অথ বারমঙ্গল কাব্য
নাহ, এ বার আদালতের বার নয়, জিমন্যাশিয়ামের প্যারালাল বার নয়, ক্যাডবেরির চকোলেট বার তো নয়ই, সাপ্তাহিক দিনের হিসেবও নয়, বুঝতেই পারছেন এখানে কোন বারের কথা বলতে চলেছি। আমার মতন অনেক অভাগার জন্যেই জীবনমরুতে এইসব মরূদ্যান হল যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী এবং জীবনান্তে ক্যাওড়াতলা। আমার এই গল্পরাজি শুধুই তাহারে লক্ষ্য করে!
ইহাতে কেহ ঘটনা খুঁজিবেন না, কারণ উহা নাই। শুধুমাত্র কিছু ভালোলাগা আপনাদের সহিত শেয়ার করিয়া লইলাম।
দুহাজার চোদ্দর প্রখর মধ্যফেব্রুয়ারি। গ্রীষ্মস্যপ্রথমদিবসে সল্টলেকের অফিসে বসে থম মেরে বসে আছি। খানিকক্ষণ আগে মোহমুদগরসম তিতিক্ষায় রিজিওনাল ডেটাধর্মাধিকরণ জানিয়ে গেছেন যে, যেভাবে সেলপত্তর চলছে,তাতে এই ফিনান্সিয়াল ইয়ারের টার্গেট হবে না, হতে পারে না। কা তব টার্গেট, কস্তে ইন্সেন্টিভঃ ইত্যাদি ইতাদি….
শুনেই চড়াৎ করে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো।এদ্দিন ধরে ক্রেডিট কার্ডে যে চল্লিশ ইঞ্চি এলইডি টিভি,দামি মাইক্রোওয়েভ আভেন, তিনশো আশি লিটারের ফ্রিজ, এসবই কিনলুম ইন্সেন্টিভের আশায়, সে কি সবই গাধার ইয়েতে যাবে নাকি? ইল্লি আর কি!
কেবিনের দরজা বন্ধ করে এরিয়া ম্যানেজার দের কনফারেন্স কলে ধরলুম।
চল্লিশ মিনিট বাদে উদ্দাম উস্তুমকুস্তমের পর যখন পষ্ট শুনলুম ওড়িশার এএসএম মহাপাত্র ‘হায় জগঅন্নাথঅ’ বলে দমাস করে পড়ে মূর্ছা গেলো, নর্থ ইস্টের ম্যানেজার আশিষ ঝা যথেষ্ট শ্রবণবোধ্য রেঞ্জে বিড়বিড় করতে লাগলো যে এমন হারামি বস হবে জানলে এমন কোম্পানিতে ও জয়েনই করতো না, বিহারনরেশ বৈদ্যাধিপতি সেনগুপ্তবাবু স্থিরস্বরে প্রশ্ন করলেন যে এমুহূর্তেই রেজিগনেশন লেটার জমা দেবেন না কাল, তখন খুবই গম্ভীরস্বরে সব্বাইকে ”গুড নাইট ফোকস, কীপ পারফর্মিং হার্ড” বলে টেলিফোন রেখে দেবো, এমন সময় সাউথ বেঙ্গলের ম্যানেজার শ্রীমান শ্রীযুক্ত সুজন বসু মহোদয় হাসিমুখে আমার কেবিনে ঢুকে দাঁত কেলিয়ে গ্যালগ্যালে হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো,’ বস, সন্ধ্যেবেলায় ফ্রী আছো?’
বিশ্বাস করবেন না মাইরি, ইচ্ছা করলো ঠাসিয়ে কানের গোড়ায় চড়িয়ে দিই দুটো। একে তুই সবচে বড় টার্গেট নেওয়ার পর দায়িত্ব নিয়ে ধ্যাড়াচ্ছিস, আগেকার দিন হলে তোর নামে সুপারি দিয়ে ভাড়াটে ঠ্যাঙাড়ে লেলিয়ে দিতুম, কি কুচিকুচি করে কেটে ডাকাতে কালীর পুজোই কত্তুম কি না কে জানে, তার ওপর এত্ত ইম্পর্ট্যন্ট কলে তোকে পেলুমই না, কি না, ”বস, দুর্গাপুর থেকে ফিরচি, নেটওয়ার্ক বহুত খারাপ”, এই অজুহাতে, সে তুই কিনা ঘন্টা দুয়েকবাদে এসে দাঁত ক্যালাচ্ছিস আমি সন্দেবেলা ফ্রী আচি কি না জানতে? কেন বে? মুজরো করবি? আমি বাঁহাতে বেলফুলের মালা জড়িয়ে হাত ঘুরিয়ে প্যালা দোব?
যাই হোক, শীতল স্টিলের মতন গলায় ‘বলো কোথায় নিয়ে যেতে চাও’ শুনেই সে ভদ্রলোক ‘আহা চলই না’, বলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কেনা লঝঝড়ে গাড়িখানা চালিয়ে আমাকে হাজির করলে এফডি ব্লকের এক বারের সামনে।
বারের নাম দেখলুম গোল্ডেন সিটি। লাল রঙের নিওন সাইনবোর্ডে একটি অত্যন্ত রোগাসোগা নিরীহ গোছের ড্র্যাতগন এঁকে খুবই ভয় দেখাবার চেষ্টা করে হয়েছে দেখে বুঝলুম যে ইটি একটি চাইনিজ বার কাম রেস্টুরেন্ট বটেক।
ভেতরে ঢুকে বুঝনু যে বেশ ছিমছাম ঘরোয়া পরিবেশ। বেশি লোকজন ছিল না, শুধু ততটা-আলোকিত-নয় এমন কোণে বসে প্রায় পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক কিছুতেই-তিরিশের-বেশি-নয় এমন এক হাহাহিহি কন্যার সংগে খুবই ঘরোয়াভাবে ঘষাঘষি করছিলেন। আপনারা তো জানেনই যে আমার শিশুর মত পবিত্র মনে কোন পাপ নেই, আমি গুটিগুটি পায়ে ওদিকেই যাচ্ছিলুম পাশে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে। সুজন মাঝখান থেকে ‘ন্না ন্না, ওদিকে নয় বস, এদিকে’ বলে অন্যদিকে টেনে নিয়ে বসেই বলল ‘কি খাবে? রেড লেবেল বলি?’
শুনেই, বুইতেই পারছেন, দিল পুরো গার্ডেন গার্ডেন, মনটা দিব্যি ফুরফুরে হয়ে উঠলো। প্রাণপণে উচ্ছাস চেপে গম্ভীর মুখে বল্লুম ‘ঠিকাচে ঠিকাচে, অত ব্যস্ত হতে হবে না, কিচুমিচু একটা হলেই হল’।
ওয়েটার প্রসেনজিত দেখলুম চালু মাল, ঠক করে একসঙ্গে ছ’পেগ টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেলো, আদা বিটনুন আইসবক্স ইত্যকার সহিত।
এবং ঠিক প্রথম পেগ শেষ হবার মুখে এলো অর্ডার করা স্পেশাল দুটি ডিশ, কুমপাও চিকেন, আর চিলি শ্রিম্প।
হাল্কা করে ভাজা উজ্জ্বল বাদামী রঙের চিকেনের টুকরো, অল্প মশলা দিয়ে বানানো, গ্রেভির মধ্যে মন ভালো করে দিয়ে ভাসছে। প্রতি কামড়ের পরতে পরতে শুধু অপার্থিব ভূমানন্দ। ঝালটা কাঁচা লংকার, ফলে তীক্ষ্নতার মধ্যে শুকনো লংকার তীব্র ”দিলজ্বলে” ব্যাপারটা নেই, কিশোরীর সদ্যপ্রেমের রাগের ঝাঁঝটুকু মাত্তর আছে, ঝালও বটে, মধুরও!
তবে যেটা খেয়ে পুরো বাওরা হয়ে গেলুম, সেটা হচ্ছে চিলি শ্রিম্প।
ঘটিদের আমি যেকটি জিনিসের জন্যে আত্যন্তিক শ্রদ্ধা করি তার একটি হচ্ছে চিংড়ি। স্বাদে ইলিশের কাছাকাছি যায়না বটে, কিন্তু রান্নার এপ্লিকেশনের বৈচিত্রে চিংড়ি ইলিশের চেয়ে একটু এগিয়েই আছে। অন্তত ইলিশ দিয়ে কোন মুখোরোচক চাইনিজ রান্নার কথা আমি আজ অবধি শুনিনি। তাছাড়া ছোট ইলিশ তত ভালো হয়না খেতে, কিন্তু চিংড়িকে দেখুন, একদম গুঁড়ো কাদাচিংড়ি থেকে শুরু করে বাঘাটে প্রমাণ সাইজের জাম্বো প্রণ অব্ধি, সব্বাই কেমন জন্ম হইতেই আমার মতন হ্যাংলাদের জন্যে বলিপ্রদত্ত!!
চিলি শ্রিম্প। আহা, সত্য, ত্রেতা দ্বাপরে এই জিনিস হয়নি, ঘোর কলিতে এই প্রথম। পুরো বৌলের মধ্যে হাল্কা সোনালি হলুদ ঝোল, কিছু কুচোন কাঁচা লংকা, আর বুড়ো আঙুলের সাইজের মনোমোহিনী, চিত্ততোষদায়িনী কিছু চিংড়িমাছ।
সে সোয়াদের বন্ননা করি এমন জোর আমার কলমে এখনো হয়নি। সুদ্দুমাত্তর ঝোলটুকুন চামচে করে মুখে দিতেই সারা শরীর জুড়ে বেজে উঠলো বেথোফেনের নাইন্থ সিম্ফনি ”ওড টু জয়”, শরীরের প্রতিটি রোমকূপ জুড়ে সোয়ান সং এর অপার্থিব উল্লাস। যেন ”আপনি কেত টাকা চান” এর জবাবে ফেলুদা ঠাঁই ঠাঁই করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে অশ্লীল টাকার অহংকার, যেন এইমাত্তর কোনি নামের জলপরীটি প্রথম হবার বিনয়ী গৌরবে উজ্জ্বল চোখে তাকালে ক্ষিদ্দার দিকে, যেন এই মাত্র পরিত্যক্ত স্তালিনগ্রাদের মাথায় বিজয়ীর পতাকা তুলল রেড আর্মির কোন কমরেড, যেন শিবার শেষ মোক্ষম আপারকাট টুকু আছড়ে পড়লো প্রতিদ্বন্দ্বীর থুতনিতে,যে এই মাত্র রেডিওতে ভেসে এলো কারও ভাষণ, ‘লং ইয়ার্স এগো, উই মেড আ ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি,’, যেন আহত টিনটিনকে জড়িয়ে দেড়েল মাতাল সেই ক্যাপ্টেন কান্নাভেজা গলায় বলে উঠলেন, ‘তুমি বেঁচে আছো?’, যেন প্রথমবার সামান্যক্ষণের জন্যে হলেও আবেগার্ত হয়ে সেভেরাস স্নেপ ডাম্বলডোরের ‘আফটার অল দিস টাইম?’ এর উত্তরে চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন ”অলওয়েজ”…
তিন পেগের পর আর কি কি করেছিলাম আজ আর মনে নেই। শুধু দুহাতে বৌলটা তুলে ঝোলটা চুমুক দিয়ে খাবার সময় যখন গাল বেয়ে শার্টে গড়িয়ে পড়ছিল, মনে আছে সেই সময় আড়চোখে দেখেছিলাম সুজন প্পুরো মাতাল হয়ে রাঁধুনি ওয়াং বুড়োকে ডেকে ঝোল, কান্না, শিকনি, মাল সব জড়িয়ে মড়িয়ে দুগালে চুমু খাচ্ছে। চকাম চকাম শব্দে সেই ক্ষুদ্র বারটি সচকিত ও মুখরিত!
মালের সঙ্গে সাইড ডিশের কথাই যখন উঠলো, তখন আরেকটা অভিজ্ঞতার কথাও শেয়ার করে ফেলা যাক।
আমার এই তের বছরের সুদীর্ঘ মদ্যপ জীবনে অনেক বিচিত্র বস্তু দিয়ে বিচিত্রতর লোকজনকে মদ্যপান করতে দেখেছি। আজকাল আর কিছুতেই বিশেষ অবাক হই না। কিন্তু লাস্ট বার স্লাইট চমকে গেসলুম একদিন।
বইমেলা থেকে ফিরে আমার ফেভারিট বার কিক্সে গিয়ে বসেছি, সল্টলেক সিটি সেন্টারে, সামনে এক বেহেড মাতাল ক্যালাকাত্তিক তার কন্ঠলগ্না ততোধিক মাতাল ছম্মকছল্লুটির সংগে কিঞ্চিৎ নির্দোষ আঁখমিচোলি খেলছি, এমন সময়ে আমার পাশে বিশাল আড়ম্বরে এক মহাত্মা এসে অধিষ্ঠান হলেন। মহিষাসুরের সাক্ষাৎ বড়ভাই টাইপ দেখতে, গলায় জাহাজের রশি বাঁধার মতন মতন মোটা সোনার চেন, হাতে তদ্রূপ হৃষ্টপুষ্ট ব্রেসলেট, হাবেভাবে লবাব খাঞ্জাখাঁ। চেনা ওয়েটার প্রণবকে জিগালুম ইনি কে? ইশারা ঈঙ্গিতে বোঝাল ইনি রাজারহাট এলাকার একজন নির্মাণশিল্পী। আগে ”তাপসদা” র ডানহাত ছিলেন, এখন ”সব্বো” দার।
ভদ্রলোক এসেই রাজার হালেই তিনটে ব্ল্যাক ডগের অর্ডার দিলেন, ফেঁত করে নাক ঝাড়লেন,বিপুল নাদে বাঁদিকে হেলে বায়ুত্যাগ করলেন, নরম সোফায় গা এলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানালেন যে ওয়েটার গুলো ব্যাপক হারামি হয়ে উঠেছে, আমিও কাষ্ঠহাসি হেসে ”সে তো বটেই, সে তো বটেই হেঁ হেঁ কত্তে লাগলুম, এমন সময় ওনার স্নেহের ব্ল্যাক ডগ তিনটি এসে হাজির!!
ভদ্রলোক চুমুক মেরেই, বিশ্বাস করবেন না, বরফ চুষতে লাগলেন!! জিজ্ঞেস করলুম ”কিচু নেবেন না? আমার পিনাট মসালা থেকে এট্টু বাদাম নিতে পারেন কিন্তুক”। উনি ওই রাবুণে হাতে আমার পিঠে স্নেহের থাপ্পড় মেরে জানালেন যে, থ্যানকস, কিন্তু উনি লাস্ট চল্লিশ বছর ধরে এইভাবেই মালঝাল খেয়ে এসেছেন।
বরফের টুকরোই ওনার চাট!
আপাতত এইখানেই শেষ করলুম। ভালো থাকবেন, আর, ওঃ, সত্যের খাতিরে জানিয়ে রাখা ভালো যে সেই বছর এনুয়াল আপ্রেইজালে সুজন সবচে” ভালো স্কোর করে বেস্ট এএসএমের এওয়ার্ড পায়। এখন কেউ যদি সেই গোল্ডেন সিটির ঘটনাকে এর পিছনে কারণ হিসেবে দেখাতে চায়, তবে আমি নেহাতই নাচার!