অতল জলের শহর – ৬

(৬)

অনেকেই পত্র পাঠিয়েছিলেন আমাকে, ডক্টর ম্যারাকটকে, এমনকী বিল স্ক্যানলানকেও। আটলান্টিকের তলদেশে আমাদের অত্যাশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চার সাড়া জাগিয়েছিল দেশে দেশে। জায়গাটা উত্তর আটলান্টিকের ক্যানারিজ দ্বীপপুঞ্জ থেকে ২০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। সাবমেরিন পন্থায় জলতলে নেমে গিয়ে যা যা দেখে এসেছি, যে সব আমাদের জলতল সম্বন্ধে পূর্বধারণা পালটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ‘নিতল জলের’ জীবনধারা সম্বন্ধে যে ধারণা তা উল্টে দিয়ে গেছে আমাদের সেই অ্যাডভেঞ্চার। একই সঙ্গে প্রমাণ জুগিয়ে গেছে একটা অতি আশ্চর্য ব্যাপারের— অতীব অবিশ্বাস্য কষ্টকর পরিবেশের মধ্যে যেখানে টিকে রয়েছে এক সুপ্রাচীন সভ্যতা। অভিজ্ঞতার আরও বিশদ বিবরণ দেওয়ার জন্যে চিঠি এসেছে বিস্তর। প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা বিবরণী ছিল ভাসা ভাসা, যদিও ছুঁয়ে গেছিলাম মূল ঘটনাগুলোর সব ক-টাকে। কিছু ঘটনা বর্ণনায় সংযত ছিলাম, বিশেষ করে কিছুই বলিনি কৃষ্ণবদন মহাপ্রভুর ভয়ানক উপসংহার সংক্রান্ত ঘটনাবলী। এই সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন কিছু একেবারেই অসাধারণ প্রকৃতির সিদ্ধান্ত, যা চেপে যাওয়াই সঙ্গত মনে করেছিলাম তখনকার মতো। এখন যখন বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে আমাদের সিদ্ধান্ত— বলতে পারি, সমাজও মেনে নিয়েছে আমার বধূকে— তখন আমাদের মোটামুটি সত্যবাদিতা সম্বন্ধে আর কোনও সংশয় থাকতে পারে না; কাজেই এখন আরও কিছু বলা যেতে পারে, যা জানামাত্র জনগণের সহানুভূতি বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বিলক্ষণ। ভয়ানক বিস্ময়কর সেই ঘটনাবলী বলার আগে বলে নিতে চাই আটলান্টিয়ানদের জলতল সমাধিস্থ নিবাসে আমাদের মাসকয়েক থাকা প্রসঙ্গে আমার আরও কিছু ওয়ান্ডারফুল অভিজ্ঞতা বিবরণী— সেইসব আটলান্টিয়ান সম্বন্ধে যারা কাচের শোকেসবন্দি অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে অক্লেশে ঘুরে বেড়ায় সাগরতলে— ঠিক যে ভাবে দেখতে পাচ্ছি আমার এই হাইড পার্ক হোটেল থেকে লন্ডন বাসিন্দাদের ঘুরে বেড়ানো ফুলঝোপের আশপাশ দিয়ে।

জলপৃষ্ঠ থেকে জলতলে জঘন্য পতনের পর সাগরতলের এই মানুষরা প্রথম-প্রথম আমাদেরকে অতিথি হিসেবে না দেখে বন্দি হিসেবেই দেখে গেছিল। এহেন পরিস্থিতি পালটে গেল কীভাবে, এবার তা বলা যেতে পারে। ডক্টর ম্যারাকটের প্রতিভার চমক তাদের তাক লাগিয়ে দেওয়ার ফলেই যে এমনটা ঘটেছে, তা কি আর খুলে বলতে হবে? উনি একাই ওদের মনে এমন একটা ছাপ ফেলে এসেছেন যার দৌলতে আমরা যেন স্বর্গলোক থেকে নেমে আসা অতিথিবৃন্দের পর্যায়ে পৌঁছে গেছিলাম। তারপর ফিরে গেছি সেই স্বর্গলোকেই তাদেরই ঘরের এক কন্যাকে নিয়ে বধূ হিসেবে।

আশ্চর্য সেই দুনিয়ার আরও কিছু অদ্ভুত বৃত্তান্ত এবার লিপিবদ্ধ করা যাক। সেই সঙ্গে লিখে রাখি বেশ কিছু অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি— যা ঘটে গেছিল চূড়ান্ত অ্যাডভেঞ্চারটার আগে— যে অ্যাডভেঞ্চার দাগ রেখে যাবে আমাদের মনের মধ্যে আমৃত্যু— কৃষ্ণবদন মহাপ্রভুর আবির্ভাব নিয়ে সেই প্রসঙ্গ লিখতে গিয়েও যে আমার কলম কেঁপে ওঠে বারবার! এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ভাবনা এসে যায় মনের মধ্যে, আরও কিছুদিন থেকে গেলেই পারতাম সাগরতলে। সেখানকার বহুবিধ রহস্যের আকর্ষণে আজও যখন অনেক প্রহেলিকার মর্ম বুঝে উঠিনি, তখন আরও কিছুদিন থাকা উচিত ছিল আমাদের। ওদের ভাষাটাও শিখে নিচ্ছিলাম ঝটপট, সেক্ষেত্রে পেতাম আরও অনেক তথ্য।

অভিজ্ঞতা এই সব সাগরতলের মানুষদের শিক্ষা দিয়ে গেছে নানান দিক দিয়ে— শিখেছে অনেক ভয়ানক কাণ্ডকারখানার ইতিবৃত্ত; দেখেছে অনেক নিরীহ ব্যাপারস্যাপার। মনে পড়ছে একদিনের ঘটনা। আচমকা বিপদ সংকেতের ঘণ্টা বেজে উঠতেই আমরা সকলে অক্সিজেন মোড়কে নিজেদের মুড়ে নিয়ে ছুটে গেছিলাম সাগরের তলদেশের প্রান্তরে। কিন্তু কেন যে ছুটছি, কী যে ঘটেছে, তা থেকে গেছে রহস্যাবৃত। তবে নিঃসীম আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখেছিলাম প্রত্যেকেরই চোখে মুখে। প্রান্তরে পৌঁছে দেখেছিলাম বেশ কিছু গ্রিক কয়লাখনি শ্রমিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে কলোনির প্রবেশ পথ লক্ষ করে। দৌড়ে আসার ফলে নিদারুণ ক্লান্তিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল কর্দমপঙ্কের মধ্যে বারংবার— আমরা যে তাদের বাঁচানোর জন্যেই ছুটে যাচ্ছি, তাও বোঝা হয়ে গেছিল। সেই মুহূর্তে আগুয়ান আতঙ্কের মোকাবিলা করার জন্যে কারও কাছে কিন্তু কোনও হাতিয়ার দেখিনি, রুখে দাঁড়ানোর মতো মনোভাব দেখিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই কয়লা শ্রমিকদের যারা আর হাঁটতে যেন পারছিল না— টেনেটুনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল আশ্রয়স্থলে দরজার মধ্যে দিয়ে। তারপর তাকিয়ে দেখেছিল যেদিক থেকে তারা হোঁচট খেতে খেতে এসেছে, সেইদিকে। দেখতে পেয়েছিলাম শুধু সবজেটে কুয়াশার মতো মেঘপুঞ্জ, যার কেন্দ্র বিলক্ষণ আলোকময়, কিনারার দিকটা খোঁচা খোঁচা, আমাদের দিকে আসছে যেন ভেসে ভেসে— নক্ষত্ৰবেগে নয়। প্রায় আধমাইল দূর থেকেই তাদের আগমনের সুস্পষ্ট সংকেত পেয়ে কয়লাখনি শ্রমিকরা দরজার দিকে ছুটে আসছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে! রহস্যজনক সেই আবিল আতঙ্ককে আরও কাছে চলে আসতে দেখে নার্ভাস হয়ে গেছিল পাম্প চালকরা। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিরাপদে চলে এসেছিলাম সকলে। দেখেছিলাম স্বচ্ছ ক্রিস্টালের মতন মস্ত একটা চাঁই— লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় দু-ফুট দরজার খিলেনের ঠিক ওপরে যেখানকার আলোক ব্যবস্থা দিয়ে জোরালো আলো ফেলা যায় বাইরে। এমনতর দৃশ্য দেখবার জন্যেই সিঁড়ি লাগানো থাকে সেখানে। আমরাও উঠে গেছিলাম সিঁড়ি বেয়ে। সাদামাটা জানলার ভেতর দিয়ে তাকিয়েছিলাম বাইরে। দেখেছিলাম অদ্ভুত আলোকময় সবুজাভ কিছু একটা থমকে গেছে দরজার সামনে। দেখলাম, ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে আমাদের দু-পাশের আটলান্টিয়ানরা। তারপর একটা ছায়াচ্ছন্ন প্রাণী জল ঠেলে এগিয়ে এসে নড়ে নড়ে গেল জানলার সামনে। তৎক্ষণাৎ আমার দু-পাশের আটলান্টিয়ান সঙ্গীরা আমাকে টেনে নামিয়ে এনেছিল জানলার সামনে থেকে। কিন্তু পুরোপুরি নেমে আসার আগেই আমারই অসাবধানতার জন্যে মাথার চুলের খানিকটা থেকে গেছিল জানলার সামনে। জলচর মহা আতঙ্করা সেখানে তাদের ছাপ রেখে গেছে। খানিকটা চুল সাদা হয়ে রয়েছে আজও।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত দরজা খুলতে আর সাহস পায়নি আটলান্টিয়ানরা। তারপর অবশ্য একজন দুঃসাহসী দেখে এসেছিল বাইরের অবস্থা। ফিরে আসবার পর তাকে যেন মাথায় তুলে নাচা হয়েছিল, যেন বুকের পাটা আছে বিলক্ষণ। তার মুখেই জানা গেছিল, তল্লাট এখন বিপদমুক্ত। তারপরে সবাই যেন ভুলেই গেল মহা আতঙ্ককে। আমরা খবর নিয়ে জেনেছিলাম, বিপুল এই বিভীষিকার নাম ‘প্রাক্সা’। আতঙ্কে কাঠ হয়েছিল প্রত্যেকেই নামটা উচ্চারণ করবার সময়ে। একজনকেই শুধু উল্লসিত হতে দেখেছিলাম। তিনি ডক্টর ম্যারাকট। একটা ছোট জাল আর একটা কাচের ফুলদানি নিয়ে তক্ষুণি বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, আটকে রাখা হয়েছিল অতিকষ্টে। সোল্লাসে কিন্তু বলে গেছিলেন একটাই কথা, ‘প্রাণের নতুন এক বিকাশ, কিছুটা জৈব, কিছুটা গ্যাসীয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে ধীমান।’ স্ক্যানলানের অত বৈজ্ঞানিক হামবড়াই ভাব নেই। সোজা সাপটা বলে দিয়েছিল, ‘নরকের দূত।’

দু-দিন পরে চিংড়ি মাছ ধরার অভিযানে বেরিয়েছিলাম। গভীর জলের ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাত জাল দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরছিলাম নমুনা হিসেবে। আচমকা দেখেছিলাম একজন কয়লা-শ্রমিককে। অদ্ভুত জীবটার খপ্পরে পড়েছিল নিশ্চয়। কাচের গোলক চূর্ণ হয়েছে— অথচ এই কাচ-বস্তুটা নিরতিসীম শক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি যা বুঝেছেন নিশ্চয় আমার পাঠানো প্রথম লিপি উদ্ধারের সময়ে। বেচারার চোখ দুটো খুবলে বের করে নেওয়া হয়েছে, তাছাড়া শরীরের আর কোথাও কোনও ক্ষত নেই।

ফিরে এসে প্রফেসর বলেছিলেন, ‘পছন্দসই খাবার খেতে ভালোবাসে। নিউজিল্যান্ডে একরকম শ্যেন কাকাতুয়া আছে। ভেড়া মারে শুধু কিডনি-র ওপরদিকের মাংস খাওয়ার জন্যে। জঘন্য এই প্রাণীটা মানুষ মারে শুধু চোখ খাওয়ার জন্যে। খাইয়ে প্রাণী বলা যায়। স্বর্গে আর পাতালে প্রকৃতির বিধান একটাই— নিরতিসীম নিষ্ঠুরতা।’

ভয়ানক এই কানুনের আরও অনেক নিদর্শন পেয়েছিলাম জলের গভীরে। মনে পড়ছে একটা ব্যাপার। সাগরপঙ্কের বহু জায়গায় দেখেছিলাম অদ্ভুত খাঁজকাটা দাগ। যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটা পিপে। দাগটা দেখিয়েছিলাম আটলান্টিয়ান সঙ্গীদের। জেরা করে অদ্ভুত প্রাণীটা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলাম। নামটা বলতে গিয়ে জিভ দিয়ে অদ্ভুতভাবে ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ করে যা বলেছিল তা ইউরোপীয় জিভে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়— ইউরোপীয় হরফ দিয়েও তা লেখা যায় না। মোটামুটিভাবে বলা যায়, নাম তার ক্রিসচক। চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে আটলান্টিয়ান চিন্তা-প্রতিফলকের সাহায্য না নিলেই নয়। মন দিয়ে যা বোঝাতে চেয়েছে, চিন্তার চেহারায় তা ফুটে উঠেছিল। সে এক অদ্ভুত সাগরদানব। প্রফেসর তার শ্রেণীকরণ করেছেন এইভাবে: দানবিক খোলকহীন শামুকবিশেষ। সাইজে বিরাট, আকারে সসেজ অথবা শুঁয়োপোকার মতন, সারা গায়ে খোঁচা খোঁচা কাঁটা। পর্দার বুকে এহেন ছবি ফুটিয়ে তুলতে গিয়েও আটলন্টিয়ান সঙ্গীরা ভয়ের চোটে ঘেমে গিয়ে শিউরে উঠেছিল।

ঘামেননি শুধু প্রফেসর ম্যারাকট। বরং উল্লসিত হয়েছিলেন। অজানা এহেন সাগর দানবের শ্রেণী বিচারের জন্যে উদগ্রীব হয়েছিলেন। ফলে, একদিন দেখেছিলাম, কাদার ওপর দিয়ে টানা লম্বা ঘসটানির দাগ দেখে এগোচ্ছেন আগ্নেয় পাথর ঘেরা ঝোপঝাড়ের দিকে, যার মধ্যে নিশ্চয় নিবাস রচনা করে রয়েছে অজানা এই আতঙ্ক। প্রান্তর পেরিয়ে আসবার পরেই সেই দাগ আর না দেখলেও প্রকৃতির তৈরি একটা গলিপথ দেখে বুঝেছিলাম শরীরী আতঙ্ক মহোদয় নির্ঘাৎ নিবাস রচনা করে রয়েছে তার মধ্যে। তিনজনেরই হাতে ছিল সড়কি— যা থাকে সব আটলান্টিয়ানদের হাতে— কিন্তু ওই জিনিস তো খড়কে-কাঠি অজানা ওই আতঙ্কের কাছে। প্রফেসর কিন্তু নাছোড়বান্দা। এগিয়েই চললেন। অগত্যা আমাদেরকেও যেতে হল পেছন পেছন।

পাথুরে গিরিখাত উঠে গেছিল সটান ওপর দিকে, দু-পাশে রাশীকৃত আগ্নেয় আবর্জনা, ছেয়ে গেছে প্রচুর স্তরীভূত কোলেনকাইমা-য়, যা কিনা গভীর সাগরতলের এক বৈশিষ্ট্য। হাজার হাজার বিউটিফুল কলসি গড়নের পাতা, তারামাছ, সমুদ্রশশা, কতই না রং তাদের অঙ্গে অঙ্গে, আকৃতিও রকমারি, উঁকি দিয়ে রয়েছে আবর্জনার মধ্যে থেকে— যে সবের খাঁজে খাঁজে বাসা বেঁধেছে কঠিন খোলস দিয়ে ঢাকা চিংড়ি আর কাঁকড়ার মতো কত রকমের প্রাণী— মৃদুমন্দ গতিবেগে যারা চলমান যেন হামাগুড়ি দিয়ে। গতিবেগ তাই ছিল আমাদের মন্থর, কেননা সাগরতলের এমন জায়গায় হনহন করে হাঁটা যায় না, এ ছাড়া খাড়াই আগ্নেয় পাহাড় বেয়ে উঠতে হচ্ছিল একটু একটু করে। আচমকা দেখেছিলাম সেই জীবটাকে যাকে শিকার করবার জন্যে এসেছি এতটা পথ— দেখে তো গা হিম হয়ে গেছিল আমার।

শরীরী এই আতঙ্ক আগ্নেয় পাথরের শিলাস্তূপ বিবর থেকে অর্ধেক বের করে এনেছিল নিজেকে। লোমশ বপুর প্রায় পাঁচ ফুট বেরিয়ে ছিল বাইরের দিকে। দেখতে পাচ্ছিলাম থালার মতো চাকা চাকা চোখ, হলদেটে রঙের অতি কঠিন মূল্যবান অকীক পাথরের মতন, মন্থর গতিতে নড়ে নড়ে যাচ্ছিল লম্বা লম্বা দাঁড়া-র ওপর ভর দিয়ে আমাদের অগ্রগতির শব্দ শোনবার সঙ্গে সঙ্গে। তারপরেই খুব আস্তে আস্তে নিজেকে টেনে আনতে লাগল কোটরের ভেতর থেকে, শুঁয়োপোকার মতন শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে। কোটরের বাইরে পুরোপুরি বেরিয়ে আসবার পর দেখতে পেয়েছিলাম তার গোটা অবয়ব। সে এসেছিল ফুট চারেক বাইরে আমাদের ভালো করে দেখে নেওয়ার অভিপ্রায়ে, আর তখনই আমি দেখেছিলাম, টেনিস জুতোর ঢেউখেলানো খাঁজ কাটা শুকতলার মতো কী যেন আটকানো রয়েছে তার ঘাড়ের দু-পাশে— একই রঙের, গড়নের খাঁজকাটা। এ জিনিসের মানে কী, তা মাথায় আনতে পারিনি। তবে তার কার্যকারিতার ফলে শিক্ষালাভ করেছিলাম একটু পরেই।

প্রফেসর তাঁর সড়কি উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেছিলেন সামনের দিকে, চোখে মুখে দৃঢ় প্রত্যয়ের ভাব। দুর্লভ একটা নমুনা সংগ্রহের সুযোগ পাওয়ায় ভয়টয় একদম নেই মনের মধ্যে। স্ক্যানলান আর আমি অবশ্য অতটা বেপরোয়া হতে পারিনি, বুড়ো মানুষটাকে ফেলে চম্পট দিতেও পারিনি, তাই খাড়া ছিলাম তার দু-পাশে।

বেশ কিছুক্ষণ অপলকে আমাদেরকে ঠাহর করে নেওয়ার পর একটু একটু করে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের দিকে আগুয়ান হয়েছিল বিদ্‌ঘুটে সেই প্রাণী। নামছিল একটু একটু করে ঢাল বেয়ে, পাথরটাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে, মাঝে মধ্যে দাঁড়ার ডগার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছিল আমরা আছি কোনদিকে এবং কী করছি। আসছিল এতই মন্থর গতি ভঙ্গিমায় যে নিজেদেরকে নিরাপদই মনে করেছিলাম— বিপদ বুঝলেই চটপট পা চালিয়ে সরে পড়তে কতক্ষণ আর লাগবে। শুধু বুঝিনি, রয়েছি খোদ মৃত্যুর আওতার মধ্যে।

নিয়তি হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল আমাদের। বিটকেল চেহারার জানোয়ারটা যখন হেলেদুলে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে গেছে আমাদের কাছ থেকে প্রায় ষাট গজ দূরে, তখন একটা গভীর জলের খুবই বড় সাইজের মাছ শৈবালপুঞ্জ অরণ্য থেকে আস্তে আস্তে ভেসে এসেছিল তার সামনে। এসেছে যখন কেন্দ্রবিন্দুতে, আমরা যেখানে আছি আর বিটকেল চেহারার জানোয়ারটা যেখানে আছে— তার মাঝমাঝি জায়গায়, তখন সে আচমকা তেউড়ে গিয়ে উল্টে গেল, মুহূর্তমধ্যে মরে গিয়ে পড়ে রইল সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের তলায়। একই সময়ে আমাদের প্রত্যেকের আপাদমস্তক শিউরে উঠল অসাধারণ অত্যন্ত অস্বস্তিকর ঝনঝনে অনুভূতিতে, হাঁটু দুমড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। বুড়ো ম্যারাকট দুঃসাহসী হতে পারেন, কিন্তু বেকুব নন। চকিতে বুঝে নিলেন, খেল খতম হয়ে যেতে পারে এখুনি। যে প্রাণীটার সামনাসামনি রয়েছি, সে শিকার নিপাত করে বিদ্যুৎ তরঙ্গ নিক্ষেপ করে। আমাদের হাতের সড়কি মেশিনগানের সামনে অকিঞ্চিৎকর অস্ত্রের মতন। কপাল ভালো যে ভ্রাম্যমান মৎস্য মহাশয় বিদ্যুৎ বহ্নির শিকার হয়ে গিয়ে আমাদের টনক নড়িয়ে দিয়েছে নইলে ব্যাটারির পুরো চার্জ ঠিকরে পড়ত আমাদের ওপর— নিকেশ হতাম তৎক্ষণাৎ। পাগলের মতন হাঁচড় পাঁচড় করে পালিয়েছিলাম দানবিক বৈদ্যুতিক সমুদ্র-কীটের সামনে থেকে।

নিতল জলের আতঙ্ক সমূহদের একটার কথা বললাম এখানে। আর একটার কথা বলা যাক। প্রফেসর তার নাম দিয়েছিলেন হাইড্রোপস ফেরক্স। বিশাল হাঁ। সারি সারি আতঙ্ক জাগানো ক্ষুরধার দাঁত। সাধারণ পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে ভয় নেই। কিন্তু রক্ত ঝরে পড়লেই, তা সে যত কম পরিমাণেই হোক না কেন, ধেয়ে আসবে পলকের মধ্যে। তখন আর তার খপ্পর থেকে নেই পরিত্রাণ। ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে এসে শিকারকে কুচি কুচি করে ফেলে তৎক্ষণাৎ। কয়লাখনির গর্তে দেখেছিলাম এমনি একটা লোমহর্ষক দৃশ্য। একজন শ্রমিকের কপাল খারাপ। কাজ করতে গিয়ে হাত কেটে রক্ত ঝরিয়ে ফেলেছিল। মুহূর্তের মধ্যে, চতুর্দিক থেকে ধেয়ে এসেছিল রক্তলোলুপ মৎস্য বাহিনী। বৃথাই সে হাত পা ছুঁড়েছিল আছড়ে পড়ে গিয়ে, বৃথাই সড়কি আর কোদাল গাঁইতি চালিয়েছিল তার সঙ্গীরা। আমাদের চোখের সামনেই ঝাঁকে ঝাঁকে রক্তখেকো মৎস্য বাহিনী খুবলে খুবলে খেয়ে নিয়েছিল তার শরীরের নিচের দিকের অংশ, অক্সিজেন মোড়কের নিচের দিকে। আস্ত মানুষটাকে দেখলাম একবার, পরের মুহূর্তে দেখলাম দগদগে লালচে মাংস লেগে রয়েছে ধবধবে সাদা হাড়ে। এক মিনিট পরে দেখা গেল, কোমরের নিচের দিকে সাদা হাড় ছাড়া আর কিছুই নেই। খুবলে খুবলে চেঁছে পুঁচে সব মাংস খেয়ে নিয়ে মৎস্য বাহিনী রেখে গেছে একটা মানুষের আধখানা কঙ্কাল।দৃশ্যটা এমনই ভয়াবহ যে গা গুলিয়ে উঠেছিল আমাদের তিনজনেরই। অমন মজবুত বিল স্ক্যানলান, সে তো জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল। অনেক কষ্টে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল তাকে।

তবে এমন অনেক দৃশ্য দেখেছি যা ভয়ানক ভয়ংকর নয় সব সময়ে। একটা দৃশ্য গেঁথে গেছে আমার মনের মধ্যে, স্মৃতিপট থেকে মুছে যাবে না কক্ষনো। অভিযানে বেরোতাম কখনও আটলান্টিয়ান গাইড নিয়ে, কখনও নিজেরাই। আশ্রয়দাতারা তো জেনে গেছিল, সব সময়ে আমাদের চোখে চোখে রাখার দরকার নেই। প্রান্তরের এক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তিনজনে। চেনা জায়গা। তাই অবাক হয়েছিলাম সে জায়গায় বেশ খানিকটা হালকা হলুদ রঙের বালি দেখে। পড়ে রয়েছে প্রায় আধ একর জায়গা জুড়ে, অথচ ছিল না আগে। অবাক হয়ে যখন দাঁড়িয়ে পড়েছি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি নিশ্চয় অতল জলের কোনও চোরা স্রোত এই বালি এনে ফেলেছে এখানে, নয়তো এসেছে ভূকম্পীয় ঢেউয়ের ফলে, এমন সময়ে আমাদের পিলে চমকে দিয়ে গোটা জায়গাটা আস্তে আস্তে শূন্যে ভেসে উঠে নড়তে নড়তে চলে গেছিল আমাদের মাথার ওপর দিকে। জিনিসটা আকারে এতই বড় যে মাথার ওপর দিয়ে চলে যেতে সময় নিয়েছিল এক মিনিট থেকে দু-মিনিট। দানবিক চ্যাপটা মাছ। প্রফেসরের মতে সমুদ্রের ওপর দিকেও চ্যাপটা মাছ দেখা যায়; তবে সাগরের গভীরে এমন অতিকায় হতে পেরেছে পুষ্টিকর আহারের জোগান পেয়ে। আস্তে আস্তে হেলেদুলে রাজকীয় ভঙ্গিমায় ঊর্ধ্বপথে প্রস্থান করেছিল অতিকায় মৎস্য, আমাদের বিমূঢ় অবস্থায় রেখে দিয়ে। আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে মিলিয়ে গেছিল সাদা আর হলুদের ঝিকিমিকি রোশনাই।

গভীর জলের আর একটা কাণ্ড একেবারেই অপ্রত্যাশিত। টর্নেডো, যা নাকি হামেশা দেখা দেয়। মাঝে মাঝে এদের অভ্যুত্থান ঘটে প্রচন্ড সামুদ্রিক স্রোতের দাপটে, কোনও রকম পূর্বাভাস না দিয়ে, ওলটপালট করে দিয়ে যায় সব কিছু— যেমনটা ঘটে স্থলভূমিতে। অবশ্য প্রকৃতির এহেন ব্যবস্থার ফলে আবর্জনা জমতে পারে না কোথাও, কিন্তু সে জিনিস দেখলে যে হাত-পা ঠান্ডা মেরে যায়।

প্রথম যখন জল টর্নেডোর খপ্পরে পড়েছিলাম, তখন আমার সঙ্গে ছিল ম্যান্ডার মেয়ে মোনা। কলোনি থেকে মাইল খানেক দূরে গেছিলাম হাজারো রঙের শৈবাল পুঞ্জের আস্তানায়। জায়গাটা ছিল মোনা-র অতি প্রিয় উদ্যান। কত রঙের কত রকমের শৈবাল যে সেখানে আছে, তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। মোনা যেদিন আমাকে নিয়ে গেছিল আশ্চর্য সুন্দর এই বাগান দেখাতে, আচমকা হুমড়ি খেয়ে ঝড়টা এসে গেল ঠিক তখুনি। স্রোতের সে কী সাংঘাতিক টান। পাথরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছিলাম। দু-জনে দু-জনকে ধরে না থাকলে স্রোতের টানে ভেসে যেতাম। লক্ষ করেছিলাম, ধেয়ে আসা এই জলস্রোত বিলক্ষণ উষ্ণ, যদিও তা সহ্যের মধ্যে। এ থেকেই বুঝেছিলাম দূরে কোথাও আগ্নেয়গিরির উৎস থেকে ধেয়ে আসছে এমন গরম জল। কাদা ঘুলিয়ে গেছিল প্রবল স্রোত আছড়ে পড়ায়, নিভু নিভু হয়েছিল চারদিকের স্বতঃদীপ্ত প্রভা। পথ চেনা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারদিকের ঘোলাটে কাদায় দিগভ্রান্ত হয়েছিলাম। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো বুকে চাপ অনুভব করায় বুঝেছিলাম, ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেনের ভান্ডার।

মৃত্যু যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, আদিম তাড়না তখন মাথা চাড়া দেয়। ছোটখাটো আবেগ ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই মুহূর্তে মোনা-কে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমার সমস্ত অন্তর দিয়ে। ভালোবাসা এমনই জিনিস, বিশ্লেষণ করে বোঝানো যায় না। সেই মুহূর্তে তার প্রবালনীল চোখের ভেতর থেকে কিছু একটা ঠিকরে এসে আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। সে যে আমার কাছে কতখানি, তা হৃদয়ের পাতায় পাতায় লেখা হয়ে গেছিল নিমেষের মধ্যে। মৃত্যু হোক পাশাপাশি, সে মৃত্যু হবে পরম সুখাবহ।

কিন্তু তা তো হবার নয়। কাচের বুদবুদের ভেতর দিয়ে টের পাচ্ছিলাম একটা মৃদু কম্পন। যেন কোথাও একটা ঘণ্টাধ্বনির মৃদু প্রতি কম্পন ভেসে আসছে কাচের বুদবুদের মধ্যে দিয়ে। অর্থ বুঝিনি আমি, বুঝেছিল আমার সঙ্গিনী। আমার হাত খামচে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে শুনেছিল কান পেতে। তারপর ঝড় ঠেলে টানতে টানতে নিয়ে গেছিল আমাকে। মরণের সঙ্গে সে এক পাঞ্জা কষা দৌড়। প্রতি মুহূর্তেই টের পাচ্ছিলাম, বৃদ্ধি পাচ্ছে বুকের চাপ, দম আটকে আসতে চাইছে। দেখলাম উদ্বিগ্ন চোখে আমাকে দেখছে মোনা, আমিও প্রাণপণে যেতে চেষ্টা করছি তার হাতের আকর্ষণে। আগুয়ান মরণকে টেক্কা মারার সে এক কল্পানাতীত প্রতিযোগিতা। মোনার মুখ চোখ দেখে বুঝেছিলাম, তার অক্সিজেন ভান্ডারে তেমন ঘাটতি দেখা দেয়নি। যতক্ষণ পেরেছি তার হাতের টানে প্রাণপণে ছুটেছি, তারপর চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেছিল।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখেছিলাম, শুয়ে আছি আটলান্টিয়ান প্রাসাদের মধ্যে নিজস্ব সোফার ওপর। হলুদবরণ আলখাল্লা পরা বৃদ্ধ পুরুত মশায় দাঁড়িয়েছিল আমার পাশে, হাতে একটা শিশি, তা থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে— আমার ঘোর কাটানোর দাওয়াই নিশ্চয়। ম্যারাকট আর স্ক্যানলান চোখে মুখে নিঃসীম উৎকণ্ঠা নিয়ে ঝুঁকে রয়েছে আমার ওপর। মোনা নতজানু হয়ে বসে সোফার পাশে, মুখের পরতে পরতে আর প্রবালনীল দুই চোখে নিঃসীম উদ্বেগ। যে আমাকে হতচেতন অবস্থায় সমুদ্রতলে রেখে দিয়ে দৌড়ে এসে বাজিয়ে দিয়েছিল প্রবেশ পথের বিপদসূচক ঘণ্টা— যে ঘণ্টা রাখা হয়েছিল এই ধরনের জরুরি অবস্থার জন্যে। লোকজন নিয়ে দৌড়ে ছিল আমার কাছে, সঙ্গে ছিল আমার দুই কমরেড— তারাই আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে আনে প্রায় মৃত্যুশয্যা থেকে। প্রাণটা বাঁচিয়েছে কিন্তু মোনা। উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ছুটে না এলে সাগরতলে আমার মৃত্যু ছিল নির্ঘাৎ!

এখন দৈবজোরে সে এসেছে ঊর্ধ্বজগতে আমার সঙ্গে। না এলেও তার সঙ্গে আমি থেকে যেতাম সাগরের তলায়। কেন যে আমরা পরস্পরকে এত কাছে টেনে নিয়েছিলাম, মোনা-র বাবা ম্যান্ডা তার ব্যাখ্যা জুগিয়ে গেছিল একদিন।

আমাদের প্রেম পর্বে তার মধুর সম্মতি ছিল। আশকারা দেওয়ার হাসি ঠোঁটের কোণে ভাসত। যেন এমনটা ঘটবে, তা তার অজানা ছিল না। একদিন আমাকে নিয়ে গেছিল নিজের ঘরে। আমার সামনে রেখেছিল চিন্তা প্রক্ষেপণের পর্দা। জ্ঞান প্রতিফলনের স্ক্রিন। আমি আর মোনা পাশাপাশি বসে দেখেছিলাম, আটলান্টিয়ানদের ইতিহাস অতীত কাহিনি— আমার আর মোনা-র পূর্বজন্মের কাহিনি।

দেখেছিলাম, সুনীল সমুদ্রে ঠেলে ঢুকে রয়েছে একটা অন্তরীপ। আগে বলা হয়নি, ওদের এই চিন্তা প্রক্ষেপণের পর্দায় রঙিন ছবি দেখা যায়। নিছক সাদা কালো নয়। অন্তরীপের প্রান্তে রয়েছে অদ্ভুত নকশার একটা ইমারত, অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সেই ইমারতের ছাদ লাল রঙের, দেওয়াল সাদা। সব মিলিয়ে ভারি সুন্দর। বাড়ি ঘিরে রয়েছে তালজাতীয় শাখাহীন বৃক্ষ কুঞ্জ। এই কুঞ্জের মধ্যে একটা তাঁবু পড়েছে। সাদা তাঁবু। চকচকে। এদিকে-সেদিকে ঝিকমিক করছে সান্ত্রীদের হাতিয়ার। বৃক্ষকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে এল মধ্য বয়সী এক পুরুষ। গায়ে বর্ম। হাতে গোলাকার ঢাল। আর এক হাতে ধরা জিনিসটা তলোয়ার না বল্লম, তা ধরা যাচ্ছে না। একবারই সে মুখ ফিরিয়েছিল পর্দার দিকে। মুখাকৃতি দেখে বুঝেছিলাম, আটলান্টিয়ানদের জাতের মানুষ। যেন, ম্যান্ডা-র যমজ ভাই। তফাৎ এক জায়গায়। ম্যান্ডা-র মুখভাব এমন রুক্ষ কর্কশ চোয়াড়ে নয়। পাশব প্রকৃতির চেহারা। জ্ঞানের অভাবে আসেনি এহেন পাশব প্রকৃতি, এসেছে নিজের স্বভাব থেকে। পাশবিকতা আর মগজের ক্ষমতা যখন সহ অবস্থান করে, তখন বিপজ্জনক হয় না আর কিছুই। তার উঁচু কপাল আর দাড়িওলা মুখের বিদ্রুপের হাসি প্রকৃতই শয়তান প্রতিম। এই যদি হয় ম্যান্ডা-র পূর্ব জন্মের আকৃতি, তাহলে বলতে হবে তার আত্মা, তার মন অনেক নিখাদ হয়ে গেছে এই জন্মে। ম্যান্ডা-র ঘাড় নাড়া সম্মতি দেখে বুঝলাম, সঠিক চিন্তাই করেছি আমি।

সে যখন বাড়ির দিকে এগোচ্ছে, বাড়ি থেকে তখন বেরিয়ে এল এক নারী, তার মুখোমুখি হতে। মেয়েটার পরিচ্ছদ সেকেলে গ্রিক মেয়েদের সাজপোশাকের মতন। গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলানো সাদা বসন। অতি সরল, কিন্তু অতি সুন্দর। এর চাইতে সুন্দর পোশাক মেয়েরা আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। পুরুষ প্রবরের দিকে আগুয়ান থাকার সময়ে তার হাবভাবে দেখলাম নম্রতা, আনুগত্য আর শ্রদ্ধা— যেমনটা থাকে পিতার প্রতি কন্যার। বর্মধারী কিন্তু বর্বরের মতো হাত তুলে প্রহার করতে গেল এমন অনন্যাকে। মারের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে একটু সরে যেতেই রোদ ঠিকরে গেল মেয়েটির মুখ থেকে। চিনলাম পলকের মধ্যে। সুন্দরী অশ্রুময়ী সেই কন্যা আমার মোনা।

ঝাপসা ঘোলাটে হয়ে গেল রুপোলি পর্দা। পরমুহূর্তে ফুটে উঠল অন্য এক দৃশ্য। পাথরের একটা গুহা। মনে হল, একটু আগেই যে অন্তরীপ দেখেছি, এই পাথুরে গুহা সেখানেই কোথাও আছে। দেখা যাচ্ছে অদূরে একটা অদ্ভুত গড়নের জলযান— দু-দিকের প্রান্ত ছুঁচোলো। তখন রাত হয়েছে, চাঁদ কিন্তু কিরণ সম্পাত করে যাচ্ছে জলের ওপর। আকাশের নক্ষত্ররা পরিচিত— যাচ্ছিল আটলান্টিকের আকাশে, তা রয়েছে আজও। আস্তে আস্তে খুবই হুঁশিয়ারভাবে কাছে আসছে অদ্ভুতদর্শন তরণী। দাঁড় টানছে দু-জন। সামনের দিকে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণবর্ণ আলখাল্লাধারী এক পুরুষ। তীরের কাছাকাছি তরণী আসতেই সে সাগ্রহে তাকাচ্ছে এদিকে-সেদিকে। চাঁদের আলোয় তার মুখ দেখতে পাচ্ছি। মোনা আমার হাত খামচে ধরল সেই মুহূর্তে, অস্ফুট চিৎকার করে উঠল ম্যান্ডা। কেননা, তরণীতে দন্ডায়মান সেই ব্যক্তি স্বয়ং আমি।

হ্যাঁ, আমি, সাইরাস হেডলে, এখন নিবাস নিউইয়র্কে, শিক্ষা অক্সফোর্ডে। আধুনিক শিক্ষা আর সংস্কৃতির ধারক এই আমি এককালে ছিলাম সুদূর অতীতের মহাপরাক্রান্ত আটলান্টিকের বাসিন্দা। বুঝলাম, আশপাশের এত প্রতীক, এত চিহ্ন কেন অস্পষ্ট স্মৃতির দরজা খুলে দিয়েছিল মনের মধ্যে। কেন সবই যেন আগে দেখেছি বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু কারণটা বুঝিনি। মোনা-কে প্রথমবার দেখেই কেন অত রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম, এবার তা বুঝলাম। বারো হাজার বছর আগেকার স্মৃতি উঠে এসেছিল আমার আত্মার গহন মণিকোঠা থেকে।

তরী এসে ঠেকেছে তীরে। ওপর দিকের ঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে চোখ ধাঁধানো এক শ্বেতকায় মূর্তি। আমি দু-হাত সামনে বাড়িয়ে ধরেছি তাকে বাহুমধ্যে টেনে নেওয়ার জন্যে। দ্রুত আলিঙ্গন সমাপ্ত করেই তাকে নিয়ে এলাম তরীর ওপরে। আচমকা হুঁশিয়ার হতে হল সবাইকেই। ক্ষিপ্তের মতো দাঁড়িদের নির্দেশ দিচ্ছি জোরে দাঁড় টানতে। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে অনেক পুরুষ। তারা খামচে ধরেছে তরণীর এক পাশ। আমি তাদের বৃথাই মারছি। শূন্যে ঝলসে উঠল একটা কুঠার— ঘ্যাঁচ করে বসে গেল আমার মাথায়। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম রূপসী কন্যার গায়ের ওপর, আমার রক্তে লাল হয়ে গেল তার শ্বেত বসন। দেখলাম, সে আর্ত চিৎকার করছে আতঙ্ক বিস্ফারিত চোখে, আর তার বাবা তার কালো কেশ আকর্ষণ করে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমার বিগত প্রাণ দেহের নিম্নদেশ থেকে। পর্দার ছবির ইতি এইখানেই।

রুপোলি পর্দায় ফুটে উঠতে দেখলাম আর একটা ছবি। সে এক আশ্চর্য চিত্রমালা। দেখা যাচ্ছে এক মস্ত অট্টালিকার অভ্যন্তর— যে অট্টালিকা নির্মিত হয়েছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহাজ্ঞানী আটলান্টিয়ানদের প্রচেষ্টায় শেষের সেদিন আগমনের অনেক আগে। উদ্বাস্তুদের ঠাঁই দেওয়ার জন্যে। যে বাড়ির মধ্যে এই মুহূর্তে রয়েছি আমরা। প্রলয়ের মুহূর্তে দেখলাম লোক গিজগিজ করছে তার মধ্যে। তারপর মোনা-কে দেখলাম আবার, সঙ্গে তার জনক মহাশয়— শেষ মুহূর্তে যার টনক নড়েছে বুঝেছে, প্রাণে বাঁচতে হলে আশ্রয় নিতে হবে এই আশ্চর্য অট্টালিকার অভ্যন্তরে। দেখতে পেলাম, মস্ত হলঘরটা থরথর করে কাঁপছে ঝড়ের খপ্পরে পড়া জাহাজের মতো, ভয়ার্ত মানুষগুলো হয় থাম জাপটে ধরছে, নয়তো মাটিতে ঠিকরে যাচ্ছে। তারপরেই জলতলে হেলে পড়ে তলিয়ে গেল সেই প্রাসাদপুরী। পর্দার বুক থেকে ফের মিলিয়ে গেল ছবি। হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ম্যান্ডা বুঝিয়ে দিল, শেষ হয়ে গেল আটলান্টিক।

হ্যাঁ জীবিত দেহে আমরা সকলেই ছিলাম একটা সময়ে, আমাদের সব্বাই, ম্যান্ডা আর মোনা আর আমি, হয়তো ফের থাকব দূর ভবিষ্যতে, অভিনয় করে যাব জীবন শৃঙ্খলের ধারাবাহিকতা। আমার মৃত্যু হয়েছিল ঊর্ধ্বজগতে, তাই পুনর্জন্ম নিয়েছিলাম ওপরের পৃথিবীতেই। ম্যান্ডা আর মোনা দেহ রেখেছিল সাগরের তলায়, তাই পুনর্জন্ম নিয়েছে সাগরতলে আবার সেই পিতা-কন্যা রূপে। মহাজাগতিক বিধিলিপি চলেছে নিজস্ব কানুনের খাতে। প্রকৃতির মহারহস্য অবগুণ্ঠন তুলে দেখিয়ে দিল সামান্য, আশপাশের মধ্যে নিহিত রয়েছে একই মহাসত্য। ঈশ্বরের বিধান অনুসারে এক একটা জন্ম একই গল্পের এক একটা অধ্যায় ছাড়া কিছুই নয়। অনন্ত কালের পথে পথিক আমরা সক্কলে।

বলা যাক এর পরের ঘটনা:

প্রফেসর আর আমি একদিন বসেছিলাম প্রকাণ্ড একটা কমনরুমে। একটা কোণে প্রফেসর বানিয়ে নিয়েছেন তাঁর ল্যাবরেটরি, আগের দিনে পাওয়া একটা পেটুক মাছের শরীর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন। আমি আটলান্টিয়ান ব্যাকরণ শেখবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি পাশের টেবিলে। জলতলের এই বাসিন্দাদের গ্রন্থাগারে বইয়ের অভাব নেই। সে সব বইয়ের কাগজ পার্চমেন্ট কাগজের মতো দেখতে হলেও মাছের পটকা থেকে চেপে চেপে তৈরি। লেখাগুলোও বাঁ দিক থেকে শুরু করে ডানদিকে না গিয়ে, ডানদিক থেকে শুরু করে বাঁদিকে এসেছে উর্দুভাষার মতো। আটলান্টিস মহাদেশের যাবতীয় রহস্য উদ্ঘাটনের অভিপ্রায় নিয়ে পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছিলাম পুরোদমে। হরফ চিনে নিয়েছিলাম। ভাষাও রপ্ত করেছিলাম।

আচম্বিতে বিঘ্নিত হল আমাদের শান্তিময় বিদ্যাচর্চা। অসাধারণ এক শোভাযাত্রা ধেয়ে এল ঘরের মধ্যে। প্রথমে এল বিল স্ক্যানলান, লাল টকটকে মুখ নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায়। এক হাত নাড়ছে শূন্যে, আর এক হাতে বগলদাবা করে রয়েছে কান্নামুখর এক শিশুকে। ওর পেছনেই রয়েছে বারব্রিক্স, এই সেই আটলান্টিয়ান ইঞ্জিনিয়ার ওয়্যারলেস রিসিভার বানাতে যে সাহায্য করেছে স্ক্যানলানকে। এমনিতে সে বিরাটকায় আমুদে প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মুখ মেঘাচ্ছন্ন বিষম শোকে। ঠিক তার পেছনেই রয়েছে এক স্ত্রীলোক যার খড় রঙের চুল আর আকাশি রঙের চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে জাতে সে আটলান্টিয়ান নয়, নিচু জাতের মানুষ— গোলাম শ্রেণীর প্রাচীন গ্রিকদের বংশধর বলে যাদের নির্ণয় করতে পেরেছি।

তারস্বরে ভীষণ উত্তেজিতভাবে আমেরিকান বুলি মিলিয়ে মিশিয়ে স্ক্যানলান বললে, ‘দেখুন তো কী অন্যায়। বারব্রিক্স বিয়ে করেছে এই মেয়েটাকে। বাচ্চাও হয়েছে। কিন্তু বেজাত বাচ্চা বলে পুরুত ব্যাটাচ্ছেলে এসেছিল সেই তালঢ্যাঙা বিগ্রহটার সামনে বাচ্চা বলি দেবে বলে। নাকে একখানা ঘুসি ঝেড়ে বাচ্চা ছিনিয়ে এনেছি। শিশুবলি হতে দেব না— কিছুতেই না।

কথা এই পর্যন্ত এগোতেই দড়াম করে ফের খুলে গেছিল দরজা। এবার সদলবলে ঘরে ঢুকেছিল পুরুতমশায় বাচ্চাটাকে স্ক্যানলান-এর কোল থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্যে। থমকে দাঁড়িয়ে গেছে তার রুদ্রমূর্তি দেখে। এক্সপেরিমেন্টের টেবিলে শিশুকে শুইয়ে দিয়ে সে একটা ছুঁচোলো শিক হাতে রুখে দাঁড়িয়েছে, রক্তগঙ্গা বইয়ে ছাড়বে। তারাও কোমর থেকে ছুরি টেনে হাতে নিয়েছে। কিন্তু স্ক্যানলানের রুদ্র মূর্তি দেখে এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

একজন কিন্তু চুপিসাড়ে এগিয়ে এসেছিল পাশের দিক থেকে। ডক্টর ম্যারাকট যেন শব ব্যবচ্ছেদ করছেন, এমনি একটা মুখভাব নিয়ে টেবিল থেকে একটা মড়াকাটা ছুরি তুলে নিয়ে ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিলেন আগুয়ান হানাদারের ছুরিধরা হাতে। সে যখন যন্ত্রণায় চেঁচাচ্ছে আর নৃত্য করছে, সঙ্গীরা যখন একযোগে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ঘরে ঢুকেছিল ম্যান্ডা আর মোনা। ম্যান্ডা যখন চড়া গলায় কথা বলছে পুরুত মশায়ের সঙ্গে, মোনা তখন কোনও কথা না বলে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়েছিল নিজের দু-হাতে। ব্যাস, ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি ঘটে গেল ওইখানেই। খুনোখুনি আর ঘটল না।

ম্যান্ডা কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে কী ভেবে নিয়ে পুরুত মশায়কে দলবল সমেত মন্দিরে ফিরিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে যা বুঝিয়ে গেছিল, আমি তার সবটা বুঝিনি।

বলেছিলাম স্ক্যানলানকে, ‘বাচ্চাকে দিতে হবে।’

‘দেব না!’

‘আরে গেল যা! বাচ্চা দিন মোনা-র জিম্মায়। কাল বসবে পর্ষদের মিটিং।’

‘মিস মোনাকে দিতে পারি, কিন্তু ওই পুরুত রাসকেল—’ এখানকার প্রথা ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে। ওপরের জাত আর নিচের জাতের মধ্যে বিয়ে হলে অসবর্ণ বিয়ের সন্তানকে মন্দিরে বলি দিতেই হবে। এটা কানুন।’

তারপর যা ঘটেছিল, তা-ই নিয়েই শুরু হোক পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *