অতিথি
তিন বছর পর সফুরা দেশে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে সে যে একনাগাড়ে এতদিন পার করে দিয়েছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে নি। এই তো মনে হয় সেদিন মাত্র এসেছে। এক শীতে এসেছিল, মাঝখানে দুটা শীত গিয়ে এখন আবার শীতকাল।
প্রথম দিন ভীতমুখে বারান্দায় বসে ছিল। বেগম সাহেব তাকে দেখেও নাদেখার ভান করলেন। দুটা সুন্দর-সুন্দর বাচ্চা রূপা, লোপা; পাশেই খেলছে, অথচ তার দিকে তাকাচ্ছে না। এক সময় সফুরা ভয়েভয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার ভইন?
রূপা তার দিকে না তাকিয়েই বলল, আমাকে ভইন ডাকবে না।
সফুরা চুপ করে গেল। সময় কাটতেই চায় না। এরা তাকে কাজে বহাল করবে কি-না তাও বোঝা যাচ্ছে না। তার খুব পানি পিপাসা হচ্ছে কার কাছে পানি চাইবে?
এক সময় বেগম সাহেব চায়ের কাপ হাতে তার সামনে বসলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী নাম?
সফুরা।
ঘরের কাজকর্ম জানো?
সফুরা কী বলবে বুঝতে পারল না। ঘরের কাজকর্ম সে তো অবশ্যই জানে। ভাত রাঁধা, বাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া …. কিন্তু ঢাকার এইসব বাড়িতে কাজকর্ম কী রকম কে বলবে।
আগে কখনো বাসায় কাজ করেছ?
জে-না। ঢাকায় কী এই প্রথম?
জে।
বেগম সাহেব কঠিন মুখে বললেন, হাত ধরে-ধরে কাজকর্ম শেখাব, তারপর পাখা গজাবে। উড়ে চলে যাবে অন্য বাসায়। তোমাদের আমার চেনা আছে।
আমি কোনোখানে যামু না।
খামোকা এইসব বলবে না। আগে অনেকবার শুনেছি। বেতন চাও কত?
সফুরা চুপ করে রইল। যে তাকে নিয়ে এসেছে সে বারবার বলে দিয়েছে— বেতনের কথা বললে চুপ কইরা থাকবা। আগ বাড়াইয়া কিছু বলবা না। চুপ করে আছে। কিছু বলছে না।
কী, কথা বল না কেন? কত চাও বেতন?
আপনের যা ইচ্ছা।
কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছ?
সফুরা লজ্জা পেয়ে গেল। কাপড়চোপড় আনবে কী? একটা শাড়ি ছিল সেটাই নিয়ে এসেছে। যার কাপড়চোপড় আছে সে কি আর ছেলেপুলে স্বামী ছেড়ে ঢাকায় কাজ করতে আসে?
বেগম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাদের এই আরেক টেকনিক। এক কাপড়ে উপস্থিত হবে। যাতে সুঙ্গে-সঙ্গে একটা শাড়ি কিনে দিতে হয়।
সফুরা মাথা নিচু করে রাখল।
তোমার কী নাম যেন বললে?
সফুরা।
শোন সফুরা, থাক এইখানে। কাজ কর। কয়েকদিন কাজ দেখি। যদি কাজ পছন্দ হয় বেতন ঠিক করব। আমার সংসার ছোট। কাজকর্ম নেই বললেই হয়। মেয়েদের কখনো নাম ধরে ডাকবে না। আন্টি ডাকবে। একজন বড় আন্টি, একজন ছোট আন্টি। মনে থাকবে?
জে।
আমাদের আলাদা বাথরুম। ঐ বাথরুমে কখনো ঢুকবে নামনে থাকবে?
জে।
তোমাকে আলাদা থালা, গ্লাস দেয়া হবে। সব সময় সেগুলি ব্যবহার করবে। আমাদের থালা গ্লাস কখনো ব্যবহার করবে না।
জে আইচ্ছ।
সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। গ্রাম থেকে এসেছ, পেট ভর্তি কৃমি। কৃমির ওষুধ খাইয়ে দেব। মাথায় উকুন আছে?
জে।
উকুনের ওষুধ দেব। লরেকসিন চুলে মেখে গোসল কর।
জে আইচ্ছা।
দুদিন পরপর দেশের বাড়িতে যাওয়া। এর অসুখ তার অসুখ এইসব চলবে। দেশে যাবে বৎসরে একবার। দেশের বাড়ি থেকেও প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে লোক আসবে তাও চলবে না। বেতনের টাকা মাসের দু তারিখে দিয়ে দেব। মনি অর্ডার করে কিংবা কারো হাতে পাঠিয়ে দেবে।
জে আইচ্ছা।
কাচের থালা-বাসন ধরবে খুব সাবধানে। টেবিলের উপর কাচের যে বাটিটা দেখছ, যেখানে ফল রাখা—ঐ বাটিটার দাম তিন হাজার টাকা।
একটা বাটির দাম তিন হাজার টাকা? সফুরার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তিন হাজার টাকায় একটা গরু কেনা যায়। সামান্য একটা বাটি, তার দাম তিন হাজার।
বাটিটা একবার ছুঁয়ে দেখতে হবে।
সফুরা কাজে বহাল হল। যা-কিছু শেখার ছিল, সাতদিনে শিখে গেল। বেগম সাহেব যে তার কাজে খুশি তাও সে নদিনের দিন জেনে গেল। মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে সে শুনল বেগম সাহেব টেলিফোনে কাকে যেন বলছেন, আমার কাজের মেয়েটা চটপটে আছে। কাজ ভালোই করে। শেখার আগ্রহ আছে। তবে টিকবে না। কাজ শেখা হলে অন্য বাড়িতে কাজ খুঁজবে। এদের চেনা অাছে।
বেগম সাহেবের কথা সত্যি হয় নি। সে কোথাও যায় নি। এ বাড়িতে আছে। গত তিন বছরে দেশেও যায় নি। কয়েকবারই যাওয়া ঠিকঠাক হল। তার এমনি কপাল—যখন দেশে যাওয়া ঠিকঠাক হয় তখনি এ বাড়িতে একটা কিছু ঝামেলা লেগে যায়। প্রথমবার হোট আন্টির ফ্লু হল। অসুস্থ মানুষকে রেখে যাওয়া যায় না। পরের বার জাপান থেকে কারা যেন বেড়াতে এল। এ বাড়িতে থাকল এক সপ্তাহ। বাড়িতে মেহমান ফেলে সে যায় কীভাবে? তবে ঐ মেহমানরা যাবার সময় তাকে একটা ঘড়ি দিলেন। কী আশ্চর্য কাণ্ড, তার মতো মানুষকে কেউ ঘড়ি দেয়? ঘড়ি দিয়ে সে কী করবে? ঘড়ির সে কী বুঝে? বকুলের বাবা যখন পরের বার টাকা নিতে এল তখন টাকার সঙ্গে ঘড়িও দিল। মানুষটা অবাক।
ঘড়ি পাইলা কই?
আমারে খুশি হইয়া দিছে।
কও কী তুমি!
যা সত্য তাই কইলাম।
বেজায় দামি জিনিস বইল্যা মনে হয়।
হুঁ। বেইচ্যেন না।
আরে না, বেছ কী! ঘড়ির একটা প্রয়েজন আছে না? ঘড়ির ইজ্জতুই আলাদা।
বকুলের বাবা ঘড়ি হাতে পরে আনন্দে হেসে ফেলল। লোকটা বেজায় শৌখিন। টাকা নিতে যখন আসে মনে হয় ভদ্রলোক। মাথার চুল বেশির ভাগই পেকে গিয়েছিল। একবার এল— সব চুল কুচকুচে কালো। চুলে কলপ দিয়েছে। পাঁচ দশ টাকা নিশ্চয়ই চলে গেছে। লোকটা এইসব দেখবে না। বড় শৌখিন। সফুরা বড় ইচ্ছা করে এই শৌখিন মানুষটাকে চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে চারটা ভাত খাওয়ায়। তিন হাজার টাকা দামের বাটিতে করে সালুন এনে দেয় তা তো সম্ভব না। বেগম সাহেব বলে দিয়েছেন, তোমার স্বামী যে দুদিন পরপর ফুলবাবু সেজে চলে আসে খুব ভালো কথা। আসুক। তাকে ঘরে ঢুকাবে না। বাইরে থেকে বিদায় দেবে। একবার ঘরে ঢুকলে অভ্যাস হয়ে যাবে।
বেগম সাহেবের কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। তার অন্তর ভালো। তিন ঈদেই তার ছেলেমেয়ের জন্য টাকা দিয়েছে। গত ঈদে বেতনের বাইরেও পাঁচশ টাকা দিলেন। একটা গায়ের চাদর দিলেন। তার বেতন ছিল দেড়শ। তাকে কিছু বলতে হয় নি, বেগম সাহেব নিজেই বেতন বাড়িয়ে করেছেন দুশ। তা ছাড়া লোকজন এ বাড়িতে বেড়াতে এলে যাবার সময় হাতে পঞ্চাশ, একশ টাকা সব সময়ই দেয়। প্রতিটি পাই পয়সা সফুরার কাজে লাগে। বেতনের বাইরের টাকাটা সে জমা করে রাখে। দেশে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের জন্যে এটা-সেটা নিজের হাতে কিনে নিয়ে যাবে। তার এত কষ্টের টাকা।
বকুলের বাবা এসেছে সফুরাকে নিয়ে যেতে। বাবু সেজে এসেছে। হাতে ঘড়ি। চোখে কালো চশমা। গম্ভীর মুখে বারান্দায় বসে আছে। সফুরা বেগম সাহেবের কাছে বিদায় নিল। কদমবুসি করল এবং কেঁদে ফেলল। তিন বৎসর ছিল। মায়া পড়ে গেছে। যেতেও কষ্ট হচ্ছে। বেগম সাহেব বললেন, তোমার কাজে-কর্মে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার বাচ্চারাও তোমাকে পছন্দ করে। বেশিদিন থেকো না, চলে এসো। আজ থেকে তোমার বেতন আমি তিনশ করে দিলাম। ফিরে এসে এই বেতনেই কাজ করবে।
আপনের অনেক দয়া আম্মা।
বেগম সাহেব বেতন ছাড়াও–যাওয়া-আসার গাড়িভাড়া বাবদ দুশ টাকা দিলেন। একটা প্রায়-নতুন শাড়ি দিলেন। একজোড়া পুরানো স্যান্ডেল দিলেন। উদাস গলায় বললেন, তোমার সাহেবের একটা কোট আছে। এখন আর পরে না। নিয়ে যাও—কাউকে দিয়ে দিয়ে।
বকুলের বাবা সেই কোট সঙ্গে-সঙ্গে গায়ে দিয়ে বলল, ভালো ফিট করছে বউ। মাপ মতো হইছে। চল এখন গাবতলি বাসস্টেশন গিয়া বাস ধরি।
সফুরা বিস্মিত হয়ে বলল, পুলাপানের জন্যে সদাই করমু না? এতদিন পরে দেশে যাইতেছি।
কী সদাই করবা? চল গিয়া দেখি–জামা জুতা। রিকশা লও।
বকুলের বাবা সিগারেট ধরিয়ে বাবু সাহেবের মতো টানতে-টানতে খালি রিকশা দেখতে লাগল। সফুরা বলল, আপনেরে চিননের আর উপায় নাই। বাবু সায়েবের মতো লাগতাছে। চউক্ষে চশমা দিছেন কত দাম চশমার?
শস্তায় কিনছি। রইদের মইধ্যে চউক্ষে দিলে খুব আরাম হয়।
আপনে অখন একজোড়া জুতা কিনেন।
বকুলের বাবা উদাস গলায় বলল, চল যাই। শস্তায় পাইলে একজোড়া কিনব।
রিকশায় উঠে বকুলের বাবা ক্ষীণ স্বরে বলল, একটা বিষয় হইছে, বুঝলা সফুরা। তোমারে আগে না বললে বাড়িতে গিয়া হই চই করবা। হই চই করনের কিছু না।
সফুরা আতঙ্কিত গলায় বলল, কী বিষয়?
বকুলের বাবা নিচু গলায় বলল, তুমি ঢাকায় চইল্যা আসলা, বাড়ি হইল খালি। ঘরের শতেক কাজকর্ম। সংসার ভাইস্যা যাওনের উপক্রম। গেরামের দশজনে তখন বলল ….
আপনে কী বিবাহ করছেন?
উপায়ান্তর না দেইখ্যা গত বাইস্যা মাসে …
আমারে তো কিছু খবর দেন নাই।
বকুলের বাবা চুপ করে গেল। সফুরার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। লোকটা বাইস্যা মাসে বিয়ে করেছে। ঈদের পরপর। বেগম সাহেব জাকাতের টাকা থেকে যে পাঁচশ টাকা বাড়তি দিয়েছেন সেই টাকাটা খরচ করেছে বিয়েতে। জাকাতের টাকাটাই তার কাল হয়েছে।
রাগ করলা নাকি সফুরা? ভালো মতো বিবেচনা কর। মেয়েমানুষ ছাড়া সংসার চলে? তুমি পইরা আছ ঢাকা শহরে।
নয়া বউ-এর নাম কী?
সুলতানা।
দেখতে কেমুন?
আছে মোটামুটি।
গায়ের রং কেমন? ধলা।
আবার সফুরার চোখে পানি এসে গেল। চিৎকার করে তার কাদতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করলেও তা সম্ভব না। তা ছাড়া কী হবে চিৎকার করে কাঁদলে? কিছুই হবে না।
ঘুরে-ঘুরে অনেক কিছু কিনল সফুরা। ছেলেমেয়েদের জন্যে জামা-জুতা, স্নাে-আলতা। একটা মশারি। চিনি, পোলাউয়ের চাল, এক ডজন কমলা। সবার জন্যেই কিছু-না-কিছু কেনা হয়েছে, শুধু নতুন বউয়ের জন্যে কেনা হয় নি। বেচারি মন খারাপ করবে। তার তো কোনো দোষ নাই। তাকে বিয়ে করেছে বলেই সে এই সংসারে এসেছে।
সফুরা নয় বউ-এর জন্যে একটা লালপেড়ে শাড়ি এবং কাচের চুড়ি কিনল।
বকুলের বাবা বলল, লাল ফিতা কিনো তো বউ। ফিতার কথা বলছিল।
সফুরা লাল ফিতাও কিনল।
দুপুরের দিকে তারা গাবতলি বাসস্টেশন থেকে বাসে উঠল। বকুলের বাবা মিষ্টি পান কিনেছে। সে বসেছে জানালার পাশে। জানালার পাশে ছাড়া সে বসতে পারে না। তার মাথা ধরে যায়। বাস ছাড়ার মুহূর্তে সে ঘড়িতে সময় দেখে গম্ভীর গলায় বলল, রাইত আটটা বাজব। শীতের দিন বইল্যা রক্ষা। আরামে যাইবা। গরমের সময় হইলে খুব কষ্ট হইত। এইটা খিয়াল রাখবা বউ, শীতকাল ছাড়া দেশে আসবা না। বেড়াইবার সময় হইল তোমার শীতকাল।
সফুরা জবাব দিল না। শীতকালের পড়ন্ত রোদে সে বেড়াতে যাচ্ছে। পাশে স্বামী। কতদিন পর দেখবে ছেলেমেয়েদের। আনন্দে তারা চিৎকার করে কাদবে। সারারাত হয়তো ঘুমাবে না। নয়া বউ লালপেড়ে শাড়ি পরে তাকে এসে কদমবুসি করবে। সে নয়া বউকে বলবে— আমার অনেক কষ্টের এই সংসার। তুমি এরে দেখেশুনে রাখ। বলতে বলতে. সে হয়তো কেঁদে ফেলবে। আজকাল অকারণেই তার চোখে জল আসে। কত আনন্দ করে সে বাড়ি যাচ্ছে। এখন কাদার কোনো কারণ নেই। অথচ কী কাণ্ড! সে কেঁদেই যাচ্ছে। অনেককাল আগে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়ও সে এইভাবেই কাঁদছিল।
অসাধারণ লেখনী।