অণুবীক্ষণ – কুণালকিশোর ঘোষ
স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…। গানটা এইমাত্র শেষ হল। টিভির অ্যানাউন্সার পরের গানটার প্রথম কলি ঘোষণা করার ভিতরেই শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, উদাস। হুড়মুড় করে ছোটবেলাটা উঠে আসছিল? নাকি তিনি নিজেই দুড়দাড় করে ছোটবেলায় ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন?
মা! চেতলার সেই বিশাল ছাদ-এর ওপর তিন কামরার ফ্ল্যাট! সারা ছাদ ভরে মা কেমন বাগান করেছিল। বাবা হাসতে হাসতে মাকে কতবার যে বলত—এত ছাদ নয়। এ আমার গিন্নির ফুলছাদ। সন্ধেবেলায় আশ্চর্য একটা সোনালি রোদ্দুর মাখা থাকত আকাশে। গুঁড়ো গুঁড়ো বাতাস। কঁক বেঁধে চড়ুইপাখি নামত মায়ের ফুলছাদে। বাবা তখনও ফেরেনি। আমরা দু’বোন চুপটি করে মায়ের গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত সবই তো মায়ের ওই গুনগুনানি শুনেশুনেই শেখা।
পুরনো ছাদ, পুরনো ফুলের গন্ধ, পুরনো সন্ধেবেলার গানের স্মৃতি এই পুড়ে যাওয়া দুপুরকে ঠেলে ঠেলে দিয়ে কেমন করে যে এগিয়ে এল শ্রাবণী জানেন না।
শ্রাবণীর চোখ বোজা। বোজা দু’চোখের ওপর গোল গোল করে কাটা শশার টুকরো। দেওয়াল ঘড়িটা একটুক্ষণ সর সর একটা শব্দ করল—ঢং। তার মানে দেওয়াল ঘড়ির—একটা। আসলে এখন একটা সাত। পুরনো এই ঘড়িটা ঠিক টাইমই দেয়। তবে সাত মিনিট পিছিয়ে থেকে।
—আমরা এমনিই ভেসে যাই…। পরের গানটা শুরু হয়েছে। এই দুপুর বেলায় এমন গান। কে শোনে? ভাবতে ভাবতেই শ্রাবণীর মনে হল, আমি তো শুনছি। আমার মতো হাজারটা লোক নিশ্চয়ই শুনছে। কিন্তু…? টিভি চালিয়ে কেউ কি শুধু শোনে? দেখতে তো হবেই। কিন্তু আমি?
শ্রাবণীর হাসি পেল। তাকে এখন আধঘণ্টা দু’চোখের ওপর গোল করে কাটা শশার টুকরো রাখতেই হবে। ‘চোখের দু’পাশের কালিমা শশার ছোঁয়ায় উধাও’—পড়েছে। সেই বিখ্যাত রূপচর্চার বইতে।
—এ বড় কষ্টের। শ্রাবণী নিজেকে বললেন।—টিভি শুনব। দেখব না? এ হয় নাকি? রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…যখন শুনছিলাম তখনও শশা দিয়ে চোখ ঢেকে ছিলাম। কিন্তু এখন? এখন তো মায়ের গুনগুন করে গাওয়া সেই গানটা হচ্ছে। আলোর মতো হাসির মতো কুসুমগন্ধ রাশির মতো শুনতে শুনতে বোজা চোখেই পুরনো দিনের ছাদ থেকে নেমে এসে জানলার পর্দা ফেলা তার এই বেডরুমে ঢুকে পড়লেন।
শ্রাবণী জেগে জেগে চোখ বুজে রয়েছেন। তাই কোনও স্বপ্ন আসছে না। বোজা চোখের ভিতর অনেক ছবি উঠে আসছিল। অসংলগ্ন। পরম্পরাবিহীন সে সব ছবি। মা। ছাদ। ঝকবাঁধা চড়ুই-এর দল। তারপরই আবার শ্রবণা। মেয়ের কথা মনে আসতেই একপেশে এক হাসি ঠোঁটের কোণায় উঠে এল। নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পাওয়ার আগেই নিজের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিলেন। সেদিনের ন্যাপিতে জড়ানো শ্রবণা আজ আঠারো বছরের অনার্স পড়া লেডি। কি তরতর করে বছগুলো বয়ে গেল।
আজ অনেকদিন পর শ্রাবণী নিজেকে একটু ঝাড়পোেছ করার সময় পেয়েছেন। শ্রবণার মর্নিং কলেজ। দুপুরগুলো সবটাই তো মেয়ের। আয়নার সামনে একটু যে দাঁড়াবেন, তেমন সুযোগ তো নেই। আজ বলল, বন্ধুর কাছে নোটস নিতে যাচ্ছে। এই সুযোগে নিজেকে নিয়ে একটু…।
-নোটস্-এর নাম করে এই ভর দুপুরে বেরোল। সত্যিই নোটস্ তো? যা! কি সব ভাবছি। প্রেম করলে ও আমাকে ঠিকই বলবে। আজকালকার মেয়েরা অনেক ম্যাচিওরড। আমাদের মতো হাবুডুবু খাওয়া নয়।
হাবুডুবু শব্দটা কেন যে হঠাৎ উঠে এল! বোজা চোখের শ্রাবণী শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হচ্ছিলেন। সত্যিই তো তিনি হাবুডুবু খেয়েছিলেন। তাঁর সেই উনিশ কুড়ি বছর বয়সে। চেতলার সেই ছাদভরা বাগানওয়ালা ফ্ল্যাট। মা। বাবা। দু-বোন। আশুতোষ কলেজের মর্নিং সেকশন। সব একেবারে নিখুঁত। নিখাদ। হঠাৎ কি যে হল পুজোর শাড়ি কিনতে গেল বেহালাতে। শখের বাজারে থাকে মৌসুমী। হিস্ট্রি অনার্সের বেস্ট ছাত্রী শ্রাবণীর গলায় গলায়। ফোন করে বলল, চলে আয়। গড়িয়াহাটকেও বিট করেছে। কী কালেকশন! ভাবতে পারবি না।
শ্রাবণী শাড়ি দেখবে কি! শাড়ি দেখছে তো মা। শ্রাবণী দেখল, একদম পুঁচকে একটা ছেলে। লজ্জা লজ্জা মুখ করে ক্যাশ কাউন্টারে বসে রয়েছে। ওই নাকি মালিক। প্রেমে পড়ে গেল। হাবুডুবু খাওয়া প্রেম।
বিয়ে হয়েছিল। বাবাই দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলেন। সব নিয়ম মেনে। তারপর কিন্তু অনেকদিন আর কোন সম্পর্ক রাখেননি। শ্রাবণী মজুমদার যে নিজেকে শ্রাবণী সাহা বানিয়ে ফেলতে পারে এটা মা বাবার স্বপ্নে ছিল না।
শ্রাবণী তখন হাবুডুবুতে ডুবে আছে। একটা কথা বিয়ের রাত থেকেই বুঝতে পেরেছিল, অনিল সাহা খুব পোষমানা বর হবে। চাইতেই সব পাওয়াগুলো কেমন হাতের মুঠোয় উঠে উঠে এল। নিজের সংসার, নিজের বর, নিজের মেয়ে। সবটাই শুধু নিজের। নিজের ইচ্ছেমতো সবাইকে শুধু তৈরি করে নেওয়া।
বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেও খুব ঘন মুহূর্তে স্বামীর দৃষ্টি দেখে শ্রাবণী মনে মনে প্রীত হত। এমন মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়েছে যেন এটা কোনও অন্য গ্রহের বিস্ময়কর এক নারী শরীর। ভালো লাগত। খুব ভালো।
–কিন্তু এখন…? শ্রাবণী নিজেকে বললেন, এখন ও যেন কেমন অন্যমনস্ক। থেকেও যেন নেই। খ্যাক করে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু…। সেই পোষমানা ভাবটা কখন যেন মিইয়ে গেছে।
পর্দা ফেলা জানলার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মনখারাপের বাতাস এসে শ্রাবণীকে নাড়িয়ে দিতে চাইছিল। উড়িয়ে।সত্যিই তো…। শ্রাবণীর মনে হল। ইদানীং তো ও সেই মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে হামলে পড়ে না। কেমন যেন গুটিয়ে থাকা পুরুষ। দোকান বড় হয়েছে। কর্মচারী বেড়েছে। কাজ। ক্লান্তি। সবই বুঝলাম। তা বলে…। আমি কি বুড়িয়ে গেছি? কি করে? এখনও তো ক্যালেন্ডারের দিন মেপেই মাসে মাসে ঐটে হয়ে যায়। ও কি বুড়ো হয়েছে? যাঃ, ছেচল্লিশ কি একটা বয়স? পুরুষমানুষের ছেচল্লিশ কোনও বয়সই নয়। তবে…?
…এমনিই এসে ভেসে যায়… শেষ হল। শ্রাবণী বিছানা ছাড়লেন। চোখের ওপর সেঁটে দেওয়া শশার টুকরো দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। খুব হাল্কা, তৃপ্ত, গর্বিত একটা হাসি ঠোঁটের কোণ বেয়ে উঠে আসছিল—আমি এখনও চোখে পড়ার মতন। চোখের কোণে কালিমারা কোথায়? ওরা ওই গানের সঙ্গে বুঝি ভেসে গেছে। ভালো লাগল। খুব ভালো।
সেই ভালো লাগা নিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেছেন আর গুনগুন করছেন।—এমনিই এসে ভেসে যায়…।
কি ভেসে যায়? কোথায় ভেসে যায়? কেন ভেসে যায়? খেয়ালই করছেন না। গুনগুন করে ভাসিয়েই দিচ্ছেন। সেই গুনগুনানির ভেতর ফোন এল।
একটা হাঃ হাঃ চিৎকার। তারপরই স্ব কিছু অন্ধকার।
ওষুধের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল। শ্রাবণী জানেন না। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক দেখার আগেই দুটি যুবক এগিয়ে এসে কি কথা যে বলেছিল, শ্রাবণী তাও জানেন না। দুটো শব্দ কানে কিল মেরেই চলেছে, হার্ট অ্যাটাক। একটি নার্সের পিছনে পিছনে আই সি সি ইউতে ঢুকলেন। অনিলের চোখ বোজা নাকে নল। মাথার কাছে দেওয়ালে ছোট্ট টিভি সেট-এর মতো মনিটরিং মেশিনটায় দুটো সরু সরু লাইন ভাঙছেগড়ছে, ভাঙছেগড়ছে করতে করতে বাঁদিক থেকে বেরিয়ে ডান দিকে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
নার্সটি গোপন কথা বলার ঢঙ-এ ফিসফিসিয়ে বলল, বাইরে চলুন। শ্রাবণী ফ্যালফ্যাল করে আবার দেখলেন, শব্দ না করে টিভি সেট-এর মতো মনিটরিং মেশিন, নল গোঁজা নাক। বোজা চোখ। বেরিয়ে আসতে হল।
নার্স বলল, আর কেউ আসেননি? একা? শ্রাবণীর মাথা নাড়া দেখে কিছু বুঝতে পারল না। বলল, এই টুলটায় বসুন। এখন ভিজিটিং আওয়ার নয়। ঠিক আছে, বসুন, নার্স চলে গেল।
নার্স চলে যেতে শ্রাবণী একা হয়ে গেলেন। কী ভীষণ একা। বাইরে কি এখন ট্রামবাস চলছে? লোকের ভিড়? গা-পোড়া রোদ্দুর? এ জায়গাটা এমন কেন? শীত শীত করা নির্জনে। হাসপাতালটার নাম কি যেন? এন.আর.এস.। এখানে নিয়ে এল কেন? ছেলে দুটো কি যেন বলছিল, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া..। শিয়ালদা স্টেশন। শিয়ালদায় কি করছিল? শ্রবণা কোথায়? ও কি জানে না, ওর মায়ের কত বড় বিপদ? এই সময় তুই পাশে থাকবি না? কেমন মেয়ে?
শ্রাবণী কোনও পথ পাচ্ছিলেন না। চিন্তার সব পথগুলোর মাঝখানে কে যেন ‘নো-এনট্রি’ বোর্ড লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কান্না পাচ্ছিল। ভয় হচ্ছিল। নিদারুণ সেই অসহায়তাকে শ্রাবণী এক ঢোকে গিলে ফেললেন। এখানে ঘড়ি নেই। শ্রাবণী ঘড়ি পরে আসেননি। সময় যে কতটা বয়ে গেছে বুঝতেই পারলেন না।
দুড়দাড় করে শ্রবণা উঠে এল। পেছনে মল্লিকবাবু আর দোকানের দুজন কর্মচারী। শ্রবণা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা। শ্রাবণী সেই নার্সটির নকলে ফিসফিসিয়ে বললেন, আস্তে। জোরে কথা বলো না। তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক। নাকে নল গুঁজে শুয়ে রয়েছে। আমার সঙ্গেও কথা বলেনি।
শ্রবণা মাকে দেখল। যা বোঝবার নিজেই বুঝল। কথা বাড়ায়নি।
মাঝে মাঝে গম্ভীর মুখের এক একজন ডাক্তার আই সি ইউতে ঢুকে যাচ্ছেন। অনিলের মুখের দিকে এক পলক চেয়েই, খাটের সঙ্গে লাগানো চার্টটায় চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে আসছেন। অনিলের চোখের পলক পড়ছে না। একই ভাবে বোজা। কাঁচের জানালার এপাশ থেকে শ্রাবণী সব কিছুই লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন।
সন্ধের মুখে দুজন কমবয়সি ডাক্তার একসঙ্গে ঢুকলে, শ্রাবণী কেমন যেন সাহস পেয়ে তাদের পেছনে পেছনে ঢুকে পড়লেন। তারা বেরিয়ে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা ও কখন কথা বলবে? দুজন ডাক্তারই একসঙ্গে থমকে গেল। একজন বলল, কথা? বলবে? অপরজন বলল,–হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলবে। তবে এখন তো…।
মল্লিকবাবু অনেকদিনের কর্মচারী। সেই শশুরের আমল থেকে। অনিলকেই নাম ধরে ‘তুমি’ বলেন। এতক্ষণ পর এগিয়ে এসে বললেন—বৌমা, এবার তুমি ওঠো। আমরা সকলে তো রয়েছি। কাঁধের ব্যাগটা আমাকে দাও। আমি তোমাদের পৌঁছে। দিয়ে আসছি।
ব্যাগটা অনিলের। হাসপাতালে ঢোকার মুখে সেই ছেলে দুটো শ্রাবণীকে দিয়ে যায়।
‘ব্যাগটা আমাকে দাও’, শুনে শ্রাবণীর দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। দুহাত দিয়ে ব্যাগ জড়িয়ে ধরে তীব্র গলায় বললেন—না। না। আমার কাছে থাক।
অমন হিংস্র হয়ে ওঠার দরকার ছিল না। শ্রাবণী এখন বেখেয়ালি। হঠাৎ বোধহয় ভাবলেন স্বামীকে কেউ কেড়ে নিতে চাইছে।
মায়ের মুখ-চোখের অবস্থা দেখে শ্রবণা আজ এই ঘরে শুতে চেয়েছিল। শ্রাবণী বড় বড় করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,—ওমা! না, না, ঠিক আছে। কিছু হবে না। সারাদিন তোর এত ধকল গেল। যা, শুয়ে পড়।
মেয়ে আড়চোখে মাকে দেখল।—কোথায় যেন অঙ্ক মিলছে না। নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
শ্রাবণী নিজেও জানেন না। জানেন না? হয়তো জানেন। কিন্তু এ মুহূর্তে কোন কিছুই তো ঠিকঠাক কাজ করছিল না। শ্রাবণী তাই বুঝতেই পারলেন না, নিজেকে বড় বেশি একা পেতে চাইছেন। একদম একা।
ঘড়ির সর-সর। তারপরই ঢং ঢং করে দশটা বাজল। ঘড়ির শব্দে চমকে উঠেছিলেন। কী চুপচাপ! ঘরটা। এত শব্দে ঘোর কেটে গেল। দরজা খোলা। আলোটাও জ্বলছে। সেই জ্বলা আলোয় দেখলেন—ইস। এঁটো ব্যাগটা এখনও খাটেই রেখে দিয়েছি। অনিলের টিফিন নেওয়া কাঁধে ঝোলানো সেই ব্যাগটা।
অলস হাতে নামিয়ে রাখতে গিয়েও বুকের কাছে নিয়ে এলেন।—এমা! টিফিন কৌটো তে ভর্তি। খায়নি।
না খাওয়া টিফিন কৌটো। বার করলেন। একটা ঠোঙা।ঠোঙা আবার কিসের? আঙুরে ভরা ঠোঙা বেরিয়ে এল।—ভরা নয়তো। কে যেন অনেকগুলো
খেয়ে নিয়েছে। এই তো। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এখান ওখান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া। অনিল টিফিন না খেয়ে আঙুর খেয়েছে?
দুপুর দুটোর গরম রাত দশটায় অনেকটা নেমে এসেছে। মাথার ওপর বন বন করে ফ্যান ঘুরছিল। তাও…, শ্রাবণী দেখলেন, তাঁর গলা বেয়ে ঘামের একটা দাগ দরদর করে নেমে যাচ্ছে। হাত দুটো কি কেঁপে গেল? সেই কঁপা হাতে শ্রাবণী আবিষ্কার করলেন। ব্যাগের এক কোণে, গোপাল বড় সুবোধ ছেলের মুখ নিয়ে এক প্যাকেট কনডোম শুয়ে রয়েছে। পুরো প্যাকেট তো নয়। কেউ যেন একটা ছিঁড়ে নিয়েছে। একটা ভয়ংকর বরফের টুকরো শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ডে ঝাঁপটা মারল। ঝাঁপটা? না ছোবল। নিমেষের ভেতর সেই সাপের কিলবিলানি শ্রাবণীর পা থেকে মাথার স্নায়ু পর্যন্ত উঠে এসে, ক্লান্ত এই মহিলাকে অসাড় করে দিল।
—আঙুর! কনডোম! অনিল তো কোনদিন এসব জানত না। ফলের ভেতর, আম, পেঁপে আর সবেদা। এই তো খায়। কনডোম নিয়ে কত হাসাহাসি। পরতে গেলেই সময় নষ্ট। সেই লোকের ব্যাগে…। কে শেখাল?
শ্রাবণী কাঁদছেন। নিঃশব্দ। আকুল। সর্বস্বান্ত হওয়ার তীব্র ভয় মেশানো সেই কান্না। কী আশ্চর্য। শ্রাবণী বুঝতে পারছেন না কেন। তবুও এই নষ্ট মুহূর্তে টকটক করে কত সুন্দর সব ছবি উঠে আসছিল। বিয়ের আগের দোকানের সেই লাজুক অনিল। মায়ের ‘ফুলছাদ’ দেখে বলেছিল, এত উঁচু ছাদেও এমন বাগান হয়। এর পরে তো আকাশেও বাগান হবে। বেহালার অন্যতম আদি, ‘লক্ষ্মী শাড়ি সংসার’, বিয়ের পরপরই কেমন ‘শ্রাবণী শাড়ি এম্পোরিয়াম’ হয়ে গেল। যা চেয়েছি তাই হয়েছে। চাইতে তো হয়নি। না চাইতেই সব কিছু পেয়ে গেছে। তুমি যে বড় পোবমানা। আমার হিস্ট্রিতে অনার্স। তোমার কি অনিল? মনে আছে? কেমন মজার মুখ করে বলত,দোকান মালিক হব। আর হিসেব শিখব না? সেই জন্যেই তো পিতাঠাকুর পাশ কোর্সের বি.কম বানিয়ে দোকান ফিট করে দিল। তোমাদের বাড়ির জলখাবার আমার বিয়ের পরেই কেমন ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল! মনে পড়ছে? কি হল? বলো না। মনে পড়ছে? মনে পড়ছে।
একটা ‘গোঁ’-এর ভেতর থেকে এক কথা বারবার বলে চলেছেন। শ্রাবণীর কি খেয়ালে রয়েছে। অনিল এখন হাসপাতালের আই সি সি ইউতে? বাঁচবে কি বাঁচবে না ডাক্তাররাও জানেন না।
শ্রাবণীর খেয়ালই নেই। তিনি সেই তখন থেকে নিজের হেরে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়েই চলেছে। কার সঙ্গে? জানেন না। তবু এই লড়াই লড়ছে—আজ শশা দিয়ে শখের দাগ উঠিয়েছি। কার জন্যে। বল? কার জন্যে? তোমাকে ‘শ্রী’ থেকে ‘মিস্টার’-এ উঠিয়েছে কে? জান না? শুয়ার। বাটামাছের ঝোল না খেয়ে আঙুর খাওয়া হয়েছে? কার সঙ্গে রে? পোষমানা কুকুর? শ্রাবণী হাঁপালেন। শ্রাবণী কাঁদলেন। শ্রাবণী বোধহয় শুয়ে পড়লেন। দুঃখের কান্নার ভেজানো সেই সুখের বালিশ-এ। রাতের পর সকাল আসে। জাপানে আসে। সাইবেরিয়ায়। বেহালাতেও এসেছিল। বেহালার সকাল, সকাল সকাল এসে দেখল, শ্রাবণী দাঁতও মেজে একদম তৈরি।
শ্রবণা বলল, মা তুমি যাচ্ছ? আমি যাব? শ্রাবণী হাসলেন। সে হাসিতে আনন্দ মজা কিছু ছিল না। শুধু ক’খানা দাঁত বার করতে হয়, তাই। মুখে বললেন, অনার্স ক্লাশগুলো করে আয়। আমি তো থাকবই। মনে মনে খুব বিশ্রিভাবে হাসলেন। সেই খ্যানখেনে হাসির ভেতর, মনে মনেই বেরিয়ে এল, আমি তো যাচ্ছি সতীনের খোঁজে। মায়ের সতীন দেখতে তোর ভাল লাগবে?
শ্রবণা অনেকক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে কি যেন খোঁজবার চেষ্টা করল, খুঁজে পায়নি। আজ তিনদিন। শ্রাবণী আসেন। আই সি সি ইউ-এর বাইরে এই টুলটায় ঠায় বসে থেকে লক্ষ করেন, অনিলকে দেখতে কে এল। এসেছে অনেকে। তবে মহিলা বিশেষ নয়। যারা এসেছিল সবাই তো কাছের আত্মীয়া। আজ দুপুর বেলা হঠাৎ শ্রাবণী জানেন না কেন, সেই ছেলে দুটোর কথা খুবই মনে হল—-ওদের ঠিকানা রাখলেই হত। ওরাই তো ব্যাগ খুলে বাড়ি আর দোকানে ফোন করেছিল। আচ্ছা, কনডোম দুটো কি ওদের চোখে পড়েছিল? ওরা কি দেখেছে? অনিল যখন মাথা ঘুরে পড়ে যায় তখন কেউ ওর পাশে ছিল কি না? ইস বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এখন সতীনকে কোথায় খুঁজে পাই…? টুলের উপর চুপটি করে বসে, শ্রাবণী মনে মনে বকবক করেই চলেছেন।
শ্রবণা এসেছিল। বাবাকে দেখে গেছে।—সেই একই। মাকে ওঠাতে পারেনি। সন্ধ্যায় আবার আসবে বলে ফিরে গেছে। বিকেল শেষের আগে এক দঙ্গল এলেন। মহিলাই বেশি। শ্রাবণী এঁদের চেনেন না। শাড়িব্লাউজ মাখানো পারফিউমের গন্ধে হাসপাতালের ওষুধ গন্ধ উধাও। সবার পেছনে মল্লিকবাবু ধীর পায়ে উঠে এসে বললেন, এঁরা বেহালা বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিত্রি সব কমিটি মেম্বার। অনিলের কথা শুনে খুব শোক পেয়েছেন। ‘শোক’ কথাটা কানে যেতে শ্রাবণী সবার হাতের দিকে তাকালেন-যাক বাবা! সন্দেশ কিংবা রজনীগন্ধা আনেনি।
শ্রাবণী এক একজনের দিকে আড়চোখে চাইছে, মানে, এক একজন মহিলার দিকে। আর তৎক্ষণাৎ + চিহ্ন-সেঁটে দিচ্ছেন। এক দুই করে সবার গায়েই দেখলেন,—চিহ্ন আঁটা। কেবল একজনের গায়ে শ্রাবণী খুব অবাক হয়ে দেখলেন, বয়স বোঝা যাচ্ছে না। চল্লিশও হতে পারে। কিংবা কম। পুরুষ্ট গা হাত পা শুধু নয়, বেশ মোটার দিকে। সাদা শাড়ি-ব্লাউজ এর গা বেয়ে না দেখা একটা খাই খাই গন্ধ উঠে আসছিল। অনিলের খুব কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার ভেতর আড়ে আড়ে শ্রাবণীকেও দেখে গেলেন—আমার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছে নাকি? শ্রাবণী মনে মনে বিড়বিড় করলেন—ওই তো ছিরি। আমার এই স্লিম ফিগারের পাশে, ওই টপ মার্কা চেহারা। দাঁড়াতে পারবে? সাহস আছে বলতে হবে।
খুব গভীর গোপন চিন্তার ভেতরেই শ্রাবণী হঠাৎ হোঁচট খেলেন—স্লিম ফিগার। আমার? কিন্তু ওই স্লিম ফিগারকে তো অনিল ইদানীং তেমন করে চাইছিল না। তেমন করে কেন? চাইছিলই না তো। মুখে না বললেও, আমি কি বুঝিনি? আমাতে কি অরুচি এসেছিল। ‘অরুচি’ শব্দটা কোথা থেকে যেন একদলা বমি নিয়ে এল। শ্রাবণী এখন খুব শক্ত। এতটুকুও বমি না করে ড্যাবড্যাব চোখে দেখলেন, সাদা শাড়ি ব্লাউজের সারা গায়ে + চিহ্ন, + চিহ, আর + চিহ্ন।
হেরে যাবার কান্না কাদলেন। মনে মনে। অনেকক্ষণ ধরে।
এখন অনেক রাত। গভীর রাতে গোপন কান্নারা খুব সহজে বেরিয়ে আসে। শ্রাবণীর বেলায় তেমন কিন্তু হল না। হাসপাতালেই কান্নার কোটা বোধহয় শেষ করে এসেছেন। সেই শেষ বিকেল থেকেই ভেবেছিলেন, লুকোনো সতীন এতক্ষণ পাকড়াও হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। + চিহ্ন মার্কা সাদা শাড়ি বেশ ভালো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দুটো হাত ধরে কেমন বললেন, শ্রাবণী দেখা হল। কিন্তু বড্ড অসময়ে। অনিলদা ভালো হয়ে উঠুক। তোমাদের আমি বোয়াল মাছের পাতুরি খাওয়াব। খেয়েছ? কোন ভয় নেই। তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। এমন মেয়েকে বেশি দিন কষ্ট পেতে হবে না। চলি। ভালো থাকবে। খুব ভালো।
সতীন খোঁজার সব রাস্তাগুলোই বন্ধ। কোন মেয়ে কি সতীন হতে চায়? কেউ নয়। কেউ নয়। মেয়েরা তো মেয়ে। অনেক ঘেরাটোপ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে।
সেই ঘেরাটোপ খুলে একদিন তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। চেতলার ‘ফুলছাদ’ থেকে বেহালার একতলার বাড়িতে। অনেকগুলো সিঁড়ি নামতে হয়েছিল। কম বয়সের উচ্ছাসে নেমে আসাটা সেদিন চোখে পড়েনি। বেহালার বাড়িও ধীরে ধীরে তিলা করেছিলেন। এখানেও ফুল ফুল সবই আছে। তবে…, আজ এই বয়সে এসেও শ্রাবণীর মনে হল,—ওগুলো বোধহয় প্লাস্টিকের নকল ফুল। জাঁক আছে। কিন্তু ফুলের হৃদয়ের গন্ধ কোথায়? চারপাশ ঘিরে যা কিছু করেছি সবটাই কি এমন হৃদয়হীন? জাঁকসর্বস্ব। তা না হলে…।
অনেক কান্না, অনেক হেঁচকি। কতবার নাক মোছার পর শ্রাবণী দেখলেন, ড্রেসিং টেবিলটার একেবারে যা তা অবস্থা। এখানে ওখানে ছেঁড়া কাটা চুল। আবছা ঝুল। সারা ড্রেসিং টেবিলটা জুড়ে একটা নোংরা আস্তরণ। একবার ভাবলেন, পরিষ্কার করবেন। কিন্তু না, থাক। কি হবে? ভাবতে ভাবতে কি যেন চোখে পড়ল।ওগুলো কি? কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন। গোল গোল করে কাটা দু’টুকরো শশা। আধপচা, প্রায় শুকনো শশার টুকরো দুটো আরও গোস্লা পাকিয়ে গেছে। ঠিক যেন দুটো পচা চোখ।
অনের রাতের অনেক কান্নার শেষে, হাতের তেলোয় ধরা গোল্লা পাকানো শশা দেখতে দেখতে শ্রাবণী ফিসফিস করে নিজেকে বললেন,—এমন পচা চোখ নিয়ে সতীন খুঁজে বেড়াব? মা গো!
রাত বয়েই যাচ্ছিল।