অতল জলের শহর – ৩

(৩)

ঘুম ভাঙবার পর মনে হয়েছিল যেন জ্ঞানহীন অবস্থা থেকে সংজ্ঞা ফিরে পেলাম। কোথায় যে রয়েছি, এই ধারণাটাই প্রথমে আনতে পারিনি কল্পনার মধ্যে। গতদিনের ঘটনাগুলোকে মনে হচ্ছিল সারবন্দি আবছা ঘটনার ছায়া, প্রকৃত ঘটনা হিসেবে মন মেনে নিতে চাইছিল না কিছুতেই। ফ্যালফ্যাল করে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে ছিলাম জানলাবিহীন মস্ত ঘরটার ম্যাড়মেড়ে রঙের দেওয়ালগুলোর দিকে, কার্নিশের কাছ থেকে ঠিকরে আসা কম্পমান বেগুনি আলোক ধারার দিকে, ইতস্তত ছড়ানো আসবাবপত্রের দিকে, সবশেষে অন্য দুটো বিছানার দিকে— যে দুটোর একটা থেকে ভেসে আসছিল কেঁপে কেঁপে ওঠা অদ্ভুত নাক ডাকার শব্দ— সে শব্দ যে ম্যারাকটের, সে অভিজ্ঞতা হয়েছিল ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজে থাকবার সময়েই। সবই যেন অতিশয় কিম্ভূতকিমাকার মনে হয়েছিল, যেন সত্যি হতে পারে না কিছুতেই, যাচাই করে নেওয়ার জন্যে বিছানার চাদর খামচে ধরে লক্ষ করলাম চাদরের কাপড় কোনও সমুদ্র উদ্ভিদের শুকনো তন্তু বুনে তৈরি হয়েছে। হাড়েহাড়ে টের পেলাম সত্যিই কল্পনাতীত এক অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে এসে পড়েছি। ব্যাপারটা নিয়ে যখন মস্তিষ্ক ঘর্মাক্ত করছি, তখন অট্টহাসির উচ্চকিত বিস্ফোরণ ত্যাগ করে শয্যায় উঠে বসল বিল স্ক্যানলান।

আমার ঘুম ভেঙেছে দেখে শুষ্ক কাষ্টহাসির ফাঁকে ফাঁকে বললে, ‘মর্নিং, বো।’

চিবিয়ে চিবিয়ে জবাবটা দিলাম, ‘খুব মেজাজে আছেন দেখছি। এত হাসির কী আছে?’

‘প্রথমে আপনার মতো আমিও ভড়কে গেছিলাম, তারপর মাথায় এল খাসা একটা আইডিয়া। হাসিটা সেই কারণেই।’

‘আইডিয়াটা কী?’

‘ওই যে সিসের ওজনটা জলের গভীরতা মাপতে নেমে এসেছিল, ওই দড়িতে নিজেদেরকে বেঁধে দিলেই তো পারতাম। ওই যে সব কাচের ছদ্মবেশগুলো পরিয়ে দিয়েছিল, ওই সবের মধ্যেই তো নিঃশ্বেস নিয়ে যেতে পারতাম। বুড়ো ক্যাপ্টেন হোয়ি রেলিং ধরে ডেক থেকে হেঁট হয়ে দেখত, দড়িতে বাঁধা তিনখানা বান্ডিল উঠে আসছে জল থেকে। হাঃ হাঃ হাঃ!’

হেসেছিলাম আমিও। দু-জনের হাসির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছিল ডক্টরের। চোখে মুখে বেশ খানিকটা বিমূঢ় ভাব নিয়ে উঠে বসেছিলেন বিছানায়— ঠিক এই রকম বিমূঢ়তা দেখিয়েছিলাম আমি নিজেও চোখ মেলবার সঙ্গে সঙ্গে। নিজের বেহাল অবস্থা ভুলে গিয়ে বেশ মজার সঙ্গে শুনে গেছিলাম তাঁর ছাড়া ছাড়া মন্তব্য— কখনও উল্লসিত, কখনও বিমর্ষ… উল্লসিত এমন সুগভীর পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাওয়ায়… বিমর্ষ এই বার্তা মর্তের বিদগ্ধ বৈজ্ঞানিকদের কাছে পাঠানোর সুযোগ না থাকায়— যা কিনা এই মুহূর্তে খুবই দরকার।

নিজের ঘড়ির দিকে নেত্রপাত করে বললেন, ‘এখন বাজে ন-টা। কিন্তু রাত ন-টা, না দিন ন-টা সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’

তারপরেই বললেন, ‘নিজেদের ক্যালেন্ডারের হিসেব রাখতে হবে এখন থেকে। অবতরণ করেছিলাম তেসরা অক্টোবর। এখানে পৌঁছেছিলাম সেই দিনই সন্ধে নাগাদ। ঘুমিয়েছি তাহলে কতক্ষণ?’

স্ক্যানলান বললে সকৌতুকে, ‘মাসখানেক বলেই তো মনে হচ্ছে।’

সভ্য ভব্য থাকার জন্যে হাতের কাছে যা-যা মজুদ ছিল, তা-ই দিয়ে মুখ-টুখ ধুয়ে ফিটফাট হয়ে নিলাম। দরজা কিন্তু বন্ধই রইল। বেশ বুঝলাম, আপাতত আমরা সবাই কয়েদখানায় আছি। বাতাস যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে কি না বোঝা না গেলেও, বাতাস কিন্তু সুখাবহ। একটু পরেই লক্ষ করলাম, বাতাস আসছে দেওয়ালের অনেকগুলো ছোট ছোট ফুটোর মধ্যে দিয়ে। পুরো জায়গাটা উষ্ণ রাখবার কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা নিশ্চয় কোথাও আছে, যদিও স্টোভ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু টেম্পারেচার বেশ সুখাবহ। একটু পরেই দরজার ওপর দেখলাম একটা উঁচু বোতাম। টিপে ধরতেই হলুদ রঙের জামাকাপড় পরা কালচে চেহারার একটা লোক ফোকর পথে দেখা দিল। তার বড় বড় চোখের রং বাদামি, সে চোখে ভাসছে আপন করে নেওয়া চাহনি। চেয়ে রইল আমাদের দিকে নির্নিমেষে।

ম্যারাকট বললেন, ‘আমাদের খিদে পেয়েছে। খাবারদাবার কিছু আনা যাবে?’

মাথা নেড়ে হাসল লোকটা। বেশ বোঝা গেল, শব্দগুলোর মানে বুঝতে পারেনি।

স্ক্যানলান তখন চালিয়ে গেল ওর আমেরিকান স্ল্যাং। প্রত্যুত্তরে দেখলাম সেই নীরব হাসি। কিন্তু আমি যখন হাঁ করে আঙুল দিয়ে মুখের ভেতরটা দেখালাম, লোকটা সজোরে মাথা নেড়ে ত্বরিত পদে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

দশ মিনিট পরেই খুলে গেল দরজা। হলদেটে চামড়ার দু-জন পরিচারক এল ঘরের মধ্যে। ঠেলে নিয়ে এল একটা টেবিল। বাল্টিমোর হোটেলে বসেও এমন খানা পেতাম কি না সন্দেহ। কফি, গরম দুধ, রোল, সুস্বাদু চ্যাপটা মাছ, আর মধু। আধঘণ্টা মুখে কথা না বলে হাত চালিয়ে গেলাম। আধঘণ্টা পরে ফের এল পরিচারক দু-জন, ট্রে সমেত টেবিল ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, সন্তর্পণে বন্ধ করে দিল দরজা।

স্ক্যানলান বললে, ‘চিমটি কেটে কেটে নিজের গাল নীল আর কালো করে ফেলেও বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কী! স্বপ্ন দেখছি নাকি? ডক্টর, আপনি যখন আমাদের নিয়ে এসেছেন, তখন আপনিই বলুন, এ সবের মানে কী?’

মাথা নাড়তে নাড়তে ডক্টর বললেন, ‘মনে তো হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। তবে বড় মধুর স্বপ্ন! বড় সোনালি স্বপ্ন! মর্তের মানুষদের কাছে যদি পৌঁছে দিতে পারতাম এখানকার এই কাহিনি, তাহলে চক্ষুস্থির হয়ে যেত জগৎ জনের।’

আমি বললাম, ‘একটা ব্যাপার কিন্তু বিলকুল পরিস্কার, আন্টলান্টিক নিয়ে কিংবদন্তী তাহলে কুহক কল্পনা নয়— আদতে সত্যি আছে। সেই মহাদেশেরই কিছু মানুষ চমকপ্রদ কোনও পন্থায় সমুদ্রের তলায় বসবাসের উপযোগী করে নিয়েছে নিজেদের।’

বুলেট মাথা চুলকোতে চুলকোতে বিল স্ক্যানলান বলেছিল, ‘তা-ই যদি হয়, বুঝতে পারছি না বাতাস, টাটকা জল আর এলাহি বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে কেমন করে। দাড়িওয়ালা যাকে গতকাল দেখেছিলাম, সে এলে ফয়সালা হতে পারে এই রহস্যের।’

‘কিন্তু সেটা হবে কী করে? ভাষা তো আলাদা।’

ম্যারাকট বললেন, ‘নিজেরাই বরং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাই। একটা ব্যাপার এর মধ্যেই বোঝা হয়ে গেছে। বুঝলাম ব্রেকফাস্টের মধু থেকে। সংশ্লেষিত মধু নিঃসন্দেহে মৌচাকের খাঁটি মধু নয়। সিন্থেটিক মধু বানানোর কায়দা তো মর্তের মানুষও শিখে গেছে। সিন্থেটিক মধু যদি বানানো হয়, তাহলে সিন্থেটিক কফি আর ময়দাই বা বানানো যাবে না কেন? মৌল পদার্থের মলিকিউলগুলোতো ইটের মতো, আর এরকম ইট ছড়ানো রয়েছে আমাদের চতুর্দিকে। শুধু জানতে হবে বিশেষ ইটদের বের করা যায় কী করে— কখনও কখনও একটা মাত্র ইটকে— টাটকা বস্তু বানানোর জন্যে। চিনি স্টার্চ হয়ে যাচ্ছে, অথবা অ্যালকোহল হয়ে যাচ্ছে তো শুধু এই ইটদের নড়ানো সরানোর ফলে। কিন্তু তাদের নড়াচ্ছে কোন শক্তি? তাপ, বিদ্যুৎ! হয়তো আছে আরও অনেক কিছু যা আমাদের জানা নেই। তাদেরই কেউ কেউ নিজেরাই নড়ে সরে যায়, রেডিয়াম হয়ে যায় সিসে, অথবা ইউরেনিয়াম হয়ে যায় রেডিয়াম— তাদেরকে না ছুঁয়েই।’

‘বলতে চান, এরা তাহলে এগিয়ে থাকা রসায়ন বিদ্যা রপ্ত করেছে?’

‘আমি অন্তত সুনিশ্চিত সে ব্যাপারে। অবশ্যই সব রকমের মৌলিক পদার্থ রয়েছে এদের ভাঁড়ারে। অজানা নয় কিছু। সাগরের জল থেকে সহজেই পেয়ে যাচ্ছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। সামুদ্রিক উদ্ভিদ দুনিয়ায় রয়েছে দেদার নাইট্রোজেন আর কার্বন। গভীর সমুদ্রের তলানি খনিতে রয়েছে প্রচুর ফসফরাস আর ক্যালসিয়াম। পর্যাপ্ত জ্ঞান আর দক্ষ পরিচালনা থাকলে এসব থেকে কী না বানানো যায়?’

এই বলে যখন কেমিক্যাল লেকচার শুরু করেছেন ডক্টর, দরজা খুলে গেল সেই সময়ে, ঘরে ঢুকল ম্যান্ডা, মুখমন্ডলে বন্ধুত্বসূচক আপ্যায়ন ভঙ্গিমা। তার সঙ্গে এল সম্মানিত চেহারার সেই বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি— যাকে দেখেছিলাম আগের রাতে। নিশ্চয় বিদগ্ধ পুরুষ! কেননা, বেশ কয়েকটা বাক্য উচ্চারণ করে মহড়া দিয়ে গেল— যদি আমরা বুঝতে পারি। নিশ্চয় বিভিন্ন ভাষা, কিন্তু কোনওটারই মাথামুণ্ড কিসসু বুঝতে পারলাম না। বয়োবৃদ্ধ পুরুষ তখন মাথা নেড়ে কথা বলে গেল ম্যান্ডা-র সঙ্গে। ম্যান্ডা হুকুম দিল হলুদ পোশাক পরা দুই পরিচারককে। দু-জনেই তখনও দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে। দু-জনেই অদৃশ্য হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ, একটু পরেই ফিরে এল অদ্ভুতদর্শন একটা স্ক্রিন নিয়ে— দু-পাশে দুটো খুঁটির ওপর খাড়া করা অবস্থায়। দেখতে অবিকল আমাদের সিনেমার পর্দার মতো, কিন্তু ওপরে রয়েছে ঝিকিমিকি একটা পদার্থের প্রলেপ, আলো পড়লেই ঝিকমিক চিকমিক করছে। জিনিসটাকে রাখা হল একটা দেওয়ালের গা ঘেঁষে। বৃদ্ধ তখন মেপে মেপে পা ফেলে পেছিয়ে এল একটু পর্দার সামনে থেকে, দাগিয়ে দিল সেখানকার মেঝে। ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ম্যারাকটের দিকে ফিরে কপালে হাত রেখে আঙুল তুলে দেখাল পর্দা।

স্ক্যানলান বললে, ‘যাচ্চলে! এটা আবার কী মশকরা?’

ম্যারাকট মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের প্রত্যেকের হতভম্ব থতমত অবস্থাটা। একই অবস্থা চকিতের জন্যে দেখা গেল বৃদ্ধের মুখাবয়বে। মাথায় খেলে গেল একটা আইডিয়া! আঙুল তুলে দেখাল নিজেকে। তারপর ঘুরে দাঁড়াল পর্দার দিকে, স্থির চোখে চেয়ে রইল সেইদিকে। মুহূর্তমধ্যে তার প্রতিফলন দেখা গেল আমাদের সামনেকার স্ক্রিনে। তারপরেই আঙুল তুলে দেখাল আমাদেরকে, এক লহমা যেতে না যেতেই তার প্রতিচ্ছবির জায়গায় এসে গেল আমাদের সকলের প্রতিচ্ছবি। হুবহু আমাদের মতো নয়। স্ক্যানলানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম কমিক চিনেম্যানের মতে, ম্যারাকটকে বিশীর্ণ পচনপ্রাপ্ত মড়ার মতো, কিন্তু আমরাই বটে, অপারেটরের চোখে যেমন আমরা— তেমনি।

সবিস্ময়ে বলেছিলাম, ‘চিন্তার প্রতিফলন?’

‘তা-ই বটে,’ বললেন ম্যারাকট, ‘আশ্চর্য আবিষ্কার— পিলে চমকে দেওয়ার মতো! টেলিপ্যাথি আর টেলিভিশনের কম্বিনেশন— পৃথিবীতে যা নিয়ে ভাবনা চলছে আবছাভাবে।’

স্ক্যানলান বললে, ‘সিনেমায় আমাকে এই রকম দেখায় নাকি? কী আশ্চর্য! ‘লেজার’ দৈনিকের সম্পাদকের কানে খবরটা পৌঁছে দিতে যদি পারি, তাহলে বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। যদি এখান থেকে বেরোতে পারি।’

‘মুশকিলটা সেইখানেই,’ বলেছিলাম আমি, ‘গোটা দুনিয়াকে ঝাঁকিয়ে দেওয়া যেত শুধু এই একখানা খবর বাজারে ছেড়ে দিয়ে। কিন্তু ইশারা করছে কেন? কী বলতে চায়?’

‘ডক্টর, আপনাকে দিয়ে ট্রায়াল দিতে চায় বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক।’

ম্যারাকট তক্ষুণি গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন দেখিয়ে দেওয়া জায়গায়। তাঁর শক্তিশালী মগজ চিন্তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন জাগ্রত হল স্ক্রিনের ওপর। আমরা দেখলাম ম্যান্ডা-কে, তারপরেই দেখলাম ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজকে— যে অবস্থায় ছেড়ে এসেছিলাম, সেইভাবে।

ম্যান্ডা আর বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক দু-জনেই বিষম সন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করে গেল জাহাজের ছবি দেখবার পর, ম্যান্ডা দ্রুত ভঙ্গিমায় হস্ত সঞ্চালন করে প্রথমে দেখাল আমাদের কে, তারপর পর্দার দিকে।

সোল্লাসে বলেছিলাম আমি, ‘বুঝলেন কী বলতে চায়? যা বলতে চান, সব বলে যান। গুড আইডিয়া! ছবির মাধ্যমে জানতে চায় আমরা কে, এ চুলোয় এলাম কী করে?’

ম্যারাকট ঘাড় দুলিয়ে ম্যান্ডা-কে বুঝিয়ে দিল, অনুরোধটা তাঁর মাথায় ঢুকছে, বক্তব্য বোধগম্য হচ্ছে। সমুদ্র যাত্রার খুঁটিনাটি বিবরণ প্রক্ষেপণ করতে যখন শুরু করেছিলেন, হাত তুলে ম্যান্ডা তাঁকে আটকে দিল। হুকুম দিতেই দুই পরিচারক সরিয়ে নিয়ে গেল স্ক্রিনটা, তারপরেই আটলান্টিসবাসী দু-জন ইশারায় আমাদেরকে বললে তাদের পেছন পেছন আসা হোক।

বাড়িটা বিরাট। গলিপথের পর গলিপথ পেরিয়ে গেলাম, এসে গেলাম প্রকাণ্ড একটা হল ঘরে, ধাপে ধাপে সাজানো আসন— যেমনটা থাকে লেকচার কক্ষে। একদিকে রয়েছে একটা বড় স্ক্রিন, যেরকম স্ক্রিন একটু আগে দেখেছি, সেই রকম। স্ক্রিনের দিকে মুখ করে গ্যালারিতে বসে আছে কমসে-কম এক হাজার মানুষ, আমরা ঘরে ঢুকতেই অভিনন্দন জানালো মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি দিয়ে। স্ত্রী আর পুরুষ উভয়ই আছে সেই সম্মেলনে, সব রকম বয়সের, পুরুষদের গায়ের রং গাঢ়, গালে দাড়ি; মেয়েরা সুন্দরী, বয়স যাদের একটু বেশি তাদের চোখে মুখে চাপা গাম্ভীর্য। এদের সবাইকে খুঁটিয়ে দেখবার সময় পেলাম না আমাদেরকে ঝটপট সামনের সারির আসনে বসিয়ে দেওয়ায়, তারপর ম্যারাকটকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল স্ক্রিনের সামনে। বিশেষ এক কায়দায় কমিয়ে দেওয়া হল আলোর তেজ, তারপরেই ওঁকে সংকেতে বুঝিয়ে দেওয়া হল— এবার শুরু হোক চিন্তা প্রক্ষেপণ।

দারুণভাবে সেই কর্মটি করে গেলেন ম্যারাকট। ব্রেন বটে একখানা। প্রথমে দেখলাম, টেমস নদী থেকে রওনা হয়েছে আমাদের জাহাজ, সত্যিকারের আধুনিক লন্ডন শহরের ছবি দেখে গুঞ্জন ধ্বনিতে ঘর ভরিয়ে তুলল দর্শকবৃন্দ— যারা ভীষণ উদ্বেগে কাঠ হয়ে বসেছিল এতক্ষণ। তারপরেই দেখা গেল একটা মানচিত্র— কোন কোন পথ দিয়ে এগিয়েছে জাহাজ। তারপরেই দেখা গেল বিবিধ কলকবজা লাগানো ইস্পাত কক্ষ— দেখেই গুঞ্জন মারফত দর্শকরা বুঝিয়ে দিল, জিনিসটাকে তারা চিনতে পেরেছে। ফের দেখতে পেলাম আমাদের জলে নামবার অভিযান, পৌঁছেছি খাদের একদম কিনারায়। তারপরেই দেখা গেল বিশাল কলেবরের সেই দানবটাকে যে আমাদের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। দর্শকরা তাকে দেখেই ‘ম্যারাক্স! ম্যারাক্স!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। বুঝলাম, অতিকায় এবং নৃশংস দানবের সঙ্গে তাদের পূর্ব পরিচয় আছে। ভয় পায় বিলক্ষণ। আমাদের কাছি নিয়ে দানবটার টানাটানি পর্ব শুরু হতেই আতঙ্কের গুঞ্জন জাগ্রত হল বিরাট হল ঘরে। আতঙ্ক গুঞ্জন বেড়ে গেল কাছি ছিঁড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ইস্পাত কক্ষ তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। পরবর্তী আধঘণ্টায় যা দেখানো হয়ে গেল, তা মুখে বলতে গেলে পুরো একটা মাস সময় লাগত। ব্রেনের ছবি তথা মনের ছবি দেখানো সাঙ্গ হতেই সমবেত দর্শকরা সহানুভূতির গুঞ্জন ছড়িয়ে ঘিরে ধরল আমাদের, পিঠ চাপড়ে স্বাগতম জানাল। আমাদের হাজির করা হল জনাকয়েক দলপতির কাছে। দেখেশুনে বুঝলাম জ্ঞানবৃদ্ধ তাপসিক যারা, দলপতি হবার অধিকার আছে শুধু তাদেরই। জ্ঞানের জোরে বড়, গায়ের জোরে নয়। প্রত্যেকেই একই সামাজিক মাপকাঠির মানুষ, পোশাক পরিচ্ছদও একই রকমের। পুরুষদের শ্রীঅঙ্গে হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো গেরুয়া আলখাল্লা, কোমরে বেল্ট পায়ের উঁচু বুট কোনও সামুদ্রিক জীবের শক্ত চামড়া দিয়ে তৈরি। মেয়েদের পোশাকের ছাঁটকাট সুন্দর— সেকেলে স্টাইলে। লুটিয়ে পড়া পরিচ্ছদ গোলাপি, নীল, সবুজ রঙের, মুক্তো অথবা অস্বচ্ছ ঝিনুকের কারুকাজের ফলে বেশ নয়ন সুন্দর। বেশিরভাগ মেয়েদের লাবণ্য পৃথিবীর মেয়েদের রূপলাবণ্যের চেয়ে ঢের বেশি, বিশেষ করে একজনের। কিন্তু… জনসমক্ষে আমার এই ধারাবিবরণী পেশ করতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার তার মধ্যে মিশিয়ে ফেলছি কেন? যার কথা বলছিলাম, তার নাম মোনা, ম্যান্ডা-র একমাত্র কন্যা, প্রথমদিনের সেই পরিচয়ের মুহূর্তেই তার দু-চোখে যে প্রশংসা, সমবেদনা এবং মনপ্রাণ দিয়ে আমাদের দুর্দশা আর ভোগান্তি অনুভব করার ছাপ দেখেছি, তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছিল, কৃতজ্ঞতায় মন আমার টইটুম্বুর হয়ে গেছিল। সর্বসেরা এই লেডি সম্পর্কে বেশি কথা এখন আমি বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট বলা হবে— আমার সারা জীবনে খুবই জোরদার আর নতুন ধরনের একটা প্রভাব এসে পড়েছিল এর পর থেকেই। আমাদের এহেন বিয়োগান্তক পরিণতির মধ্যেও যে একটা মনোরম ভাব থেকে গেছে, তা বুঝতে পারছিলাম, যখন দেখছিলাম বিশেষ এক মহীয়সী মহিলার সঙ্গে হাত মুখ নেড়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন ম্যারাকট, আর একদল হাস্যমুখরা মেয়েদের মাঝে বিষমভাবে মূক অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে বিল স্ক্যানলান। ট্র্যাজেডির মধ্যে সে এক বিচিত্র কমেডি! মর্ত জগতে আমরা মৃত হয়ে যেতে পারি, কিন্তু পাতাল জগতে আমরা যে পরিমাণে অভিনন্দিত হয়েছিলাম গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারের পুরস্কার স্বরূপ, তাতেই ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে যাওয়ায় আমাদের মন মেজাজ প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল।

সেইদিনই একটু বেলার দিকে ম্যান্ডা আর অন্যান্য বন্ধুবর্গ আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল সুবিশাল ইমারতের নানান অংশ। সমুদ্রতলে সেই ইমারত এমনভাবে গেঁথে বসে গেছে যে তার ভেতরে ঢুকতে হয় ছাদের দরজা দিয়ে, সেখান থেকে অজস্র অলিগলি দিয়ে নেমে আসতে হয় একদম নিচের তলার মূল প্রবেশ পথের মস্ত ঘরটার মধ্যে। মেঝের ওপরেও চালানো হয়েছে বিস্তর খনন কাৰ্য, তাই দেখতে পেলাম সব দিকের অলিগলিই ঢালু হয়ে নেমে গেছে পৃথিবীর গর্ভে— পাতালে। বাতাস তৈরির মেশিন দেখানো হয়েছিল আমাদের, যে বাতাসকে পাম্পের সাহায্যে চালান করা হচ্ছে ইমারতের সর্বত্র। ম্যারাকট ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলেন, প্রশংসায় মুখর হয়েছিলেন অক্সিজেনের সঙ্গে নাইট্রোজেনকে মিশিয়ে দেওয়ার অভিনব যন্ত্রপাতি দেখে, অবাক হয়েছিলেন ছোটখাটো কলকবজার মধ্যে দিয়ে কীভাবে যাচ্ছে অন্যান্য গ্যাস, বাতাসের অন্যান্য উপাদান— আরগন, নিয়ন, ইত্যাদি বহুবিধ ব্যবস্থা প্রকরণ দেখে। সেসব গ্যাস এমনই যাদের নামটুকুই শুধু জেনেছে মর্তের মানুষ, তাদের হালচাল এখনও বুঝে ওঠেনি। সুপেয় জল পাতিত অর্থাৎ ডিসটিল করার প্রকরণ দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন। সুবিশাল বৈদ্যুতিক কলকবজা দেখে চক্ষু ছানাবড়া করে ফেলেছিলেন। এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক যন্ত্রপাতি— যা এতই জটিল আর সূক্ষ্ম যে বিশদ ব্যাপারটা মাথায় ঢোকাতে অক্ষম হয়েছি। আমি যেটুকু বুঝেছি চোখে দেখে আর জিভ দিয়ে চেখে, তা এই: বিপুল জটিল এই সব কলকবজার মধ্যে দিয়ে তরল, গ্যাসীয় উপাদানরা ছুটোছুটি করছে। তাপ, চাপ আর বিদ্যুৎ প্রবাহের মধ্যে দিয়ে এবং বানিয়ে দিচ্ছে ময়দা, চা, কফি অথবা সুপেয় সুরা।

একটা প্রতীতি সুস্পষ্টভাবে জাগ্রত হয়ে গেছিল আমার মনের মধ্যে এইসব এলাহি কাণ্ডকারখানা দেখবার পর। সমুদ্রের তলায় প্রবেশ ঘটার ব্যাপারটা এখানকার প্রাচীন মানুষরা অবধাবন করেছিল অনেক আগে থেকেই, প্রস্তুতিও নিয়েছিল সেইভাবে। জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই আটঘাট বাঁধা হয়ে গেছিল। বিশালকায় এই ইমারতটাকেই তো নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে জলতলে দিব্বি থেকে যেতে পারে। বিশাল বিশাল আধার, বানানো হয়েছে বাতাস, খাবার আর পানীয় জল সঞ্চয়ের পরিকল্পনা নিয়ে। আরও অনেক দরকারি জিনিস মজুদ রাখবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে নানাভাবে। সবই তৈরি হয়েছে দেওয়ালের মধ্যে ইমারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে। ঠিক একইভাবে নির্মিত হয়েছে বাইরে যাওয়ার দরজা, সিলিকা দিয়ে তৈরি মুখোশ আর গাত্রাবরণ, জল নিয়ন্ত্রণের বিশাল পাম্প। আসন্ন বিপর্যয়ের সংকেত বহু আগেই পেয়েছিল দূর অতীতের সেই বিপুল শক্তিধর মহামানবরা— যাদের এক হাত প্রসারিত ছিল মধ্য আমেরিকা পর্যন্ত, আর এক হাত মিশর পর্যন্ত— সেইসব জায়গাতেই রেখে গেছে তাদের কৃষ্টি আর সংস্কৃতির কিছু কিছু ছাপ— নিজেদের দেশটা কিন্তু তলিয়ে গেছে আটলান্টিকের অতলে। তাদেরই বংশধরেরা আজও রয়েছে সাগরের অতলের এই সাম্রাজ্যে, খুব সম্ভব অতটা মহীয়ান হতে না পেরে, বেশ কিছুটা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পতনের পথে গড়িয়ে গিয়ে, যা খুবই স্বাভাবিক, তারপরে অবশ্য স্খলন রোধ করে ধরে রাখতে পেরেছে দূর অতীতের প্রবুদ্ধ পূর্বপুরুষদের কিছুটা জ্ঞান আর বিজ্ঞান— নতুন করে তাতে সংযোজন করার মতো এনার্জি আর না থাকায়। যারা এখন থেকে গেছে, সেই উত্তর পুরুষদের মধ্যে অত্যাশ্চর্য শক্তি, বংশ পরম্পরায় পাওয়া বংশানু সংকেতবাহী অবস্থায়, কিন্তু নতুন করে সেই বিদ্যার বহরে সংযোজন করতে পারেনি কিছুই। আমার বিশ্বাস, এই যে জ্ঞান ম্যারাকট এখান থেকে আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন, একে কাজে লাগিয়ে তিনি অচিরেই জগৎজনের শীর্ষে পৌঁছে যাবেন। স্ক্যানলানের কিন্তু মাথা চলে বিদ্যুৎ গতিতে, যান্ত্রিক দক্ষতাও অবিশ্বাস্য— তাই কারিগরদের সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে যা পারছে, তা-ই শিখে নিচ্ছে। অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগে ইস্পাতের ঢোকবার সময়ে পকেটে করে এনেছিল একটা মাউথ অরগ্যান। পাতাল কারিগরদের জমিয়ে রেখে দিয়েছে সেই বাজনা দিয়ে। মোজার্ট সঙ্গীত শুনতে পেলে আমি আর ম্যারাকট খুশি হতাম। স্ক্যানলান কিন্তু মাতিয়ে রেখেছে সবাইকে ওর মার্কিনী গিটকিরি বাজিয়ে।

পুরো অট্টালিকাটা যে আমাদের দেখাশুনোর আওতার মধ্যে ছিল না, সে কথা আমি আগেই বলেছি। এ বিষয়ে আরও কিছু বিশদে আমি যেতে পারি। টানা লম্বা অলিন্দ পথ দেখেছিলাম সব সময়েই লোকজনের যাতায়াতে সরগরম। কিন্তু কিছুতেই আমাদেরকে সেদিকে নিয়ে যেত না আমাদের গাইডরা। খুবই স্বাভাবিক, এর ফলে বৃদ্ধি পেয়েছিল আমাদের কৌতূহল। এক সন্ধ্যায় ঠিক করলাম, নিজেরাই অভিযান চালাব সেদিকে। সরে পড়েছিলাম ঘর থেকে, চলে গেছিলাম অজানা সেই অঞ্চলে— যে সময়ে সেদিকে লোকজনের ভিড় থাকে কম। থাকে না বললেই চলে।

গলিপথ বেয়ে গিয়ে পৌঁছেছিলাম একটা খুব উঁচু খিলেনওলা দরজার সামনে— মনে হয়েছিল সেই দরজা আগাগোড়া সোনা দিয়ে তৈরি। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখেছিলাম রয়েছি একটা বিশাল ঘরের মধ্যে। চৌকোনা হল ঘর। এক-একদিকের মাপ দু-শো ফুট। চারদিকের দেওয়ালে জ্বলজ্বলে রং দিয়ে আঁকা অনেক অসাধারণ ছবি, ছবি ছাড়াও রয়েছে বিস্তর কিম্ভূত দর্শন প্রাণীদের মূর্তি। তাদের মাথার মুকুটগুলোর সাইজ প্রকাণ্ড— আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের রাজমুকুটের মতো। সুবিশাল সেই হলঘরের এক প্রান্তে বসা অবস্থায় রয়েছে বিরাট এক মূর্তি, বুদ্ধমূর্তির মতো পা মুড়ে, কিন্তু বুদ্ধমূর্তিতে যে প্রশান্তি থাকে, তার তিলমাত্র নেই। রয়েছে ঠিক তার উলটো মুখভাব— প্রচন্ড ক্রোধ যেন ফেটে ফেটে পড়ছে মুখাবয়বে। মুখবিবর ঈষৎ হাঁ করা। চোখের মধ্যে যেন অগ্নিকণা। লাল চোখ। আরও গনগনে দেখাচ্ছে ভেতরের দিকে দুটো বিদ্যুৎবাতি থাকার জন্যে। কোলের ওপর রয়েছে একটা উনুন, ছাইভরতি।

ম্যারাকট বললেন, ‘মোলোক! অথবা, বাল। ফিনিসিয়ানদের প্রাচীন দেবতা।’

প্রাচীন কার্থেজ-এর ছবি আমার মনের চোখে ভেসে উঠেছিল। বলেছিলাম ভীষণ বিস্ময়ে, ‘যাচ্চলে! এরা কি তাহলে নরবলি দেয়!’

উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল স্ক্যানলান, ‘আমাকে বলি দিতে এলে মজাটা টের পাইয়ে দেব।’

আমি বলেছিলাম, ‘সে চেষ্টা আর করে না বলেই মনে হয়। যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। দয়া আর করুণার মাহাত্ম্য বুঝেছে সেই শিক্ষার পর থেকেই।’

ম্যারাকট বললেন, ‘ঠিক।’ বলেই, ছাই ঘাঁটতে লাগলেন, ‘এ দেবতা বংশ পরম্পরার দেবতা। তবে এদের ধর্মবোধ এখন অনেক শান্ত। এ সবই রুটি পোড়ানো ছাই। একটা সময়ে কিন্তু— ’ চিন্তাভাবনায় বাধা পড়েছিল, পেছন দিক থেকে কঠিন কঠোর এক ধমকে। দেখেছিলাম, বেশ কয়েকজন এসে গেছে আমাদের পেছনে। মন্দিরের পুরুত। মাথায় উঁচু টুপি, গায়ে হলুদ বসন। তাদের রক্তচক্ষু আর ভয়াল মুখচ্ছবি দেখেই বুঝলাম, ‘বাল’ বিগ্রহের সামনে আর একটু হলেই বলি হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। একজন তো কোমরের খাপ থেকে ছোরা বের করে ফেলেছিল। রক্তজল করা চিৎকার ছেড়ে বাকি সবাই আমাদের খেদিয়ে দিল বেদীর সামনে থেকে।

তারস্বরে বলেছিল স্ক্যানলান, ‘গায়ে হাত দিলেই খতম করে দেব। এই সরে যা… হাত ছেড়ে দে?’

মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল, এই বুঝি তিনজনকেই আহুতি দেওয়া হবে রক্ত পিপাসু সেই বিগ্রহের সামনে। কোনও রকমে রেগে চন্ডাল মেকানিককে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলাম আমাদের থাকবার জায়গায়। তবে ম্যান্ডা আর অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের ভাবসাব দেখে বুঝলাম, আমাদের এই অভিযান তারা ভালো চোখে দেখেনি।

এই মন্দির ছাড়া ছিল আর একটা জায়গা। সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোনও রকম নিষেধের ঘেরাটোপ না থাকায়। অপ্রীতিকর অপ্রত্যাশিত কিছুই ঘটেনি সে জায়গায়। জায়গাটা আমাদের থাকবার জায়গা থেকে সঙ্গীদের জায়গায় যেতে গেলে যাতায়াতের পাশেই পড়ে। সেটা একটা ঘর, দেবালয়ের নিচের ঘর। ঘরের দেওয়ালে টেওয়ালে কোথাও কোনও কারুকাজ বা উৎকীর্ণ মূর্তি বা হরফ নেই। ঘরের প্রান্তে রয়েছে একটা হাতির দাঁতের মূর্তি— মহাকাল তাকে হলদেটে করে দিয়েছে। সে মূর্তি এক রমণীর, হাতে বর্শা, কাঁধে বসে একটা প্যাঁচা। ঘরের গার্জেন হিসেবে ছিল অতি বৃদ্ধ এক পুরুষ; বয়স তার যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মনে হয়েছিল, এই যে যাদের মধ্যে এসে পড়েছি, এদের সমগোত্রীয় নয় এই অতি বৃদ্ধ— অন্য প্রজাতির মানুষ, মন্দিরে যারা আছে তাদের চেয়ে কৃষ্টি সংস্কৃতিতে উন্নততর, আকৃতিতে বড়। আইভরি স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যখন স্থির দৃষ্টিতে মূর্তি দেখে যাচ্ছি, তখন ম্যারাকট আর আমার দু-জনেরই মনে হয়েছিল, এরকম মূর্তি আগেও যেন কোথায় দেখেছি।

অতিবৃদ্ধ বিপুলকায় সেই ব্যক্তি তখন বলেছিল, ‘থিয়া।’ সচমকে বলেছিলাম আমি, ‘আরে সর্বনাশ! এ যে দেখছি গ্রিক বলছে!’

‘থিয়া? এথেনা?’ ফের গ্রিক শব্দ ত্যাগ করেছিল অতিবৃদ্ধ।

নিঃসন্দেহে দেবী এথেনার কথা বলছে সেই বৃদ্ধ। ম্যারাকটের ওয়ান্ডারফুল ব্রেন বিবিধ জ্ঞানে সমৃদ্ধ থাকায় তৎক্ষণাৎ জেরা শুরু করে দিয়েছিলেন ধ্রুপদী গ্রিক ভাষায়— যার কিছুটা বোঝা গেছিল, কিছুটার উত্তর এসেছিল এমনই প্রাচীনতর সংলাপের মধ্যে দিয়ে যার মাথামুণ্ড কিস্‌সু বোঝা যায়নি। এতদ্‌সত্ত্বেও বেশ কিছু জ্ঞান আহরণ করতে পেরেছিলেন ম্যারাকট এবং আবছাভাবে আমাদের বোধগম্য হওয়ার মতো কিছু জ্ঞানও পরিবেশন করতে পেরেছিলেন।

সেইদিনই সন্ধ্যায় ক্লাসে লেকচার দেওয়ার ভঙ্গিমায় উঁচু গলায় আমাদের বলেছিলেন, ‘অত্যাশ্চর্য একটা প্রমাণ পাওয়া গেল। এতদিন যা স্রেফ কিংবদন্তী বলেই মনে হয়েছিল, তার যে একটা ভিত আছে, সত্যতা আছে, তা জানা গেল। সব কিংবদন্তীর মূলে একটা না একটা ঘটনা থাকে, কালপ্রবাহে তা বিকৃত অস্পষ্ট হয়ে আসে। হয় তো জানা আছে, অথবা আদৌ জানা নেই— (‘জানছেন কী করে?’ স্ক্যানলানের ফুটুনি)— আটলান্টিস দ্বীপ যখন ধ্বংস হয়ে যায় তখন একটা যুদ্ধ চলছিল আদিম গ্রিক আর আটলান্টিয়ানদের মধ্যে। সোলন এর বিবৃতির মধ্যে আছে সেই ঘটনার বর্ণনা— উনি জেনেছিলেন সাইস-এর পুরুতদের মুখে। ধরে নিতে পারি, সেই সময়ে আটলান্টিয়ানদের হাতে তখন বন্দি অবস্থায় ছিল কিছু গ্রিক কয়েদি, তাদের কেউ কেউ সেবা দিয়ে যেত মন্দিরে, এরাই সেখানে বহন করে নিয়ে এসেছিল স্ব-ধর্ম। এই যে বুড়োটার সঙ্গে আলাপ জমে গেল, আমার বিশ্বাস প্রাচীন সেই ধর্মের উপাসকদের বংশধর সে— এদের আরও অনেকের সঙ্গে পরে আমাদের আলাপ জমে যেতেও পারে।’

স্ক্যানলান বললে, ‘সেটা ভালো মনে করলেই ভালো। প্লাস্টার ভগবানকেই যদি পুজো করতে হয়, তাহলে সে লালচোখো আর কোলের ওপর কয়লার ছাই নিয়ে বসে থাকা দেবতা না হয়ে ফাইন একটা মেয়ে মানুষ হলেই ভালো।’

আমার মন্তব্য, ‘আপনার কপাল ভালো এসব কথা ওদের কানে পৌঁছোচ্ছে না। পৌঁছে গেলেই খ্রিস্টান শহীদ হয়ে যেতে হবে।’

‘দূর মশায়, এমন জাজ বাজাব, শুনে ঠান্ডা মেরে যাবে। মনে তো হয় আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে— আমি ছাড়া ওদের চলবেই না।’

তা বটে। ফুর্তিবাজ মানুষগুলোকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম ভালোভাবেই। মাঝে মধ্যে অবশ্য মন কেমন করত দেশের জন্যে। মনের চোখে দেখতে পেতাম চারদিকে প্রাঙ্গণ দিয়ে ঘেরা চতুর্ভুজ অক্সফোর্ড, অথবা হার্ভাড-এর অতিপ্রিয় চত্বর আর সুপ্রাচীন এলম বৃক্ষরাশি। সেই সময়টায় মনের এই দৃশ্যগুলোকে মনে হত বুঝি চাঁদের প্রকৃতি-সুন্দর প্রান্তর, আর ঠিক তখনই আবার সেই সব জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্যে ছটফটিয়ে উঠত মনটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *