অতল জলের শহর – ৭

(৭)

আগেই বলেছি, আটলান্টিয়ানদের জলতলের শহর যেখানে, সেখান থেকে কিছু দূরে রয়েছে তাদেরই সেই মহানগর— যা ছিল একদা ভূপৃষ্ঠে সরগরম অবস্থায়, এখন নেমে এসেছে সমুদ্রতলে বিধ্বস্ত অবস্থায়। এরকমটা হবে তা জেনেই আটলান্টিয়ানরা জলতলে বাসযোগের উপযোগী প্রাসাদ নির্মাণ করে নিয়েছিল। গোটা দেশটা ডুবে গিয়ে প্রাণহীন হয়ে গেলেও প্রাণস্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে চলেছে অতল জলের এই শহর— যেখানে ঠাঁই পেয়েছিলাম আমরা। অক্সিজেন বোঝাই কাচের গোলক দিয়ে মুখ ঢেকে কীভাবে সেই প্রাসাদনগরীর ধ্বংসস্তূপ দেখে এসেছিলাম, সে কাহিনিও আমি বলেছি অনেক আগে। ভাবাবেগে বিচলিত হয়েছিলাম, তাও লিখেছি। ভাষা দিয়ে আমার মনের সেই অবস্থা ব্যক্ত করা যায় না। দেখে এসেছি জলমগ্ন বিশাল বিশাল ইমারত, কারুকাজ করা থাম সমেত প্রকাণ্ড সৌধ— নিতল জলের স্বতঃদীপ্ত প্রভায় ছায়ামায়ায় গড়া এখন সব কিছুই— খাঁ খাঁ করছে চারিদিক— গভীর জলের মাছ আর বিবিধ প্রাণীদের আনাগোনা চলছে ভেঙে পড়া খিলেন আর বুরুজের আশপাশ দিয়ে। মস্ত তোরণ হেলে ঝুলছে, কোথাও খিলেন ভেঙে পড়েছে… দুঃস্বপ্ন নগরীর মতো ছায়ামায়ায় ঘেরা যেন অতীতের এক কঙ্কাল শহর। আমরা প্রায় টহল দিতে যেতাম জায়গাটায়, কবরখানায় ঘুরে দেখার মতো পায়চারি করতাম, মহাকালের কুলিশকঠোর শাসনের মূর্ত প্রতিচ্ছবি দর্শন করতাম। অদ্ভুত স্থাপত্য নিয়ে হারিয়ে যাওয়া সেই সভ্যতা নিয়ে পৃথিবীর ওপর কতই না জল্পনা কল্পনা… কিন্তু আমাদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা বলে দিয়েছে, কিংবদন্তী হলেও মূলে আছে সত্যি। আটলান্টিস নামক গৌরবোজ্জ্বল মহাদেশ একদা ছিল ধরাপৃষ্ঠে, এখন তা রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের পাঁচ মাইল তলায়। যেতাম অত্যাবশ্যক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য নিয়ে। জড়বস্তু তথা ভৌতিক পদার্থের মাল-মশলা থেকে যা পাওয়া যায়। কিন্তু এহেন অভিযানের ফলে অচিরেই যে অবাস্তব আধ্যাত্মিক শক্তির আধিভৌতিক নমুনা দেখতে পাব, এমন সম্ভাবনাটা দূরতম কল্পনাতেও আনতে পারিনি। অথচ সেই অভিজ্ঞতা হয়ে গেল আমাদের— যা লিখতে বসে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

বস্তুজগতে আটলান্টিয়ানরা উর্ধ্বে উঠেছিল। পেছিয়ে থাকেনি আত্মিক কৃষ্টি আর সংস্কৃতিতেও। আধ্যাত্মিক জগতে তাদের সেই উত্থান আমাদের চেয়ে ঢের বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও পতন ঘটেছিল ধীশক্তির অপব্যয় ঘটানোর দরুণ, আত্মিক শাসনে না চলে হঠকরিতা দেখানোর শাস্তি স্বরূপ। সুপ্রাচীন সেই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছিল এ হেন ঔদ্ধত্যের ফলে, হবে আমাদেরও।

প্রাচীন সেই শহরে আমরা দেখেছিলাম বিশাল একটা ইমারত। নিশ্চয় নির্মিত হয়েছিল পাহাড়ের মাথায়, কেননা জলতলে থেকেও রয়েছে সমুদ্রতল থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, চারদিক ঢালু হয়ে নেমে এসেছে শৈবাল সমাকীর্ণ অবস্থায়। কালো মার্বেল পাথরের রীতিমতো চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে নিচ থেকে ওপরে। এই কালো মার্বেল দিয়ে নির্মিত হয়েছে ইমারতের বেশির ভাগ অংশ। কিন্তু প্রায় ঢেকে এসেছে হলুদ রঙের ভয়াবহ এক ছত্রাকের দাপটে, দগদগে কুষ্ঠরোগের মতো, ঝুলছে প্রতিটি কার্নিশ আর ঠেলে বেরিয়ে থাকা অংশ থেকে। মূল তোরণটাও কালো মার্বেল দিয়ে গড়া। তোরণের মাথায় বসানো কালো পাথরের মেডুসা মুণ্ড— মাথায় কিলবিলে সাপ-চুলের বদলে সে মুখ দেখলেই নাকি পাথর হয়ে যেতে হয়— কিংবদন্তী কাহিনি অনুসারে। গোটা ইমারতের দেওয়ালে দেওয়ালে এখানে সেখানে সেই একই মেডুসা প্রতীক খোদাই করা হয়েছে বারংবার। বেশ কয়েকবার ইচ্ছে হয়েছিল অভিযান চালাব এহেন দুর্লক্ষণযুক্ত অশুভ অট্টালিকার অভ্যন্তরে, প্রতিবারেই কিন্তু আমাদের রুখে দিয়েছিল ম্যান্ডা। বিলক্ষণ অঙ্গভঙ্গীসহ বুঝিয়ে দিয়েছিল— খবরদার! ওই বাড়ির ছায়া যেন না মাড়াই। বেশ বুঝেছিলাম, ম্যান্ডা সঙ্গে থাকলে কোনওদিনই অশুভ ওই অট্টালিকার অন্দরে প্রবেশ করা যাবে না। অথচ ভেতরে এমন কী আছে যা সিঁটিয়ে দিচ্ছে খোদ দলপতিকে, তা তো জানা দরকার। রহস্য ভেদ করতেই হবে, যে ভাবেই হোক। একদিন সকালে তাই মিটিং করে নিলাম আমি আর স্ক্যানলান।

স্ক্যানলান বলেছিল, ‘কিছু একটা আছে বাড়ির ভেতরে। ম্যান্ডা তা দেখাতে চায় না আমাদের। চলুন, একদিন আপনি আর আমি কাচের গোলক মাথায় দিয়ে ঢুঁ মেরে আসি ভেতরে।’

‘আমার আপত্তি নেই,’ কথা শেষ হতে না হতেই ম্যারাকট ঢুকেছিলেন ঘরে। তাকেও বলেছিলাম, ‘চলুন, কালো মার্বেল প্রাসাদের রহস্যভেদ করে আসা যাক।’

ম্যারাকট বলেছিলেন, ‘ও প্রাসাদ ব্ল্যাক ম্যাজিক-এর প্রাসাদ হলেও হতে পারে। কৃষ্ণ আনন অধিপতির নাম জানা আছে?’

স্বীকার করেছিলাম আমার অজ্ঞতা। একটা কথা লিখতে ভুলে গেছিলাম ডক্টর ম্যারাকট সম্বন্ধে। উনি তুলনামূলক ধর্ম বিষয়ে জগৎবিখ্যাত বিশেষজ্ঞ। সুপ্রাচীন আদিম বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করে বিলক্ষণ নাম কিনেছেন। আটলান্টিস সম্বন্ধেও উনি খবর রাখেন অনেক।

বলেছিলেন, ‘আমাদের যা কিছু জ্ঞান সম্পদ, সবই তো এসেছে মিশর মারফত। সাইস মন্দিরের পুরুতরা যা-যা বলেছিল সোলনকে, সেই সব উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে কিছু কল্পনা, কিছু সত্যি।’

‘বলেছিল কী?’ স্ক্যানলানের প্রশ্ন।

‘অনেক কথা। এই সবের মধ্যে মুখে মুখে চলে এসেছে কৃষ্ণ আনন অধিপতির কিংবদন্তী। মনে হয়, কালো মার্বেল প্রাসাদের অধিপতিও সে। কেউ কেউ বলে, এরকম অধিপতি ছিল জনা কয়েক। নথিভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু একজনের বৃত্তান্ত।’

‘সেই বৃত্তান্তটা কী, জানতে পারি?’

‘অনায়াসে। সে ছিল মানুষের চেয়েও অনেক বেশি কিছু— অমানুষ বললে হয়তো কিছুটা বলা হয়, শক্তিমত্তা আর কুটিল ব্যাপারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারই নষ্টামির ফলে ডুবে যায় গোটা আটলান্টিস।’

‘সোডোম আর গোমোরা-র মতো? ঈশ্বরের কোপে ধ্বংস হওয়া দু-খানা শহরের মতো?’

‘সঠিক। একটা সময় আসে যখন সব সীমার বাইরে চলে যায়। প্রকৃতি আর সহ্য করে না। ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে। যার নাম একটু আগে বললাম— কৃষ্ণ আনন অধিপতি— ব্ল্যাক ম্যাজিকের চূড়ান্ত ঘটিয়েছিল যত্তসব অশুভ শক্তিদের হাতের মুঠোয় এনে, তছনছ কাণ্ড আরম্ভ করেছিল। তাকে মানুষ না বলে শয়তান বলা উচিত। কৃষ্ণ আনন অধিপতির কিংবদন্তী সৃষ্টি হয়েছে এই কাহিনি থেকেই। তাই তার ভয়ানক আলয়ে ঢুকতে চাইছে না সাগরতলের এই সৎ মানুষরা।’

আমি বলেছিলাম, ‘আর ঠিক সেই কারণেই ঢুকতে চাই আমি।’

‘আমিও,’ তাল ঠুকে গেছিল স্ক্যানলান।

প্রফেসর বলেছিলেন, ‘আগ্রহটা আমার যে নেই, তা বলব না। কিন্তু যারা আমাদের ঠাঁই দিয়েছে, তাদের নিয়ে যাওয়া যাবে না। এরা অন্ধ কুসংস্কারের ভক্ত, রামভীতু। সুযোগ বুঝে একদিন আমরা তিনজনে যাব।’

সুযোগটা এসেছিল অচিরে। একদিন সকালের দিকে (আমার মোটামুটি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) আটলান্টিয়ানরা একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিল। যে দ্বারপাল দু-জন জলের পাম্প চালানোর দায়িত্বে ছিল প্রবেশ পথে, তাদেরকে এটা-সেটা বুঝিয়ে, তিনজনে বেরিয়ে পড়েছিলাম বাইরে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেছিলাম প্রকান্ড কালো মার্বেল অট্টালিকার মেডুসা-মুন্ডা তোরণের সামনে। ঢুকে গেছিলাম অশুভ শক্তির ঘাঁটির মধ্যে।

সুপ্রাচীন এই মহানগরের অন্যান্য ভবনের চাইতে অধিকতর উত্তমভাবে সুরক্ষিত থেকেছে এই ব্ল্যাক মার্বেল ম্যানসন। পাথর-টাথর যেখানে যা ছিল, তার কোনওটাই খসে বা পালটে যায়নি। ফার্নিচার আর ঝোলানো পর্দা-টর্দাগুলোই কেবল বহু আগে উচ্ছন্নে গেছে। সে সবের জায়গায় প্রকৃতি জুগিয়ে দিয়েছে নিজস্ব ঝালর এবং তা নিরতিসীম ভয়ানক। পুরো জায়গাটা অতিশয় ছায়াচ্ছন্ন দম-আটকানো পরিবেশময়। কিন্তু এহেন ছায়ামায়ার মধ্যে প্রকটভাবে বিরাজ করছে দানবিক বিযুক্তদল উদ্ভিদ আর বিদঘুটে বিকট আকারেরর মীন মহাশয়রা— যেন নিশার দুঃস্বপ্ন দিয়ে নির্মিত। বিশেষ করে আমার চোখের সামনে ভাসছে খোলকহীন এক রকমের সামুদ্রিক-শামুক গুটি গুটি সঞ্চারমান সর্বত্র, আর এক রকমের বৃহদাকার কৃষ্ণকায় চ্যাপটা মৎস্য যারা কার্পেটের মতো ছেয়ে রেখেছে সব মেঝে— শুঁড় নেড়ে চলেছে অনবরত— শুঁড়ের ডগা থেকে যেন অগ্নিশিখা ঠিকরে এসে নৃত্য করে চলেছে সর্বত্র। পা ফেলতে হয়েছে হুঁশিয়ার হয়ে, কেননা গোটা আট্টালিকাটাই তো কদাকার প্রাণীতে ঠাসা— দেখলে মনে হয় নিরীহ নয় কেউই— রীতিমতো বিষধর।

অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত গলিপথের পর গলিপথ দেখেছি বিস্তর— দু-পাশে ছোট ছোট ঘর, মস্ত ভবনের ঠিক মধ্যিখানে রয়েছে কিন্তু প্রকাণ্ড একটা হলঘর— চোখধাঁধানো রকমের জমকালো— সুদিনের সময়ে এমন হলঘর নিশ্চয় গোটা আটলান্টিক মহাদেশে দ্বিতীয় একটা ছিল না। মানুষের হাতে গড়া হলঘর যে এমন অপরূপ হতে পারে, না দেখলে প্রত্যয় হবে না। ছায়াচ্ছন্ন আলোর মধ্যে দিয়ে ছাদ দেখতে পাইনি, লম্বায় চওড়ায় কোনদিকে কতখানি প্রসারিত— তাও ঠাহর করতে পারিনি। কিন্তু যখন হেঁটে গেছি হাতের আলোর দীপ্তি সামনের দিকে ছিটিয়ে দিয়ে, তখনই স্তম্ভিত হয়েছি আকার আয়তনের বিশালতায়, দেওয়ালে দেওয়ালে মার্ভেলাস খোদাই কর্মের প্রাচুর্যে। অলঙ্করণ করা হয়েছে প্রস্তরমূর্তি আর কারুকাজ দিয়ে, শিল্পনৈপুণ্যের অসাধারণ নিদর্শন, অথচ চিত্তচঞ্চল করার মতো ভয়ানক। নিষ্ঠুরতা আর লাম্পট্য চূড়ান্ত রূপে ফুটে উঠেছে দেওয়ালে দেওয়ালে। ছায়ামায়ার মধ্যে দিয়ে এরা যেন কায়া পরিগ্রহ করে চলেছে দিকে দিকে। শয়তান যদি তন্নিষ্ঠ হয়ে নিজের মন্দির নির্মাণে মনোযোগ দেয়, তাহলে এই সেই মন্দির। শয়তান স্বয়ং যেন নিরতিসীম প্রকট হয়ে রয়েছে এখানকার একটা কক্ষে। ঘরের এক প্রান্তে বিরং এক ধাতু দিয়ে তৈরি চন্দ্রাতপের নিচে— সে ধাতু সুবর্ণ হলেও হতে পারে— লোহিত মার্বেলের একটা সিংহাসনের ওপরে আসীন রয়েছে ভয়াবহ এক বিগ্রহ— মূর্তিমান অশুভ শক্তি— বর্বর, ভ্রুকুটি কুটিল, নির্দয়— আটলান্টিয়ান কলোনির ‘বাল’ মন্দিরে যেমনটা দেখেছিলাম তেমনি, বরং আরও বিদঘুটে, নিরতিসীম কদর্য। মুখাবয়বে ভয়াবহ শক্তি যেন বিস্ফারিত হয়ে চলেছে। হাতের আলো ফেলে বিকট সেই মুখাবয়ব যখন নিরীক্ষণ করছি স্থানু অবস্থায়, ঠিক সেই সময়ে অতীব আশ্চর্য এবং অতিশয় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল আমাদের সক্কলের বুকের রক্ত ছলকে দিয়ে। ঠিক পেছনে শুনলাম মনুষ্য কণ্ঠে অতিশয় নির্দয় উচ্চরবের অট্টহাস্য।

আগেই বলেছি, কাচের গোলকের মধ্যে আমাদের মুণ্ড থাকার ফলে বাইরের কোনও শব্দ কানে আসবার কথা নয়। এমন গোলক দিয়ে মাথামুণ্ড ঢেকে কেউ আওয়াজ করতেও পারে না। তা সত্ত্বেও বিদ্রুপের সেই অট্টহাসি আছড়ে পড়েছিল আমাদের প্রত্যেকের কর্ণকুহরে। সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। থ হয়ে গেছিলাম সামনে যে জিনিসটা দাঁড়িয়েছিল, তা দেখে।

অনেক স্তম্ভের একটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা লোক। দু-হাত ভাঁজ করে রাখা বুকের ওপর। হিংস্র দুই চক্ষু মেলে স্থির নয়নে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। শুধু চাহনি দিয়েই বুকের মধ্যে কাঁপন জাগিয়ে দিতে চাইছে। তাকে আমি লোক বলছি বটে, কিন্তু কোনও লোকের মতো সে নয়… এ রকম মানুষ আমি কখনও দেখিনি… অমানুষ বললে সঠিক বলা হয়, যদিও সে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, কথা বলছে মানুষের মতো, তাহলেও তার কণ্ঠস্বর একেবারেই অমানবিক— আমাদের মতো নয় কোনমতেই। বাহ্যত সে এক জমকালো প্রাণী, মাথায় সাত ফুটের কম নয়, গড়নপেটন চৌকস ক্রীড়াবিদের মতন, যা আরও পরিস্ফুট গায়ে চেপে বসা বসন পরে থাকার দরুন— যেন চকচকে কালো চামড়া দিয়ে নির্মিত। মুখমন্ডল যেন ব্রোঞ্জ দিয়ে গড়া— ব্রোঞ্জের মূর্তিতে যেমনটা দেখা যায়— বিশ্বের যাবতীয় শক্তি জড়ো করে পিটিয়ে নির্মিত হয়েছে সেই মুখমন্ডল— সেই সঙ্গে শক্তিধর মূর্তি কারিগর এমন শক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়েছে মুখাবয়বের পরতে পরতে, যা ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। ইন্দ্রিয়পরায়ণতার চিহ্নমাত্র নেই মুখাবয়বে, কেননা ইন্দ্রিয়পরায়ণতা তো দুর্বলতার নামান্তর, শক্তিমান মুখাবয়বের কোথাও নেই তিলমাত্র দুর্বলতার চিহ্ন। তার বদলে, গোটা মুখখানা যেন পাথর কুঁদে তৈরি হয়েছে, খড়গনাসায় অপরিসীম ঔদ্ধত্য প্রকট হয়ে চলেছে— সেই সঙ্গে সীমাহীন বর্বরতা, ঝোপের মতন কৃষ্ণকালো ভুরু যুগলে অপরিমেয় স্পর্ধা ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে, ধূমায়মান কুচকুচে চক্ষুযুগলে স্ফুলিঙ্গের জাগরণ ঘটছে— গনগন করছে যেন ভেতরকার অগ্নিস্রোতের দরুন! অপরূপ দর্শনধারী নিঃসন্দেহে, কিন্তু অপরিসীম নিষ্ঠুরতায় সদা আচ্ছন্ন, ওষ্ঠ ভঙ্গিমায় বিদ্রুপ, হাসির মধ্যে ব্যঙ্গ।

কথা বলল পরিস্কার ইংরেজীতে এমন এক কণ্ঠস্বরে যেন আমরা সকলেই দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীপৃষ্ঠে, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, অতীতে অত্যাশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে এসেছেন এখানে, ভবিষ্যতে আরও আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আপনাদের— যদিও আমি তার সমাপ্তি ঘটাব সানন্দে। কথাবার্তা এক তরফা চলছে বলেই মনে হতে পারে, আমি কিন্তু আপনাদের চিন্তা পাঠ করে নিতে পারছি। আপনাদের আদ্যোপান্ত আমার জানা হয়ে গেছে। ভয় পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তবে কি জানেন, আপনাদের শিক্ষার এখনও অনেক বাকি।’

অসহায় বিস্ময়ে আমরা তিনজনে দেখে নিলাম পরস্পরের মুখের চেহারা। চিন্তা পঠনে কুশল নই বলেই বুঝতে পারলাম না কে কী ভাবছে। আবার কানে ভেসে এল বিদ্রুপঠাসা কর্কশ সেই অট্টহাস্য।

‘আর হ্যাঁ, ব্যাপার একটু কঠিন বটে। তবে ফিরে গিয়ে কথা বলতে পারেন প্রাণ খুলে, কেননা আমি যে চাই আপনারা প্রাণ নিয়ে ফিরে গিয়ে আমার দেওয়া বার্তা পৌঁছে দিন। বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই আপানাদের টিকিয়ে রেখেছি, নইলে আমার এ বাড়িতে ঢোকামাত্র পরলোকে পাঠিয়ে দিতাম। আগে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। ডক্টর ম্যারাকট, আপনাদের তিনজনের এই দলে আপনিই সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর জ্ঞানী পুরুষ— বয়সেও প্রবীণ। বাকি দু-জনেরও দুঃসাহসের প্রশংসা করছি— তবে, এ জায়গায় পা না দিলেই ভালো করতেন। শুনতে পাচ্ছেন তো? ভালো। মাথা কাত করে সায় দিলে আরও ভালো হবে।

‘ডক্টর ম্যারাকট, আপনি অন্তত জানেন, আমি কে। আবিষ্কারটা করেছেন সম্প্রতি। আমার অজানা কিছুই নেই। আপনারা যা করবেন, যা ভাববেন— সবই আমি জেনে যাই। আমি সর্বজ্ঞ । আমি না চাইলে, আমি না ডেকে পাঠালে এই পুরীতে প্রবেশের ক্ষমতা নেই কারও। আমার গহনতম যজ্ঞবেদী যে এখানেই। এই কারণেই কেউ এখানে আসতে চায় না। বেচারার দল! তাদের কথায় কান দিলে ভালো করতেন। আপনারাই আমাকে নিয়ে এসেছেন আপনাদের সামনে। একবার যখন আমি আসি, সহজে যাই না।

‘অকিঞ্চিৎকর পার্থিব জ্ঞান নিয়ে ভাবছেন আমি কে, আমি কী! অক্সিজেন ছাড়া টিকে রয়েছি কীভাবে? কারণ, আমি এখানে থাকি না। থাকি সূর্যের তলায় বৃহত্তর দুনিয়ায়। এখানে আসি যদি আমাকে ডাকা হয়, যেমন ডেকেছেন আপনারা। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস চলে ইথার-এর মাধ্যমে। পৃথিবীর ওপরে পাহাড় চুড়োয় যত ইথার থাকে, এখানেও আছে ততটা। আপনাদের মধ্যেও অনেকে বাতাস ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। মূর্ছারোগগ্রস্তরা মাসের পর মাস শ্বাসপ্রশ্বাস না নিয়ে টিকে থাকে। আমিও তা-ই। তবে সজাগ সক্রিয় যেমনটা দেখছেন।

‘ভাবছেন আমার কথা আপনারা শুনছেন কীভাবে। ইথার থেকে বাতাসে বেতার বার্তা যায় কী করে? আমিও সেইভাবে আমার কথা ইথারের মাধ্যমে আপনাদের ওই বিদঘুটে বাতাস গোলকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছি।

‘আমার ইংরেজী? মন্দ নয় নিশ্চয়। বেশ কিছুকাল ছিলাম মর্তে— সে অনেক… অনেক দিন। কত দিন? এটা এগারো হাজার, না, বারো হাজার বছর? বোধহয় শেষেরটা। অনেক সময়। শিখে নিয়েছি সব মানুষের মুখের ভাষা। আমার ইংরেজি আপনাদের ইংরেজির চেয়ে খারাপ নয়।

‘এবার কিছু সিরিয়াস কথা বলা যাক।

‘আমি-ই বাল-সিপা। আমি-ই কৃষ্ণ-আনন অধিপতি। প্রকৃতির গূঢ় রহস্য আমার অধিগত। তাই মৃত্যুকে টেক্কা মেরে যাই। ইচ্ছামরণের শক্তি আমার মুঠোয়। যদি কখনও মরি, তাহলে আমার চাইতে শক্তিমান কিছুর অস্তিত্ব থাকার দরকার। মরলোকের হে মনুষ্যবৃন্দ, অমর হতে চেও না। ভয়ানক অতি ভয়ংকর এই অনন্ত আয়ু। অন্তহীন মনুষ্য সমাজ আসছে আর যাচ্ছে— অমর যে, তাকে থেকে যেতে হচ্ছে। ইতিহাস বয়ে চলেছে, আমি পাশে বসে দেখছি। ইতিহাসে কুঠারাঘাত করার শক্তি আমি রাখি। করিও। করব না কেন?

‘জখম করি কীভাবে? সে শক্তি আমার আছে। সে বড় ভয়ানক শক্তি। মানুষের মন টলিয়ে দিতে পারি আমি। জনতার প্রভু আমি। আমিই জনগণেশ। অশুভ শক্তির পরিকল্পনা যেখানে, সেখানে থাকি আমি। হুন বাহিনী যখন আধখানা ইউরোপ তছনছ করেছিল, আমি ছিলাম হুনদের সঙ্গে। সারাসেন-রা যখন ধর্মের নামে তরবারি ধারণ করেছিল, আমার মদতেই তারা তা করতে পেরেছিল, এখনও পৃথিবীর নানান জায়গায় ধর্মের নামে যে তান্ডব বর্বরতা, তার পেছনে আছি আমি। বারথোলোমিউ রজনীতে অভিযান চালিয়েছিলাম আমিই। ক্রীতদাস প্রথার পেছনে ছিলাম আমিই। আমারই মন্ত্রণায় ডাইনি অপবাদ দিয়ে দশ হাজার বুড়িদের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। প্যারিসের রাস্তায় যখন রক্তনদী বইছে, তখন আমিই সেই দীর্ঘকায় কৃষ্ণ পুরুষ— জনতা পরিচালনা করেছিলাম। রাশিয়াতেও রয়েছি আমি। যেখানে বিক্ষোভ, ইন্ধন জোগাত সেখানে আমি। আমার এই পুরোনো ডেরা এককাট্টা হয়েছিল এতদিন, আপনারাই আমাকে আহ্বান করে নিয়ে এসেছেন এখানে। এলাম ব্যক্তিগত পরিম্পন্দকম্পন-এর দৌলতে অকাল্ট সায়েন্সের এই ভাইব্রেশনের হদিশ আপনাদের আধুনিক বিজ্ঞান আজও পায়নি। আমি জানি সেই মানুষটিকে যিনি গড়েছিলেন সাগরতলের এই শহর। আগন্তুকরা যে এসেছে সেই শহরে, আমি তা জানতে পেরেছি। খোঁজ নিয়েছি, তারপর এসেছি। হাজার বছর পরে এসে এখানকার লোকগুলোর কথা ভাবছি। অনেকদিন টিকে রয়েছে, এবার বিদেয় হোক। এরা টিকে আছে যাঁর দৌলতে, তিনি টেক্কা মেরেছিলেন আমাকে, মহাপ্রলয়কে টেক্কা দিয়ে নগরী নির্মাণ করেছিলেন সাগরতলে। সেই মহাপ্রলয় গ্রাস করেছিল সব কিছু, আমাকেও। তাঁর জ্ঞান ভক্তদের বাঁচিয়েছে, আমার জ্ঞান আমাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এবার আমার শক্তি ধ্বংস করবে তাদের— রক্ষাকবচ দিয়ে এতদিন যাদের টিকিয়ে রাখা হয়েছে— তবেই শেষ হবে আমার কাজ।’

এই পর্যন্ত বলে বুকের মধ্যে হাত গলিয়ে টেনে বের করল একটা চিরকুট। বললে, ‘জল-ইঁদুরদের মোড়লটার হাতে দেবেন এই চিরকুট। যে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসছে তাদের ললাটে, আপনারাও যে সেই ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন, তার জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু যেহেতু আপনারাই তাদের আসন্ন দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী, তাই বিচারের দন্ড আপনাদের ওপরেও পড়বে। আপনাদের সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে— পরে। ইতিমধ্যে এই সব চিত্রমালা আর খোদাই কর্ম দু-চোখ ভরে দেখে যান— তাহলেই বুঝতে পারবেন আমার শাসনকালে আটলান্টিসকে কত উঁচু পর্যায়ে আমি নিয়ে গেছিলাম। আমার প্রভাব-আচ্ছন্ন তখনকার মানুষগুলোর আদবকায়দা প্রথা সম্বন্ধেও আপনাদের খানিকটা ধারণা অন্তত হবে। জীবন ছিল কত বৈচিত্র্যময়, কত বর্ণময়, কত দিকে প্রসারিত। এখনকার এই বৈচিত্র্যহীন জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার সেই বর্ণময় জীবনধারাকে বলা হয় নিশীথকালের তান্ডব, লম্পট্য। যা খুশি বলুন, রচনা করেছিলাম আমি, উপভোগ করেছি আমি, তাই আমার নেই কোনও পরিতাপ! আবার যদি সুযোগ আসে, ফের যদি সুদিন ফিরে আসে, নতুন করে গড়ব আরও বেশি করে উল্লোল— হল্লাকে টেনে আনব— খেদ থেকে যাবে শুধু আমার এই অনন্ত অমরত্বে। এ ব্যাপারে ওয়ার্দা ছিলেন আমার চেয়ে অধিকতর জ্ঞানবান— আমার অভিশাপ স্পর্শ করুক তাঁর আত্মাকে— আমার উচিত ছিল জনগণকে খেপিয়ে দিয়ে আমার পেছনে লেলিয়ে দেওয়ার আগেই তাঁকে খতম করে দেওয়া। পৃথিবী দর্শনে তিনি আজও আসেন, মানুষ রূপে নয়, বিদেহী গুরুরূপে। এবার আমি যাই। বন্ধুগণ, কৌতূহল চরিতার্থ করতে এসেছিলেন এখানে। আশাকরি, সেই কৌতূহল মিটেছে।

তারপরেই তাকে দেখলাম অদৃশ্য হয়ে যেতে। হ্যাঁ, আমাদের চোখের সামনেই গলে গলে মিশে গেল জলের মধ্যে। চকিতে নয় যে থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ, সরে দাঁড়িয়েছিল সেই থাম থেকে একটু তফাতে। চমকদার চেহারার কিনারা অস্পষ্ট হয়ে এল একটু একটু করে। নিভে গেল চোখের দীপ্তি, আবছা হয়ে গেল দেহরেখা। পরক্ষণেই রূপান্তরিত হয়ে গেল কৃষ্ণকালো ঘূর্ণমান মেঘরূপে। ধেয়ে গেল ওপর দিকে ভয়ানক হলঘরের আবদ্ধ জল ঠেলে। তারপর আর সে রইল না। আমরা তিনজনে শ্বাসরোধী সেই মস্ত কক্ষে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বিনিময় করে নিলাম নিজেদের মধ্যে। ভাবলাম জীবন কী বিচিত্র। কত সম্ভাবনাময়।

ভয়ানক সেই প্রাসাদে আর আমরা থাকিনি। নিরাপদে টহল দেওয়ার মতো জায়গা তো নয়। স্ক্যানলানের কাঁধ থেকে চিমটি কেটে তুলে এনেছিলাম অতি নচ্ছার খোলকহীন একটা শামুক। মস্ত একটা হলুদ রঙের স্তরীভূত কোলেনকাইমা বিচ্ছিরিভাবে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল আমার হাতে। টলতে টলতে হোঁচট খেতে খেতে যখন বেরিয়ে আসছি, শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম রক্ত জল করা খোদাই কাজগুলোর ওপর, তারপর প্রায় দৌড় দিয়েছিলাম আঁধার ঘেরা গলিপথ বেয়ে, এমন জায়গায় পদক্ষেপ করার জন্যে নিজেরাই নিজেদের মুণ্ডপাত করেছিলাম। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম গভীর সমুদ্রের স্বতঃদীপ্ত উপপাতালিক অঞ্চলে পুনরায় পদক্ষেপ করে। বাড়ি ফিরে এসেছিলাম এক ঘণ্টার মধ্যেই। হেলমেট খুলে ফেলে ঘরে গেছিলাম শলাপরামর্শ করার জন্যে। প্রফেসর আর আমি এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম যে মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারছিলাম না। কিন্তু বিল স্ক্যানলানকে এত সহজে দমিয়ে দেওয়া যায় না।

গর্জে উঠেছিল চাপা গলায়, ‘বটে! পেছনে লাগবে হুমকি দিচ্ছে! আমরাও দেখে নেব। খোদ শয়তান! নরক থেকে এসেছিল। তাই অমন পাথরের মূর্তিটুর্তি বানিয়েছে। হারামজাদাকে বাগে আনা যায় কী করে, সমস্যাটা সেইখানেই।’

চিন্তান্বিত অবস্থায় চুপচাপ ছিলেন ডক্টর ম্যারাকট। কিছুক্ষণ পরে ঘণ্টা বাজিয়ে হলুদ বসন পরিচারককে ডেকে ম্যান্ডা-কে ডেকে পাঠালেন। সে এলে তার হাতে তুলে দিলেন নারকীয় চিঠি।

সেই মুহূর্তে ম্যান্ডা-র প্রশংসা না করে পারিনি। তার সাধের এই শহরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছি আমরা আমাদের কৌতূহল চরিতার্থ করতে গিয়ে— সেই আমরা যাদের সে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনে ঠাঁই দিয়েছে সুরম্য এই প্রাসাদে। তা সত্ত্বেও আমাদের একটুও তিরস্কার করেনি। চিঠি পড়ে কিন্তু মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে করে ফেলে বিষণ্ণ চোখে শুধু আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর অস্ফুট স্বরে ‘বাল-সিপা! বাল-সিপা!’ বলতে বলতে চোখের সামনে ক্ষিপ্তের মতো হস্তচালনা করেছিল— যেন মনোদৃশ্যের ভয়াবহতায় মুমূর্ষ প্রায় অবস্থায় পৌঁছেছে। ছুটে বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে সঙ্গী সাথীদের চিঠির বয়ান পড়ে শোনাবে বলে। একটু পরেই শুনেছিলাম ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ— কেন্দ্রীয় হলঘরে শুরু হবে সম্মেলন।

আমি বলেছিলাম, ‘যাব কি?’

মস্তিষ্কচালনা করেছিলেন ডক্টর ম্যারাকট।

‘গিয়ে কী করব? ওরাই বা কী করতে পারে? খোদ শয়তানের শক্তি যার হাতের মুঠোয়, তার কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা ওদের নেই।’

ফুঁসে উঠেছিল স্ক্যানলান, ‘কিন্তু কিছু একটা করতে তো হবে! শয়তানকে খেপিয়ে দিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাব নাকি?’

‘মতলবটা কী?’ আমি প্রশ্ন করেছিলাম বিল স্ক্যানলান সত্যিকারের ডানপিটে বলে। ফিকির-ফন্দিতে গুরুদেব।

‘যতটা বড়াই করেছে, অতটা বিশ্বাস না করলেও চলবে। দুর্বল হয়ে পড়েছে বারো হাজার বছরের ধাক্কায়। শক্তিক্ষয় নিশ্চয় ঘটেছে। তাই মুখে অত তড়পানি! বাক্যবাগীশদের দৌড় আমার জানা আছে।’

‘তাহলে প্রথম আক্রমনটা আমরাই করব?’

‘নিছক পাগলামি!’ বাধা দিলেন ডক্টর।

স্ক্যানলান উঠে গেল ওর দেরাজের কাছে। ঘুরে দাঁড়াল হাতে একটা ছ-ঘরা রিভলভার নিয়ে।

বললে, ‘স্ট্র্যাটফোর্ড জাহাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। কাজ সারব এই দিয়ে। কার্তুজ আছে এক ডজন। বারোটা ছেঁদা করে ম্যাজিকগিরি খতম করে দেব! একী! একী! ও লর্ড!’

রিভলভার ছিটকে গেল মেঝেতে। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি খামচে ধরে স্ক্যানলান কাতরাচ্ছে বিষম যন্ত্রণায়। গোটা হাতটার শিরা টেনে ধরেছে, পেশী শক্ত হয়ে গেছে— গাছের শেকড়ের মতো। ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে আতীব্র যন্ত্রণায়। শেষকালে ছিটকে গেল নিজের বিছানায়।

বললে, ‘আমি বাদ। ছ-ঘর রিভলভার দিয়ে শয়তানকে ঠেকানো যায় না। স্যালুট জানাই তাকে।’

ম্যারাকট বললেন, ‘উচিত শিক্ষা হয়েছে।’

‘কেস তাহলে হোপলেস? কোনও আশা নেই?’

‘তা-ই তো মনে হচ্ছে। প্রতিটা কাজ আর কথার ওপর যে নজরদারি রাখছে, তার সঙ্গে কি টক্কর দেওয়া যায়? তা সত্ত্বেও, হাল ছাড়বার পাত্র আমি নই। গায়ের জোর বৃথা। আত্মিক স্তরে যে লড়ছে, তার সঙ্গে এভাবে লড়া যায় না। পড়বার ঘরে যাচ্ছি। দেখি কী করা যায়।’

ম্যারাকটের ওপর বিশ্বাস আমাদের অগাধ। মগজ দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে তাঁর জুড়ি নেই। যে অবস্থায় পৌঁছেছি, যদিও তা মানবিক সামর্থ্যের বাইরে। এক মহাশক্তির খপ্পরে আমরা যেন শিশুর মতন অসহায়। স্ক্যানলান তো ঘুমিয়েই পড়ল। পাশে বসে আমি ভাবতে লাগলাম বাঁচা যায় কী করে। বিপদটা আসবে কোন দিক থেকে এবং কীভাবে? নিশ্চয় মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়বে, গোটা বাড়ি তলিয়ে যাবে, সাগরের জল ছাড়া এ তল্লাটে আর কিছুই থাকবে না।

বিশাল ঘণ্টা ফের বেছে উঠল আচমকা। প্রাচীন প্রাসাদে এরকমভাবে তো ঘণ্টা আগে বাজেনি! এ যে পাগলা ঘন্টির নিনাদ। হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার! যে যেখানে আছ, ছুটে এসো এখুনি।

আমি আর স্ক্যানলান দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছি, ডক্টর ম্যারাকট ঢুকলেন ভেতরে। কিন্তু এ কোন ম্যারাকট? এঁর মুখের পরতে পরতে যে রকম আত্মপ্রত্যয় দেখলাম এ রকম তো কখনও দেখিনি। কর্তৃত্ত্বব্যঞ্জক কুলিশ কঠোর মুখভাব। পুঁথিমনস্ক সেই প্রশান্ত মুখচ্ছবি কোথায়? এ যে এক সুপারম্যান! এক মহানেতা! যাঁর মনোবল টলিয়ে দিয়ে যাবে মানবসমাজকে!

বললেন, ‘চলুন! সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আর দেরি নয়?’

ঠিক এই সময়ে আতঙ্কিত মুখে জনা কয়েক অ্যাটলান্টিয়ান ঘরে ঢুকে হাতের ইশারায় জানাল জরুরি আহ্বান। আমাদের শক্তিমত্তা আর সাহসের পরিচয় এরা পেয়েছে এর আগে। তাই বিপদের সময়ে ডাকছে ব্যাকুলভাবে। হলঘরে যখন ঢুকলাম, তখন যেন স্বস্তির গুঞ্জন শুনলাম। ঘর ভরতি লোক। সামনের আসন রাখা হয়েছে আমাদের জন্যে।

এসেছি সঠিক সময়ে। কিন্তু জানা নেই আমাদের উপস্থিতি কোনও ফয়সালা জোগাতে পারবে কি না। মঞ্চে এসে গেছে ভয়াবহ সেই সত্তা, মুখভাবে অপরিসীম নিষ্ঠুরতা, পাতলা অধরোষ্ঠ শক্ত, যেখানে ভাসছে দানবিক হাসি— ঘর ভরতি লোক ভয়ে কাঠ। একে অপরকে ধরে রয়েছে। নিঃসীম আতঙ্কে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মঞ্চে দাঁড়ানো মূর্তিমান বিভীষিকার দিকে যার মুখাবয়বের গ্র্যানাইট কঠিন চাহনি নির্নিমেষে দেখে যাচ্ছে আতঙ্ক পাণ্ডুর জনগণকে। প্রত্যেকেরই ত্ৰাস কম্পিত চাহনি নিবদ্ধ মঞ্চে দন্ডায়মান পৈশাচিক মূর্তিটার দিকে। মৃত্যুর ঘণ্টা যেন বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন শুধু মরণের অপেক্ষা।

ম্যান্ডা একপাশে দাঁড়িয়ে করুণ কণ্ঠে সবার প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন জানাচ্ছে, কিন্তু তাতে যেন আরও ফুঁসে উঠছে মূর্তিমান বিভীষিকা। দাবড়ানি দিয়ে ম্যান্ডাকে থামিয়ে দিয়ে শূন্যে এক হাত তুলেছিল অবয়বী আতঙ্ক, সঙ্গে সঙ্গে করুণ আর্তনাদ ঠিকরে এসেছিল হল ঘরের প্রত্যেকের কণ্ঠ চিরে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে ডক্টর ম্যারাকট লাফিয়ে উঠে গেলেন মঞ্চে। তাঁর সেই সময়কার মূর্তি দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। অলৌকিক কোনও এক প্রভাবের দরুন তিনি এক্কেবারে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। আচরণ আর পদক্ষেপ যুবকোচিত। মুখাবয়বে বিধৃত এমনই এক শক্তি যার সমতুল্য শক্তি কোনও মনুষ্য মুখাবয়বে কখনও দেখিনি। তাল ঢ্যাঙা দানবের দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে তিনি যখন এগিয়ে গেলেন, তখন খোদ শয়তানের মতন সেই আকৃতি চোখ নামিয়ে শুধু তাঁর দিকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চেয়ে রইল।

বললে, ‘ওহে খুদে মানুষ, কিছু বলবার আছে নাকি?’

ম্যারাকট বললেন, ‘আছে বইকী। তোমার সময়সীমা ফুরিয়েছে। এখন বাড়তি সময় নিচ্ছ। পালাও! নরকের দ্বার খোলাই আছে, যাও সেখানে! অমানিশার রাজপুত্র, সময়ের অধিক আর থেকো না। যাও, যেখানে অমানিশা, যেখানে আঁধার, যেখানে তমিস্রা— সেখানে যাও!’

জলন্ত চোখে তাকিয়ে জবাবটা দিল শরীরী বিভীষিকা, ‘আমার সময় কখন ফুরোয়, তা মরজগতের মানুষের মুখে শোনার অপেক্ষা আমি রাখি না। আমার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি পেলে কোত্থেকে? নিমেষে চূর্ণ করে দিতে পারি তোমার মতো নশ্বর জীবকে— যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, ঠিক ওইখানেই।’

জ্বলন্ত চোখে চোখ রেখে দিলেন ম্যারাকট চোখের পাতা না কাঁপিয়ে। আমার তো মনে হল, চোখের পাতা কেঁপে গেল মূর্তিমান সেই শয়তানেরই।

ম্যারাকট বললেন চিবিয়ে চিবিয়ে, ‘ওরে অসুখী সত্তা, শক্তি আছে আমারও, এমনই সেই শক্তি যা দিয়ে তোকে উড়িয়ে দিতে পারি যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস ওইখানেই। ধরণীতে অনেক নৃশংস কদাচার ঘটিয়ে গেছিস তুই তোর অশুভ শক্তি দিয়ে। যা কিছু শুভ, যা কিছু মঙ্গলদায়ক— সব কিছু নস্যাৎ করে এসেছিস অনেকদিন ধরে। কিন্তু এবার তোর সময় ফুরিয়েছে। ধরণী উজ্জ্বলতর হবে তোর প্রস্থান ঘটলে। ওরে যা! ওরে যা! নরকের কীট, নরকে ফিরে যা!’

সবিস্ময়ে বললে মঞ্চে খাড়া দীর্ঘদেহী আতঙ্ক, ‘কে তুই? কী বলতে চাস?’

লক্ষ করলাম, তালঢ্যাঙা এখন তোতলাচ্ছে।

ম্যারাকট বললেন তেজবহ্নিদীপ্ত কণ্ঠস্বরে, ‘গুপ্ত জ্ঞানের বড়াই করিস তুই? কিন্তু অশুভ অবশেষে পরাস্ত হয় শুভ শক্তির কাছে। যুগে যুগে তা-ই হয়েছে। নারকীয় সত্তারা দেবদূতদের কাছে হার মেনেছে। এই মুহূর্তে আমি সেই স্তরে উন্নীত হয়েছি— যে স্তরে তুই ছিলিস এতদিন। জয়ের দণ্ড এখন আমার হাতে— এই শক্তি দেওয়া হয়েছে আমাকে, তোকে নরকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে— মেয়াদ ফুরিয়েছে বলে। তাই বলছি— ওরে যা! ওরে যা! নরকের কীট নরকে ফিরে যা! যা! যা! যা!’

অত্যাশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে গেল তৎক্ষণাৎ। মিনিটখানেক দু-জনে দু-জনের দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল। একজন কল্যাণী বিদ্যার গুরু, অন্যজন অশুভ শক্তির প্রতীক। তারপরে দীর্ঘদেহী যেন গুটিয়ে ছোট হয়ে যেতে লাগল একটু একটু করে। বিষম ক্রোধে শূন্যে দু-হাত নিক্ষেপ করে তখনও সে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘ওয়ার্দা, তোর জন্যে আজ আমার এই দশা! মূলে রইছিস তুই!’ শেষের দিকে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এল কণ্ঠস্বর, একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে গেল গোটা অবয়ব, মাথা ঝুঁকে পড়ল বুকের ওপর, হাঁটু দুমড়ে গেল পলকা কাঠির মতো, একটু একটু করে নেতিয়ে পড়ল মঞ্চের ওপর। প্রথম দিকে দেখা গেল গুটিশুটি মেরে থাকা একটা মনুষ্যাকৃতি অবয়ব, তারপর আকারবিহীন একটা পিন্ড, পরমুহূর্তেই তলতলে থকথকে খানিকটা কালচে কাদা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে লেপটে গেল মঞ্চে, দূষিত করে দিল বাতাসকে। একই মুহূর্তে আমি আর স্ক্যানলান ধেয়ে গেলাম মঞ্চের দিকে, কেননা শক্তি ফুরিয়ে যাওয়ায় গুঙিয়ে উঠে লুটিয়ে পড়ছেন ডক্টর ম্যারাকট। তখনও বলছেন বিড়বিড় করে, ‘জিতে গেলাম! জিতে গেলাম!’ সম্পূর্ণ জ্ঞান লোপ পেল তারপরেই। হতচেতন হয়ে পড়ে রইলেন মঞ্চের ওপর।

*

এইভাবেই অতি ভয়াবহ এক পরিণতি থেকে বেঁচে গেছিল আটলান্টিয়ান কলোনি। পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদেয় হয়েছিল এক অশুভ সত্তা। বেশ কিছুদিন ব্যাপারটা বিশদভাবে বলেননি ডক্টর ম্যারাকট। শোনবার পর থ হয়ে গেছিলাম। সেই দৃশ্য সেদিন চোখে না দেখলে মনে করতাম যা কিছু সেদিন বলেছিলেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে, সবই নিশ্চয় অসুস্থতার ঘোরে প্রলাপের বকুনি। শক্তির আধার হয়ে রূপান্তর ঘটেছিল তাঁর, ঘোর কেটে যাওয়ার পর আবার তিনি আগের মতোই সহৃদয় সদালাপী বিজ্ঞাননিষ্ঠ পুরুষ।

বলেছিলেন সোল্লাসে, ‘আমার ওপর যে কেউ ভর করতে পারে, আমাকে দিয়ে কাজ হাসিল করে নিতে পারে, এমনটা আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। এ যে একেবারেই অভাবনীয় ব্যাপার, বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। আমাদের দর্শনে অদৃশ্য সত্তার কোনও অস্তিত্ব নেই। আমরা বস্তুজগতের মানুষ। সারা জীবনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকথা ধুলিসাৎ হয়ে গেল এই একটি ব্যাপারে।’

স্ক্যানলান বলেছিল, ‘বাড়িতে যদি কোনওদিন ফিরতে পারি, ছেলেপুলেদের জমিয়ে দেব খাসা এই গল্প দিয়ে।’

আমি বলেছিলাম, ‘না বললেই ভালো করবেন। সবাই বলবে, আমেরিকার পয়লা নম্বর মিথ্যেবাদী। এমন কাহিনি আর কেউ বললে আমরাও কি বিশ্বাস করতাম?’

‘তা ঠিক। ডক্টর, কীসের দাওয়াই দিলেন শয়তানটাকে, সেটাই তো মাথায় আনতে পারছি না। তবে খাসা বলেছেন। হারামজাদা তল্লাট ছেড়ে উধাও হয়েছে।’

ডক্টর বললেন, ‘যা ঘটেছিল, হুবহু তা বলছি। পড়বার ঘরে গিয়ে ভাবছিলাম কী করা যায়। ব্ল্যাক ম্যাজিক আর গুপ্তবিজ্ঞান নিয়ে বেশ কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলাম এককালে। জানতাম, সাদা সবসময়ে কালোকে দমিয়ে রাখে— যদি থাকে একই স্তরে। কালো শয়তান ছিল অন্য এক স্তরে, মরেছে সেই কারণেই।

‘সোফায় আছড়ে পড়ে আমি শুধু প্রার্থনা করেছিলাম। প্রার্থনার শক্তি অপরিসীম। ফল ফলেছে তৎক্ষণাৎ। ভিক্ষা চেয়েছিলাম— আশীর্বাদ পেয়েছি।

‘আচম্বিতে মনে হয়েছিল, ঘরে আমি একা নই। ঘরে উপস্থিত হয়েছে একটা সত্তা— দয়াবান সত্তা— এক গাল দাড়ি— দয়া মায়া করুণার মূর্ত প্রতিমূর্তি। অপরিসীম শক্তির সঞ্চার ঘটিয়েছিল সে আমার ভেতরে— স্বয়ং সূর্যকেও টলিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি। স্নেহস্নিগ্ধ চোখে একদৃষ্টে চেয়েছিল আমার দিকে। আমার স্পষ্ট মনে হয়েছিল— এই সেই মহামানুষ, একদা যিনি আটলান্টিসকে বাঁচানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন— হতাশ হয়ে মুষ্টিমেয়দের নিয়ে জলতলে নিবাস রচনা করেছিলেন। বিদেহী সেই সত্তা আজও বিরাজমান জলতলে— উত্তর পুরুষদের কল্যাণ কামনায়। আবির্ভূত হয়েছে সঙিন মুহূর্তে। হাত রেখেছিলেন আমার মাথার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে যেন অগ্নিস্রোত বয়ে গেছিল আমার শিরা উপশিরায়। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল অসাধ্য কিছুই নয় আমার কাছে। মিরাকল ঘটনার মতন মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি এসে গেছে আমার ভেতরে। ঠিক তখন শুনেছিলাম বিপুল শব্দের ঘণ্টাধ্বনি। বুঝেছিলাম, এসে গেছে সঙিন মুহূর্ত। সোফা ছেড়ে যখন উঠে দাঁড়াচ্ছি, বিদেহী সেই গুরু স্মিত মুখে আমাকে উৎসাহ জুগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন তৎক্ষণাৎ। আমি এলাম মঞ্চে। তারপর কী ঘটেছিল, তা আপনারাই জানেন।’

আমি বলেছিলাম, ‘আপনার সুনাম বজায় রেখেছেন। এখন যদি দেবতার বেদীতে গিয়ে বসতে চান, কেউ আপত্তি করবে না।’

স্ক্যানলান বলেছিল একটু বিমর্ষ গলায়, ‘রিভলভারে হাত দিতেই আমাকে যে সিঁটিয়ে দেয়, সে আপনার সামনে গুটিয়ে গেল কীভাবে?’

ডক্টর বললেন, ‘আপনি বস্তু জগতের স্তরে কেরামতি দেখাতে যাচ্ছিলেন বলে। সে ছিল সূক্ষ্ম স্তরে— তার স্তরেই তাকে মোক্ষম চোট দেওয়ার শক্তি আমাকে জুগিয়ে গেছেন বিদেহী গুরু। শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাকেও। সেদিন থেকে আমার চিন্তা ভাবনা মোড় নিয়েছে সূক্ষ্ম জগতের দিকে— যা থেকে সব কিছুর উৎপত্তি, সেই দিকে সেই অবিনাশী সত্তার দিকে। আমার ভবিষ্যৎ কাজকর্ম হবে এখন সেই স্তরেই।’

আমাদের নাটকীয় অভিজ্ঞতার সমাপ্তি এইখানেই। এই ঘটনার দিন কয়েক পরেই ঊর্ধ্বজগতে ফিরে যাওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিলাম, তার ইতিবৃত্ত আগেই বর্ণিত হয়েছে। ডক্টর ম্যারাকট আবার অগাধ জলধির অতলে নামবার প্ল্যান আঁটছেন। মৎস্যবিজ্ঞান সম্পর্কে নতুন জ্ঞান আহরণের মতলবে। স্ক্যানলান কিন্তু বউ নিয়ে সুখেই আছে। ফিলাডেল ফিয়া-য় প্রোমোশন পেয়ে হয়েছে কারখানার ওয়ার্কস ম্যানেজার। আর আমি পেয়েছি সাগর ছেঁচা মুক্তো— আর কিছু চাই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *