1 of 2

অদৃশ্যের কীর্তি

অদৃশ্যের কীর্তি

এক

বিমল আর কুমারের জন্যে ভৃত্য রামহরি যখন বৈকালী চা নিয়ে এল, কুকুর বাঘা তখন টেবিলের তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে সেইসব স্বপ্ন দেখছিল, কুকুর ছাড়া আর কেউ যে স্বপ্ন দেখতে পারে না।

কিন্তু রামহরি চা আনবামাত্র বাঘার ঘুম চট করে ভেঙে গেল। সে প্রথমে মাথা তুললে, তারপর চায়ের টেবিলের দিকে মুখ ফিরিয়ে দুই-তিন বার নাক কুঁচকে গন্ধ নিয়েই টের পেলে, চায়ের সঙ্গে আজ চপ, কাটলেট, ওমলেট বা আমিষের কোনো সম্পর্কই নেই! অতএব বাঘা আর অকারণে চতুষ্পদে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শরীরকে কষ্ট দিতে চাইলে না। সে আবার চোখ মুদে স্বপ্নলোকে ফিরে গেল।

সসার স্যান্ডউইচ সহযোগে বিমল ও কুমার পেয়ালার চা শেষ করতেই নীচে থেকে ডাক শোনা গেল, ‘বিমলবাবু! কুমারবাবু! বাড়িতে আছেন নাকি?’

কুমার বললে, ‘ইন্সপেক্টর সদানন্দবাবুর গলা না? রামহরি, ওঁকে ওপরে নিয়ে এসো।’

সদানন্দবাবু ভিতরে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের ওপর স্পষ্ট ফুটে উঠেছে অত্যন্ত দুর্ভাবনার চিহ্ন।

বিমল শুধোলে, ‘ব্যাপার কী সদানন্দবাবু? কোনো শক্ত মামলা ঘাড়ে পড়েছে নাকি?’

চেয়ারের ওপরে বসে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সদানন্দবাবু বললেন, ‘হাঁ, একটা শক্ত মামলায় জড়িয়ে পড়েছি বটে, কিন্তু এ মামলায় পুলিশ না ডেকে রোজা ডাকাই উচিত।’

কুমার বললে, ‘তার মানে? ব্যাপারটা ভৌতিক নাকি?’

বিমল বললে, ‘পুলিশ কেস নিয়ে আমাদের কথা কওয়া উচিত নয়, কারণ গোয়েন্দাগিরির কিছুই আমরা জানি না। কিন্তু ব্যাপারটা যদি ভৌতিক হয়, তাহলে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে রাজি আছি।’

সদানন্দবাবু বললেন, ‘তাহলে আপনিও ভূত মানেন?’ বিমল ভুরু কুঁচকে বললে, ‘ভূত? মোটেই নয় মশাই, মোটেই নয়! কিন্তু ভূতের গল্প শুনতে আমি ভারী ভালোবাসি!’

সদানন্দবাবু বললেন, ‘ভূত-টূত আমিও মানতুম না মশাই। কিন্তু যে বেয়াড়া মামলায় পড়েছি, সেটাকে ভৌতিক ছাড়া আর কী বলব বুঝতে পারছি না।’

বিমল বললে, ‘আপাতত হাতে কাজ নেই। আপনার ভূতের গল্প মন্দ লাগবে না। বলুন।’

দুই

সদানন্দবাবু বলতে লাগলেন:

ভূতের দৌরাত্ম্যের কথা প্রায়ই শোনা যায়। অমুক বাড়িতে চারিদিক থেকে ইট-পাটকেল পড়ছে, নানারকম গোলমাল হচ্ছে—এমনি সব অভিযোগ প্রায়ই থানায় আসে। কিন্তু সদলবলে তদন্ত করতে গিয়ে প্রায়ই আমরা আবিষ্কার করি যে, সেসব উৎপাতের মূলে আছে পাড়ার সব দুষ্টু লোক। ভেবেছিলুম, এবারের ব্যাপারটাও সেই শ্রেণির।

অভিযোগ এসেছে জোড়াসাঁকোর চৌধুরি বাড়ি থেকে। চৌধুরিরা হচ্ছেন কলকাতার বনেদি পরিবার, তাঁদের বসত বাড়ির বয়স দেড়শো বছরের কম হবে না। বাড়িতে ভূতের উৎপাতের কথা কখনো শোনা যায়নি।

কিন্তু কিছুদিন থেকে সেখানে হঠাৎ যেসব কাণ্ড শুরু হয়েছে তা অত্যন্ত আশ্চর্য! আচম্বিতে দুমদাম করে জানলা-দরজা খুলে যায়, টেবিল-চেয়ারগুলো জ্যান্ত হয়ে ঘরময় ছুটোছুটি আর পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে ভেঙে খান-খান হয়ে যায়, যাদের শূন্যে ওড়বার কথা নয়, সেইসব বাসন-কোশন শূন্যে উঠে পাখির মতো খানিক এদিক-ওদিক করে আবার মাটির ওপরে আছড়ে পড়ে। অথচ কারা যে এসব কাণ্ড করছে, তা দেখা কী বোঝা যায় না। ধনী চৌধুরির বাড়ির সর্বত্র শিখ-গুর্খা দ্বারবানের পাহারা, কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর কীর্তি দেখে তারা দস্তুরমতো হতভম্ব হয়ে গেছে।

খবর পেয়ে চৌধুরি বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। তখন সকাল বেলা, দিনের আলোয় কোনোদিকে আবছায়া নেই। আমি বাড়ির চারিদিকে পাহারাওয়ালাদের দাঁড় করিয়ে দিলুম, তাদের ওপরে হুকুম রইল, কারুকে যেন বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে না দেয়।

তারপর বাড়ির ভিতরে ঢুকলুম। সর্বপ্রথমেই আমাকে ভয়াবহ অভ্যর্থনা করলে একখানা থান ইট। কোথা থেকে কে যে ছুড়লে কিছুই বুঝতে পারলুম না। কিন্তু ইটখানা শোঁ করে আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গিয়ে দুম করে দেওয়ালের ওপরে গিয়ে পড়ল।

চৌধুরিদের কর্তা বগলাবাবু বললেন, ‘দেখলেন তো?’

আমি মাথা বাঁচাবার জন্যে তাড়াতাড়ি সামনের একটা ঘরে ঢুকে পড়ে বললুম, ‘এই কাণ্ড কি সর্বদাই হচ্ছে?’

‘সর্বদাই! স্থান-কাল-পাত্র নেই, বাড়ির যেখানে মানুষ থাকে সেইখানেই উপদ্রব। কিন্তু উপদ্রবে আমাদের প্রাণ এরই মধ্যে যায়-যায় হয়ে উঠেছে। ঘরের কোনো দরজা বন্ধ রাখবার উপায় নেই, ভিতর থেকে বন্ধ করলে দরজার খিল কখনো আপনি খুলে যায়, কখনো বাইরে থেকে এমন ধাক্কার-পর-ধাক্কা পড়তে থাকে যে আমরাই খুলে না-দিয়ে পারি না; অথচ দেখতে পাই না কারুকেই! বাড়ির আসবাবপত্তর ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে এই ঘরেরই অবস্থা দেখুন না।’

ঘরের ভিতর তাকিয়ে দেখলুম, চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। কোথাও একখানা প্রকাণ্ড দেয়াল-আয়না মেঝের ওপর চুরমার হয়ে রয়েছে, কোথাও একখানা ভাঙা চেয়ার বা ওলটানো টেবিল, আবার কোথাও-বা ছিঁড়ে-পড়া আলোর ঝাড়ের টুকরো ছড়ানো।

একদিকে তখনও দু-খানা আস্ত চেয়ার ছিল। আমি বসবার জন্যে তাদের একখানার দিকে অগ্রসর হলুম।

হঠাৎ চেয়ারখানা জীবন্ত হয়ে এমন অপূর্ব তাণ্ডব নাচ শুরু করে দিলে যে, উদয়শঙ্করও দেখলে অবাক হয়ে হার মানতেন! আমি যতই তাকে হাতে-নাতে গ্রেপ্তার করবার চেষ্টা করি, সে ততই আমার হাত ছাড়িয়ে নাচতে নাচতে এঁকে-বেঁকে তফাতে সরে যায়!

তখন হার মেনে চেয়ারখানাকে ছেড়ে আমি তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে ঘরের দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়ে বললুম, ‘ঘরের ভিতর যদি কেউ এসে থাকে, তাহলে দেখি সে কেমন করে বেরিয়ে যায়’ বলেই বন্ধ দ্বারের ওপরে পিঠ রেখে দাঁড়ালুম।

আমার মুখের কথা ফুরোতে-না-ফুরোতেই নৃত্যশীল চেয়ারখানা সশব্দে আমার বদলে মেঝের উপর পড়ে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল! পরমুহূর্তেই শুনলুম, খিল খোলার ও দড়াম করে দরজা খোলার শব্দ! ফিরে দেখি, যে দরজা স্বহস্তে বন্ধ করে দিয়েছি আবার তা খুলে গেছে— অর্থাৎ ঘরের ভিতর যাকে বন্দি করতে চেয়েছিলুম সে আর ঘরের ভিতর নেই!

বগলাবাবু শুকনো গলায় বললেন, ‘দেখছি আজ থেকে মানুষেরও ওপর আক্রমণ আরম্ভ হল!’

‘নাঃ, এ বাড়িতে আর থাকা চলে না!’—

আমি বললুম, ‘রহস্য এখনও আমি বুঝতে পারছি না। বগলাবাবু, আমাকে বাড়ির সব ঘর একে একে দেখান দেখি!’

প্রথমে বাড়ির একতলায় ঘরগুলো পরীক্ষা করতে লাগলুম। সাত-আটখানা ঘর পরীক্ষা করবার পর একখানা অদ্ভুত ঘর দেখলুম, একটিমাত্র দরজা ছাড়া তার কোথাও কোনো জানলা নেই। সে যেন গুহাঘর!

বগলাবাবু বললেন, ‘এখানা হচ্ছে কর্তাদের আমলের ঘর। এমন অন্ধকূপ তাঁরা যে কেন তৈরি করিয়েছিলেন কেউ তা জানেন না। আমি এটাকে গুদাম ঘর করে রেখেছি।’

ঘরে ঢুকে দেখলুম, তার ভিতরে রয়েছে অনেক পুরোনো আসবাব ও যজ্ঞিবাড়িতে ব্যবহার করবার জন্যে বড়ো বড়ো কড়া, পিতলের হাঁড়ি, থালা ও গামলা প্রভৃতি তৈজসপত্র।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘খালি ঘরে উপদ্রব হয় না?’

বগলাবাবু বললেন, ‘নাঃ, আগেই তো বলেছি, যেখানে মানুষ থাকে না, সেখানে উপদ্রবও হয় না। ঘরের মেঝেতে কীরকম পুরু ধুলো জমে আছে, দেখছেন তো? এঘরে আমরা আসি কালে-ভদ্রে কদাচ! কিন্তু ও কী! দেখুন, দেখুন!’ বলেই তিনি অঙ্গুলি নির্দেশে দরজার নীচের দিকটা দেখিয়ে দিলেন।

স্তম্ভিত নেত্রে দেখলুম, দরজার সামনেই ধূলিধূসরিত মেঝের ওপরে দাগের-পর-দাগ পড়েছে। সে দাগ কী করে কেন হচ্ছে জানি না। সেগুলো ঠিক যেন চোখের অগোচরে শূন্য থেকে ঝরে পড়ছে আর ঝরে পড়ছে! সে দাগগুলি যদি পায়ের দাগ হয় তাহলে তেমন অদ্ভুত পায়ের দাগ আমি জীবনে দেখিনি! কেউ যেন ঠিক হাতের মতো দেখতে অদৃশ্য পায়ের আঙুলগুলো ছড়িয়ে পাঁচ আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে হেঁটে ঘরের ভিতর ঢুকছে!

আমরা দু-জনেই আতঙ্কে শিউরে উঠে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালুম এবং সেখান থেকেই পেলুম সেই আঙুল ছড়ানো হাতের মতো, অদৃশ্য পায়ের ভীষণ দাগগুলো আবার বাইরের দিকে এগিয়ে আসছে। পদশূন্য পদচিহ্ন!

আমি কাপুরুষ নই, পুলিশে চাকরি নিয়ে অনেক গুন্ডা, খুনে আর ডাকাতের সঙ্গে নির্ভয়ে লড়াই করেছি। ভূত-প্রেতও কখনো মানিনি। কিন্তু স্পষ্ট দিনের বেলায় এই অপার্থিব দৃশ্য স্বচক্ষে দেখে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভরসা হল না। কোনোরকমে সপ্রতিভ ভাব বজায় রেখে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে পড়লুম।

‘এখন বলুন বিমলবাবু, একী ভৌতিক কাণ্ড, না ভোজবাজি, না আমরা জেগে-জেগেই স্বপ্ন দেখেছি?’

তিন

বিমল অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগল।

তারপর বললে, ‘সদানন্দবাবু, আমি ভূত মানি না।’

‘তবে এসব কী?’

‘পরে হয়তো বলতে পারব। আপাতত একটা কাজ করতে পারেন।’

‘কী কাজ, বলুন?’

‘বগলাবাবুকে গিয়ে বলুন, যেখানে পায়ের দাগ দেখেছেন, সেই গুদোমঘরের দরজার সামনে তিনি যেন একটা খুব মজবুত কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দেন।’

‘তাতে লাভ?’

‘পরে বুঝতে পারবেন।’

দুই দিন পর সদানন্দবাবু এসে বললেন,

‘বিমলবাবু, আপনার কথামতো কাজ করা হয়েছে, যদিও আপনার এ খেয়ালের কোনোও অর্থই হয় না।’

বিমল হেসে বললে, ‘আমার খেয়াল নিয়ে ভেবে আপনি মাথা খারাপ করবেন না সদানন্দবাবু। চলুন, এখন আমরা বগলাবাবুর বাড়িতে যাই। কুমার, তুমিও আসবে নাকি?’

কুমার বললে, ‘সে কথা আবার বলতে? তুমি আর আমি হচ্ছি কায়া আর ছায়া!’

বগলাবাবুর মস্ত বড়ো অট্টালিকার কাছে গিয়ে দেখলে, বাড়ির সামনে কৌতূহলীদের বিষম জনতা! ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলে কয়েকজন প্রেততত্ত্ববিদ ও খবরের কাগজের রিপোর্টার প্রশ্নের-পর-প্রশ্নে বগলাবাবুকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।

সদানন্দবাবু বিমলের সঙ্গে বগলাবাবুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিমল বললে, ‘আমি প্রথমেই আপনাদের গুদোমঘরে যেতে চাই।’

বগলাবাবু বললেন, ‘আসুন, এই পথে।’

একতলার দালান দিয়ে এগুতে-এগুতে বিমল জিজ্ঞাসা করলে, ‘আচ্ছা বগলাবাবু, খালি ঘরে কি কোনো উপদ্রবই হয় না?’

‘না। যেখানে মানুষ যায়, ভূত যেন সেখানেই তার পিছু নেয়। সে যেন আমাদের চোখের সামনে ভয় দেখিয়ে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চায়! ওই দেখুন, কী কাণ্ড!’

দালানের দেয়ালে একটা মস্ত গোল ঘড়ি টাঙানো ছিল, হঠাৎ সেটা দেয়াল থেকে খসে মাটিতে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। প্রেততত্ত্ববিদরা ও কাগজের রিপোর্টাররা প্রাণপণে পদচালনা করে এক মুহূর্তে সেখান থেকে অদৃশ্য হল।

কুমার বললে, ‘আমি তো তাই চাই!’

বগলাবাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘এই আমার গুদোমঘর। আপনাদের কথামতো দরজার পাল্লার সঙ্গেই আমি কলাপসিবল গেটটা তৈরি করে দিয়েছি। কিন্তু এতে কী উপকার হবে জানি না।’

গেটটা খুলে পরীক্ষা করতে করতে বিমল বললে, ‘পৃথিবীতে সত্যিই যদি অশরীরী ভূত থাকে তাহলে কোনো উপকারেই হবে না; কিন্তু—’ মুখের কথা শেষ না-করেই সে ঘরের ভিতর গিয়ে দাঁড়াল।

ঘরটি মাঝারি। কোথাও জানলা নেই বলে ভিতর দিকটা দিনের বেলাতেই অন্ধকার, চোখ চলে খালি দরজার কাছেই।

সদানন্দবাবু অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘এই দেখুন বিমলবাবু, সেই দাগগুলো—’

পুরু ধুলোর ওপরে মানুষের পায়ের দাগের সঙ্গে আরও যে চিহ্নগুলো রয়েছে তাদের পদচিহ্ন বলে সন্দেহ হয় না, কারণ মানুষ বা পশু কোনো জীবেরই পায়ের দাগ সেরকম নয়! দুই হাতের আঙুল ছড়িয়ে আঙুলের ডগাগুলো ধুলোর ওপরে রাখলে এইরকম দাগ হতে পারে বটে। কিন্তু কেবল দুই হাতে ভর দিয়ে মানুষ তো হাঁটে না!

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সদানন্দবাবু, ‘বিমল, বিমল! এই দ্যাখো, ধুলোর ওপরে আবার নতুন দাগের সৃষ্টি হচ্ছে!’

সবই আড়ষ্ট ও স্তব্ধ হয়ে দেখতে লাগল, জোড়া জোড়া দাগ ঘরের অন্ধকারের দিকে অগ্রসর হয়ে গেল। তারপরেই এক প্রকাণ্ড একটা পিতলের গামলা তুলে মাটির ওপরে আছড়ে ফেললে, সশব্দে!

বিমল বলে উঠল, ‘শিগগির সবাই বাইরে চলুন!’

এক এক লাফে প্রত্যেকেই বাইরে এসে পড়ল। বিমল ক্ষিপ্র হস্তে কলাপসিবল গেট টেনে বড়ো বড়ো দুটো তালা লাগিয়ে ও দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিলে!

তারপরেই ঘরের ভিতরে জেগে উঠল সে কী কান ফাটানো অমানুষিক ক্রুদ্ধ গর্জন এবং সঙ্গে-সঙ্গে বদ্ধ দরজার ওপরে ভীষণ ধাক্কার-পর-ধাক্কা! সেরকম বীভৎস ও রক্ত-ঠান্ডা-করা গর্জন পৃথিবীর কোনো জীবের কণ্ঠেই কেউ কখনো শোনেনি। সে যেন একসঙ্গে সিংহ, বন্য মহিষ ও অজগরের উন্মত্ত চিৎকার!

বিমল বিপুল আনন্দে বলে উঠল, ‘যা ভেবেছি, তাই! বগলাবাবু, আর কেউ আপনাদের ওপরে অত্যাচার করবে না, শত্রু এখন বন্দি!’

‘তার মানে?’

‘বৈঠকখানায় চলুন। বুঝিয়ে বলছি।’

চার

সকলে বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। বিমল বলতে লাগল:

আমি ভূত মানি না।

প্রায়ই শুনি ভূতের অত্যাচারের গল্প। তাকে দেখা যায় না, অথচ সে ঢিল ছোড়ে, জিনিসপত্তর ভাঙে, চ্যাঁচায় বা নানান শব্দ করে। আমার বরাবরই বিশ্বাস ছিল, এসব ভূতের কীর্তি নয়। আজ সেই বিশ্বাস দৃঢ় হল।

সদানন্দবাবুর মুখে যখনি শুনলুম, এখানে যে উপদ্রব করছে তাকে দেখা যায় না বটে, কিন্তু ঘরের ভিতরে আসতে বা ঘর থেকে বেরুতে হলে তার দরজার দরকার হয়। তখনি বুঝলুম এসব উপদ্রবের মূলে আছে কোনো অদৃশ্য জীব। আর ঘরে পুরে দরজা বন্ধ করলেই তাকে আটক করা যাবে।

অদৃশ্য জীবের কথা শুনে আশ্চর্য হবেন না। বাতাসও অদৃশ্য, কিন্তু আমরা তার অস্তিত্ব অনুভব করি। অদৃশ্য হলেও মৃদু বাতাস হালকা নিরেট জিনিস নিয়ে ছোড়াছুড়ি করতে পারে। বাতাস যখন ঝড় হয়ে দাঁড়ায় তখন সে বাড়িঘরও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। মরুভূমির বালির ওপরে বাতাস কতরকম দাগ কাটে, তাকে বাতাসের পদচিহ্ন বললে ভুল হয় না। অদৃশ্য বাতাসের পক্ষে যা সম্ভব অদৃশ্য জীবের পক্ষেও তা অসম্ভব নয়। ফুটবলের ভিতরে বাতাসকে বন্দি করা যায়, এই অদৃশ্য জীবকেও আজ আমি ঘরের ভিতরে দরজা বন্ধ করে বন্দি করেছি।

বিরাট বিশ্বে গ্রহে-উপগ্রহে কত রহস্যময় জীব আছে। মানুষের অসম্পূর্ণ জ্ঞান এখনও তা আবিষ্কার করতে পারেনি। হিমালয়ের দানব-মানুষের কথা সবে জানা গিয়েছে। মঙ্গল গ্রহেও নূতন এক জীবের কথা সবে প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং চন্দ্র বা অন্যান্য গ্রহে কোনোরকম জীব নেই একথা জোর করে বলা চলে না। কে জানে তাদের কেউ কেউ হয়তো মাঝে মাঝে পৃথিবীতে বেড়াতে আসে, আর আমরা তাদের ভূত ভেবে ভয় পাই।

বগলাবাবু, আপনাদের বিভীষিকাকে আমি বন্দি করেছি। বেশি দিন ওখানে বন্ধ থাকলে হয়তো সে অনাহারে মারা পড়বে। তাকে মুক্তি দিলেও হয়তো সে আপনাদের আক্রমণ করবে। অতএব আপনাদের কর্তব্য আপনারাই স্থির করুন, আমি এখন বিদায় হলুম—নমস্কার মশাই, নমস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *