে দে। সন্তোষবাবু, গজেনবাবুরা দেখেছে গোবিন্দবাবু জোর করেই বসন্তকে নামিয়ে এই বিপর্যয় এনেছে।

হরিশবাবু সম্মানিত দর্শকের আসনে চুপ করে বসে আছে।

ওদিকে নির্বাচকমণ্ডলীও নির্বাক। খেলার মোড় এভাবে ঘুরে যাবে তা ভাবেনি হরিশ। ওর টাকা প্রতিপত্তি দিয়ে সবকিছু করা যাবে না এটা বুঝেছে।

মাঠের মধ্যে ভূতনাথ অন্য প্লেয়াররা বলে গজেনবাবুকে — গোবিন্দস্যারই এসব করলেন স্যার। আমরা এতগুলো ওপেন নেট মিস করেছি বসন্তর জন্য। দুটো গোল আগে দিতে পারলে ওদের মর‍্যাল থাকত না। খেলা অন্যরকম হত।

গোবিন্দবাবু চুপ করে গেছে।

গজেনবাবু বলে—ফটিককেই নামাও গোবিন্দ ।

গোবিন্দবাবু ইতিউতি করে—আর কি হবে? বসন্তও চোট পেয়েছে। ভাবছি নিতুকে নামাই । গজেনবাবু বলে—না, ফটিককেই দ্যাখো।

ফটিক মাঠের একদিকে বসেছিল। ও দেখছে বসন্ত দলের কি সর্বনাশ করেছে। তিনটে গোল শোধ করে জিততে পারা আজ যাবে না। সামনেই গাছের ওখানে সিরিনকে দেখে চাইল।

ওদিকে ভিড় নেই। ফটিককে বলে সে—এবার তৈরি হও। খেলতে হবে। পথ করে দিয়েছি বসন্তকে চোট করে।

—সে কি! অবাক হয় ফটিক। বলে—তাহলে বসন্তকে তুমিই ধাক্কা মেরেছিলে। সিরিন বলে—একটু ছুঁয়ে গেছি মাত্র। এবার নামো।

ফটিক বলে—নেমে কি হবে? জেতা যাবে না। জেলা স্কুলকে চারটে গোল দেওয়াও যাবে না ।

সিরিন হাসল।

হঠাৎ মতিলালকে দেখে চাইল। সিরিনও মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়। মতিলাল বলে—তুই এখানে? শিগগির চল। নামতে হবে তোকে।

সিরিনের কথাগুলো ফলে যাচ্ছে।

তবু ফটিক সন্তোষবাবুকে বলে–আর কি করব স্যার নেমে?

ভূতনাথ বলে—তবু চাপ রাখলে আমাদের গোল দিতে পারবে না ওরা। না হলে ডজন পুরিয়ে দেবে।

মাঠে নেমেছে এবার ফটিকই।

হরিশবাবুর মুখটা বোদা হয়ে যায়। গোবিন্দবাবু তবু কানে কানে বলে, আর ওর করার কিছু নেই স্যার। নেহাৎ বসন্ত ‘উনডেড’ হয়ে গেল, ওরা সবাই বললে, না নামালে কথা হত। তাই নামালাম।

ফটিক পরমুহূর্তে বল পেয়েছে।

সামনে রবি, রবিকে বল ঠেলে ও গিয়ে পজিশন নেবার সঙ্গে সঙ্গে বলটা তার কাছেই এসেছে, সেই রানিং বলেই কিক্ করতে সোজা গোল।

সারা মাঠ আনন্দে ফেটে পড়ে।

আবার খেলা শুরু হয়েছে। এবার জেলা স্কুল তৈরি হবার আগেই ফটিক বল নিয়ে দৌড়চ্ছে, ওদিকে কানুকে ঠেলে দিয়েছে। উইঙ্গার কানুও উঁচু করে সেন্টার করতেই ফটিকের মনে হয় কে যেন তার শরীরটাকে এক ধাক্কায় আশমানে তুলে দিয়েছে আর সেই অবস্থাতেই বলটা তার মাথায় লেগে গোত্তা খেয়ে সেকেন্ড বারে ঢুকে গেছে।

আবার আকাশ ফাটানো চিৎকার ওঠে—গো-ও-ও-ল।

দু’গোল শোধ করে দিয়েছে ফটিকের দল হাফটাইমের দশ মিনিটের মধ্যে। এবার খেলার মোড় ঘুরেছে। জেলা স্কুলও বুঝেছে ফটিক, ওই লম্বা মাঝারি গড়নের ছেলেটাকে ছাড়া যাবে না। তিন চারজন ওকে গার্ড দিয়ে রাখছে। আর এগোতে পারছে না ফটিক।

এবার বলটা পেয়ে ফটিক মাঠের বাঁ দিকে গেছে। তাকে ঘিরে রেখেছে চারটে প্লেয়ার, ফটিকও তাক বুঝে ফাঁকায় ফাঁকায় দাঁড়ানো রবিকে বল দিতে রবিও গোলেই মেরেছে।

তিন গোল এরাও দিয়েছে। মাঠে হৈ চৈ কলরব চলছে। অতিথিরাও মুগ্ধ হয়ে খেলা দেখছে। একটিমাত্র প্লেয়ার মাঠে নেমে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

জেলা স্কুল দলও মরিয়া হয়ে খেলছে। বল, আর আসতে দিচ্ছে না। এদিকে ভূতনাথ বিমলও আটকে রেখেছে ওদের। আর ফটিককে ওরা চারজন পাহারায় রেখেছে।

খেলা শেষ হতে আর মিনিট তিনেক বাকি। তখনও ড্র চলেছে।

জেলা স্কুল কিছুতেই বল গলাতে দেবে না। খেলা অমীমাংসিত থেকে যাবে, উভয়ে যুগ্ম বিজয়ী হবে হয়তো।

ফটিক বলটা পেয়েছে, হঠাৎ তার সামনেই দেখা যায় জেলা স্কুলের ব্যাক দৌড়ে আসছে, ওকে কাটাতে পারলে ফাঁকা গোল। হঠাৎ মনে হয় ব্যাক এর প্লেয়ারটাকে কে যেন পায়ে পায়ে আটকে দিতে সে ছিটকে পড়ে, পথ পরিষ্কার। ফটিক তীর বেগে বলসমেত গোলে ঢুকে পড়েছে।

—গো-ও-ও-ল।

সারা মাঠে উৎসাহী দর্শকরা নেমে পড়েছে। ফটিকের টিমই জিতেছে। আর জিতেছে শুধু মাত্র ফটিকের জন্যই ।

সন্তোষবাবু ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে—আজ তুই মান রাখলি ফটিক।

ওকে ফিরে ধরেছে সবাই। সেই নির্বাচকমণ্ডলীও বলে হরিশবাবুকে—দারুণ একটা প্লেয়ার রেখেছেন স্কুলে। ওকেই ন্যাশনাল টিমে চান্স দেব। আগে নামলে খেলা অন্যরকম হত। হরিশবাবু হাসবার চেষ্টা করে বলে-একটু বাজিয়ে নেবার জন্যই ওকে শেষে নামালাম । কি হে গোবিন্দ?

গোবিন্দস্যারও সায় দেয়—হ্যাঁ স্যার।

শিল্ড জিতেছে এদের স্কুল এবারও। পরপর তিনবার জিতল ওরা। বেস্টম্যান প্রাইজ রুপোর কাপটা পেয়েছে ফটিকই।

আর সকলেই খুশি হয়েছে ওই ন্যাশনাল টিম কর্তৃপক্ষের ঘোষণায়। ফটিক ঘোষই এবার জাতীয় টিমের হয়ে দিল্লীতে খেলতে যাচ্ছে।

হাততালি—চিৎকার করে ওরা ফটিককে সম্বর্ধিত করতে চায়।

ফিরছে ফটিক বাড়ির দিকে। ছোট্ট শহরে আজ সে বিজয়ীর সম্মান পেয়েছে। হারানো প্রতিষ্ঠা ফিরে পাচ্ছে।

হঠাৎ নির্জন পথের মাঝে সিরিনকে পাশে দেখে চাইল। হাসছে সিরিন। বলে সে–কি বলেছিলাম ফটিক? খেললে—জিতলে তো বন্ধু ।

চাইল ফটিক। বন্ধুই সে! ফটিক বেশ বুঝেছে শেষের গোলটা সে দিতেই পারত না। হঠাৎ ব্যাককে মনে হয় সিরিনই ওই রামধাক্কা দিয়েছিল। না হলে পথ পেত না ফটিক।

ফটিক বলে,—ওদের ব্যাককে ওভাবে ঠেলে দিলে কেন?

সিরিন বলে—না হলে গোল করতেই দিত না। তাই—

হাসছে সিরিন। এর শুঁড় দুটো নড়ছে। চোখে নীলাভ দীপ্তি। দুজনে পরম বন্ধুর মত ফিরছে!

সিরিন বলে—হরিশবাবু কিন্তু খুব রেগে আছে তোমার ওপর। আবার কিছু করতে পারে। ফটিক বলে—তোমার মত বন্ধু থাকতে ও আমার কিছু করতে পারবে না।

সিরিন কি ভাবছে।

হরিশবাবুর কাছে ব্যাপারটা কেমন রহস্যময় বলেই বোধহয়। বসন্তও বুঝতে পারেনি কে যেন হাওয়ার মধ্যে তাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলেছিল। আবার শেষ গোলের সময়ও ওদের ব্যাক হঠাৎ তালগোল পাকিয়ে পড়ে গেল আর সেই ফাঁকে গোল করেছে ফটিক।

গোবিন্দস্যার বলে –এ যেন মিরাক্যাল মানে রহস্যজনক ব্যাপার স্যার। ফটিকটা মাঝে মাঝে কেমন হয়ে যায়। এ তো যেন ভৌতিক কাণ্ড। হাফটাইমে চারখানা গোল দিল ওই টাফ্ টিমকে। নৃপতিস্যারের সেই অঙ্কের রহস্যটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। ওই অঙ্কটা বোস আইনস্টাইন-এর থিয়োরির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

নৃপতিস্যার বলে—আমার কাছেও ব্যাপারটা খুব রহস্যজনক ঠেকছে হরিশবাবু, ওইসব উদ্ভট অঙ্ক ও ছোঁড়ার মাথায় এল কি করে ?

শশী ভট্টাচার্য হরিশবাবুর বাড়ির বিগ্রহের পূজারী, এমনিতে ভূত ব্রহ্মদত্যির ওঝাগিরি করে। সাপের কামড়ের মন্ত্রতন্ত্রও জানে। শীর্ণ চেহারা, বুকের হাড় ক’খানা গোনা যায়। তেমনি লম্বা, গলাটা বকের মত। কিন্তু গলার স্বর তেমনিই বাজখাঁই। যেন হাঁড়ির ভিতর থেকে কথা বলছে। কপালে সিন্দুরের লাল মাজুলি। শশী ভট্টাচার্য খ্যান-খেনে গলায় বলে,—ওটাকে ভূতে পেয়েছে নাকি হে? ভূত বেহ্মদত্যি যাতেই পাক না কেন বলো তো এক সরষে পোড়া দিয়ে সারিয়ে দেবো।

হরিশবাবু ভাবছে কথাটা ।

এই ছেলেটার জন্য বসন্ত এমনি অপদস্ত হল। আর এত লোকের সামনে ছেলেটা খেলে গোল করে আজ জাতীয় দলে চান্স পেয়ে গেল। হরিশবাবু তার বাবা গদাধরের জমি—বাগান সর্বস্ব মিথ্যা দলিল করে কৌশলে লুট করেছে, কিন্তু কৌশল করে ফটিককে থামাতে পারছে না।

হরিশবাবুরও জেদ চেপে গেছে।

স্কুলের কেরানিবাবুই খবরটা দেয়, ফটিকের স্কুলের মাইনে অন্যান্য ফি প্রায় সাত মাসের বাকি। ওর বাবা গরিব, কোনোমতে দিন আনে দিন খায় অবস্থা। ছেলের স্কুলের মাইনেও বাকি পড়েছে।

এ সময় স্কুল থেকে নাম কাটাতে পারলেই ফটিকের জাতীয় স্কুল দলে খেলার অধিকারও থাকবে না।

হরিশবাবু বলে হেডমাস্টারমশাইকে—স্কুল না দানছত্র করেছেন যে সাত মাসের মাইনে বাকি থাকবে ছেলেদের আর তারা সব সুবিধা পাবে। তিনদিনের মধ্যে সকলকে বকেয়া মাইনে শোধ করতে বলুন, না হলে নাম কেটে দেবেন। স্কুল ফান্ডে টাকা নেই—আর এই সব চলবে?

ফটিকের বাবাও চিঠিখানা পেয়েছে। বিপদে পড়ে গদাধর ঘোষ। টাকাও হাতে নেই।

ফটিকও শুনেছে কথাটা। ওদিকে ন্যাশন্যাল টিমে পাঠানো হবে স্কুল থেকে সাতদিনের মধ্যে। সামনে ফাইন্যাল পরীক্ষা। এবার সে ফার্স্ট হবেই। কিন্তু ঠিক সময় বুঝেই হরিশবাবু, প্রেসিডেন্ট, স্কুলে এই হুকুম দিয়েছে।

তিনদিনের মধ্যে মাইনে সব মিটিয়ে না দিলে নাম কাটা যাবে। পরীক্ষা দিতে পারবে না, জাতীয় দলে খেলার অধিকারও থাকবে না ।

এতদিনের সব স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাবে। দুঃখে দু’চোখে জল নামে।

গদাধরও স্ত্রীকে বলে,—ওর আর এভাবে পড়ে লাভ কি? দত্তমশায়ের গদিতেই ঢুকিয়ে দিই ফটিককে।

অর্থাৎ ফটিকের জীবনের সব আশা স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাবে এইবার ।

মা বলে—একটা মাত্র ছেলে, তাকেও মানুষ হতে দেবে না ওই হরিশবাবু। আর কত নেবে আমাদের ওই লোকটা।

গদাধর ঘোষ বলে–একা আমাদেরই সর্বনাশ করেনি সে। বহু লোকের সর্বস্ব নিয়েছে। ফটিকও চোখে অন্ধকার দেখছে।

কারো কাছে হাত পাতার উপায় নেই। সন্তোষবাবু, গজেনস্যারও বাইরে। এই সুযোগে তার নাম কেটে দিতে চায় স্কুল থেকে।

বাইরের ঘরে বসে আছে ফটিক। চার দিকে ভাঙা কাছারি—ওদিকে এককালে তাদের সমৃদ্ধির ধ্বংসাবশেষ। আজ কিছুই নেই।

হঠাৎ সিরিনকে দেখে চাইল ফটিক। তার দু’চোখে জল নামে। বলে ফটিক—আজ আমাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে সিরিন। তোমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। পড়াশুনা খেলাধুলা কিছুই আর হবে না টাকার অভাবে।

সিরিন হাসছে।

ওর শুঁড় দুটো নড়ছে। দুচোখে নীলাভ জ্যোতি। সিরিন বলে-তোমাদের কিছু সঞ্চয় এখনও আছে। চাইল ফটিক। সিরিন বলে—তোমরা জান না আমি জানি। সব খবর পাই। একটা শাবল আনো দেখাচ্ছি ।

ফটিক ঠিক বুঝতে পারে না ।

ওদের কাছারি বাড়ির ওদিকে এখন আগাছার বন। বুনো মানকচু, ওল এর গাছ গজিয়েছে। সিরিন-এর মাথার শুঁড় দুটো নড়ছে। যেন মাটির নীচের দিকে কিসের সন্ধান করছে। বলে—খোঁড়ো এখানে।

বনের মধ্যে একটা বড় ওলগাছের পাশে খুঁড়তে থাকে ফটিক। একটা ওল ও তুলেছে। এই মানকচু ওল তাদের এখন প্রধান সব্জি, আর একটু খুঁড়তে শাবলটা কিসে লেগে ভারী শব্দ হয়। বুক কাঁপছে ফটিকের।

সিরিন হাসছে। দেখা যায় একটা ঘটির মত। মুখ বন্ধ ঘটিটাকে দুরু দুরু বুকে তুলেছে ফটিক। উপরে মাটির আস্তর। মুখটা খুলতে দেখা যায় তাতে একঘটি রুপোর টাকা, সেকালে কেউ পুঁতে রেখেছিল।

সিরিন বলে—ভয় কী, নিয়ে চলো, ও টাকার মালিক তুমিই। এ সব জানতে না, আমি বলছি। ওসব তোমার ।

ফটিক সিরিনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে-তুমি আমাদের বাঁচালে সিরিন। সিরিন বলে–সেকি, বন্ধুকে ভালোবাসা তার জন্য বন্ধুর কোনো কর্তব্য নেই? আমি তো কিছু দিতে পারিনি। খবর দিয়েছি মাত্র।

ফটিকের মা সুধাময়ী ওল আর পুরোনো ঘটিটাকে দেখে অবাক হয়। তাদের পূর্ব পুরুষরা বড়লোকই ছিল, কাছারির ওখানে এমন কিছু টাকা থাকা অসম্ভব নয়। ওই রুপোর টাকাগুলোর তবু অনেক দাম এখন।

গদাধর ঘোষও অবাক হয়। তবু কিছুদিন তারা নিশ্চিন্তে থাকবে এই টাকাটা পেয়ে। হরিশবাবু খবরটা রাখছে।

নোটিশের দু’দিন পার হয়ে গেছে। তখনও ফটিক মাইনে জমা দিতে পারেনি। আজ শেষ দিন। বেলা তিনটের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে নাম কাটা যাবে। হরিশবাবু আজ নিজে স্কুলে এসেছে।

বেলা আড়াইটা নাগাদ ফটিককে অফিসে ঢুকতে দেখে চাইল হরিশবাবু। ও বোধহয় সময় চাইতে এসেছে।

হরিশবাবু বলে—আজই মাইনে না দিলে সবকটার নাম কেটে দেবেন কেরানীবাবু। না হলে আমি স্টেপ নেব।

স্বয়ং প্রেসিডেন্টের হুকুম। কিন্তু ফটিক কোনো কথা না বলে টাকাটা বের করে বলে কেরানীবাবুকে–আমার মাইনেটা নিন। বিরাশি টাকা আছে।

ফটিকের কথায় হরিশবাবু চাইল ।

টাকাটা বের করছে সে। ও যেন হরিশবাবুর গালেই প্রকাশ্যে আজ চড় মারছে। হরিশবাবু বের হয়ে গেল ।

তবু সন্দেহ হয় তার! এত টাকা ওদের কাছে অনেক, কোথায় পেল ফটিক? এটা জানতে হবে। আর যদু স্বর্ণকারই খবরটা আনে।

কিছু পুরানো আমলের রুপোর টাকার কথা বলেছিল হরিশবাবু। যদু আজ গোটা দশ সেই আমলের টাকা এনেছে। সবুজ শেওলার আভা রয়েছে তখনও

হরিশ টাকাগুলো নিয়ে বলে-কোথায় পেলে হে এ জিনিস ?

যদু স্বর্ণকার বলে—আজ্ঞে গদাধর ঘোষ বিক্রি করে গেল। বহু পুরোনো আমলের গেঁড়ি টাকা। খাঁটি মাল ৷

চমকে ওঠে হরিশ! তখন আর কথা বাড়াল না।

যদু চলে যেতে ভাবছে সে, গদাধর তাহলে গুপ্তধনটন পেয়েছে। আর সে বিষয়ে একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। তাহলে সেসব যেভাবে হোক কেড়ে নিতে হবে।

তার জন্য নীরু সর্দার মজুত আছে। সে বলে—আমি ওখানে দেখছি খুঁজে পেতে। গুপ্তধন মানে মাটির নীচে থাকবে তো। খুঁড়ে তুলতে হবে। আমি খবর লাগাচ্ছি।

নীরু সর্দারও এবার টাকার গন্ধ পেয়ে খেপে উঠেছে।

হরিশবাবুর বাড়িতে ওর বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ। এই দিনটিতে সারা মহল্লার লোককে সে খাওয়ায়। এলাহি ব্যাপার। দই তিনরকম মিষ্টি, রাজভোগ, সন্দেশ, কমলাভোগ, ছানাবড়া বানানো হয় সেরা কারিগর দিয়ে। আর হাজারখানেক লোককে খাওয়ায়।

তার আয়োজন চলছে। হরিশবাবুর সুনাম নির্ভর করে এর উপরেই। শহরে হাকিম, মুনসেফ, পুলিশসাহেব দারোগাবাবুও আসেন–শহরের নামি উকিলরাও। বিরাট ভোজই হয়। এত কিছু সত্ত্বেও হরিশবাবুর মনে কাঁটার মতন বিঁধছে ওই গদাধর আর ফটিকের ব্যাপারটা।

ফটিকের নাম জাতীয় টিমে গেছে। আটকাতে পারেনি হরিশবাবু। আর পড়াশুনাতে, এবার সেই ফার্স্ট হবে। কারণ এর মধ্যে শহরের বেশ কিছু মহলে গুঞ্জন উঠেছে, হরিশবাবুই কৌশলে ফটিককে খেলতে দেয়নি, সেকেন্ড করিয়েছে অঙ্কে। অথচ যে অঙ্ক কেউ কষতে পারেনি বোর্ডে তাই কষেছে ফটিক। আর যে অঙ্কটি কষতে বলেছিল নৃপতিস্যারকে সেটা আজ অবধি কষতে পারেনি স্যার। সন্তোষবাবুর দলও এবার নজর রাখছে।

হরিশবাবুর মান সম্মান যেতে বসেছে। তবু নীরু সর্দার যদি খবর আনতে পারে গুপ্তধনের তাহলে হরিশবাবু ডাকাতির চার্জে ফেলে এবার গদাধর আর ফটিককে জেলে পাঠাবে। নীরু সর্দারকে তাড়া দেয় হরিশবাবু।

—কিছু খবর বের কর।

নীরু সর্দার সেদিন সন্ধ্যার পরই এসেছে ফটিকদের বাড়িতে।

এখান ওখান ঘুরছে সে, আবছা অন্ধকারে তার চোখ জ্বলে। সে কাছারির ওদিকের বনেও ঢুকে এখান ওখানে দেখছে কোথাও গর্ত খোঁড়ার চিহ্ন আছে কিনা।

নীরু সর্দার সেই জায়গাটার দিকে চলেছে, কিন্তু ততদূর যাবার আগেই হঠাৎ একটা তীব্র আলোর ঝলকে দাঁড়াল, আলোটার তেজ বাড়ছে, উজ্জ্বল নীলাভ আলোটা যেন তীক্ষ্ণ বল্লমের ফলার মত ঢুকছে তার দেহে, সারা দেহে অসম্ভব জ্বালা, চোখ যেন অন্ধ হয়ে আসছে, দুঃসহ জ্বালায় একবার আর্তনাদ করে প্রাণভয়ে নীরু সর্দার লাফ দিয়ে দৌড়তে থাকে।

—বাঁচাও, বাঁচাও!

জ্বলে যাচ্ছে সারা দেহ। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। দৌড়চ্ছে সে ভয়ে। ফটিক ওদিকের ঘরে পড়ছিল। সে বের হয়ে আসে।

লোকটা তখন বুকফাটানো আর্তনাদ করে দৌড়ে বের হয়ে গেছে ।

চাইল ফটিক। সিরিন হাসছে মিটি মিটি করে। ফটিক শুধোয়–কি ব্যাপার বন্ধু ? সিরিন বলে—একটা শয়তান এসেছিল গুপ্তধনের খোঁজে। হরিশবাবুর চর।

অবাক হয় ফটিক—সে কি!

সিরিন বলে-একটু ওষুধ দিয়েছি মাত্র। ও আর আসবে না। ভয় নেই ।

ফটিক বলে—তোমার জন্যই ভয় পাই না বন্ধু। না হলে ওই হরিশবাবু তো শেষই করে দিত। এতদিন বাইরে যা করার করেছে, এবার বাড়ি চড়াও হয়েছে কিনা। তাই ভয় হয়। সিরিনের চোখ দুটো জ্বলছে। বলে সে—ও নিয়ে তুমি ভেব না বন্ধু

সুধাময়ীও চিৎকারটা শুনেছে, সে বের হয়ে আসে ঘর থেকে।

ওদিকে ফটিককে কার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছে সে। মা শুধোয়-কার সঙ্গে কথা বলছিলি রে?

ফটিক চাইল, সিরিন হাওয়ায় মিশে গেছে।

ফটিক নিশ্চিন্ত হয়ে বলে-কই না তো। কার চিৎকার শুনলাম—তাই বের হয়ে এসেছি।

সুধাময়ী তখনও বাতাসে যেন কাতর আর্তনাদটা শুনছে।

বলে সে,–কে জানে কার ! চ, ভেতরে চ।

হরিশবাবুর বৈঠকখানায় তখন আগামী ভোজের ব্যাপারে ফর্দ হচ্ছে। সকলেই রয়েছে। এবার হরিশবাবু এখানে সদর থেকে ফ্রিজ আনিয়ে আইসক্রিম সন্দেশ খাওয়াবে। বরফের মত ঠান্ডা ক্ষীর কিসমিস, পেস্তা জমানো সন্দেশ, ইতিপূর্বে এখানে কেউ খায়নি।

হরিশবাবু বলে–খরচ পড়বে।

হেডস্যার বলে—কিন্তু নতুন একটা জিনিস হবে।

এমন সময় আর্তনাদ করে এসে ছিটকে পড়ে নীরু সর্দার। চোখ দুটো আতঙ্কে ঠেলে বের হয়ে আসছে। গোঙাচ্ছে। জ্ঞান নেই। সারা শরীরে কালচে দাগ। পরনের জামাটাও কালচে হয়ে পুড়ে গেছে।

হরিশবাবু, আর সকলেই অবাক হয়।

মুখে চোখে জল দিতে জ্ঞান ফেরে, বৃন্দাবন ডাক্তারকেও ডাকা হয়েছে।

রাত্রি নেমেছে। ওদিকের একটা ঘরে পড়ে পড়ে আর্তনাদ করছে নীরু সর্দার। দেখে আর চেনা যায় না। বৃন্দাবন ডাক্তারও অবাক হয়। শুধোয় সে-কি হয়েছিল নীর?

নীরু এর মধ্যে একটা চোখে দেখতেই পাচ্ছে না। ডান দিকটাই যেন পুরো ঝলসে গেছে। নীরু বলে—আলো। জোর আলোর আভা যেন জ্বালিয়ে দিল ডাক্তারবাবু, উঃ—বাঁচান। আলোটা আসবে আবার। পুড়িয়ে দেবে।

বৃন্দাবন ডাক্তারও কিছু হদিশ করতে পারে না।

-এমন বিচিত্র কেস্ আমি দেখিনি। একটা দিক যেন ঝলসে গেছে৷ অথচ আগুনেও পোড়েনি। ওষুধ দিচ্ছি, খেতে আর লাগাতে থাকুক। তবে একটা চোখ বেচারার নষ্ট হয়ে গেল বোধ হয়।

হরিশবাবু ঘাবড়ে গেছে। নীরু তাকে বলে সব ব্যাপারটাই। কোথায় যেন একটা অদ্ভুত কি ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে ওই গদাধর ঘোষ এর বাড়িতে। ফটিকও কেমন এক নতুন এক সত্তায় পরিণত হয়েছে। আর নীরুর মত সহচরকে এমনিভাবে আঘাত দেওয়ায় হরিশও দমে গেছে।

শশী ভট্টাচার্য তবু সাহস দেয়—ও সব অপদেবতার ব্যাপার। কোনো গুণিনকে দিয়ে পিশাচ সিদ্ধ করিয়েছে। ও আমি এক দিনে ঠান্ডা করে দেব। আপনার বাড়ির কাজটা চুকে যাক, তারপর এই অমাবস্যাতেই ওই ভূতের দফা রফা করে দেব।

হরিশেরও এখন সময় নেই। সামনে কাজ।

বিরাট আয়োজন করেছে এবার হরিশবাবু। সামনের মাঠ জুড়ে বিশাল সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। ওদিকে বিশজন কারিগর রসগোল্লা, ছানাবড়া, কমলাভোগ বানাচ্ছে।

কাল সকাল থেকেই ভোজ শুরু হবে।

সারা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও আমন্ত্রিত।

সারা শহরে খবর রটে গেছে বরফ সন্দেশও খাওয়ানো হবে। তার জন্য ট্রাকে করে বহু খরচ করে বরফের বাক্স আনানো হয়েছে।

গদাধর ঘোষের বাড়িতেও নেমন্তন্ন করে গেছে। হাজার হোক একটা সম্পর্ক তো আছে। ফটিক বলে- যাব না বাবা !

গদাধর ঘোষ বলে—নারে। না গেলে কথা হবে। চল।

তাই সে এসেছে বাবার সঙ্গে।

ওদিকের সামিয়ানার নীচে ঝকঝকে সানমাইকার টেবিল চেয়ার পাতা, সকলেই বসেছে সেখানে গদাধরও ফটিককে নিয়ে বসেছে।

পাতা পড়েছে। হরিশবাবু বসন্ত ম্যানেজারবাবু তদারক করছে। হঠাৎ হরিশবাবু গদাধর আর ফটিককে এখানে দেখে এগিয়ে এসে কর্কশস্বরে বলে-কে এখানে বসতে বলেছে তোমাদের?

বসন্ত গর্জে ওঠে,–এটা স্পেশাল গেস্টদের জন্য। উকিল, দারোগাবাবু, পুলিশসাহেব হাকিমদের মধ্যে বসতে লজ্জা করে না? এত বড় সাহস?

গদাধর, ফটিক সবে লুচি একখানা ভেঙে মুখে পুরেছে।

হরিশবাবু বলে—উঠে যাও ওখান থেকে, ওই যে মাটিতে বসেছে ওখানে যাও। ওঠো— ফটিক চাইল, কে একজন এসে গদাধরের শতটা ধরে টেনে তুলছে, অন্যজন ধরেছে ফটিককে। গর্জায় হরিশবাবু –যাও, কাঙ্গালীর মত পোশাক পরে এখানে এসে বসেছ? আস্তাকুঁড়ের কুকুরের সমাজে ওঠার সখ!

ফটিক বলে—চলো বাবা।

সকলেই দেখছে ওদের এই অপমান। গদাধরের চোখ ফেটে জল আসে। বলে সে—ভিখারী আমি নই হরিশ। আমারই সব নিয়ে আজ তুমি বড়লোক, ঠকিয়ে নিয়েছ সব। তবু এসেছিলাম।

ফটিক বলে—চলো বাবা।

বাবাকে টেনে আনে সে।

আর ওখানে দাঁড়ায়নি। ওই সমারোহ, বিরাট উৎসব এর প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আসছে ওরা। গদাধর কান্নাভেজা স্বরে বলে—ডেকে নিয়ে গিয়ে এইভাবে অপমান করবে তা ভাবিনি রে। তুই ঠিকই বলেছিলি, আমিই শুনিনি তোর কথা। যদি পারিস এই অপমানের জবাব দিবি। সুধাময়ীর চোখেও জল নামে। তার স্বামী, ছেলেকে এভাবে অপমান করবে হরিশবাবু তা ভাবেনি সে। ফটিক বাড়ি ফিরে গুম হয়ে বসে আছে। হঠাৎ সিরিনকে দেখে চাইল।

হাসছে সিরিন। বলে সে একটু কাজে গেছিলাম, এর মধ্যে এই সব ঘটে গেল বন্ধু।

ফটিকের চোখে জল। বলে সে-আমাকে যা করে করুক, এত লোকের সামনে বাবাকে এভাবে অপমান করল।

সিরিন ঘাড় নাড়ছে ।

ফটিক বলে—অনেক রকম মিষ্টি করেছিল। ভাবলাম তোমার জন্যও আনব।

হাসে সিরিন। বলে—ওর অভাব হবে না। আর হরিশও একটু বুঝবে এবার।

ফটিক চমকে ওঠে। নীরু সর্দার দেখেছে কাল। আধমরা হয়ে গেছে। আর সিরিনই করেছে। তবু সিরিন বলে–কিছুই করিনি। আমাদের দেহের জেনারেটিং সেট এ যা রশ্মি বের হবে তা জাগতিক আলোর চেয়েও বহুগুণে তীব্র। কসমিক রে! ওই রশ্মিতে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ওকে তো কিছুই করিনি।

আজ আবার সিরিনকে ওকথা বলতে দেখে ফটিক।

–আবার কি করবে?

হাসে সিরিন—তেমন কিছুই না।

বিরাট প্যান্ডেলের নীচে খাওয়া দাওয়া চলছে। হরিশ, বসন্ত বীরদর্পে ঘুরছে। লুচি পোলাও ছানার ডালনার পর শুরু হবে আসল পর্ব। দই, রাবড়ি, রাজভোগ, কমলাভোগ, সন্দেশ তারপর সেই শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ আইসক্রীম সন্দেশ।

হঠাৎ কলরব ওঠে—রসুইখানার কাছে বড় বড় ডেকে রাজভোগ নামানো হয়েছে, এবার পরিবেশন শুরু হবে। চোখের নিমেষে চার ডেক রাজভোগ আর দেখা যায় না। হাওয়ায় যেন উবে গেছে।

হরিশবাবু চিৎকার করে—ওই ব্যাটাদেরই কাণ্ড, পুরো রাজভোগের স্টক সব সরিয়েছে। ওদের বেঁধে রেখে ছানাবড়া আন—

রাজভোগ শেষ। হরিশবাবু গর্জন করে।

রাজভোগ পড়েছে দু লাইনে, তারপরই ছানাবড়ার দুটো ডেকও হাওয়া। ছানাবড়াও শেষ, ওদিকে ভাঁড়ার থেকে সন্দেশ-এর কোনো পাত্তাই নেই। হাওয়ায় যেন কপূরের মত উবে গেছে। হরিশবাবুর মাথায় রক্ত উঠে গেছে। গজাচ্ছে সে।

—বন্দুক লাও। গুলি করে ওই চোর রসুইকর ব্যাটাদের উড়িয়ে দেব। এভাবে বিপদে ফেলবে? ম্যানেজার, আইসক্রীম সন্দেশই লাগাও, যে যত চায় দিতে বলো।

আইসক্রীমওয়ালা এবার চিৎকার করে ক্যারেন্ট নাই—আর তার সব সন্দেশ গলে জল। ক্ষীর, কিসমিস, পেস্তা গলে বের হচ্ছে। সবকিছু মাঠনয় গড়িয়ে চলেছে। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ আকর্ষণও এবার নিকৃষ্ট ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এত অতিথিরা অভুক্ত প্রায়ই রয়ে গেছে। তারা রাজভোগ থেকে প্রকৃত খাওয়া শুরু করত, লুচি, ডাল, ছানার ডালনা কে খাবে। ফলে পেটও ভরেনি তাদের, এদিকে স্টকও বিলকুল শেষ। হৈ চৈ পড়ে যায় এতজন লোকের মধ্যে কেউ হাঁকে—কই হে রাজভোগ, সন্দেশ আনো।

কেউ বলে—আইসক্রীম কই বাপধন, হরিশের গুল নাকি রে।

হরিশের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। তারপরই হঠাৎ প্রবল বেগে আসে ঝড়টা। ঝড় তো নয় যেন প্রচণ্ড একটা দমকা হাওয়া উঠেছে, ঘুরছে ধুলোবালি বিকট বেগে, হঠাৎ ওই বিরাট প্যান্ডেলের বাঁশগুলো ভেঙে পড়ে। নীচে ওই প্রচণ্ড বেগে হাওয়া ঢুকে তেরপলগুলোকে বেলুনের মত ফুলিয়ে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

তারপর বাঁশগুলো ভেঙে পড়ে আর ওই শ’কয়েক নিমন্ত্রিত জন চাপা পড়েছে ওই তেরপলের নীচে। ওদের খাওয়া তখন মাথায় উঠেছে। রাজভোগ, ছানাবড়া, সন্দেশের কথা ভুলে গিয়ে তখন চাপা পড়া বন্দী লোকগুলো প্রচণ্ড কলরব আর্তনাদ করছে বাঁচার জন্য । লোকজন চারিদিক থেকে ছুটে আসে। ঘূর্ণিঝড়টাও থেমে গেছে। তারপর সেই তেরপলের নীচে থেকে ওরা ভোজন বিলাসীদের টেনেটুনে বের করছে। দারোগাবাবু তো ডালকুমড়ো মাখা অবস্থায় বের হয়েছে, পুলিশসাহেবের অবস্থাও তেমনি। হাকিম সাহেবকে টেনে বের করছে, ওদিকে জগদীশ উকিল পড়ে ছিল ছানার ডালনার টবে, ওকে আলু মশলার মত দেখাচ্ছে।

দারোগাবাবুর টাকে তখন দই এর হাঁড়িটা টুপির মত বসে গেছে, হরিশবাবুর পায়েই পড়েছে একটা খুঁটি। ল্যাংচাচ্ছে সে।

আজ তার মান সম্মান যেন ধুলোয় মিশে গেছে। লোকজনদের তখন ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, পাড়ার ছেলেরা টেনে বের করছে।

শ্রাদ্ধই হয়ে গেছে যেন হরিশবাবুর।

সারা শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। বিরাট একটা খবর !

হরিশবাবু সারা শহরের লোককে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়ে খেতেও দেয়নি। উলটে পালচাপা দিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিল। গদাধর, সুধাময়ীও শুনেছে ব্যাপারটা।

গদাধর বলে—ভগবান আছেন। উঃ এতবড় অপমান করেছিল হরিশ, তার দর্পচূর্ণ হবে না। ফটিক ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করেছে।

তাই নিরিবিলিতে সিরিনকে শুধোয়—আবার এই সব করেছ?

সিরিন মিটিমিটি হাসে। বলে সে–সামান্য একটু করেছি।

যদি ওরা জানতে পারে? ফটিক বলে।

সিরিন বলে—জানতে পারবে না। ওই হরিশের সাজা হওয়া উচিত বন্ধু। ও বহু ক্ষতি করেছে লোকের, সারা শহরের।

অর্থাৎ আরও কিছু ঘটতে পারে এটা অনুমান করে ফটিক বলে—তাতে তোমার কি? সিরিন বলে–অন্যায় অন্যায়ই। তার কোনো দেশ কাল নাই। তার প্রতিকার করা দরকার। হরিশ-এর কাছেও ব্যাপারটা বিচিত্র ঠেকে। থানায় রসুইকার, ঠাকুর চাকরদের ধরে নিয়ে গিয়েও রাজভোগ ছানাবড়া এত সন্দেশ চুরির কোনো কিনারাই হয়নি ।

দারোগাবাবুও হুঙ্কার দিয়ে কিছু খবর বের করতে পারে না।

পুলিশসাহেবও দেখেছেন ব্যাপারটা। বলেন—কেমন বিচিত্র ঠেকছে। তাহলে এত মালপত্র গেল কোথায়? আর হঠাৎ ওই ঘূর্ণিঝড়ই বা এল কি করে ?

দারোগাবাবু বলে—সাইক্লোন টর্নাডো এসব তো ঘটে স্যার।

হরিশবাবু কাতরস্বরে বলে—ধনে প্রাণে মারা গেলাম। এতবড় বেইজ্জত হলাম একটু তদন্ত করুন স্যার। আমারও ভয় হচ্ছে এবার। আবার অন্য কিছু কাণ্ড না ঘটে।

এই সময় নীরু সর্দারের ব্যাপারটাও একটু রেখে ঢেকে বলে হরিশ—আমার লোক নীরু সর্দার আসছিল তাগাদা থেকে রাতের বেলায়। কিভাবে তার একদিক ঝলসে দিয়েছে স্যার। বেচারার একটা চোখও গেছে। ডাক্তারও দেখে অবাক হয়েছে। তারপর আবার এই সব ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটেছে।

পুলিশসাহেবও এসে নীরুকে দেখে গেছেন।

তার মুখেও শুনেছে সেই আলোর ঝলকের কথা, আবার এই ভোজবাড়ির ভোজবাজি, ওই ঘূর্ণিঝড় সব মিলে একটা রহস্যজনক ব্যাপারই চলেছে।

শশী ভট্টাচার্য হরিশবাবুর পূজারীই নয়, মোসাহেবও। সেদিন সকালে বৈঠকখানায় হরিশবাবু মুখ চুন করে বসে আছে। নৃপতিস্যার হেডমাস্টারবাবু, গোবিন্দবাবুরাও রয়েছে। তারাও সেদিন নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিল। পাল চাপা পড়ে নৃপতিবাবুর ঠ্যাং-এ চোট লেগেছিল, এখনও খোঁড়াচ্ছে। সকলেই চিন্তিত।

কারণ নীরু সর্দারের ওই চোট হওয়ার পর আবার হরিশবাবুর বাড়িতে এমনি কেলেঙ্কারি হয়ে গেল।

শশী ভট্টাচার্য তার বাজখাঁই গলা তুলে বলে—এসব পিশাচ, ভূত প্রেতের কাণ্ড। আর এসব কাণ্ড করাচ্ছে গদাধর ঘোষই কোনো তান্ত্রিককে ধরে।

হরিশবাবু এখন এসব কিছু কিছু মানতে বাধ্য হয়েছে। গোবিন্দবাবু বলে—তা হতে পারে হরিশবাবু। এসব সম্ভব।

হরিশ ক্লান্ত স্বরে বলে—আর কি ক্ষতি করবে তাহলে কে জানে। এমনিতে শহরে মুখ দেখাতে পারছি না। জগদীশ উকিল তো সেদিন আলুর দম হয়ে বাড়ি যাবার সময় বলে গেছে—জীবনে আর আমার বাড়িতে আসবেন না। উঃ, তোমরা থাকতে এসবও সহ্য করতে হবে ?

শশী ভট্টাচার্য বলে—দেখুন না, এই বুধবার ভর্তি অমাবস্যা। এবার ওই গদাধরের গুষ্টিকে মারণ বাণ ঠুকছি। আর ভূত পিশাচ যাই আনুক গণ্ডীবন্ধন এইসা দেব ব্যাটা ভূত ওখানেই দম বন্ধ হয়ে খতম হয়ে যাবে।

হরিশ বলে—তাই করো।

শশী ভট্টাচার্য আমতা আমতা করে–কিন্তু ওসব তান্ত্রিক ক্রিয়ায় খরচা একটু বেশি পড়ে। আর একজন চ্যালাকেও নিতে হবে। হোম যজ্ঞি করতে হবে ।

হরিশবাবু বলে—তাই করো। নাও একশো টাকা, কাজ হলে আরও একশো পাবে। শশী কবরেজ বড় নোটটা পকেটস্থ করে টিকি নেড়ে বলে, দেখুন এবার মজা। গদাধর ঘোষ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু মনে হয় কোথায় একটা বিচিত্র কিছু ঘটছে। হঠাৎ ওই এক হাঁড়ি পুরানো টাকাগুলোও যেন দৈবাৎ মিলে গেছে তাদের।

ফটিক এখন মন দিয়ে পড়ছে। এবার ভারতের জাতীয় দলেও খেলতে যাবে।

সুধাময়ী বলে—এ নিয়ে এত ভাবছ কেন? কারো তো কোনো অনিষ্ট করিনি, ঠকিয়েও নিইনি। ভগবান ঠিক বিচার করবেন। দেখো দিন বদলাবেই।

গদাধর তবু বলে—কেমন ভয় হয় ফটিকের মা, হরিশবাবুর টাকার জোর আছে ওইসব কাণ্ড হয়েছে—এবার আমাদের না জড়ায়।

সুধাময়ী বলে—আমরা এ সবের কি জানি বলো। তবে কেন জড়াবে?

গদাধর এর জবাব দিতে পারে না।

অমাবস্যার অন্ধকার নেমেছে। জমাট অন্ধকার। সারা বাড়িটা আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকের বুনো ওল কচু ভেরেণ্ডা গাছের বন গজিয়েছে উঠানে। কাছারি বাড়ির এদিকটা নির্জন। শশী ভট্টাচার্য এসেছে তার চ্যালা হরকাত্তকে নিয়ে চুপিচুপি। কাছারি বাড়ির এককোণে এবার তন্ত্রমতে ভূত বধের সব আয়োজন করে এনেছে। আসন পেতে জবাফুল, আতপচাল, চ্যাং মাছ, আলতা, সিঁদুর, ঘট সব এনে তোড়জোড় করে বসেছে। আজ তার মন্ত্রের চোটে এ বাড়ির মানুষদের সর্বনাশ করে যাবে। আর ভূতকেও ঠান্ডা করে দেবে ।

শশী ভট্টাচার্যের চোখ জ্বলছে, যজ্ঞের আগুন জ্বেলেছে। পরনে লাল ধুতি চাদর। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। শশী ভট্টাচার্য হুঙ্কার ছেড়ে আগুনে সরষে ছিটোচ্ছে।

ওঁ হুঁং তুং ফট্!

সিরিন দেখছে ওকে। গর্জাচ্ছে শশী ভট্টাচার্য আগুনে সরষে ছুড়তে ছুড়তে।

গদাধরং ফট্, ফটিকং ফট্—

সিরিনের ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। লোকটাকে এর আগে দেখেছে সে হরিশের ওখানে।

ও এসেছে ফটিকদের অগোচরে তাদেরই বাড়িতে নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি করতে তার জন্যই হরিশের কাছে টাকা নিয়েছে। আর এখানে এই সব বিটলেমি করছে।

সিরিন দেখছে ওকে।

হঠাৎ শশী ভট্টাচার্য চমকে ওঠে সামনে ওই বিচিত্র দর্শন একটা কি দেখে। আগুনের আভায় ঝক ঝক করছে তার দেহটা। না মানুষ, না কিছু ।

একটা আর্তনাদ করে ওঠে শশী।

আর তস্য চ্যালা হরকান্ত ওই না দেখে বাবারে মারে করে দৌড়ে গিয়ে কচুবনেই পড়ে জ্ঞান হারায়। দমকা একটা ঝড় ওই আগুন জিনিসপত্রগুলো ছত্রাকার করে দেয়।

শশী ওই হাওয়ার বেগে বোঁ করে একটা পাক খেয়ে শূন্যে উঠে পড়ে। কে যেন তার গলাটা ধরে তুলেছে শূন্যে।

হরিশবাবু অপেক্ষা করছে, শশী ভট্টাচার্য যজ্ঞসিদ্ধির খবর আনবে। কিন্তু কোথায় শশী। মনে মনে রেগে উঠেছে হরিশবাবু, সব ব্যাটাই জোচ্চোর। এমন সময় বিকট চিৎকার শুনে চমকে ওঠে।

বৈঠকখানার চাতালে বসেছিল হরিশবাবু, ঠিক সেইখানেই শূন্য থেকে যেন বিকট আওয়াজ করে এসে ছিটকে পড়েছে শশী ভট্টাচার্য ।

চোখ দুটো কি আতঙ্কে ঠেলে বের হয়ে আসছে। আছড়ে পড়ে শশী ভট্টাচার্য জ্ঞান হারিয়েছে। গলার রুদ্রাক্ষের মালা ছিঁড়ে গেছে, চাদরটাও নেই।

জল টল দিয়ে হাওয়া করতে জ্ঞান ফেরে শশীর। ভীত চকিত স্বরে বলে-কোথায় রইছি? হরিশবাবু বলে—আমার বৈঠকখানায়!

হুঁশ হয় শশী ভট্টাচার্যের।

বিড় বিড় করে সে—গদাধরের পোড়ো কাছারি বাড়িতে ছিলাম, এখানে এলাম কি করে ? ক্রমশ ব্যাপারটা মনে পড়ে শশীর।

বিবর্ণ মুখ চোখ। তখনও কাঁপছে শশী ভট্টাচার্য। বলে—সাংঘাতিক কাণ্ড হরিশবাবু, বিকট একটা বস্তু। তেমনি তার চেহারা। ঝকঝক করছে। দুটো চোখ জ্বলছে। মনে হল হাওয়ার দাপটে বোঁ করে আসমানে তুলে এনে এখানে ফেলে দিয়ে গেল। ওরে বাবা। আর ওদিকে যাব না হরিশবাবু। সাংঘাতিক কিছু ব্যাপার আছে ওখানে।

হরকান্তের জ্ঞান ফেরে অনেক পর। তখন পোড়ো কাছারিবাড়িতে আর কেউ নেই। হরকান্ত কোনোরকমে বন থেকে বের হয়ে সোজা দৌড়ে এসে পড়ে হরিশবাবুর এখানে। শশী ভট্টাচার্যকে দেখে অবাক হয় হরকান্ত ।

—বেঁচে আছ কাকা? আমি তো ভাবলাম কোথায় নে গেল তোমায় ওইটা। ওটা কি গো ভূত না বেহ্মদত্যি না অন্য কিছু?

হরিশবাবু বলে—ডাকাতের আস্তানাই করেছে। নানারকম মুখোশ পরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একটা সর্বনাশ করার মতলবে আছে ওরা।

শশী ভট্টাচার্য বলে—তা হতে পারে বাবু! ভূত, বেহ্মদত্যি হলে শশী ভট্টাচার্যকে যমের মত ডরাত।

ওরা নির্ঘাত ডাকাত ফাকাতই হবে।

হরিশ এবার ভাবছে কথাটা! বলে সে শশীকে—ওসব কথা বাইরে কোথাও জানাবে না। আমি এবার দেখছি।

তবু সারা শহরে এই নিয়ে নানা আলোচনা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। নীরু সর্দার এখন ঠান্ডা, হরিশবাবুর বাড়িতেও দারুণ ব্যাপার ঘটেছে, শশী ভট্টাচার্যকে নাকি শূন্যে উড়িয়ে দিয়েছিল কারা!

চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে নানা আলোচনা চলছে। মুষড়ে পড়েছে নৃপতিস্যার, গোবিন্দবাবুও।

সেদিন ক্লাসের পর নৃপতিস্যার ফটিককে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে- সেবার পরীক্ষার খাতায় তোর একটা নম্বর যোগ দিতে ভুল হয়ে গেছল বাবা। তাই সেকেন্ড হয়েছিলি, পরে দেখলাম তুই-ই ফার্স্ট হয়েছিস। ভুলের জন্য মনে কিছু করিস না বাবা খাতায় এবার ঠিক করে দিয়েছি। তোর কাছে মানে বসন্ত? ওটা একটা গাড়োল। তুই গুড বয়, স্কুলের গৌরব রে। ফটিক অবাক হয়। আজ তাকে নৃপতিস্যারও যেন ভয় করে।

গোবিন্দস্যার বলে খেলার পর।

—হ্যাঁ। তোকে তখন ঠিক চিনতে পারিনি রে ফটিক। তুই ‘বর্ন প্লেয়ার’। স্কুলের গৌরব। ন্যাশনাল টিমে গিয়ে সেরা খেলোয়াড় হবিরে ।

গোবিন্দবাবুও আজ ফটিককে চটাতে চায় না ।

এক হরিশবাবুর রাগটা বেড়েই চলেছে।

ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন পুলিশ সাহেবের বাংলোতে এসেছে হরিশবাবু। পুলিশ সাহেবের কানেও নানা কথা আসছে। এদিকে শুরু হয়েছে উগ্রপন্থীদের হামলা। কোথায় পুলিশ থানার ওপরও হামলা হয়েছে। পুলিশ এখন খুবই সজাগ।

হরিশবাবুর কথাতে পুলিশসাহেব অবাক হন–সে কি!

হরিশবাবু বলে–ওই বিরাট পোড়ো বাড়িটা এখন বনজঙ্গলে ঢাকা। লোকজনও কেউ যায় না। পিছনেই নদীর খাত, এদিক দিয়ে ওরা যাতায়াত করতে পারে। ওখানেই আড্ডা গেড়েছে বোধহয়। আমার থেকে দু’একজনকে সন্দেহ হতে পাঠিয়েছিলাম, নীরু সর্দারের কি হাল করেছে দেখেছেন। কয়েকদিন আগে শশী ভট্টাচার্যকে তো মেরেই ফেলত ওরা।

পুলিশ সাহেব ভাবছেন কথাটা।

বলেন তিনি—তাহলে একবার সার্চ করা দরকার ওখানে।

হরিশ বলে—তা করুন স্যার। না হলে কে জানে আবার কি সর্বনাশ করবে ওরা। আর গদাধরের ছেলে ওই ফটিক, ওর সঙ্গে ওদের নিশ্চয়ই যোগাযোগ আছে স্যার। ও ছেলেটাকে ধরে এনে একটু চাপ দেন, দেখবেন সব বেরুবে।

পুলিশ সাহেব বলেন-তা-ও দেখব।

হরিশবাবু এবার বলে—কিন্তু আমি যে এসব খবর দিয়েছি গোপন রাখবেন স্যার । না হলে ওদের অসাধ্য কিছু নেই। কিছু করে বসবে। নিরীহ লোক স্যার।

পুলিশ সাহেব বলেন—না, না। এসব কথা কেউ জানবে না।

খুশি হয়ে বের হয়ে আসে হরিশবাবু। এবার গদাধর-ফটিককে একসঙ্গে ঠান্ডা করে দিতে পারবে।

ফটিক এসবের কিছুই জানে না। গদাধর ঘোষও বাইরের কোনো খবরে থাকে না। সকালে স্নান করে গদিতে চলে যায়৷

ফটিকের সামনে পরীক্ষা, ভোরে উঠে পড়তে বসে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। গদাধরও ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ সারা বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ, হাতে বন্দুক, টর্চের আলোয় অন্ধকার উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। গদাধরের ঘুম ভেঙে গেছে। সুধাময়ীও উঠে পড়েছে।

ভীত কণ্ঠে বলে সে—পুলিশ এসেছে বাড়িতে!

-সে কি! গদাধরও চমকে ওঠে।

ততক্ষণে বিরাট পুলিশ বাহিনী ওদের বাড়ি ঘর, ভাঙা বাড়ি জঙ্গল সব ঘিরে ফেলেছে। দারোগাবাবু গদাধরকে দেখে হুঙ্কার ছাড়ে—দেশের শত্রুদের এখানে ঘাঁটি গাড়তে দিয়েছেন মশাই? বোমা গোলাগুলি বন্দুক এসব কোথায় আছে?

গদাধর আকাশ থেকে পড়ে। কাতর কণ্ঠে বলে সে-বিশ্বাস করুন, এ সবের কিছুই জানি না। এখানে ওসব কিছুই নেই।

—নেই। সব খুঁজে বের করব। ঘটিরাম দারোগা আমার নাম। বুঝলেন।

ঘটিরাম না হয় ওর নাম জালারাম হলেই ভালো মানাত।

ওদিকে ফটিককেও টেনে বের করেছে ।

সুধাময়ীর চোখে জল। বলে সে-আমার ছেলে কিছুই জানে না।

ফটিককে দেখে গর্জায় দারোগাবাবু–কে কে আসে এখানে বলো ?

ফটিক অবাক হয়ে জানায়—কেউ আসে না।

—চোপ্। তুলে নে গিয়ে কচুয়া ধোলাই দিলে সব বের হবে। দারোগা গর্জন করে।

সকাল হয়ে গেছে। পুলিশ সাহেবও এসেছেন। সারা শহরের লোকও জমে গেছে। পুলিশ তখনও বনবাদাড়, ভাঙাবাড়ির এদিক ওদিক সার্চ করছে, কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। কেউ থাকে এখানে তারও চিহ্ন নেই। কোনো অস্ত্রশস্ত্র তো দূরের কথা বাঁশের লাঠিও একখানা মেলে না।

পুলিশসাহেব বলেন—কিছুই তো পাওয়া গেল না। এখানে বাইরের লোক থাকারও কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। এসব খবর ঠিক নয় বোধহয়।

দারোগাবাবু কিন্তু কড়া লোক। এর মধ্যে হরিশবাবুর কাছে কিছু বকশিশও মিলেছে। সুতরাং বলে সে—ওই ছেলেটাকে একটু আটকে রেখে জেরা করতে চাই। স্যার। ওরা নিশ্চয়ই এখানে আসে। কোনো রকমে খবর পেয়ে ওইই তাদের সরিয়ে দিয়েছে। আমার ডেফিনিট খবর আছে স্যার।

পুলিশসাহেবও আর বিশেষ কিছু বলেন না। শুধু শোনেন।

—বেশি চাপ দেবেন না। ছেলেটা পড়াশুনায় – খেলাধুলোতে ভালো। দুচারটে কথা জিজ্ঞাসা করে তেমন কিছু না পেলে ছেড়ে দেবেন। না হলে শহরে গোলমাল হতে পারে। ওর সাপোর্টারও কম নেই।

ঘটিরাম আপাতত ধরেই নিয়ে যাবে ফটিককে। ফটিকের মায়ের চোখে জল।

গদাধর বলে—ও কিছু জানে না স্যার। বিশ্বাস করুন এখানে তারা কেউ আসে না। কিন্তু ঘটিরাম নাছোড়বান্দা। বলে-ওকে নিয়ে যাব। দু চারটে কথা জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দেবো। চলো হে !

রাগে দুঃখে ফটিকের দু’চোখ ফেটে জল নামে। আজ বিনাদোষেই তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিল, কে দিয়েছে সেটাও অনুমান করতে পারে সে। কিন্তু বলার কিছুই নেই।

গদাধর আর কোনো পথ না দেখে শহরের বড় উকিল জগদীশবাবুর ওখানেই এসেছে। জগদীশ উকিল সেই দিনের ঘটনার পর থেকে হরিশবাবুর উপর চটেছিল। আজ আবার ফটিককে থানায় নিয়ে যাবার খবর শুনে চটে ওঠেন। লোকটা এমনিতে দয়ালু। বলেন তিনি—আমি দেখছি, আর হরিশবাবুও দারুণ বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। লোকটা খুব বেড়েছে হে।

অন্ধকার ঘরে একা বসে ফটিক। এরপর ঘটিরাম বাড়িতে গেছে স্নান খাওয়া করে ঘুমিয়ে আসবে, তারপর জেরা করবে। হঠাৎ সিরিনকে দেখে চাইল ফটিক।

সিরিন কিছু সন্দেশ আর জলও এনেছে। ফটিক-এর চোখে জল।

সিরিন বলে—হরিশবাবুরই কাজ এসব। ওর ব্যবস্থা এবার করছি। নাও, খেয়ে নাও এসব। ফটিক বলে—খেতে ইচ্ছা করছে না সিরিন। এতবড় বিপদে ফেলল শুধু শুধু আমাদের। সিরিন বলে—ওর সর্বনাশ এবার করছি ফটিক। তোমাদেরও দুঃখের শেষ হবে বন্ধু। এটুকু আমাকে করতেই হবে। নাও—খেয়ে নাও ।

ফটিককে দেখতে এসেছে ঘটিরাম।

ফটিক সন্দেশ জল খেয়ে বসেছে। ঘটিরাম বাইরে এসে হুঙ্কার ছাড়ে—সিপাই, ওকে একফোঁটা জল অবধি দেবে না। শুকিয়ে থাকুক। তবেই সত্যি কথা বলবে।

ফটিকের অবশ্য খাবার বা জলের দরকার এখন নেই। আর জানে সে ওসবের দরকার হলে সিরিন ঠিক এনে দেবে। একজন বন্ধু সে পেয়েছে। তাই এত দুঃখ কষ্টও সইতে পারছে ফটিক। ঘটিরাম দারোগা হরিশবাবুকে দেখে চাইল। আপ্যায়ন করে সে,—আসুন হরিশবাবু। হরিশবাবুও দেখছে গারদের ভিতরে ফটিককে। আর দেখে খুশি হয়েছে এটা বোঝা যায়। তবু ন্যাকামির স্বরে বলে—একে এনেছেন দারোগাবাবু ?

ঘটিরাম গর্জন করে বলে—আর বলবেন না স্যার, ওসব বিচ্ছু ছেলে এর মধ্যেই বাঁদরামি শুরু করেছে। এবার ওকে সিধে করে দেবো। চলুন।

ওদিকের ঘরে নিয়ে গেল দারোগাবাবু হরিশবাবুকে। চা, সন্দেশও আসছে দেখা গেল । ফটিক একা চুপ করে বসে আছে। বেশ মনে হয় তাকে বিপদে ফেলার জন্য একটা চক্রান্ত চলেছে।

একটা শব্দ হতে চাইল ফটিক।

সিরিন এসেছে। ফটিক বলে—হরিশবাবুই আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে বন্ধু। ওই লোকটাই আমাদের সর্বনাশ করবে।

হঠাৎ বাইরে মোট্‌কা বিরাট এক পাহারাদার গর্জন করে ওঠে হাতের লাঠি তুলে—চোপ্‌বে। চেল্লাবি তো ডাণ্ডা মেরে ঠান্ডা বানিয়ে দেবে হামি।

বিরাট বিড়ালের ল্যাজের মত গোঁফ, ইয়া ভুঁড়ি। হঠাৎ সিরিনকে দেখা যায় না, বিরাট চিৎকার ওঠে। ওই বিশাল পাহারাদারকে কে যেন শূন্যে ফুটবলের মত তুলে দিয়েছে, শূন্যে ঝুলছে, পায়ের জুতো খসে পড়েছে। খসে পড়েছে বিশাল ভুঁড়ি ঘেরা বেল্টটা, প্যান্টটা বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে, পাগড়িটা খুলে টাক বের হয়ে গেছে, আর পরিত্রাহি চিৎকার করছে পাহারাদার—জান বাঁচাও, বাঁচাও। মার ডালা।

ওর চিৎকারে দারোগাবাবুও ছুটে আসে, হরিশবাবুও। ঘটিরাম এই দৃশ্য দেখে অবাক, কে যেন পাহারাদারের বিশাল পিপের মত দেহটাকে সশব্দে মেঝেতে ফেলে দিল। ঘটিরাম চিৎকার করে। হঠাৎ ঘটিরামের টুপিটাই উড়ছে উপরে—অ্যাই, অ্যাই !

হরিশবাবু ঘাবড়ে গেছে।

দেখা যায় ঘটিরামবাবুর টুপিটা উড়ে গিয়ে বাইরে অশ্বত্থগাছের ডালে আটকে গেছে, আর পাহারাদার তখনও মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করছে। হরিশবাবু বলে—ভূত! ভূত প্রেতের কাণ্ড দারোগাবাবু।

দারোগাবাবু শিউরে ওঠে—অ্যাঁ ভূত!

দু’চারজন কনস্টেবলও বিচিত্র দৃশ্য দেখে তখন তারস্বরে রাম নাম শুরু করেছে। এর মধ্যে দেখা যায় ঘটিরামবাবুর চেয়ারটা শূন্যে যেন উড়তে উড়তে চলেছে।

চিৎকার করে ঘটিরামবাবু-আই বাপ! চেয়ার ভাগতা হ্যায়! পাড়ো, পাড়ো— চেয়ারটা ওই গাছের উপর বসিয়ে রেখে কে যেন থেমে গেল। ঘটিরামবাবুর টাক ঘামছে। মনে হয় আবার কি ঘটবে কে জানে ।

ঘটিরাম বলে হরিশবাবুকে—এসব ঝামেলায় আমি নেই হরিশবাবু। ও ছেলেটার ওখানে কিছু পাওয়া যায়নি। ওকে ছেড়েই দিচ্ছি।

ফটিককে ডাকে ঘটিরাম–বাইরে এসো ফটিক। যাও বাবা, আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই । ফটিক অবাক হয় ৷

দেখা যায় ঘটিরামের চেয়ার উইথ টুপি আবার শূন্যে যেন উড়ে এসে যথাস্থানেই বসল। দারোগাবাবু ফটিককে ছেড়ে দিতে দেখে রেগেমেগে বের হয়ে যায় হরিশ। শাসায়—পুলিশ সাহেবের কাছে যাব। দরকার হয় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছেই যাব।

ঘটিরামবাবু বলে—আর এইসব ব্যাপারে আমি নেই। দেখলাম কাণ্ড। আপনিও অনেকের অনেক সর্বনাশ করেছেন মশাই। তাই বলছি এবার সাবধান হোন ।

হরিশবাবু রেগে বের হয়ে গেল।

তার মত মানী লোককেও এবার দারোগা অবধি অপমান করেছে। এর শোধ নিতেই হবে। হরিশবাবু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছেই গেছে আজ। এবার খুশি হয়েই ফিরেছে হরিশবাবু। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ব্যবস্থা নেবেন। রাত্রি নেমেছে। হরিশ এখন সাবধান হয়েছে। সুরক্ষিত বাড়ি তার। ঘরে কালোবাজারির ব্যবসার প্রচুর লোক ঠকানো টাকা তার আছে। আর সোনার বাট ও রয়েছে সুরক্ষিত আলমারি ঠাসা। অন্য আলমারিতে রাজ্যের লোক ঠকানো দুনম্বরি জাল দলিল, কাগজপত্র সব বোঝাই।

এ ঘরটা খুবই পোক্ত। দেওয়ালে পোঁতা ওই দামি আলমারিগুলো । দরজায় লোহার মজবুত গেট। জানলাগুলোয় ডবল গ্রিল দেওয়া ।

হরিশ ঘরে বসে রাতের বেলায় হিসাবপত্র করছে। হঠাৎ চোখ ধাঁধানো একটা তীব্র আলোর রেখা দেখে চাইল। আলোর উজ্জ্বল বিন্দুটা জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে।

চোখ ঝলসে ওঠে। সামনে বিচিত্র একটা মূর্তি। সাদা দেহ মাথায় দুটো শুঁড় মত, চিৎকার করতে যাবে হরিশ, ওর চোখের নীলাভ উজ্জ্বল জ্যোতিটা এসে লাগে তাকে।

তার চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে গেছে। নড়বার সামর্থ্যটুকুও নেই।

ওই আলোর রেখাটা আলমারির তালাগুলোকে গলিয়ে দিচ্ছে, পাল্লাগুলো খুলে যায় । ঘরময় টেনে ফেলছে পাঁজা পাঁজা নোট, সোনার বাট।

ছটফট করছে হরিশ। কিন্তু হায় কিছু করতেও পারে না। হাত পা-ও নড়ছে না। কণ্ঠস্বরও নীরব হয়ে গেছে। ওই বিচিত্র জীবটা তার সামনে আলমারি থেকে এক তাড়া দলিল, কাগজপত্র নিয়ে আবার জানলা দিয়ে বের হয়ে গেল।

সারা ঘর তছনছ হয়ে আছে। ও চলে যাবার পর চিৎকার করছে হরিশ। বাড়ির লোকজন জুটে যায়। বসন্তও ছুটে আসে। হরিশ পাগলের মত চিৎকার করে।

—সর্বনাশ হয়ে গেছে। থানায় খবর দে! ওরে বাবা ।

পুলিশ সাহেব, দারোগাবাবু এসে ঘরে ঢুকেই চমকে ওঠে ওই লাখকয়েক টাকার নোট আর সোনার বাট দেখে ।

পুলিশসাহেব বলেন—এত এত টাকা, এত লাখ টাকার বেআইনি সোনা আপনার ঘরে? কোথা থেকে পেয়েছেন এসব ?

হরিশের এবার খেয়াল হয় হাজারো মানুষকে ঠকিয়ে এসব করেছে সে। তার কোনো হিসাবই নেই। এটা সামাজিক অপরাধ। আর আজ হাতে নাতে ধরা পড়ে গেছে।

হরিশ এবার পুলিশসাহেবের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে।

বাঁচান স্যার।

পুলিশসাহেব বলেন–এসব আপাতত সরকারে জমা পড়বে। তারপর হিসাব দেখিয়ে

ফেরত পাবেন ।

এতদিন শয়তানি করে, এত লোকের সর্বনাশ করে জমানো টাকা—সোনা সব আজ সরকারে জমা হয়ে গেল। আর্তনাদ করে হরিশ—মরে যাব স্যার।

পুলিশসাহেব বলেন—আমাদের আইন মত কাজই করতে হবে।

সারা শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে।

ওদিকে সিরিন গেছে ফটিকের কাছে। ওর হাতে ওদের বাড়ি, জমি, বাগান, পুকুর, মিথ্যা মামলা সাজিয়ে দলিল জাল করে কেড়ে নেবার কাগজপত্র নিয়ে।

সিরিন বলে—এগুলো তোমার বাবাকে দিয়ে বলো ভালো উকিলকে দেখাতে। তোমাদের ঠকিয়ে জালিয়াতি করে হরিশ যা নিয়েছিল তা ফেরত পাবে ।

গদাধর ঘোষ যেন স্বপ্ন দেখছে। হ্যাঁ—এসব দলিল জাল।

আর জগদীশ উকিল ওসব কাগজপত্র দেখে বলেন গদাধরকে—আজই কোর্টে জালিয়াতির মামলা করছি। হরিশ যে এতবড় শয়তান তা জানতাম না ।

গদাধর বলে—কিন্তু টাকা পয়সা তো আমার নেই উকিলবাবু।

জগদীশ উকিল শহরের সবচেয়ে নামি উকিল। পয়সার অভাব তার নেই। ভালো মামলা পেলে বিনা খরচেই করে। জগদীশবাবু বলে-এতবড় শয়তানকে শাস্তি দেওয়া মানুষের কর্তব্য হে। এর জন্য তোমার খরচা লাগবে না গদাধর। আমি দেখছি।

হরিশ-এর টাকাকড়ি চোরাই সোনাদানা সব গেছে। এবার এই জালিয়াতির মামলায় পড়েছে। এতদিন অন্যায় অত্যাচার করে সারা এলাকার মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তার সাম্রাজ্য গড়েছিল হরিশ। সেই সাম্রাজ্য, সেই প্রাসাদ আজ তাসের প্রাসাদের মত ধসে পড়েছে।

সারা শহরের লোক আদালতে ভেঙে পড়েছে। হরিশবাবুও ভাবতে পারে না যে তার এত শত্রু ছিল। এতদিন এরাই তাকে খাতির করে এসেছে। আজ সেই হাজারো বঞ্চিত মানুষ এসে ভিড় করেছে ধিক্কার জানানোর জন্য।

তার চোরা কারবার, সিমেন্টে বালি মেশানোর ব্যাপার–আর ওই জালিয়াতির অনেক খবরই পুলিশ বার করেছে।

গদাধর ঘোষ তার হারানো সম্পত্তিগুলো ফিরে পায় আর জালিয়াতি-প্রবঞ্চনা ওইসব নোংরা অসামাজিক কাজের শাস্তি হিসাবে হরিশ-এর কারাবাসের ব্যবস্থা হয়ে যায় ।

চমকে ওঠে হরিশ। আজ তার করার কিছুই নেই। গদাধর ঘোষের দুঃখের দিন বদলাচ্ছে। সুধাময়ী বলে,—বলিনি গো, দুঃখকষ্ট চিরকাল থাকে না। সৎপথে থাকলে সব কষ্ট সয়েও মানুষ আবার দাঁড়াতে পারে।

কথাটা আজ গদাধরও বিশ্বাস করে।

আজ সে আবার সব ফিরে পাচ্ছে।

এবার ফটিকও অ্যানুয়াল পরীক্ষায় আবার ফার্স্ট হয়েছে। বসন্ত কোনো পজিশন পায়নি, টেনেটুনে পাস করেছে মাত্র।

ফটিক সেদিন স্কুলে খবরটা পায়।

হেডস্যার তাকে অফিসে ডেকে বলেন–জাতীয় টিমে খেলতে যাবার চিঠি এসেছে ফটিক। সামনের মাসেই যেতে হবে। এই জেলার মধ্যে তুমিই চান্স পেয়েছ।

আজ গোবিন্দস্যারও বদলে গেছে। বলে সে-তুই স্কুলের গর্ব রে! জিততেই হবে। সন্তোষবাবু, গজেনস্যার বলেন – চেষ্টা করবি ফটিক, বি সিনসিয়ার, দেখবি জীবনে সব বাধা উত্তীর্ণ হয়ে এগিয়ে যাবি ।

ফটিক আজ ওদের প্রণাম করে।

আজ তার খুশির দিন।

বৈকালে বাড়ি ফিরে, গেছে সেই ঝিলের দিকে। সেই নীরব নির্জন ঠাঁইটা তার ভালো লাগে। সে আর সিরিন এখানে বসে কথা বলে। ওই তার নিকটতম বন্ধু ৷

আজও সিরিন এসেছে।

মিটিমিটি হাসছে সে ।

ফটিক বলে—তোমার জন্যই আজ সব ফিরে পেয়েছি বন্ধু। তুমি আমার জন্য অনেক

করেছ।

সিরিন বলে—এ বন্ধুর প্রতি বন্ধুর কর্তব্য ফটিক। তার বদলে তুমিও আমাকে অনেক কিছু দিয়েছ। এই পৃথিবীকে দেখে গেলাম, চিনে গেলাম। বুক ভরা ভালোবাসা পেয়ে গেলাম। ফটিক দেখছে ওকে। সিরিনের মাথার ছোট শুঁড় দুটো নড়ছে। বলে সে—আমাদের গ্রহের জীবরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। তারা সব কিছু করতে পেরেছে। প্রাণের উৎসের সন্ধানও পেয়েছে। আমার মত জীবদের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু একটা জিনিসের সন্ধান আমাদের গ্রহের বিজ্ঞান আজও পায়নি, সেটা হচ্ছে ভালোবাসা ।

যন্ত্র ভালোবাসতে জানে না। ওটা ছাড়া সৃষ্টির কোনো সার্থকতাই নেই বন্ধু ।

তাই সেই দূর নক্ষত্রলোক থেকে আমরা আসি এই পৃথিবীতে, মানুষের কাছে ভালোবাসার সন্ধান পেতে। আর সেই নিবিড় ভালোবাসার স্পর্শে তুমি আমাকে সার্থক করেছ বন্ধু। তার জন্য আমার অসীম ক্ষমতা দিয়ে তোমার জন্য সামান্য কিছু করেছি মাত্র।

আজ আমার কাজ শেষ। আমাকে তাই ফিরে যেতে হবে বন্ধু।

চমকে ওঠে ফটিক।

এতদিন ওই বিচিত্র জগতের জীবই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিনরাতের সঙ্গী। আজ তাকে হারাতে হবে। বড় বেদনায় ফটিক বলে—তুমি চলে যাবে?

হাসে সিরিন–হ্যাঁ বন্ধু। আমার থাকার আর উপায় নেই। যে সঞ্চিত শক্তিটুকু দিয়ে আমাকে ওরা পাঠিয়েছিল এই জগতে তা ফুরিয়ে আসার আগেই আমাকে চলে যেতে হবে। বৈকালের আলো মুছে সন্ধ্যা নামছে।

দু’একটা তারা ফুটে ওঠে। হঠাৎ শান্ত অরণ্যভূমি, ঝিলের জলে জাগে তুমুল আলোড়ন গাছগুলো যেন ভেঙে পড়বে। তীব্র গর্জন ওঠে। একটা আলোর বৃত্ত নেমে আসছে। আরও নীচে, হঠাৎ দেখা যায় সিরিন আর নেই।

ওই বৃত্তটাও জ্বলন্ত অগ্নিপুঞ্জের মত আকাশে উঠে দূর তারার ভিড়ে হারিয়ে গেল। ঝিল—বনরাজ্যে আবার শান্তি নামে।

একাই দাঁড়িয়ে আছে ফটিক। তবু ডাকছে সে–সিরিন— সিরিন—বন্ধু। আজ আর কেউ সাড়া দেয় না।

তার বন্ধু আজ আবার কোনো দূর সবুজ নক্ষত্রের দেশে ফিরে গেছে। আর কোনোদিনই আসবে না। ফটিকের দুচোখে জল নামে। সিরিন বোধহয় এ খবরও আর রাখবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *