অণুনাটিকা
দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বসু রোড নিবাসিনী শ্রীমতী স্নিগ্ধা দাশগুপ্তা নাম্নী এক মহিলা, আমাকে কিছুদিন আগে ফোন করেছিলেন।
স্নিগ্ধা দেবীর উদ্দেশ্য মহৎ। তিনি হাসির গল্প লেখা শিখতে চান। সেই জন্য তিনি আমার সাক্ষাৎ প্রত্যাশিনী, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে জেনে নিতে চান কী করে হাসির গল্প লিখতে হয়।
হাসির গল্প নামক মার্কামারা রচনা লেখারও যে একটা শেখার ব্যাপার আছে, এ কথা আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। হাসির কথা যখন যে রকম মনে হয়েছে লিখেছি। কখনও কখনও শুনে বা পড়ে আবার নেহাত খারাপ ছাত্রের মতো অন্য কোনও বই থেকে বেমালুম টুকে লোক হাসাতে চেষ্টা করেছি।
এ ধরনের হাবিজাবি লেখার লোক বিশেষ নেই বলে, সম্পাদক মহোদয়েরা গম্ভীর মুখে, নিতান্তই অপারগ হয়ে, সেগুলো গ্রহণ করেছেন। আর কম্পোজিটর এবং প্রুফ রিডারবাবুরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, ‘যেমন হাতের লেখা, তেমনই রসিকতার ছিরি।’
এর পরেও গোমড়ামুখো, বিদ্যাবুদ্ধি ভারাক্রান্ত পাঠকেরা কেন যে এসব লেখা পড়েছেন, কেন যে হাজার গোঁজামিল দেয়া প্রকাশকেরা বই করে ছেপেছেন সব রহস্য আমার জানা নেই।
শ্রীমতী স্নিগ্ধা দাশগুপ্তের ফোন পাওয়ার পরে আমার মনে হল, সত্যিই তো উপযুক্ত বয়েসে যদি উপযুক্ত মানুষের কাছে আমি হাসির গল্প লেখাটা ঠিকমতো শিখতে পারতাম, কত ভাল হত।
আমি যখন লেখার মকশো শুরু করি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে সেই পঞ্চাশ-ষাটের যুগে সেই সময় শিবরাম চক্রবর্তী এবং পরশুরাম দু’জনাই জীবিত ছিলেন। দু’জনকেই অল্প বিস্তর চিনতাম। শিবরামের সঙ্গে তো বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল। কিন্তু তাঁদের কাউকে সাহস করে বলে উঠতে পারিনি, ‘হাসির গল্প লেখাটা একটু শিখিয়ে দেবেন?’ আসলে এ রকম কোনও বুদ্ধি মাথায় খেলেইনি।
শ্রীমতী দাশগুপ্তকে ধন্যবাদ, তিনি আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছেন। কিন্তু এই ষাট বছর বয়েসে গুরু পাব কোথায়? আর তেমন গুরু পেলেও আমার মতো অজ মূর্খ, শুষ্ক কাউকে তিনি শিষ্য গ্রহণ করবেন কেন?
বলা বাহুল্য, শ্রীমতী দাশগুপ্তের বিষয়ে আমার মনের মধ্যে প্রবল কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তদুপরি হাসির গল্প লেখা শেখা বলতে তিনি কী বোঝেন, সেই শিক্ষার পাঠক্রম কী হবে বা হওয়া উচিত সেসব নিয়েও শ্ৰীমতীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আছে। তবে তাঁকে বলেছিলাম, এখন একটু ব্যস্ত আছি, পুজোর লেখার মরশুম চলছে, তিরিশে জুনের পর আপনার সঙ্গে বসব। তিনিও সানন্দে রাজি হয়েছিলেন।
দুঃখের বিষয়, শ্রীমতী দাশগুপ্ত ইতিমধ্যে আরও দুবার ফোন করেছেন। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে এই ‘কী খবরে’ দুটি অণুনাটিকা পেশ করেছিলাম। স্নিগ্ধা দেবী আমাকে বলছেন, হাসির গল্পের চেয়ে এই রকম অণুনাটিকা ঢের ভাল, এই রকম অণুনাটিকা যেন বেশ কয়েকটা লিখি। উপরোধে ঢেঁকি গেলার একটা ব্যাপার আছে, এবারের অণুনাটিকাগুলি প্রায় তাই।
এক
স্থান: একটি থানার মধ্যে দারোগাবাবুর সামনে এক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন।
ভদ্রলোক: স্যার, গতকাল আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে আমার স্ত্রী পালিয়ে গেছেন।
দারোগাবাবু (ডায়েরি লিখতে লিখতে): আপনার বন্ধুর নাম বলুন।
ভদ্রলোক: তা জানি না। নাম বলতে পারব না।
দারোগাবাবু (ডায়েরি লেখা বন্ধ করে): তবে যে বললেন, ‘আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু’।
ভদ্রলোক: সে তো ঠিকই বলেছি। শ্রেষ্ঠবন্ধু না হলে আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, আমার স্ত্রীর হাত থেকে আমাকে বাঁচাবে?
দুই
স্থান: একটি চুল কাটার সেলুন। অন্যান্য ক্ষৌরকারেরা বিভিন্ন খদ্দেরের চুল, দাড়ি কাটতে ব্যস্ত রয়েছে। এমন সময় কোট-প্যান্ট-টাই পরা এক ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক দাড়ি কামাতে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের খুব তাড়াতাড়ি থাকায় সেলুনের শিক্ষানবিশ নাবালক ক্ষৌরকারটি তাঁর দাড়ি কামানোর হাত দিল।
শিক্ষানবিশ (অল্প কিছুক্ষণ দাড়ি কামানোর পরে): স্যার, আপনার নেকটাইটায় কি নীল স্ট্রাইপের মধ্যে লাল ফোঁটা-টোঁটা আছে?
ভদ্রলোক: না। শুধু নীল স্টাইপ। লাল ফোঁটা আবার দেখছ কোথায়?
শিক্ষানবিশ: (দাড়ি কামানো থামিয়ে) তা হলে সর্বনাশ হয়েছে স্যার।
ভদ্রলোক: কীসের সর্বনাশ? এসব কী বলছ তুমি? ও কী? দাড়ি কামানো বন্ধ করলে কেন, তাড়াতাড়ি হাত চালাও।
শিক্ষানবিশ: আমি আর হাত চালাতে পারব না স্যার। আপনার গাল আমি সাংঘাতিক কেটে ফেলেছি। আপনার নেকটাইয়ের নীল স্ট্রাইপ লাল ফোঁটায় ভরে গেছে।
তিন
স্থান: একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার অফিস ঘর। টেবিলের ওপরে টেলিফোন বাজছে। বড়দিমণি ফোন ধরলেন।
বড়দিমণি: হ্যালো, হ্যালো।
টেলিফোনে কচি কণ্ঠস্বর: কে, বড়দিমণি বলছেন?
বড়দিমণি: হ্যাঁ, বলুন।
টেলিফোনে কচি কণ্ঠস্বর: ক্লাস টুয়ের সায়ন্তনী চক্রবর্তীর খুব জ্বর হয়েছে, সে আজ স্কুলে যেতে পারবে না।
বড়দিমণি: আপনি কে বলছেন?
টেলিফোনে কচি কণ্ঠস্বর: আমি মা বলছি।
বড়দিমণি: মা?
টেলিফোনে কচি কণ্ঠস্বর: হ্যাঁ, আমি আমার মা বলছি।
পুনশ্চ:
এক
বড়সাহেবের ঘর। ছোটবাবু একটি দরখাস্ত হাতে করে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। বড়সাহেব ব্যস্তভাবে নথি দেখছিলেন, হঠাৎ মুখ তুলে ছোটবাবুকে দেখলেন।
বড়সাহেব: কী ব্যাপার।
ছোটবাবু: (হাতের দরখাস্ত বড়সাহেবের সামনে পেশ করে) স্যার, এই একটি ছুটির আবেদন।
বড় সাহেব: এই তো সাতদিন ছুটি কাটিয়ে এলেন বিয়ে করার জন্যে। আবার ছুটি?
ছোটবাবু: ওই স্যার, একটু হানিমুনে যাব, সেই জন্যে যদি কয়েকদিন ছুটি পেতাম।
বড়সাহেব: কয়দিন ছুটি চাই?
ছোটবাবু: (বিনীতভাবে, হাত কচলাতে কচলাতে) সে স্যার আপনিই ঠিক করে দিন।
বড়সাহেব: কী করে ঠিক করব? আমি তো আপনার স্ত্রীকে দেখিনি, কী করে বুঝব হানিমুনে ক’দিন লাগবে।
দুই
স্থান: মধ্য কলকাতার, একটি হোটেল।
খদ্দের: (রাগত ভাবে) বেয়ারা এটা কী দিয়েছ?
বেয়ারা: মাংসের ঝোল স্যার।
খদ্দের: এটা মাংসের ঝোল? এটা তো মুখে তোলা যায় না। যাও তোমার ম্যানেজারবাবুকে গিয়ে ডেকে নিয়ে এসো।
বেয়ারা: তাতে কোনও লাভ হবে না, স্যার।
খদ্দের: (চটে গিয়ে) কেন?
বেয়ারা: (বিনীতভাবে) ম্যানেজারবাবুও এ মাংস খেতে পারবেন না, স্যার।
তিন
স্থান: দন্ত চিকিৎসকের চেম্বার। ডাক্তারবাবু রোগীর দাঁত তুলতে উদ্যত।
রোগী: (পাগলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে) ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে!
ডাক্তারবাবু: আপনি এমন সাংঘাতিক চেঁচাচ্ছেন কেন, আমি তো এখন পর্যন্ত আপনার দাঁতে হাত দিইনি।
রোগী: দাঁত নয়, দাঁত নয়।
ডাক্তারবাবু: তবে?
রোগী: আপনি আপনার জুতোর গোড়ালির নীচে আমার বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুলটি থেঁতলে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁত তোলার নিকুচি করেছে। আপনি ভাল চান তো এখনই আমার পায়ের ওপর থেকে জুতো সরান।