অতিশয়োক্তি ও কাব্য

অতিশয়োক্তি ও কাব্য

ঠাকুর্দা নাতিকে গল্প বলছেন : একবার আমার ছোটবেলায় সে যে কী গরম পড়েছিল তোরা ভাবতে পারবি না। আমাদের গ্রামের পুরুতঠাকুর আর এক গ্রামে পূজো করতে গিয়েছিলেন। পূজো শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল। যজমান বাড়ীর লোকেরা বলল, ঠাকুর আর বাড়ী যাবেন না। এ প্রচণ্ড রোদে ঘর থেকে বেরুলে আর বাঁচবেন না। ঠাকুরের কিন্তু বাড়ী ফিরে আসতেই হবে। জরুরী কাজ আছে। বাইরে একটিও জনমানব নেই, ঠাকুর একাই চলছেন। রোদের তাপে তার হাত-পা-নাক-কান সব গলে গলে মাটিতে ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু সূৰ্য্যদেব ঠাকুরের টিকিটকে কিছুতেই গলাতে পারল না। জোকের মত বুকে হেঁটে টিকিট শেষ পৰ্যন্ত বাড়ী গিয়ে পৌঁছাল। বাড়ীর লোকে দেখল। দরজার চৌকাটের তলা দিয়ে একটা বড় জোক গলিয়ে আসছে। কাছে গিয়ে দেখতে পেল জোক নয়, ঠাকুরের টিকি। পুরুতের প্রাণ টিকির ভিতরেই কিছুক্ষণ ধূক ধূক করে নিভে গেল।

ঠাকুর্দার এই গল্পটিতে আলঙ্কারিকের অতিশয়োক্তি পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে। অতিশয়োক্তি না হলে অলঙ্কার জমে না, অলঙ্কার না হলে কাব্যও জমাট বঁধে না। আমাদের প্রাচীন আলিঙ্কারিক আচাৰ্য্য দণ্ডী একটা দামী কথা বলেছেন-অতিশয়োক্তি সমস্ত অলঙ্কারের একমাত্র অবলম্বন। ইংরেজি figure of speech-এর চেয়ে সংস্কৃত ‘অলঙ্কার’ শব্দটি বোধ হয় বেশী সার্থক, কারণ এ শব্দটির মধ্যে এমন একটি প্রয়োজনীর ব্যঞ্জনা আছে যা ইংরেজি প্রতিশব্দটিতে নেই। মেয়েদের অলঙ্কার একটি বাহুল্য বা আতিশয্য যা শোভাবৃদ্ধিতে সাহায্য করে; কাব্যকথায় অলঙ্কারও এমনি একটা আতিশয্য যা কাব্যকে হৃদয়গ্ৰাহী করে তুলতে সাহায্য করে।

এরিষ্টোটেল রাজনৈতিক বাক্ষ্মীদের বাগবৈদগ্ধ্য শিক্ষা দেবার জন্য অলঙ্কার শান্ত্রের অবতারণা করেন। অতিশয়োক্তি না হলে বাগিতা দিয়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় না, বক্তৃতার জৌলুস খোলেনা, শ্রোতার হাততালি জোটেনা। সুতরাং এরিষ্ট্যোটেলও দণ্ডীর মত অতিশয়োক্তিকেই তার অলঙ্কারশান্ত্রের সারা বলে ঘোষণা করতে পারতেন। দণ্ডীও বলেছেন, অতিশয়োক্তি হল “বাগীশমহিতা উক্তি’-বাক্যাধীশদের বন্দনীয়া উক্তি। বৈষ্ণব কবিদের অনেক আগেই দণ্ডী তাঁর অভিসারিকাকে জ্যোৎস্না রাতে সাদা অভিসারে পাঠিয়েছেন। সাদা মল্লিকার মালায় মাথা ঢেকে, শ্বেত চন্দন মেখে, সাদা শাড়ী জড়িয়ে গৌরী তন্ধী অভিসারিকা পূর্ণিমারাতে অভিসারে চলেছে। কোনো অভিভাবক পুলিশ পাঠিয়েও এই অভিসারিকাকে ধরতে পারবে না, সে যে চন্দ্ৰালোকে একাকার হয়ে মিশে গেছে। পাঠক কিন্তু ঠিকই ধরতে পারবে, তার বৈষয়িক দৃষ্টির সামনে পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নাতেও কোনও অভিসারিণী সর্বশুক্ল হয়েও মিলিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু পাঠককে তার বৈষয়িক চোখটি বন্ধ রাখতে হবে, কাব্যদৃষ্টি উল্মীলিত করে এই বিচিত্র অতিশয়োক্তির রসটুকু উপভোগ করতে হবে।

সুতরাং সাহিত্যে অতিশয়োক্তি শুধু সহনীয় নয়, উপভোগ্যও বটে। অতি কঠোর বাস্তববাদী সাহিত্যিক ও অতিশয়োক্তি ছাড়া এক কলম লিখতে পারবেন না। অকাল-প্ৰয়াত কিশোর কবি মাত্র আটটি ছোট্ট পঙক্তিতে নিরন্ন মানুষের ক্ষুধার যাতনাকে প্ৰকাশ করলেন। নিছক ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ঐ ছোট্ট কবিতাটির প্রত্যেক পঙক্তিই তো অতিশয়োক্তি–

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমাচাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

সোজা কথাকে এত বাঁকাবার কি দরকার ছিল। বললেই হত—’ক্ষুধার জালায় জ্বলছি, তোমাদের কাব্যটাব্য শিকায় তুলে রাখ। কিন্তু এ হলেও হবে না। ‘শিকায় তুলে রাখ’-ওটাও তো কাব্যিক বাহুল্যই হল। কাব্যের বইগুলো সত্যিই তো আর রান্নাঘরের শিকায় তুলে রাখতে বলা হচ্ছে না। তবে বাহুল্য বর্জন করতে হলে কি বলতে হবে? কাব্যকে কবর দাও, আগুনে পুড়িয়ে ফেল? এতেও হল না। বাহুল্য রয়েই গেল। আর কবি যা বলতে চেয়েছেন তার কিছুই বলা হল না। কথাগুলিকে যতই সাদাসিদে আটপৌরে করার চেষ্টা করুন না কেন, কাপ্পার খোলুটা অর্থের তুলনায় অনেক বড় হতে বাধ্য। যদি বলা যায় ক্ষুধার সময় কাব্যের ঘ্যান্যাননি বন্ধ করা, কথাটা একদম বাস্তবধর্মী হল কি? কবির বক্তব্য কি ছিল, আর আমরা কোথায় নেমে এসেছি সে বিচার এখন থাক। আমরা একান্ত জৈব জৈব যাতনা কি ভাবে প্ৰকাশ করব সে কথাই ভাবছি। অনুভূতির তীব্রতা-প্ৰকাশকে নিতান্ত বাস্তবধর্মী করতে হলে ভাষার মাধ্যম পরিত্যাগ করতে হবে। আর্তনাদ, চীৎকার, ছটফটানি, মাটিতে গড়াগড়ি, ভাবপ্রকাশের এই আদিম জাস্তব ভঙ্গীগুলোকেই আমাদের গ্ৰহণ করতে হবে। তাহলে আমরা মাটির কাছাকাছি পৌঁছব সন্দেহ নেই, তবে এহেন কবির জন্য কোন কবিগুরু কান পেতে থাকবেন না।

আধুনিক কবিতা চিত্ৰকল্পসৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করে বাস্তবধর্মী হতে চাইছে। মনে পড়ে কোথায় যেন কোন এক আধুনিক কবিতায় দ্বিতীয়ার চাঁদকে নারিকেল ফলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। বেরসিক পাঠক নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন-কবির সনা কি নারকেল রসাস্বাদে অনেকদিন বঞ্চিত ছিল? জীবনানন্দ বলেছেন-‘শিং-এর মত বাঁকা নীল চাঁদ।‘ কবি কি কোনদিন ষণ্ডরাজের শৃঙ্গাঘাতে কাতর হয়েছিলেন? না হলে বঙ্কিম চাঁদ দেখে বাঁকা শিং-এর কথা মনে পড়ল কেন? দিনেশ দাস কাস্তে হাতে ধান কাটেন নি। তবু বাক চাঁদ দেখে তার কাস্তের কথা মনে হয়েছে“এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে”। প্রাচীন কবিরা আকাশের চাঁদকে সুন্দরী রমণীর মুখ পৰ্যন্ত নামিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আধুনিক কবিরা তাকে নারিকেল ফলা, গরুর শিং, রুটি ও কাস্তে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। এর মধ্যে নারকেল-ফলা ও গরুর শিং-এর চিত্রকল্প কবির ভাবনাকৃতির বৈচিত্রমাত্র। কিন্তু কাস্তে ও ঝলসানো রুটি শুধুমাত্র চিত্রকল্প নয়, বিবর্তিত সমাজ-চেতনার এক সুগভীর প্রতিচ্ছবি ব্যঞ্জনাবৃত্তি-বাহিত হয়ে চিত্রাকারে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইতরজনের বস্তুদৃষ্টিতে এই চিত্ৰকল্পগুলিতেও অতিশয়োক্তি রয়েছে—চাঁদ শিং বাগিয়ে গুতোঁতে আসে না, কাস্তে হয়ে ধান কাটতেও যায় না।

চিত্রকল্প রচনায় সংস্কৃত কবি বাণভট্ট অদ্বিতীয়। সংস্কৃত সাহিত্যের বাঁধাধরা চিরাচরিত উপমামণ্ডলীও গণ্ডীরেখা তিনি দুঃসাহসের সঙ্গে অনেকদূর অতিক্রম করে গিয়েছেন। এদিক থেকে বিচার করলে বাণভট্ট সংস্কৃত সাহিত্যে most unconventional poet যেমন most unconventional dramatist হলেন শূদ্রক। অন্তগামী জীৰ্ণরশ্মি বৃদ্ধ সূর্যের গায়ে তিনি পারাবতের পায়ের পাটল রং মাখিয়ে দিয়েছেন-“পারাবত-পাদ-পাটলিয়াগো রবিরস্বরতলাদলম্বত’। জীবনানন্দ দাস বাংলা কবিতার চিত্র বিতানে যে ধূসর রংএর আধিপত্যসৃষ্ট করেছিলেন, বাণভট্টের কাব্যে সেই ধূসরিমা আধিপত্যের দাবি করেননি, কিন্তু কখনো কখনো এমন একটি নিটোল আবহমণ্ডল সৃষ্টি করেছে যার মোহ পাঠককে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। রাত্রি শেষের আকাশে কয়েকটি পাণ্ডুর তারকা মাত্র অবশিষ্ট আছে, প্ৰভাত-কালীন নবজন্মের পূর্বে এই মৃত্যুবিলীন জরাগ্রস্ত আকাশের নির্বিড় রিক্ততাকে বাণভট্ট প্রকাশ করলেন বৃদ্ধ পারাব্বতের ডানার ধূসরবর্ণে-“অল্পাবশেষপাণ্ডুতারকে জরৎপারাবতপক্ষধূসারে নভসি)। অসামান্য শব্দধ্বনির ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ সমাসগুলি সমুদ্রের তরঙ্গের মত গড়িয়ে চলেছে, তারি মধ্যে ব্যঞ্জনগম্ভীর অফুরন্ত চিন্ত্ৰৈশ্বৰ্য্য ছড়িয়ে পড়েছে। কলমকে তুলির মত ব্যবহার করতে বাণভট্টের দোসর নেই। এবিষয়ে রবীন্দ্ৰনাথই সর্বপ্রথম পাঠকসমাজকে দৃষ্টিদান করেছেন। আলঙ্কারিকদের অতিশয়োক্তি মূলে না। থাকলে বানভট্টের এই চিত্রগুলিও কিন্তু ঐশ্বৰ্য্যমণ্ডিত হত না।

মনে হতে পারে। আধুনিক কবি ও পাঠক বাহুল্যপক্ষপাতী নন। যন্ত্রনির্ভর সমাজ-জীবনে কাজের তাগিদে উর্ধর্বশ্বাসে ধাবমান মানুষের কাছে সাজের বাহুল্য বর্জনীয়, ভাষার আতিশয্যেরও সময় নেই। আমাদের প্রাচীন অট্টালিকাগুলিতে গম্ভীর স্তম্ভগুলি যে নিষ্প্রয়োজন সৌন্দর্যের আতিশয্য সৃষ্টি করত তাকে ছাঁটাই করে architecture এখন functional হয়ে উঠেছে। কাব্যসাহিত্যে ভাষা-ব্যবহারেও লক্ষ্যে বা অলক্ষ্যে, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কলা দেবীও functional হয়ে উঠেছেন। সরস্বতী দেবী হলেও মহিলা। functional art পরিধান-কলায় প্রযুক্ত হয়ে fashionable মহিলাদের অঙ্গবাসকে প্রায় বক্ষোবাসে এনে দাঁড় করিয়েছে। দেবী সরস্বতীও এ যুগধর্মকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই সারস্বত-সজ্জাকেও যথাসম্ভব বাহুল্যবজিত হতে হবে। অবশ্য আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সুদীর্ঘ ক্লান্তিকর পাঁচালী ও কড়চা এই নূতন সারস্বত বিধিকে মেনে নেয়নি। মেনে নিয়েছে। বোধ হয় বাংলা কৰিতা। এখন মনে হচ্ছে উচ্চাঙ্গ গণিতের ফরমুলা সাজিয়েও বোধ হয় কবিতা তৈরী করা সম্ভব।

যারা সব চেয়ে বৈষয়িক তাদেরই বোধ হয় বাহুল্য বর্জনে সব চেয়ে বেশী উৎসাহ থাকা উচিত ছিল। ব্যবসায়ীদের মত বৈষয়িক বোধ হয় আর কারুর নেই। কাজ হাসিল করার দিকে একাগ্র তাদের দৃষ্টি। কত অল্প খরচে কত বেশী কাজ হাসিল করা যায় এবিষয়ে তারা খুবই সতর্ক। তবু দেখুন সরকার যখন বিজ্ঞাপনের খরচ কমাবার প্রস্তাব করলেন তখন শুধু খবরের কাগজের মালিকরাই নন, শুধু বিজ্ঞাপনী এজেন্সীগুলিই নয়, মূল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিও ঘোর আপত্তি তুলল। আপনার আমার কাছে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনগুলি কৌতুকাবহ বাহুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়। বোর্ণভিটার মালিক চান আমরা যেন বোর্ণভিটা কিনে খাই । খবরের কাগজে একদিন একটা অনুরোধ জ্ঞাপক নোটিস দিলেই চলত। কিন্তু কাগজের অৰ্দ্ধেক পাতা জুড়ে কি বিপুল কাণ্ড। দুটো চাকার উপর একটা বোর্ণভিটার পিঁপা দাঁড়িয়ে আছে । তার ওপর দাড়িয়ে আছে এক পালোয়ান । এক হাতে কাপ থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে। আর এক হাতে চারটা লাগাম দিয়ে দূরে চারটা মহাতেজী বেয়াড়া ঘোড়াকে বাগ মানাচ্ছে। এই অতিশয়োক্তির তাৎপৰ্য কি ? –বোর্ণ ভিটা কিনে খাও । এই বিজ্ঞাপনাবাগীশ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বোধ হয় আমাদের প্রাচীন পূর্বমীমাংসক দার্শনিকদের শ্রেষ্ঠ উত্তরসাধক। পূর্বমীমাংসাদর্শনে বিধি আর অর্থবাদ নিয়ে প্ৰকাণ্ড বিচার চলেছে। বিধি মানে কোন কাৰ্য্যে প্রবৃত্তিজ্ঞাপক বৈদিক নির্দেশবাক্য-যেমন, বায়ু দেবতাকে শ্বেত ছাগ বলি দাও। এটাই আসল বক্তব্য। এই বিধিবাক্যগুলিই স্বতন্ত্র প্রামাণিক বাক্য। তারপর আছে বায়ুদেবতার মাহাত্ম্যাবর্ণনামুখর মন্ত্রবাক্য। এই স্তুতিমাহাত্ম্যময় মন্ত্রবাক্যগুলিকে বলা হয়। অর্থবাদ । এখন বিচার চলল, এই অর্থবাদ-বাক্যগুলি প্রমাণ কি অপ্রমাণ ? পূর্বপক্ষ বললেন, এগুলির প্রামাণ্য নেই। কারণ, এদের মধ্যে অনেক আজগুবি, অবিশ্বাস্থ্য, অসম্ভব, পরস্পরবিরোধী অতিশয়োক্তি আছে। উত্তরপক্ষ সিদ্ধান্ত করলেন- এই অর্থবাদ বাক্যগুলির স্বতন্ত্র প্রামাণ্য নেই একথা ঠিক, তাই বলে এগুলি অপ্ৰমাণ নয়। বিধিবাক্য-নির্দিষ্ট কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত করতে এই অতিশয়োক্তিগুলি সাহায্য করে। তাই বিধিবাক্যের সঙ্গে একার্থিতা-প্ৰাপ্তির দ্বারা অর্থবাদ-বাক্যেরও প্রামাণ্য স্বীকার করা যেতে পারে। বিধিবাক্যই প্ৰধান। চাপরাসীর চাপরাসে যেমন মালিকেরই মহিমা প্ৰতিফলিত হয়ে চাপরাসীকেও কিছুটা মৰ্যাদা দান করে, অতিশয়োক্তিরূপী অর্থবাদ-বাক্যও তেমনি স্বপ্ৰধান বিধিবাক্যের মাহাত্ম্য থেকে কিছুটা গৌরব ধার করে প্রামাণ্য লাভ করে।

 

তাহলে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনগুলি অতিশয়োক্তি হলেও নিতান্ত নিষ্প্রমাণ ও নিরর্থক নয়। মালিকের পণ্য বিক্রয়ের সহায়ক বলে-“বোর্ণ ভিটা কিন্নুন’ এই আসল বিধিবাক্যটির সঙ্গে একাৰ্থতা বা একবাক্যতা লাভ করে অর্থবাদরূপী বিজ্ঞাপনটি বাহুল্যও সার্থকতা লাভ করেছে। পূর্বমীমাংসা-প্ৰদৰ্শিত বৈদিক অর্থবাদ-বাক্যই কি বর্তমান যুগে ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপন রূপে অবতীর্ণ হয়েছে?

আমাদের দেশের ব্যঞ্জনাবাদী আলিঙ্কারিকরা মীমাংসকদের কাব্যরসানভিজ্ঞ বেরসিক বলে তিরস্কার করেছেন। এতটা তিরস্কার হয়ত এদের প্রাপ্য নয়। কারণ অর্থবাদের প্রামাণ্য মেনে নিয়ে মীমাংসকরা কাব্য-সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গির মূল মাহাত্ম্যটি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। কাব্য-সাহিত্যের রস-অলঙ্কার-ধ্বনি এ সবই কিন্তু এক অর্থে অর্থবাদের খেলা। রাস্তায় নিরন্ন ভিখারীর কান্নাকে বিদগ্ধজন করুণরসের অভিব্যক্তি বলবেন না। ভিখারীর কান্না সাহিত্যের পাতায় কথার সাজে সাজলে তবেই রসিক সুজন রসাস্বাদ করবেন। রসিকের আবদার বড় বেশী। পরের দুঃখকেও তিনি আনন্দরূপে উপভোগ করতে চান। অর্থাৎ বস্তুসত্য স্বরূপে উপস্থিত হলে রসিকের রস – ভঙ্গ হবে। সত্যকে অভিনয়ের সাজ পরতে হবে, কথার বিনুনি বুনতে হবে, শোককে শ্লোকের ঘটা দিয়ে ঢাকতে হবে, তবেই শোক রসারূপে প্ৰকাশ পাবে। রাসবাদী আলিঙ্কারিকের মতে অলঙ্কার মূলতঃ রসকেই অলঙ্কত করে, কারণ পরোক্ষভাবে রস-প্রকাশে সাহায্য করাই অলঙ্কারের কাজ। সুবৰ্ণালঙ্কার আসলে শরীরকে সাজাবার জন্যই ব্যবহৃত হয় না, সুন্দরী গরবিণীর হৃদয়ের গৌরববোধ চরিতার্থ করার জন্য, তার হৃদয়কে সাজাবার জন্যই ব্যবহৃত হয়। আলঙ্কারিক অবশ্য গম্ভীরভাবে বলেন-লৌকিক অনুভূতির আস্বাদনযোগ্য অলৌকিক অনুভূতিরূপে যে প্ৰকাশ তারই নাম সাহিত্যািরস। এতো সহজকে গম্ভীর করার চিরাচরিত পণ্ডিতী কৌশলমাত্র। মানুষের হাসিকায়াকে ঘর-সংসারের গণ্ডী থেকে রঙ্গমঞ্চের আলোকসজ্জায় টেনে আনা হল, ভাষার জৌলুস ঘিরে কবিতার পাতায় ঠাই দেয়া হল। এত সেই বোর্ণভিটার বিজ্ঞাপন। মানুষ হাসে কাঁদে-এই সহজ বস্তুসত্যটিকে ফ্যাশনের পোষাকে পল্লবিত করে প্রকাশ করা হল। সাহিত্য তাহলে অনাড়ম্বর সত্যের সাড়ম্বর বিজ্ঞাপন-পূর্বমীমাংসার অর্থবাদের প্রকারান্তর। ধ্বনিবাদী আলঙ্কারিক মনে করেন সাহিত্যে ব্যঞ্জনাবৃত্তির মাধ্যমে অনুক্ত বহু অর্থকে। স্বল্পোক্তিতে প্ৰকাশ করা সম্ভব। সুতরাং ধ্বনি অতিশয়োক্তির প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক। ভরতনাট্যমের মুদ্রার মত শুধু ইঙ্গিতে, স্বল্পভঙ্গীতে ভাবরাশিকে রস-সমুদ্রে পরিণত করে। ধ্বনির চূড়ান্ত পরিণতি প্রতীকী প্রকাশে এবং প্রতীকী প্ৰকাশের শেষ কথা গাণিতিক ভাষা-যেখানে ভাষার আর দরকার নেই, শুধু প্ৰতীক দিয়েই সব কিছু প্ৰকাশ করা চলে। হে অঙ্ক, কথা কও! ধ্বনিবাদকে প্রতীকবাদে রূপান্তর করলে, প্ৰথম ধরুন, বিশ্বশান্তির জয়যাত্রা বোঝাবার জন্য কাব্যনাটক-উপন্যাস সভা-সমিতি-বক্তৃতা, ইত্যাদি সব কিছু বাদ দেয়া যেতে পারে-মাটিতে লুটিয়ে পড়া একটা হায়েনা বা বাঘের মাথায় একটি ডানামেলা পায়রা বসিয়ে দিন। তবু রং তুলি ইত্যাদির আতিশয্য বাদ দিতে হবে। তাই এখন গণিতের শরণ লউন। পায়রা বোঝাবার জন্য p ব্যবহার করুন, হায়েনা বোঝাবার জন্য h, এখন p/h মানে সভ্যতার কাছে হিংস্রতার পরাজয়। আমি অঙ্ক একেবারে জানিনা বলে এমন কাঁচাভাবে কথাটা বললাম। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সভাপতিত্বে mathematical logician-দের একটা কমিটি তৈরী করে তাদের উপর ভার দিন-মানুষের স্কুল ভাষা বাদ দিয়ে অশরীরী গাণিতিক প্রতীকে কিভাবে সূক্ষ্ম সাহিত্যিক রস থেকে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সব কিছু প্ৰকাশ করা সম্ভব। সে কায়দা তারা বাতলে দেবেন। এডিংটন বলেছেন, বিশ্বের মূল সত্তা এক অসীম অনন্ত গণিত-মানস বা mathematical mind, যা বিশ্বকারে বিবর্তিত হচ্ছে; সুতরাং গণিতের ফরমুলা ও সমীকরণ দিয়ে এই জগৎপ্ৰপঞ্চ প্ৰকাশ করা অন্তত: theoretically সম্ভব। একাজ করতে পারলে আনন্দবৰ্দ্ধানের আত্মা পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করবে, কারণ র্তার ধ্বনিবাদের এই চরম বিস্ময়কর সার্থকতা তিনি কোনদিন কল্পনা করতে পারেন নি।

কিন্তু একাজ যে পৰ্যন্ত আমরা করতে না পারি। সে পৰ্য্যন্ত ধ্বনি-কাব্যেও আতিশয়োক্তি থাকতে বাধ্য। কারণ মানুষের ভাষাটাই হল অতিশয়োক্তি। আমাদের দেশের বৌদ্ধ দার্শনিকরা এ কথাটা খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন। উৎসববিশেষে ইংলণ্ডের রাণীর গাউনের পিছনে প্ৰায় আধ ফার্লং লম্বা একটি পুচ্ছ থাকে, রাজকীয় কুটুর্ঘটনারীগণ এই পুচ্ছের ভার বহন করে রাণীর পিছনে বহুযুগস্থায়ী মঠ ও বিহার তৈরী করেছেন। প্ৰাচীন নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট খুব রসিক লোক ছিলেন, বৌদ্ধদের স্ববিরোধী ব্যবহার উল্লেখ করে তিনি চমৎকার একটি শ্লোক লিখলেন–

‘নাস্ত্যাত্মা ফলভোগমাত্রমথ চ স্বৰ্গায় চৈত্যাৰ্চনং
সংস্কারাঃ ক্ষণিকা যুগস্থিতিভূতশ্চৈতে বিহারাঃ কৃতাঃ।
সৰ্বং শূন্যমিদং বসূনি গুরবে দেহীতি চাদিশ্যতে
বৌদ্ধানাং চরিতং কিমন্যদিয়াতী দম্ভস্য ভূমিঃ পরা॥’

–ক্ষণিক বিজ্ঞানধারার অতিরিক্ত আত্মা বলে কিছু নাই, অথচ পরলোকে স্বৰ্গফল ভোগ করার জন্য চৈত্যমূলে পূজাৰ্চনা করা হয়। সব কিছুই ক্ষণিক সংস্কারমাত্র, অথচ বহুযুগস্থায়ী বিহার নির্মাণ করা হয়েছে। সব কিছুই শূন্য, কিন্তু গুরুকে ধনদৌলত দান কর, এ আদেশটি শিষ্যকে ঠিকই দেয়া হয়ে থাকে। এই চূড়ান্ত ভণ্ডামি ছাড়া বৌদ্ধদের চরিত্র আর কি হতে পারে। জয়ন্তভট্ট শেষের দিকে একটু কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন। আমরা তা করব না। শুধু এটুকু বলব–ভাষার মাধ্যমে সত্যাৰ্থ প্ৰকাশ করা যায় না, এই পরম সত্যটি প্রকাশ করার জন্য কয়েক শ’ বই না লিখে একেবারে শূন্যসিদ্ধিতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকাই বৌদ্ধদের উচিত ছিল।

উক্তি মাত্রই অতিশয়োক্তি বৌদ্ধদের এই চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমূহ বিপত্তি দেখা দেবে, প্ৰত্যেকটি মানুষের মুখে কাপড় গুজে চারদিকে এক একটি দেয়াল তুলে দিতে হবে। নইলে প্রত্যেকটি মানুষই মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত হবে। অথচ আশ্চৰ্য্য, বৌদ্ধাচাৰ্য্য অশ্বঘোষ কাব্যনাটক পৰ্য্যন্ত লিখে ফেললেন। আমরা প্রসঙ্গটা আরম্ভ করেছিলাম ঠাকুর্দার গল্পের অতিশয়োক্তি দিয়ে । কোনও সাহিত্যিকের হাতে পড়লে এগল্পটি বেশ রসাল হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় অসাহিত্যিক সাধারণ লোকও সাৰ্থক অতিশয়োক্তি সৃষ্টি করে থাকেন। কোন প্রদেশে সাধারণ নিৰ্বাচন সুরু হবে। তখন ভারত সরকার প্রত্যেক প্রদেশে জলশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা পেশ করেছেন । আমাদের আলোচ্য প্রদেশটিতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা সত্ত্বেও কাজ তখনও কিছুই এগোয়নি। বিপক্ষদল মন্ত্রীদের নির্বাচনে ঘায়েল করতে চান। এক মন্ত্রীকে নিয়ে এক রসাল গল্প প্রচলিত হল—মন্ত্রীমহোদয় বক্তৃতা দিচ্ছেন—‘সমবেত সভ্যবৃন্দ, আপনারা জানেন আমরা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারিনি বলে বিরোধী পক্ষ আমাদের কঠোর সমালোচনা করছেন । কিন্তু আমরা বিরোধী পক্ষকে জিজ্ঞাসা করছি—দুধ থেকে মাখন তুলে নিলে দুধের কি থাকে ? অসার জল মাত্র! আমাদের প্রদেশের জল থেকে বিদ্যুৎ শক্তি তুলে নিলে শক্তিহীন জলমাত্র পড়ে থাকবে। ভেবে দেখুন বিরোধী পক্ষ কত বড় দেশদ্রোহী চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। তারা আমাদের সমস্ত জলসম্পদকে নিবীৰ্য্য দুর্বল করে দিতে চান। এই চক্রান্ত সম্পর্কে আপনারা হসিয়ার থাকুন।” এজাতীয় গল্পে নির্বাচনী যুদ্ধের তীব্রতা ও তিক্ততার মধ্যেও একটু রসিকসুলভ মেজাজের সৃষ্টি করে। মীমাংসাশাস্ত্ৰ কথিত অর্থবাদের এ এক নবীন সরস সংস্করণ । এই গল্পটির কোনও স্বতন্ত্র প্রামাণ্য বা সত্যতা নেই। বিরোধী পক্ষ বলতে চান—মন্ত্রীরা মূঢ়। এজন্য বহু যুক্তিতর্কের মধ্যে এই গল্পটিও চালু করে দিলেন । গল্পটি লোকে বিশ্বাস করবে। এ তাদের ধারণা নয় । কিন্তু সামগ্রিকভাবে মন্ত্রীদের মুর্থতা প্রতিপাদনের জন্য এ এক সরস অতিশয়োক্তি যা শ্রোতৃবৃন্দ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস না করে ও উপভোগ করেন। পূর্বমীমাংসকগণ বিধি ও অর্থবাদের মধ্যে যে সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন তার একটা গভীর লৌকিক তাৎপৰ্য রয়েছে। বৈদিক যাগ-যজ্ঞের লৌকিক প্রসঙ্গ থেকে সমাজের লৌকিক প্রসঙ্গে এই সম্বন্ধটি টেনে আনলে তার তাৎপৰ্য্য বোঝা যায়। তাৎপৰ্য্যটি এই যে সত্যাৰ্থপ্রকাশের বাহন হিসাবে ভাষার সার্থকতা বিচার করতে হলে শব্দ এবং অর্থ উভয়কেই সামগ্রিকভাবে গ্ৰহণ করতে হবে। সত্যের স্বরূপ সামগ্রিক, অর্থস্বরূপ সামগ্রিক, শব্দস্বরূপও সামগ্রিক। পূর্ণতাই সত্য এই ঔপনিষদিক সিদ্ধান্ত উজ্জ্বাসমােত্র নয়। বাক্যার্থবোধের বিচারে এই অখণ্ডার্থ উপলব্ধি করা সহজ। ‘বৃষ্টি পড়ছে’–এই বাক্যটির অর্থ এবং শব্দ বিশ্লেষণ করে আপনি বলতে পারেন-বৃষ, ধাতু, তি প্রত্যয়, প্রথম বিভক্তি, পড়া ধাতু, ছে৷ প্ৰত্যয়-এই সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যোগ করে একটি বাক্য তৈরি হয়েছে, এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অর্থগুলো যোগ করে একটি বৃহৎ অর্থ তৈরি করা হয়েছে। এজাতীয় অর্থনির্মাণ ও বাক্যনিৰ্মাণ পদ্ধতি-বৈয়াকরণের বৈঠকখানায় প্রচলিত থাকতে পারে। কিন্তু নির্বোধ বালক বা প্রাজ্ঞ পণ্ডিত বস্তুজগতে বাক্যার্থ উপলব্ধির সময় এজাতীয় বিশ্লেষণী নৈপুণ্যের মারফত অর্থগ্রহণ করেন না, অর্থাৎ বাক্য ও অর্থ আমাদের উপলব্ধির ক্ষেত্রে পাটিগণিতের যোগফল নয়। একটি সমগ্ৰ বাক্যের সমগ্র একটি অর্থ আমরা একটি মানসিক প্রযত্বের দ্বারা অখণ্ড ভাবেই গ্ৰহণ করে থাকি। কর্তা, কর্ম, অধিকরণ, উদ্দেশ্য, বিধেয়, বিশেষ্যবিশেষণ, ধাতু, শব্দরূপ, প্রত্যয় ইত্যাদি বিশ্লিষ্ট রূপগুলির সংশ্লেষণের দ্বারা যদি পদে পদে অর্থাহরণ করতে হত তাহলে সমাজ-জীবন একদিনে আচল হয়ে পড়ত। বৃষ্টি পড়া একটি ঘটনা যা বৃষ্টি-রূপী কর্তার সঙ্গে পড়া’ ধাতুর অর্থযোগ করে তৈরী হয়নি। অপণ্ডিতের সহজ সামগ্রিক অর্থবোধকে পববর্তীকালে পণ্ডিতেরা বিশ্লেষণ করেন এবং মনে করেন যে বোধবিধৃত অর্থটিই বােধ হয় সংশ্লিষ্ট অংশগুলির যোগফল রূপে তৈরী হয়েছে। “নীল শাড়ীটা নিয়ে আয়’ বললে ‘নীলরূপ বিশেষণের দ্বারা বিশিষ্ট একটি তত্ত্ববিন্যাসময় পরিধেয় বস্তু আমাকে আনতে বলা হল”। এই মনে করে আপনার মেয়েটি শাড়ী আনতে ছুটবে না। পণ্ডিতেরা অনেক সময় নিজেদের চাতুৰ্য্যের দ্বারা নিজেরাই প্ৰতারিত হন, বিশ্লেষণী প্ৰতিভার দ্বারা অখণ্ডকে খণ্ডিত করেন আর মনে করেন ইটের ওপর ইট চাপিয়ে ইমারত তৈরির মত খণ্ড খণ্ড শব্দার্থ জোড়া দিয়েই একটি সমগ্ৰ শব্দার্থ তৈরী হয়ে থাকে। যদি বলা হয়। অর্থবোধের সময় আমরা খণ্ডগুলিকে খুঁজে পাইনা কেন, অনুভব করিনা কেন, তারা উত্তর দেন, ‘আছে বুঝতে পারছিনা। ন্যায় ব্যাকরণ পড়লে বুঝতে পারবে।” অনেকটা ‘চিকিৎসা-সংকটের” কবিরাজ মহাশয়ের ‘হয়, জানতি পারো না’ গোছের উত্তর হল।

পাণিনি ব্যাকরণের দার্শনিক সম্প্রদায় কিন্তু এ বিষয়ে খুবই স্পষ্টবাদী। তারা স্পষ্ট বলে দিলেন–বাক্যের অখণ্ড রূপ এবং অর্থের অখণ্ড রূপটাই সত্য। খণ্ডাংশগুলি এই অখণ্ড সত্তাকেই অভিব্যক্ত করে মাত্র। অংশগুলির স্বতন্ত্র সত্তা সত্য নয়, সামগ্রিক সত্যের প্রকাশে অংশগ্রহণ করে বলেই অংশগুলির সার্থকতা। আধুনিক ভাবনায় সমাজ ও ব্যক্তির সম্বন্ধ নির্ণয়ে এই সমগ্ৰতাবাদ অধিক প্রযোজ্য। সামাজিক চিন্তা চেতনা ও কর্মে অংশ গ্ৰহণ করেই ব্যক্তিসত্তা। সার্থকতা লাভ করে। সামাজিক সম্বন্ধের দ্বারাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। সুতরাং কতগুলি স্বতন্ত্র ব্যক্তির যোগফল হিসাবে সমাজ গড়ে ওঠেনি। বাক্যার্থ বিচারে পাণিনীয় সমগ্ৰতাবাদ “পূর্ণতাই সত্য।’ এই ঔপনিষদিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলিত রূপান্তর মাত্র। সমগ্রতাকে অস্বীকার করলে বাক্যার্থবোধ অসম্ভব হয়ে পড়ে-ধরুন ‘আকাশকুসুম নাই’; একটি বাক্য। এখানে খণ্ডাৰ্থ যোগ করে সমগ্র অর্থটি নির্মাণ করার চেষ্টা করে দেখুন প্রথম ধরুন ‘আকাশকুসুম’ শব্দটির একটি আলাদা অর্থ আছে। এই অর্থটি কি নাই? অর্থ যদি আছেই। তবে নাই বলছেন কাকে? আর অর্থই যদি নাই, তবে “নাই” ক্রিয়ার কর্তা কে?। আকাশকুসুম শব্দটির অর্থ না থাকলে সমগ্ৰ বাক্যটিই তো নিরর্থক হয়ে পড়বে। অথচ এর স্পষ্ট অর্থ তো আমরা অনুভব করি। যদি বলেন আকাশকুসুম শব্দটির একটি মানসিক ধারণাগত অর্থ আছে, কিন্তু সে অর্থটি বাইরে নাই, তাহলেও আকাশকুসুম ‘নাই’ ক্রিয়ার কর্তা হতে পারে না, কারণ বুদ্ধিগত ধারণাটা সত্যিই আছে। যদি বলেন “ধারণা ব্যাতিরিক্ত বস্তুস্বরূপ নাই’ বিপদ আরও বেড়ে যাবে, কারণ যা নিঃস্বরূপ তা ক্রিয়ার কর্তৃত্বস্বরূপ লাভ করতে পারে ন। তাই কর্তা নিঃস্বরূপ হলে “নাই” এই ক্রিয়াপদটি নিরর্থক। এইরূপে ‘বইটি আছে’ বা “বইটি নাই’ প্ৰভৃতি যে কোন বাক্যকে বিশ্লেষণ করে দেখানো সম্ভব যে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করলে সমগ্ৰ বাক্যার্থটি ব্যর্থতায় বিলীন হয়ে যাবে। এই জটিল কুটিল তর্ক তর্কের খাতিরেই করা হচ্ছে না। এ কথাটাই দেখাবার চেষ্টা করা হচ্ছে যে আমাদের বুদ্ধির সহজ স্বভাব সমগ্ৰতামুখী। খণ্ড-সত্যবাদী বার্ট্রাণ্ড রাসেল তাই বিপদে পড়ে বললেন, ‘A does not exist’-এই বাক্যটির কর্তা A কোনো না কোনো রকমে অবশ্যই আছে, না হলে বাক্যের কর্তা হ’ল কিরূপে? আমরা কিন্তু সমগ্রতাবাদী পাণিনীয় দর্শন অনুসারে বলতে পারি-আমাদের অনুভব-ধূত বাক্যার্থটি সমগ্ৰ অখণ্ড। এ অখণ্ডত। আপামর পণ্ডিতজনের অনুভবসিদ্ধ। পণ্ডিতের পরিতৃপ্তির জন্য এই সামগ্রিক বোধকেও বিশ্লেষণ করে পাণ্ডিত্য প্ৰকাশ সম্ভব। কিন্তু সে প্রচেষ্টা থেকে সম্প্রতি আমাদের বিরত থাকতে হবে। পারিপাশ্বিকের সঙ্গে একাত্মতা অনুভবের দ্বারা শিশুমানসেও সমগ্র বাক্যার্থবোধ কিভাবে জাগ্রত হয় সে বিষয়টি কুতুহলী গবেষকের অনুসন্ধিৎসার উপযুক্ত লক্ষ্য হতে পারে।

ভাষা মানুষের যৌথ সমাজ-জীবনের সব চেয়ে সার্থক অভিব্যক্তি। ভাষা ছাড়া সমাজ এক মুহূর্তে অচল হয়ে যেত, দণ্ডী বলেন-জগত অন্ধকারে ডুবে যেত। ভাষা ও অর্থের এই পূর্ণতাগ্রাহী অনুভূতি সমগ্রতাসন্ধানী মানব মোহ পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে, কিন্তু তবু এহেন শক্তিধর কবির বিখ্যাত কবিতা ‘হাওয়ার রাতে’র কয়েকটি পঙক্তি নেয়া যাক–

জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য্য রাত ছিল।

আশ্চৰ্য্য রাতের বিশাল আকাশের জলজলে চিত্র আঁকতে গিয়ে বেবিলনের রাণীর ঘাড়টাকে চিতার চামড়ায় জড়িয়ে নিরীহ পাঠকের বুদ্ধিকে চিতায় চড়াবার কি খুবই প্রয়োজন ছিল?

অতি আধুনিক কবি এরকম বাড়াবাড়ি করেন না, তবে যেদিকে তারা বাড়াবাড়ি করেন তার চেয়ে জীবানানন্দের এই বাড়াবাড়ি অনেক বেশী সহনীয়। আধুনিক কবি যখন কবিতার মধ্যে সোজাসুজি উচ্চাঙ্গ গণিতের কয়েকটি ফরমুলা বসিয়ে দেন :
… বলা যাবে মিলিয়নে, বিলিয়নে…ইত্যাদি ইত্যাদি
তিনগুণ দশের শক্তি চুয়াত্তর হলে যত পরমাণু ধরে
তাদের বিভাগ্য শক্তি, ক্ষমতায়, যা কেবল শুধু E = MC²-এর সীমা জানে,…
তখন ব্যাপারটা খুবই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সত্যিই গণিত হলে মা সরস্বতী চমকাবেন না, কারণ তিনি গণিত-বিদ্যার ও দেবতা। কিন্তু গণিতও নয় কবিতা ও নয়–এ কেমন রূপ? এতো মা সরস্বতীর শ্রাদ্ধের মন্ত্র!

বাংলা উপন্যাসের মেদ বাহুল্য কমিয়ে দিয়ে, বাংলা কবিতায় বাণভট্ট ও রবীন্দ্ৰনাথের অতিশয়োক্তিকে ফিরিয়ে আনলে সরস্বতী বোধ হয় আমাদের মত ইতরজনের ঘরে আবার বেঁচে উঠবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *