অতিথির আবদার

অতিথির আবদার

আমি কিছুদিন খবরের কাগজের রিপোর্টার হয়েছিলাম৷ অর্থাৎ প্রতিদিন যত রাজ্যের খবর সংগ্রহ করে আমাকে দৈনিক সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা পরিপূর্ণ করতে হত৷ সত্যের সঙ্গে খানিকটা কল্পনা এবং কল্পনার সঙ্গে খানিকটা সত্যের রসান দিয়ে নীরস হাড় বার করা খবরগুলোকে নধর এবং সরস করে তোলাই আমার কাজ ছিল৷ এইটুকু পারি বলেই সংবাদ সাহিত্যে আমার এতখানি আদর এবং প্রতিষ্ঠা৷

সেদিন সারাদিন সারা শহরটা ঘুরে দু-চারটে ছুটো তুচ্ছ খবর ছাড়া বেশি কিছু সংগ্রহ করতে পারিনি! সেই জন্য মনটা তেমন ভালো ছিল না৷ একে শ্রান্ত দেহ, তার উপর অবসন্ন মন নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম তখন সমস্ত দেহ-মনে কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব অনুভব করতে লাগলাম৷ মনে হতে লাগল খাটিয়ায় চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়ি৷ কিন্তু পারলাম না, সামনে যে কাজ! যে খবরগুলো সংগ্রহ করেছি কোনো রকমে গুছিয়েগাছিয়ে নিয়ে সেগুলো ছাপাখানায় পাঠিয়ে দেবার মতলবে কলম নিয়ে বসে গেলাম৷

একটা খুনের খবর ছিল৷ কলকাতা থেকে বারো মাইল দূরে এক গ্রামে একটা ভীষণ খুন হয়েছিল৷ কিন্তু খবরটা এমন প্রহেলিকায় ধোঁয়াটে যে সেটাকে যথেষ্ট পরিমাণে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলা শক্ত৷ কে যে খুন করেছে, কাকে খুন করেছে এবং কেনই বা খুন করেছে তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পুলিশ এ পর্যন্ত দিতে পারেনি এবং আমিও আবিষ্কার করতে পারিনি৷ যে ঘরে খুন হয়েছে সেখান থেকে একটা জিনিসও চুরি যায়নি, একটা বাক্স-প্যাঁটরাও ভাঙা হয়নি৷ তাহলে খবর দেবার আর কী আছে? এক লাইনেই খুনের সব খবর শেষ হয়ে যায়৷ খুন তো প্রত্যহ হয় না, কাজেই এই খবরটাকে এক নিশ্বাসে শেষ করে আমার খবর রচনার প্রতিভাটাকে ক্ষুণ্ণ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না৷ তাই বসে বসে ভাবতে লাগলাম৷

হঠাৎ মনে হল, চুরি তো হয়েছে! যারা খুন করেছে, তারা আর কিছু চুরি করেনি বটে, কিন্তু যাকে খুন করেছে তার মাথাটা তো কেটে নিয়ে গেছে৷ নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য আছে৷ কিন্তু সে উদ্দেশ্যটা কী? খামখা একটা মানুষের মাথা কেটে নিয়ে গিয়ে চোরের যে কী লাভ হতে পারে তার সূক্ষ তত্ত্বটা কিছুতেই মাথায় আনতে পারছিলাম না৷ কিন্তু তা বলে তো খবরটাকে ছাড়া চলবে না-কোনো একটা বিশেষ সূত্র অবলম্বন করে খবরটাকে রীতিমতো লোমহর্ষক করে তুলতে হবেই৷

বেশ নিবিষ্ট মনে লিখতে বসে গেলাম৷ সামনে কেরোসিনের বাতিটা টিমটিম করে জ্বলছিল, টেবিল ঘড়িটা টিকটিক শব্দে চলছিল৷ রাতের নিস্তব্ধতা ক্রমেই বেশ জমাট হয়ে আসছিল৷ আমি ঘরের মধ্যে একলাটি বসে খুনের একটা লোমহর্ষক কাহিনি লিপিবদ্ধ করে চলেছিলাম৷ মুণ্ডচ্ছেদের ব্যাপারটা ক্রমেই এমন ঘোরালো হয়ে উঠেছিল যে সেই গভীর রাত্রে একলা ঘরে বসে নিজের লেখা বিবরণে নিজেই চমকে উঠছিলাম৷ শেষে গায়ের ভেতরটা কেমন শিরশির করতে লাগল-কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম৷ মনে হতে লাগল যেন মাথাটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে৷ ওই ভীষণ খুনটা যেন নিজের চক্ষে দেখছি৷ সামনে যেন রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে, একটা দুশমন কার ঘাড়টা ধরে, তার জ্যান্ত মুণ্ডুটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কেটে নিচ্ছে-উঃ! আমি আর থাকতে পারলাম না, তাড়াতাড়ি খুনের বর্ণনা লেখা কাগজগুলো চাপা দিয়ে চোখ বুজে ফেললাম৷

হঠাৎ একটা জোর ফুঁ দিয়ে কেরোসিনের ছোট্ট টিমটিমে বাতিটা কে নিভিয়ে দিল৷ মানুষেণ গলা টিপে ধরলে যেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, টেবিল ঘড়িটা তেমনিতর একটা বিশ্রী আওয়াজ করে একেবারে নিসাড় হয়ে গেল- তার বুকের টিকটিক আওয়াজ আর শোনা গেল না৷ আর সঙ্গে- সঙ্গে একটা চড়াই পাখি কড়ি কাঠের ফাঁক থেকে কী একটা টুপ করে ঠিক আমার সামনেটিতে ফেলে দিল৷ মনে হল যেন একটি ছোটো মটর দানা৷

অন্ধকারে সেই মটর দানাকে দেখতে দেখতে ক্রমে সেটা একটা প্রকাণ্ড মাথার মতো হয়ে উঠল! ধড় নেই, শুধু গলা কাটা মুণ্ডু! মাথা ভরা মস্ত বড়ো বাবরি চুল৷ বড়ো বড়ো দুটো গোল চোখ লাল টকটক করছে৷ চওড়া কপালখানা মিশকালো-তার উপর রাঙা সিঁদুর দিয়ে একটা ত্রিশূল আঁকা৷ এই এত বড়ো জোড়া কালো গোঁফ-দু-দিকে পাকানো৷ গালপাট্টা দাড়ি! ঠিক যেন মনে হল মা দুর্গার প্রতিমার হাতের অসুরের মুণ্ডুটা৷ আমার দিকে কটমটিয়ে চেয়ে আছে৷

আমি ভয়ে একটু পেছিয়ে যেতেই, সে তার বড়ো বড়ো চোখ দুটো বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে উঠল-“ভয় পাও কেন?”

আমি আর কথার জবাব দেওয়া নয়, সাঁ করে চেয়ার ছেড়ে একেবারে আমার শোবার খাটিয়ায় এসে বসলাম! সঙ্গেসঙ্গে মুণ্ডুটা টেবিল থেকে তড়াক করে লাফিয়ে একেবারে আমার খাটিয়ায় এসে হাজির হল৷ বলল- ‘শোনো না!”

আমি আর বিলম্ব নয়, খাটিয়া থেকে দৌড়ে আবার চেয়ারে এসে বসলাম৷ সেও লাফাতে লাফাতে খাটিয়া ছেড়ে, টেবিলের উপর ঠিক মুখের সামনেটিতে এসে বসল৷ বলল, “একটু স্থির হও না৷” বলে ক্রমেই সে আবার কাছে ঘেঁষে আসতে লাগল৷

আমি এবার চেয়ার ছেড়ে খাটিয়ায় এসে ধপ করে শুয়ে একেবারে লেপের মধ্যে প্রবেশ করলাম-আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে!

সে বলল-“অমন করছ কেন? হল কী তোমার?”

আমি লেপের মধ্যে থেকে বললাম, “আমার কিছু হয়নি৷ তুমি এখান থেকে বেরোও!”

সে বলল-“আচ্ছা অভদ্র তো তুমি! তোমার ঘরে অতিথি এল, তাকে তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছ? এই তোমার শিক্ষা?”

আমি কোনো জবাব দিলাম না৷ সেই নাছোড়বান্দা বাবরি চুলওয়ালা মুণ্ডুটা আমার লেপ মুড়ি দেওয়া দেহের আশেপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ আমি চুপ করে পড়ে রইলাম৷ এমনি থাকলে, সে নিরুপায় হয়ে আপনিই পালাবে ভাবলাম৷ কিন্তু কী সর্বনাশ! হঠাৎ দেখি, লেপের কোনো একটা ফাঁক আবিষ্কার করে সে সুড়ুৎ করে আমার লেপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে-একবারে আমার বুকের উপর এসে বসেছে! আর সেই কালো গালপাট্টা ভরা মুখের ভেতরকার সাদা দাঁতগুলো বার করে সে হেসে বলল-“কী বড্ড যে লুকিয়েছিলে?” বলে সে বিকট শব্দে হেসে উঠল৷ আমি সেই হাসির শব্দে আঁতকে উঠে হাতের এক ঝাপটায় সেই মুণ্ডুটাকে বুক থেকে টেনে ফেলে দিলাম৷ সে খানিকটা গড়িয়ে পড়ে আবার হাসতে হাসতে আমার বুকের উপর এসে বসল৷ কী আপদ!

আমি চোখ বুজে কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম! সে বলল, “ও কী, চোখ বুজলে কেন? শোনো যা বলি৷” আমি তবু চুপ করে রইলাম৷ সে কখন আস্তে আস্তে বুক থেকে মুখের কাছে এগিয়ে এসেছে টের পাইনি৷ হঠাৎ তার গালপাট্টা দাড়িটা আমার গালে ঘসতেই আমি চমকে উঠলাম৷ সে আদর করে তার সেই গালপাট্টা আমার গালে ঘসতে ঘসতে আমায় বলতে লাগল- “রাগ করছ কেন ভাই? একবার চোখটা খোলো৷”

আমি জবাব দেব কী, তার সেই দাড়ির ঘর্ষণে বোধ হতে লাগল আমার দেহের ভেতরের অস্থি মেদ মাংসগুলোকে একটা মুড়ো খ্যাংরা দিয়ে কে যেন আগাপাশতলা ঝেঁটিয়ে দিচ্ছে! সর্ব শরীর রি-রি করতে লাগল৷ আমি ঘাড় দিয়ে একটা জোর ঝাঁকানি মেরে সেই মুণ্ডুটাকে মুখের পাশ থেকে সরিয়ে দিলাম৷ পাছে আবার সে মুখের কাছে মুখ নিয়ে আসে এই আতঙ্কে লেপ ছেড়ে একেবারে সোজা হয়ে বসলাম৷ সে একটু মুচকে হাসল৷

আমি তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি৷ এই বীভৎস মুণ্ডুটার সঙ্গে এতক্ষণ একলা কাটিয়ে ভয় এবং অস্বস্তির প্রথম ধাক্কাটা যেন অনেকখানি মোলায়েম হয়ে এসেছিল৷ আমি তার দিকে চেয়ে বিরক্তির স্বরে বলে উঠলাম-“কী চাও তুমি?”

সে বলল-“এই কথাটা প্রথমেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল৷ তাহলে এতক্ষণ ধরে এতখানি ধস্তাধস্তি করতে হত না৷”

আমি বললাম-“আমি কি সেধে ধস্তাধস্তি করেছি? তোমার যে বিকট রূপ!”

সে বলল-“তোমারই বা কী এমন মনোমোহন রূপ? ওই তো চিমসে চেহারা!”

আমি বললাম-“থাক, এখন আর রূপের সমালোচনায় কাজ নেই৷ তুমি কী চাও, বলো৷”

সে বলল-“আমি কী চাই, তা আবার বলে দিতে হবে? আমার কী অভাব তা তুমি দেখতে পাচ্ছ না? তোমার চোখ নেই?”

আমি বললাম,-“দেখো, তোমার কী অভাব আছে না আছে তা দেখবার আমার ইচ্ছেও নেই, দরকারও নেই৷”

সে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল-“দেখছ না, আমার ধড় নেই৷ মানুষের একটা চোখ কি একটা পা না থাকলে, তার প্রতি তোমাদের কত দয়া হয়, আমার সারা ধড়টাই নেই দেখেও তোমার এতটুকু দয়া হচ্ছে না?” বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়তে লাগল৷

সত্যি বলছি, তার সেই কান্না দেখে আমার কেমন মায়া করতে লাগল৷ তার যে অমন ভয়ংকর মূর্তি, যা দেখলেই প্রাণ আঁতকে ওঠে, তা দেখে আর তেমন ভয় করতে লাগল না৷ বরং ইচ্ছে হতে লাগল তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিই৷ সে বোধ হয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল৷ আদর দিলে বেড়ালগুলো যেমন গায়ের উপর এসে গা ঘসতে থাকে, তেমনিতর সেই বিকট মুণ্ডুটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার পায়ের উপর মুখ থুবড়ি খেয়ে পড়ে তার গালপাট্টাওয়ালা গালটা বুলোতে লাগল৷ বেচারার সেই আকুতি-কাকুতি দেখে আমি আর তাকে ঠেলে ফেলে দিতে পারলাম না; তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে তোমার বলো তো?”

সে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “আমার ধড় চুরি গেছে!”

এই চুরির কথা শুনেই হঠাৎ আজকের খুনের কথাটা আমার মনে পড়ল! আমি বলে উঠলাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজ একটা ধড় পাওয়া গেছে বটে, তার মুণ্ডু নেই, সে কি তোমারই ধড় নাকি?”

কথাটা শুনে সে গলাটা উঁচু করে বলে উঠল-“অ্যাঁ! ধড় পাওয়া গেছে? কী রকম? কী রকম? শুনি!”

আমি আমার লেখা রিপোর্টখানা টেনে নিয়ে তাকে আগাগোড়া ঘটনাটা পড়ে শোনাতে লাগলাম৷ সে একমনে শুনতে লাগল৷ শোনা শেষ হলে এক গাল হেসে বলে উঠল-“দুর! এ তোমার গল্প! তুমি গল্প লেখো বুঝি?

আমি বললাম-“গল্প হবে কেন? এ সত্যি ঘটনা৷”

সে তার চোখ দুটো ঘুরিয়ে বলল-“কক্ষনো না৷ সত্যি ঘটনা এ রকম হতে পারে না৷ এ তোমার বানানো গল্প!”

আমি তার কথা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলাম৷ খুনের ঘটনার উপর রসান দিয়ে আমি যে এতক্ষণ একটা ঘোরালো রিপোর্ট তৈরি করলাম, সেটা কি তাহলে নিতান্ত ছেলেমানুষি গল্প হয়ে উঠল?

আমি বললাম-“এ তো একেবারে সত্যি ঘটনার মতো! গল্প কোনখানটা দেখলে?”

সে বলল-“কাটা মুণ্ডু কী করে চুরি যায়, এই কাটা মুণ্ডু আমি-আমি তা জানি৷ তুমি কী করে জানবে? তোমার ও লেখা ঠিক হয়নি-আগাগোড়াই আজগুবি গল্প হয়েছে৷”

আমার কেমন ধাঁধা লাগতে লাগল৷ এতকাল রিপোর্ট লিখে আসছি, কেউ কখনো নিন্দে করেনি, আজ কি একটা আজগুবি গল্প লিখে ফেললাম? নাঃ, তার কথায় আমার বিশ্বাস হল না৷ আমি ভাবছি, সে বলল-“ভাবছ কী? আমার কাছে শুনে যাও, তবে কাটা মুণ্ডুর রিপোর্ট সঠিক লিখতে পারবে৷”

আমি হেসে বললাম-“তাহলে সেটা আরও আজগুবি হবে৷”

সে বলল-“কেন?”

আমি বললাম-“এত রাত্রে একটা কাটা মুণ্ডু এসে আমায় রিপোর্ট দিয়ে গেল, একথা শুনলে লোকে বলবে কী? বলবে গাঁজাখুরি গল্প!”

সে রেগে দাঁত কড়মড় করে বলে উঠল-“কী, আমি গাঁজাখুরি গল্প? আমি সর্দার গজধর সিংহ, যে এককালে হাতির শুঁড় ধরে চরকি বাজির মতো বিশ মন হাতি ঘুরিয়েছে, সে হল গল্প? আর তোমার ওই কাগজে লেখা কতকগুলো ফাঁকা কথা, তাই হবে সত্যি?”

তার এই ভীষণ রাগ দেখে আমার কেমন ভয় করতে লাগল৷ আমি বললাম-“রাগ করো কেন ভাই? এই দুপুর রাত্রে, কেউ কোথাও নেই, একটা কাটা মুণ্ডু কোথা থেকে আমার ঘরে এসে আমার সঙ্গে বাগবিতণ্ডা করছে, এ কথা বললে কেউ কি বিশ্বাস করবে? বলবে ও তোমার বানানো গল্প!”

সে ভুরু দুটো কুঁচকে বলল-“বিশ্বাস করবে না কেন?”

আমি বললাম-“কাটা মুণ্ডু কখনো কথা কইতে পারে? না সে জ্যান্ত মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে?”

সে বলল-“পারে কি না পারে-এই তো স্বচক্ষে দেখছ! বলো, পারে কি না পারে৷”-বলে সে আমায় এক ধমক দিয়ে উঠল!

আমি বললাম-“হ্যাঁ, স্বচক্ষে দেখছি বটে যে তুমি এসেছ, কিন্তু-“

সে বলল-“কিন্তু কী? কিন্তু আবার কী?-এই তো দেখছ, স্বচক্ষে দেখছ সর্দার গজধর সিংহের কাটা মুণ্ডু তোমার সামনে স্পষ্ট কথা কইছে!”

আমি বললাম-“হ্যাঁ, দেখছি বটে, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না৷”

সে বলল-“রোসো বুঝিয়ে দিচ্ছি!” বলেই সে তার সেই সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো একবার বার করে দেখাল৷ মনে হল বুঝিবা আমাকে এখনই কামড়ে ধরবে! আমি আঁতকে উঠে একটু পিছিয়ে গেলাম৷

সে বলল-“এইবার বুঝতে পেরেছ তো? এখন শোনো আমার ইতিহাস-তারপর তোমার রিপোর্টটা লিখো৷ কাটা মুণ্ডুর রিপোর্ট কি সোজা জিনিস নাকি!”

এই রে, আবার ইতিহাস যে আরম্ভ করে! এমনি করে সারা রাত চলবে নাকি? আমি বললাম-“মাথা ধরেছে আমার; আমি এখন ইতিহাস শুনতে পারব না৷”

সে বলল-“শুনতেই হবে তোমাকে! না শুনলে তোমার কান ফুঁড়ে জোর করে শুনিয়ে দেব৷”

আমি আর কী করি? প্রায় কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললাম-“আচ্ছা তা হলে বলো৷”

সে আরম্ভ করল-“আমার নাম সর্দার গজধর সিং৷ আসল নাম কিন্তু পূর্ণ বেহারা৷ হাতির শুঁড় ধরে ঘোরাতে পারতাম বলে লোকে আমায় খেতাব দিয়েছিল গজধর সিং৷ কত বছর আগে ঠিক জানি না, আমি ছিলাম বিষ্ণুপুরে বনগাঁয়ের জমিদারের পাইক৷ যেমন দুশমনের মতো চেহারা, তেমনই দুশমনের মতো গায়ে জোর! আমার ডাকে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খেত! আমি বাবুর বাড়ি পাহারা দিতাম৷ আমার নাম শুনে বনগাঁয়ের বিশ-পঁচিশ ক্রোশের মধ্যে চোর কি ডাকাত আসতে সাহস করত না৷ আমি রোজই দেউড়িতে পাহারা দিই, একদিন সকালে বাড়িতে মহা হইচই পড়ে গেল গিন্নিমায়ের সিন্দুক ভেঙে হিরের গয়না চুরি হয়েছে৷ কর্তা আমায় তলব করলেন, আমি দেউড়িতে পাহারা দিই, অথচ চুরি হল কেমন করে? চুরির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম-আমি সর্দার গজধর সিং হাজির থাকতে, চোর এল কেমন করে? আমি বললাম-‘হুজুর, বাইরে থেকে কখনোই চোর আসেনি৷’ কর্তা বললেন-‘তবে কি আকাশ থেকে চোর পড়ল?’ আমি বললাম-‘চুরি ভেতরের লোকই করেছে৷’ কর্তার ছোটো ভাই সেখানে দাঁড়িয়েছিল, সে এই কথা শুনে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে উঠল৷ সে আমার উপর ভারি চটা ছিল৷ রোজই অনেক রাত্রে লুকিয়ে সে বাড়ি ফিরত বলে আমি তাকে শাসাতাম কর্তাবাবুকে বলে দেব৷ সেই রাগ তার আমার উপর ছিল৷ সে বলে উঠল-এত বড়ো আস্পর্ধা! চাকর হয়ে মনিবদের চোর বলে-দাও ব্যাটাকে গলাধাক্কা! বলে সে আমার ঘাড় ধরে এক ধাক্কা দিল৷ আমি তার হাতখানা তখনই মুচড়ে ভেঙে দিতে পারতাম কিন্তু হাজার হোক মনিব!

“সেই দিনই চাকরির উপর আমার ঘৃণা হল! চাকর বলেই তো মিছামিছি অপমানটা সইতে হল! আমি কাজে ইস্তফা দিয়ে একটা ডাকাতের দল খুললাম৷ মনে করলাম গায়ের জোরে যা পারি রোজগার করব, পরের চাকরি আর করব না৷ ডাকাতি ব্যাবসা খুব জোর চলতে লাগল৷ দলের লোকেরা আমার পুরোনো মনিব মস্ত ধনী বলে তাঁর বাড়ি লুট করবার জন্যে প্রায়ই আমাকে জেদাজেদি করত, কিন্তু আমি রাজি হতাম না-একদিন তাদের নুন খেয়েছি তো!

“কিছুদিন পরে একদিন রাত্রে বনগাঁয়ের বনের মধ্যে আমাদের আড্ডায় অন্ধকারে বসে আছি, এমন সময় দেখি আমাদের দলের এক পাহারাওয়ালা একজন লোককে বেঁধে আমার কাছে নিয়ে আসছে৷ আমি অন্ধকারে লোকটার চেহারা ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও কে রে?’ পাহারাওয়ালা উত্তর দিল-‘সর্দার, এই লোকটা আমাদের আড্ডার কাছে ঘুপটি মেরে বসেছিল, নিশ্চয় পুলিশের চর হবে-তাই বেঁধে নিয়ে এসেছি৷’ আমি বললাম-‘আলো নিয়ে আয়, দেখি, লোকটা কে৷’ আলো আনতে লোকটাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ আমি বলে উঠলাম-‘প্রণাম হই ছোটোবাবু৷’ ছোটোবাবু আমার পায়ের উপর আছড়ে পড়ে বলল-‘রক্ষে করো গজধর আমায়৷’ এই ছোটোবাবুই একদিন গলাধাক্কা দিয়েছিল৷ আমি তাকে তাড়াতাড়ি পায়ের কাছ থেকে বুকে তুলে নিয়ে বললাম-‘কী হয়েছে ছোটোবাবু?’ ছোটোবাবু বলল-‘আমায় পুলিশে তাড়া করেছে৷’ আমি বললাম, ‘কেন?’

“সে বলল-‘সেই হিরের গয়না চুরি নিয়ে৷ তোকে মিথ্যে বলব না- চুরি আমিই করেছিলাম৷ পরে ধরা পড়ি৷ পুলিশের হাজত থেকে পালিয়ে এখন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি৷ তুই আমাকে আশ্রয় দে৷’ আমি বললাম-‘সে কী ছোটোবাবু! এ তো আপনারই আশ্রয়-আমরা আপনার চাকর মাত্র! তবে শুনে রাখুন, যদি আমরা ধরা পড়ি তবে একসঙ্গে মরতে হবে৷ কেউ যদি আমাদের কাউকে ধরিয়ে দিতে যায়, তার জীবন আমাদের হাতে! আপনি হলেও নিস্তার নেই!’

“ছোটোবাবু আমাদের সঙ্গেই রয়ে গেলেন৷ আমরা যেমন লুকিয়ে ফিরি তার চেয়ে বেশি করে লুকিয়ে তাঁকে ঘুরতে ফিরতে হত-কারণ তিনি দাগি তাঁর নামে পুলিশের ওয়ারেন্ট আছে৷ আমরা তাঁকে যকের ধনের মতো আগলে রাখতাম৷ এমন কারও সাধ্য ছিল না, তার গায়ে হাত দেয়৷

“একদিন ছোটোবাবুকে খুঁজে পাওয়া গেল না৷ তখন বিষ্ণুপুরে গোটাকতক খুব বড়ো বড়ো ডাকাতি হওয়াতে পুলিশ চারিদিকে হইচই লাগিয়ে দিয়েছিল৷ আশপাশে চারিদিকে তাদের গোয়েন্দা ঘুরছিল৷ ভয় হল ছোটোবাবু পুলিশের হাতে পড়লেন নাকি! খবর পেলাম আমাদের আড্ডার খুব কাছাকাছি পুলিশ ছাউনি ফেলেছে, দলের সবাই সে জায়গা ছেড়ে পালাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল, কিন্তু আমি ছোটোবাবুকে ছেড়ে পালাতে পারলাম না-তাঁকে খোঁজবার জন্যে আমাকে দলবল নিয়ে সেইখানে থেকে যেতে হল৷

“পরের দিন রাত্রে পুলিশ আমাদের আড্ডা ঘেরাও করল৷ আমরা ধরা পড়লাম৷ হাতে হাতকড়া পড়ল৷ পুলিশের সঙ্গে ছোটোবাবু ছিলেন, তাঁর কিন্তু হাত খোলা৷ তিনি আমাকে সনাক্ত করলেন-‘এই গজধর সিং, আমাদের বাড়ির পুরোনো পাইক, এখন ডাকাতের সর্দার!’

“আমাদের সকলকার জেল হল-বারো বচ্ছর করে৷ কিন্তু ছোটোবাবুর সকল অপরাধ মার্জনা হল৷ তিনি নিজের প্রাণের মায়ায় এত বড়ো একটা ডাকাতের দল ধরিয়ে দিয়ে যে নিমকহারামি করলেন-এ তারই বখশিশ৷ কিন্তু আমি যে এতদিন তাঁর বিপদ নিজের মাথায় নিয়ে তাঁকে খাইয়ে-দাইয়ে লুকিয়ে রাখলাম, তার বখশিশ কেউ দিল না৷”

এই অবধি বলে সে চুপ করল৷ তারপর তুড়ুক করে লাফিয়ে একেবারে আমার বুকের উপর এসে সেই কাটা মুণ্ডুটা বলে উঠল-“কী ঘুমোলে নাকি?”

আমি বললাম-“না ঘুমোইনি৷ কিন্তু তোমার মুন্ডু চুরির ইতিহাস কই? এ তো তোমার জীবন কাহিনি৷”

সে বলল-“তুমি তো আচ্ছা বোকা! গোড়া না শুনলে শেষটা বুঝবে কী করে?”

আমি বললাম-“আচ্ছা তাহলে বলো৷”

সে আমার বুক থেকে তুড়ুক করে নেমে বলতে লাগল-“বারো বচ্ছর তো জেলে কাটল ভালোয়-মন্দয়৷ ফিরে এসে আর বিষ্ণুপুর বনগাঁয়ের দিকে গেলাম না৷ কিন্তু সেখানকার খবর মাঝে মাঝে পেতাম৷ কিছুদিন বাদে শুনলাম ছোটোবাবুকে খুন করেছে আমাদেরই সেই ডাকাতের দলের একজন৷ জিনিসপত্র টাকাকড়ি কিছুই নেয়নি, শুধুই খুন করেছে৷ লোকে শুনে অবাক! কিন্তু যখন ধরা পড়ে কবুল করল তখন লোকে বুঝতে পারল৷ সে বলেছে ছোটোবাবু নিমকহারামি করে তাদের ধরিয়ে দিয়েছিল বলেই তাকে খুন করতে হয়েছে৷ কারণ মাকালীর সামনে সর্দারের পা ছুঁয়ে সে শপথ করেছিল যে তাদের দলের মধ্যে যে নিমকহারামি করবে সে যদি আপনার মায়ের পেটের ভাইও হয় তবুও তার বুকে ছুরি বসাতে কাতর হবে না৷ মাকালীর সামনে সর্দারের পা ছুঁয়ে শপথ৷ সে শপথ ভঙ্গ করে সে নরকে যাবে?

“বেচারা ফাঁসি গেল, তাও শুনলাম৷ গায়ে মাথায় কতবার কত লাঠি পড়েছে, রক্ত ঢেউ খেলে গেছে, কিন্তু চোখ দিয়ে কখনো এক ফোঁটা জল পড়েনি৷ কিন্তু সেদিন তার ফাঁসির খবর শুনে আমার দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল, কেন কে জানে?

“আমার বুকটা যেন ভেঙে গেল৷ আর ডাকাতের দল খুলতে পারলাম না, সে সাহসও ছিল না, শক্তিও ছিল না৷ এবার একটা চোরের দল গড়লাম৷ হইহই রইরই করে, মশাল জ্বেলে, পাড়া জাগিয়ে রাজা-জমিদারের বাড়ি ডাকাতি নয়, এবার চুপিচুপি, গা-ঢাকা দিয়ে, পা টিপে টিপে গৃহস্থের বাড়িতে সিঁধ কেটে চুরি!”

এই অবধি শুনে আমি অধৈর্য হয়ে বলে উঠলাম-“কই হে, মুণ্ডু চুরির ব্যাপারটা কখন আসবে? এ তো তোমার সিঁধেল চুরির গল্প আরম্ভ হল!” যেমন এই কথা বলা, কাটা মুণ্ডুটা একটা উল্কার মতো ঘুরতে ঘুরতে আমার মুখের সামনে এসে দাঁত কড়মড় করে বলে উঠল-“দেখো, ফের যদি আমায় বিরক্ত করবে তা হলে এই দাঁত দিয়ে তোমার জিভ কেটে দেব-চিরদিনের জন্যে বকবকানি থেমে যাবে৷”

আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম-“আচ্ছা আমি আর কিছু বলব না!”

সে আবার শুরু করল-“চুরির ব্যাবসা বেশ সজোরে চলতে লাগল৷ সম্বলের মধ্যে আমাদের ছিল গোটাকতক সিঁধকাটি আর খানকতক কুড়ুল৷ কাঠি দিয়ে সিঁধ কাটা হত, আর কুড়ুল দিয়ে সিন্দুক বাক্স এবং দরকার হলে মানুষের মাথা ভাঙা হত৷ দলে আমরা পাঁচজন ছিলাম-যেন পঞ্চপাণ্ডব! পাড়াগাঁয়ে দশ ক্রোশ অন্তর থানা পুলিশ৷ আমাদের খবরদারি করে কে? চোরে কামারে দেখা হলে তো? কাজেই আমাদের ব্যাবসা ফলাও হয়ে উঠল-কিন্তু নিয়তি যাবে কোথায়? এক জায়গায় সিঁধ কাটতে গিয়ে ইঁদুরের মতো জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে গেলাম৷ সিঁধ কেটে গর্তের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে পা দুটি চালিয়ে এদিক-ওদিক পরখ করে দেখে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে যেই কোমর অবধি চালিয়ে দিয়েছি, অমনি ভেতর থেকে দুটো লোহার মুগুরের মতো দু-খানা হাত দিয়ে কে আমার কোমরটা সজোরে জাপটে ধরে হিড়হিড় করে টানতে লাগল৷ আমি বেরিয়ে আসবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু সেই ভীমের সঙ্গে পেরে উঠলাম না৷ ব্যাপার দেখে আমার সঙ্গীরা বাইরে থেকে আমায় জাপটে ধরে টানতে লাগল৷ ভেতরে বাইরে দু-দিক থেকে আমার দেহটাকে নিয়ে টানাটানি চলতে লাগল-যেন দেবাসুরে মিলে সমুদ্র মন্থন লাগিয়ে দিয়েছে৷ আমার প্রাণ যায় যায় হয়ে উঠল৷ শেষে যখন আমায় আর ধরে রাখতে পারা গেল না-আমার কাঁধ অবধি প্রায় গর্তের মধ্যে চলে গেছে তখন আমাদের দলের মধ্যে ঠিক অসুরের মতো যার চেহারা সে আর বাক্যব্যয় না করে তার হাতের কুড়ুলটা নিজের মাথা অবধি তুলে একটি কোপ দিয়ে ধড় থেকে আমার মুণ্ডুটা সাফ দিল খসিয়ে৷ তারপর আমার কাটা মুণ্ডু নিয়ে লাফাতে লাফাতে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল৷”

আমি বলে উঠলাম-“কেন! কেন! কাটা মুণ্ডু নিয়ে পালাল কেন!”

সে বলল-“তা আর বুঝলে না! মুণ্ডু সুদ্ধ ধরা পড়লে লোকে আমায় চিনে ফেলত৷ শুধু ধড় দেখে তো মানুষ চেনা যায় না৷”

আমি জিজ্ঞেস করলাম-“তাহলে আজকের মুণ্ডু চুরিটাও কি ওই ব্যাপার?”

সে বলল-“রোসো৷ আগে বলো দেখি সিঁধ কাটা হয়েছে কি না?”

আমি বললাম-“কই সিঁধ কাটা তো দেখিনি৷”

সে ভুরু দুটো কুঁচকে বলল-“তবেই তো মুশকিলে ফেলল! সিঁধ কাটা নেই-চোরকে নিয়ে টানাটানি নেই, খামকা মুণ্ডুটা কেটে নিয়ে গেল? ব্যাটারা এমন বেদস্তর কাজ করল! পাজি ব্যাটারা, ছুঁচো ব্যাটারা, গর্দভ ব্যাটারা, এমন বেদস্তর কাজ করল!” বলে সে রাগে গমগম করতে লাগল৷

আমি একটু ভেবে বললাম-“দেখো, ও ঠিক হয়েছে৷ তোমার ইতিহাস শুনে আমি একটা হদিস পেয়েছি৷ টাকাকড়ি চুরি যায়নি অথচ একটা খুন হয়েছে এবং তার মুণ্ডুটা পাওয়া যাচ্ছে না এর একটা হদিস তোমার ছোটোবাবুর খুন আর তোমার মুণ্ডু কাটার গল্প থেকে আমি বেশ ধরে নিয়েছি৷ এবার আমি লিখে দিতে পারব৷”

সে এক গাল হেসে বলল-“তাহলে আমার বখশিশ!”

আমিও হেসে বললাম-“কী বখশিশ চাও?”

সে বলল-“আমায় একটা ধড় দাও৷ আমি কি শুধু মুণ্ডুটা নিয়ে ঘুরে বেড়াব!”

আমি বললাম-“ধড় কোথায় পাব?”

সে ভয়ংকর চেঁচিয়ে উঠে বলল-“কী রাস্কেল! এতক্ষণ পরে বলল ধড় কোথায় পাব? সাতকাণ্ড রামায়ণের পর সীতা কার ভার্যা! আমি কি তোমার ঘরে যাত্রা শুনতে এসেছি? ধড় আমার চাই!” বলে সে দমদম করে আমার টেবিলের উপর তার কপালটা ঠুকতে লাগল৷

আমি বললাম- “করো কী! করো কী!”

সে বলল-“বলো একটা ধড় এনে দেবে? নইলে আমি মাথা ঠুকতে লাগলাম৷” বলে আবার দমাদ্দম মাথা ঠুকতে লাগল৷

আমি তার এই ব্যাপার দেখে বলে উঠলাম-“থামো, থামো৷ আমি তোমার জন্যে নিশ্চয় চেষ্টা করে দেখব৷”

সে বলল-“আচ্ছা তাহলে এই কথাই রইল৷ আমি আবার একদিন আসব, মনে থাকে যেন”-বলেই সেই কাটা মুণ্ডুটা শূন্যের উপর ডিগবাজি খেতে খেতে উঠে গিয়ে কড়িকাঠের কাছে ঘুলঘুলিটার ভেতর দিয়ে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল৷ আমি ধড়মড় করে বিছানার উপর উঠে বসলাম৷

সকাল বেলা খুনের খবরটা বেশ বাগিয়ে গুছিয়ে লিখে খবরের কাগজে পাঠিয়ে দিলাম, কিন্তু সম্পাদক ছাপালেন না৷ বললেন, অচল৷ সেই জন্যে রাগ করে সেটাতে আরও খানিকটা রসান দিয়ে ‘কায়াহীনের কাহিনি’র পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, জানি সেখানে অচল হবে না৷

কিন্তু কথা হচ্ছে এই, সত্যই ওই দেহহীন ভদ্রব্যক্তিটি আবার কোনো দিন নিশীথ রাত্রে নিদ্রাচ্ছন্ন আমাকে দেখা দিতে আসবেন নাকি? কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *