(১)
এই যে কাগজপত্র আমার হাতে এসেছে সম্পাদনার জন্যে, সে কাজে হাত দেওয়ার আগে জনসাধারণকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই একটা ব্যাপার। ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজটা এক বছর আগে অভিযানে বেরিয়েছিল সমুদ্রবিদ্যা অর্জনের অভিলাষ নিয়ে। গভীর সমুদ্রের জীবজগৎ নিয়ে তথ্য আহরণের উদ্দেশ্য নিয়ে। বাষ্পচালিত এই জাহাজ নিয়ে অভিযানের সংগঠক ছিলেন ডক্টর ম্যারাকট— নিতল সমুদ্রের জীবজগৎ নিয়ে দু-খানি গ্রন্থ রচনা করে যিনি জগৎ প্রসিদ্ধ। ওঁর সঙ্গে ছিলেন মিস্টার সাইরাস হেডলে— কেমব্রিজের প্রাণীবিদ্যা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন সহকারী। অভিযানের সময়ে তিনি ছিলেন অক্সফোর্ডের ‘রোড্স স্কলার’। জাহাজের দায়িত্বে ছিলেন অভিজ্ঞ নাবিক ক্যাপ্টেন হোয়ি। তেইশজন নাবিকের মধ্যে ছিলেন ফিলাডেলফিয়ার এক আমেরিকান মেকানিক।
পুরো পার্টিটাই নিখোঁজ হয়ে যায় একেবারে। একটাই মাত্র খবর পাওয়া গেছিল নরওয়ের একটা জাহাজ থেকে। নিরুদ্দেশ জাহাজের মতো একটা জাহাজকে নাকি দেখা গেছিল ১৯২৬ সালের প্রলয়ঙ্কর তুফানের সময়ে। ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ নাম লেখা একটা লাইফবোট পরে পাওয়া গেছিল বিয়োগান্তক দুর্ঘটনার কাছাকাছি জায়গায়। তাতে ছিল একটা লাইফবেল্ট আর একটা লাঠি। এরপর থেকে অনেকদিন আর কোনও খবর না পাওয়া যাওয়ায় ধরে নেওয়া হয়েছিল জাহাজ আর নাবিকদের আর কোনও খবর পাওয়া যাবে না। ভাগ্য যে বিরূপ হয়েছে, সে বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া গেছিল অদ্ভুত একটা বেতার বার্তা পাওয়ার পর থেকে। সেই সংবাদের বেশির ভাগটাই দুর্বোধ্য হওয়া সত্ত্বেও জাহাজটার কপাল যে পুড়েছে, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। এ ব্যাপারটা আমি বিশদভাবে বলব পরে।
‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজের অত্যাশ্চর্য অভিযান প্রসঙ্গে বেশ কিছু ব্যাপার সাড়া জাগিয়েছিল সেই সময়ে। একটা ব্যাপার গুজবে ইন্ধন জুগিয়ে গেছিল বিলক্ষণ। প্রফেসর ম্যারাকট নাকি গোটা অভিযানটাকে গোপনে রেখেছিলেন বড়ই কৌতূহলোদ্দীপকভাবে। একটা ব্যাপারে ওঁর সুনাম ছিল যথেষ্ট। সাংবাদিক মহলকে দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। বিশ্বাসও করতেন না। অপছন্দের এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত মাত্রায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশেষ এই অভিযানের সময়ে। অ্যালবার্ট ডকে তাঁর জাহাজ যখন ছিল, তখন কোনও সাংবাদিককে তিনি খবর দেননি, জাহাজে পা ফেলতেও দেননি কোনও সংবাদ-সন্ধানীকে। জাহাজটায় নাকি গভীর সমুদ্র অভিযানের উপযুক্ত জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে, এই সম্পর্কিত গুজব শোনা গেছিল। জাহাজের গঠনেও যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আনা হচ্ছে, এমন সংবাদও সাংবাদিকদের কানে এসেছিল। জানা গেছিল, জাহাজের গোটা তলার দিকটা নাকি খুলে ফেলা যায়। লয়েড সংবাদমহলের সাংবাদিকরা এ খবর যাচাই করেও নিয়েছিলেন। যদিও সে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের কালঘাম ছুটে গেছিল। তারপরেই ব্যাপারটা সবাই ভুলে গেলেও, জাহাজের পরিণাম নিয়ে যখন ঝড় উঠেছিল সংবাদ জগতে, তখন এই গঠনবৈশিষ্ট্য অসাধারণ সাড়া জাগিয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে।
‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজের গোড়ার দিকের কথা এই পর্যন্ত। চারখানা প্রামাণ্য কাগজপত্র থেকে বেশ কিছু খবর জানা গেছে। প্রথম খানা একটা চিঠি। লিখেছিলেন মিস্টার সাইরাস হেডলে, গ্র্যান্ড ক্যানারির রাজধানী থেকে স্যার জেমস ট্যালবটকে— যিনি ছিলেন অক্সফোর্ডের ট্রিনিটি কলেজে। চিঠিখানা লেখা হয়েছিল ‘স্ট্যাটফোর্ড’ জাহাজ যখন জাহাজঘাটা ছাড়িয়ে টেমস নদী পেরিয়ে জমি ছুঁয়েছিল একবারই— তখন। দ্বিতীয় ডকুমেন্টটা একটা অদ্ভুত বেতার বার্তা, যে প্রসঙ্গ একটু আগেই ছুঁয়ে গেছি। তৃতীয়টা একটা কাচের গোলকের গতিমাপক যন্ত্রের কিছুটা। চতুর্থটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। একটা আধারের মধ্যে রাখা এমন সব ব্যাপার যা অতীব নির্মম আর কৌতূহলোদ্দীপক প্রহেলিকা। মানব ইতিহাসে যার সমতুল্য আর কিছু হয় না। অতিরঞ্জনের প্রলেপ ছুঁইয়েও যার ধারে কাছে আসা যায় না। মানব ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচনা করার পক্ষে যথেষ্ট।
এই ভূমিকা অন্তে আমি এখন পেশ করব মিস্টার হেডলে-র চিঠিখানা, যা আমি পেয়েছি স্যার জেমস ট্যালবট-এর সৌজন্যে, যে চিঠি প্রকাশিত হয়নি এর আগে। চিঠিটার তারিখ পয়লা অক্টোবর, ১৯২৬।
***
মাই ডিয়ার ট্যালবট, এই চিঠি আমি পাঠাচ্ছি পোর্টা ডি লা লাজ থেকে। দিন কয়েকের জন্যে বিশ্রাম নিচ্ছি এখানেই। বিন স্ক্যানলান আমার সবচেয়ে কাছের সহযোগী ছিল অভিযানে। খুবই আমুদে মানুষ। এ কাজে বেশির ভাগ সাহায্য পাচ্ছি তার কাছ থেকেই। আজ সকালে অবশ্য সে আমার কাছে নেই, আছে এক ‘ঘাগড়া’। বিল স্ক্যানলান-এর কথা বলার ধরনটাই এই রকম, কথা বলে ইংরেজদের মতো— কিন্তু আমেরিকান কায়দায়। খাঁটি আমেরিকান। ইংরেজ বন্ধুদের সঙ্গে যখন থাকি, তখন তার কথাবার্তা বুঝে নিতে হয় ভাবে ভঙ্গীতে। আমি কিন্তু এই চিঠি লিখছি নিখাদ অক্সফোর্ড ঢঙে, ইয়াঙ্কি কায়দায় নয়।
ম্যারাকট-এর সঙ্গে তোমার মোলাকাত হয়েছিল মিটরে-তে। তিনি যে কি পরিমাণ শুষ্ক মানব, তা তোমার অজানা নয়। আগেই তোমাকে বলেছি, এ কাজে আমাকে নেওয়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের খুঁটিনাটি। আগে খোঁজ নিয়েছিলেন জীববিজ্ঞান সংস্থার বৃদ্ধ সমারভিল-এর কাছে। সমুদ্রচর কাঁকড়াদের নিয়ে লেখা আমার নিবন্ধটা তিনি পড়তে দিয়েছিলেন ম্যারাকট-কে। ওষুধ ধরে যায় তখনই। এ রকম একটা মনোমতো ভ্রান্তি যে অতিশয় উপাদেয়, আমাকে তা মানতেই হবে। তবে কি-জানো ম্যারাকট-এর মতো একখানা জীবন্ত মমির সান্নিধ্যে না এলেই বুঝি ভালো হত। অমানবিকভাবে ইনি একলা থাকতে ভালোবাসেন, ডুবে থাকেন নিজের কাজকর্মের মধ্যে। বিল স্ক্যানলান এঁর সম্বন্ধে অনেক সরস টিপ্পনি কাটলেও মানুষটাকে তারিফ না করে পারবে না, তাঁর নিজস্ব কাজে সুগভীর নিমগ্নতার জন্যে। এঁর দুনিয়ায় আছে শুধু বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের বাইরে নেই কোনও কিছুর অস্তিত্ব। শুনলে হাসবে, আমি যখন ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম নিজেকে তৈরি করার জন্যে কী কী পড়া উচিত, উনি তখন বলেছিলেন, সিরিয়াস পড়াশুনোর জন্যে পড়া দরকার ওঁর নিজের রচনা সংগ্রহ, অবসর বিনোদনের জন্যে পড়তে পারি হেকল-এর ‘প্লাঙ্কটন-স্টাডিজ’! শুষ্ক কৌতুকের অবতার এই প্রফেসর ম্যারাকট!
অক্সফোর্ড হাই-য়ের আড্ডাখানায় যতটুকু জেনেছিলাম, তার বেশি এক তিলও বুঝে উঠিনি ভদ্রলোককে! কথাই বলেন না। অস্থিময় শুষ্ক মুখ সবসময়ে খটখট করছে, আন্তরিকতার বাষ্প পর্যন্ত নেই। নাকখানা কৃপাণের মতো যেমন খাড়া, তেমনি লম্বা। দেখলেই মনে হয় যেন কচুকাটা করতে আসছে। চোখদুটো সে তুলনায় ছোট আর কুতকুতে ধূসর বর্ণের, কিন্তু প্রদীপ্ত, খুব কাছাকাছি, ঝোপের মতো ভুরুর ঠিক নিচে। অধরোষ্ঠ নিরতিসীম পাতলা। মুখবিবর-এর যেন দু-খানা কপাট। যে কপাটে খিল তোলা থাকে প্রায় সবসময়ে। দুই গালে দুটো গর্ত আছে বলে মনে হয়— অষ্টপ্রহর চিন্তার ঘোরে থাকার পরিণাম, সাধুসন্তের মতো জীবন যাপন করলে গাল তুবড়ে যায় এই ভাবেই। এমন মুখ যাঁর থাকে, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করা যায় না। ভদ্রলোক নিবাস রচনা করেছেন যেন মনের পাহাড়ে, যা মরলোকের বাসিন্দাদের নাগালের বাইরে। মাঝে মাঝে আমার তো মনে হয়, ভদ্রলোক নিশ্চয় একটু পাগলাটে। উদাহরণ স্বরূপ, এই যে অসাধারণ যন্ত্রটা উনি বানিয়েছেন… যাক গে, এ প্রসঙ্গে মুখ খুলব যথা সময়ে। তখনই বুঝবে আমি কী বলতে চাইছি।
অভিযানের গোড়া থেকেই বলা যাক। ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ সাগরে পাড়ি দেওয়ার মতো ছোট্ট কিন্তু বেজায় মজবুত জলপোত। যে কাজে যাচ্ছে, সে কাজের উপযুক্ত। বারোশো টন। ডেক মজবুত। স্টিম ইঞ্জিন রীতিমতো শক্তিশালী। আছে অনেক কলকবজা। কিছু চেনা, কিছু বিদঘুটে। আর আছে আরামে থাকবার মতো কোয়ার্টার। বিবিধ যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো ল্যাবরেটরি— আমাদের বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষার উপযোগী।
যাত্রা শুরুর আগে থেকেই এ জাহাজ নাকি একটা প্রহেলিকাপোত— এই সুনাম অর্জন করে ফেলেছিল। অচিরে দেখলাম, এহেন নাম ডাক অকারণে হয়নি। প্রথম প্রথম ষাট ফুট গভীর জল কেটে যেতে হয়েছিল। খামোকা সময় নষ্ট করা হয়েছিল। কেননা এ জাহাজ যে গভীর জলে যাওয়ার উপযোগী। যাচ্ছিলাম তো উত্তর সাগরের দিকে। মামুলি খাওয়ার মাছ, কুকুর-মাছ, স্কুইড, জেলি-মাছ, আর তলদেশের পলিমাটি সমৃদ্ধ তলানি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়েনি। তারপর স্কটল্যান্ড ঘুরে এগিয়ে যাওয়ার পর কপাল খুলে গেল। চলে এলাম আফ্রিকার উপকূল আর সেখানকার দ্বীপসমূহের মাঝামাঝি অঞ্চলে। চাঁদ বিহীন এক রজনীতে আর একটু হলে জাহাজের তলা ঘষটে যেত তলদেশে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটেনি।
প্রথম কয়েকটা সপ্তাহে ম্যারাকটের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিবিড় করবার চেষ্টা করেছি। দেখলাম, কাজটা খুব সোজা নয়। প্রথমত, ভদ্রলোক দুনিয়ার সেরা আত্মভোলা আর অন্যমনস্ক মানুষ। লিফট থেকে নেমে বকশিশ আর ভাড়া দিতে যান লিফটম্যানকে, মনে করেন বুঝি ট্যাক্সি থেকে নামলেন। অর্ধেক সময় এমনই চিন্তা নিবিষ্ট থাকেন যে কোথায় আছেন আর কী করছেন, সে খেয়াল থাকে না। এর ওপরে আছে চূড়ান্ত মাত্রায় গোপনীয়তা রক্ষা করা। বেফাঁস কিছু বলে ফেলার পাত্র নন মোটেই। অনবরত দেখছেন কাগজপত্র আর মানচিত্র, লুকিয়ে ফেলেন আমি কেবিনে ঢুকলেই। অতিশয় গুপ্ত কোনও ব্যাপার আছে নিশ্চয় এই অভিযানে— পয়েন্টগুলো আছে মনের মধ্যে, কাউকে ফাঁস করছেন না এক বন্দর থেকে আর এক বন্দরে যাওয়ার সময়ে। দেখলাম বিল স্ক্যানলানও আমার সঙ্গে একমত এই ব্যাপারে।
একদিন ল্যাবরেটরিতে বসে পরীক্ষা করছিলাম জল কতখানি লবণাক্ত, বিল স্ক্যানলান এসে বললে, ‘এই যে মিস্টার হেডলে, লোকটার মতলব কী বলুন তো? কী করতে চলেছেন?’
আমি বললাম, ‘আগে সবাই যা করেছে, তাছাড়া আর কী হতে পারে? নতুন নতুন মাছের ফর্দ, আর জল কতখানি গভীর— ব্যাস, হয়ে গেল।’
‘মোটেই না। ফের ভাবুন মশায়, ফের ভাবুন। যেমন, আমাকে আনা হল কেন?’
‘কলকবজা যদি বিগড়োয়, আপনি দেখবেন— তাই।’
‘আপনার মুন্ডু! কলকবজা দেখবার ভার তো স্কচ ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকলারেন-এর ওপর। আসুন তাহলে, দেখানো যাক আপনাকে।’ এই বলে, পকেট থেকে একটা চাবি বের করেছিল বিল স্ক্যানলান। খুলেছিল ল্যাবরেটরির পেছন দিকের একটা দরজা। নেমে গেছিল একটা মই বেয়ে খোলের মধ্যে। সেখানে দেখেছিলাম, বিরাট প্যাকিং কেসের মধ্যে রয়েছে চারখানা খুব চকচকে জিনিস। ইস্পাতের পাত। চারপাশে সারবন্দি নাট-বল্টুর ছেঁদা। প্রত্যেকটা স্টিল প্লেট লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় দশ ফুট। আধ ইঞ্চি পুরু। মাঝখানে একটা করে দেড় ফুট ব্যাসের গোল ফোকর।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এ আবার কী?’
সকৌতুকে তাকিয়ে থেকে অট্টহাস্য করেছিল বিল স্ক্যানলান। বলেছিল, ‘এ-ই আমার খোকা। এর জন্যেই আনা হয়েছে আমাকে। মেঝেটাও ইস্পাতের। ছাদটাও ইস্পাতের। একটু বেঁকা, যাতে দড়ি বা ইস্পাতের শেকল লাগানো যায়। এবার দেখুন জাহাজের তলার দিকটা।’
দেখলাম, খোলের নিচে রয়েছে একটা চৌকোনা কাঠের মঞ্চ— চারপাশে বেরিয়ে রয়েছে স্ক্রু-র মাথা। তার মানে, খোলের এই চৌকোনা তলদেশ খুলে আনা যায়। স্ক্যানলান বললে, ‘এর নিচে আর একটা তলা আছে। তার মানে, ম্যারাকট মশায়ের ফন্দি অনেক। সযত্নে রেখেছেন গোপনে, কাকপক্ষীকেও জানতে দিতে চান না। আমাদেরকেও নয়। আমার তো মনে হয়, ইস্পাতের একখানা ঘর তৈরি করার মতলব আছে ওঁর মগজের মধ্যে। জানলাগুলো স্টোর করে রেখেছেন এইখানে। তারপর জাহাজের তলা দিয়ে নামিয়ে দেবেন জলের মধ্যে। এইখানে রেখেছেন ইলেকট্রিক সার্চ লাইট। গোল পোর্টহোল দিয়ে সমুদ্রের তলায় আলো ফেলে দেখবেন কী আছে সাগরের একদম নিচে।’
আমি বললাম, ‘সেই মতলব থাকলে জাহাজের তলায় একটা ক্রিস্টাল চাদর লাগিয়ে নিলেই পারতেন।’
বলেছেন ঠিকই, মাথা চুলকেছিল বিল স্ক্যানলান, ‘মাথামুন্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বুঝেছি শুধু একটা ব্যাপার। উনি যা বলবেন, মুখ বুজে তা করে যেতে হবে। তা সে যতই নিরেট বোকামির কাজ হোক না কেন। এখনও পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আমিও তক্কে তক্কে আছি। মতলবটা কী, জানতেই হবে।’
এইভাবেই রহস্যের একটু আভাস পেয়েছিলাম সেদিন। এরপরে যেতে হয়েছিল খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে। জুবা অন্তরীপের উত্তর পশ্চিমের গভীর জলে কিছু কাজ করতে হয়েছিল। জায়গাটা মহীঢাল এর ঠিক বাইরে। টেম্পারেচার আর জলের লবণতা মাপতে হয়েছিল। কাজটার মধ্যে ছিল খেলোয়াড়ি উদ্যম। কখনও যেতে হয়েছে গভীর সমুদ্রে প্রায় সিকি মাইল পর্যন্ত, কখনও আধ মাইল, জালে টেনে তোলা হয়েছে বিস্তর মাছ এবং যেন বহু মহাদেশীয় অনেক কিছু। কখনও তুলে এনেছি আধটনের মতো গোলাপি জেলি। প্রাণের মূল উপাদান, কখনও স্বচ্ছ কাদার মধ্যেকার লক্ষ লক্ষ খুদে খুদে গোলক। সমুদ্রের তলদেশের এই অগণন বৈচিত্র্য নিয়ে তোমার বিরক্তি উৎপাদন ঘটানোর ইচ্ছে আমার নেই। তবে, গোড়া থেকেই আমার মনে হয়েছিল এই যে এত কাণ্ড করে চলেছেন ম্যারাকট ওঁর মূল কাজ এ সবের মধ্যে নেই। মিশরীয় মমির মগজে আছে অন্য মতলব। এ যেন মহড়া চলছে— আসল কাজের আগের রিহার্সাল।
এই পর্যন্ত লেখবার পর আমাকে একবার ডাঙায় নামতে হয়েছিল হাত-পা টান টান করে নেওয়ার অভিলাষ নিয়ে। কেননা, যাত্রা শুরু হবে পরের দিন সকালেই। ম্যারাকট আর বিল স্ক্যানলানও ছিলেন আমার সঙ্গে। জেটিতে যারা জড়ো হয়ে সদা মশগুল থাকে, ছুরি ছোরা তাদের নিত্য সঙ্গী। ম্যারাকট একটা ছ্যাকড়া গাড়ি ভাড়া নিয়ে দ্বীপে টহল দিতে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু পকেটে যে পয়সা নেই, তা মনে ছিল না। হাঙ্গামাটা লেগেছিল তারপরেই। বিল স্ক্যানলান দাঙ্গা শুরু করে দিতেই। ভাগ্যিস আমার কাছে কিছু ডলার ছিল, তা-ই দিয়ে ড্রাইভারকে খোশমেজাজে নিয়ে এসেছিলাম। ম্যারাকট এই ঘটনার পর অনেকটা মানবিক হয়ে গেলেন। জাহাজে ফিরে আসার পর আমাকে ওঁর ছোট্ট কেবিনে ডেকে পাঠিয়ে ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, ‘মিস্টার হেডলে, আপনি তো আইবুড়ো?’
আমি বললাম, ‘তা বটে।’
‘বিয়ে যখন করেননি, আপনি ঝাড়া হাত-পা মানুষ, আপনার রোজগারের মুখ চেয়ে কেউ বসে নেই?’
‘কেউ নেই।’
চমৎকার। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য বলিনি বিশেষ কারণে। পাঁচকান হোক, তা চাই না। গুপ্ত অভিযান গুপ্ত থাকুক। জানাজানি হলেই বাগড়া পড়ত। বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা গোপনে রাখতে হয়। দক্ষিণমেরু অভিযান এর আগে যাঁরা করেছেন, তাঁরা ঢাক পিটেছিলেন বলেই ব্যর্থ হয়েছেন। আমি ঢাক না পিটে দক্ষিণ মেরুর দিকেই চলেছি। কিন্তু মুখে চাবি দিয়ে রেখেছি। কিন্তু গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারের দোড়গোড়ায় এসে যখন দাঁড়িয়েছি, তখন একটু মুখ খোলা যেতে পারে। বিশেষ করে যখন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী আমার প্ল্যান চুরি করতে পারেনি। কাল শুরু হবে আমাদের আসল অ্যাডভেঞ্চার।’
‘কী সেই অ্যাডভেঞ্চার?’ আমার প্রশ্ন।
বিশীর্ণ তাপসিক মুখে উন্মত্ত উৎসাহের রোসনাই জাগ্রত করে আমার দিকে ঝুঁকে পড়লেন ম্যারাকট।
বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য— আটলান্টিকের তলদেশ।’
শুনে তো আমার দম আটকে এসেছিল। আটকে আসছে নিশ্চয় তোমারও। হাতে যদি একটু সময় থাকত, শেষ ডাকে এই খবরটা লিখে পাঠিয়ে দিতাম।
ম্যারাকট বললেন, ‘যা খুশি এখন লিখতে পারেন। কেননা, আপনার রিপোর্ট ইংল্যান্ডে যখন পৌঁছবে, তখন আমরা সাগরের তলায়।’
কথাটার মধ্যে ঠিকরে ঠিকরে গেল ভদ্রলোকের শুষ্ক কৌতুকবোধ।
বললেন, ‘বিজ্ঞানের ইতিহাসে আমরা একটা নতুন অধ্যায় জুড়তে চলেছি। প্রথমেই বলে রাখি, সাগরের তলায় ভীষণ চাপ নিয়ে এখনকার মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল। অন্য অন্য কারণে এই জল চাপ কাটাকুটি হয়ে যায়— সেই কারণগুলো কী, এই মুহূর্তে তা বলতে চাই না। এই একটা ব্যাপার মিটিয়ে নেওয়ার পর একটা প্রশ্ন রাখছি আপনার কাছে। এক মাইল জলের নিচে কতখানি চাপ আপনি আশা করেন?’
‘প্রতি বর্গইঞ্চিতে এক টনের একটু কম। এ ব্যাপার তো আগেই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘যা দেখানো হয়েছে, তা ভুল। যে পুরোধা ব্যক্তি এমন মত জাহির করেছেন, তিনি ভ্রান্ত। ইয়ং ম্যান, নিজের মাথা খাটান। গত একমাস ধরে খুবই সূক্ষ্ম আকারের কিছু জলচর প্রাণীদের আপনি জাল ফেলে ধরেছেন— এতই সূক্ষ্ম যে জাল থেকে ছাড়াতে বেগ পেয়েছেন। জাল থেকে ছাড়িয়ে জলের ট্যাঙ্কে ফেলতে গিয়ে আপনার হাতেই তাদের সূক্ষ্ম অবয়ব বিকৃত হয়ে গেছে।’
আমি বললাম, ‘জলের চাপ আর ওদের ভেতরকার চাপ একই রকম বলে জলের মধ্যে থাকার দরুণ দেহ বিকৃত হয়নি, চিঁড়ে চ্যাপটা হয়নি।’
শীর্ণ মাথা ঝাঁকিয়ে ম্যারাকট বললেন, ‘এ তো শুধু কথার মারপ্যাঁচ! আপনার জালে গোল গোল মাছও উঠেছে। নয় কি? জলের প্রচন্ড চাপে তো তাদের চ্যাপটা হয়ে টিকে থাকা উচিত ছিল?’
‘ডুবুরিদের অভিজ্ঞতাটা হিসেবের মধ্যে ধরছেন না কেন?’
‘সেটা একটা পয়েন্ট বটে। তারা যথেষ্ট চাপ অনুভব করেছে শরীরের খুব স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গ দিয়ে যেমন— কানের ভেতর দিক। কিন্তু আমি যে প্ল্যান করেছি, তাতে আমরা কোনওরকম চাপের আওতায় যাব না। আমরা নেমে যাব একটা ইস্পাতের খাঁচার মধ্যে থেকে, যে খাঁচার চারদিকে থাকবে চারটে ক্রিস্টাল জানলা— চারপাশ দেখবার জন্যে। জলের চাপ যদি প্রচণ্ড হয়, তাহলেও দেড় ইঞ্চি পুরু ডাবল নিকেল ইস্পাত তা রুখে দেবে— ভেতরে থাকব আমরা। গায়ে আঁচ লাগবে না। ন্যাসো-র উইলিয়ামসন ব্রাদার্স এই এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় আপনার তা অজানা নয়। আর যদি বলেন, ভুল আছে আমার হিসেবে, তাতে আপনার বয়ে গেল— কেননা, আপনার রোজগারের ওপর নির্ভর করে নেই কেউই। মরব একটা গ্রেট অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে। এখন যদি মনে করেন, সরে দাঁড়াতে পারেন— আমি একাই যাব।’
এ যে দেখছি উন্মাদের কাণ্ডকারখানা! সব শুনেও কিন্তু সটাসট প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না। আর একটু ভাবা দরকার। তাই সময় নিলাম।
বললাম, ‘যাওয়ার প্ল্যানটা কী?’
টেবিলের ওপর একটা চার্ট পিন দিয়ে আটকানো ছিল। ম্যারাকট তার ওপর কম্পাস রেখে যে জায়গাটা দেখালেন, সেটা ক্যানারিস-এর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে।
বললেন, ‘গত বছর এই জায়গাটার জল মেপেছিলাম। একটা বিষম গভীর গর্ত আছে— ঠিক এইখানে। পঁচিশ হাজার ফুট পর্যন্ত পেয়েছিলাম। প্রথম রিপোর্ট পাঠাই আমি। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতের ম্যাপে জায়গাটার নামকরণ হবে ‘ম্যারাকট ডিপ।’
‘সে কী! এই রকম একটা পাতালে আপনি নামতে চান নাকি?’
শুষ্ক হেসে বললেন ম্যারাকট, ‘আরে না। আধমাইলের বেশি তো যাবে না আমাদের বাতাসের নল অথবা নিচে নামানোর শেকল। এমন একটা গভীর নিতল খাদ সৃষ্টি করেছে আগ্নেয়গিরির শক্তি— বহু বছর আগে… নিশ্চয় খাঁজ খোঁদল সরু উপত্যকা আছে… যে জায়গাগুলো জলপৃষ্ঠ থেকে তিনশো ফ্যাদম গভীরতার গভীরে নিশ্চয় নেই।’
‘তিনশো ফ্যাদম! এক মাইলের তিন ভাগের একভাগ।’
‘আরে হ্যাঁ, মোটামুটি এক তৃতীয়াংশ মাইল। আমার এখনকার ইচ্ছে অনুযায়ী, সাগরতলের এই গভীরতায় নেমে যাব প্রেসার-প্রুফ খুদে পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ঢুকে থেকে— নেমে যাব সাগরতলের উপত্যকায়। যা পারি, তা-ই দেখে নেব। একটা কথা বলার নল থাকবে জাহাজ পর্যন্ত। নির্দেশ-টির্দেশ দেব সেই নলের মধ্যে দিয়ে। কোনও ঝামেলা নেই সে ব্যাপারে। টেনে তোলার ইচ্ছে যখন হবে, নলের মধ্যে দিয়ে তা বলে দেব।’
‘বাতাস?’
‘পাম্পে করে নামিয়ে দেওয়া হবে নিচে।’
‘কিন্তু সেখানে যে আলকাতরার মতো অন্ধকার।’
‘কথাটা নিঃসন্দেহে খাঁটি। জেনেভা লেক-য়ে ফোল আর সারাসিন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন, ওই রকম গভীরতায় অতিবেগুনি রশ্মি পর্যন্ত পৌঁছয় না। তাতে কী এসে গেল? জাহাজের ইঞ্জিন পাওয়ার ফুল ইলেকট্রিক আলো সাপ্লাই দেবে, সেই সঙ্গে বাড়তি জোগানদার থাকবে ছ-টা দু-ভোল্টের হেলেসেন্স ড্রাই ব্যাটারি। এর সঙ্গে থাকবে লুকাম আর্মি সিগন্যালিং ল্যাম্প— যে রিফ্লেকটর নড়ানো সরানো যাবে যদি দরকার হয়। আছে আর কোনও অসুবিধে?’
‘বাতাসের নল যদি জট পাকিয়ে গিঁট বেধে যায়?’
‘যাবে না। রিজার্ভ বাতাস হিসেবে থাকবে টিউবের মধ্যে চেপে ঢোকানো বাতাস, যাতে চলে যাবে চব্বিশ ঘণ্টা। সন্তুষ্ট তো? আসছেন অসম্ভবের এই অভিযানে?’
চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া কি সম্ভব? ব্রেনকে কাজ করতে হয়েছে ঝটিকা বেগে। কল্পনার ফানুসে মগজ ভরে গেছে। মনের ছবিতে দেখতে পেলাম কালো বাক্স নেমে গেছে আদিম গভীরতায়, যে বাতাসে দু-বার শ্বাস নেওয়া হয়ে গেছে— সেই বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস আর চলছে না; তারপর দেখতে পেলাম— দেওয়াল তুবড়ে দুমড়ে মুচড়ে ঢুকে আসছে ভেতর দিকে, জয়েন্টগুলো খুলে গেছে— হু হু করে জল ঢুকছে ভেতরে— পাশ থেকে, ওপর থেকে, নিচ থেকে; মৃত্যু হচ্ছে ধীরে ধীরে; বড় ভয়ানক বড় ধীরস্থির মৃত্যু। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম বৃদ্ধ প্রফেসর প্রদীপ্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে থেকে বিজ্ঞানের প্রগতির জন্যে শহীদের মতো মৃত্যু বরণ করছেন। তাতেই ওষুধ ধরে গেল। তাঁর চোখের আগুনে আমি প্রদীপ্ত হয়ে উঠলাম। লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে দু-হাত সামনে বাড়িয়ে দিলাম।
‘ডক্টর, শেষ পর্যন্ত আমি আছি আপনার সঙ্গে।’
‘জানতাম আপনি থাকবেন। আপনার উলটোপালটা জ্ঞানের জন্যে আপনাকে দলে টানিনি।’ একটু মুচকি হেসে— ‘সমুদ্রচর কাঁকড়া নিয়ে আপনার নিবন্ধের খাতিরেও নয়। এ ছাড়াও অন্যান্য কিছু গুণপনা দরকার— আনুগত্য আর সাহস।’
তেঁতো প্রসঙ্গ টেনে এনেও মিছরি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন প্রফেসর। আমার ভবিষ্যৎ রাখলেন নিজের মুঠোর মধ্যে, বাকি জীবনটা ধ্বংস হয় হোক, তা নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। শেষ বোট জাহাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তীরের দিকে, নিয়ে যাচ্ছে চিঠিপত্র। চাইছে সবার কাছে। তাই এই চিঠি তড়িঘড়ি লিখে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। মাই ডিয়ার ট্যালবট, তোমার কাছে আমার এই চিঠিই বোধহয় শেষ চিঠি। আর যদি আবার চিঠি পাও তাহলে জানবে সে চিঠি হবে পড়বার মতো চিঠি। যদি আর চিঠি না পাও তাহলে একটা ভাসমান সমাধি ভাসিয়ে দিও ক্যানারিস-এর দক্ষিণে কোথাও, তাতে যেন লেখা থাকে:
‘এইখানে, অথবা এই জায়গার ধারে কাছে কোথাও, রয়েছে বন্ধুবর সাইরাস জে. হেডলে-র মাছে ঠোকরানো দেহাবশেষ’।
***
এই কেসে দ্বিতীয় নথি যেটা এসেছিল, সেটা অতিশয় দুর্বোধ্য বেতার বার্তা— বেশ কয়েকটা জাহাজের মারফত। রয়্যাল ডাক জাহাজ আরোরা ছিল এই জাহাজগুলোর অন্যতম। সেটা পাওয়া গেছিল ১৯২৬ সালের তেসরা অক্টোবর বিকেল ৩ টের সময়ে। তাহলে এই বেতার বার্তা পাঠানো হয়েছিল নিশ্চয় ‘গ্র্যান্ড ক্যানারি’ ছেড়ে ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজ রওনা হওয়ার দু-দিন পরে, আগের চিঠির তারিখ অনুসারে, সময় আর তারিখ মোটামুটিভাবে মিলে যাচ্ছে নরওয়ে জাহাজ থেকে দেখা একটা দৃশ্যের সঙ্গে। বিশেষ সেই স্টিমার সাইক্লোনের কবলে পড়েছিল ‘পোর্টা ডি লা লাজ’ থেকে দু-শো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে একটা জায়গায়। বার্তায় যা লেখাছিল, তা এই:
‘রশ্মির শেষের দিকে ফেটে উড়ে গেল। ভয় হচ্ছে অবস্থা সুবিধের নয়। ম্যারাকট-কে এর মধ্যেই হারিয়েছি, হেডলে আর স্ক্যানলানকেও। পরিস্থিতি দুর্বোধ্য। হেডলে-র রুমাল গভীর সমুদ্রের তলদেশ মাপবার তারে। ঈশ্বর সহায়! এস এস স্ট্র্যাটফোর্ড।’
কপাল পোড়া জাহাজ থেকে সর্বশেষ পাওয়া দুর্বোধ্য বার্তা এইটাই। বার্তার কিছুটা অংশ এতই অদ্ভুত যে অপারেটরের মাথা বিগড়েছেমনে করে আমল দেওয়া হয়নি প্রলাপের মতো মেসেজটাকে। তবে, জাহাজটার কপালে যে অশেষ দুর্গতি ঘটেছে, এ ব্যাপারে আর সন্দেহ থাকেনি। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা। পাওয়া গেছে একটা স্ফটিক গোলক। গোলকের মধ্যে যে বার্তা ছিল, তার কোনও মাথামুন্ডু নাকি হয় না। ‘আরাবেল্লা নোলেস’ জাহাজের মাস্টার অ্যামোস গ্রিন জাহাজের লগ বুকে ঠিক যে রকমটি লিখেছিলেন, আমি তা হুবহু তুলে দিচ্ছি। এ জাহাজ কয়লা নিয়ে যাচ্ছিল কারডিফ থেকে:
‘বুধবার, ৫ জানুয়ারি, ১৯২৭। অক্ষাংশ ২৭.১৪, দ্রাঘিমা ২৮ পশ্চিম। আবহাওয়া প্রশান্ত। নীল আকাশে হালকা মেঘ নিচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। সমুদ্র কাচের মতন। দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়তেই মধ্য অবস্থানের ফার্স্ট অফিসার জানালেন, একটা চকচকে জিনিস দেখেছেন লাফিয়ে উঠল সমুদ্রের ওপর অনেকখানি উঁচুতে… তারপর ভেসে রইল জলের ওপর। প্রথমে ভেবেছিলেন, অদ্ভুত কোনও মাছ। দূরবীন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার পর বুঝলেন, জিনিসটা একটা রুপোলি গোলক, অথবা বর্তুল, খুব হালকা, তাই ঠিক যেন জলের ওপর পড়ে রয়েছে— ভাসছে, একথা বলা যায় না। আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল। গিয়ে দেখলাম জিনিসটাকে। ফুটবলের মতো বড়। আধমাইল দূর থেকে দেখছি, তবুও ঝকঝক চকচক করছে। জাহাজ থামানোর হুকুম দিলাম। সেকেন্ড মেট-কে বললাম কোয়ার্টার বোট নিয়ে গিয়ে গোলকটাকে তুলে আনতে। সে এনে দিল জাহাজের ওপর।
‘খুঁটিয়ে দেখলাম। খুব মজবুত কাচ দিয়ে তৈরি গোলক। ভেতরে ঠাসা আছে এমন কিছু যার জন্যে শূন্যে ছেড়ে দিলে গ্যাসভরতি বাচ্চাদের বেলুনের মতো ভেসে থাকে কিছুক্ষণ। স্বচ্ছ। ভেতরে পাকানো অবস্থায় কাগজ রয়েছে। ভীষণ মজবুত গোলক। মানে, গোলক যা দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই পদার্থ। ভাঙতে বেগ পেতে হয়েছিল। তারপরেই তো ভেতরকার কাগজপত্র বাইরে আনা গেছে। হাতুড়ি দিয়ে ঘা মেরে চিড় ধরানো যায়নি। চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইঞ্জিনের মধ্যে দিয়ে তবে ভাঙতে পেরেছেন, ভেতরকার রোলকরা কাগজ বাইরে আনতে পেরেছেন। তারপরেই সেই গোলক স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় জিনিসটার নমুনা সংগ্রহে রাখা গেল না। তবে কাগজগুলো পেয়েছি। পড়ে বুঝেছি, খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ঠিক করেছি, প্লেট রিভার-এ পৌঁছে ব্রিটিশ দূতাবাসে দেব। সমুদ্রে টহল দিচ্ছি পঁয়ত্রিশ বছর, এমন অদ্ভুত জিনিস কখনও পাইনি। আমার জাহাজি সাঙ্গপাঙ্গরা একমত আমার সঙ্গে। আমার চাইতে বিচক্ষণ ব্যক্তিদের জন্যে তোলা থাক গোটা ব্যাপারটা।
সাইরাস জে হেডলে-র বক্তব্য এইবার তুলে ধরা যাক হুবহু:
লিখছি কাকে? গোটা দুনিয়াটাকে সম্বোধন করা মানে সেটা হয়ে যাবে ভাসা ভাসা সম্বোধন। তার চেয়ে বরং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার জেমস ট্যালবটকে উদ্দেশ করা যাক। একটাই কারণে। আমার সর্বশেষ পত্র গেছিল তো তাঁর কাছেই। এই চিঠি সেক্ষেত্রে সেই চিঠির ক্রমশ ধারাবাহিকতা। জানি না, তাঁর কাছে পৌঁছোবে কি না। গোলকটা সূর্যের মুখ নাও দেখতে পারে। যদিও বা দেখে একটামাত্র দিনের জন্যে। তারপরেই পাশ দিয়ে যাওয়া কোনও এক হাঙরের পেটে প্রস্থান করতে পারে, অথবা হয়তো ঢেউয়ে নেচে নেচেই যেতে পারে কোনও নাবিকের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে। তাহলেও চেষ্টা করতে দোষ কী। ম্যারাকট মশায় নিজেও একটা ছাড়তে চলেছেন। দুটোর একটা যদি পৃথিবীর মানুষের হাতে পৌঁছোয়, তাহলেই তো সবাই জেনে যাবে আমাদের ওয়ান্ডারফুল কাহিনি। বিশ্বাস না করতে পারে, তাহলেও গোলক কী দিয়ে নির্মিত, এই নিয়েই তো ভাবনাচিন্তা গবেষণা শুরু হয়ে যাবে। স্ফটিক গোলক, ভেতরে লেভিজেন গ্যাস। এই থেকেই বুঝবে, ব্যাপারটা মামুলি নয়। ট্যালবট, তুমি অন্তত এই বিবৃতিকে কপোলকল্পিত বিবেচনায় ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করবে না।
এত কাণ্ডকারখানার সূচনাটা কী, তা যদি কেউ জানতে চান, অথবা কী করতে চাই আমরা এই বিষয়ে যদি কৌতূহলী হন, তাহলে যেন গত বছরের পয়লা অক্টোবর তোমাকে যা লিখেছিলাম পোর্টা ডি লা লুজ থেকে রওনা হওয়ার আগের রাতে, তাতে দয়া করে একটু চোখ বুলিয়ে নাও! কপালে কী দুর্গতি আছে, তা যদি ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারতাম সেই রাতে, তাহলে নৌকো চুরি করে নির্ঘাত চম্পট দিতাম জাহাজ থেকে। বলছি বটে, কিন্তু তারপরেই সিদ্ধান্ত নিতাম অন্য রকমের। থাকা যাক ডক্টরের পাশে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত। চম্পট দেওয়ার প্রাথমিক ঝোঁক কেটে গেলে ঠিক তা-ই করতাম। এই বিষয়ে আমার মনে নেই তিল মাত্র সংশয়।
যাক গে, গ্র্যান্ড ক্যানারি থেকে রওনা হওয়ার পর থেকে আমার অভিজ্ঞতাপর্ব লিপিবদ্ধ করে যাওয়া যাক।
বন্দর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনার আগুনে যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেন বৃদ্ধ ম্যারাকট মশায়। অবশেষে এসেছে কাজের কাজ করার সময়— বৃদ্ধের ভেতরকার মিইয়ে থাকা এনার্জিতে যেন ফুলকি ধরে গেল নিমেষের মধ্যে। চকিত চমকে গোটা জাহাজটাকে এনে ফেললেন মুঠোর মধ্যে। জাহাজের সব কিছু আর সব মানুষকে নুইয়ে আনলেন নিজের ইচ্ছের ছকে। সদা অন্যমনস্ক আত্মভোলা সেই মানুষটা যেন নিমিষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, সে জায়গায় এসে গেল একটা মানুষ বৈদ্যুতিক মেশিন, ফেটে ফেটে কেঁপে কেঁপে গেলেন প্রচন্ড মনের জোরে, ভেতরকার বিশাল চালিকাশক্তির দৌলতে। লণ্ঠনের শিখার মতো জ্বলে জ্বলে গেল তাঁর দুই চক্ষু চশমার কাচের আড়ালে। বিদ্যুৎ শিখার মতোই যেন একই সময়ে হাজির রইলেন সব জায়গায়, কখনও চার্ট ফেলে দূরত্ব মেপে গেলেন, কখনও ক্যাপ্টেনের সঙ্গে হিসেবের বচসা চালিয়ে গেলেন, বিল স্ক্যানলানকে মুহূর্তের জন্যেও স্থির থাকতে দিলেন না, আমাকে শখানেক কাজে ভিড়িয়ে দিলেন— সব কিছুর পেছনে রইল সুনির্দিষ্ট একটা প্রক্রিয়া— বিশেষ একটা শেষ। ইলেকট্রিসিটির ব্যাপারে অপ্রত্যাশিত জ্ঞানের বহর দেখিয়ে গেলেন, যন্ত্রপাতির ব্যাপারেও দেখা গেল তার জ্ঞান হেলাফেলার ব্যাপার নয়, বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে গেলেন স্ক্যানলান-এর সঙ্গে যন্ত্রপাতি সম্পর্কিত ব্যাপারে। নিজেই তদারকি চালিয়ে জোড়া লাগাতে লাগলেন কলকবজার টুকরো টাকরা অংশ।
দ্বিতীয় দিবসের প্রত্যুষে বিল বললে আমাকে, ‘আসুন, আসুন, দেখে যান ডক্টর কী জিনিস বানিয়েছেন।’
মনে হল যেন তাকিয়ে আছি আমার নিজের কফিনের দিকে। তা সত্ত্বেও মানতে হল, সমাধি পিঞ্জর হিসেবে জিনিসটা মন্দ নয়। মেঝের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হয়েছে চারদিকের চারটে ইস্পাতের দেওয়াল। প্রত্যেক দেওয়ালের মাঝে রয়েছে গোলাকৃতি পোর্টহোল বাতায়ন। মাথার ওপরকার ইস্পাতের চাদরে রয়েছে একটা চোরা দরজা— শোয়ানো দরজা— নিচে নেমে ভেতরে ঢোকবার জন্যে। আর একটা শোয়ানো দরজা রয়েছে পায়ের তলার মেঝেতে। ইস্পাতের এই খাঁচাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মাথার ওপরকার একটা খুব সরু, কিন্তু শক্তিশালী ইস্পাতের জাহাজি কাছি দিয়ে, যা জড়ানো রয়েছে একটা ড্রামে, খুলে বের করে দেওয়া যাবে অথবা গুটিয়ে টেনে নেওয়া যাবে একটা পাওয়ারফুল ইঞ্জিন দিয়ে— যে ইঞ্জিন থাকে গভীর সমুদ্রের জলযানে। স্টিলের এই কাছি লম্বায় আধ মাইল, রয়েছে ডেকের ওপরে রাখা মস্ত কাটিমে জড়ানো অবস্থায়। শ্বাসপ্রশ্বাসের রবারের নলও সেইরকম লম্বা, টেলিফোনের তার লাগানো রয়েছে এই কাছির সঙ্গে, রয়েছে ইলেকট্রিক আলোর তার যার মধ্যে দিয়ে জাহাজ ব্যাটারি থেকে কারেন্ট যাবে ইস্পাতের খাঁচার মধ্যে, এ ছাড়াও খাঁচার মধ্যে রয়েছে নিজস্ব স্বনির্ভর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা।
সেইদিনই সন্ধের সময়ে বন্ধ করে দেওয়া হল সমস্ত ইঞ্জিন। দিগন্তে দেখা গেল ঘন কালো মেঘ ঝড়ের সংকেত। নজরের সীমার মধ্যে ছিল একটাই জাহাজ— মাস্তুলে উড়ছিল নরওয়ে পতাকা, পাল গুটিয়ে নিল প্রভঞ্জনের সংকেত পেয়ে। সেই মুহূর্তে চারদিক ছিল বিলকুল প্রসন্ন অবস্থায়। গভীর নীল সমুদ্রে ছন্দে ছন্দে দুলে যাচ্ছিল ‘স্ট্র্যাটফোর্ড’ জাহাজ, বাণিজ্য বাতাসের দৌলতে মাঝেসাঝে এদিকে সেদিকে দেখা যাচ্ছিল সাদা ফেনা। আমার ল্যাবরেটরিতে এল বিল স্ক্যানলান। বেশ উত্তেজিত অবস্থায়। ভাবভঙ্গীতে ওর সেই স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া লক্ষণ দেখতে পেলাম না।
বললে, ‘মিস্টার হেডলে, খাঁচাটাকে জাহাজের খোলে নামিয়ে দেওয়া হল এখুনি! বস কি এর মধ্যে ঢুকে পাতাল দেখতে যাবেন নাকি? কী মনে হয় আপনার?’
‘যাবেন বইকী। আমিও যাচ্ছি সঙ্গে।’
‘পোকা আছে আপনাদের দু-জনেরই মাথার মধ্যে। এ রকম কাণ্ড কেউ করে? আপনারা শুধু দু-জনেই কেল্লা মেরে দেবেন, সেটি কিন্তু হতে দিচ্ছি না।’
‘এটা তো আপনার ব্যাপার নয়, বিল।’
‘কিন্তু আমি যে মনে করি, ব্যাপারটা আমারও বটে। আপনারা শুধু দু-জনে হিরো হবেন, সেটি হতে দিচ্ছি না। কলকবজা ঠিকঠাক আছে কি না, দেখতে পাঠাল মেরিব্যাঙ্ক। জলের তলাতেও ঠিকঠাক চলছে কি না, সেটাও তো দেখতে হবে আমাকে। ইস্পাতের কলকবজা যেখানে, বিল স্ক্যানলান সেখানে। আমার সঙ্গে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের মাথায় যদি পোকা নড়ে, তা সত্ত্বেও আমি আছি সঙ্গে।
এমন লোকের সঙ্গে তর্ক করা যায় না। তাই আমাদের ছোট্ট সুইসাইড ক্লাবে ভিড়ে গেল আর একজন। রইলাম শুধু হুকুমের অপেক্ষায়।
ফিটিং করতেই গেল সারারাত। পরের দিন সাতসকালে প্রাতরাশ সেরে নিয়েই ঢুকে গেলাম খাঁচার মধ্যে। অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে তৈরি হয়ে। জাহাজের খোলের নিচের যে দিকটা খুলে ফেলা যায়, ইস্পাতের খাঁচাটাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে। ওপরকার মেঝেতে শোয়ানো দরজা দিয়ে আমরা ঢুকলাম ভেতরে। তিনজনে ঢুকে যেতেই ক্যাপ্টেন হোয়ি আমাদের সঙ্গে অতিশয় কষ্টের সঙ্গে করমর্দন সেরে নিয়ে শোয়ানো দরজা বন্ধ করে দিলেন ওপর থেকে। স্ক্রু টাইট দেওয়া হল তার পরেই। খাঁচা নিচে নামিয়ে দেওয়া হল কয়েক ফুট, শাটার টেনে বন্ধ করে দেওয়া হল মাথার ওপর, কতখানি জল ঢুকে পড়েছে তা মেপে নিয়ে পরীক্ষা করা হলে সমুদ্রের উপযুক্ত আমরা কতটা। খাঁচা উতরে গেল সেই পরীক্ষায়। জল চুঁইয়ে ঢুকল না কোনও দিক দিয়েই। তারপরেই ঢিলে করে দেওয়া হলখোলের নিচের অংশ। আমরা ভেসে রইলাম জাহাজের নিচে জলের মধ্যে।
ঘরটা বাস্তবিকই বেশ ছোটখাটো আরামপ্রদ কক্ষ। অবাক হয়েছিলাম নির্মাণকর্তার অপূর্ব চাতুর্য আর বুদ্ধির দূরদৃষ্টি দেখে। আগে থেকেই ভেবেচিন্তে মেপেজুপে যেখানে যেটি দরকার সেখানে সেটি স্থাপন করা হয়েছে। বেশ গুছোনো ব্রেনের গুছোনো কাজ। বৈদ্যুতিক আলো তখনও চালানো না হলেও আধা-নিরক্ষীয় সূর্যের চাপা আলো গাঢ় সবুজ সমুদ্র জল ভেদ করে ইস্পাত কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করছিল চার দেওয়ালের চারটে গোল গবাক্ষ দিয়ে। ছোট ছোট কিছু মাছ সন্তরণের কায়দা দেখিয়ে যাচ্ছিল এ পাশে সে পাশে— সবুজ পটভূমিকায় রুপোলি রেখার মতন। ভেতরে, চৌকোনা ঘরের চারদিকের দেওয়াল জুড়ে পাতা ছিল সোফাসেট, গভীর সমুদ্রের গভীরতা মাপবার ব্যাথিমেন্ট্রিক ডায়াল, একটা থার্মোমিটার, আরও অনেক যন্ত্রপাতি— সারবন্দি সাজানো চার দেওয়ালের গা ঘেঁষে সোফা সেটের ঠিক মাথার ওপরে। সোফার নিচ দিয়ে গেছে সারবন্দি খানকয়েক পাইপ চেপে রাখা বাতাসের রিজার্ভ সাপ্লাই-এর জন্যে— দৈবাৎ যদি নলের মধ্যে দিয়ে বাতাস আসা বন্ধ হয়ে যায়, সেই দূরবস্থার প্রতিকার হিসেবে। টিউবগুলোর মুখ রয়েছে আমাদের মাথার ওপর দিকে। তার পাশেই ঝুলছে টেলিফোনের যন্ত্র। ইস্পাত কক্ষে বসে বসেই শুনতে পাব বাইরে থেকে ভেসে আসা জাহাজ ক্যাপ্টেনের বিষন্ন কণ্ঠস্বর।
সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম সেই মুহূর্তে— সত্যিই কি যাত্রার জন্যে প্রস্তুত?
অসীম সহিষ্ণুতা দেখিয়ে জবাবটা দিলেন ডক্টর— অবশ্যই। বহাল তবিয়তে রয়েছি প্রত্যেকেই। আস্তে আস্তে নামাবেন— রিসিভারের সামনে একজনকে সর্বক্ষণ রেখে দেবেন সব কথা যেন শুনতে পায়। কখন কী অবস্থায় আছি, বলতে বলতে নিচে নামব। একদম নিচে নেমে যাওয়ার পরেও, যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন যতক্ষণ না নির্দেশ পাঠাচ্ছি। কাছির ওপর খুব একটা ধকল যাবে না। তবে সমুদ্রপথের মাইল দুয়েক আস্তে আস্তে যাওয়াই ভালো, কাছিতে বেশি জোর লাগবে না। এবার নামিয়ে দিন।’
শেষ শব্দদুটো এমন চেঁচিয়ে বললেন যেন মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে ভদ্রলোকের। প্রকৃতই ক্ষিপ্ত! জীবনের চরম মুহূর্ত এসেছে বলেই অমন তারস্বরে চেঁচাতে পারলেন, এতদিন যে স্বপ্ন মনের মধ্যে চেপে রেখেছিলেন, এখন তা সফল হতে চলেছে। মুহূর্তের জন্যে আমার যদিও মনে হয়েছিল, মহাধুরন্ধর এক পাগলের পাল্লায় পড়েছি নিশ্চয়। বিল স্ক্যানলান-এর মনের মধ্যেও ঠিক এই ভাবনাটাই খেলে গেছিল বলেই আমার দিকে বিদ্যুৎ চাহনি নিক্ষেপ করে কাষ্ঠহাসি হেসেছিল। সেই সঙ্গে কপালে হাত রেখেছিল এমনভাবে, যার মানে দাঁড়ায় একটাই— যা আছে কপালে। কিন্তু ওই একবার আবেগের বিপুল বিস্ফোরণ দেখিয়েই ধাতস্থ হয়ে গেছিলেন আমাদের লিডার মশায়— ফিরে গেছিলেন ওঁর সেই বরাবরের সংযত ধীরস্থির ভঙ্গিমায়। পুঁচকে কক্ষের চারপাশের এলাহি বন্দোবস্ত দেখেই তো পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল, মাথা তাঁর কত ঠান্ডা, কত ভেবেচিন্তে হিসেবটিসেব করে এত যন্ত্রপাতি বানিয়ে যেতে পারেন, ভবিষ্যতের সব কথা আগেভাগে দূরকল্পনা দিয়ে যেন চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে। ভদ্রলোকের মনের শক্তির প্রশংসা না করে পারছি না।
এরপর থেকেই আমাদের মন চলে গেছিল নতুন পরিস্থিতির দিকে, ওয়ান্ডারফুল নতুন অভিজ্ঞতার দিকে। মুহূর্তে নব নব রূপে বিকশিত হয়ে যাচ্ছিল সেই অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতা। খুব আস্তে আস্তে সমুদ্রের গভীরে প্রবেশ করছিল ইস্পাতের খাঁচা। হালকা সবুজ রং পালটে গিয়ে এসে গেল গাঢ় জলপাই বর্ণ। সে রংও একটু একটু করে গাঢ় হতে হতে এসে গেল ওয়ান্ডারফুল নীল বর্ণ, খুবই ঝকঝকে গভীর নীল আস্তে আস্তে গাঢ় হতে গাঢ়তর হয়ে গেল ধূসর বেগুনে। নামতে লাগলাম আরও নিচে, আরও নিচে— একশো ফুট, দু-শো ফুট, তিনশো ফুট। সঠিকভাবে চালু রয়েছে সব ক-টা ভাল্ভ কবাটিকা একদিকে আঁটা ঢাকনি। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক— যেমনটা ছিল জাহাজের ওপরে থাকার সময়ে। আস্তে আস্তে ব্যাথিমিটারের কাঁটা আলোকময় ডায়ালের ওপর ঘুরে গিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে জলতলের কত গভীরে আমরা পৌঁছেছি। চারশো, পাঁচশো, ছ-শো। মাথার ওপর দিকে দুম করে চেঁচিয়ে উঠল একটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, ‘কী রকম বুঝছেন?’
‘ফাইন! এমন মজায় কখনও থাকিনি।’ জবাবটা বেশ চেঁচিয়েই দিলেন ম্যারাকট। চারপাশে এখন দেখছি নিষ্প্রভ ধূসর গোধূলি— যা দ্রুত নিশ্চিদ্র অন্ধকার হতে চলেছে। চিৎকার করে বললেন আমাদের নেতা, ‘থামা যাক এখানে!’ আর না নেমে ঝুলে রইলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাতশো ফুট গভীরে। সুইচ টেপার ক্লিক শব্দ শুনলাম। পরমুহূর্তেই ভেসে গেলাম ঝকঝকে সোনালি আলোয়, যে আলো চারপাশের জানলা দিয়ে ধেয়ে গেল বাইরে— আলোকিত করে তুলল অপরিচ্ছন্ন জলের অনেক দূর পর্যন্ত। পুরু কাচে মুখ ঠেকিয়ে বসে রইলাম আমরা, দেখে গেলাম এমন দৃশ্য যা কখনও কোনও মানুষ দেখেনি।
জলের কতটা গভীরে এসেছি, তা বুঝতে পারছিলাম চারপাশের মাছেদের দঙ্গল দেখে। গোলকের গা ঘেঁষে ভেসে যাচ্ছে আহাম্মকের মতো জালের পরোয়া না রেখে। এরপরেই দেখতে পেলাম জলতলের অদ্ভুত সুন্দর রাজ্য। স্রষ্টার লক্ষ্য যদি মানুষ সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় একটু অবাক হয়েই, জলতলে জীবের সাম্রাজ্য অনেক বেশি, বসতিও বেশি। শনিবার রাতের ব্রডওয়ে, সপ্তাহান্ত অপরাহ্নের লোমবার্ড স্ট্রিট এমন ভিড়ে গিজগিজ করে না, যেমনটা দেখলাম সেদিন চারদিকের চার গবাক্ষের মধ্যে দিয়ে। জলতলের যে জায়গাটায় মাছেরা হয় রংবিহীন, অথবা সুন্দর নীল রঙের ওপর দিকে আর রুপোলি রঙের নিচের দিকে— সে জায়গা আমরা পেরিয়ে এসেছি। দূর সমুদ্রের মীন মহাশয়দের সব রকমের বর্ণ আর আকৃতি, সুষমা আর সৌন্দর্য এখন দেখা যাচ্ছে। সূক্ষ্ম আকৃতির লেপ্টোকেফ্যালি অথবা ইল লার্ভা চকিত আলোকরশ্মির মতো টানা রেখায় ধেয়ে যাচ্ছে আলোকরশ্মির টানেলের মধ্যে দিয়ে। মুরোয়েনা-র মন্থর সর্পাকৃতি চেহারা, গভীর সমুদ্রের ল্যামপ্রে, গুটিয়ে পাকিয়ে দুমড়ে সরে সরে যাচ্ছে আলোক-টানেলের মধ্যে দিয়ে। তাদের সারা গায়ে খোঁচা খোঁচা কাঁটা, নির্বোধের মতো বদন বিস্তার করে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। কখনও ভেসে যাচ্ছে চ্যাপটা চোয়াড়ে কাটল ফিশ, অমানবিক পৈশাচিক চাহনি মেলে দেখে যাচ্ছে আমাদের; কখনও কখনও খোলা সমুদ্রের ক্রিস্টাল-স্বচ্ছ প্রাণিরা উঁকি মেরে দেখছে নির্বোধ এই সমুদ্র বিহারীদের, কখনও ফুলের মতো শোভা দেখিয়ে এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে সিসটোমা অথবা গ্লকাস। বিরাট একটা ঘোড়া ম্যাকারেল অথবা বিপুলাকৃতি ক্যারন্ক্স বর্বরের মতো ঠুকরে ঠুকরে যাচ্ছে ক্রিস্টাল গবাক্ষর কাচ, তারপরেই তার পেছনে চলে আসছে সাত ফুট লম্বা হাঙরের কালো ছায়া— ব্যাদিত মুখগহ্বরে নিমেষে টেনে নিচ্ছে নির্বোধকে। ডক্টর ম্যারাকট মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছেন, হাঁটুর ওপর নোটবই রেখে লিখে লিখে যাচ্ছেন, আর বৈজ্ঞানিক মন্তব্যের অস্ফুট বচন উগড়ে দিচ্ছেন মুখগহ্বর থেকে। এটা কী? এটা কী? হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিমোরা মিরাবিলিস— যেমনটা বলেছিলেন মাইকেল মার্স। কী আশ্চর্য? এ যে দেখছি লেপিডিয়ন— কিন্তু এক্কেবারে নতুন জাতের বলেই তো মনে হচ্ছে। ম্যাকরুরাস ম্যাকরুরাস দেখছেন তো মিস্টার হেডলে? জালে পড়লে যে রং দেখায়, এখানে দেখাচ্ছে অন্য রং।’ একবারই দেখলাম চমকে উঠতে। বিরাট একটা গোলমতন বস্তু বিপুল বেগে ধেয়ে গেল এক জানলা থেকে আর এক জানলায়, পেছনের লেজের কাঁপুনিতে জল নাড়িয়ে দিয়ে গেল, গবাক্ষর ওপর নিচের জল অনেক দূর পর্যন্ত। ডক্টরের মতন আমিও ভড়কে গেছিলাম। সমস্যার সমাধান জুগিয়ে দিল বিল স্ক্যানলান।
‘জন জুইনি… জন জুইনি… কাচে মাথা ঠুকে ঠাট্টা করে গেল আমাদের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে বুঝিয়ে গেল, আমরা আর নিঃসঙ্গ নই!’
তাল ঠুকে বললেন ম্যারকট, ‘তা-ই তো! তা-ই তো! প্লাসবাস লঙগিকডেটাস… নতুন জাতি। লেজখানা পিয়ানোর তারের মতো, নাকের ডগায় যেন এক ডেলা সিসে। দেখে নিন, মিস্টার হেডলে, দেখে নিন? ক্যাপ্টেন, সব ঠিক! আরও নামতে পারেন।’
ফলে, আরও নামলাম, আরও আরও। ইলেকট্রিক লাইট চালু করে দিলেন ডক্টর ম্যারাকট। ব্যাথিমিটারের প্রদীপ্ত ডায়াল ছাড়া ভেতরে এখন আলকাতরা কালো অন্ধকার। টিক টিক করে ঘুরে চলেছে ব্যাথিমিটারের কাঁটা। যত নিচে নামছি, কাঁটা তত ঘুরছে। দুলছি অল্প অল্প, এ ছাড়া গতিবেগ কিছু টের পাচ্ছি না বললেই চলে। ডায়ালের কাঁটার সঞ্চরণই শুধু জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের অতি ভয়াবহ কল্পনাতীত অবস্থান। এখন নেমে এসেছি এক হাজার ফুট নিচে।
নিঃশ্বাসের বাতাস বেশ ভারি হয়ে উঠেছে— নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ডিসচার্জ টিউবের ভাল্ভটায় তেল দিয়ে দিল স্ক্যানলান— বাঁচা গেল। দেড় হাজার ফুট নিচে নেমে থেমে গেলাম— প্রজ্বলন্ত আলোক বর্শা চারদিকে ছুটিয়ে দিয়ে মধ্য সমুদ্রে ভেসে রইলাম। বৃহদাকার কালচে বেশ কিছু আকৃতি সাঁ সাঁ করে ধেয়ে গেল সামনে দিয়ে। কিন্তু বুঝলাম না, তারা গভীর সমুদ্রের হাঙর, না, তলোয়ার মাছ। অন্য কিছু অজানা সাগর দানবও হতে পারে। তড়িঘড়ি আলো জ্বালিয়ে দিলেন ডক্টর। বললেন— এই গুলোই হচ্ছে আস্ত আপদ। এত গভীর জলে এমন সব প্রাণী আছে যাদের গুঁতো মৌচাকে গন্ডারের গুঁতোর সমান।’
শুনে তো গা হিম হয়ে গেল আমার।
স্ক্যানলান বললে, ‘তিমি নাকি?’
ম্যারাকট বললেন, ‘তিমি মহাশয়রা অনেক গভীরে যায়। গ্রিনল্যান্ডের একটা তিমি সোজা গোঁৎ মেরে এক মাইল নিচে চলে গেছিল। তবে, চোট না পেলে, ভয় না পেলে, অত নিচে তিমিরা অবতরণ করে না। যেটা গেল এইমাত্র, খুব সম্ভব সেটা দানব স্কুইড। এদের নিবাস জলের সব রকম গভীরতায়।’
‘স্কুইডদের গা খুব নরম হয়। গুঁতোক, কিস্যু হবে না। আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে যদি একটা স্কুইড মেরিব্যাঙ্ক-এর নিকেল ইস্পাত দাঁড়া দিয়ে ফুটো করে দেয়।
প্রফেসর বললে, ‘শরীর ওদের নরম তুলতুলে হতে পারে, তবে বড় সাইজের যে কোনও স্কুইড লোহার পাতও কেটে দু-টুকরো করে দিতে পারে। ঠোঁটের ঠোক্কর মেরে এক ইঞ্চি পুরু জানলা ফুটো করে দিতে পারে পার্চমেন্ট কাগজ ফুটো করার মতো।’
‘কী মজা?’ ফের নিচে নামতে নামতে সোল্লাসে বলেছিল বিল।
তারপর খুব আস্তে, খুব আলতোভাবে স্থগিত হয়েছিল আমাদের নিম্ন অবতরণ। এত আস্তে, এত নরমভাবে তলদেশ ছুঁয়েছিল যে প্রথম দিকে আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি— তারপর বুঝলাম যখন, দেখলাম কুণ্ডলী পাকিয়ে কাছি নেমে যাচ্ছে ক্রিস্টাল জানলার সামনের আলোর মধ্যে দিয়ে। দঙ্গল পাকিয়ে কাছি যদি এইভাবে ঢিলে হয়ে পড়তে থাকে তাহলে আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের টিউব ছিঁড়ে যেতে পারে। চেঁচিয়ে উঠেছিলেন ম্যারাকট। কাছি টেনে তুলে নেওয়া হয়েছিল ওপরে। ডায়ালের কাঁটা দাঁড়িয়ে আছে আঠারোশো ফুট জলতল গভীরতায়। আটলান্টিকের একদম নিচে এসে পড়েছি একটা মধ্য মহাসাগরীয় আগ্নেয় ভূ-শিরার ওপরে।