গৌড়ানন্দ কবি ভনে

অতিথি-যোজনামন্ত্রী, স্বাগতম

অতিথি-যোজনামন্ত্রী, স্বাগতম

সুধী পাঠক! আমাদের নব নিযুক্ত অতিথি-যোজনামন্ত্রী কমরেড নিকোলাই বাইবাকোভের সঙ্গে আসুন, আপনাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিই। কমরেড বাইবাকোভকে আপনারা বোধহয় তেমন চেনেন না। উনি আমাদের পরম সখা সোভিয়েত রুশিয়ার যোজনামন্ত্রী। সমাজতান্ত্রিক যোজনার রথকে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে বাঁই বাঁই করে ছোটাতে উনি খুবই ওস্তাদ। তাই সম্ভবত ওঁর শুভনাম বাইবাকোভ হয়ে থাকবে।

অতিথি-যোজনামন্ত্রী কথাটা হয়তো আপনাদের কানে নতুন শোনাবে। তবে জিনিসটা খুব একটা নতুন নয়। অতিথি শিল্পী বা গেসট্ আরটিস্ট বলে একটা কথা আমাদের দেশে অনেকদিন ধরেই প্রচলিত আছে জানেন তো? অতিথি-মন্ত্রীর ব্যাপারটাও প্রায় তাই। এবং আরও কিছু। যোজনা দফতরের অতিথি-মন্ত্রীকেই নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী অতিথি যোজনামন্ত্রী বলা হয়।

আপনারা জানেন আমাদের গরিবি হঠাও অর্থনীতি ব্যাংক, কয়লা, ইস্পাত ইত্যাদি ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত করার পরও জনসাধারণের মনে এমন আবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি যার জোয়ারে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আমরা তরতরিয়ে তরে যেতে পারি। বা ওড়িশার বা অন্য কোনও রাজ্যে আমাদের অনুগত প্রার্থীরা অনায়াসে বুঝতেই তো পারছেন কী বলতে চাইছি। এখন কথা হচ্ছে জনসাধারণের মনে তেমন আবেগ মানে আমরা যেমনটি চাই তেমনটি, সৃষ্টি হল না কেন? আমাদের অর্থনীতিতে কোনও ভুল ছিল না। কারণ আমাদের অর্থনীতি গরিবি হঠাও অর্থনীতি। এর প্রয়োগেও যে ভুল হয়নি, তার প্রমাণ আমাদের হাতেই আছে। আমরা এ বিষয়ে যে সমীক্ষা চালিয়েছিলাম তাতে দেখা গিয়েছে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে আমাদের এবং আমাদের প্রগতিশীল মোরচাভুক্ত জনপ্রতিনিধিদের শতকরা ৬০ ভাগই নিজ নিজ পরিবার থেকে গরিবি হঠিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি কয়েকটি রাজ্যে যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এ কাণ্ড ঘটেছে তা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মাত্র দু বছরের মধ্যেই উল্লিখিত রাজ্যের কিছু ছাত্র ও যুবনেতা সহ জনপ্রতিনিধির বাইশ শতাংশের পারিবারিক গ্রোথ রেট্‌ সর্বভারতীয় গ্রোথ্ রেট্ অপেক্ষা শতকরা দুশ ভাগ বেশি হয়েছে, ছত্রিশ শতাংশ জনপ্রতিনিধির পারিবারিক গ্রোথ রেট্‌ সর্বভারতীয় গ্রোথ রে অপেক্ষা শতকরা একশ পঁচিশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে এমনকি মন্ত্রিস্থানীয় কোনও কোনও জননেতার আত্মীয় বন্ধু মহলের পারিবারিক গ্রোথ্ রে গড়ে সর্বভারতীয় গ্রোথ রেট্‌ অপেক্ষা শতকরা আশী ভাগ বেড়েছে। যেহেতু আমাদের সিসটেমে জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষা জনপ্রতিনিধি এবং জননেতাদের মাধ্যমেই মূর্ত হয়ে ওঠে, কারণ তাঁরাই জনগণের প্রতিনিধি সেই হেতু জনপ্রতিনিধি এবং জননেতাদের গ্রোথ্ রেকে আমরা প্রতিনিধিত্বমূলক গ্রোথ রেট্‌ হিসাবে ধরতে বাধ্য। এবং যেহেতু অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিই একদা নিজে গরিব ছিলেন অথবা গরিবের ঘর থেকেই এসেছিলেন, অতএব এঁদের উন্নতিশীলতার দৃষ্টান্ত আমরা অনায়াসেই গরিবি হঠাও-এর অকাট্য প্রমাণ হিসাবে উপস্থিত করতে পারি এবং এইভাবেই প্রমাণ করতে পারি যে আমাদের গরিবি হঠাও অর্থনীতি ত্রুটিমুক্ত এবং তার প্রয়োগও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভুল এবং ফলপ্রসু।

তথাপি যে দেশে সাড়া জাগছে না, তার কারণ পুঁজিবাদী একচেটিয়া মালিক সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তি এবং তাদের চরেদের চক্রান্ত। এদেরই চক্রান্তে আজ দেশে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত হবার পর কয়লাখনি থেকে কয়লা প্রাপ্তি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কথাও আপনাদের জানা।

যাই হোক, তা সত্ত্বেও আমরা এগিয়ে যাব এবং এগিয়ে যাচ্ছি। আপনারা জানেন, আমরা এখন পঞ্চম যোজনার দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছি। পঞ্চম যোজনার ভিতরে আমাদের জন্য বিরাট সমাজতান্ত্রিক উন্নতি অপেক্ষা করছে। আমাদের পঞ্চম যোজনার দরজা খোলার জন্য যে চাবি দরকার আপনারা শুনে সুখী হবেন যে, সেই চাবি আমরা কোনও ষড়যন্ত্রকারী পুঁজিবাদী কি নয়া সাম্রাজ্যবাদীদের কোনও কারখানায় তৈরি করতে দিইনি। আমাদের সমাজতান্ত্রিক সখা সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে আমরা আশ্বাস পেয়েছি, এ চাবি তাঁরাই সরবরাহ করবেন। অতি সম্প্রতি আমরা এই জন্য পনের বছরের এক সহযোগিতা চুক্তি করেছি। রুশ-ভারত সহযোগিতা চুক্তি সত্যই। এক ঐতিহাসিক চুক্তি। কারণ এই চুক্তি বলেই আমরা আমাদের সমাজতান্ত্রিক যোজনার দরজা খোলার চাবি, মেড ইন মসকো অনায়াসে পেয়ে যাব।

এই চাবি ঘোরাবার পদ্ধতি কিঞ্চিৎ জটিল। কমরেড নিকোলাই বাইবাকোভ এই চাবি ব্যবহারের কৌশল জানেন, কেননা এই চাবির নকশা তিনিই অনেক মাথা খাটিয়ে তৈরি করেছেন। কাজেই বুঝতে পারছেন, আমরা কমরেড বাইবাকোভকে অতিথি-যোজনা মন্ত্রীর পদে বরণ করে কী পরিমাণ, দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছি। মনে রাখবেন, অতিথি-যোজনামন্ত্রী নিয়োগ করে আমরা এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। নবনিযুক্ত অতিথি-যোজনামন্ত্রী কমরেড নিকোলাই বাইবাকোভ পদাধিকার বলে আমাদের ভবিষ্যতের যোজনাগুলো রুশ-ভারত ঐতিহাসিক মৈত্রীর ভিত্তিকে যাতে দিনে দিনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম পরামর্শ দেবেন। এবং আমাদের যোজনামন্ত্রী শ্রীধর সর্বদা তাঁর মস্তকে সহযোগিতার ছত্র ধরে থাকবেন। যদি এই পরীক্ষা সফল হয় (সফল হোক এই আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা) তাহলে ভবিষ্যতে অন্যান্য দফতরের অতিথিমন্ত্রী আমদানীর পথও প্রশস্ত হয়ে উঠবে।

সমাজতান্ত্রিক যোজনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ়তর করা। কাজেই অতিথি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর প্রয়োজন দেখা দেবে। তার পর আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা দৃঢ় করার প্রয়োজন বড় হয়ে উঠবে। বিরোধী দলের অস্তিত্ব সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাবগত ঐক্য স্থাপনের পক্ষে যে বড় অন্তরায় কমরেড ব্রেজনেভের এই সমাজতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে আমরা, আহা কে না একমত নই। আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা দৃঢ় করার সমাজতান্ত্রিক কৌশল শিক্ষা দেবার জন্য অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমদানি আমাদের স্বনির্ভর অর্থনীতিতে এক নতুন মহিমা আরোপ করবে।

আসুন আমরা আনন্দ করি এবং এই সকল সম্ভাবনার অগ্রদূত আমাদের অতিথি-যোজনামন্ত্রীকে আসুন, স্বাগত জানাই।

১২ ডিসেম্বর ১৯৭৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *