অতল জলের শহর – ৫

(৫)

সমাধিস্থ শহর দেখে আসবার পর আন্দাজি হিসেবে প্রায় একমাস বাদে আমাদের সাগরতলের জীবনধারায় সংযোজিত হল সবচেয়ে বিস্ময়কর আর অপ্রত্যাশিত ব্যাপারস্যাপার। আর কোনও কিছুই তেমন বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটাতে আর পারবে না— বিস্ময় নামক ব্যাপারটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে— এমন একটা ধারণা আমাদের মনের মধ্যে শেকড় গেড়ে বসে গেছিল। চমকে ওঠার মতো যেন কিছুই আর নেই। কিন্তু এরপরেই ঘটনাটার আভাসটুকুও যে কল্পনায় আনতে আমরা অসমর্থ ছিলাম, তা আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেল মনের মধ্যে বেশ খানিকটা ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে।

খবরটা নিয়ে এসেছিল স্ক্যানলান— বিরাট কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়। বুঝতেই পারছেন, এই সময়ে আমরা মোটামুটি খোলাখুলিভাবে সুবৃহৎ বিল্ডিং-এর সর্বত্র যাতায়াত করতে পারতাম। সাধারণের বিশ্রাম কক্ষ কোথায়, আমোদ প্রমোদের ঘরগুলো কোথায়— সে সব জানা হয়ে গেছিল। কনসার্ট বাজনা পর্যন্ত শুনেছি গানের আসরে গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে, বুঝেছি এদের সঙ্গীতবোধ বড় অদ্ভুত এবং এলাহি। দেখেছি থিয়েটার অঙ্গনের আমোদপ্রমোদ, যেখানকার দুর্বোধ্য শব্দগুলোর তর্জমা ঘটানো হয়েছে বিপুল অঙ্গভঙ্গী আর নাটকীয় ইশারা ইঙ্গিত মারফত। বলতে গেলে, গোটা সম্প্রদায়টার অঙ্গে অঙ্গে মিশে গেছিলাম আমরা ক-জনে। বহু ফ্যামিলির প্রাইভেট ঘরে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি, তাদের জীবনধারা দেখেছি— আমার নিজের তরফ থেকে বলা যায়— অদ্ভুত আশ্চর্য এই সব মানুষদের সংস্পর্শে এসে কিছুটা ঝাঁ-চকচকেও হয়ে উঠেছি— বিশেষ করে সেই মহিলাটির কাছে, যার নাম উল্লেখ করেছি আগেই। সাগরতলের অত্যাশ্চর্য এই প্রজাতির অন্যতম এক দলপতির কন্যা ছিল সে, নাম তার মোনা (মোনালিসা নয়)। এর বাড়িতে গেলেই আমি পেতাম বিশেষ রকমের বিপুল অভ্যর্থনা— যা এই প্রজাতির স্বভাব চরিত্রে নিহিত। তখন আর আমাকে কেউ অন্য প্রজাতির মানুষ বলে মনে করত না— যেন বাড়ির লোক। এমনকী ভাষার অন্তরায়ও আর কোনও ব্যবধান থাকত না। খুবই মৃদু অন্তরের ভাষার যখন প্রয়োজন হত, তখনও কিন্তু প্রাচীন আটলান্টিস আর বর্তমান আমেরিকার মধ্যে কোনও অন্তরায় থাকত না। জলতলের এই সুকন্যার মনোরঞ্জনের জন্যে যা-যা প্রয়োজন, ব্রাউন্স কলেজ-এর ম্যাসাচুসেট কন্যাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেইগুলোরই যে প্রয়োজন হয়, সে অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করেছিলাম।

এইবারে আসা যাক স্ক্যানলানের হন্তদন্ত হয়ে একদিন আমাদের ঘরে আসার ব্যাপারটায়— খবর এনেছিল মস্ত একটা ব্যাপারের।

বোমার মতো ফেটে পড়েছিল ঘরে ঢুকেই— দারুণ ব্যাপার! লোকটা জলের তলা থেকে ঘরে ঢুকেই হাউমাউ করতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। উত্তেজনার চোটে কাচের মুখোশ খুলতেও ভুলে গেছিল। তাই তো প্রথম দিকের কথাগুলো কিছু শুনতে পাওয়া যায়নি। তারপরেই হুড়মুড় করে ফের বেরিয়ে গেল দোস্তদের নিয়ে। ব্যাপারটা তো তাহলে আমাদেরও দেখা দরকার।

শুনেই, দৌড়ে বেরিয়ে গেছিলাম ঘর থেকে। দেখেছিলাম, গলিপথ বেয়ে বিষম উত্তেজিত অবস্থায় ছুটছে আমাদের বন্ধুবৰ্গ বিবিধ অঙ্গভঙ্গীসহ। আমরাও ভিড়ে গেলাম তাদের সঙ্গে। দল বেঁধে ছোটখাটো একটা শোভাযাত্রা করে হেঁটে চললাম সাগরের তলা দিয়ে। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে উত্তেজিত সেই বার্তাবাহক। যাচ্ছে যে গতিবেগে, সেই গতিবেগে ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে পেছিয়ে পড়লেও তাদের হাতের ইলেকট্রিক লণ্ঠন থাকায় পেছন পেছন লেগে থাকতে অসুবিধে হয়নি। পথ পরিক্রমা করে যাচ্ছি আগের মতোই খাড়াই আগ্নেয় পাহাড়ের কিনারা দিয়ে। অচিরে এসে গেলাম এমন একটা জায়গায় যেখান বহু পদক্ষেপে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে যাওয়া সিঁড়ির ধাপ উঠে গেছে ওপরদিকে চূড়োর দিকে। তরতর করে উঠে গেছিলাম সোপান শ্রেণী বেয়ে, এসে পড়েছিলাম এবড়োখেবড়ো এমন একটা অঞ্চলে যেখানে অগুন্তি খোঁচা খোঁচা চুড়ো মাথা উঁচিয়ে রয়েছে যত্রতত্র এমনভাবে যে পথ চলাই দুষ্কর। সুপ্রাচীন লাভার এই সব কেরামতির জটাজাল থেকে কোনওমতে বেরিয়ে এসে গেছিলাম একটা স্বতঃদীপ্ত গোলাকার প্রান্তরে, ঠিক মাঝখানে পড়ে থাকা বৃহদাকার বস্তুটা দেখে পিলে চমকে গেছিল আমার। দুই সঙ্গীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখেছিলাম দু-জনেই মুখের পরতে পরতে পরিস্ফুট একই কৌতুকাবহ বিস্ময়বোধ। আবেগ মথিত অন্তর প্রত্যেকেরই।

কর্দমপঙ্কে অর্ধেক গাঁথা অবস্থায় রয়েছে একটা বৃহদাকার স্টিমার। শুয়ে আছে পাশ ফিরে, চিমনি ভেঙে গিয়ে কাত হয়ে রয়েছে একদিকে, ভেঙে গেছে মূল মাস্তুল, এছাড়া প্রায় আস্ত বলা চলে জাহাজটাকে, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জেটি ছেড়ে যেন সবে বেরিয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপে কাছে গেছিলাম প্রত্যেকেই। গলুইয়ের কাছে গিয়ে দেখেছিলাম। মানসিক অবস্থা হয়েছিল ভাষায় অবর্ণনীয়। কেননা, নামটা এই— “স্ট্র্যাটফোর্ড লন্ডন”! ম্যারাকট ডিপ-এ আমাদের পেছন পেছন চলে এসেছে আমাদেরই জাহাজ।

বিষম বিস্ময়ে স্থানু হয়ে গেছিলাম কিছুক্ষণের জন্যে। ঘোর কেটে গেছিল একটু পরে। মনে পড়ে গেছিল ব্যারোমিটারের সংকেত, পালগুলোর নেতিয়ে পড়া, দিগন্তের অদ্ভুত কৃষ্ণকায় মেঘ পুঙ্গবদের দঙ্গল। আচমকা অতি প্রলয়ঙ্কর এক সাইক্লোন নিশ্চয় ধেয়ে এসেছিল সর্বশক্তি নিয়ে— খপ্পর থেকে নিষ্কৃতি পায়নি “স্ট্র্যাটফোর্ড”! যাত্রীরা অবশ্যই নিহত হয়েছে প্রত্যেকেই, কেননা সব ক-টা লাইফবোট রয়েছে যে যার জায়গায়, তাছাড়া সাইক্লোন যখন মহাপ্রলয় রচনা করে ধেয়ে আসে, তখন লাইফবোটও আস্ত থাকে না। মনে তো হল, আমাদের নিজেদের ভাগ্য বিপর্যয়ের দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই “স্ট্র্যাটফোর্ড”-এর সলিল সমাধি ঘটেছে। জলতল মাপবার জন্যে সিসের যে ওজনটা নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হয়তো সেই ওজন ডেকের ওপর তুলে নেওয়ার পরেই হারিকেন ঝড়ের হাওয়ায় নাস্তানাবুদ “স্ট্র্যাটফোর্ড” জলতলে চলে গেছিল। খুবই পরিতাপের বিষয় সন্দেহ নেই, কিন্তু ভাগ্যের কী বিড়ম্বনা! আমরা জলে ডুবে অক্কা পেয়েছি মনে করে যারা বিষাদগ্রস্ত হয়েছিল, তারাই জলতলে প্রাণ দিল— আমরা রইলাম বেঁচে।

ক্যাপ্টেন হোয়ি নিশ্চয় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শক্ত হাতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জাহাজ ডুবেছে তাঁকে আর ইঞ্জিন ঘরে যারা আগুনে কয়লা চালান করছিল তাদের নিয়ে। আমাদের ইচ্ছানুসারে তাদের প্রত্যেককে ভাঙা জাহাজ থেকে এনে কবরস্থ করা হয়েছিল সমুদ্রতলের একটা সামুদ্রিক ঝোপের পাশে। এত কথা খুঁটিয়ে লিখলাম এই কারণে যে, যদি আমার এই লেখা মিসেস হোয়ি-র চোখে পড়ে, তিনি অন্তত কিছুটা সান্ত্বনা তো পাবেন। কয়লা চালান করছিল ইঞ্জিনের চুল্লীতে যারা, তাদের নাম আমার জানা নেই।

এহেন কর্তব্য-কর্মের অনুষ্ঠানে আমরা যখন ব্যাপৃত, খুদে মানবরা তখন ছেয়ে ফেলেছে গোটা জাহাজটাকে। চোখ তুলে ওপরদিকে চেয়ে দেখেছিলাম তারা থুকথুক করছে জাহাজের সব জায়গায়— এক ডেলা মাখনের ওপর এক পাল ইঁদুরের মতো, তাদের উত্তেজনা দেখে বুঝে নিলাম, এ রকম বাষ্পীয় পোত বা আধুনিক জাহাজ দেখছে তারা এই প্রথম। অর্ধস্বচ্ছ কাচের বর্মের মধ্যে অক্সিজেনের জোগান সীমিত বলেই মূল ঘাঁটি থেকে এতদূরে বেশিক্ষণ থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ঝটপট হাত চালিয়ে ভাঙচুর করে যা যা নেবার নিয়েছে। আমরাও আমাদের কেবিনে গিয়ে কিছু জামা কাপড় আর বই-টই নিয়ে এসেছিলাম— তখনও পর্যন্ত আস্ত অবস্থায় যা যা পাওয়া গেছিল।

জাহাজ থেকে পাওয়া অনেক কিছুর মধ্যে ছিল “লগবুক”, যে জাহাজি ডায়েরিতে শেষ দিনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যাবতীয় বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত বিশদভাবে লিখে গেছেন ক্যাপ্টেন মহাশয়। সেই লেখা এখন আমরা পড়ছি, এইটাই তো একটা আশ্চর্য ব্যাপার। যিনি লিখেছিলেন, তিনি কিন্তু বেঁচে নেই। সেদিনের কাহিনি লেখা আছে এইভাবে:

*

‘তেসরা অক্টোবর। তিন কাঠগোঁয়ার, কিন্তু অতীব দুঃসাহসী, আমার নিষেধে কান না দিয়ে আজ নেমে গেল সাগরের তলায়— ইস্পাতের বাক্সের মধ্যে ঢুকে। যে দুর্ঘটনা ঘটবে বলে ভয় পেয়েছিলাম, ঠিক তা-ই ঘটেছে। তাদের আত্মার শান্তি হোক। জলে নেমে গেছিল সকাল ১১টায়। ওই সময়ে জলে নামার অনুমতি দেওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না, কেননা দিগন্তে ঘন হচ্ছিল ঝড়ের সংকেত। বিদায় জানিয়ে ছিলাম তা সত্ত্বেও একটাই মনোভাব নিয়ে— এই দেখাই শেষ দেখা। প্রথম দিকে সবই ছিল ঠিকঠাক, এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ইস্পাতের বাক্স নেমে গেছিল তিনশো ফ্যাদম গভীরতায়। ডক্টর ম্যারাকট যে ক-টা বার্তা পাঠিয়েছিলেন, প্রত্যেকটাই ছিল শুভ। তারপরেই তাঁর কণ্ঠস্বরে পেলাম উত্তেজনার আভাস, তাদের কাছিও দুলছিল দারুণভাবে। কাছি ছিঁড়ে গেল ঠিক তার পরেই। মনে হয় ওই সময়ে গভীর কোনও খাদে গিয়ে পড়েছিল ইস্পাতের বাক্স, কেননা ডক্টর আস্তে আস্তে কাছি টেনে নিয়ে যেতে বলছিলেন। প্রায় আধমাইল পর্যন্ত বাতাসের নল ছিল আস্ত, তারপর তাও গেল ছিঁড়ে। এরপর থেকে ডক্টর ম্যারাকট, মিস্টার হেডলে আর মিস্টার স্ক্যানলান-এর আর কোনও বার্তা পাইনি।

তা সত্ত্বেও একটা অত্যাশ্চর্য বিষয় লিপিবদ্ধ না করে পারছি না, ছাব্বিশ হাজার ছ-শো ফুট গভীরতা থেকে তুলে আনা হয়েছিল একটা সিসের ওজন। কাছিতে বাঁধা ছিল মিস্টার হেডলের নামাঙ্কিত একটা রুমাল। জাহাজের সব্বাই বিমূঢ়। ভেবে পাচ্ছে না এমনটা হয় কী করে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর কাছি টেনে তুলেছিলাম— দেখেছিলাম ছেঁড়া প্রান্ত। এবার জাহাজ নিয়ে ভাবা যাক। এরকম দুর্যোগের আভাস কখনও দেখিনি। ব্যারোমিটার এসে দাঁড়িয়েছে ২৮.৫-এ, আরও নামছে।

জাহাজি সঙ্গীদের শেষ সংবাদ পেলাম এই ভাবেই। ভয়ানক এই সাইক্লোনের খপ্পরে পড়ে জাহাজ তলিয়ে গেছে এর ঠিক পরেই। ধ্বংসাবশেষের কাছে ছিলাম ততক্ষণ, যতক্ষণ না অর্ধস্বচ্ছ কাচের খোলসের মধ্যে অক্সিজেন একটু একটু করে কমে এসে আমাদের প্রাণান্ত ঘটানোর উপক্রম করেছিল। ফেরবার পথে পড়েছিলাম এমন একটা আচমকা বিপদের খপ্পরে যা থেকে বুঝে নিয়েছিলাম এতকাল সমুদ্রতলের বাসিন্দা হয়েও কেন এদের জনসংখ্যা তেমনভাবে বাড়েনি। গ্রিক গোলাম সমেত এদের সংখ্যা বড়জোর চার থেকে পাঁচ হাজার। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে আগ্নেয় পাহাড়ের কিনারা বরাবর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমরা কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরেই ম্যান্ডা আঙুল তুলে দেখিয়েছিল মাথার ওপর দিকে, একই সঙ্গে আমাদেরই দলের একজনকে পাগলের মতো ইশারা করেছিল জঙ্গলের মধ্যে চলে আসার জন্যে— সে লোকটা দলছাড়া হয়ে এগিয়ে গেছিল একটু খোলা জায়গায়। একই সঙ্গে ম্যান্ডা নিজে দলবল সমেত তড়িঘড়ি ছুটে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিল মস্ত একটা পাথরের চাঁইয়ের তলায়। সেখানে যাওয়ার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম নিদারুণ এহেন আতঙ্কের কারণটা কী। আমাদের মাথার ওপর দিকে একটু দূর থেকে দ্রুত নেমে আসছিল অদ্ভুত গড়নের একটা মাছ। ফুলো আর চ্যাপটা, তলার দিকটা সাদাটে, কিনারা বরাবর লালচে আভা— যার কম্পন আর আলোড়ন বিকট মীন মহাশয়কে দ্রুত নামিয়ে আনছিল নিচের দিকে। সে মাছের চোখ মুখ কিছু আছে বলে মনে হল না, কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল তার শিহরণ জাগানো ক্ষিপ্রতা। যে সঙ্গী একটু দূরে ছিটকে গেছিল, মাথার ওপরে দ্রুত নেমে আসা ভয়ানক দর্শন মীন মহাশয়কে দেখেই সে দৌড় দিয়েছিল আমাদের দিকের পাথরের গোল চাইটা লক্ষ করে, কিন্তু বড় দেরি করে ফেলেছিল। দূর থেকে দেখেছিলাম তার আতঙ্ক বিস্ফারিত চক্ষু যুগল যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, নিদারুণ ভয়ে মুখভাব বিকৃত হয়ে গেছে।

ভয়ানক দর্শন প্রাণীটা নিমেষের মধ্যে গ্যাঁট হয়ে চেপে বসে গেছিল বেচারার ওপর সব দিক দিয়ে যাতে কোথাও ফাঁকা না থাকে, ঠিকরে বেরিয়ে যেতে না পারে। গায়ে কাঁটা জাগানো ভঙ্গিমায় স্পন্দন জাগিয়ে গেছিল সর্ব অবয়বে এমনভাবে যেন নিচের মানুষটাকে পিষে ফেলছে প্রবাল পাথরের ওপর। পুরো বিয়োগান্তক দৃশ্যটা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছি, সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। তা সত্ত্বেও আতঙ্কে অবশ্য সঙ্গীরা দাঁড়িয়েছিল কাঠ হয়ে— মরণের পথে আগুয়ান সঙ্গীকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে যায়নি। স্ক্যানলান কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতে পারেনি। ধেয়ে গেছিল সামনে, লাফিয়ে উঠে পড়েছিল মহাকায় বিকটাকার আতঙ্কের নরম চওড়া পৃষ্ঠদেশে, হাতের ছুঁচোলো শড়কি দিয়ে খুঁচিয়ে গেছিল নির্মমভাবে।

অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ছিটকে গেছিলাম স্ক্যানলান-এর পাশে। তারপরেই এসে গেছিলেন ম্যারাকট, দলের বাকি সবাই তখন একযোগে জলরাক্ষসকে আক্রমণ করতেই সে বেচারা আস্তে আস্তে ভেসে উঠেছিল ওপর দিকে তেলতেলে আঠালো একটা বস্তুর নিষ্ক্রমণ ঘটিয়ে। কিন্তু দেরি করে ফেলেছিলাম। বিশাল সাগর দানবের দেহভারেই ভেঙে গেছিল হতভাগ্য আটলান্টিয়ানের অর্ধস্বচ্ছ স্ফটিক হেলমেট— মারা গেছিল জলতলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। মৃতদেহ নিয়ে ফিরে আসবার পর একদিকে যেমন শোকস্তব্ধ হয়েছিল গোটা তল্লাটটা, আর একদিকে হিরো হয়ে গেছিলাম আমরা তিনজনে। অদ্ভুত সেই মৎস্য সম্বন্ধে ডক্টর ম্যারাকট পরে যা মন্তব্য করেছিলেন, তা এই: কম্বল মাছের নয়া নিদর্শন। মৎস্যবিজ্ঞানীদের কাছে অজ্ঞাত নয়। কিন্তু এহেন মৎস্য যে এমন বৃহদাকার হয়, তা ছিল তাঁর ধারণাতীত।

ঘটনাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখলাম বিয়োগান্তক হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে। কিন্তু অত্যাশ্চর্য যে প্রাণপ্রবাহ সাগরতলে দেখেছি, তা নিয়ে একটা গ্রন্থ রচনার অভিলাষ আমার আছে। এখানে দেখছি লাল আর কালো রং দুটোরই দাপট বেশি— জানি না কেন সমুদ্রের গভীরের প্রাণীমহলে এই বর্ণদুটোর এত প্রাধান্য। গাছপালা কিন্তু জলপাই রঙের, খুবই ফিকে। কিন্তু এমনই মজবুত যে সমুদ্রতলে ট্রলার নামিয়েও ছিঁড়ে আনা যায় না। বিজ্ঞানীদের তাই বিশ্বাস হয়ে গেছে, সমুদ্রের তলাটা বোধ হয় এক্কেবারে ন্যাড়া, অনুর্বর উদ্ভিদের ঠাঁই নেই সেখানে।

সাগর জীবেদের অনেকেই অসাধারণ সুন্দর, অন্যান্যরা এমনই কিম্ভূতকিমাকার যে যেন তারা দুঃস্বপ্নলোকের আততায়ী, ভয়ানক বিপজ্জনক, তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা নেই স্থলভূমির খোদ শয়তান-প্রতিম আতঙ্ক জাগানো প্রাণীদেরও। তিরিশ ফুট লম্বা একটা হুল-রশ্মি প্রাণী আমি দেখেছি, গায়ের রং মিশকালো, লেজে রয়েছে এমনই ভয়ানক দাঁড়া যার এক ঘায়েই পরলোকে প্রস্থান করবে ধরাতলের যে কোনও জীব। ব্যাঙের মতো একটা প্রাণী দেখেছি যার ড্যাবডেবে সবুজ চোখ ঠেলে বেরিয়ে থাকে শরীরের বাইরে, গোটা শরীর জুড়ে রয়েছে ব্যাদিত মুখবিবর— খোলা হাঁ-য়ের মধ্যে টেনে নেয় মনের মতো খাদ্য। চালান করে যে উদরের মধ্যে, তার সাইজ অতি বিরাট। হাতে ইলেকট্রিক মশাল না থাকলে এমন জীবের সম্মুখীন হওয়া আর যমালয়ে যাওয়া একই ব্যাপার। আমি দেখেছি বিলকুল অন্ধ লাল টকটকে বান মাছ— যারা ঘাপটি মেরে থাকে পাথরের আনাচে কানাচে— প্রাণ হরণ করে করাল বিষ ছিটিয়ে দিয়ে। দানবসদৃশ বিরাটকায় সামুদ্রিক কাঁকড়াবিছেও আমি দেখেছি, যা কিনা জলতলের অন্যতম আতঙ্ক, দেখেছি ডাইনি মৎস্য— যারা ঘাপটি মেরে থাকে সাগরতলের অরণ্যের আঁধারে।

একবার তো সাগরতলের সত্যিকারের সমুদ্র সরীসৃপ দেখবার সুযোগও আমার হয়েছিল। এমন প্রাণী কদাচ আসে মানব চক্ষুর সামনে। কারণ, এর নিবাস জলের অতি গভীরতায়। জলতলে যদি কখনও প্রাকৃতিক খিঁচুনি আরম্ভ হয়, তখনই শুধু ঠিকরে আসে জল পৃষ্ঠে। মোনা আর আমি একদিন স্তরীভূত কোলেনকাইমা স্তবকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দুটো সাগর-আতঙ্ক পিছলে পিছলে চলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। আকারে তারা অতিকায়— উচ্চতায় প্রায় দশ ফুট, লম্বায় দুশো ফুট। ওপর দিকটা মিশকালো, তলার দিকটা রুপোলি সাদা, পিঠে খাড়াই ঝালর। চক্ষুযুগল কিন্তু একটা ষাঁড়ের চোখের চাইতে বড় নয়। এর সম্বন্ধে এবং আরও অনেক বিদঘুটে প্রাণী সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ পাবে ডক্টর ম্যারাকটের লেখার মধ্যে, সে লেখা যদি কখনও পৌঁছোয় তোমাদের হাতে।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ পিছলে পিছলে বেরিয়ে গেছে নতুন এই জীবন ধারায়। খুব মজায় ছিলাম। দিনগুলো ফুরফুর করে কেটে যাচ্ছিল। বহুবিস্মৃত এদের ভাষার টুকটাক শিখেও নিচ্ছিলাম। ফলে, সঙ্গীদের সঙ্গে বাক্যালাপে অসুবিধে হচ্ছিল না। অধ্যয়ন আর আমোদপ্রমোদের বিষয়ের তো শেষ ছিল না। ইতিমধ্যেই প্রাচীন রসায়ন শাস্ত্রের বেশ কিছুটা রপ্ত করে নিতে পেরেছিলেন ডক্টর ম্যারাকট। আমাকে বলেছিলেন, যদি কোনওদিন তাঁর এই জ্ঞান মর্তের মানুষদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে নির্ঘাৎ বিপ্লব এসে যাবে বিজ্ঞান জগতে। অন্য অনেক জ্ঞানের মধ্যে আটলান্টিয়ানরা পরমাণু ভাঙবার কৌশল আবিষ্কার করেছিল, ফলে যে শক্তি নির্গত হত, তা আমাদের বৈজ্ঞানিকদের কল্পনার চেয়ে কম পরিমাণ হলেও, সাগরতলের শক্তির আধার ভরাট রেখে দিতে পারত নিজেদের কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্যে। ইথার-এর প্রকৃতি আর শক্তি সম্বন্ধে এদের জ্ঞান আমাদের জ্ঞানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। সবার ওপরে রয়েছে, চিন্তাকে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা। এই চিন্তা-সিনেমা দিয়েই তো ওদের দেখাতে পেরেছি আমাদের দুর্দৈব, তারা দেখাতে পেরেছে তাদের অতীতের গৌরব আর পতন কাহিনি। এ সবই তো ইথারের বুকে জেগে থাকা ছাপ-কে বস্তুর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার বিদ্যা।

এতদ্‌সত্ত্বেও, আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছুই এদের অতীত জ্ঞানবৃদ্ধদের নজরের বাইরে থেকে গেছে।

হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছে বিল স্ক্যানলান। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখছিলাম চাপা উত্তেজনায় ছটফটিয়ে যাচ্ছে। যেন বিপুল এক গুপ্ত সংবাদকে গোপনে রাখতে গিয়ে পেট ফুলে ঢোল হয়ে যাচ্ছে। খুক খুক করে আপন মনে হেসেই যাচ্ছে নিজের ভাবনাচিন্তাতেই। এই সময়ে ওকে দেখেছি, বারব্রিক্স নামের এক আটলান্টিয়ানের সঙ্গে গলায় গলায় বন্ধুত্ব পাতিয়ে অষ্টপ্রহর তাকে নিয়ে থাকতে। বেশ কিছু কলকবজা দেখাশুনা করবার দায়িত্বে ছিল বারব্রিক্স। কথাবার্তার বেশির ভাগটাই চালাত হাবেভাবে নয়তো পরস্পরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে। হরিহর আত্মা দুই বন্ধু বেশির ভাগ সময়টা কাটাতে একসঙ্গে। একদিন প্রোজ্জ্বল মুখে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল স্ক্যানলান।

বললে ম্যারাকট-কে, ‘ডক, এদের পিলে চমকে দিতে চাই আমার কিছু বিদ্যে দিয়ে। আমাদের পিলে চমকে দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এবার চমকে দেওয়ার পালা আমার। আগামীকাল একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা যাক।’

আমি বলেছিলাম, ‘সেই প্রদর্শনীতে এবার নিশ্চয় হবে জ্যাজ বাজনা?’

‘দূর মশায়। ধৈর্য ধরুন, দেখতে পাবেন। আক্কেল গুড়ুম করে ছাড়ব। এখন কিছু বলব না।’

পরের দিন আটলান্টিয়ানরা জড়ো হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহে। মঞ্চে উঠে গেছিল স্ক্যানলান আর বারব্রিক্স। চোখমুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিশ্বজয় করতে যাচ্ছে। একজন টিপে দিল একটা বোতাম। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেছিল গমগমে কণ্ঠস্বরের ঘোষণা:

‘লন্ডন থেকে বলছি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে। আবহাওয়ার ভবিষ্যৎবাণী।’ তারপরেই যথারীতি আসন্ন প্রাকৃতিক নিম্নচাপের সংবাদ আর বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত সমাচার। তার পর— ‘নিউজ বুলেটিন। হ্যামারস্মিথে নতুন এক শিশু হাসপাতাল উদ্বোধন করেছেন মহারাজ’ এইভাবেই একনাগাড়ে সংবাদ বিতরণ চলল বেশ কিছুক্ষণ। জলে নেমে আসার পর সেই প্রথম আধুনিক ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় ফিরে গেলাম বেশ কিছুক্ষণের জন্যে। শুনলাম যুদ্ধকালীন ধারদেনা করার সংবাদ। ক্রীড়া সংবাদ। বিদেশ বার্তা। পুরোনো পৃথিবী সজীব হয়ে গেল কালের গোড়ায়। চক্ষু ছানাবড়া করে সব শুনে গেলেও মানে বুঝল না পাতালবাসী আটলান্টিয়ানরা। তারপর যখন বেজে উঠল যুদ্ধের রণদামামা, তখন উল্লসিত হতে দেখা গেল সাগরতলের বাসিন্দাদের। সঙ্গীত এমনই জিনিস— সবাইকে মাতিয়ে দেয়, বিশেষ করে ব্যান্ড মিউজিক। মেতে উঠে নেচে নেচে অনেকেই ছুটে গেছিল মঞ্চের ওপর, পর্দা সরিয়ে দেখতে চেয়েছিল পেছনে বসে কারা বাজাচ্ছে এমন বাজনা। কিছুই দেখতে পায়নি। ফলে থ হয়ে গেছিল পাতালের প্রতিটি বাসিন্দা।

পরে বলেছিল স্ক্যানলান, ‘রেডিয়ো তৈরির বিদ্যেটা একটু জানা ছিল বলেই ভড়কি দেখালাম। দেখলাম ইথার তরঙ্গ শুধু আকাশের মধ্যে দিয়েই যায় না, জলের মধ্যে দিয়েও যায়। সহজ কেরামতি, কিন্তু বিপুল চমক!’

আটলান্টিয়ানরাও তো কম যায় না। জলের তলায় থেকেও আবিষ্কার করেছিল অনেক কিছু। রসায়নবিদরা মাথা খাটিয়ে বানিয়েছিল এমনই একটা গ্যাস যা হাইড্রোজেনের চেয়ে ন-গুন বেশি হালকা। ম্যারাকট বিশেষ এই গ্যাসটার নাম দিয়েছিলেন “লেভিজেন”। এই গ্যাস নিয়ে উনি নিজেও বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। সেই সব থেকেই মাথায় এসেছিল খাসা একটা আইডিয়া: লেভিজেন গ্যাস দিয়ে ঠাসা কাচের গোলক পাঠিয়ে দেওয়া যাক সমুদ্রতল থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠে নিয়ে যাক আমাদের বার্তা— সমুদ্রের তলায় কাটাচ্ছি কী ধরনের খাসা জীবন।

‘ম্যান্ডা-কে দিয়েছি মতলবটা,’ আমাদের বলেছিলেন ম্যারাকট, ‘সিলিকা কারখানার কর্মচারীদের বলে দিয়েছে, দিন দুয়েকের মধ্যে গোলক তৈরি হয়ে যাবে।’

আমি বলেছিলাম, ‘কিন্তু আমাদের খবর কাচের গোলকের মধ্যে ঢোকানো হবে কীভাবে?’

‘গ্যাস ঢোকানো হবে ছোট্ট একটা ফুটোর মধ্যে দিয়ে। সেই ফুটো দিয়েই গলিয়ে দেব কাগজ। তারপর ঝানু কারিগররা বন্ধ করে দেবে ফুটো। ছেড়ে দিলে নিশ্চয় জল ঠেলে উঠে যাবে ওপরে।’

‘তারপর নেচে নেচে বেড়াবে ঢেউয়ের ওপর বছরের পর বছর?’

‘সেটা ঘটলেও ঘটতে পারে। তবে, গোলক থেকে রোদ ঠিকরে যাবে। লোকের চোখে পড়বেই। গোলক ছাড়ব ইউরোপ আর দক্ষিণ আমেরিকার মাঝামাঝি জায়গার সাগরের তলা থেকে যেখানে রয়েছি আমরা। অনেক জাহাজ যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। কারও না-কারও চোখে পড়বেই।’

ভায়া ট্যালবট; এই চিঠি সেইভাবেই পৌঁছচ্ছে তোমার কাছে, অথবা অন্য কোনও জনের হাতে। তবে আরও একটা আইডিয়া খেলে গেছিল আমাদের আমেরিকান দোস্ত বিল স্ক্যানলান-এর মগজে।

বলেছিল, ‘শুধু পত্র পাঠিয়ে কী লাভ? যেতে হবে নিজেদের।’

‘কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

‘ঠিক যেভাবে চিঠি যাবে ওপরে, সেই ভাবে।’

‘তার মানে?’

‘আরে মশায়, গ্যাস যদি চিঠি বয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদেরকে নিয়ে যাবে না কেন?’

‘তারপর পড়ব হাঙরের মুখে?’

‘যাচ্চলে? জল ফুঁড়ে উঠে গিয়ে আমরা তো ছিটকে যাব জল থেকে কমসে-কম পঞ্চাশ ফুট ওপরে। তা-ই দেখে ভড়কে যাবে সব্বাই!’

‘তারপর?’

‘আরে গেল যা! তারপরের কথা তারপরে! আগে তো ওঠা যাক ওপরে। ঘরে আমার একটা বউ আছে।’

সায় দিয়েছিলেন ম্যারাকট সোল্লাসে, ‘আমিও চাই জগতের বিজ্ঞানীদের মুন্ডুগুলো ঘুরিয়ে দিতে। ম্যান্ডা-র সঙ্গে দোস্তি আমার ভালোই। দেখা যাক কী করা যায়।’

মতলবটায় কেন আমার মত ছিল না, সে কাহিনি বলছি পরে।

বলেছিলাম, ‘নিছক পাগলামি। জল ঠেলে উঠে পটল তুলবে খিদে আর তেষ্টায়।’

ম্যারাকট বলেছিলেন, ‘কী আশ্চর্য! বিশেষ অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমা মেপে উঠে গেলেই জাহাজ যাতায়াতের পথে গিয়ে পড়ব।’

স্ক্যানলান বলেছিল, ‘যাচ্চলে! নিজেরা না গেলেই হল। শুধু খবর পাঠানো যাক— আমরা রয়েছি অমুক অক্ষাংশ অমুক দ্রাঘিমায়। জাহাজ থেকে রশি নামিয়ে তুলে নিয়ে যাবে আমাদের।’

ম্যারাকট আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘শুধু আমরা তিনজন কেন, একজন সুকন্যাও যেতে পারে আমাদের সঙ্গে।’

সোল্লাসে বলেছিল স্ক্যানলান, ‘তা-ই হোক, তা-ই হোক। মিস্টার হেডলে, লিখুন চিঠি, ছ-মাসের মধ্যে পৌঁছে যাব লন্ডনের নদীতে।’

তাই ছাড়লাম দু-খানা কাচের গোলক। ছোট্ট বেলুন।

বিদায়।

*

কাচের গোলকের ভেতরকার বিবরণীর সমাপ্তি এইখানেই।

খবরটা হু-হু করে ছড়িয়ে গেছিল গোটা ইউরোপ আমেরিকায়। একটা জাহাজ এসে গেছিল নির্দিষ্ট দ্রাঘিমা অক্ষাংশের জায়গায়। পিয়ানোর তারে বাঁধা একটা বোতলের মধ্যে (সিসে দিয়ে ভারি করা) ছিল এই বার্তা:

‘আপনাদের সংবাদ নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। আমরা এসে গেছি। একই খবর পাঠাচ্ছি বেতার প্রেরক যন্ত্র দিয়ে। চিরুনি আঁচড়ানোর মতো যাব আপনাদের অঞ্চল বরাবর। এই খবর পিয়ানোর তার থেকে খুলে নিয়ে আপনাদের খবর বেঁধে দিন। যে রকমভাবে বলবেন, সেই রকমভাবে আপনাদের তুলে আনব।’

এই বার্তা সাগরের তলায় নামিয়ে দিয়েছিল যে জাহাজ, সেই জাহাজই একই জায়গা দিয়ে যাতায়াত করেছিল পুরো দুটো দিন দুটো রাত। তৃতীয় দিনে ঝকঝকে একটা গোলক ঠিকরে উঠে এসেছিল জলপৃষ্ঠের ওপরে। ভাসছিল জাহাজ থেকে কয়েকশো গজ দূরে। সেই গোলক তুলে এনে অতি কষ্টে ভেঙে ফেলার পর পাওয়া গেছিল এই বার্তা:

‘ধন্যবাদ বন্ধুগণ। আপনাদের চমকপ্রদ দেশভক্তি আর এনার্জির জন্যে তারিফ জানাচ্ছি। আপনাদের বেতার বার্তা পেয়েছি। জবাব পাঠাচ্ছি এইভাবে। আগামীকাল, মঙ্গলবার, পাঁচ জুলাই সকাল ছ-টায় তৈরি থাকবেন। ম্যারাকট, হেডলে, স্ক্যানলান।’

এর পরবর্তী বিবরণী দিয়ে গেছেন মিস্টার কে. অসবর্ণ এইভাবে:

‘বেশ মিষ্টি সকাল। নীলকান্ত মণির মতো গাঢ় নীল সমুদ্র। দীঘির মতো স্থির, নিস্তরঙ্গ। মাথার ওপর ঘন নীল আকাশের খিলেন। ছোট ছোট মেঘ। ‘ম্যারিয়ন’ জাহাজের সব্বাই সজাগ, আগ্রহপ্রদীপ্ত। ঘড়িতে ছ-টা বাজতে বেশি দেরি নেই। সামনের দিকে যাকে দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকে খর-নজর রাখতে বলেছিলাম, সে চেঁচিয়ে উঠল ছ-টা বাজতে যখন পাঁচ মিনিট বাকি। আঙুল তুলে দেখাল সমুদ্রের দিকে। ডেকের কিনারায় রেলিংয়ের ধারে জড়ো হলাম সবাই। একটা বোট নামিয়ে নিজে গিয়ে তাতে বসলাম। যেখান থেকে আরও স্পষ্ট দেখতে পেলাম। স্থির জলের মধ্যে দিয়ে রুপো দিয়ে গড়া বুদবুদের মতো একটা জিনিস দ্রুত উঠে আসছে জলপৃষ্ঠের দিকে। উঠে গেল শূন্যে জাহাজ থেকে প্রায় দু-শো গজ তফাতে। সোজা আকাশের দিকে। খুব সুন্দর চকচকে বর্তুল। ব্যাস ফুট তিনেক। খেলনার গ্যাসভরতি বেলুনের মতো ভেসে গেল হাওয়ার টানে। দেখে মোহিত হওয়ার মতো দৃশ্য। কিন্তু আমি ভয় পেলাম। বর্ম কি ছিঁড়ে গিয়ে ছিটকে গেল? যাদেরকে টেনে তোলার কথা, তারা তলিয়ে গেল? বেতার বার্তা পাঠালাম তৎক্ষণাৎ:

‘‘আপনাদের বার্তাবাহক এসেছিল জাহাজের খুব কাছে। সঙ্গে কিছু লাগানো ছিল না। হাওয়ায় উড়ে গেল।’ নামিয়ে দিলাম আরও একটা বোট— যদি দরকার হয়।

‘ছ-টার ঠিক পরে ওয়াচম্যানের কাছ থেকে এল আর একটা সিগন্যাল, তারপরেই দেখলাম আবার একটা রুপোলি বর্তুল, প্রথমটার চাইতে ধীর গতিতে উঠে আসছে জলের মধ্যে দিয়ে। উঠে এসে ভাসতে লাগল বাতাসে, কিন্তু তাতে বাঁধা বোঝাটা রইল জলপৃষ্ঠে। সেই বান্ডিলের মধ্যে দেখা গেল মাছের চামড়া দিয়ে মোড়া প্রচুর বই, কাগজ আর রকমারি বস্তু। টেনে তোলা হল জাহাজের ডেকে। বেতার বার্তা মারফত জানিয়ে দেওয়া হল কী কী পেয়েছি। সাগ্রহ প্রতীক্ষা শুরু হল তারপর থেকে।

‘এবার আর বেশি দেরি হল না। আবার জল ঠেলে তেড়ে উঠে এল একটা রুপোলি বুদবুদ। এবার কিন্তু জলপৃষ্ঠ ছেড়ে বেশ খানিকটা শূন্যে উঠে গিয়ে ভাসতে লাগল চকচকে সেই বুদবুদ, সবিস্ময়ে দেখলাম, তাতে বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে ছিপছিপে চেহারার নারী মূর্তি। তেড়ে উঠে আসার দরুন জলপৃষ্ঠ ছেড়ে খানিকটা উঠে গেলেও ফের জল পৃষ্ঠেই নেমে এসে ভাসতে লাগল। টেনে আনা হল তক্ষুনি। বর্তুলের ওপর দিকে বাঁধা একটা চামড়ার বেল্ট থেকে চামড়ার ফিতে নেমে এসে আটকে রয়েছে সেই তন্বী রমণীর ক্ষীণ কটিদেশের চওড়া বেল্টে। তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ মোড়া রয়েছে নারকেল আকারের অদ্ভুত স্বচ্ছ একটা খোলস দিয়ে। জিনিসটাকে বলা যাক কাচের খোলস, কিন্তু কাচের চেয়ে মজবুত হালকা সেই পদার্থ যা দিয়ে নির্মিত হয়েছে অর্ধস্বচ্ছ কাচের মতো গোলক।

‘প্রায় স্বচ্ছ এই গোলকের গায়ে রয়েছে রুপোলি শিরা আর ধমনীর মতো আঁকাবাঁকা রেখার জটাজাল। অদ্ভুত কাচের এই খোলস খুবই টাইটভাবে লাগানো রয়েছে ঘাড়ে আর কোমরে ইলাসটিক বেল্ট দিয়ে যা এক্কেবারে ওয়াটারটাইট— এক বিন্দু জল ঢাকবারও উপায় নেই। ভেতরে রয়েছে বাতাস তৈরির কেমিক্যাল কলকবজা যার বর্ণনা হেডলে-র মূল পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গেছিল। অনেক কষ্টে শ্বাসপ্রশ্বাসের বেল্ট খুলে এনে তন্বী মহিলাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল ডেকের ওপর। পড়ে রইল সুগভীর জ্ঞানহীন অবস্থায়। কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়মিত ছন্দ থেকে বোঝা গেল, জ্ঞান ফিরে আসবে এখুনি। জলচাপের মধ্যে দিয়ে বেগে এতটা উঠে আসার ধকল যাচ্ছে শরীর আর স্নায়ুতন্ত্রের ওপর দিয়ে। বাতাসের যা চাপ, জল চাপ তো তার থেকে বেশি। এহেন অবস্থায় মানিয়ে নেয় ডুবরিরা। কোনও মহিলার পক্ষে সে অবস্থায় খাপ খাইয়ে নেওয়া সহজ নয়।

‘নিঃসন্দেহে এই সেই আটলান্টিয়ান সুকন্যা, নাম যার মোনা, যার কথা হেডলে জানিয়েছে আগেই। জলতলের সেই কন্যা মর্তলোকের বাতাসে কিঞ্চিৎ কাহিল তো হবেই। তার গায়ের রং গাঢ়, গঠন নিখুঁত সুন্দর, সম্ভ্রান্ত আকৃতি, মাথার কালো চুল বেশ লম্বা। ক্ষণপরেই যে প্রবালনীল চোখ মেলে বিহ্বলভাবে তাকিয়ে ছিল আশপাশে মুগ্ধ বিস্ময়ে। ঝিনুক আর মুক্তো দিয়ে তৈরি তার ক্রিম রঙের পরিচ্ছদ। অতল জলের এমন রূপসী কন্যাকে কেউ কখনও কল্পনাতেও আনতে পারেনি। আশ্চর্য সুন্দর দুই চোখে সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে এসেছিল একটু একটু করে। আচমকা লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে জাহাজের রেলিংয়ের কাছে ছুটে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল কান্না-কান্না গলায়— ‘সাইরাস! সাইরাস!’

‘জলতলের বাসিন্দাদের উদ্বেগ কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে বেতার বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আগেই। কিন্তু এখন তাদের তিনজনে পর পর উঠে এল জল ভেদ করে, ছিটকে গেল জলপৃষ্ঠ থেকে তিরিশ-চল্লিশ ফুট উঁচুতে, তারপরেই ঝপাস করে পড়ে গেল সাগরের জলে। আমরা জাহাজের ডেকে তাদের তুলে আনলাম ঝটপট। জ্ঞান ছিল না তিনজনেরই। রক্ত চুঁয়ে চুঁয়ে বেরোচ্ছিল স্ক্যানলানের নাক আর কান থেকে। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনজনেই টলে টলে হেঁটে গেছে ডেকের ওপর দিয়ে। এক-একজন দেখিয়েছিল এক-এক রকম প্রতিক্রিয়া। হাস্যমুখর নাবিকেরা স্ক্যানলানকে টেনে নিয়ে গেছিল মদের আড্ডায়, সেখান থেকে ভেসে আসছিল ফুর্তির ফোয়ারা ছোটানো হল্লাবাজি। ডক্টর ম্যারাকট খপ করে তুলে নিয়েছিলেন কাগজপত্রের বান্ডিল, যার মধ্যে বীজগণিতের অঙ্ক আর চিহ্ন ছাড়া ছিল না কিছুই, দৌড়ে নেমে গেছিলেন নিচের তলায় সিঁড়ি বেয়ে। সাইরাস হেডলে ছিটকে গেছিল অদ্ভুত কন্যার পাশে। যেন এমন মেয়েকে কাছ ছাড়া করতে রাজি নয় মোটেই। ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি এইখানেই। ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারের বিশদ বিবরণ পরে যাবে সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চারিস্টদের কাছ থেকেই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *