প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

অতীত যখন কথা বলে – পার্থ গুহবক্সী

অতীত যখন কথা বলে – পার্থ গুহবক্সী

মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা সম্বন্ধ ও সংঘাত নিয়ে পৃথিবীজুড়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বিচিত্র হয়ে চলেছে। সে একটা মানসজগৎ, বহু যুগের রচনা। তাকে আমরা নৃতত্ত্বের দিক থেকে, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে বিচার করে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চাই। অন্বেষণ আর বিশ্লেষণের প্রবৃত্তি রয়ে গেছে আমাদের হৃদয়ের গভীরে। নিজেকে নিয়ে অন্বেষণ, চেনা পরিবেশ, প্রকৃতি, স্বজনকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে করতে আমরা খুঁজতে থাকি শিকড়কে। অতীতের যে তৈরি করা ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে অস্থির বর্তমান, নানাভাবে স্পর্শ করে বুঝে নিতে চাই তার অস্তিত্বটিকে। যখন উপলব্ধি করি, বিশাল প্রকৃতির মাঝখানে আমরা নিজেরা কত অসহায়, তখন বিস্ময় লাগে আমাদেরই পূর্বপুরুষেরা কীভাবে ঝড়ঝাপটা সয়ে এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে জন্মবন্ধনের সূত্রটিকে পৌঁছে দিয়েছেন। সেই অতীতের জীবনীশক্তিকে স্মরণের ভেতর দিয়ে, তর্পনের ভেতর দিয়ে অনুভব করতে পারলে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি বারে বারে। সুধীরকুমার মিত্র মশাইয়ের জেজুরের মিত্র বংশ পড়তে পড়তে সেই অনুভূতিই যেন ফিরে ফিরে আসে।

জেজুরের মিত্র বংশ বইটি ১০৫০ থেকে ১৩৪০ সন পর্যন্ত হুগলি জেলার জেজুর গ্রামের মিত্র বংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সুধীরকুমার মিত্র শুরুতে নিবেদন করেছেন পিতৃপুরুষের ইতিহাস রচনার কারণগুলিকে। ছোটোবেলায় তিনি দেখেছেন, তখনকার দিনের ছেলে-মেয়েদের শৈশবেই পিতৃমাতৃকুলের নাম, জাতি, জাতির পরিচয়, জাতির প্রাচীনত্ব, জীবিকা এইসব মুখে মুখে শেখানো হত। তার ফলে পরিবারের সন্তানেরা নিজেদের বংশমর্যাদা সম্বন্ধে সম্যক শিক্ষা, জ্ঞানলাভ করত প্রাথমিক স্তরেই, জীবনের চলার পথে সেই জ্ঞান, সেই প্রত্যয় জেগে থাকত অবিচল। কিন্তু ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাবধারার প্রচলনে আত্মানাং বিদ্ধি প্রথাটি লোপ পেতে বসেছে। লেখক এই বইটির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন সেই উজ্জ্বল সাবেকি বংশলতিকাকে। প্রতিটি পিতৃপুরুষের নাম স্মরণ করতে করতে তিনি যে অনাবিল আনন্দ পেয়েছেন, তাকে ভাগ করে দিতে চেয়েছেন পাঠকদের মধ্যে। নিজের অনুভূতিকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এই প্রচেষ্টাও সাহিত্যসাধনার এক বিশেষ উপাদান। সুধীরকুমার মিত্রের অবশ্য সাহিত্য সৃষ্টির বদলে ইতিহাস রচনাতেই বেশি আগ্রহ। তিনি বিশেষ মিত্র বংশের ইতিহাস রচনা উপলক্ষে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতিকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন গৌরবোজ্জ্বল অতীতের মহিমা সম্পর্কে, ব্যক্তি থেকে সমষ্টি অভিমুখে যাত্রার বিভিন্ন গতিমুখের ধারাবিবরণী তৈরি করে তখনকার শ্রেণি বিভক্ত সমাজের রূপরেখা গঠন করার চেষ্টা করেছেন। সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা বিশেষ একটি বংশের উৎস চিহ্নিত করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তাকে বিশ্লেষণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, এই গ্রন্থ রচনার সময় লেখকের বয়স মাত্র তেইশ বছর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সদ্য স্নাতক হয়ে বেরিয়েছেন তিনি। বাংলাভাষায় এই ধরনের বংশলতিকা রচনারীতি তখনকার দিনে একেবারে অপ্রচলিত বলে প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। পাঠনির্দেশ হিসাবে যেসব লেখাপত্রের কথা সুধীরকুমার মিত্র উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে লেখকের পিতামহ রাধামাধব মিত্রের স্বহস্ত লিখিত কবিতা ‘তোমার কথা’, ১০০৮ সালে ঘটকচূড়ামণি রচিত কায়স্থকারিকা, কায়স্থ পুরাণ, বঙ্গীয় কায়স্থ সমাজ, কায়স্থ সন্দর্ভ, বিশ্বকোষ, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ইত্যাদি এবং কায়স্থ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা।

বইটির পূর্বাভাষ শুরু বাংলায় আদিশূরের রাজত্বকাল থেকে। বৌদ্ধধর্ম বিপ্লবের ফলে বাংলার বৈদিক ধর্ম প্রায় লোপ পেয়ে যায়। আদিশূর সেই বৈদিক ধর্মকে আবার এই দেশে স্থাপন করার জন্য কনৌজ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণ ও পাঁচ ক্ষত্রিয়কে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে নিয়ে আসেন। ঘটকচূড়ামণির লেখা কায়স্থকারিকা বইয়ে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। অবশ্য আচার্য নীহাররঞ্জন রায় এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। বাঙ্গালীর ইতিহাস-এর বর্ণবিন্যাস অধ্যায়ে স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন, বাংলার কৌলীন্যপ্রথা পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত কুলশাস্ত্র বা কুলজি গ্রন্থমালার সাক্ষ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। নানা কারণে ঐতিহাসিকেরা এইসব কুলজি গ্রন্থমালার সাক্ষ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি পদ্ধতিতে আলোচনার বিষয়ীভূত করেননি। তবে এদের ভিতর দিয়ে লোকস্মৃতির একটি ঐতিহাসিক ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায় এবং সে ইঙ্গিত অস্বীকার করা কঠিন।

সুধীরকুমার মিত্র মূলত নির্ভর করেছেন কুলশাস্ত্রের বিভিন্ন মতামতের ওপর। কায়স্থকারিকা অনুযায়ী পাঁচ ক্ষত্রিয় থেকে তিনি নির্বাচন করেছেন কালীদাস মিত্রকে, তাঁর পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তিনি বৈষ্ণব, যশস্বী, সত্যবান, পন্ডিত ছন্দড়ের শিষ্য, বিশ্বামিত্র গোত্র, চিত্রগুপ্ত পুত্র। এরপর ধীরে ধীরে লেখক বল্লালসেনের রাজত্ব, কৌলিন্যপ্রথার প্রচলন, রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র শ্রেণীর কায়স্থদের চরিত্রলক্ষণ অল্প অবসরে বর্ণনা করেছেন। এরপর একে একে এসেছে দক্ষিণ রাঢ়ীয় ও বঙ্গজ সমাজের মিত্র বংশ প্রতিষ্ঠার আখ্যান। শুধু ভৌগোলিক স্থান নয়, অঞ্চলভিত্তিক বংশ গড়ে উঠবার মূলেও সমাজ ও রাজনীতি কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে, গোবিন্দরাম মিত্রের মুসলমানদের অত্যাচারে বড়িশা গ্রাম ছেড়ে জেজুরে গিয়ে বাস করার কাহিনিটি তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ।

সম্ভবত কুলশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করেই সুধীরকুমার মিত্র নির্মাণ করেছেন হিরণ্যগর্ভ নারায়ণকে আদিপুরুষ হিসাবে মান্য করে একচল্লিশতম পুরুষ হিসাবে কালীদাস মিত্র পর্যন্ত পূর্বপুরুষদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়, এ ছাড়া কালীদাস মিত্র থেকে শুরু করে সাতাশতম পুরুষ হিসাবে বংশাবলির নাম।

গোবিন্দরাম মিত্র যখন জেজুরে এসে বসবাস করতে থাকেন, তখন হুগলির এই গ্রাম অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী ছিল। তিনি এবং তাঁর বংশধরেরা জেজুর ও আশপাশের গ্রামজুড়ে গ্রাম উন্নয়ন, দেবসেবার কাজে ব্যাপৃত হন। কালের গতিতে ধীরে ধীরে মিত্র বংশ বৃদ্ধি শুরু হয়, বংশধরেরা জেজুর ছেড়ে কলকাতা, বাগনান, মেমারি, পর্শপুর, সরসা প্রভৃতি জায়গায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে মিত্র বংশের বিখ্যাত মানুষদের কথাও বইটিতে সুন্দরভাবে এসেছে যেমন পরোপকারী গোপাল মিত্র, ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পর সংবাদ প্রভাকর-এর সম্পাদক কবি রাধামাধব মিত্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহপাঠী সর্বগুণাকর মিত্র, প্রত্নতত্ত্ববিদ অচ্যুতকুমার মিত্রের কথা। ফুটে উঠেছে মিত্র বংশের গৌরবোজ্জ্বল বংশলতিকা।

এই দুরূহ কাজে ব্রতী হওয়ার জন্য সুধীরকুমার মিত্র ১৯৩৪ সালেই পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রশংসাসূচক চিঠি। ১৯৪৮ লাসে লেখা হুগলি জেলার ইতিহাস, ৫৩ সালে তারকেশ্বরের ইতিহাস, ৬২ সালে লেখা হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, ৭১ সালে হুগলি জেলার দেবদেউল রচনার বীজ রোপিত হয়েছিল যে এই ছোট্ট বইটির মধ্যেই, সে-কথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। বাঙালি সমাজ ও দর্পণ অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও গবেষকের পক্ষে জেজুরের মিত্র বংশ একটি মহামূল্যবান দলিল।

আলোচিত গ্রন্থ

জেজুরের ইতিবৃত্ত ও মিত্র বংশকারিকা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *