অতল জলের শহর – ২

(২)

বেশ কিছুক্ষণ আমরা সকলেই থেকেছি একই রকম অনুভূতির মধ্যে। কিছুই আর করতে চাইনি, দেখতে চাইনি। চেয়েছি শুধু চুপচাপ বসে থেকে বিস্ময়কে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যাক। এসেছি কোথায়? এই পৃথিবীর অন্যতম বিরাট মহাসাগরের একদম নিম্ন কন্দরে। তারপরেই জানলায় জানলায় আলোর ছটার মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যাবলী দেখবার জন্যে সবাই ছুটে গেলাম জানলার সামনে।

আমরা এসে পড়েছি অ্যালজি অর্থাৎ শৈবালশ্রেণীর ওপর (ম্যারাকট বললেন— ‘কাটলারিয়া মালাটিফিডা’), যার হলুদ রঙের ফার্ন বা তালগাছের পাতার মতো অংশ দুলছে চোখের সামনে আমাদের চারপাশে, নড়ে সরে দুলে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রের কোনও এক স্রোতের টানে, ঠিক যেভাবে গ্রীষ্মের মৃদু পবনে দুলে দুলে ওঠে তালগাছের পাতা। আমাদের দৃষ্টিপথ আটকে দেওয়ার মতো নয় কোনওটাই, যদিও তাদের মস্ত চ্যাটালো পাতা, আলোর সামনে গভীর সোনালি বর্ণ ধারণ করে, দুলে দুলে উঠছে আমাদের দৃষ্টিপথের সামনে। এদের ওদিকে রয়েছে ঢালু মতো জায়গায় কালচে ধাতুমল-এর বস্তু, জায়গায় জায়গায় দল বেঁধে রয়েছে সুন্দর রঙিন প্রাণীরা হোলোথুরিয়ান, অ্যাসিডিয়ান, ইচিনি আর ইচিনোডার্ম— ইংলিশ বসন্ত ঋতুতে যেমন হায়াসিন্‌থ আর বাসন্তী পুষ্পবিশেষের সমারোহ দেখা যায় সেইভাবে। সাগরতলের এই পুষ্পরা বুঝি সজীব; কারও বর্ণ উজ্জ্বল লোহিত, কারও ঘন বেগুনি, কারও সূক্ষ্ম গোলাপি। কয়লাকালো পটভূমিকায় এরা গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে বিপুল পরিমাণে অবস্থান করছে। এখানে সেখানে কালচে পাথরের ফাঁক ফোকর থেকে বড় বড় স্পঞ্জ বেরিয়ে এসে দুলে দুলে উঠছে, আলোক বলয়ের মাঝখান দিয়ে মাঝে মাঝে সাঁৎ সাঁৎ করে ঠিকরে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বর্ণের বাহার দেখিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতন আমরা চেয়ে আছি এই পরিলোকের দিকে। ঠিক এই সময়ে একটা উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর নেমে এল নলের মধ্যে দিয়ে, ‘সাগরতল লাগছে কেমন? সব ঠিক তো? বেশি দেরি করবেন না। মিটারের মাত্রা নামছে, আমার ভালো ঠেকছে না। আরও বাতাস দেব কি? আর কিছু করতে পারি?’

প্রফুল্লস্বরে ম্যারাকট বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, সব ঠিক আছে। বেশিক্ষণ থাকব না। ভালোই রেখেছেন আমাদের। গুড নার্সিং! বসে আছি যেন বাড়ির বৈঠকখানায়। একটু পরেই আস্তে আস্তে সামনের দিকে নিয়ে যাবেন।’

আমরা এসে পড়েছি আলোকময় মীন মহাশয়দের অঞ্চলে। আমাদের আলো নিভিয়ে দিয়ে বেশ মজা পেলাম। নিঃসীম অন্ধকার। তমালকালো তমিস্রা। এমনই নিরেট আঁধার যে ঘণ্টাখানেক সেন্সিটিভ প্লেট ঝুলিয়ে রাখলেও অতিবেগুনি রশ্মির রেখা পর্যন্ত পড়বে না। এমন তমিস্রার মধ্যে দিয়েই দেখে গেলাম সাগরতলের স্বতঃদীপ্ত তৎপরতা। নিশুতি রাতে জাহাজের পোর্টহোল দিয়ে যে রকম আলো ঠিকরে যায়, যেন ঠিক সেইভাবে কালো মখমলের বুকে অবিরাম গতিতে সরে সরে যাচ্ছে অত্যুজ্জ্বল প্রভার ছোট্ট ছোট্ট কণিকা। আলোকময় দংষ্ট্রাল একটা মীন মহাশয় অতর্কিত আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ধেয়ে গেল জানলার সামনে দিয়ে। ঠিক যেন বাইবেলের কায়দায়। তারপরেই ধেয়ে এল সোনালি শুঙ্গ দেখিয়ে একটা মৎস্য। তার পেছন পেছন মাথায় আগুনের মতন পালকওলা আর একটা। যতদূর দৃষ্টি যায়, দেখতে পেলাম অত্যুজ্জ্বল বিন্দুসমূহ ঝলক মেরে যাচ্ছে কয়লাকালো আঁধারের মধ্যে, প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজ নিয়ে শশব্যস্ত, নিজের নিজের আলোয় পথ দেখে নিচ্ছে— ঠিক যেভাবে স্ট্র্যান্ডের চত্বরে থিয়েটারের সময়ে রাতের ট্যাক্সিগাড়িগুলো আলো জ্বালিয়ে ছুটে ছুটে যায়। একটু পরেই জ্বালিয়ে নিলাম নিজেদের আলো। সমুদ্রতলের বিবরণ খুঁটিয়ে লিখতে বসে গেলেন ডক্টর ম্যারাকট। বললেন, ‘অনেকটা নিচে নেমেছি বটে, কিন্তু আরও নিচে না নামলে উপপাতালিক স্তরে পৌঁছোনো যাবে না। সে জায়গা অবশ্য আমাদের একদম বাইরে। আরও লম্বা কাছি লাগিয়ে সে চেষ্টা আর একবার—’

খ্যাঁক করে উঠেছিল বিল, ‘থামুন তো!’

মুচকি হাসলেন ম্যারাকট, ‘গভীর সমুদ্রের গভীরতা সয়ে যাবে, স্ক্যানলান। এই শেষ নয়।’

‘গোল্লায় যান,’ বিড়বিড় করে বলেছিল বিল।

‘তখন কিন্তু মনে হবে বুঝি স্ট্র্যাটফোর্ড জাহাজের খোলে ঢুকে বসে আছেন— তার বেশি নয়। মিস্টার হেডলে, দেখেছেন নিশ্চয় এখানকার জমিতে ঝামাপাথর আর কালচে আগ্নেয়পাথর চাঁই চাঁই পড়ে রয়েছে। তারই মাঝ দিয়ে বেরিয়েছে জলজ উদ্ভিদ আর কাচের মতন স্পঞ্জ। এ থেকেই সুপ্রাচীন পাতালিক আগ্নেয় সমাবেশের আইডিয়াটা মাথায় আনতে পারেন। ফলে বহাল থাকছে আমার পূর্ব সিদ্ধান্ত— এই যে মধ্য মহাসাগরীয় ভূশিরা এর উৎপত্তি ঘটেছে অতীতের এক অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। জায়গাটার নাম দিলাম ‘ম্যারাকট ডিপ’— বলে, চোখ ঘুরিয়ে ওপরে তাকিয়ে চালিয়ে গেলেন— এ জায়গা আসলে একটা পাহাড়ের ঢাল। ‘ডিপ’ কতদূর গেছে, সেটা যাচাই করার জন্যে এই খাঁচাটাকে আস্তে আস্তে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া দরকার। তাহলেই দেখা যাবে, কী আছে সেখানে। আমার মনে হয়, দেখতে পাব ঢল নেমে গেছে আরও অতল জলের গভীর অঞ্চলে। এমন একটা এক্সপেরিমেন্ট করবার সময় এখন হয়েছে বলেই আমি মনে করি।’

আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, এক্সপেরিমেন্টটা হবে অতিশয় বিপজ্জনক। সরু কাছি কতক্ষণ টিকবে? এই খাঁচাকে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে? কিন্তু বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ করার সময়ে ম্যারাকটের কাছে বিপদ শব্দটা মোটেই আমল পায় না— সে বিপদ নিজের হোক, কি অন্যের হোক। তাই যখন দেখলাম, ইস্পাতের বাক্স একটু নড়তেই কাছিতে টান পড়ছে, সমুদ্রের আবর্জনা সরিয়ে অল্প অল্প অগ্রসর হতেই কাছির দম বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন আপনা থেকেই আমার দম আটকে এসেছিল, একই অবস্থা হয়েছিল বিল স্ক্যানলানেরও। টান টান হয়ে গিয়েও কাছি বুঝিয়ে দিল তার শক্তপোক্ত অবস্থা এবং গোটা ইস্পাতের বাক্সটাকে আস্তে আস্তে পিছনে নিয়ে গেল সাগরতল দিয়ে। হাতের চেটোয় কম্পাস রেখে হুকুমের পর হুকুম ছেড়ে গেলেন ম্যারাকট, মাঝে মাঝে সামনে বাধা পড়লে খাঁচাকে টেনে তুলে নিয়ে ফের নামিয়ে দিতে বললেন।

যেতে যেতে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন এইভাবে, ‘এই যে ক্ষারীয় আগ্নেয়শিলার মধ্যমহাসাগরীয় ভূশিরা, এটা লম্বায় হবে বড় জোর মাইল খানেক। যেখানে ডুব দিয়ে নেমে এসেছিলাম। হিসেব করে দেখেছি, সেখান থেকে পাতালিক অঞ্চলটা আছে পশ্চিমদিকে। এই গতিবেগে গেলে শীগগিরই পৌঁছে যাব সেখানে।’

নির্বিঘ্নে পিছলে গেলাম আগ্নেয় প্রান্তরের ওপর দিয়ে। চারপাশে দুলে দুলে উঠল সোনালি শৈবাল রাজ্য— প্রকৃতির হিরে-কাটিয়ে যে অনুপমভাবে গড়ে রেখেছেন সমুদ্রতল অপরূপ মণিমাণিক্য দিয়ে। আচমকা টেলিফোনের দিকে ধেয়ে গেলেন ডক্টর।

বললেন তারস্বরে, ‘থামান এখানে! যেখানে যেতে চাই, এসে গেছি সেখানে।’

আচমকা আমাদের সামনে ব্যাদিত মুখে উপস্থিত হয়েছে দানবিক ফাঁক। সে বড় ভয়ানক জায়গা, রাতের দুঃস্বপ্ন জাগানোর মতো জায়গা। কালচে আগ্নেয়শিলার খাড়াই খাদ সোজা নেমে গেছে অজানা অতলান্ত গভীরে। তাদের কিনারায় কিনারায় থুকথুক করছে প্রজ্বলন্ত শৈবাল পত্র— পৃথিবীর খাদের গায়ে যেমনটা দেখা যায়, কিন্তু এখানে এই দুলন্ত কেঁপে কেঁপে যাওয়া পত্রাবলীর মাঝ দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেবল খাদের কালচে চকচকে দেওয়াল। পাথুরে প্রাচীর বেঁকে গিয়ে সরে গেছে আমাদের দিক থেকে, খাদ যে কত গভীর তা আন্দাজি হিসেবেও আনা যাচ্ছে না, কেননা আমাদের জোরালো আলো নিচের নিকষ আঁধারে পথভ্রান্ত হয়েছে। সিগন্যাল দেওয়ার লুকাস ল্যাম্প ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল নিচের দিকে, অনেক নিচ পর্যন্ত, সোনালি আলোক বল্লম ধেয়ে গিয়েও অবশেষে হারিয়ে গেছিল ভয়াবহ খাদের শ্বাসরোধী তমিস্রায়।

চোখে মুখে বিপুল হর্ষ ফুটিয়ে তুলে সোল্লাসে বলেছিলেন ম্যারাকট— ‘ওয়ান্ডারফুল! এত নিচে এর আগে কেউ কখনও নামেনি। এমন গভীরতার সন্ধানই পায়নি। ল্যাড্রোন দ্বীপপুঞ্জের কাছে চ্যালেঞ্জার ডিপ তো মোটে ছাব্বিশ হাজার ফুট গভীর, ফিলিপাইন্স এর কাছে প্লাসট ডিপও মাত্র বত্রিশ হাজার ফুট, সবাইকে বোধহয় টেক্কা দিয়ে গেল ম্যারাকট ডিপ, অনেক অনেক আটলান্টিক অভিযাত্রীর নজরে পড়েনি আজ পর্যন্ত। নিঃসন্দেহে বলা যায়—’

কথাটা অসমাপ্ত রেখে বিষম বিস্ময়ে আগ্রহ প্রদীপ্ত চোখে চেয়ে থেকে চমকে উঠেছেন ম্যারাকট। তাঁর ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমরা যা দেখেছিলাম, তা আমাদের চমকিত চক্ষুর ভেতর দিয়ে গা হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

খাদের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত আমাদের আলোক সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে অতিকায় কোনও এক জানোয়ার। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে তার কালচে কুঁজো, মস্ত বপুর মন্থর অগ্রগতি উঠে আসছে একটু একটু করে। খাদের কিনারার দিকে একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছে অদ্ভুত অবয়বের প্যাডেল নাড়িয়ে নাড়িয়ে। আরও কাছে চলে আসতেই এসে গেল আলোকরশ্মির ফোকাসের আওতায়, দেখতে পেলাম তার গা হিম করা আকৃতি আরও সুস্পষ্টভাবে। বিরাট এই পশুর সন্ধান পায়নি বিজ্ঞান আজও, অথচ এর আকৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচিত অবয়বের কোথায় যেন একটা মিল আছে। বিশাল কাঁকড়ার চাইতে অনেক দীর্ঘ, বিশাল গলদা চিংড়ির চাইতে অনেক ছোট, একে দেখতে অনেকটা ফ্রেকিশ চিংড়ির মতন। দুটো রাক্ষুসে সাঁড়াশি ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে দু-দিকে, কালচে ম্যাড়মেড়ে ক্রুর দুই চক্ষুর সামনে লকলক করছে একজোড়া ষোলো ফুট লম্বা অ্যান্টেনা। কচ্ছপ বা কাঁকড়ার মতো বর্ম, দেহের বর্ণ হালকা হলুদ— আড়াআড়িভাবে প্রায় দশ ফুট, অ্যান্টেনা ছাড়া লম্বালম্বিভাবে কম করেও তিরিশ ফুট।

‘ওয়ান্ডারফুল!’ সোল্লাসে বললেন ম্যারাকট, সেই সঙ্গে মরিয়া কায়দার লেখা চালিয়ে গেলেন নোটবইতে— ‘উকুন চোখ, নমনীয় খোলস— কাঁকড়া বা চিংড়ির মতো, প্রজাতি অজানা। নাম দেওয়া যাক ফ্রামটেসিয়া ম্যারাকটি— নিশ্চয় হোক এই নাম, হবে না কেন? কেন?’

কানের কাছে চিৎকার করে বলেছিল বিল, ‘নাম না হয় আমি অনুমোদন করে দিলাম, কিন্তু আলোগুলো এখন নিভিয়ে দিলে হয় না?’

‘আর একটু, আর একটু… জালিকাকৃতি শিরা বিন্যাসের গঠনটা দেখে নিই? ব্যাস ব্যাস, হয়ে গেছে ওতেই হবে!’ বলেই খট করে টেনে দিলেন আলোর সুইচ। সঙ্গে সঙ্গে তমাল কালো তমিস্রায় ঢেকে গেল চারদিক, শুধু দেখা গেল চাঁদবিহীন রাতের আকাশে উল্কাদের ছুটোছুটির মতন আলোক কণিকাদের দৌড়াদৌড়ি।

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বিল বললে, ‘বিশ্বের জঘন্যতম জানোয়ার কোথাকার? হাত-পা ঠান্ডা করে দেওয়ার মতন কুৎসিত কদাকার!’

ম্যারাকটের মন্তব্য, ‘দেখতে কদাকার হতে পারে, স্বভাব চরিত্রও ভয়ানক হতে পারে, দানবিক দাঁড়ার পাল্লায় পড়লে আর রক্ষে নেই, তাও বুঝি। তবে কি জানেন, ইস্পাতের খাঁচার মধ্যে থেকে অনায়াসেই অতীব স্বচ্ছন্দে এবং বিলকুল নিরাপদে আমরা হারামজাদার ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে পারি।’

ম্যারাকটের মুখের কথা শেষ হতে না-হতেই ইস্পাত কক্ষের বাইরের দেওয়ালে যেন গাঁইতি আর শাবলের ঘা পড়ল। তারপরেই বেশ কিছুক্ষণ আঁচড়ানি, পরিশেষে আবার সেই ঠোক্কর। ভয়ানক টোকা। যেন নক করা হচ্ছে দরজায়।

সভয়ে বললে বিল স্ক্যানলান, ‘আরে গেল যা! হারামজাদা যে ভেতরে আসতে চায়। বাইরে “প্রবেশ নিষেধ” লিখে দেওয়া উচিত ছিল।’ মজার ঢঙে কথাগুলো বলে গেলেও কণ্ঠস্বরের কম্পন থেকে মালুম হয়ে গেল, কী পরিমাণ ভয় পেয়েছে বিল। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ঠকঠক করে কাঁপছিল আমার হাঁটু দুটোও। বাইরের ওই শয়তানের ক্রমাগত ইস্পাত কক্ষ আঁচড়ে যাওয়ার সময়ে, জানলাগুলোর সামনে দিয়ে তার বারংবার বিষম অবয়বের সরে সরে যাওয়ার সময়ে, যেন অদ্ভুত এই খোলসটাকে বাজিয়ে দেখে নিচ্ছে ভেতরকার শাঁস খেতে দরকার আর কতখানি হিম্মত।

ম্যারাকট বললেন, ‘আমাদের গায়ে টুসকি ফেলবার ক্ষমতাও নেই ওর!’ বললেন বটে, কিন্তু কথার সুরে মনের জোর খুব একটা দেখলাম না— ‘পিশাচটাকে পালটা ঠোক্কর মেরে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, বজ্জাতির জায়গা এটা নয়।’

বলেই, হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেনকে, ‘টেনে তুলুন বিশ থেকে তিরিশ ফুট।’ কয়েক সেকেন্ড পরেই উঠে এলাম লাভা প্রান্তর থেকে, বেশ দুলতে লাগলাম স্থির জলের মধ্যে। ভীষণাকৃতি জানোয়ারটা দেখলাম ভয়ানক নাছোড়বান্দা। একটু পরেই ফের টের পেলাম কর্কশ কঠোর দাঁড়া বুলিয়ে টোকা মেরে যাচ্ছে ইস্পাত কক্ষের সব দিকে। এই রকম একটা ভয়ানক সাক্ষাৎ মৃত্যুর এত কাছে থেকে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। বিশাল বিপুল আর ভয়ানক শক্ত ওই দাঁড়া যদি জানলার কাচে টোকা দিতে শুরু করে, তাহলেই তো গেছি। কাচের ক্ষমতা নেই ওই ইস্পাত কঠিন দাঁড়ার ঠোক্কর থেকে নিজেকে আস্ত রাখার। একই ভীতি যে সঞ্চারমান প্রত্যেকেরই মনের মধ্যে তা মালুম হয়ে গেল মুখাকৃতি দেখেই।

আর তারপরেই উপস্থিত হল এর চাইতেও বিপজ্জনক আর অপ্রত্যাশিত একটা আপদ। দেওয়ালের টোকা বন্ধ হয়েছে, শুরু হয়েছে ছাদে, গোটা ঘরটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলে দুলে উঠছে ছন্দে ছন্দে।

চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল আমার গলা চিরে, ‘কী সর্বনাশ! কাছি ধরে টানছে যে! ছিঁড়ে যাবে এক্ষুনি!’

বিল স্ক্যানলান বললে মিষ্টি মিষ্টি শক্ত গলায়, ‘ঢের হয়েছে। এবার বাড়ি ফেরা যাক।’

সঙ্গে সঙ্গে চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন ম্যারাকট, ‘যাচ্চলে। কাজ তো এখনও শেষ হয়নি। সবে তো অর্ধেক হল! ডিপ-এর কিনারাটুকু শুধু দেখা হল। চওড়ায় কতখানি, সেটা তো দেখা দরকার। অন্য দিকটায় পৌঁছোই, তারপর ওঠা যাবে ওপরে।’ বলেই টিউবের মধ্যে দিয়ে হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেনকে, ‘ক্যাপ্টেন, সব ঠিক আছে। দু-নট স্পিডে খাঁচা নিয়ে যান— যতক্ষণ না থামতে বলি।’

পাতাল খাদের কিনারা বরাবর ধীরগতিতে এগিয়ে গেল আমাদের খাঁচা। কুচকুচে কালো তমিস্রার আবরণে থেকে আক্রমণ থেকে যখন পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি, তখন জ্বালিয়ে দেওয়া হল সব ক-টা আলো। একটা পোর্টহোল পুরোপুরি ঢেকে গেছে সম্ভবত বাইরের ওই মূর্তিমান আতঙ্কের নিম্ন উদরের চাপে। মস্তক আর সাঁড়াশি নিশ্চয় খুটখাট কাজ করে চলেছে মাথার ওপর দিকে। গোটা ঘরটা রয়েছে দোদুল্যমান অবস্থায় গির্জের ঘণ্টার মতো। জানোয়ারটার গায়ের জোর নিশ্চয় অপরিসীম। জলপৃষ্ঠের পাঁচ মাইল নিচে এসে মরলোকের কোনও বাসিন্দা এমন বিপদে কখনও পড়েনি। কালান্তক সেই আতঙ্ক রয়েছে ঠিক মাথার ওপর। দুলুনি একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। কাছিতে ঘন ঘন টান পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে বিষম চেঁচানি শুরু করেছেন ক্যাপ্টেন মশায় জাহাজে বসে, ইস্পাত খাঁচায় বসে তা শুনতে পাচ্ছি। বিষম নৈরাশ্যে দু-হাত শূন্যে তুলে লাফিয়ে উঠলেন ভয়ানক উত্তেজিত ম্যারাকট। খাঁচার মধ্যে থেকেও টের পেলাম একটু একটু করে ছিঁড়ছে ইস্পাত দিয়ে মজবুত কাছি। তারপরেই তলিয়ে যেতে লাগলাম নিতল খাদের গভীরে।

ম্যারাকট চেঁচিয়ে উঠলেন তারস্বরে।

‘কাছি ছিঁড়ে গেছে! আর কিছু দরকার নেই! মরণ সুনিশ্চিত প্রত্যেকের!’ বলছেন আর টেলিফোনের তার খামচে ধরছেন, ‘বিদায়, ক্যাপ্টেন, বিদায় জানাচ্ছি সব্বাইকে।’

পৃথিবীর মানুষদের কাছে এই তাঁর শেষ কথা।

পতন কিন্তু খুব একটা দ্রুত হল না, যা ভাবছেন, তা নয়। থাকতে পারে খাঁচাসমেত নিজেদের ওজন, কিন্তু পদার্থের প্লবতা ধর্ম অনুযায়ী আমরা নেমে যেতে লাগলাম একটু একটু করে— খাঁচা তো নিরেট নয়, ফাঁপা। হারামজাদা যে বিকট জানোয়ারটার জন্যে আমাদের এহেন হাল, সে কিন্তু সমানে আঁচড় আর ঠোক্কর দিয়ে চললো খাঁচা-খোলসের গায়ে। তারপরেই চক্রাকারে গতিশীল অবস্থায় মসৃণভাবে খাঁচা নেমে গেল খাদের নিতল অঞ্চল অভিমুখে। মিনিট পাঁচেকে মনে হয়েছিল যেন ঘণ্টাখানেক, তারপরেই পলকা সুতোর মতন পট করে ছিঁড়ে গেল টেলিফোনের তার। একই সময়ে ছিন্ন হল আমাদের বাতাসের নল। ফুটো দিয়ে হুড় হুড় করে ঢুকতে লাগল নোনা জল। চটপটে পটু হাতে দুটো নলকেই দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল বিল স্ক্যানলান। তাতেই বন্ধ হল জল ঢোকা। একই সঙ্গে হাত চালিয়ে ডক্টর খুলে দিলেন চেপে রাখা বাতাসের টিউব— হুস হুস করে বেরিয়ে এল বাতাস। তার ছিন্ন হওয়ার সময়ে আলো নিভে গেছিল। ওই অন্ধকারের মধ্যেই হাত চালিয়ে ড্রাই ব্যাটারিতে তার জুড়ে দিলেন ডক্টর, যার ফলে আলো জ্বলে উঠল সিলিং-এ।

বললেন শুষ্ক হেসে, ‘এতেই চলে যাবে দিন সাতেক। মরবার সময়ে আর কিছু না পাই, আলো তো পাব।’ এই পর্যন্ত বলেই মাথা নাড়লেন খুবই বিষন্নভাবে। পরক্ষণেই দেখলাম চোখে মুখে ফুটে উঠেছে স্নিগ্ধ কোমল হাসির ছটা, ‘আমার না-হয় বয়স হয়েছে, এই পৃথিবীতে আমার করণীয় অনেক কাজ করে গেলাম। পরিতাপ রইল শুধু একটা জায়গায়— আপনাদের দু-জনকে আমার পথের পথিক না করলেই পারতাম। ইয়ংম্যান— দু-জনেই। ঝুঁকিটা একলা নেওয়া উচিত ছিল।’

আমি ওঁর অনুতাপ কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে জোরের সঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়েছিলাম। মুখে কথা বলবার মতো অবস্থা ছিল না। বিল স্ক্যানলান-এর মুখেও কোনও কথা জোগালো না। নেমে যেতে লাগলাম আস্তে আস্তে, কতটা নিচে নামছি, তা বুঝতে পারছি জানলাগুলোর সামনে আঁধার কালো মাছেদের সাঁ সাঁ করে ওপরদিকে উঠে যাওয়া দেখে। ঠিক যেন নিজেরাই ধেয়ে যাচ্ছে ওপরদিকে, আমরা যে তলিয়ে যাচ্ছি, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তখনও দুলে দুলে যাচ্ছে গোটা ইস্পাত কক্ষ, এমনভাবে দুলতে থাকলে ইস্পাত কক্ষ একদিকে হেলে পাশ ফিরতে পারে, অথবা একেবারেই উল্টে গিয়ে মাথা নিচে পা ওপরে করে দিতে পারে, অথবা কপালক্রমে আমাদের নিজস্ব ওজন সেটি হতে দেয়নি, ভারসাম্য ঠিক রেখে দিয়েছিল। ব্যাথিমিটারের দিকে চক্ষু চালনা করে দেখলাম, পৌঁছে গেছি প্রায় এক মাইল গভীরতায়।

এমন সময়ে যৎকিঞ্চিৎ আত্মপ্রসাদের সুরে ম্যারাকট বললেন, ‘দেখলেন তো, যা বলেছিলাম, ঠিক তা-ই। সমুদ্রবিদ্যা সমিতিতে আমার লেখা আমার প্রবন্ধটা নিশ্চয় পড়া আছে আপনাদের। বিষয়টা ছিল জলের গভীরতার সঙ্গে জলের চাপের সম্পর্ক নিয়ে। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন গিসেন-এর বালো। তাঁর মুখের মতো জবাব দেওয়ার সুযোগ যদি পেতাম…!’

ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল মেকানিক বিল স্ক্যানলান, ‘যাচ্চলে! আমি ভাবছি ফিলাডেলফিয়ার এক খুদে রমণীর কথা যে কিনা কেঁদে ভাসিয়ে দেবে বিল পটল তুলেছে শুনলে। আপনার ওই চৌকস মগজ পণ্ডিতের থোড়াই কেয়ার করি আমি।

আমি ওর হাতে হাত রেখে বলেছিলাম, ‘আসা উচিত হয়নি আপনার।’

‘দূর মশায় না এলে কাঁচকলা কী কাজটা করতাম? এসেছি একটা কাজের কাজ করতে!’

‘আর কতক্ষণ?’ একটু থেমে জিজ্ঞেস করেছিলাম ডক্টরকে। উনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘সাগরের সত্যিকারের তলদেশ দেখতে এখনও অনেক দেরি বলেই তো মনে হচ্ছে। নলের মধ্যে বাতাস যা আছে, তাতে প্রায় একটা দিন চলে যাবে। সমস্যাটা হচ্ছে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া আবর্জনাদের নিয়ে। কার্বন ডাই অক্সাইডের খপ্পর থেকে যদি রেহাই পাওয়া যেত—’

‘সেটা অসম্ভব।’

‘খাঁটি অক্সিজেনের টিউব আছে একটা। এনেছিলাম হঠাৎ দুর্গতির কথা ভেবে। তা থেকেই অল্প অল্প করে নিয়ে অনেকক্ষণ চালানো যাবে। দেখতেই পাচ্ছেন, নেমে এসেছি দু-মাইলেরও বেশি।’

‘টিকিয়ে রাখার দরকার কী আমাদের? ঝটপট মরে গেলেই তো ল্যাটা চুকে যায়!’

ম্যারাকট বললে, ‘যাচ্চলে! তাহলে তো অতিশয় ওয়ান্ডারফুল দৃশ্যটাই আর দেখা হবে না— সে দৃশ্য এমনই যা মর্তের মানুষ কখনও দেখেনি। অমন কাজ করা মানে বিজ্ঞানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যা দেখব, তা লিখে রাখতে হবে। সে লেখা যদি আমাদের সঙ্গে সাগরের কবরে যায়, তাহলেও লেখা থামানো চলবে না।’

‘তা-ই হোক,’ সোল্লাসে বললে বিল স্ক্যানলান।

সোফার কিনারা কষে আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম তিনজনে, জানলার সামনে দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধেয়ে যেতে লাগল ওপর দিকে, যার মানে, আমরা আরও অতলে তলিয়ে যাচ্ছি।

ম্যারাকট হৃষ্ট স্বরে বললেন, ‘আসা গেল তিন মাইল। মিস্টার হেডলে, অক্সিজেনের টিউব খোলবার এবার কিন্তু সময় হয়েছে।’ বলে, একটু শুষ্ক হাসি হাসলেন, ‘ম্যারাকট ডিপ-এর মাপ নেওয়ার সময়ও হয়েছে। ক্যাপ্টেন হোয়ি এই খবর যখন পৌঁছে দেবেন মর্তের পণ্ডিতদের কাছে, তখন তারা বলতে বাধ্য হবে— ম্যারাকট মরেও নিজের মনুমেন্ট বানিয়ে গেল।’

এরপর নিঃশব্দে বাসে বসে দেখলাম, কাঁটা পৌঁছে গেল চার মাইলের গভীরতায়। একবার ভারি কিছুতে ধাক্কা লাগতেই আর একটু হলে উল্টে যেতাম। হয় কোনও বড় মাছের গায়ে, নয়তো খাদ থেকে, বেরিয়ে থাকা কোনও পাথরে ধাক্কা মেরেছে ইস্পাত কক্ষ। খাদের যেন শেষ নেই। ইস্পাত-কক্ষ ঘুরে ঘুরে নেমেই চলেছে কালচে সবুজ আবর্জনার মধ্যে দিয়ে। ডায়ালে দেখা গেল, নেমেছি পঁচিশ হাজার ফুট নিচে।

ম্যারাকট বললেন, ‘যাত্রা শেষ হতে চলেছে। এখানকার সবচেয়ে গভীরতা ছাব্বিশ হাজার সাতশো ফুট বলেই জানা গেছিল আগের এক রেকর্ড অনুযায়ী। মিনিট কয়েকের মধ্যেই জানা যাবে, ভাগ্য আমাদের নিয়ে এলো কোথায়। ধাক্কার চোটে অক্কা পেতেও পারি। অথবা—’

ঠিক তখনই তলদেশ স্পর্শ করেছিল ইস্পাত কক্ষ। ঠিক যেন বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল জননী আটলান্টিকের গভীরতম অঞ্চলে। নমনীয় পুরু স্তূপের ওপর অবতরণ ঘটায় চোট লাগল না একদম— ঝাঁকুনি লাগল না একটুও। বসে রইলাম যে যার সোফায় একইভাবে। বেশ বুঝলাম, একটু একটু দুলছে ইস্পাতকক্ষ। ঠেলে বেরিয়ে আসা কোনও পাথরের ওপর জমে থাকা আবর্জনা-কাদায় নিশ্চয় আটকে গিয়ে টলে টলে উঠছে। এ রকমভাবে দুলতে থাকলে ফের গড়িয়ে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেরকম কিছু ঘটল না। দুলুনি আস্তে আস্তে থেমে গেল। একটা পোর্ট হোল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবিস্ময় চিৎকার ছাড়লেন ম্যারাকট এবং ঝটপট নিভিয়ে দিলেন বিদ্যুৎবাতি।

কী আশ্চর্য! তা সত্ত্বেও সবই দেখতে পেলাম স্পষ্টভাবে। বাইরে বিরাজ করছে ফিকে কুয়াশাসম আলোক প্রভা— ঠিক যেন শীতের সকাল। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলাম অদ্ভুত দৃশ্যটার দিকে। নিজেদের আলোর সাহায্য ছাড়াই দেখতে পেলাম সবদিকের জানলা দিয়ে কয়েকশো গজ দূর পর্যন্ত। অসম্ভব, কল্পনাতীত, কিন্তু চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। আলোকময় হয়ে রয়েছে মহাসমুদ্রের একদম নিচের মেঝে।

মিনিট দুয়েক আমরা হতভম্ব হয়ে শুধু চেয়েছিলাম— মুখ দিয়ে বাক্য সরেনি। তার পরেই সোল্লাসে বলেছিলেন ম্যারাকট, ‘হবেই তো! আগেই তো ভেবে রেখেছিলাম, দেখব এমন দৃশ্য। আলোকময় কাদা! অযুত বছর ধরে যা পচেছে, তা থেকে ফসফরাসের দ্যুতি বেরোচ্ছে! আহারে! এমন দৃশ্য স্বচক্ষে দর্শন করেও বাইরের দুনিয়ায় সে সংবাদ পাঠাতে পারছি না।’

আমি বলেছিলাম, ‘আধটন রেডিয়ো লেরিয়ান জেলি চেঁছে তুলেও কিন্তু এরকম দ্যুতি দেখা যায়নি— গভীর সমুদ্রের সিলিকা কঙ্কালদের গা থেকে দ্যুতি তো বেরোয়— কিন্তু এমনটা দেখলাম এই প্রথম।’

‘এই আলো এতখানি সমুদ্রের জল ঠেলে ওপর পর্যন্ত পৌঁছাতে কি পারে? তাছাড়া, আধটন থেকে কতটুকু আশা করা যায়? এখানে যে দেখা যাচ্ছে, যতদূর দু-চোখ যায় শুধু পচা পাঁক। দেখুন, দেখুন,’ সে কী উল্লাস ম্যারাকটের, ‘মর্তের মাটিতে যেমন গরু ছাগল মোষ চরে বেড়ায়, সমুদ্রের তলার জমিতে তেমনি অতল সমুদ্রের প্রাণীরা দিব্বি চরে বেড়াচ্ছে! ঠিক যেন মাঠে ঘাস খাচ্ছে!’

কালচে রঙের মস্ত মাছের একটা ঝাঁক আস্তে আস্তে বিশাল চ্যাপটা বপু নিয়ে এগিয়ে এল আমাদের দিকে স্পঞ্জের মতো সমুদ্রতলের বিবিধ বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে, আস্তে আস্তে লেজ নেড়ে নেড়ে সরে গেল তফাতে। তারপরেই এল একটা বিশাল লাল জীব, সমুদ্রের নির্বোধ গাভীর মতন, পোর্টহোলের সামনের আবর্জনা-কাদা চুষে নিয়ে সরে গেল তফাতে। এই রকম গবেট চেহারার আরও অনেক সমুদ্রবাসীদের দেখলাম আশপাশে, মাঝে মাঝে মাথা তুলে চেয়ে আছে হঠাৎ নেমে আসা অদ্ভুতাকৃতির এই ইস্পাত কক্ষের দিকে।

ম্যারাকটের প্রশংসা না করে পারছি না। ইস্পাতকক্ষের ভেতরকার অমন বদ আবহের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যুর সন্নিকটে থেকে বিজ্ঞানের পূজারী হয়ে রয়েছেন বিষম উল্লসিত মুখাবয়ব নিয়ে। ঝাঁ ঝাঁ করে লিখে যাচ্ছেন। নোটবুকের পাতায় পাতায় চোখে যা-যা দেখছেন, সে সবের নিখুঁত বিবরণ। উনি যা করছেন, তা সঠিক, আমি কিন্তু নিতান্ত বেঠিকভাবে দর্শনের অভিজ্ঞতাকে জমিয়ে রেখে দিলাম মগজের মধ্যে। তা সত্ত্বেও, যা দেখেছি, তা জীবনে ভুলব না। সমুদ্রের একদম নিচের প্রান্তরে থাকে লালচে কাদামাটি। কিন্তু এখানে দেখছি বহুদূরব্যাপী ধূসর প্রান্ত— যতদূর দু-চোখ যায়, ততদূর। প্রান্তর কিন্তু মসৃণ নয়, রয়েছে অসংখ্য গোলমতো টিলা— যে রকম একটা টিলার ওপর নেমে পড়েছি আমরা— প্রত্যেকটা টিলা থেকে ঠিকরে যাচ্ছে ভৌতিক দ্যুতি। ছোট ছোট এই টিলাদের মাঝ-মধ্যে দিয়ে খেলে খেলে যাচ্ছে অদ্ভুত মীন মহাশয়দের বিশাল বিশাল দঙ্গল— মেঘের মতো, যাদের বেশির ভাগ মর্তের বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা, যাদের গা থেকে ঠিকরে যাচ্ছে রকমারি রঙের দ্যুতি, বেশির ভাগই অবশ্য কালো আর লাল। অবদমিত উত্তেজনা নিয়ে ম্যারাকট তাদের অবলোকন করছেন আর হাই স্পিডে খুঁটিনাটি লিখতে লিখতে যাচ্ছেন।

বাতাস বদ হয়ে এসেছে অতি মাত্রায়, আর একটু অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে প্রাণগুলোকে ধরে রাখতে হল দেহপিঞ্জরের মধ্যে। আশ্চর্যের বিষয়, খুব খিদে পেয়েছিল। এই সময়ে রুটি মাংস মাখন পেটে চালান করলাম হুইস্কি আর জল দিয়ে। দূরদর্শী ম্যারাকট সবই এনেছিলেন যথেষ্ট পরিমাণে। চাঙ্গা হয়ে পোর্টহোলের সামনে বসে যখন ভাবছি, আহারে, এই সময়ে একটা সিগারেট পেলে মন্দ হত না— ঠিক তখন আমার চোখ আটকে গেল এমন একটা ব্যাপারে যা চিন্তার তুফান তুলে দিল মনের মধ্যে— সেই সঙ্গে অনেক অদ্ভুত কিছুর সম্ভাবনা।

আগেই বলেছি, ঢেউ খেলে যাওয়া বিশাল প্রান্তরের মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল অসংখ্য গোলমতো টিলা। বিশেষ একটা ছিল আমার পোর্টহোল থেকে তিরিশ ফুটের মধ্যে। গায়ে রয়েছে অদ্ভুত কতকগুলো দাগ। ভালো করে তাকাতে গিয়ে দেখলাম, দাগগুলোর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে একইভাবে বারবার— শেষ পর্যন্ত চলে গেছে গোল টিলার কিনারা পর্যন্ত— তারপর আর দেখা যাচ্ছে না— রয়েছে দৃষ্টিপথের আড়ালে। মৃত্যুর সামনাসামনি এসে গেলে মাথা খেলে না, এমন কথা আমি হামেশাই শুনি। সেদিন কিন্তু অদ্ভুত দাগগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল— আরে! এ যে বাড়ির কার্নিশ! নানা রকম মূর্তি বসানো এই কার্নিশ তো এক সময়ে তৈরি হয়েছে মানুষেরই হাতে। ম্যারাকট দৌড়ে এলেন আমার পোর্টহোলের সামনে, ছুটে এল স্ক্যানলানও। বিষম বিস্ময়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইলেন মনুষ্যকীর্তির সর্ববিদ্যমান স্বাক্ষরের দিকে।

স্ক্যানলান বলেছিল সল্লাসে, ‘কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি খোদাই করা কারুকাজ! বাড়ির ছাদের আলসে! তাহলে আশপাশে যা দেখছি, সবগুলোই বাড়ি— যাচ্চলে! এ কী কাণ্ড!’

ম্যারাকট বললেন, ‘সত্যিই বটে। এসে পড়েছি এক প্রাচীন শহরে। ভূবিজ্ঞান বলে, সমুদ্র এক সময়ে মহাদেশ ছিল, মহাদেশ ছিল সমুদ্র। কিন্তু আটলান্টিকের জায়গায় এককালে যে একটা মহাদেশ ছিল, এ তত্ত্ব আমি কস্মিনকালেও বিশ্বাস করিনি। প্লেটো তাহলে ঠিকই বলেছেন। মিশরীয়দের গুজবে তাহলে সত্যি আছে। এই যে আগ্নেয় অঞ্চল এতক্ষণ দেখে এলাম এ সবই ভূকম্পের ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল।’

আমি বললাম, ‘গম্বুজগুলোর মধ্যে একভাব দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট— একটা নিয়ম নিষ্ঠা— মাপ করা পদ্ধতি। আলাদা আলাদা বাড়ি নয়। মস্ত একটা অট্টালিকার ওপরকার অনেকগুলো গম্বুজ— ছাদের ওপরকার কারুকাজ।’

স্ক্যানলান বললে, ‘ঠিক বলেছেন। চারকোণে রয়েছে চারটে বড় গম্বুজ— এক এক দিকের দুটো বড় গম্বুজের মাঝখানে একটা করে ছোট গম্বুজ। বিরাট একটা বাড়ি-ই বটে, কপাল মন্দ— সমস্তটা দেখতে পাচ্ছি না! গোটা একটা কারখানাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় ভেতরে! তবুও জায়গা থেকে যাবে!’

ম্যারাকট বললেন, ‘ওপর থেকে ক্রমাগত আবর্জনা পড়ার ফলে ছাদ পর্যন্ত ঢেকে গেছে। অথচ, নষ্ট হয়ে যায়নি। গভীর জলের টেম্পারেচার ৩২ ডিগ্রী ফারেনহাইটের একটু ওপরে আটকে থাকে। কিছুই নষ্ট হয় না সেই কারণেই। কী আশ্চর্য! কার্নিশের নিচের ওই দাগানো জায়গাগুলো তো কারুকার্য নয়, উৎকীর্ণ লিপি!’

ঠিকই বলেছেন ম্যারাকট। একই প্রতীক বারে বারে দেখা যাচ্ছে নানা জায়গায়। নিশ্চয় কোনও প্রাচীন হরফ। লিপি। উনিই বলে গেলেন বিষম উত্তেজিত গলায়, ‘ফিনিসিয়ান প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আমার কিছু পড়াশুনো আছে। যা দেখছি, তার কিছু না কিছু মানে আছেই। প্রতীকগুলোকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দেখছি, প্রাচীন যুগের ডুবে যাওয়া এক শহর— এই মহাজ্ঞান সঞ্চয় করে মরতে চলেছি তিনজনে। বিজ্ঞানের বই শেষ হোক এইখানেই, আর তো কিছু জানার নেই। এখন যত তাড়াতাড়ি পারি মরা যাক।’

সেই মুহূর্তটার বেশি বিলম্বও আর নেই। বদ্ধ বাতাস দূষিত হয়ে গেছে। সে বড় ভয়ানক অবস্থা। কার্বন উপাদানে ভারী হয়ে যাওয়ায় সেই চাপ ঠেলে অক্সিজেন নিজের পথ করে নিতে পারছে না। বেগ পাচ্ছে। টাটকা বাতাস যেন গিলে খেতে হচ্ছে, সোফার ওপর দাঁড়িয়ে গিয়ে, কিন্তু পায়ের দিক থেকে দুর্গন্ধময় বাষ্প একটু একটু করে উঠে আসছে ওপর দিকে। ডক্টর ম্যারাকট হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিমায় দু-হাত বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বসলেন। দুর্গন্ধময় বাম্প স্ক্যানলানকে প্রায় মেরে এনেছে, নেতিয়ে পড়েছে মেঝের ওপর। আমার নিজের মাথা বনবন করে ঘুরছে বুকের ওপর, অসহ্য চাপ অনুভব করছি। চোখ মুদে ফেলেছি, জ্ঞান লোপ পেতে চলেছে খুবই তাড়াতাড়ি। তারপর একবার চোখ খুলেছিলাম শেষবারের মতো এই পৃথিবীটাকে দেখে নেওয়ার জন্যে, আর তখনই টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম তারস্বরে।

পোর্টহোলের মধ্যে দিয়ে চেয়ে আছে একটা মানব মুখ!

দুঃস্বপ্ন নাকি? ম্যারাকটের দু-কাঁধ খামচে ধরে সবেগে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলাম। সোজা হয়ে বসে ফ্যালফ্যাল করে সবিস্ময়ে নির্বাক অবস্থায় প্রেতচ্ছায়ার দিকে উনি চেয়েছিলেন। উনি যখন দেখতে পেয়েছেন, তাহলে আমি যা দেখেছি, তা মনোবিকার নয়। ব্রেন বিগড়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়। মুখটা লম্বাটে আর শীর্ণ, গাঢ় রঙের, চিবুকে ছোট্ট ছুঁচোলো একটা দাড়ি, ঝকঝকে সঞ্চারমান দুটো চোখ চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে আমাদের বেহাল দুর্গতির প্রতিটি খুঁটিনাটি। বিষম বিস্ময়ের বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে সেই মানুষ মুখাবয়বে। ঘরের আলো তখন জ্বলছে পুরো মাত্রায়, সেই আলোয় নিশ্চয় দেখা যাচ্ছে সুস্পষ্টভাবে ঘরের খুঁটিনাটি, একজন মেঝেতে এলিয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছে, জ্ঞান হারিয়েছে, বাকি দু-জন মৃত্যুর পথে পা দিয়ে মুখাবয়ব বিষম বিকৃত করে চেয়ে আছে— টাটকা বাতাসের অভাবে খাবি খাচ্ছে। দু-জনেই গলায় হাত রেখে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছি— সময় ফুরিয়ে আসছে, মৃত্যুর আর দেরি নেই। লোকটা হাত নেড়ে কী একটা ইঙ্গিত করে সাঁৎ করে সরে গেল জানলার সামনে থেকে।

‘পালিয়ে গেল!’ ভাঙা গলায় বললেন ম্যারাকট।

‘লোকজন ডাকতে গেল। স্ক্যানলানকে সোফায় শুইয়ে দেওয়া যাক। মেঝেতে শুয়ে মরবে কেন।’

দু-জনে মিলে টেনে হিঁচড়ে মেকানিক বিল স্ক্যানলানকে তুলে আনলাম সোফার ওপর— হেলিয়ে শুইয়ে রাখলাম মাথা। মুখ তার বর্ণহীন। প্রলাপ বকছে। নাড়ি কিন্তু চলছে।

ভাঙা গলায় বলেছিলাম, ‘আশা আছে এখনও।’

‘পাগলের মতো যা তা কী বকছেন!’ চিৎকার করে উঠেছিলেন ম্যারাকট, ‘সমুদ্রের একদম তলায় মানুষ বেঁচে থাকে নাকি? বাস করতে পারে? নিঃশ্বাস নেবে কী করে? আমরা দলগতভাবে মরীচিকা দর্শন করছি— ভ্রান্তি রোগে ভুগছি। মাই ইয়ং ফ্রেন্ড, আমরা সবাই পাগল হয়ে যাচ্ছি।’

বিবর্ণ জনশূন্য ধূসর প্রান্তরের মলিন প্রেতলোকের দিকে চেয়ে থেকে আমারও তা-ই মনে হয়েছিল— মরণকালেও সঠিক কথা বলেছেন ম্যারাকট। নিশ্চয় উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি তিনজনেই। তারপরেই চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম একটা নড়াচড়া। দূরের জলের মধ্যে নড়ছে কতকগুলো ছায়া। আস্তে আস্তে নিরেট ঘন হয়ে গিয়ে কায়া পরিগ্রহ করল সেই ছায়ামূর্তিগুলো। সমুদ্রতল মাড়িয়ে একদল লোক ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পরেই ভীড় করে দাঁড়িয়ে গেল পোর্টহোলের সামনে, আমাদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে অঙ্গভঙ্গী করে কথা চালিয়ে গেল। দলটার মধ্যে মেয়েছেলে আছে জনাকয়েক, বেশিরভাগই পুরুষ, তাদের একজনের শরীর বেশ শক্তসমর্থ, মাথা বেশ বড়, গালে একমুখ দাড়ি, নিশ্চয় দলপতির মতো হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ইস্পাত কক্ষের ভেতরে আমাদের অবস্থাটার সরেজমিন তদন্ত করে নিল দ্রুত চোখ চালিয়ে। যেহেতু আমাদের খাঁচা একটা ঠেলে বেরিয়ে আসা জায়গায় আটকে গিয়ে ঝুলছিল, তাই দেখতে পেয়েছিল খাঁচার তলার দিকে রয়েছে একটা তুলে খুলে ফেলা দরজা। একজন বার্তাবাহককে কী বলতেই সে দৌড়ে চলে গেল কিছু একটা করতে। দাড়িওয়ালা ব্যক্তিত্বময় পুরুষটা তখন হুকুমের ভঙ্গিতে আমাদের ইশারায় বললে, এক্ষুণি খোলা হোক পায়ের তলার টেনে তোলা দরজার পাল্লা।

আমি বলেছিলাম, ‘খোলাই যাক। এমনিতেই তো সলিল সমাধি ঘটছে। সেটা ঘটুক পুরোপুরি।’

ম্যারাকট বললেন, ‘সলিল সমাধি নাও ঘটতে পারে। ঘরের মধ্যে বাতাস তো চাপের মধ্যে রয়েছে। নিচ থেকে জল ঢুকলেও কিছুটা উঠে আটকে যাবে বাতাসের চাপে। স্ক্যানলানকে একটু ব্র্যান্ডি গিলিয়ে দিন। ওকেও তো হাত লাগাতে হবে।’

মেকানিকের গাল টিপে ধরে মুখ হাঁ করিয়ে গলায় ঢেলে দিলাম একটু ব্র্যান্ডি। মাথা চনমন করে উঠতেই চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে দেখতে লাগল চারপাশ। ধরাধরি করে বসিয়ে দিলাম সোফার ওপরে, দাঁড়ালাম দু-পাশে। যদিও তখনও ঘোরের মধ্যে রয়েছে, তা সত্ত্বেও কানের কাছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অল্প কথায় পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিলাম।

ম্যারাকট বললেন, ‘জল যদি ব্যাটারিতে লাগে, তাহলে ক্লোরিন পয়জনিং এর সম্ভাবনা একটা আছে। বাতাসের সব ক-টা নল খুলে দিন যাতে চাপের চোটে কম জল ঢেকে ভেতরে। এবার হাত লাগান— হাতল ধরে টান মারছি।’

সবাই মিলে ঝুঁকে পড়ে তিনজনের ওজন এক করে হ্যাঁচকা টান মেরে আমাদের ছোট্ট ঘরের তলদেশ থেকে গোলাকার চাকতি সরিয়ে দিলাম— যদিও তখন মনে হয়েছিল সুইসাইড করতে যাচ্ছি। আলোর নিচে ফুঁসে তোড়ে ঢুকে পড়ল সবুজ জল হুশহুশ শব্দে। দ্রুত উঠে এল গোড়ালি ছাড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত, কোমর পর্যন্ত আটকে গেল সেখানেই। অসহ্য হয়ে উঠল কিন্তু বাতাসের চাপ। মাথা ঘুরতে লাগলো বোঁ বোঁ করে, মনে হল এই বুঝি ফেটে যাবে কানের পর্দা। বেশ বুঝলাম, এহেন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারব না বেশিক্ষণ। তাক খামচে ধরেছিলাম বলেই হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাইনি পায়ের তলায় ফুঁসে উঠে আসা থই থই জলের মধ্যে।

উঁচু অবস্থানে থাকার দরুণ পোর্টহোলের মধ্যে দিয়ে আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, বুঝতেও পারছিলাম না আমাদের উদ্ধারের জন্যে কী ব্যবস্থা নিতে চলেছে উদ্ধার কর্তারা। উদ্ধার যে আদৌ পাব, এমন সম্ভাবনা মাথার মধ্যে ঠাঁই পাচ্ছিল না। তা সত্ত্বেও বাইরের লোকগুলোর কর্তৃত্বময় উদ্দেশ্যমূলক আচরণ মনের মধ্যে আশাব্যঞ্জক আভাস দেখতে পাচ্ছিলাম— যদিও তা ক্ষীণ আশা ছাড়া কিছুই নয়। আচমকা দেখতে পেলাম পায়ের দিকের ফুটো দিয়ে মুখ বাড়িয়েছে লোকটা, পরমুহূর্তেই উঠে এল ঘরের মধ্যে, সোফার কিনারায় দাঁড়িয়ে কৌতুকময় চোখে তাকিয়ে যেন চোখের ভাষা দিয়ে বলে গেল— যত্তসব মুর্খের দল! কী ভেবেছ? পটল তুলবে? আমরা থাকতে?’

আর ঠিক এই সময়ে ভারী আশ্চর্য একটা ব্যাপার আমার নজরে এল। যে লোকটার কথা বলছি, সে যদিও-বা আমাদের মতোই মনুষ্য গোত্রের জীব হয়, তার হাত আর পা ছাড়া বাকি দেহটা ঘিরে ছিল একটা স্বচ্ছ আবরণ— মাথা আর ধড় মুড়ে। জিনিসটা এমনই স্বচ্ছ বস্তু দিয়ে তৈরি যে জলের মধ্যে থাকার দরুন এতক্ষণ বোঝা যায়নি, কিন্তু জল ঠেলে উঠে ইস্পাত কক্ষের মধ্যে আমাদের সামনে দাঁড়াতেই বোঝা যাচ্ছে— ঠিক যেন মিহি কাচ দিয়ে তৈরি একটা রুপোলি বস্তু। জিনিসটাকে দেখতে আয়তাকার বাক্সের মতো, গায়ে অনেক ছেঁদা যেন সামরিক অফিসারদের কাঁধের ওপরকার চাপরাশের মতো কিছু একটা গায়ে চাপিয়ে রেখেছে।

নবাগত বন্ধু আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতেই পায়ের তলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল আর একটা মুখ, ঠেলে তুলে দিল বিরাট বুদবুদের মতো কাচের মতো একটা বস্তু। এই রকম তিনটে বস্তু উঠে এল পরপর, ভাসতে লাগল ইস্পাত কক্ষের ভেতরে জমা জলের ওপর। তারপর ছ-টা ছোট বাক্স চালান করা হল নিচের ফুটো দিয়ে ভেতরের ঘরে। সদ্য পরিচিত ব্যক্তি আমাদের তিনজনের দু-কাঁধে আটকে দিল একটা করে, দেখে তখন মনে হল তাদের কাঁধের ওপরকার চাপরাশের মতো। একটু আগে থেকেই আমার মাথার মধ্যে একটা চিন্তার আনাগোনা শুরু হয়ে গেছিল। এই যে অদ্ভুত মানুষগুলো, এরা কোনও প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করে অপ্রাকৃত পন্থায় জীবিত নয়, এক কাঁধের একটা বাক্স বাতাস উৎপাদন করে যাচ্ছে, আর এক কাঁধের একটা বাক্স বাতাস টেনে নিচ্ছে। ইলাসটিক ব্যান্ড দিয়ে টেনে আটকে দিল বাহুর ওপর দিকে আর কোমরের নিচে, যাতে আর জল ঢুকতে না পারে। ভেতরে থেকে স্বচ্ছন্দে শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে গেলাম। বিপুল হর্ষে মন নৃত্য করে উঠল যখন দেখলাম ম্যারাকট প্রফুল্ল বদনে চশমা চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে, বিল স্ক্যাননের দেঁতো হাসি দেখে বোঝ গেল প্রাণদায়ী অক্সিজেন তার ক্ষেত্রে কাজ দিচ্ছে, আগের হাসিখুশি অবস্থায় ফিরে এসেছে। আমাদের উদ্ধারকর্তা একে একে আমাদের অবলোকন করে নিল হৃষ্টভাবে, তারপর হাতের ভঙ্গিমায় বললে পায়ের তলার ফুটো দিয়ে যেন বেরিয়ে আসি তার পেছন পেছন সমুদ্রের মধ্যে। ডজন খানেক হাত এগিয়ে এসে সাহায্য করেছিল আমাদের সে কাজে— পাঁকালো হড়হড়ে জমির ওপর প্রথম পা দিয়ে যাতে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি, তাই সব দিক থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেছিল আমাদের।

বিস্ময়ের সেই প্রথম চমক আজও বিস্মৃত হইনি আমি। পাতাল সমুদ্রে পাঁচ মাইল নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিন মূর্তি পরমানন্দে এবং বিপুল স্বচ্ছন্দে। বৈজ্ঞানিকদের কল্পনার সেই ভয়াল জলচাপ কোথায়? আশপাশ দিয়ে সুন্দর সুন্দর মাছগুলো অবহেলায় যেমন ঘুরেফিরে যাচ্ছে, আমরাও তো সেই রকম স্বচ্ছন্দ বোধ করছি। ধড়গুলোকে অবশ্য মুড়ে রেখে দিয়েছে ইস্পাতের চাইতেও মজবুত এই পাতলা আবরণ, কিন্তু হাত-পা তো বেরিয়ে রয়েছে— রয়েছে সামান্য চাপের মধ্যে, যা আর খেয়াল থাকে না কিছুক্ষণ পরেই। বড় ভালো লেগেছিল যে কক্ষের মধ্যে ছিলাম, সেই কক্ষের দিকে চেয়ে থাকবার সময়ে বাইরে থেকে। ব্যাটারিগুলো তখনও চালু থাকায় হলদেটে আলো ঠিকরে আসছে সব ক-টা জানলা দিয়ে, মাছের দঙ্গল খেলা করে যাচ্ছে প্রতিটা আলোকিত গবাক্ষের সামনে। দলপতি হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলেন ম্যারাকট-কে, আমরা ভারি পদক্ষেপে অগ্রসর হলাম পেছন পেছন।

আর তার পরেই ঘটে গেল অতীব বিস্ময়কর একটা ব্যাপার। ব্যাপারটায় সমপরিমাণে বিস্মিত হয়েছিল আমাদের নতুন সহচররা। মাথার ওপরে দেখা গেছিল একটা ছোট্ট কালচে বস্তু। ওপরকার তমিস্রা ভেদ করে আস্তে আস্তে নেমে এসে কাদাটে জমিতে ঠেকে গিয়ে থেমে গেছিল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে সামান্য দূরে। স্ট্র্যাটফোর্ড জাহাজ জল মাপছে সিসের গোলক নামিয়ে দিয়ে। ইস্পাত কক্ষের কর্ড ছিঁড়ে যাওয়ার পর আমরা যে অক্কা পেয়েছি, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হবার পর কর্তব্য করছেন ক্যাপ্টেন, সলিল সমাধি ঘটল যে জায়গায়, সে জায়গাটার গভীরতা মাপছেন। উনি কি ভেবেছিলেন, সিসের ওজনটা নেমে এসে থমকে যাবে আমাদেরই পায়ের গোড়ায়! মাথার ওপর দিকে উঠে গেছে টান টান পিয়ানো তার পাঁচ মাইল জলের মধ্যে দিয়ে জাহাজের ডেক পর্যন্ত। আহারে! এই তো সুযোগ। বার্তা পাঠানো যাক তারের সঙ্গে! আইডিয়াটা অদ্ভুত সন্দেহ নেই, কিন্তু আমরা যে এখনও মরিনি, বহাল তবিয়তে আছি, এ খবরটা জাহাজের লোকদের জানিয়ে দেব না কেন? কাচের আবরণে আমার কোট ঢাকা থাকলেও ট্রাউজার্সের পকেট থেকে রুমাল বের করতে পেরেছিলাম। সেই রুমাল বেঁধে দিয়েছিলাম পিয়ানো তারে সিসের ওজনের ঠিক ওপরে। অটোমেটিক কলকবজা তক্ষুণি সিসের ওজনটাকে টেনে তুলে নিয়ে গেছিল মাথার ওপর দিকে, সেই সঙ্গে নড়তে নড়তে উঠে গেছিল আমার সাদা রুমাল— যে দুনিয়ার দিকে, সে দুনিয়া আর দেখতে পাব না কস্মিনকালে। আমাদের নতুন সঙ্গীরা সাগ্রহে চেয়ে রইলো পঁচাত্তর পাউন্ড ওজনের সিসেটার দিকে। তারপর ফের শুরু হল পথ পরিক্রমা।

খুদে পাহাড়ের মতো ঢিবিদের পাশ দিয়ে শ দুই গজ এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেছিলাম একটা চৌকোনা দরজার সামনে দু-পাশে রয়েছে নিরেট থাম আর কারুকাজ করা খিলেন। দরজা খোলা ছিল। আমরা ঢুকলাম ভেতরে একটা বড়সড় শূন্য কক্ষে। টেনে সরিয়ে আনা পার্টিশনের ব্যবস্থা ছিল ভেতর দিক থেকে। আমরা ভেতরে যেতেই একটা হাতলে চাপ দিতেই সেই পার্টিশন সরে এসে বন্ধ করে দিয়েছিল পেছনের দরজার মুখ। কাচের হেলমেটের মধ্যে কান থাকায় কিছুই শুনতে না পেলেও বুঝতে পারলাম। শক্তিশালী পাম্প ঘরের জল বের করে দিচ্ছে বাইরে, তাই জলের লেভেল হু-হু করে নেমে আসছে মাথার ওপর দিকে। পনেরো মিনিটও গেল না, দেখলাম দাঁড়িয়ে আছি একটা ঢালু পাথর দিয়ে বাঁধাই মেঝের ওপর। নতুন সঙ্গীরা হাতাহাতি করে আমাদের স্বচ্ছ পরিচ্ছদ খুলে দিচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই নিঃশ্বাসে খাঁটি বাতাস টেনে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম প্রস্তর প্রকেষ্ঠের বিলক্ষণ উষ্ণ আলোকিত পরিবেশে— পাতালের ময়লা রঙের মানুষরা আমাদের ঘিরে ধরে খুশির হাসি হেসে হেসে কথা বলে গেল নিজেদের মধ্যে, বন্ধুর মতো আমাদের হাত ধরে নেড়ে দিয়ে পিঠ চাপড়ে দিল বিষম খুশিতে। কথা বলছিল অদ্ভুত রকমের উখো ঘষা গলায়, মানে বুঝতে পারছিলাম না কোনও কথার, কিন্তু চোখের চাহনি আর মুখভাবে বন্ধুত্বের আলো বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ভয় কী? আমরা তো আছি! সাগরতলের বন্ধুদের সেই মুখভাব আর আপনজনের মতো কথা বলা আমি বিস্মৃত হব না কোনও দিন।

কাচের পোশাকগুলো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেওয়ালের অনেকগুলো খোঁটায়। ঠেলে খুলে দেওয়া হয়েছিল ভেতরদিকের একটা দরজা— যে দরজার পরেই রয়েছে একটা টানা লম্বা গলিপথ। গলিপথে ঢুকে যেতেই পেছনের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর আর বুঝতেই পারলাম না আমরা রয়েছি পাঁচ মাইল সমুদ্রের নিচে এক অজানা মনুষ্য প্রজাতির অনাহুত অতিথি হয়ে, জলতলের ওপরের জগতের সঙ্গে নেই আমাদের আর কোনও সম্পর্ক।

ভয়াবহ চাপ থেকে সহসা মুক্তি পাওয়ার পর আমরা সকলেই বিষম শ্রান্তিতে নেতিয়ে পড়েছিলাম। বিল স্ক্যানলানকে পকেট হারকিউলিস বলা যায়। সে পর্যন্ত পা টেনে টেনে চলছিল মেঝের ওপর দিয়ে। ম্যারাকট আর আমি দু-জনেই এলিয়ে পড়েছিলাম আমাদের গাইডদের গায়ের ওপর। শত ক্লান্তি সত্ত্বেও খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছিলাম আশপাশের সব কিছু। বাতাস আসছে নিশ্চয় বাতাস তৈরির কোনও মেশিন থেকে, কোনও সন্দেহই নেই তাতে— কেননা সেই বাতাস হু হু করে বেরোচ্ছে দেওয়ালের গায়ের গোল গোল ফুটো থেকে। আলো স্তিমিত ফ্লোরেসেন্ট আলোর মতো যার উদ্ভাবনা নিয়ে ইতিমধ্যেই মাথা ঘামিয়ে চলেছেন ইউরোপের ইঞ্জিনিয়াররা— ফিলামেন্টওলা ল্যাম্প যখন আর থাকবে না। গলিপথের কার্নিশের কাছে ঝোলানো সারবন্দি স্বচ্ছ কাচের লম্বাটে সিলিন্ডার থেকে এই আলো নেমে আসছে নিচের দিকে। এই পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে যাওয়ার পর ঢালুপথে আমাদের নেমে যাওয়া রুখে দিয়ে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটা বড়সড় বসবার ঘরে। মেঝেতে পাতা পুরু কার্পেট। চকচকে সোনালি চেয়ার আর সোনালি সোফা দিয়ে সাজানো— যা দেখেই আবছাভাবে মনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল মিশরীয় কবরখানার ছবি। অত লোকজনদের বিদায় দিয়ে কাছে থেকেছিল সেই দাড়িওয়ালা লোকটা, আর দু-জন সহকর্মী। নিজের বুকে বার কয়েক টোকা মেরে দাড়িওলা বলেছিল ‘ম্যান্ডা’, বেশ কয়েকবার বলে আউড়ে গেছিল নিজের বুকে টোকা দিয়ে। তারপর একে একে আমাদের প্রত্যেকের দিকে ফিরে ম্যারাকট, হেডলে আর স্ক্যানলান নাম তিনটে বলে গেছিল বেশ কয়েকবার, উচ্চারণ সঠিক না হওয়া পর্যন্ত। তারপরে আমাদেরকে ইশারায় আসন গ্রহণ করতে বলে তিন সহকর্মীর প্রত্যেককে বলেছিল একটা করে কথা, তারা বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে, একটু পরেই সসম্ভ্রমে নিয়ে এসেছিল অতি বৃদ্ধ এক ভদ্রলোককে, যাঁর সাদা চুল দাড়ি লুটিয়ে পড়ছে বুক পিঠের ওপর, মাথায় রয়েছে অদ্ভুত শঙ্কুর মতো কালচে টুপি। আগেই আমার বলা উচিত ছিল, বাকি সবারই পরনে রয়েছে রঙিন রোমান পরিচ্ছদ, হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো, পায়ে রয়েছে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু মাছের চামড়া অথবা শ্যাগ্রিন চামড়ার হাই বুট। শ্রদ্ধেয় নবাগত নিঃসন্দেহে পেশায় চিকিৎসক, কেননা আমাদের প্রত্যেককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, প্রত্যেকের কপালে হাত রেখে চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ ধরে, যেন আমাদের অবস্থার মানসিক ছবি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দেখে তো মনে হল, খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না, কেননা মাথা নাড়তে নাড়তে গম্ভীর গলায় কয়েকটা কথা বললেন ম্যান্ডা-কে। শুনেই, ম্যান্ডা একজন সহকর্মীকে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাইরে। সে ফিরে এসেছিল ট্রে ভরতি খাবার আর এক ফ্লাক্স সুরা নিয়ে। নামিয়ে রেখেছিল আমাদের সামনে। জিনিসগুলো যে আদতে কী, সে প্রশ্ন করবার শারীরিক শক্তি ছিল না কারুরই। বেদম অবস্থায় আহার সাঙ্গ করে অনেকটা সুস্থ বোধ করেছিলাম। তারপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর একটা ঘরে, যেখানে পাতা ছিল তিনটে বিছানা, একটায় আমি ধপাস করে শুয়ে পড়েছিলাম তৎক্ষণাৎ। ক্ষীণভাবে মনে আছে বিল স্ক্যানলান আমার পাশে এসে বসেছে।

বলছে, ‘ব্রান্ডিটা খেয়ে বাঁচলাম। কিন্তু এলাম কোথায়?’

‘আপনি যা জানেন, আমিও তা জানি— তার বেশি নয়!’ ঘুমন্ত চোখে নিজের বিছানার দিকে যেতে যেতে কী যে বিড়বিড় করে বলে গেল বিল স্ক্যানলান— তা আর মাথায় ঢোকেনি, কেননা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অঘোরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *