অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নবতম কীর্তি বি টি রোডের ভাসমান রাজপথ শুধু যে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য অপেক্ষাও আশ্চর্যতর তাই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে এর আর জুড়িও নেই। এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ দেখবার জন্য এখনই এমন আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে যে বিদেশী ট্রাভেল এজেন্টরা আগামী এক বছরের জন্য কলকাতাগামী বিমানসমূহের সমস্ত টিকিট আগাম বুক্ করে রাখার জন্য দরখাস্ত পেশ করেছেন।
এয়ার ইনডিয়ার ঘনিষ্ঠ মহল ইতিমধ্যেই যে নমুনা সমীক্ষা করেছেন তাতে প্রকাশ, বর্তমান বছরেই বি টি রোডের অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ দেখার জন্য বিদেশি টুরিস্টের সংখ্যা শতকরা দেড়শ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। এবং এই বাবদ বিদেশী মুদ্রা আমদানি যে-পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে তাতে বিদেশ থেকে পেট্রোল আমদানি বাবদ বিদেশী মুদ্রার বাড়তি খরচ পুষিয়ে গিয়েও সামান্য কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে। ওই নমুনা-সমীক্ষার রিপোরটে আরও বলা হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালে বিদেশী টুরিস্ট আগমনের সংখ্যা ১৯৭৪ সাল অর্থাৎ চলতি বছর অপেক্ষা আড়াই গুণ এবং ১৯৭৬ সালে বি টি রোডের অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথের আকর্ষণে আগন্তুক বিদেশী টুরিসটের সংখ্যা ১৯৭৫ সাল অপেক্ষা পঁচিশ গুণ বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা আছে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের সম্পদ-সংগ্রহ সাব কমিটি আশা বি টি রোডের অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ দেখতে আগ্রহী বিদেশী টুরিস্টদের আগমন বাবদ ১৯৭৪, ১৯৭৫ এবং ১৯৭৬ সালেই যে বিদেশী-মুদ্রা আমদানি হবে তা দিয়ে গোটাতিনেক পঞ্চম যোজনার খরচ অনায়াসে উঠে আসবে।
দমদম বিমান বন্দরের ভি আই পি লাউনজে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের এক মুখপাত্র আমাকে জানান, টাকার অভাবে পঞ্চম যোজনার যে-ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বি টি রোডের অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ তাকে সংকটমুক্ত করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ আমাদের কামধেনু।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দিললির সদর দফতর থেকে টেলিফোন যোগে আই-জির কাছে যে জরুরি নির্দেশ পাঠান তাতে বলা হয়, ডানলপ ব্রিজের কাছ থেকে টিটাগড়ের তালপুকুরের মোড় পর্যন্ত আট মাইলব্যাপী বি টি রোডের অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথটি যেন দিবারাত্র সশস্ত্র পুলিশের কড়া পাহারায় রাখা হয়। কারণ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর তাঁকে জানিয়েছেন যে রাস্তা মেরামতের নামে কিছু সমাজবিরোধী ইঞ্জিনিয়ার এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথটি বিনষ্ট করার তালে আছে। তাই তিনি আশা করেন যে, আই-জির সুদক্ষ নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ সর্বশক্তি দিয়ে বি টি রোডের এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথের মত বিরল এবং অমূল্য জাতীয় সম্পত্তিটিকে রক্ষা করবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদর দফতরের কলিকাতা-শাখা রাইটারস বিল্ডিংসের সূত্রে জানা যায়, এই অত্যাশ্চর্য জাতীয় সম্পত্তি রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় ববস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আপাতত লিগ্যালি রিমেমব্রানসারারের পরামর্শ অনুসারে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন মোতাবেক বি টি রোডের এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে :
সাবধান, এই রাস্তা মেরামত করিলে সাজা পাইবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য মুখপাত্র জানান, এই সতর্কবাণী ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এক জরুরি সারকুলার মারফত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ইনজিনিয়ার বা কনট্রাকটর অথবা রাস্তা মেরামতকারী যে কোনও জীবকে বি টি রোডের এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথের উত্তরে, দক্ষিণে পূর্বে বা পশ্চিমে এক কিলোমিটারের মধ্যে ঘুর ঘুর করিতে দেখিলেই তাহাকে বা তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ যেন মিসায় আটক করা হয়।
গতকাল দুপুরে পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রীয় টুরিসট দফতরের যৌথ উদ্যোগে একদল সাংবাদিককে বি টি রোডের এই অত্যাশ্চর্য রাজপথটি দেখানো হয়। অহো! কী অপূর্ব দৃশ্য! শীতের দুপুর। এই বিশাল ভাসমান রাজপথটি যেন প্রকাণ্ড এক ভাসমান সরীসৃপ। রোদের মৌতাতে বুঁদ হয়ে পড়ে আছে। কোথাও বা অ্যাসফালট কূর্মাকৃতি, কোথাও বা মনোহর সব মানস সরোবর। একবার দেখলে সে দৃশ্য আর ভোলা যায় না!
আমাদের গাইড জানালেন, ইনজিনিয়ারিং দক্ষতার এ এক অবিশ্বাস্য নিদর্শন। আমাদের আরও গর্বের কথা, এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথটির ষোলআনাই বাঙ্গালী ইনজিনিয়ারদের বিদ্যা কোথায় যে পৌঁছাতে পারে, এই অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথটি তার এক অক্ষয় সাক্ষী। তিনি আরও জানান, ব্যাবিলনে ছিল শূন্যে উদ্যান, ব্যাংককে আছে ভাসমান বাজার, বোমবাইতে আছে ভাসমান উদ্যান। কিন্তু ভাসমান রাজপথ এবং তাও এত বড়, এর দৈর্ঘ্য আট মাইল, বিশ্বের আর কোথাও নেই। এর নির্মাণকৌশলও কম বিস্ময়কর নয়।
আমাদের সঙ্গে রাজ্য পূর্ত দফতর এবং কলকাতা পুরসভার দুজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা বললেন, রাজ্য সরকার এবং পুরসভার যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্পটি রূপায়িত হয়েছে। শান্তি, মৈত্রী এবং সহযোগিতার এ এক অবিস্মরণীয় জীবন্ত দলিল।
তাঁরা আরও বলেন, রাজ্য পূর্ত দফতর রাজপথটি নির্মাণ করেছেন। তবে এটাকে ভাসিয়ে রাখার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কলকাতা পুরসভার সুদক্ষ ইনজিনিয়ারদের। ভাসাবার ব্যাপারে ওঁদের আর জুড়ি নেই।
পুর-বিশেষজ্ঞ ফিসফিস করে বললেন, আমাদের পায়ের নিচে যে-রাজপথ তার পনের ফুট নিচেতেই জল থৈ থৈ করছে। আমরা জলবাহী বাহাত্তর ইনচি পাইপ ফুটো করে রাস্তাটা ভাসিয়ে রেখেছি। রাস্তায় পা ঠেকালেই মনে হবে যেন অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে ভেলায় করে ভাসছেন।
কথা শুনতে শুনতেই দেখতে পেলাম অনতিদূরে মাটি ফুঁড়ে হু-উ-স্ করে জলের ফোয়ারা বেরিয়ে পড়ল।
জনৈক সঙ্গী আত্মহারা হয়ে বলে উঠলেন, অপূর্ব! অপূর্ব! আচ্ছা এটা কি উষ্ণ প্রস্রবণ? পুর-বিশেষজ্ঞ বললেন, উষ্ণ প্রস্রবণের স্কিম তো আমরা এখানে নিইনি। সেটা আমরা করব চৌরঙ্গীতে আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউতে। পঞ্চম যোজনায় আমরা ভাসমান মহানগরী নির্মাণের যে প্রকল্প রচনা করেছি, উষ্ণ প্রস্রবণ তারই আওতায় পড়বে।
সঙ্গী বললেন, ওয়ানডারফুল!
১৬ জানুয়ারি ১৯৭৪