অথর্ববেদের প্রার্থনা
যদিহ ঘোরং যদিহ ক্রূরং যদিহ পাপম্।
তচ্ছান্তং তচ্ছিবং সর্বমিহ শমন্তু নঃ।
(অথর্ববেদ ১৯:৯:১৩-১৪)
অথর্ববেদের এই প্রার্থনাটি সকলেরই মর্ম স্পর্শ করে। কারণ, প্রথমত, সকল মানুষই জানে এর প্রাথমার্ধে পৃথিবীর যে-রূপটি বর্ণনা করা হয়েছে তা একেবারে সত্য, সমস্ত মানুষেরই অভিজ্ঞতায় এটি সত্য। ইহ’ মানে এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘোর, যা কিছু নিষ্ঠুর এবং যা কিছু অমঙ্গলের— এবং এ সবের প্রচুর উপাদান পৃথিবীতে সকলেরই রোজ চোখে পড়ে— তার অবসান হোক। অর্থাৎ শান্ত হোক, তা মঙ্গলকর হোক, সব কিছুই শান্ত হোক।
নানা দিক থেকেই এ প্রার্থনাটির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এটি পরিসরে খুব ছোট এবং মূলত একটি সম্পূর্ণ সূক্ত। মনে হয়, কোনও কোনও সাংমনস্য সূক্ত বা যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানের শেষে এটি হয় সমস্বরে, নয়তো পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হত।
এতে কী বলা হচ্ছে? পৃথিবীতে যত মন্দ, নিষ্ঠুরতা, যত অশুভ আছে তা যেন প্রতিহত হয়; যেন সব কিছুই শান্ত হয়। এর মধ্যে প্রধানত, লক্ষ করি, সূক্ত রচিয়তা যেন সমস্ত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে পৃথিবীর যত অশুভ অমঙ্গল ও নিষ্ঠুরতা আছে তার থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছেন, অর্থাৎ ওই ক্রুরতা ও অমঙ্গলকে স্বীকার করছেন। তার থেকে যেন পৃথিবীর মানুষ অব্যাহতি পায় এ তারই প্রার্থনা। দ্বিতীয়ত, এ সব অশুভ ও নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, এ বিশ্বাস এ প্রার্থনায় স্পষ্ট। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যদিও সূক্তটির শীর্ষে ব্রহ্মার নাম আছে, সেটাতে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই; ব্রহ্মা এখানে অথর্ববেদের একজন প্রধান দেবতা এবং বহু সূক্তেই তাঁর উল্লেখ আছে। আসলে এ প্রার্থনা কোনও বিশেষ দেবতার কাছে নয়, অনুক্ত বিশ্বশক্তির কাছে এ প্রার্থনা: ‘তুমি দাও’ বলছে না, বলছে, ‘যেন হয়’। কেমন করে হবে সে বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত নেই। এবং এখানেই এ সূক্তের বৈশিষ্ট্য।
যেখানে অধিকাংশ প্রার্থনাই ধন দাও, যশ দাও, আয়ু দাও, জয় দাও ধরনের, সেখানে এ প্রার্থনায় ব্রহ্মার নাম শিরোনামে আছে, ইনি অথর্ববেদের প্রধান ও সাধারণ দেবতা। কোনও উদ্দিষ্ট দেবতা নেই। এবং প্রার্থিত বস্তুও কোনও পার্থিব লাভের জন্য এখানে চাওয়া হচ্ছে না। এ সূক্তের কোনও রচয়িতার নাম নেই অর্থাৎ যেমন কোনও বিশেষ দেবতার কাছে এ প্রার্থনা নয়, তেমনই কোনও বিশেষ ঋষিরও নয় এ প্রার্থনা। আবার কোনও আবেদন-নিবেদন নেই এতে।
সব মিলে মনে হয়, যেন সমস্ত পৃথিবীর হয়ে কোনও এক ঋষি অদৃশ্য, অজ্ঞাত-পরিচয় কোনও এক বিশ্বনিয়ন্তার কাছে এই আবেদন করছে। সবচেয়ে বেশি করে যা চোখে পড়ে তা হল, এ প্রার্থনার মধ্যে কোনও স্থানকালের, কোনও বিশেষ প্রার্থিতব্যের ইঙ্গিত নেই। সেই দিক থেকে প্রার্থনাটির মধ্যে একটি নির্বিশেষ নিরঞ্জনতা আছে, যা অন্যত্র বিরল। যেন কোনও বিশেষ প্রার্থী কোনও বিশেষ দেবতার কাছে কোনও বিশেষ প্রার্থনা করছে না।
এইখানেই সূক্তাংশটির জোর। প্রার্থনাটি কীসের জন্যে? পৃথিবীতে যা কিছু অশুভ ও নির্দয়তা আছে, যা মানুষকে অহরহ পীড়িত করছে তার থেকে পরিত্রাণের জন্যে। কার পরিত্রাণ? তাবৎ বিশ্বমানবের। কারণ, এই নিষ্ঠুর অশুভশক্তির দ্বারা বিশ্বের সব মানুষই অহরহ পীড়িত হচ্ছে। অস্পষ্ট একটি ইঙ্গিত যেন আছে যে, এই নিষ্ঠুরতা অমঙ্গল মানুষেরই সৃষ্ট, এর অন্তরালে মানুষের পাপ, অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি সক্রিয়। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় মানুষ জানে, পৃথিবীতে তার অবস্থান চতুর্দিকে হিংসা ও মানুষের-প্রতি-মানুষের অমঙ্গল চেষ্টা— এতেই সমাকীর্ণ তার জীবন। এ সব চিরকাল আছে এবং মানুষ তার অবচেতনে জানে, চিরকাল থাকবেও। এর কোনও প্রতিকার মানুষের সমাজে নেই। কোনও দেবতার কাছে বা কোনও যজ্ঞকর্মের মাধ্যমে এর প্রতিবিধান মেলে না। অথচ মানুষের জীবন এর দ্বারা নিষ্প্রতিকার ভাবে বিপন্ন, সেই জন্যেই এই প্রার্থনা।
এই প্রার্থনা যুগে যুগে, সর্বত্রই, অথচ কোনওদিন কোনওখানেই সব অমঙ্গলের, অন্যায়ের নিষ্ঠুরতার নিরসন হয় না, তবুও— এবং তাই-ই— প্রার্থনা। সর্বমানুষের, সর্বকালের।