অড অ্যান্ড দ্য ফ্রস্ট জায়ান্টস

অড অ্যান্ড দ্য ফ্রস্ট জায়ান্টস

চিত্রাঙ্কন – ব্রেট হেলকুইষ্ট
উৎসর্গ – ইমেলিন আর লিন্নেমাকে

অধ্যায় এক – অড

এক ছিল বালক, নাম ছিল তার অড। নামটা শুনতে এখন অদ্ভুত লাগারই কথা। কিন্তু যে সময় আর যে জায়গার কথা বলছি, সেটা হিসাব করলে—নামটা খুবই সাধারণ। অড শব্দটার অর্থ-তলোয়ারের অগ্রভাগ। ভাইকিংদের কাছে নামটা সৌভাগ্যময়।

নাম অদ্ভুত না হলেও, ছেলেটা কিন্তু সে অদ্ভুত। অন্তত, গ্রামবাসীরা তাই মনে করত। ও আরেকটা কথা-নামটা সৌভাগ্যময় হলেও, ছেলেটার কপাল কিন্তু ছিল মন্দ।

দুই বছর আগে, সমুদ্রে গিয়ে তার বাবা আর ফিরে আসেনি। অডের বয়স তখন মাত্র দশ। অনেকেই সমুদ্রে মারা যায়। কিন্তু, ওর বাবার কপাল মন্দ। ভাইকিংদের মতে গৌরবের মৃত্যু হলো যুদ্ধ করতে করতে মারা যাওয়া। অথচ সে মারা গিয়েছে জাহাজ থেকে পানিতে পড়া এক ছোট ঘোড়াকে বাঁচাতে গিয়ে!

ঘোড়াগুলো ছিল ভারবাহী। ভাইকিংরা যেসব সোনা-দানা, খাবার আর অস্ত্র লুট করত, সেগুলোকে জাহাজ পর্যন্ত বয়ে নেবার কাজে ব্যবহৃত হত এই ঘোড়াগুলো। সত্যি বলতে কি, যে কোন ভাইকিং জাহাজের সবচেয়ে দামী আর পরিশ্রমী প্রাণী হলো এই ঘোড়া। ওলাফ দ্য স্ট্রং, এক স্কটসম্যানের (স্কটল্যাণ্ডের অধিবাসী ভাইকিং) হাতে নিহত হবার পর, অডের বাবার ঘাড়ে ঘোড়াগুলো দেখে রাখার ভার পড়ে। ঘোড়া পালার ব্যাপারে কিন্তু তার খুব একটা অভিজ্ঞতা ছিল না। পেশায় সে ছিল কাঠুরে, তবে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। ফেরার পথে, ওর্কনি দ্বীপের কাছে আসতেই, হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইতে শুরু করে। জাহাজের দুলুনিতে তাল সামলাতে না পেরে, পানিতে পরে যায় একটা ঘোড়া। বাবা একটা দড়ি নিয়ে ধুসর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যান্য ভাইকিংদের সাহায্য নিয়ে টেনে তোলে ঘোড়াটাকে।

পরের দিন সকালে ঠাণ্ডা, ভেজা জামা আর ফুসফুস ভর্তি পানি নিয়ে মারা যায় সে।

নরওয়ে ফিরে এলে, জাহাজের অন্যান্যরা অডের মাকে সব জানায়। অডের মা জানায় অডকে। অড শুধু কাঁধটা একটু ঝাঁকায়, কাঁদেনি সে; কোন কিছু বলেওনি।

অডের মনের ভেতরে কী চলছিল, তা কেউ জানতে পারেনি। কেউ বুঝতে পারেনি ওর ভাবনা। আর অডের গ্রামের মতো একটা গ্রামে, যেখানে সবাই সবার সবকিছু জেনে যায়, ব্যাপারটা বিরক্তিকর। ওদের গ্রামটা একটা ফিয়র্ড (বরফের গ্লেসিয়ার দিয়ে পরিবেষ্টিত সামুদ্রিক খাঁড়ি)-এর মাঝে অবস্থিত।

তখনকার দিনে কেউ পুরো সময় ভাইকিংগিরি করত না। সবারই অন্য কোন না কোন পেশা ছিল। জাহাজে করে অভিযানে যাওয়া—তখনকার লোকরা হয় আনন্দের জন্য করত, আর নাহয় গ্রামে পাওয়া যায় না এমন জিনিস খুঁজে বের করার জন্য। অনেকে তো অভিযানে গিয়ে স্ত্রী পর্যন্ত খুঁজে নিত। অডের মাকে, যে-কি না এতটাই কালো যতটা ফর্সা ছিল অডের বাবা, স্কটল্যাণ্ড থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল। সে অনেক দিন আগের কথা। বাবা ওর মাকে দেখতে পেয়ে, হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল ছুরি। এরপর কাঁধে ফেলে নিয়ে এসেছিল এখানে। অড যখন ছোট ছিল, তখন মা ওকে গান গেয়ে শোনাত। স্কটল্যাণ্ডের গান, অপহৃত হবার আগে শেখা।

অডের মাঝে মাঝে মনে হত, মা বোধহয় স্কটল্যাণ্ডকে মিস করে। কিন্তু, জিজ্ঞেস করলে উত্তরটা সব সময় না-ই হত। মা বলত, খুব একটা না। তবে মাতৃভাষায় কথা না বলতে পারা তাকে কষ্ট দেয়। এখন নর্স-ভাষায় কথা বলতে পারে সে, কিন্তু টান একটা রয়েই যায়।

বাবা কুড়াল হাতে জাদু দেখাতে পারত। ফিয়র্ডের পিছনের ছোট্ট বনটাতে নিজ হাতে একটা কুটির বানিয়েছিল সে। কখনও কখনও এক সপ্তাহের জন্য বনে হারিয়ে যেত। ফিরে যখন আসত, তখন ওর সাথে থাকত ইয়া লম্বা কাঠ ভর্তি গাড়ি। অডরা সবকিছু কাঠ দিয়ে বানাত। এমনকি দূরপাল্লার যাত্রার জন্য কাঠের যে জাহাজটা তৈরি করত, তাতেও ব্যবহার করত কাঠের কীলক। কাঠের তৈরি কীলক দিয়ে গাঁথা কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো কাঠের কুটিরে বাস করত ওদের গ্রামের সবাই। শীতকালে, যখন তুষারপাতের কারণে যাতায়াত করা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ত, বাবা তখন আগুনের ধারে বসে কাঠ কাটত। বিভিন্ন খেলনা বানাত, পানীয় পানের পাত্র বানাত, খাবার রাখার হাড়ি-পাতিলও বাদ পড়ত না। আর বানাত মূর্তি, কী অসম্ভব সুন্দরই না ছিল ওগুলো! অডের মা বসে বসে সেলাই করত… আর গান গাইত।

খুব সুন্দর গলা ছিল তার।

অড গানের কথা বুঝতে পারত না। তবে, গান গাওয়া শেষ হলে মা কথাগুলোর অর্থ ওকে বোঝাত। গানের কথা বুঝতে পেরে, আরও মুগ্ধ হয়ে যেত অড। মাথায় ঘুরত বীর যোদ্ধাদের কথা। তাদের তেজী ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যাবার কথা। হাতের কব্জিতে চিল আর পায়ের কাছে ভয়ংকর শিকারি কুকুর নিয়ে অভিযানে বেরোবার কথা। তাদের একের পর এক দৈত্য নিধন আর দুষ্টের দমনের গল্প-গাথা মাথায় নিয়ে ঘুমাতে যেত সে।

বাবা মারা যাবার পর, মায়ের গান গাওয়া কমে এল।

তবে অড ওর হাসি থামায়নি। কিন্তু কেন জানি, গ্রামবাসীরা ওর এই হাসি সহ্যই করতে পারত না। এমনকি, দুর্ঘটনায় ওর ডান পা খোঁড়া হয়ে যাবার পরও অডের মুখে হাসি লেগেই রইল।

সেটা বাবার লাশ নিয়ে জাহাজ ফিরে আসার তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। বাবার কাঠ কাটার কুড়ালটা কাঁধে নিয়ে, অড রওনা দিল বনের দিকে। যদিও কুড়ালটা এত ভারী যে, সেটা তুলতেই ওকে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। তবে মনে বিশ্বাস ছিল, এত দিনে গাছ কাটা সম্পর্কিত সব কিছু সে শিখে ফেলেছে। এখন কেবল কাজে লাগাবার অপেক্ষা।

তবে সম্ভবত, আর পেের মায়ের কাছে কথাটা স্বীকারও করেছে, তার উচিত ছিল আরও ছোট কুড়াল ব্যবহার করা। সেই সাথে উচিত ছিল প্রাকটিসের জন্য আরও ছোট গাছ বেছে নেয়া।

তাও বিপদের মুখে পড়ে সত্ত্বেও অসাধারণ কাজ করেছিল অড।

সেবার গাছটা এসে পড়েছিল ঠিক ওর পায়ের উপর। কিন্তু অড ঘাবড়ায়নি। কুড়ালটা ব্যবহার করে আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেলেছিল পায়ের নিচের মাটি। এরপর কোন রকমে পা-টাকে বের করে নিয়ে, গাছেরই একটা ডাল ব্যবহার করেছিল ক্র্যাচ হিসাবে। পায়ের সবগুলো হাড় ভেঙে যে টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল, সেটা সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। কীভাবে কীভাবে যেন বাড়ি ফিরতে পেরেছিল সে। এমনকি ওর বাবার কুড়ালটাও ফেলে আসেনি। কেননা ওসব এলাকায় ইস্পাত খুবই দুর্লভ। আর ওর বাবাটার মতো কুড়াল হয় ব্যবসা করে কিনতে হত, আর না হয় চুরি করতে হত। এত দামী জিনিসটাকে তো আর মরিচার শিকার হতে দেয়া যায় না!

সে ঘটনারও দুই বছর পরের কথা, অডের মা ফ্যাট অ্যালফ্রেড (মোটা অ্যালফ্রেড)-কে বিয়ে করল। অবশ্য মদ পান না করলে ফ্যাট অ্যালফ্রেড বেশ শান্ত শিষ্ট আর আমুদে লোক। কিন্তু তার ছেলেমেয়ের সংখ্যা অনেক-চার ছেলে আর তিন মেয়ে। ওরা সবাই আগের স্ত্রীর ঘরের সন্তান (বজ্রপাতে মহিলা মারা যান)। আরেকজন খোঁড়া ছেলে ওর জন্য বোঝা স্বরূপ। তাই অডের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটতে লাগল বনে।

বসন্ত ছিল অডের সবচেয়ে পছন্দের মৌসুম। তখন ঝর্ণা ধারা বইত, ফুল ফুটত চারিদিকে। গ্রীষ্মের সময়টাও মন্দ না। কেননা তখন জাম পাকত। আর হেমন্ত .ছোট ছোট আপেল আর বাদামের জন্য হেমন্তই সবচেয়ে ভাল সময়। শীতটা অডের সহ্য হত না। শীতের বেশিরভাগ সময়টা সবাই গ্রামের গ্রেট হলে কাটাত। শাক- সবজি আর নোনা মাংস খেত। এসময় পুরুষরা লড়ত, আর গাইত আর ঘুমাত। ঘুম থেকে উঠে আবার লড়ত। মেয়েরা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ত আর সেলাই করত।

মার্চের দিকে শীতকালের বিদায় ঘণ্টা বেজে যেত। তুষার গলে গেলে আবার বয়ে চলা শুরু করত নদী, পৃথিবী ফিরে পেত তার সেই মোহনীয় রূপ

সে-বছর এসব কিছুই হলো না।

শীত যেন যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। দিনের পর দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু বরফ গলল না। পৃথিবী সেই ঠাণ্ডা আর শত্রুভাবাপন্নই রয়ে গেল।

গ্রামের লোকদের মাঝে শুরু হয়ে গেল ঝগড়া-ঝাঁটি। চার মাস হলো তারা গ্রেট হলে আটকে আছে। অন্যান্য বছরের এই সময়টাতে পুরুষরা সমুদ্র যাত্রার জন্য তৈরি হয়। আর মহিলারা তৈরি হয় কৃষি কাজের জন্য। কিন্তু এবার কিছুই হলো না। এতদিন খেলাচ্ছলে হওয়া লড়াইগুলো আস্তে আস্তে ভয়ানক রূপ ধারণ করল, কৌতুকগুলো আর নিছক কৌতুক রইল না।

আর সেজন্যই, মার্চের শেষের দিকের এক সকালে…সূর্য ওঠেনি তখনও, তুষার তাই জমাট-বাঁধা আর ইস্পাতের মতো শক্ত… ফ্যাট অ্যালফ্রেড আর তার বাচ্চারা আর অডের মা ঘুমিয়ে আছে তখনও…ঠিক সেই মুহূর্তে অড পরে নিল ওর সবচেয়ে মোটা আর সবচেয়ে গরম পোশাকটা। ফ্যাট অ্যালফ্রেডের ঘরের দেয়াল থেকে ঝুলানো স্যামন মাছের ঝলসানো টুকরাটাও নিয়ে নিল। আরও নিল অগ্নিকুণ্ড থেকে একদলা কয়লা ভরা পট। ওর বাবার দ্বিতীয় সেরা কুড়ালটা নিতেও ভোলেনি। সাবধানে সেটা বেঁধে নিল বেল্টের চামড়ার সাথে। আর তারপর? রওনা দিল বনের দিকে।

তুষার বেশ ভালই পড়েছে। মোটা, পুরু হয়ে জমাট বেঁধে আছে বরফ। সূর্যের আলো পড়লে ঝলসে ওঠে। দুইটা ভাল পা নিয়েও এর উপর দিয়ে হাঁটা কষ্টকর। আর একটা ভাল পা আর একটা ভাঙা পা নিয়ে কোন পঙ্গু ছেলের কাছে তো প্রতিটা টিলাই পাহাড়ের সমান।

অডের পথে প্রথমে পড়ল একটা জমাট-বা লেক। অথচ, না হলেও কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগেই ওটা গলে যাওয়া উচিত ছিল। বনের আরও ভেতরে ঢুকে গেল সে। দিনগুলো মধ্য-শীতের মতো ছোট। এখন মাত্র মাঝ বিকাল, অথচ রাতের চেয়েও অন্ধকার হয়ে এসেছে সবকিছু। অনেক কষ্টে বাবার কুটিরে পৌঁছল অড।

বরফে ছেয়ে আছে দরজা। কাঠের একটা বেলচা নিয়ে বরফ সরাতে হলো অডের। তারপর ভিতরে ঢুকতে পারল। ফায়ারপটে কয়লা ফেলে আগুন জ্বালাল সে। ফায়ারপ্লেস পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে নিভে যাবে না নিশ্চিত হলে, পটটাকে নিয়ে গেল। শুকনো কাঠ রাখা আছে ওখানে, আগুন ধরাতে কোন কষ্ট হলো না।

মেঝেতে ওর হাতের মুঠির চেয়ে একটু বড় এক টুকরা কাঠ দেখতে পেল অড। আগুনে ফেলে দেবে, এমন সময় হাতের ছোঁয়ায় টের পেল-কাঠটাকে চাঁছা হয়েছে। সম্ভবত কিছু একটা বানাবার জন্য। তাই পাশে রেখে দিল ওটা, দিনের আলোতে পরীক্ষা করে দেখবে। একটা ছোট প্যানে কিছু বরফ জমা করল, আগুনের তাপে গলিয়ে নিল বরফগুলো। ঝলসানো মাছ আর গরম জাম মিশ্রিত পানি খেয়ে পেট ভরালো।

স্বাদটা মন্দ না। এখনো কুটিরের এক কোনায় কম্বল রাখা আছে, এমনকি মেঝেতে খড় দিয়ে বানানো মাদুরও আছে। ঘরটায় যেন বাবার গন্ধ পেল অড। নিরাপদ বোধ করল। কেননা কেউ ওকে এখানে আঘাত করছে না। এমনকী পঙ্গু বলে উপহাসও করছে না। তাই সকাল পর্যন্ত আগুন জ্বলবে, সে ব্যবস্থা করে আনন্দচিত্তে ঘুমিয়ে পড়ল অড।

অধ্যয় দুই – শেয়াল, ঈগল আর ভালুক

কুটিরের দেয়ালে কিছু একটার গা ঘষার আওয়াজে ঘুম ভাঙল অডের। নিজেকে টেনে তুলল সে। এক মুহূর্তের জন্য ট্রল আর দানবদের কথা মনে পড়ে গেল। মনে মনে প্রার্থনা করল-আর যা-ই হোক না কেন, অন্তত কোন ভালুক যেন না হয়। এরপর খুলে ফেলল দরজা। দিনের আলো ফুটেছে। দেখতে পেল-বরফের আড়াল থেকে একটা শেয়াল অবজ্ঞার সাথে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

প্রাণীটার মুখ সরু, কান দুটো খাড়া খাড়া আর তীক্ষ্ণ। চোখ দুটো খুব হিসাবী। অডকে ওর দিকে তাকাতে দেখে বাতাসে লাফ দিল শেয়াল। যেন বলতে চাইছে—দেখ, আমি কী করতে পারি! একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়াল। গায়ের চামড়া লালচে কমলা, আগুন রঙা। অডের দিকে দুইপা এগোল, আবার পরমুহূর্তেই ঘুরে দাঁড়াল। এরপর অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল। সরাসরি অডের চোখের দিকে তাকাল শেয়ালটা। যেন বলছে-আমার সাথে এসো।

প্রাণীটার কোন একটা উদ্দেশ্য আছে-অড নিজেকে বলল। ওর জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। শুধু আর কখনো গ্রামে ফিরতে চায় না। আর তাছাড়া, প্রতিদিন কি আর এমন শেয়াল দেখা যায়, যে অনুসরণ করতে বলে?

তাই পিছু নিল সে।

আগুনের মতোই দৌড়ে চলল শেয়ালটি, অডের সামনে সামনে। অড ক্লান্ত হয়ে পড়লে বা পথ কষ্টদায়ক হলে অথবা সে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, শেয়ালটা থমকে দাঁড়াল। বুদ্ধিমান শেয়ালটা থামছে সবচেয়ে কাছের চড়াই এর মাথায়, যেন অড ওকে হারিয়ে না ফেলে।

অড হাল ছাড়ল না।

মাথার উপর একটা পাখি পাক খাচ্ছে। প্রথম দেখায় মনে হলো বাজ পাখি। কিন্তু যখন সামনের একটা মরা গাছের মাথায় এসে বসল পাখিটা, অড দেখতে পেল সেটা কত বড়! ঈগল-ভাবল সে। মাথাটা অদ্ভুতভাবে এক দিকে বাঁকানো। অডের মনে হলো, ঈগলটা একদৃষ্টিতে ওকে দেখছে।

শেয়ালটাকে অনুসরণ করে একের পর এক টিলা পার হয়ে গেল অড (অবশ্য ওঠার চেয়ে নামার সময় বেশি অসুবিধা হলো ওর। এমনিতেই পা ভাঙা, তারপর পিচ্ছিল বরফ। বেশ কয়েকবার পড়ে গেল)। অবশেষে ওরা এসে উপস্থিত হলো একটা মৃত পাইন গাছের সামনে। টিলার উপর এমনভাবে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে যে মনে হচ্ছে—পচে যাওয়া কোন দাঁত। একটা রুপালি বার্চ গাছ মৃত পাইনটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই বার্চ গাছের পাশে এসে থামল শেয়ালটা।

ভীত এক গোঙানি অভ্যর্থনা জানাল ওদের।

মৃত গাছটার এক পাশে একটা ফোঁকর। সাধারণত মৌমাছি এরকম ফোঁকরে বাসা বাঁধে, মৌচাক বানায়। অডের গ্রামের লোকরা এ-সব মৌচাকের মধু দিয়ে মদ বানায়। বিভিন্ন উৎসবে পান করে হয় সেই মদ। আর ভাইকিংদের উৎসব করার জন্য উপলক্ষের অভাব হয় না।

ফোঁকরটায় এই মুহূর্তে শোভা পাচ্ছে একটা বিশালাকার বাদামি ভালুকের সামনের থাবা।

অড দুঃখের হাসি হাসল। এখানে কী ঘটেছে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে।

ফোঁকরের ভেতরে থাবা ঢোকাবার জন্য, ভালুকটা বার্চগাছের উপর ওর শরীরের ভার চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে বেঁকে গিয়ে, খুলে গিয়েছে গর্তের মুখ। কিন্তু যে মুহূর্তে থাবা ভেতরে ঢুকেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভালুকটার দেহ সরে গিয়েছে বার্চ গাছের ওপর থেকে। গাছটা আগের অবস্থানে ফিরে এসে আটকে দিয়েছে থাবাটা।

আরেকবার গোঙাল বিশাল ভালুকটা। গলার ভিতর থেকে আওয়াজটা বের হলো। দেখে হতাশ মনে হচ্ছে ওটাকে। কিন্তু আক্রমণ করার কোন আগ্রহ আছে বলে অডের মনে হলো না।

ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে গেল গাছটার দিকে অড।

ওদের মাথার উপর ঈগলটা এখনও পাক খাচ্ছে।

বেল্ট থেকে খুলে নিল কুড়ালটা। পাইন গাছটাকে ঘিরে একবার চক্কর খেল। ছয় ইঞ্চি লম্বা একটা টুকরা কাঠ কেটে নিয়ে, সেটাকে ব্যবহার করে আলাদা করল গাছ দুটোকে; ভালুকের থাবাটাকে থেঁতলে দিতে চাইছে না। এরপর মাপা আঘাতে কাটতে শুরু কর বার্চ গাছটা।

অড ভালুকটার দিকে তাকাল। ভালুকটাও বাদামি চোখজোড়া দিয়ে দেখল অডকে। ‘আমার পক্ষে দৌড়নো সম্ভব না।’ ভালুককে উদ্দেশ্য করে বলল অড। ‘তাই যদি আমাকে খেতে চাও, খুব সহজেই পারবে। অবশ্য আমার উচিত ছিল ব্যাপারটা আগে ভেবে দেখা। যাই হোক, এখন আর ও কথা বলে কী লাভ?’

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে শেষ বারের মতো কুঠার চালালো অড। বার্চ গাছটা কাত হয়ে পরে গেল। ভালুকটা একবার চোখের পাতা ফেলে, থাবাটা টেনে বের করে নিল। মধু ঝরছে থাবাটা থেকে।

গোলাপি রঙের জিহ্বাটা অবাক করে দিল অডকে। ভালুকটা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চাটল থাবা। এতক্ষণের পরিশ্রমের অডও ক্লান্ত। তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে, গাছের ফোঁকর থেকে মৌচাকের একটা টুকরা বের করে নিয়ে খেতে শুরু করল। মধু আর মোম-সব। কেশে ফেলল অড।

ভালুকটা শ্বাস টানার একটা আওয়াজ করল, গন্ধ শুঁকছে। থাবাটা ফোঁকরে ঢুকিয়ে বের করে আনল ইয়া বড় একটা টুকরা। শেষ করতে দুই কামড়ের বেশি প্রয়োজন হলো না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পিছনের দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল ভালুকটা, গর্জে উঠল।

এখন মনে হয় আমাকে খাবে—মনে মনে ভাবল অড। মধু খেয়ে ভালুকটার খিদে আরও বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু ভালুক আবার মধু খাওয়ায় মন দিল।

অন্ধকার হয়ে আসছে সব কিছু, রাত নামছে।

অড জানে, ওর এখন ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত। টিলার উপর থেকে নিচের দিকে তাকাল। উপলব্ধি করতে পারল, এখন কোথায় আছে তা সে জানে না। এমনকি ওর কুটির কোথায়—সেটাও বুঝতে পারছে না। শেয়ালটাকে অনুসরণ করে এতদূর এসেছে। কিন্তু, প্রাণীটা যে তাকে পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে-সে আশা করা বোকামি। তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ক্র্যাচটা ছুটে গেল হাত থেকে।

বুকে হেঁটে ক্র্যাচের দিকে এগোল সে। কিন্তু পরক্ষণেই জমে গেল, ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতে পেরে।

‘হ্যালো, ভালুক,’ খুশী মনেই বলল অড। ‘আমাকে খেয়ে ফেললেই ভাল হবে। অন্তত বরফে জমে আইসক্রিম হবার চেয়ে, ভালুকের খাবার হওয়া ভাল।’

কিন্তু ভালুকটাকে দেখে মনে হলো না-অডকে খাবার কোন ইচ্ছা ওর আছে। বরফের উপর বসে পড়ল সে, থাবাটা বাড়িয়ে দিলে অডের দিকে।

‘ভেবে চিন্তে বলছ তো?’ জিজ্ঞেস করল অড। ‘আমাকে খাবার কোন ইচ্ছা নেই?’ ভালুকটার গলা থেকে গরগর করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল। তবে আওয়াজটা শুনে মনে হলো না যে সে ক্ষুধার্ত। অড ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেবার সিদ্ধান্ত নিল। আজকের দিনে যা যা ঘটেছে, তার চেয়ে অদ্ভুত আর কী ঘটতে পারে?

ভালুকটার পিঠে চড়ে বসল সে। বাঁ হাতে ক্র্যাচটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। আর ডান হাত দিয়ে ভালুকটার পশম। ভালুক খুব আস্তে উঠে দাঁড়াল, অডকে পিঠ থেকে ফেলে দিতে চায় না। গোধূলির আলোয় শুরু করল নিচে নামা।

ভালুক গতি বাড়াল, ঠাণ্ডা বাতাস যেন কামড় বসালো অডের শরীরে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করল সে।

ওদের সামনে শেয়ালটা দৌড়ে যাচ্ছে। আর মাথার উপরে উড়ছে ঈগল। অড খুশী হয়ে উঠল। ভাবল, আমি মায়ের গানের বীর যোদ্ধাদের মতোই একজন। তবে ঘোড়া, কুকুর বা চিলের জায়গায় আমার আছে শেয়াল, ভালুক আর ঈগল!

আরও ভাবল, এই অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলব না। কারণ, কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি নিজেও করতাম না।

চলন্ত অবস্থায় গাছের ডাল থেকে বরফ কুঁচি এসে পড়ল ওর মুখে। ব্যথা করছে। কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না ওসব। চাঁদ উঠেছে ততক্ষণে, মলিন কিন্তু বিশাল। আর ঠাণ্ডা, যেন জমাট-বাঁধা বরফ। কিন্তু অডের সেসবের দিকে নজর নেই। কেননা সে হাসছে…কেননা এই মুহূর্তে সে এক বীর যোদ্ধা, সফর করছে ভালুকের পিঠে…

…কেননা সে-অড।

ওর কুটিরের ঠিক সামনে এসে থামল ভালুকটা। অড খানিকটা পিছলে, আর বাকিটা পড়ে গিয়ে নামল পিঠ থেকে। ক্র্যাচ ব্যবহার করে নিজেকে টেনে তুলল। বলল, ‘ধন্যবাদ।’ ওর মনে হলো, ভালুকটা যেন মাথা নাড়ল। কিন্তু কে জানে, চাঁদের আলোয় ভুলও হতে পারে!

হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কানে এল। ওই যে মাথার উপরে ভেসে থাকা ঈগলটা! ঠিক কয়েক ফুট সামনে এসে নামল। ঘাড় এক দিকে কাত করে এক চোখ দিয়ে দেখছে অডকে। যেখানে অন্য চোখটা থাকার কথা, সেখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।

কুটিরের দরজার দিকে হেঁটে গেল অড। শেয়ালটা ওখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছে, ঠিক যেন একটা কুকুর। ভালুকও ওর পিছু নিয়েছে।

অড একবার শেয়ালের দিকে তাকায় তো একবার ভালুকের দিকে। ‘কী চাই?’ কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল, যদিও জানে প্রাণীগুলোর মনে কি আছে!

‘কী আর করা! এসো, ভিতরে এসো।’ বলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে। প্রাণীগুলোও ওর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকে পড়ল।

অধ্যায় তিন – মাতের আলাপচারিতা

অড ভেবেছিল স্যামনটা দিয়ে রেখে ঢেকে এক সপ্তাহ চালানো যাবে। কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল ভালুক, শেয়াল আর ঈগল-সবাই স্যামন খায়! আর তাছাড়া, কুটির পর্যন্ত নিয়ে আসার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ওদের জন্য এতটুকু করা অডের যেন কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেবারে পুরোটা শেষ করে খাওয়া থামাল প্রাণীগুলো। কিন্তু মনে হলো, কেবল অড আর ঈগলের পেট ভরেছে। ভালুক আর শেয়ালকে এখনও ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে।

‘আগামী কাল আরও খাবার খুঁজে বের করব।’ বলল অড, ‘এখন ঘুমাও।’

প্রাণীগুলো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কিন্তু অড সেদিকে নজর না দিয়ে খড়ের মাদুরে শুয়ে পড়ল। পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখল ক্র্যাচটা, যেন সকালে ঘুম থেকে উঠে আর খুঁজতে না হয়। কুটিরটায় বাবার গন্ধ পেলেও, মাদুরে তেমন কোন গন্ধ নেই—শুয়ে শুয়ে উপলব্ধি করল সে। শুধু খড়ের গন্ধ। চোখ মুদল অড। হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।

কিছু আনন্দঘন মুহূর্তের স্বপ্ন দেখল ঘুমিয়ে, কিন্তু কী দেখছে তা মনে নেই। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছে-স্বপ্নগুলো কেন যেন ওকে শান্ত করতে পারছে না। হঠাৎ করে গমগমে একটা আওয়াজ শুনতে পেল…স্বপ্নের মাঝেই হয়তো, ‘আমার কোন দোষ নেই।

আগের চেয়ে একটু তীক্ষ্ণ গলায়, আমুদে স্বরে কেউ বলল, ‘ঠিক বলেছ। তোমার কোন দোষ নেই। তবে সমস্যা একটাই—আমি তোমাকে বার বার নিষেধ করেছিলাম, ওদিকে যেয়ো না। শোনোনি।’

‘আমার ক্ষুধা লেগেছিল। নাকে মধুর গন্ধ পাচ্ছিলাম। ক্ষুধার্ত অবস্থায় নাকে মধুর গন্ধ এলে যে মনের কী অবস্থা হয়, সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। মদের চেয়ে মদকতাময়।’ হঠাৎ করে ভারী গম্ভীর কণ্ঠটা পরিবর্তন হয়ে গেল, ‘আর তোমার মতো লোক কি না আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে? এই ঝামেলায় আমরা পড়েছিই তোমার কারণে।’

‘এই, আমাদের মধ্যে না একটা চুক্তি হয়েছিল? ওই ভুলের মতো একটা ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে আর কোন কথা হবে না…’

‘ছোটখাট?’

তৃতীয় আরেকটা গলা শোনা গেল। উঁচু, শক্তিশালী আর ব্যক্তিত্বপূর্ণ। ‘চুপ।’

আসলেই সবাই চুপ হয়ে গেল। অড কাত হয়ে চোখ খুলল। রাত হলেও, আগুনের আলোয় পুরো কুটির খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর কেউ নেই ভেতরে। কুটিরের অধিবাসী আগের ক’জনই—সে, শেয়াল, ভালুক আর ঈগল…

‘এই ঝামেলায় আমরা পড়েছিই তোমার কারণে।’

এরা আর যাই হোক না কেন, ভাবল অড, মানুষ খায় না। নয়তো, ঘুমের মাঝেই

উঠে বসল সে। হেলান দিল দেয়ালে। ভালুক আর ঈগল ওকে পাত্তাই দিল না। কিন্তু শেয়ালটা একবার আড়চোখে তাকাল।

‘তোমরা কথা বলছিলে!’ অবাক গলায় বলল অড।

প্রাণী তিনটা একবার অডের দিকে আর একবার একে অন্যের দিকে তাকাল। মুখ দিয়ে ‘কে? আমরা?’ না বললেও, আচরণে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।

‘কেউ না কেউ তো কথা বলছিল।’ বলল অড, ‘আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। আর ঘরে অন্য কাউকে দেখছি না। এর অর্থ-তোমরা কথা বলছিলে। অস্বীকার করে লাভ নেই।’

‘আমরা অস্বীকার করব কীভাবে!’ ভালুক বলল। ‘আমরা তো কথাই বলতে জানি না।’ এরপর বলল, ‘উপস।’

শেয়াল আর ঈগল কড়া চোখে ভালুকের দিকে তাকাল। ততক্ষণে লজ্জায় ভালুকটা থাবা দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলেছে।

অড দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কেউ কি দয়া করে আমাকে জানাবে, এখানে হচ্ছেটা কী?’ জিজ্ঞেস করল।

‘কিছুই হচ্ছে না।’ শেয়ালটা সাথে সাথে জবাব দিল। ‘কয়েকটা কথা বলা প্রাণী দেখতে পাচ্ছ তুমি। ভাবনার কিছু নেই। এমনটা প্রায়ই হয়। সকাল হলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব।’

ঈগল ওর একমাত্র চোখ দিয়ে ভাল মতো পরখ করে দেখল অডকে। এরপর শেয়ালের দিকে ফিরে বলল, ‘বলো ওকে!

শেয়াল অস্বস্তিভরে উত্তর দিল, ‘আমাকেই কেন বলতে হবে?’

‘ভাল প্রশ্ন।’ জবাব দিল ভালুক, ‘কেন বলতে হবে? উম… কারণ সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী।’

‘একটু বেশি হয়ে গেল না?’ উত্তর দিল শেয়াল। ‘এভাবে সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়াটা কি উচিত হচ্ছে? এমন তো না যে আমি ইচ্ছা করে এসব কিছু করেছি। আমাদের যে কারও দ্বারা এই ভুল হতে পারত।’

‘কী ভুল?’ আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল অড, ‘আর তোমরা কথা বলতে জানো কীভাবে?’

ভালুকটা বসে পড়ল। গরগর করে একটা শব্দ করে বলল, আমরা কথা বলতে জানি। কারণ, হে মরণশীল মানবের সন্তান-ভয় পেয়ো না আবার কারণ হলো, এই প্রাণী চামড়া, যেগুলো আমরা ছদ্মবেশ হিসেবে পড়ে আছি… আসলে এগুলো ছদ্মবেশ না তবে মানে বলতে চাইছি, আসলেই আমরা একটা ভালুক, একটা শেয়াল আর একটা বড় পাখি। কিন্তু…কী যেন বলছিলাম?’

‘দেবতা!’ ঈগলটা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল।

‘দেবতা?’ জিজ্ঞেস করল অড।

‘হ্যাঁ, দেবতা।’ ভালুক জবাব দিল। ‘আমি ওটাই বলতে চাচ্ছিলাম। আমি মহান থর, বজ্রের দেবতা। ঈগল হচ্ছেন লর্ড ওডিন, অল-ফাদার, দেবতাদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর এই মরচে রঙা নাক গলানো শেয়ালটা হলো—’

‘লোকি,’ নিষ্কম্প গলায় বলল শেয়াল। ‘দেবতাদের রক্ত-শপথ করা ভাই। সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে চালাক আর অ্যাসগার্ডের দেবতাদের মাঝে সবচেয়ে প্রতিভাবান। অন্তত ওরা তাই বলে—’

‘প্রতিভাবান?’ ভালুক ঘোঁত ঘোঁত করতে বলল।

‘ওহ! তুমিও ওই ফাঁদে পা দিতে। যে-কেউ দিত।’ শেয়াল বলল।

‘ফাঁদ? কোন ফাঁদ?’ হতভম্ব অড আর সইতে না পেরে জিজ্ঞেস করল।

সবুজ চোখগুলো যেন জ্বলে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করল শেয়াল। ‘বলব, সব বলব। জানি, তুমিও আমার সাথে একমত হবে-যে-কেউ ফাঁদে পা দিত। প্রথমে অ্যাসগার্ড সম্পর্কে বলি-দেবতাদের আবাসস্থল। উঁচু জমি, চারপাশ অভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালটা আমাদের জন্য বানিয়েছে এক হিম-দানব। এখানে একটা কথা বলে রাখি। আমার জন্য, হ্যাঁ এই আমার জন্য, এত বড় একটা কাজ করাবার পরও এক পয়সা গুণতে হয় নি। একেবারে বিনামূল্যে পেয়েছি দেয়ালটা। দানবটা অনেক বেশি পারিশ্রমিক দাবী করেছিল, তা যদি চুকাতে হত তো…’

‘ফ্রেয়া,’ বলল ভালুক। ‘দানবটা ফ্রেয়াকে চেয়েছিল। দেবীদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী-অবশ্য আমার স্ত্রী, আমার প্রেম, সিফের চেয়ে কম। সেই সাথে চাঁদ আর সূর্যও দাবী করেছিল।’

‘আমার কথার মাঝে যদি আরেকবার নাক গলাও,’ সাবধান করে দিল শেয়াল, ‘মাত্র একবার, আমি শুধু কথা বলাই থামাব না, যে-দিকে মন চায় সেদিকে চলে যাব। তোমাদের যা হয় হোক।’

ভালুক বলল, ‘কিন্তু–’

‘আর…একটা…শব্দও…না।’

চুপ হয়ে গেল ভালুক।

শেয়াল বলল, ‘ওডিনের গ্রেট হলে রাতে সব দেবী আর দেবতা এক হয়। গল্প করে, হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে, মদ পান করে। মাতাল হয় আর বড় গলায় নিজেদের ঢাক নিজেরাই পেটায়। সেদিনও তাই করছিল সবাই। রাত তখন বেশ গভীর হয়েছে। দেবীরা অনেক আগেই ঘুমাতে চলে গিয়েছে। আগুন নিভু নিভু হয়ে এসেছে। দেবতাদের প্রায় সবাই যে যেখানে বসে ছিলে, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে এমনকি অনেকে মাথা কাঠের টেবিলের উপর রেখেই ঘুমিয়েছে। মহান ওডিনও নিজের সিংহাসনে বসে ঢুলছেন। তার একমাত্র চোখটা বন্ধ হয়ে আছে। তবে দেবতাদের মাঝে এমন একজন আছে, যে অন্যদের চেয়ে বেশি খাবার খেয়ে আর মদ পান করেও জেগে ছিল। আমি, লোকিই সেই দেবতা। আর আমি এক বিন্দুও ক্লান্ত বা মাতাল হইনি। এক বিন্দুও…’

ভালুক আরেকবার ঘোঁত করে আওয়াজ করল। তার অবিশ্বাস প্রকাশ করল যেন। শেয়াল তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ওর দিকে।

‘কী বলেছিলাম? আর…একটা…শব্দও না।’

‘আহা, আমি কি কোন শব্দ উচ্চারণ করেছি?’ বলল ভালুক। ‘শুধু একটা আওয়াজ করেছি। কী বলছিলে একটুও মাতাল হওনি?’

‘হ্যাঁ। একটুও মাতাল হইনি। একেবারে সুস্থ অবস্থায় হলটা ঘুরে দেখছিলাম। পায়ে ছিল বাতাসে ভাসার জুতো। একসময় হল থেকে বের হয়ে, দেয়ালের উপর উঠলাম। দেয়ালের ওপাশে দেখতে পেলাম আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে। দুধের মতো গায়ের রঙ, চুলগুলো সোনালি। ঠোঁট আর কাঁধের কথা কী বলব-পরিপূর্ণ। গলার আওয়াজ যেন পাখির গান। শুনতেই ইচ্ছা করে। আমাকে ডাক দিল সে।

‘ওহে, সাহসী যোদ্ধা।’ বলল সে।

‘বল হে সুন্দরী নারী,’ উত্তর দিলাম। ‘যার সৌন্দর্য দুনিয়ার যে কোন প্রাণীর চেয়ে বেশি!’ আমার প্রশংসা শুনে হেসে ফেলল মেয়েটি। সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, আমাকে তার মনে ধরেছে। ‘কিন্তু সৌন্দর্যের প্রতীক এই নারী, রাতের আঁধারে বাইরে কেন? সে কি জানে না, ট্রল আর নেকড়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে? আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করো-লোকির আমন্ত্রণ, যিনি অ্যাসগার্ডের অন্য সব দেবতার চেয়ে শক্তিশালী আর ক্ষমতাবান। আমি ঘোষণা দিচ্ছি, তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। তোমার যে-কোন আদেশ পালন করতে আমি বাধ্য।’

‘হায়, যদি তোমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারতাম, হে সাহসী আর অপরূপ দেবতা!’ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল সে। চাঁদের আলোয় চোখ দুটো যেন ঝিক ঝিক করছিল। ‘কেননা তুমি প্রশ্নাতীতভাবে লম্বা, শক্তিশালী আর অপরূপ হলেও, আমি যে আমার পিতাকে কথা দিয়েছি। তিনি এখান থেকে অনেক দূরের এক রাজ্যের রাজা। তাকে বলেছি, আমি আমার হৃদয় আর আমার প্রথম চুম্বন তাকেই উপহার দিব, যিনি একটি বিশেষ জিনিসের মালিক।’

‘সেই জিনিসটা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ, মেয়েটি যাই চাক না কেন-আমি এনে দিব।

‘মিয়োলনির,’ তরুণী জবাব দিল। ‘থরের হাতুড়ি।’

‘হাহ! মেয়েটিকে জায়গা থেকে নড়তে নিষেধ করে উড়ে এলাম গ্রেট হলে। সবাই ঘুমিয়ে আছে, মাতাল। থরকে দেখতে পেলাম। বেহেড মাতালটাও ঘুমিয়ে আছে। ওর কোমরের সাথে বাঁধা আছে মিয়োলনির। কেবলমাত্র লোকির নরম আর দক্ষ হাতই পারে থরকে না জাগিয়ে গোপনে সেটাকে খুলে নিতে—’

কথাটা শুনে ভালুক কেশে উঠল। আরেকবার কড়া চোখে তাকিয়ে ভালুকটা সাবধান করে দিল শেয়াল। ‘হাতুড়িটা খুব ভারী ছিল। মানুষের কল্পনার চেয়েও ভারী। ছোটখাট একটা পাহাড়ের সমান হবে। বহন করা যায় না, যদি বহনকারী থর না হয় আরকি। কিন্তু আমার বুদ্ধিমত্তার সামনে এই সমস্যাও কোন সমস্যা না। পা থেকে জুতোজোড়া খুলে ফেললাম। ওগুলো বাতাসে ভাসতে পারে। একটাকে হাতলের সাথে আর একটাকে মাথার সাথে বাঁধলাম। এরপর তুড়ি বাজাতেই আমাকে প্রভু ভক্ত কুকুরের মতো অনুসরণ করল হাতুড়ি।

‘তাড়াতাড়ি দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেলাম আমি। দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়লাম বাইরে।

‘মেয়েটা বসে ছিল। কিন্তু পাথরের উপর বসে কাঁদছিল সে।

‘কাঁদছ কেন? হে সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমার কথা শুনে অশ্রু-সজল চোখে মুখ তুলে তাকাল সে। কাঁদছি কারণ তোমাকে একবার দেখেই আমি বুঝে ফেলেছি, অন্য কাউকে ভালবাসা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আমি যে বাধ্য। কথা দিয়েছি-যে আমাকে থরের হাতুড়ি স্পর্শ করতে দেবে, কেবল তাকেই বিয়ে করব।’

‘আমি এক হাতে বাড়িয়ে ওর ঠাণ্ডা ভেজা গালটা স্পর্শ করলাম। ‘কান্না থামাও,’ বললাম তাকে, ‘চোখ খুলে দেখ। তোমার জন্য কি উপহার এনেছি। থরের হাতুড়ি!’

‘কান্না থামিয়ে কোমল হাত দুটো বাড়িয়ে দিলে সে। আঁকড়ে ধরল হাতুড়ি। ‘আমি ভেবেছিলাম, মেয়েটার সাথে সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে সকালে সূর্য ওঠার আগেই থরের হাতুড়ি ফিরিয়ে দিতে পারব। কিন্তু সেজন্য একটু তাড়াতাড়ি করা দরকার।

‘এখন,’ বললাম। ‘চুম্বনের ব্যাপারটা…

‘এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, মেয়েটি আবার কান্না শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম যে না, সে হাসছে! কিন্তু এই আওয়াজটা আগের মতো পাখির গান নয়। অনেক গভীর, সবকিছু ভেঙে যাবার মতো আওয়াজ। যেন কেউ বরফের বিরাট চাঁই কোন পাহাড়ের দেয়ালে ঘষছে।

‘হাতুড়ি থেকে আমার জুতোজোড়া টেনে সরিয়ে ফেলল মেয়েটি। এমনভাবে মিয়োলনির হাতে ধরে আছে যে মনে হচ্ছে জিনিসটা পালকের মতো হালকা। ঠাণ্ডার একটা চাদর ঘিরে ধরল আমাকে। বুঝতে পারলাম, ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। সমস্যা হলো, মেয়েটি এখন আর মেয়ে নেই।

‘ছেলে হয়ে গিয়েছে। মানে ঠিক করে বলতে গেলে ছেলে না, পুরুষ। পাহাড়ের সমান লম্বা। দাড়ি থেকে বরফের চাঁই ঝুলছে। আর মেয়েটি-মানে ছেলেটি, বলল, ‘এত যুগ পর! আর না কোন যুদ্ধ প্রয়োজন পড়ল আর না হুমকি। শুধু কামার্ত এক গাধাই যথেষ্ট অ্যাসগার্ডকে আমাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য।’ দানবটা আমার দিকে ঝুঁকে এল। হাতে ধরা থরের হাতুড়ি নেড়ে বলল, ‘আর তুমি!’ গভীর আর ভারিক্কী স্বরে বলল, ‘দেবতার চেয়ে শক্তিশালী আর ক্ষমতাবান লোকি… তোমার পুরষ্কার স্বরূপ মানবাকৃতি কেড়ে নেয়া দরকার।’

অনুভব করলাম, আমার পিঠটা উপরে উঠে আসছে। শিরদাঁড়ার গোঁড়া থেকে বেড়িয়ে আসছে একটা লেজ। আঙুলগুলোকে চোখের সামনে থাবা আর নখরে পরিণত হতে দেখলাম। এর আগেও আমি প্রাণীতে পরিণত হয়েছি-একবার ঘোড়ার রূপও নিয়েছি, বুঝেছ-কিন্তু এই প্রথম অন্য কেউ আমাকে বাধ্য করল কোন প্রাণীর রূপ নিতে। ব্যাপারটা খুব একটা সুখকর না। একদমই না।’

‘আমাদের জন্য তো ব্যাপারটা আরও ছিল ভয়াবহ।’ ভালুক যোগ করল, ‘আমি শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছি। স্বপ্ন দেখছি বজ্রপাত আর ঝড়ের। চোখ খুলে দেখি, ভালুকে পরিণত হয়ে গিয়েছি! আর অল-ফাদার ওডিনকে ওরা ঈগলে রূপান্তরিত করে দিয়েছে।’

ঈগলটা চিৎকার করে উঠল, চমকে উঠল অড। ‘রাগ!’ বলল পাখিটা।

‘দানবটা আমাদের দেখে উপহাস করল। হাতুড়িটা ইচ্ছামতো ঘুরালো মাথার উপরে। এরপর হাইমডালকে (রেইনবো ব্রিজ বা বাইফ্রষ্টের প্রহরী) বাধ্য করল রেইনবো ব্রিজ (রঙধনুর সেতু) চালু করে আমাদেরকে নির্বাসন দিতে। তাই এখন আমরা মিডগার্ডে। এই তো, আর কিছু না।’

ছোট কুটিরটায় নীরবতা নেমে এল। শুধু পাইনের ডাল পোড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে।

‘বুঝলাম।’ বলল অড, ‘কিন্তু দেবতা হও আর যাই হও, যদি শীত আরও কিছুদিন থাকে তো তোমাদের জন্য খাবার জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সত্যি বলতে-নিজের কী হবে তাই জানি না।’

‘আমরা মারা যাব না।’ ভালুক বলল, ‘কারণ আমরা এখানে মরতে পারি না। কিন্তু আমাদের ক্ষুধা লাগবে। দিন দিন আরও জান্তব হয়ে উঠব। আরও বেশি আক্রমণাত্মক। প্রাণীর রূপ নিলে এমনটা হয়। অনেক বেশি সময় ভালুক হয়ে থাকলে, স্বভাবও তেমন হয়ে যাবে। লোকি যখন ঘোড়ার রূপ নিয়েছিল—’

‘আহা! ওসব বলার কী দরকার!’ শিয়াল ওকে থামিয়ে দিল।

‘আচ্ছা, এজন্যই কি শীত ফুরাচ্ছে না?’ জিজ্ঞেস করল অড।

‘হিম-দানবরা শীত পছন্দ করে। সত্যি বলতে-ওরা আর শীত একই জিনিস।’ ভালুক উত্তর দিল।

যদি বসন্ত আর কখনো না আসে? আর গ্রীষ্ম? যদি এই শীত কখনো না ফুরায়?’

ভালুক নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। শিয়াল অধৈর্যের সাথে লেজ নাড়ল দুই একবার। শেষ মেষ সবাই তাকালো ঈগলের দিকে। পাখিটা ঘাড় কাত করে অডকে দেখল। বলল, ‘মৃত্যু!’

‘শেষ অবস্থা আরকি।’ যোগ করল শিয়াল। ‘মানে, একদম সাথে সাথে সবাই মারা যাবে না। এক বছরের মতো সময় লাগবে। আর কিছু প্রাণী দক্ষিণে গিয়ে জীবন বাঁচাবে। তবে অধিকাংশই মারা যাবে। আগেও এমন হয়েছে। সময়ের শুরুতে আমাদের আর হিম-দানবদের মাঝে প্রায়ই লড়াই হত। যখন ওরা জিতত, তখন পৃথিবীর এদিকটা বরফে ছেয়ে যেত। যখন আমরা জিততাম-প্রথমে হারলেও, শেষ পর্যন্ত আমরাই জিততাম-বরফ উধাও হয়ে যেত। ফিরে আসত বসন্ত। কিন্তু ওই সব যুদ্ধে আমরা লড়তাম দেবতা হিসেবে। বন্য জানোয়ার হিসেবে না।’

‘আর আমার হাতে থাকত আমার হাতুড়ি।’ ভালুক বলল।

‘তাহলে আর কি?’ বলল অড, ‘আলো ফুটলেই আমরা রওনা দেব।’

‘রওনা?’ শেয়াল জানতে চাইল, ‘কোথায় যাব?’

‘আর কোথায়? অ্যাসগার্ডে।’ উত্তর দিল অড। মুখে ওর সেই উত্তেজিত করে তোলা হাসি। ফিরে গেল নিজের মাদুরে। ঘুমিয়ে পড়ল আবার।

অধ্যায় চার – রঙধনু বানানো

‘তোমার হাতে ওটা কী?’ জানতে চাইল শেয়াল।

‘এক টুকরা কাঠ।’ জবাব দিল অড, ‘বাবা এটা ব্যবহার করে কিছু একটা বানানো শুরু করেছিল। অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু শেষ করতে পারেনি।’

‘কী বানাচ্ছিল?’

‘জানি না।’ স্বীকার করল অড। ‘বাবা বলত, কাঠ খোদাই করে শেষ পর্যন্ত কী বানানো হবে, সেটা খোদাইকারীর চাইতে কাঠ ভাল জানে। তোমাকে শুধু খুঁজে বের করতে হবে, কাঠটা কী চায়! এরপর ছুরি হাতে নিয়ে সেটা বাদে অন্য সবকিছু কেটে ফেলে দিলেই হলো।’

‘উমম।’ বলল শেয়াল। উত্তরটা ওকে খুশী করতে পারেনি।

অড ভালুকের পিঠে চড়ে বসেছে। শেয়াল হাঁটছে ওদের পাশে পাশে। মাথার অনেক ওপরে ঈগল উড়ছে। মেঘহীন আকাশে সূর্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখনও ঠাণ্ডা কমেনি। পাথুরে একটা পথ ধরে চড়াই এর দিকে এগোচ্ছে ওরা। অনুসরণ করছে একটা জমাট-বাঁধা নদী। বাতাস থেকে থেকে চাবুক বসাচ্ছে অডের চোখে মুখে।

‘কাজ হবে না।’ হতাশা ভরে বলল ভালুক, ‘মানে বলতে চাইছি-যা করতে চলেছি, তাতে কাজ হবে না।’

অড চুপ করে রইল।

‘তুমি হাসছ, তাই না?’ বলল ভালুক, ‘আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।’

সমস্যা হলো: অ্যাসগার্ডে যেতে হলে অবশ্যই রঙধনু সেতু পার হয়ে যেতে হবে। সেতুটার নাম বাইফ্রষ্ট। দেবতা হলে শুধু আঙুল হেলানোই যথেষ্ট, সাথে সাথে সেতু এসে উপস্থিত হবে চোখের সামনে। এরপর হেঁটে পার হলেই−ব্যস, খুব সহজ।

সহজ, তবে তা শেয়ালের মতে। অবশ্য ভালুকও ওর সাথে একমত। সহজ হত, যদি এ মুহূর্তে আঙুল বলে দেবতাদের আসলেই কিছু থাকত। কিন্তু ওদের কপাল মন্দ। আশার কথা হলো, লোকির কথা মতো, রঙধনু বানাতে আঙুল লাগে না। যদি কোন রঙধনু খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সেটা ব্যবহার করেও কাজ সারা যাবে। কিন্তু…বৃষ্টি ছাড়া রঙধনু আসবে কোত্থেকে?

আর শীতের সময় কি আর বৃষ্টি হয়!

অড সমস্যাটা নিয়ে অনেক ভাবল। বৃষ্টি হলে কেন সূর্যের আলোয় সাত রঙ দেখা যায়-সেটা চিন্তা করে দেখল।

‘আমার মনে হয়,’ বলল ভালুক। ‘প্রাপ্তবয়স্ক, দায়িত্ববান পুরুষ হিসেবে আমার কিছু কথা বলা উচিত।’

কথা বলতে পয়সা লাগে না।’ বলল অড। ‘তবে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেব করে কথা খরচ করে।’ প্রায়ই বাবা কথাটা বলত।

‘আমি শুধু বলতে চাই-আমরা সময় নষ্ট করছি। বাইফ্রষ্ট ব্যবহার করার কোন উপায় দেখছি না। যদি ব্যবহার করে অ্যাসগার্ডে পৌঁছাতেও পারি, কী লাভ? আমরা কেবল তিনজন প্রাণী। আর তোমার তো হাঁটা চলা করাই দায়। হিম-দানবকে কীভাবে হারাব? অসম্ভব!’

‘ও কিন্তু ভুল কিছু বলেনি।’ বলল শেয়াল।

‘অসম্ভব হলে…,’ জবাব দিল অড, ‘আমার সাথে আসছ কেন?’

কেউ কিছু বলল না। বরফের উপর সূর্যের আলো পরছে। অদ্ভুত আলো খেলা করছে চারদিকে। ঝলসে দিচ্ছে অডের চোখ।

‘এরচেয়ে ভাল আর কিছু করার নেই আপাতত।’ কিছুক্ষণ পর ভালুক বলল।

‘ওপরে দেখো!’ অড মাথার উপর ইঙ্গিত করল। একটা খাড়া চড়াই বেয়ে উঠছে ওরা এখন। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ভালুকের পশম। সামনে অনেকগুলো পর্বত দেখা যাচ্ছে।

‘দাঁড়াও,’ বলল সে। সামনে একটা ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। এখন অন্য সব কিছুর মতো সেটাও বরফ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অন্য সময় প্রায় সারা বছর ঝর্ণার পানি বইতে থাকে। অডের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা এটি। শুধু অডেরই না, গ্রামের অন্যান্য সদস্যদেরও জায়গাটা খুব প্রিয়। ঝর্ণার পানি প্রায় একশো ফুট নিচে, একটা উপত্যকায় এসে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে ঝর্ণাটা বহমান বলে, সেখানে একটা বেসিন হয়ে গিয়েছে।

‘একটা ঝর্ণা আছে এখানে,’ বলল অড। ‘আমরা প্রায়ই বেড়াতে আসতাম। যখন পানি উপর থেকে নিচে পড়ত, তখন সূর্যের আলো জন্ম দিত রঙধনু। পুরো ঝর্ণাটা ঘিরে থাকত রঙধনু।’

‘এখন পানি নেই।’ শেয়াল বলল, ‘তাই রঙধনুও নেই।’

‘ভুল বললে। পানি আছে, কেবল বরফ হয়ে আছে।’

বেল্টে ঝোলানো কুঠারটা খুলে হাতে নিল সে। ক্র্যাচটা বগলের তলে ঢুকিয়ে নেমে পড়ল ভালুকের পিঠ থেকে। বরফের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল ঝর্ণার কাছে। ক্র্যাচটা ব্যাবহার করে নিজেকে সামলে নিল সে। এরপর শুরু করল কুঠার চালানো। বরফের উপর কুঠার পড়ার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড় জুড়ে। মনে হচ্ছে যেন অড একা নয়, পুরো একটা সেনাদল কুঠার চালাচ্ছে।

খুব তীব্র একটা আওয়াজ করে অডের সমান আকৃতির এক বরফের টুকরা আছড়ে পড়ল জমাট-বাঁধা পানির উপর।

‘তুমি তো দেখছি খুব চালাক!’ এমন এক স্বরে বলল ভালুক যে বোঝাই গেল, সে মোটেও অডকে চালাক মনে করে না। ‘ভেঙে ফেলেছ।’

‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল অড। মাটিতে পড়া বরফের টুকরাগুলো পরীক্ষা করে দেখল। ওগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে ভাঙা টুকরাটা তুলে নিল হাতে। এরপর সেটাকে একটা পাথরের উপর রেখে খুব কাছ থেকে পরখ করে দেখল।

‘বরফের একটা ভাঙা টুকরা।’ বলল শেয়াল, ‘এতো দেখার কী আছে?’

‘ঠিক বলেছ।’ বলল অড, ‘আমার ধারণা পানি জমে বরফ হলে, রঙধনুর একটা অংশ ওতে বন্দি হয়ে যায়।’

ছেলেটা এবার ছুরি বের করল। ছেঁচে ফেলতে শুরু করল বরফের এবড়ো-খেবড়ো অংশটুকু।

ঈগল এখনও ওদের মাথার উপর পাক খাচ্ছে। মধ্য-শীতের সূর্যের আড়ালে যেন হারিয়ে গেছে সে।

‘অনেকক্ষণ ধরে উড়ছে অল-ফাদার।’ বলল ভালুক, ‘কী মনে হয়, কী খুঁজছে?’ শেয়াল জবাব দিল, ‘আমার তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ঈগল হওয়া খুব কঠিন। কে জানে নিজেকে ঈগলের সত্তার মাঝে হারিয়ে ফেলছে কি না। আমি যখন ঘোড়ার রূপ নিয়েছিলাম…

‘ঘোড়া, না ঘোটকী?’ ঘোঁত করে বলল ভালুক।

শেয়াল অবজ্ঞার সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সটকে পড়ল। অড ছুরি রেখে আবার তাকাল কুঠারের দিকে। ‘আমি মাঝে মাঝে বরফেও রঙধনু দেখেছি।’ এতটা জোরে বলল যেন শিয়ালের কানে আওয়াজ পৌঁছায়। ‘এমনকী বাড়ি-ঘরের দেয়ালেও দেখেছি। সূর্যের আলো বরফের টুকরার উপর পড়লে দেখা যায়। এতদিন ভাবতাম যেহেতু বরফও পানি, নিশ্চয়ই জমে যাবার সময় রঙধনুর একটা অংশও সাথে নেয়, অনেকটা ছোট কোন পাত্রে মাছ বন্দি হবার মতো। সূর্যের আলো সেই রঙধনুকে মুক্ত করে দেয়।’

অড জমাট-বাঁধা পুকুরের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসল। পাথরের একটা বড় টুকরার গায়ে কুঠার দিয়ে আঘাত করল। কাজের কাজ হলো না কিছুই। বরঞ্চ, কুঠার পিছলে গিয়ে ওর পায়ে আঘাত হানল।

‘আর দুই-একবার অমন হলে, কুঠারটাই ভেঙে যাবে।’ সাবধান করল শেয়াল, ‘দাঁড়াও।’

জমাট-বাঁধা পুকুরটাকে ঘিরে একবার চক্কর দিল শেয়াল। এক জায়গায় থেমে নখ দিয়ে বরফ খুঁড়ল সে, ‘এই যে, তোমার দরকার এটা।’ বরফ খুঁড়ে বের করা একটা ধুসর পাথর দেখিয়ে বলল সে।

অড টেনে বের করে আনল পাথরটা, খুব একটা সমস্যা হলো না। হাতে নিয়ে দেখল, সেটা আসলে চকমকি পাথর।

পাথরটার আংশিক ধুসর আর আংশিক স্যামন মাছের মতো গোলাপি। দেখে মনে হচ্ছে চোট খাওয়া।

‘কোনার দিকগুলো সম্ভবত ধারাল,’ বলল শেয়াল। ‘ওদিকে হাত দিলে কেটে যাবে। ওই পাথরগুলো ভয়ানক। বানাবার সময় ওগুলোর স্রষ্টা কোন খামতি করেনি।’

‘এটা কী?’

‘এক ধরনের কুঠার। এখানে আগে বলি-দান হত। ওই যে ওই বড় পাথরের বেদীতে। আর এই ধরনের পাথরের কুঠার ব্যবহার করা হত পশুগুলোর চামড়া থেকে মাংস ছাড়াবার জন্য।

‘তুমি কীভাবে জানো?’ জিজ্ঞেস করল অড।

শেয়ালের কণ্ঠ থেকে বের হওয়া শব্দগুলোয় পরিষ্কার গর্ব আর সন্তুষ্টি শোনা গেল, ‘তোমার কী মনে হয়? কাকে সন্তুষ্ট করার জন্য দেয়া হত বলিদান?’

পাথরের টুকরাটা নিয়ে বরফের কাছে এসে দাঁড়াল অড। হাত বুলালো চাঁইয়ে, মাছের মতোই পিচ্ছিল। চকমকি পাথরটা নিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল বরফের উপর। জিনিসটাকে উষ্ণ মনে হলো ওর।

‘গরম।’ বলল অড।

‘তাই নাকি?’ নিজেকে নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো শেয়ালকে।

চকমকি পাথর দিয়ে বানানো কুঠারটার আঘাতে যেন গলে উঠল বরফ, ঠিক যেমন চাইছিল অড। প্রায় ত্রিভুজের মতো করে বরফ কাটল অড। এক পাশ অন্য পাশের চেয়ে একটু বেশি পুরু।

শেয়াল আর ভালুক পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছে। এমনকি ঈগলও কী হচ্ছে তা দেখার জন্য নিচে নেমে এসেছে। বসেছে একটা গাছের পাতা শূন্য ডালে, পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল।

সদ্য-কাটা ত্রিভুজাকৃতি বরফের টুকরাটা নিয়ে অড এমন জায়গায় রাখল, যেন সূর্যের আলো ওর ভেতর দিয়ে গিয়ে জমাট-বাঁধা পানির উপরে পড়ে। প্রথম প্রথম কিছুই হলো না। বাঁকাল, মোচড়ালো…কিন্তু লাভের খাতা শূন্য।

হঠাৎ করে বরফের উপর নানা রঙের আলোর ছটা দেখা গেল…রঙধনুর সব রঙ।

‘চলবে?’ প্রশ্ন করল অড।

‘কিন্তু জিনিসটা তো মাটিতে।’ সন্দেহের সুরে বলল ভালুক। ‘রঙধনুর বাতাসে থাকার কথা। মানে, বলতে চাইছি, এটাকে কীভাবে সেতু হিসেবে ব্যবহার করব?’

ঈগল ডানা ঝাপটে উড়াল দিল।

‘মনে হয় না ওডিন খুব একটা খুশী হয়েছে।’ শেয়াল খোঁচা দিল, ‘তবে চেষ্টার প্রশংসা করতেই হয়!

অড শ্রাগ করল। মনটা দমে গেলেও, মুখের হাসি থামেনি ওর। রঙধনু বানাতে পেরে বেশ গর্ব বোধ করছিল। হাত দুটো ঠাণ্ডায় যেন জমে আছে। পাথরের কুঠারটা মাথার উপর তুলল। দূরে ছুঁড়ে ফেলবে। কিন্তু পারল না, উলটো হাত থেকে পড়ে গেল।

একটা চিৎকার। অড চোখ তুলে দেখল, ঈগল তীব্র গতিতে ছুটে আসছে ওদের দিকে। নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে এল, ঈগলের অস্বাভাবিক গতিতে মুগ্ধ ভাবছে, মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে থামতে পারবে তো…

কিন্তু ঈগল থামল না …

মাটিতে পরে থাকা রঙধনুর মাঝে ঝাঁপ দিল পাখিটা, গতি বিন্দুমাত্র না কমিয়ে। যেন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

রঙধনুর ভেতরে ঢুকে গেল এক লহমায়। রঙধনু যেন এতক্ষণ বন্ধ হয়ে ছিল। এবার … খুলে গেল।

ওদের চারপাশে যেন হঠাৎ করে খয়েরী রঙের ঢল নামল। সব কিছু দেখতে এখন সবুজ আর নীল মনে হচ্ছে। চারপাশে নানা রঙের ছটা—কখনো হালকা খয়েরী, আবার পর মুহূর্তেই সোনালি। কমলা বা হালকা সবুজও দেখা যাচ্ছে। ক্রাচে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে অড, কিন্তু মনে হলো কিছু একটা ওকে টানছে। রঙধনুর দিকে…

চারপাশে শুধু অন্ধকার। চোখ সয়ে আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। এরপর অড দেখতে পেল অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। তারকা খচিত রাতের অপরূপ আকাশ। একটা রঙধনুও দেখা যাচ্ছে। অডের মনে হলো, রঙধনুর উপর দিয়ে হাঁটছে। না, ঠিক হাঁটা নয়। যেন রঙধনুটাই পিছলে যাচ্ছে পায়ের নীচ থেকে। সামনে, আরও উপরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। কত দ্রুত, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত-এটা পরিষ্কার।

পিছনে ফিরে তাকাল একবার, মনে আশা-ফেলে আসা বরফের রাজ্য দেখতে পাবে। কিন্তু না, নেই কিছুই… এমনকী তারা-ও। তলপেট শক্ত হয়ে এল অডের। বুঝতে পারল উপর থেকে নিচে পড়ছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখল, রঙধনু যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। রঙের ফাঁক দিয়ে এখন দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল ফার গাছের অবয়ব। যেন কুয়াশা দিয়ে ঢাকা আর লালচে নীলাভ। ঠিক পরক্ষণেই পরিষ্কার দেখা গেল গাছগুলো-নীলচে সবুজ। ফার গাছের পাশে, বরফের উপর নামল অড। নাকে গাছের গন্ধ অনুভব করতে পারছে।

দিনের আলো ফুটে আছে। অড ভিজে গিয়েছে, শরীর ঠাণ্ডা। কিন্তু কোন ধরনের আঘাত পায়নি।

উপরে তাকাল সে, কিন্তু বাইফ্রস্টের কোন হদিস দেখতে পেল না। সামনে তাকিয়ে দেখল, ভালুক আর শেয়াল এগিয়ে আসছে ওর দিকে। গাছের ডালে কিছু একটা বসার আওয়াজ পেল-ঈগলও এসেছে।

এখন ঈগলটাকে দেখে একটু কম উন্মাদ মনে হচ্ছে, ভাবল অড। কিন্তু আগের চেয়েও বিশাল হয়ে গিয়েছে।

‘এটা কোন জায়গা?’ উত্তরটা জানা আছে, তাও প্রশ্ন করল অড। উত্তর দিল ঈগল, গলায় স্বস্তি আর আনন্দের ছাপ স্পষ্ট।

‘অ্যাসগার্ড!’

অধ্যায় পাঁচ – মিনিরের কুপে

মনের চাহিদা পরিষ্কার বুঝতে পারছে অড। ওর মন চাইছে, যেন চিরচেনা পৃথিবীতেই থাকে সে-ভাইকিংদের দেশ, মিডগার্ডে নর্স মিথলজি অনুসারে-পৃথিবী)। কিন্তু জানে, আশাটা সত্যি হবার নয়। এটা অন্য এক পৃথিবী। এমনকি এই পৃথিবীর গন্ধটাও আলাদা। জীবন্ত যেন। সব কিছু আরও প্রাণবন্ত, আরও…আসল।

আর সন্দেহ দূর করার জন্য একবার প্রাণীদের দিকে তাকানোই যথেষ্ট।

‘আরও বড় হয়েছ,’ সে বলল ওদের। ‘আকারও বেড়েছে।’

সত্যিই তাই। শেয়ালের কান এখন অডের বুক বরাবর চলে এসেছে। আর ঈগলের কথা কী বলব! আকাশে উড়ে যখন ডানা ছড়িয়ে দেয়, মনে হয় যেন কোন বড় নৌকা। আর ভালুক, যে শুরু থেকেই ছিল বিশাল—এখন বাবার কুটিরের সমান।

‘আমাদের আকার বাড়েনি।’ শেয়ালটা জানাল ওকে। গায়ের পশমের কমলা রঙের সাথে এখন আগুনের আর কোন পার্থক্য নেই। ‘এখানে আমদের আকার আসলে এমনই।’

অড নড করল। বলল, ‘তাহলে এটাই অ্যাসগার্ড? আর আমরা যে দেয়াল ঘেরা শহরে যাচ্ছি, সেটাকেও অ্যাসগার্ড বলে?

শহরের নাম দেয়া হয়েছে, ভালুক বলল, ‘আমাদের… মানে এসিরদের (নর্স পুরাণে দেবতাদের এসির বলা হয়) নামানুসারে।’

‘এখান থেকে কতদূর?

শেয়াল নাক তুলে গন্ধ নিল, তাকাল চারপাশে। পিছনে পর্বত মালা দেখা যাচ্ছে। আর চারপাশে বন। ‘এক দিনের পথ। তবে আরেকটু বেশি হলেও হতে পারে। এই বনের পর পড়বে একটা উঁচু খোলা জায়গা। শহরটা ঠিক তার মাঝখানে।’

অড আবার নড করল, ‘তাহলে যাত্রা শুরু করা যাক।’

‘এত তাড়াহুড়োর কী আছে!’ ভালুক বলল। ‘অ্যাসগার্ড তো আর কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না। আর এই মুহূর্তে আমি ক্ষুধার্ত, মাছ ধরতে যাচ্ছি। তোমরা নাহয় আগুন ধরিয়ে ফেল।’ কারও জবাবের অপেক্ষা না করে বনের মাঝে হারিয়ে গেল ভালুক। ঈগল ডানা ঝাপটিয়ে আকাশে ভাসল। অনেক, অনেক উপরে উঠে অনুসরণ করল ভালুককে।

অড আর শেয়াল লেগে পড়ল কাঠ সংগ্রহে। শুকনো, ভাঙা ডাল এক জায়গায় জড়ো করল। এরপর ছুরিটা নিয়ে, শক্ত একটা লাঠি বের করল। মাথাটা চেঁছে একেবারে চোখা বানিয়ে ফেলল। সবশেষে খুঁজে বের করল এক টুকরা নরম কাঠ, তৈরি হয়ে নিল চোখা মাথাটা নরম কাঠের উপর রেখে। এবার ঘষবে, আর সেই ঘর্ষণ থেকে বের হবে আগুন।

শেয়াল ওর দিকে আড়চোখে তাকাল, ‘এত ঝামেলা করার কী দরকার। দাঁড়াও…’ এই বলে মুখটাকে নিয়ে গেল জড়ো করা কাঠের কাছে, শ্বাস ফেলল একটা। বাতাস যেন মুহূর্তেই উষ্ণ হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, আগুন ধরে গিয়েছে!

কীভাবে করলে কাজটা?’

‘এটা অ্যাসগার্ড।’ শেয়ালটা বলল, ‘তোমার পৃথিবী না। এখানে, দেবতারা… তা তারা দেখতে যেমনই হোন…বেশ ক্ষমতা সম্পন্ন। বুঝতে পেরেছ?’

‘পুরোপুরি না। তবে না বুঝলেও সমস্যা নেই।

অড আগুনের পাশে বসে ভালুক আর ঈগলের ফেরার জন্য অপেক্ষা করল। করার মতো আর কিছু না পেয়ে হাতে তুলে নিল বাবার কুটিরে পাওয়া কাঠের টুকরা। শুরু করল চাঁছা, চাঁছতে চাঁছতেই ভাল করে পরীক্ষা করল টুকরাটাকে। বাবা এটা ব্যবহার করে কী বানাতে চাচ্ছিল, বুঝতে পারছে না। আর সে জন্য কেন বিরক্তি বোধ করছে-তা-ও না। তবে কাঠের উপর হাত বুলিয়ে যেন কিছুটা শান্তি খুঁজে পাচ্ছে।

গোধূলির আলো নামলে, ভালুককে ফিরে আসতে দেখল অড। ঘাড়ে করে নিয়ে আসছে, ওর দেখা সবচেয়ে বড় ট্রাউট। ছুরি দিয়ে ভিতরটা পরিষ্কার করল অড (ফেলে দিতে হলো না। শেয়াল ওগুলো খুব আগ্রহ নিয়েই খেল), এরপর লম্বা একটা লাঠি নিয়ে ঢুকিয়ে দিল দেহের পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর। এরপর হাতে হাতে বানিয়ে ফেলল পোড়ানোর মতো একটা গ্রিল। কয়েক মিনিট পরপর উল্টালো মাছ, যেন পুড়ে না যায়।

মাছ রান্না শেষ হলে, ভাগ করে নিল নিজেদের মাঝে। ঈগলের ভাগে পড়ল মাথাটা। দেহটাকে ভাগ করে নিল ওরা তিনজন। তবে স্বভাবতই, ভালুক একাই অন্য দু’জনের চেয়ে বেশি খেল।

গোধূলির আলো পরিণত হলো রাতের অন্ধকারে। একটা বিশাল, গাঢ় হলুদ রঙের চাঁদ উঠছে আকাশে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, শেয়াল আগুনের পাশে শুয়ে পড়ল। ঈগল উড়াল দিয়ে বসল একটা মৃত পাইন গাছে, ঘুমাবে। অড মাছের অবশিষ্টাংশ নিয়ে পুঁতে ফেলল বরফে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছে-এমন করে রাখলে পচন ধরে না।

ভালুক অডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই তৃষ্ণার্ত। চলো, পানি খুঁজে আনি।’

অড ভালুকের চওড়া পিঠে উঠে বসল। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। ভালুকটা ওকে পিঠে নিয়ে ঢুকে পড়ল বনের ভিতর।

কেন জানি, অডের মনে হচ্ছে না ওদের এই যাত্রা উদ্দেশ্যহীন। বরং ওর মনে হচ্ছে, ভালুক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে একটা বিশেষ জায়গার দিকে এগোচ্ছে। বেশ কিছু চড়াই-উত্রাই, গাছের কাণ্ড আর রুক্ষ জমি পার হয়ে ওরা এসে পৌঁছল একটা পরিষ্কার জায়গায়। সামনে একটা ছোট পুকুর দেখা গেল। পরিষ্কার পানি ওতে টলটল করছে।

‘সাবধান,’ ভালুক সতর্ক করে দিল ওকে। ‘দেখে মনে হয় না, কিন্তু পানি অনেক গভীর।’

অড এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পানির দিকে। চাঁদের আলোয় সবকিছুই রহস্যময় মনে হয়। কিন্তু তারপরও…

‘পানিতে কিছু একটা নড়াচড়া করছে।’ বলল সে।

‘তোমার কোন ক্ষতি করবে, এমন কিছুই ওখানে নেই।’ ভালুক আশ্বস্ত করল ওকে। ‘আসলে ওগুলো প্রতিবিম্ব। পানি পান করতে কোন অসুবিধা নেই, আমি জানি। নিশ্চিন্তে পান করতে পার।’

অড বেল্টে ঝোলানো কাঠের কাপটা খুলে নিল। পানিতে ডুবিয়ে পান করল প্রাণভরে। নিজেকে প্রাণবন্ত মনে হলো ওর, পানির স্বাদটাও মিষ্টি। কতটা তৃষ্ণা পেয়েছে, তা পানি পান করার আগে বুঝতেও পারেনি। চার চার বার কাপ ভর্তি করে

পান করল সে।

হাই তুলল এরপর, ‘ঘুম ঘুম লাগছে।’

‘পথ চলার ক্লান্তি পেয়ে বসেছে তোমাকে।’ বলল ভালুক, দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি।’ দাঁত দিতে পড়ে থাকা কিছু ফারের ডাল টেনে এনে সুন্দর করে সাজাল সে। ‘এখানে শুয়ে পড়।

‘কিন্তু অন্যরা…’ বলা শুরু করল অড।

‘আমি ওদেরকে বলে দেব তুমি এখানে ঘুমাচ্ছ।’ ভালুক বলল, ‘তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রেখো, ভুলেও এখান থেকে নড়ো না যেন। এখন ঘুমাও।’

ভালুকটা নিজের ভর চাপিয়ে দিল ডালের উপর, যেন অড আরাম করে শুতে পারে। ছেলেটা ভালুকের পাশেই শুয়ে পড়ল। প্রাণীটার গায়ের গন্ধ নাকে আসছে। সেই সাথে অনুভব করতে পারছে তার নরম পশম আর শরীরের উষ্ণতা।

ওর পৃথিবীটা এখন চুপচাপ, শান্ত, আরামদায়ক। সে নিজে নিরাপদ। অন্য সব কিছু যেন অন্ধকারে বাঁধা পড়া…

চোখ খুলে দেখতে পেল, একা একা শুয়ে আছে। শরীরটা যেন জমে গিয়েছে ঠাণ্ডায়। চাঁদটা উঠে এসেছে আকাশের ঠিক মাঝখানে বিশাল আর সাদাটে। মিডগার্ডের চাঁদের চেয়ে না হলেও দ্বিগুণ হবে-ভাবল অড। কিন্তু কেন? অ্যাসগার্ড কি চাঁদের আরও বেশি কাছে তাই? নাকি অ্যাসগার্ডের চাঁদ আলাদা…

ভালুক নেই। উধাও হয়ে গিয়েছে।

চাঁদের আধো আলোয়, পুকুরে ছায়ার নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে অড। নিজেকে টেনে তুলে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরও কাছে চলে এল সে। ভালভাবে দেখতে চায়।

পানির ধারে হাঁটু গেঁড়ে বসল সে। হাতের অঞ্জলিতে তুলে আনল পানি, ঠোঁটে ছোঁয়াল। পানিটা বরফের মতোই ঠাণ্ডা। কিন্তু পান করতেই কেন যেন উষ্ণতা আর নিরাপদ বোধ করল।

ছায়াগুলো বারবার ভেঙে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।

‘কী দেখতে চাও?’ অডের পিছন থেকে এক গলা প্রশ্ন করল।

অড উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

‘তুমি আমার ঝর্ণা থেকে পান করেছ।’ আবার বলল গলাটা।

‘আমি কী ভুল কিছু করেছি?’ জানতে চাইল অড।

এক মুহূর্তের নীরবতার পর উত্তর এল-’না।’ গলাটা শুনে মনে হলো অনেক পুরনো। এতটাই যে ছেলের কণ্ঠ না মেয়ের তা বলা যায় না। ‘দেখো।’ যেন আদেশ করল গলা।

পানির উপর প্রতিবিম্ব দেখতে পেল অড। বাবাকে দেখতে পেল, শীতের সময় ওর আর মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলছে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সবাই…

ওর মাকেও দেখতে পেল। বসে বসে ফ্যাট অ্যালফ্রেডের জামা সেলাই করছে। চোখজোড়া লাল, নিশ্চয়ই কেঁদেছে।

হিম-দানবদের ঠাণ্ডা আবাসস্থলও দেখতে পেল। দেখল, ওরা পাথর ছুঁড়ে মজা করছে, লম্বা শিং-এর একটা এল্ক হরিণের মাংস খাচ্ছে। চাঁদের আলোয় নাচছে মনের আনন্দে।

বাবাকে আবার দেখতে পেল। কুটিরে বসে আছে। এক হাতে ছুরি, আর অন্য হাতে কাঠের টুকরাটা। চাঁছতে শুরু করল, মুখে হাসি। অডের খুব পরিচিত মনে হলো হাসিটা।

পরক্ষণেই ওর বাবা হারিয়ে গেল। তার জায়গায় দেখা গেল এক যুবককে। বাবাকেই দেখা যাচ্ছে–চিনতে পারল অড, তবে সে এখন যুবক। নৌকা থেকে লাফিয়ে বালুকাবেলায় নামছে। স্কটল্যাণ্ড নিশ্চয়! অড বুঝতে পারল, কিছুক্ষণ পরই ওর বাবা আর মায়ের মাঝে প্রথম দেখার ঘটনা ঘটবে…

মাকে দেখা যাচ্ছে এখন। গ্রেট হলের এক কোনায় বসে আছে…চোখে পানি, লাল হয়ে আছে।

অড দেখেই চলল।

চাঁদের আলো এখানে বেশ উজ্জ্বল। অডের যা যা দেখা দরকার, তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর, কুটির থেকে বয়ে নিয়ে আসা কাঠের টুকরাটা হাতে তুলে নিল সে। ছুরি বের করে চাঁছতে শুরু করল। মসৃণ করে, আত্মবিশ্বাসের সাথে। যেগুলো চেঁছে ফেলা দরকার, একে একে খসে পড়ছে।

ভোরের সূর্য উঁকি দেবার আগ পর্যন্ত কাজ করে গেল অড…

কাজ করল ভালুক গাছের ডাল সরিয়ে খোলা জায়গায় আসার আগ পর্যন্ত।

পানিতে কী দেখেছে-সেকথা একবারও জিজ্ঞেস করল না ভালুক। অডও কিছু বলল না। চুপচাপ চড়ে বসল ভালুকের পিঠে। ‘আবার ছোট হয়ে যাচ্ছ।’ বলল অড। গত সন্ধ্যার মতো আর বড় দেখাচ্ছে না ভালুককে। বরং প্রথম দেখার চেয়ে অল্প একটু বড় মনে হচ্ছে। যাচ্ছ না, ছোট হয়ে গেছ!

‘তাই?’ শুধু এটুকুই বলল ভালুক।

‘হিম-দানবদের আবাস কোথায়?’ অড জানতে চাইল।

চলতে চলতেই জবাব দিল ভালুক, ‘জতুনহেইম। শব্দটার অর্থই হলো দানবদের আবাস। বিশাল নদীর পারে। সাধারণত ওরা আমাদের দিকে আসে না। কিন্তু মাঝে মাঝে… একবার ওদের একজন পার হয়ে এসে চাঁদ, সূর্য আর লেডি ফ্রেয়াকে চেয়ে বসে। তার আগের জন চেয়েছিল আমার হাতুড়ি মিয়োলনির আর লেডি ফ্রেয়াকে। আরেকবার তো অ্যাসগার্ডের সব সম্পদ আর লেডি ফ্রেয়াকেই চেয়ে বসেছিল… ‘মনে তো হচ্ছে, ওরা লেডি ফ্রেয়াকে একটু বেশিই পছন্দ করে।’ বলল অড।

‘হ্যাঁ। ওদেরই বা দোষ কী? লেডি ফ্রেয়া অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী।’

‘জতুনহেইম জায়গাটা কেমন?’ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে অড।

‘ধূসর, বিরান। ঠাণ্ডা। এখানকার মতো না। তবে লোকিকে জিজ্ঞেস করলে আরও ভাল জানতে পারবে।’

‘কেন?’

‘লোকি জন্ম থেকেই এসির না। ও জন্মেছে হিম-দানবদের ঘরে। ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট হিম-দানব ও। সবাই ওকে উপহাস করত। তাই ওদেরকে ছেড়ে চলে আসে সে। পথে ওডিনের জীবন বাঁচায়। আর…’

ভালুক একটু ইতস্তত করল। যেন কিছু বলবার আগে আবার ভেবে নিচ্ছে, কীভাবে কথাটা বলা যায়। ‘…ও থাকলে, সময়টা ভাল কাটে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘গত রাতে যা যা তুমি করেছ বা দেখেছ…’

‘হ্যাঁ?’

‘জ্ঞানী মাত্রই জানে, কখন চুপ থাকতে হয়। বোকারাই সবকিছু বলে বসে।’ শেয়াল আর ঈগল আগুনের পাশে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। অড মাছের বাকি অংশটুকু খেয়ে শেষ করে ভালুক বলল, ‘এবার? এবার আমাদের কী করণীয়?’

অড বলল, ‘আমাকে বনের ওই প্রান্তে নিয়ে চল। ওখানে তোমরা অপেক্ষা করবে। আমি দেয়াল পর্যন্ত হেঁটে যাব।’

‘কেন?’ জানতে চাইল শেয়াল।

‘কারণ আমি চাই না হিম-দানবরা জানুক যে তোমার ফিরে এসেছ।’ উত্তর দিল সে।

আর কথা না বাড়িয়ে রওনা হলো অদ্ভুত দলটা।

‘ভালুকের পিঠে চড়ে চলাচল করাটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে দেখি। মন্দ না।’ বলল অড। কিন্তু ভালুক ঘোঁত করে উঠল।

অধ্যায় ছয় – অ্যাসগার্ডের দরজা

বনের প্রান্তে এসে থামল ভালুক, অড নেমে এল নিচে। বগলের তলে ক্র্যাচ ঢুকিয়ে আঁকড়ে ধরল ডান হাতে।

‘পৌঁছে গেছি।’ বলল সে। ‘আমাকে শুভ কামনা জানাও। দেবতাদের শুভ কামনা কাজে আসা উচিত।’

‘যদি তুমি আর কখনো ফিরে না আস?’ জিজ্ঞেস করল শেয়াল।

‘তাহলে ক্ষতি কি? তোমাদের অবস্থা তো আর আগের চেয়ে খারাপ হবে না।’ আনন্দ চিত্তে বলল অড। ‘আর ফিরব না কেন?’

‘ওরা হয়তো তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’ বলল ভালুক।

অড চমকে উঠল, ‘ইয়ে…হিম-দানবরা মানুষ খায়?’

কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেল সবাই। এরপর শেয়াল উঠল, ‘মাঝে মাঝে।’ আর ভালুক বলল, ‘প্রায় কখনোই খায় না।’

কেশে উঠল শেয়াল। ‘তোমার জায়গায় আমি হলে চিন্তা করতাম না।’ যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে, এমনভাবে বলল সে। ‘এমনিতেই তোমার গায়ে মাংস নেই। খেয়ে পোষাবে না।’ দাঁত বেড় করে হাসল সে। কিন্তু ওর হাসিও অডের মন ভাল করতে ব্যর্থ হলো। ক্র্যাচটাকে আঁকড়ে ধরে হাঁটতে শুরু করল সে। কষ্ট হচ্ছে খুব, তাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। উদ্দেশ্য-দেবতাদের আবাসকে ঘিরে রাখা পাথরের দেয়াল।

পথটা বরফে ঢেকে আছে, পিচ্ছিল। কিন্তু অড অবাক হয়ে লক্ষ করল, হাঁটতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না।

অ্যাসগার্ডের দিনগুলো মিডগার্ডের চেয়ে লম্বা। সাদা আকাশে রুপালি রঙের সূর্য অনেকক্ষণ আলো দেয়।

অড যেন নিজেকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একধাপ একধাপ করে। বার বার মনে পড়ছে সেই আগের কথা। যখন ওর পা ভাঙেনি, তখন খুব সহজে হাঁটতে পারত। এক পায়ের সামনে অন্য পা ফেলাটা যে কত বড় আশীর্বাদ, তা এখন টের পাচ্ছে।

প্রথম দেখায় অড ভেবেছিল, অ্যাসগার্ডের দেয়ালটা আসলে একটা লম্বা মানুষের সমান হবে উচ্চতায়। দেয়ালের সাথে একটা মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে। অন্তত ওর কাছে মূর্তি বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু যতই এগোয় দেয়ালের দিকে, ততই বড় হয় দেয়াল। আর সেই সাথে মূর্তিও। একসময় অবস্থা এমন হলো, মূর্তির মাথা দেখতে হলে ঘাড় উপরে তুলে তাকাতে হয়।

দেয়ালের দিকে একেক পা বাড়ানোর সাথে সাথে অডের মনে হলো তাপমাত্রা ও কমে আসছে। মূর্তিটা প্রতি পদক্ষেপে আরও কাছে চলে আসছে।

হঠাৎ নড়ে উঠল মূর্তিটা, অড বুঝতে পারল ওটা আদপে মূর্তিই নয়।

‘কে তুমি?’ গমগমে স্বরে বলল হিম-দানব। অডের মনে হলো, তুষার ধ্বস হচ্ছে ধারে-কাছে।

‘আমার নাম অড।’ চিৎকার করল সে, আর হাসল।

হিম-দানব মাথা নিচু করে ওর দিকে তাকাল। যেখানে ভ্রু থাকার কথা, সেখানেও বরফ দেখতে পেল অড। চোখও দেখতে জমাট-বাঁধা পানির মতো। যেন এখনই ভেঙে যাবে।

তুমি কি? দেবতা? নাকি ট্রল? নাকি জীবন্মত?’

‘আমি মানুষ।’ আবার চিৎকার করে হাসতে হাসতে জবাব দিল অড।

ইমিরের কসম, এখানে কী মানুষের কাজ?’

অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছে অডের মনে। সে এমন একজনের সাথে কথা বলছে যে ওকে সহজেই ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারে। যেমনটা মানুষ পারে কোন ইঁদুরকে ভর্তা করতে। অন্তত, ইঁদুরটার দৌড়াবার ক্ষমতা আছে—আপন মনে ভাবল অড।

‘আমি এসেছি অ্যাসগার্ড থেকে হিম-দানবদের তাড়িয়ে দিতে।’ ব্যাখ্যা করল অড মুখে এখন সেই বড়, আর বিরক্তি উদ্রেককর হাসি।

হাসিতেই কাজ হলো। না হলে সম্ভবত দানবটা ওকে ভর্তাই বানিয়ে ফেলত। অথবা মাথাটা খেয়ে নিয়ে শরীরটা রেখে দিত পরে খাবার জন্য। কিন্তু সেই হাসিটা …যেটা দেখলেই মনে হয় অড এমন কিছু জানে যা বলছে না, বাঁচিয়ে দিল ওকে।

‘না।’ বলল দানব, ‘পারবে না।’

‘পারব তো!’ বলল অড।

‘আমি লোকিকেও বোকা বানিয়েছি।’ গর্ব ভরে বলল দানব। ‘থরকে হারিয়েছি। ওডিনকে নির্বাসন দিয়েছি। আমার শাসনের ফলে অ্যাসগার্ড জুড়ে এখন শুধু শান্তি আর শান্তি। এই মুহূর্তে জতুনহেইম থেকে আমার ভাইয়েরা আসছে আমাকে সাহায্য করতে।’ উত্তরের দিকে এক পলকের জন্য তাকাল সে। ‘দেবতারা আমার ভৃত্য। সুন্দরী ফ্রেয়া আমার বাগদত্তা। আর তোমার ধারণা, তুমি আমাকে হারাতে পারবে?’

অড শ্রাগ করে হাসল শুধু। ওর সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বেশি বিরক্তি উদ্রেককারী হাসি। গ্রামে এই হাসির জন্যই ওকে অনেক মার খেতে হয়েছে। কিন্তু দানবটা এমন হাসি আর কোনদিন দেখেনি। তাই বিভ্রান্ত হয়ে গেল সে।

‘আমি অ্যাসগার্ডের রাজা!’ যেন ঘোষণা দিল দানব।

‘কেন?’ প্রশ্ন করল অড।

‘কেন?’

‘চিৎকার করতে হবে না। আমি এমনিই শুনতে পাচ্ছি।’ চিৎকারের প্রতিধ্বনি থামলে বলল অড। এরপর গলা একটু নামিয়ে কথা বলল। যেন দানবটা একটু ঝুঁকে আসে।

‘অ্যাসগার্ডের রাজা কেন হতে চাও? লাভ কী?’

পাথরের উপর এতক্ষণ বসে ছিল দানবটা। এবার উঠে দাঁড়াল। বুড়ো আঙুল দিয়ে পিছন দিয়ে ইঙ্গিত করে বলল, ‘দেয়ালটা দেখেছ?’

না দেখে আর যাবে কোথায়? দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। দেয়ালের প্রতিটা পাথর, অডের গ্রামের একেকটা বাড়ির চেয়ে বড়।

‘আমার ভাই এই দেয়ালটা বানিয়েছিল। দেবতাদের সাথে চুক্তি হয়েছিল-ছয় মাসের মাঝে তাদেরকে একটা দেয়াল বানিয়ে দেবে। আর না পারলে, ওকে কোন কিছু দিতে হবে না। আর ছয় মাসের একেবারে শেষ দিনের শেষ ঘণ্টায়, যখন কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে-দেবতারা ওকে ধোঁকা দিল।’

‘কীভাবে?’

‘একটা ঘোটকী দিয়ে। এর চেয়ে সুন্দর ঘোটকী আর কেউ কোনদিন দেখেনি। আমার ভাই যে স্ট্যালিয়নটাকে ব্যবহার করে পাথর বয়ে আনত, সেটাকে প্রলুব্ধ করে ফেলল। বাঁধন ছিঁড়ে ঘোড়াটা ওই ঘোটকীর পিছু পিছু হারিয়ে গেল বনে। আর যখন আমার হতভাগ্য ভাই অভিযোগ জানাতে গেল, থর অভিযান থেকে ফিরে এসে নিজের সেই অভিশপ্ত হাতুড়ি দিয়ে মেরে ফেলল ওকে। আসলে দেবতা আর হিম- দানবদের সব গল্পের শেষ একই রকম হয়-থর ওর হাতুড়ি দিয়ে হিম-দানবকে মেরে ফেলে। কিন্তু আর না, এবার অন্তত তা হতে দিচ্ছি না।’

‘অবশ্যই না।’ বলল অড। আন্দাজ করতে পারছে, ঘোটকীটা আসলে কে ছিল! ‘তা তোমার ভাই পারিশ্রমিক হিসেবে কী চেয়েছিল?’

‘তেমন বেশি কিছু না।’ বলল দানব। ‘এই দুই একটা ছোটখাট জিনিস।’

আবার পাথরে বসে পড়ল দানব। তার স্পর্শে আসা মাত্রই বাষ্প হয়ে যাচ্ছিল বাতাস। ফিয়র্ডে এমন হতে দেখেছে অড। যখন বাতাস পানির চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা হয়, তখন এমনটা হয়। একবার ভাবল, না জানি হিম-দানব নিজে কতটা ঠাণ্ডা।

‘সূর্য চেয়েছিল।’ বলল দানব, ‘আর চাঁদ। আর ফ্রেয়াকে। ও পায়নি, কিন্তু এসব কিছু এখন আমার দখলে। অ্যাসগার্ডটাই আমার দখলে!’

‘প্রথমবার যখন বললে, তখনই শুনেছি।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দু’জনে। দানবটাকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে-ভাবল অড। কি যেন ভেবে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু এই জিনিসগুলো চেয়েছিল কেন?’

হিম-দানব লম্বা একটা শ্বাস নিল, ‘আমাকে প্রশ্ন করার সাহস তোমার হয় কী করে!’ গর্জে উঠল সে। অডের মনে হলো, পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। ক্র্যাচের উপর ভালভাবে ভর দিয়ে দাঁড়াল সে। কিন্তু কিছু বলল না। শুধু হাসল।

‘তোমাকে তুলে নিলে কি কিছু মনে করবে?’ দানবটা জানতে চাইল, ‘মুখোমুখি হলে কথা বলতে সুবিধা হয়।’

‘সাবধানে তুলো কিন্তু।’ অনুমতি দিল অড।

দানবটা ঝুঁকে পড়ে মাটিতে হাত রাখল। অড অদ্ভুতভাবে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল তালুর উপরে। খুব সাবধানে হাতটাকে উপরে তুলে নিল দানব, যতক্ষণ পর্যন্ত না অড ওর চোখ বরাবর চুলে আসে। শীতে বাতাসের আর্তনাদের মতো কাঁপা কাঁপা গলায় ফিস ফিস করে বলল, ‘সৌন্দর্য।’

‘সৌন্দর্য?’

‘বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর তিনটা বস্তু-সূর্য, চাঁদ আর ফ্রেয়া। জতুনহেইমে সুন্দর কিছু নেই। শুধু পাথর আর খানা খন্দ…অবশ্য সেগুলোও সুন্দর। চাঁদ আর সূর্যকে ওখান থেকেও দেখা যায়। কিন্তু ফ্রেয়া…ফ্রেয়ার মতো সুন্দর কিছু নেই। তবে ওর জিভটা একটু বেশিই চলে, এই যা।’

‘তার মানে, তোমার এখানে আসার একমাত্র কারণ সৌন্দর্য?’

‘সৌন্দর্য আর আমার ভাই-এর মৃত্যুর বদলা। জতুনহেইমের সবার সামনে আমি বলেছিলাম যে, আমি দেবতাদের হারাতে পারব। কিন্তু ওরা শুধু হেসেছে। কিন্তু এখন? শেষ হাসি কে হাসল?’

‘বসন্তের কথা কোনদিন শুনেছ?’

‘বসন্ত?’

‘বসন্ত। মিডগার্ডের বসন্ত, আমি যেখান থেকে এসেছি। এই বছর সেখানে বসন্ত আসেনি। আর যদি শীত বিদায় না নেয়, তাহলে সবাই মারা যাবে। মানুষ, প্রাণী, গাছ।’

জানালার চেয়ে আকারে বড় নীল চোখজোড়া দিয়ে অডের দিকে তাকাল দানব, ‘তাতে আমার কী?’ অডকে দেয়ালের উপর নামিয়ে দিল দানব, যে দেয়ালটা নিজ হাতে বানিয়েছিল ওর ভাই। এত উপরে বাতাসের বেগ কম না। অড ক্র্যাচটাতে আরও ভাল মতো ভর দিল। নাহলে হয়তো বাতাসের ধাক্কায় উড়েই যাবে। মাটি অনেক নিচে। এখান থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না। পিছনে ফিরে দেখল একবার। দেবতাদের বাড়ি আর ওর গ্রামে মানুষের বানানো বাড়ির মাঝে তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পেল না সে। শুধু আকারে বড়—এই যা।

অড বলল, ‘যায় আসে। কারণ তুমি সৌন্দর্যের পূজারী। আর শীত চললে, সৌন্দৰ্য বলতে কিছু বাকি থাকবে না। শুধু মৃত জিনিস অবশিষ্ট থাকবে।’

‘মৃত জিনিস সুন্দর হতে পারে না, তা কে বলল?’ বলল দানব। ‘যাই হোক, আমি জিতেছি। আমি ওদেরকে হারিয়েছি, বোকা বানিয়েছি। থর আর ওডিনকে নির্বাসন দিয়েছি, ওই বিশ্বাসঘাতক লোকিকেও।’ দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে।

গত রাতে পানিতে দেখা ছবিগুলো মনে পরে গেল অডের। বলল, ‘তুমি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস কর যে তোমার ভাইয়েরা সাহায্য করার জন্য আসছে?’

‘আহ।’ অনিশ্চিত সুরে বলল দানব, ‘আসার কথা। বলে তো ছিল যে আসবে। তবে…তবে… .আমার মনে হয়, আমি যে দেবতাদের হারাতে পারব, সেটা কেউ আশাই করতে পারেনি। আর তাছাড়া ওদের আরও কাজ আছে। ক্ষেত খামার, বাড়িঘর, বউ-বাচ্চা আছে। এই গরম রাজ্যে এসে একদল অসহ্য দেবতাকে পাহারা দেয়াটা খুব একটা লোভনীয় ঠেকার কথা না।’

‘আর নিশ্চয়ই ওরা সবাই ফ্রেয়াকে বাগদত্তা বানাতে পারবে না!’

‘ওদের কপাল ভাল।’ তেতো স্বরে বলল দানব, ‘সে সুন্দরী…কোন সন্দেহ নেই… .একদম ঠিক কথা।’ মাথা নাড়ল সে, চুল আর দাড়ি থেকে বরফের চাই ভেঙে নিচে পড়ে গেল। পাথরের সাথে বাড়ি খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেগুলো। ‘বিড়ালবাহী একটা রথও আছে। কোন কুক্ষণেই যে ওই বিড়ালগুলোকে আদর করতে গিয়েছিলাম!’ ডান হাতের তর্জনী দেখাল অডকে। খামচির দাগ দেখা যাচ্ছে। ‘আর মেয়েটা বলে কি না দোষ আমার!’

‘সে সুন্দরী,’ বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কিন্তু লম্বায় বড়জোর আমার পায়ের সমান। আর রেগে গেলে আমাদের মেয়েদের চেয়েও জোরে চিৎকার করে। আর কী কপাল, সে যেন চব্বিশ ঘণ্টাই সে রেগে আছে।’

‘কিন্তু যেহেতু একবার জিতে গিয়েছ, বিজিত এলাকা ছেড়েও যেত পারছ না। তাই না?’ জিজ্ঞেস করল অড।

‘ঠিক ধরেছ। এই গরম, বাজে জায়গাটায় দিনের পর দিন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। জানি সাহায্য আসবে না, তা-ও। স্থানীয়রা ঘৃণা করে আমাকে…’

‘তাহলে বাড়ি চলে যাও,’ শান্ত গলায় বলল অড। ‘কেউ জিজ্ঞেস করলে বোলো, আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি।’ মুখে সেই হাসিটা এখন নেই।

হিম-দানব অডের দিকে তাকাল, আর অড তাকাল হিম-দানবের দিকে।

‘লড়াই করার জন্য তুমি খুব ছোট। আর আমাকে এখন পর্যন্ত বোকাও বানাতে পারোনি। হারাতে হলে বোকা বানাতে হবে।’

অড নড করল। ‘মা আমাকে ছোট ছোট ছেলেদের গল্প শোনাতেন। গল্পে ওরা দানবদের বোকা বানিয়ে হারাত। একটা গল্পে ছিল পাথর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতার কথা। ছেলেটার একটা পাখি ছুঁড়ে দিয়েছিল। সেটা একবার ছাড়া পেয়ে আর মাটিতে নামেনি।’

‘আমাকে ওভাবে বোকা বানানো যাবে না।’ দানব বলল, ‘আর তাছাড়া গল্প কি আর বাস্তব? পাখি ছাড়া পেলে একদম কাছের গাছটায় গিয়ে বসে।’

আমি চেষ্টা করছি…’ বলল অড, ‘এমন একটা উপায় বের করতে…যেন আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে, অক্ষত অবস্থায় তুমি ঘরে ফিরে যেতে পার। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করছ না।’

‘অক্ষত অবস্থায়?’

‘তুমি থরকে মিডগার্ডে নির্বাসন দিয়েছ।’ অড ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘কিন্তু সে ফিরে এসেছে। এখানে এসে পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার মাত্র।’

দানব চোখ পিটপিট করে তাকাল। ‘কিন্তু ওর অস্ত্র, এত সাধের হাতুড়ি আমার কাছে। এই যে পাথরটা দেখছ, আসলে এটাই মিয়োলনির।’

‘বাড়ি ফিরে যাও।’

‘কিন্তু আমি যদি ফ্রেয়াকে জতুনহেইমে নিয়ে যাই, সে তো চিল্লিয়ে মাথা খেয়ে ফেলবে। আর যদি থরের হাতুড়ি নিয়ে যাই, ও কি আমাকে ছাড়বে? ঠিক মেরে ফেলবে।’

অড মাথা নেড়ে বোঝাল, সে-ও একমত। আসলে কথা দুটো সত্যি।

পরবর্তী দিনগুলোতে, দেবতারা গ্রেট হলে বসে এই গল্পটা বলার সময় এলে ইতস্তত করতেন। কেননা ঠিক সেই মুহূর্তে অড নিজের শত-ছিন্ন জামার ভিতর হাত ঢুকিয়ে বের করে এনেছিল একটা কাঠের মূর্তি। কীসের—তা শত চেষ্টা করেও কেউ দেখতে পারেনি।

কেউ কেউ বলেন, জিনিসটা আসলে কাঠের তৈরি একটা চাবি। আবার কেউ বলেন, জিনিসটা কাঠের হৃদপিণ্ড। একদলের মতে, অড দানবটাকে ঠিক থরের হাতুড়ির মতো দেখতে একটা মূর্তি দেখিয়েছিল। আর দানবটা তা আসল না নকল বুঝতে না পেরে, ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

আসলে সবাই ভুল করেছে।

জিনিসটা বের করার আগে অড বলল, ‘আমার বাবা স্কটল্যাণ্ডের কোন এক জায়গায় লুটপাট করার সময় আমার মাকে দেখতে পায়। স্কটল্যাণ্ড জায়গাটা আমাদের এলাকা থেকে অনেক দক্ষিণে। তখন মা নানার ভেড়া একটা গুহায় লুকোবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। বাবা তার চেয়ে সুন্দর কাউকে বা কোন কিছুকে আগে দেখেনি। তাই ভেড়া আর মা, দুইটা বস্তুকেই তুলে এনেছিল। আমাদের ভাষা শেখাবার আগে মাকে স্পর্শও করেনি। তারপর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বলেছিল, মা এত সুন্দর যে যে ঘরেই থাকে সে ঘরকেই উজ্জ্বল করে তোলে। গ্রীষ্মের সূর্যের মতোই উজ্জ্বল করে তুলেছিল মা বাবার জীবনটাকে।

‘এ তো তোমার জন্মের আগের কথা।’ বলল দানব।

‘ঠিক বলেছ। কিন্তু আমি জানি কথাটা সত্যি।’

‘কীভাবে?’

অডকে কেউ না বলে দিলেও সে বুঝতে পেরেছিল, এই দানবকে ওই প্রতিবিম্বঅলা পুকুরের কথা কিছুতেই বলা যাবে না। তাই মিথ্যা বলল সে, অবশ্য এক হিসাবে কথাটা মিথ্যাও না। ‘আমার বাবার চোখে দেখেছি। সে মাকে খুব ভালবাসত। আর বেশ কিছু বছর আগে, তার জন্য একটা মূর্তি বানানো শুরু করেছিল। কিন্তু আফসোস, শেষ করতে পারেনি। তার আগেই মারা গিয়েছে। তাই তার হয়ে, গত রাতে আমি কাজ শেষ করে ফেলেছি। প্রথমে বুঝতে পারিনি, শেষ পর্যন্ত জিনিসটা কী সে রূপ নেবে। কিন্তু তারপরই মাকে দেখতে পেলাম। যেভাবে বাবা প্রথম তাকে দেখেছিলেন…দেখলাম মানে কল্পনা করলাম আরকী।

মাকে যখন তুলে আনা হয়েছিল, তার দেশ আর তার লোকদের কাছ থেকে দূরে। কিন্তু তিনি ভয় পাননি। দুঃখের সামনে মাথাও নত করেননি। ঠিক তখনকার রূপে।’

দানব একটা কথাও বলল না।

অড বলল, ‘এখানে এসেছ সৌন্দর্যের খোঁজে। তাই না? খালি হাতে তো আর ফিরতে পার না।’

জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কাঠের মূর্তিটা বের করে আনল অড। বাবার শুরু করা মূর্তি, যেটাকে সে সমাপ্ত করেছে। মায়ের মূর্তি, ওর জন্মের আগে মাকে যেমন দেখাত। অডের বানানো শ্রেষ্ঠ মূর্তি ছিল এটি।

দানব ভ্রু কুঁচকে পরীক্ষা করে দেখল ওটাকে, এরপর হেসে ফেলল। মাত্র এক পলকের জন্য। মূর্তিটাকে নিজের ঝোলায় ভরল সে। বলল, ‘অ…সাধারণ একটা জিনিস। দেখতেও সুন্দর। এটাকে আমার সাথে জতুনহেইমে নিয়ে যাব। আমার বাড়ির শোভা বাড়াবে।’ ইতস্তত করে আবার বলল, ‘আচ্ছা তোমার কি মনে হয়, আমার কী লেডি ফ্রেয়াকে বিদায় জানা’না উচিত হবে?’

অড বলল, ‘আমার মনে হয়, কাজটা করলে তোমাকে আরও কিছু বকা শুনতে হতে পারে।’

‘অথবা সাথে নেবার জন্য পীড়াপীড়িও করতে পারে।’ অড প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারে, কথাটা বলতে গিয়ে দানব যেন একটু কেঁপে উঠল।

দানব অডের কাছ থেকে এক কদম এক কদম করে দূরে সরতে শুরু করল। যতই দূরত্ব বাড়ছে, দানবটার আকারও যেন বাড়ছে। এক সময় পাহাড়সম থেকে পর্বতসম হয়ে গেল দানবটা। এক হাত যখন উপরে তুলল, তখন দেখা গেল মেঘের মাঝে হারিয়ে গেছে হাতও …

‘ফেরার সময় আবহাওয়াটা একটু অন্যরকম হলে ভাল হয়,’ বলল দানব। ‘যেন আমার পায়ের ছাপ কেউ অনুসরণ করতে না পারে।’

দানবটা যে কী করল, তা অড বুঝতে পারল না। কিন্তু যখন সে হাতটা মেঘের উপর থেকে নামাল, তখন তুষারপাত শুরু হলো। চোখের সামনে পৃথিবীটা ভরে উঠল তুষারে। দানব কিন্তু হাঁটা শুরু করে দিয়েছে।

‘হেই!’ ডাকল অড, ‘তোমার নাম জানা হয়নি!’

কিন্তু সম্ভবত দানবটা ওর ডাক শুনতে পায়নি। অথবা শুনলেও উত্তর দিতে চায়নি। অল্পক্ষণের মাঝেই হারিয়ে গেল সে তুষারঝড়ের মাঝে।

অধ্যায় সাত – চারটা রূপান্তর আর একটি ভোজ

বেশ কিছুক্ষণ পর ঈগলকে অডকে খুঁজে পেল। আশপাশের একটু জায়গার তুষার সরিয়ে বসে আছে অড। ঈগল ঠিক ওর পাশে গিয়ে বসল।

‘ঠিক আছে সব?’ জানতে চাইল ঈগল। গোধূলি নামছে, তুষারপাতও কমে এসেছে।

‘ঠাণ্ডা বেশ,’ অড বলল, ‘বাতাসের ঝাপ্টায় কয়েকবার উড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। ভাবছিলাম এখানেই বাকি জীবনটা কাটাতে হয়ে কি না! কিন্তু সব মিলিয়ে-হ্যাঁ। আমি ঠিক আছি।’

আরও কাছে ঘেঁষে এল বৃহদাকার পাখিটি।

নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

‘হিম-দানব চলে গিয়েছে। আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘কীভাবে?’ জানতে চাইল ঈগল।

‘জাদু দিয়ে।’ বলে হাসল অড। ভাবল, যদি জাদুর মানে হয় যে যা করতে চায় বা হতে চায়, তাই করতে বা হতে দেয়া হয়…

‘নিচে…’ বলল ঈগল।

অড তুষারাবৃত পাথরগুলো দেখে বলল, ‘আমার পক্ষে নামা সম্ভব না। চেষ্টা করলে মারা যাব।’

ঈগল আকাশে ভাসল, পরক্ষণেই নামল নিচে। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এল আবার। এবার সাথে করে নরম চামড়ার এক পাটি জুতা এনেছে। অডের পাশে ফেলে দিল সেটা। আবার উড়ল, ফিরে এল অন্য পাটি নিয়ে।

‘অনেক বড়। পায়ে হবে না।’ বলল অড।

‘লোকির…’

‘ওহ।’ লোকির গল্পে শোনা জুতার কথা মনে পড়ে গেল ওর। জুতাজোড়া বাতাসে ভাসে।

পায়ে পরে নিল জুতাজোড়া। এরপর দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেল দেয়ালের একদম ধারে। থমকে দাঁড়াল।

লাফ দিতে চাইল, কিন্তু পারল না। পেশীগুলো ওর কথা শুনতে চাইছে না।

ওহ! কথা শুনছ না কেন?-পাকে জিজ্ঞেস করল সে…ভাল পাটাকে। আর যে পাটা ভাঙা, যেটা সব সময় ব্যথা করে, সেটাকেও। জাদুর জুতা পরে আছ তোমরা। হাঁটো। কোন অসুবিধা হবে না।

কিন্তু ওর পা কথা শুনল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল জায়গায়। ঈগলের দিকে ফিরল সে। পাখিটা মাথার উপর অধৈর্য হয়ে উঠছে। ‘আমি পারছি না।’ বলল অড, ‘চেষ্টা করেছি। কিন্তু হচ্ছে না।’

ঈগলটা চিৎকার করে উঠল, ডানা ঝাপটে আরও উপরে উঠে গেল। আরেকটা চিৎকার করে ধেয়ে এল অডের দিকে। পাখা মেলে দেয়া, বাঁকানো ঠোঁটটা হাঁ হয়ে আছে। নখর বাইরে, চোখজোড়া যেন জ্বলন্ত আগুন…

নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে এল অড। অল্পের জন্য ওকে মিস করল ঈগলের থাবা।

‘এমন কেন করলে?’ পাখিটাকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল সে।

কিন্তু নিচে তাকিয়ে দেখতে পেল, পায়ের নিচে মাটি নেই। বরঞ্চ বাতাসে ভাসছে সে!

‘ওহ,’ হাসতে হাসতে বলল অড। পাহাড় বেয়ে নামার ভঙ্গিতে দেয়াল থেকে নামল সে। গলা দিয়ে উইই! শব্দ বের হয়ে এল। পেঁজা তুলার মতো এসে নামল মাটিতে।

আবার বাতাসে ভাসল অড। লাফ দিতে দিতে একেকবারে দশ, বিশ এমনকী ত্রিশ ফুট উপরে উঠে গেল…

অ্যাসগার্ডের দালানগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। কানে বিড়ালের গরগর করার আওয়াজ না আসার আগে থামল না…

হিম-দানবের কথা শুনে ফ্রেয়াকে খুব ভয়ানক মনে হয়েছিল অডের। কিন্তু বাস্তবে লেডি ফ্রেয়াকে দেখে খুব একটা ভয়ংকর মনেই হয় না। অসাধারণ সুন্দরী তিনি, সোনালি চুল। চোখজোড়া গ্রীষ্মের আকাশের মতো নীল। কিন্তু অডের সবচেয়ে পছন্দ হলো তার হাসি-অবাক, কিন্তু নরম আর আনন্দপ্রদ। হাসিটা দেখে নিজেকে নিরাপদ মনে হলো ওর। সব কিছু বলেই বসে ছিল প্রায়। সময়মতো সামলে নিল নিজেকে।

যখন তিনি বুঝতে পারলেন, প্রাণীগুলো আসলে কে-হাসিটা আরও বড় হলো তার।

‘হাহ্,’ বললেন তিনি। ‘হায় রে পুরুষ!’ ওরা সবাই এখন গ্রেট হলে এসে দাঁড়িয়েছে। হলটা ফাঁকা, অগ্নিকুণ্ডে আগুন নেই। দেবী তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ঈগলটা এতক্ষণ বসে ছিল সুন্দর ডিযাইন করা একটা চেয়ারে। এবার ডানা ঝাপটে উড়ে এসে বসল দেবীর কব্জিতে। নখ দিয়ে এতজোড়ে হাত আঁকড়ে ধরল যে, চামড়ায় রক্তের ছোপ দেখা গেল। কিন্তু দেখে মনে হলো না, দেবী টের পেয়েছেন।

হাতের নখ দিয়ে চুলকে দিলেন পাখিটার ঘাড়। ঈগলটাও মাথা ঘষল।

‘ওডিন অল-ফাদার।’ বললেন তিনি। ‘এসিরদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী। এক চক্ষু বিশিষ্ট যুদ্ধের দেবতা। আপনি মিমিরের কুপ থেকে জ্ঞানের পানি পান করে…ফিরে এসেছিলেন আমাদের মাঝে।’ এরপর বা হাত দিয়ে পাখিটাকে নতুন আকৃতি দেয়া শুরু করলেন তিনি। কখনো চাপ দিয়ে, কখনো আলতো ছোঁয়ায়…

কাজ শেষ হতে দেখা গেল, একজন লম্বা আর ধূসর-দাড়ির পুরুষ ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চেহারা কঠোর, কিন্তু জ্ঞানী। নগ্ন শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি চেয়ারটার কাছে হেঁটে গিয়ে একটা আলখাল্লা তুলে নিলেন তিনি। সেই সাথে একটা প্রাচীন হ্যাট-অড নিশ্চিত যে হ্যাটটা একটু আগেও ওখানে ছিল না-পরে নিলেন কাপড়গুলো।

‘আমি অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম।’ ফ্রেয়াকে অন্যমনস্কভাবে বললেন তিনি। ‘আর প্রতি মুহূর্তে আরও দূরে চলে যাচ্ছিলাম আমি। যে কোন মুহূর্তে নিজ- সত্তাকে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা ছিল। খুব ভাল কাজ দেখিয়েছ।’

ফ্রেয়া ততক্ষণে তার মনোযোগ ভালুকের দিকে সরিয়ে দিয়েছেন। এবার দুই হাত লাগিয়েছেন কাজে, যেন কোন মা ভালুক তার বাচ্চাকে আদর করছে। তার ফর্সা হাতের নিচে ভালুকের রূপ পরিবর্তন হচ্ছে। দেবীর কাজ শেষ হলে দেখা গেল, লালচুলো আর বনমানুষের মতো পশমঅলা এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। উপরের হাত দুটো যেন গাছের মতো শক্তিশালী। দানব বাদে অডের দেখা সবচেয়ে বড় মানুষ তিনি। বেশ বন্ধু পরায়ণ মনে হচ্ছে। অডের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন দেবতা। কেন জানি, অডের বুক গর্বে ভরে উঠল।

ওডিন থরের দিকে একটা জামা ছুঁড়ে দিলেন। আড়ালে গিয়ে তিনি পরে নিলেন তা। এরপর একটু থেমে পিছু ফিরে তাকালেন।

‘আমার হাতুড়ি?’ প্রশ্ন করলেন থর, ‘কোথায় আমার মিয়োলনির?

‘আমি জানি কোথায়।’ অড জানাল, ‘হিম-দানব ওটাকে পাথর বানিয়ে রেখেছে। আপনি চাইলে আমি দেখিয়ে দিয়ে পারি।’

‘আগে হাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে নেই আমরা… নাকি?’ বলল শেয়াল, ‘এবার আমার পালা।’

ফ্রেয়া শেয়ালের দিকে তাকালেন, যেন খুব আমোদ পাচ্ছেন। ‘আচ্ছা,’ বললেন দেবী, ‘তোমাকে এ-ভাবেই রেখে দিলে কেমন হয়? তুমি কি আসলেই আমার সাহায্য চাও?’

শেয়াল গুঙিয়ে উঠল। কিন্তু চালাক শেয়াল সেটাকে পরিণত করে ফেলল কাশিতে।

বলল, ‘মহান ফ্রেয়া, আপনি নিশ্চয় মজা করছেন। কিন্তু পাখিরা কি গান গায় না:

‘সেই মেয়ের সঙ্গেই হতে পারে পারে তুলনা মহান ফ্রেয়ার…’

‘ফর্সা, নীতিবান আর দয়ালু মন আছে যার।’

‘লোকি, এসব কিছুর জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী।’ বললেন তিনি, ‘সবটাই তোমার দোষ।’

‘হ্যাঁ।’ বলল শেয়াল, ‘আমি মানছি। কিন্তু ছেলেটাকেও এই আমিই খুঁজে পেয়েছি। শুধু বাজে দিকগুলো না দেখে, আমার আচরণে ভাল দিকটাও দেখা তো উচিত।’

‘একদিন…,’ ফ্রেয়া নম্রস্বরে বললেন, ‘আমি এর জন্য আফসোস করব।’ কিন্তু হাসলেন তিনি। এক হাত বের করে স্পর্শ করলেন শেয়ালের মুখ। সেখান থেকে কানের পাশ হয়ে উঠে এলেন পিঠে। শেষ করলেন লেজের প্রান্তে এসে।

হালকা আলোর ঝলক দেখা গেল—এরপরই তাদের সামনে এসে দাঁড়াল একজন পুরুষ। দাড়ি নেই, চুল আগুন রঙা, ফ্রেয়ার মতোই ফর্সা। চোখগুলো যেন সবুজ বরফের টুকরা। অডের মনে অদ্ভুত একটা চিন্তা প্রবেশ করল। লোকির চোখগুলো কি এখনো শেয়ালের মতো, নাকি শেয়ালটাই সবসময় লোকির চোখ দিয়ে দেখছিল?

থর লোকির দিয়ে কিছু কাপড় ছুঁড়ে দিলেন। ‘পরে নাও।’ নি:স্পৃহ সুরে বললেন তিনি।

ফ্রেয়া এবার অডের দিকে তার মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। তার নরম হাসিটা যেন পৃথিবীটাকে ভরিয়ে তুলেছে। ‘তোমার পালা।’ বললেন তিনি।

‘আমি দেখতে এমনই।’ জানাল অড।

‘আমি জানি।’ বললেন ফ্রেয়া। হাঁটু গেঁড়ে বসলেন ওর পাশে। ভাঙা পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি, ‘দেখব?’

‘উম…, যদি আপনি চান।’

ফ্রেয়া ওকে এমনভাবে কোলে তুলে নিলেন যে মনে হলো, অড পাতার মতোই হাল্কা। দেবতাদের খাওয়ার টেবিলে শুইয়ে দিলেন ওকে। ডান পা-টা ভাল করে দেখলেন তিনি। হাঁটুর কাছ থেকে খুব সাবধানতার সাথে খুলে নিলেন। পায়ের লম্বা হাড় বরাবর আঙুল চালালেন তিনি। মাংসগুলো আলাদা হয়ে গেল। ফ্রেয়া হাড়টাকে পরীক্ষা করে দেখলেন। মলিন হয়ে এল তার মুখ, ‘পুরো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে।’

বললেন, ‘অবস্থা এতটাই খারাপ যে আমিও কিছু করতে পারব না।’ কিন্তু সেই সাথে যোগ করলেন, ‘কিছুটা উপকারে অবশ্য আসতে পারি।’

অডের পায়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। গুঁড়ো হয়ে যাওয়া পায়ের হাড়গুলোকে যতটা সম্ভব এক করলেন। এরপর সোজা করে জোড়া লাগিয়ে দিলেন। এরপর নজর দিলেন পায়ের পাতার দিকে। সেখানেও একই কাজ করলেন। গোড়ালি আর পাতার হাড়গুলো যেমন থাকা উচিত ছিল, সেভাবে সাজালেন। সব শেষে মাংসের টুকরা দিয়ে ঢেকে দিলেন হাড়টাকে। এমনভাবে লাগিয়ে দিলেন হাঁটুর সাথে যেন ওখানে পাটা সবসময় ছিল।

‘দুঃখিত।’ বললেন তিনি। ‘আমার সেরা চেষ্টাটাই করেছি। কিন্তু এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি।’ ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, ‘অন্য কোন প্রাণীর পা লাগিয়ে দিলে কেমন হয়? যেমন ধরো, বিড়ালের পা? অথবা মুরগির?’

অড হাসল, না করল মাথা নেড়ে। ‘লাগবে না। নিজের পা সবচেয়ে ভাল।’ বলল সে।

অড খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল। ডান পায়ের উপর ভর চাপাল। ভাব এমন যে, একটু আগে ওটাকে হাঁটু থেকে খুলে নিতে দেখেইনি! ব্যথা করছে না আর। অন্তত আগের মতো অসহ্য ব্যথাটা নেই।

‘আরেকটু সময় দাও, ব্যথা আরও কমে আসবে।’ বলল ফ্রেয়া।

বিশাল একটা হাত নেমে এসে থাবা বসাল অডের কাঁধে। আঘাতের জোরে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল অড।

‘এখন বাছা।’ গমগমে স্বরে বললেন থর, ‘আমদেরকে বল, কীভাবে তুমি ওই শক্তিশালী হিম-দানবদেরকে হারিয়েছ?’ ভালুক রূপের চেয়ে এখন ওকে অনেক বেশি হাসি-খুশী মনে হচ্ছে।

‘দানবদের? আদপে তো ছিল মাত্র একজন!’ আপত্তি জানাল অড।

যখন আমি গল্পটা বলব,’ বললেন থর, ‘তখন ওতে অন্তত এক ডজন দানবের কথা থাকবে।’

‘ভাল কথা,’ বলল লোকি, ‘আমার জুতা ফেরত চাই।’

সেদিন রাতটা সবাই উদযাপন করল দেবতাদের গ্রেট হলে খেয়ে-দেয়ে আর গান গেয়ে। ওডিন বসলেন টেবিলের একেবারে শেষ মাথায়। কম কথা বলেন তিনি। থর বসে ছিলেন তার বাম পাশে, আনন্দিত। লোকি বসেছিল একেবারে অন্য মাথায়। মাতাল হবার আগ পর্যন্ত সবার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করল সে। কিন্তু বাতাস বইলে যেমন মোমবাতি আস্তে আস্তে নিভে যায়, মাতাল হবার সাথে সাথে সে-ও সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করল। বাজে, খোঁচানো আর পুনরাবৃত্তি করা যায় না এমন সব কথা বলল। দেবীদের-কে বাজে ইঙ্গিত দিল। কিছুক্ষণের মাঝেই থর আর এক হাত কাটা একজন দেবতা (সম্ভবত টির) লোকিকে বয়ে নিয়ে গেলেন হলের বাইরে।

‘জীবনেও শিক্ষা হবে না ওর।’ বলল অড়।

ভেবেছিল আপন-মনেই বলেছে কথাটা। কিন্তু ফ্রেয়া, যিনি ওর ঠিক পাশেই বসে ছিলেন, বললেন, ‘না। ও শেখে না। এদের কেউ শেখে না। কোন পরিবর্তনও হয় না। আসলে হতে পারে না। দেবতাদের ধাতেই নেই তা।’

অড নড করল। কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।

ফ্রেয়া বললেন, ‘পেট ভরেছে তোমার?’

‘জি, ধন্যবাদ।’ বলল অড।

ওডিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে আসলেন ওদের দিকে। মুখ থেকে চর্বি মোছার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। ফিসফিস করে অডের কানে কানে বললেন, ‘তুমি কি জানো, কোন পুকুরের পানি পান করেছ? পানিটা এসেছে কোত্থেকে? জানো, আমাকে কি হারাতে হয়েছে সেই পানি পান করার জন্য? তুমি কি ভেবেছ, একাই হারিয়েছ হিম-দানবদের?’

অড শুধু একটা কথাই বলল, ‘ধন্যবাদ।’

‘না।’ বললেন ওডিন, ‘ধন্যবাদ তোমাকে।’ অল-ফাদার একটা লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওতে অনেক প্রাণীর মুখ আঁকা-কুকুর, ঘোড়া, মানুষ, পাখি, কংকালের মাথা, রেইন ডিয়ার, ইঁদুর আর মেয়ে মানুষের। সবগুলো যেন আঁকড়ে ধরে আছে লাঠিটাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখেও, লাঠিটার সবটা বোঝা যাবে না। অডের দিকে সেটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি, ‘তোমার জন্য।’

অড বলল, ‘কিন্তু…’

বয়স্ক দেবতা তার একমাত্র ভাল চোখটা দিয়ে তাকালেন ওর দিকে, ‘দেবতার উপহার ফিরিয়ে দেবার পরিণাম কখনোই ভাল হয় না, বাছা।’

অড বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’ লাঠিটা হাতে নিল সে। আরামদায়ক। অডের মনে হলো, লাঠিটা হাতে থাকলে অনেকদূর হাঁটতে পারবে।

ওডিন মদের পাত্রে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। যখন হাতটা বের করে আনলেন, তখন তার হাতে শোভা পাচ্ছিল মানুষের অক্ষিগোলকের মতো বড় একটা গোল বস্তু। জিনিসটাকে আগুনের সামনে ধরে বললেন, ‘এদিকে তাকাও।’

অড আদেশ পালন করল। চোখের সামনে যেন রঙধনু দেখতে পেল সে। এরপরই অন্ধকার হয়ে এল সবকিছু।

চোখ খুলে দেখল—বাবার কুটিরে ফিরে এসেছে।

অধ্যয় আট – পরিশিষ্ট

লাঠির উপর নিজের পুরো ভর চাপিয়ে দিল অড, তাকাল গ্রামের দিকে। বাড়ির পথ ধরল তারপর, এখনও খোঁড়াচ্ছে। ডান পাটা আর কোন দিন বাম পায়ের মতো শক্তিশালী হবে না। কিন্তু সুখের কথা হলো, ব্যথা করছে না। ফ্রেয়ার কাছে এ-জন্যই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা যায়।

গ্রামের পথে হাঁটতে গিয়ে কানে বিভিন্ন আওয়াজ ভেসে এল-বরফ গলার শব্দ, পানির নিজের পথ খুঁজে নেবার আওয়াজ। মাঝে মাঝে বুঝতে পারল, বরফের টুকরা গাছের ডাল থেকে ঝরে পড়ছে মাটিতে! দুই একবার থ্রাম থ্রাম থ্রাম আওয়াজও শুনতে পেল। জমাট-বাঁধা পুকুরের বরফ ভাঙ্গছে।

দুই এক দিনের মাঝেই সব বরফ গলে যাবে-ভাবল অড। আরও দুই এক সপ্তাহের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবে সবুজ গাছ গাছালি।

অবশেষে অড গ্রামে পৌঁছল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। কেননা ও যে অবস্থায় গ্রামটাকে ছেড়ে এসেছে, এখন তার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, অথচ গ্রাম ছেড়েছে তার এক সপ্তাহও হয়নি। অ্যাসগার্ডের কথা মনে পড়ল ওর-প্রাণীগুলো কীভাবে প্রথমে বড় হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আবার ছোট হয়ে এসেছিল।

হয়তো অ্যাসগার্ডের হাওয়া লেগেই এই অবস্থা হয়েছে। কিংবা হয়তো মিমিরের পুল থেকে পানি খাওয়ার ফলে এমন মনে হচ্ছে ওর।

‘কে?’ জানতে চাইল কেউ ভেতর থেকে।

‘আমি অড।’

ফিসফিসানি কণ্ঠ-স্বর শুনতে পেল সে। নিচু গলায় কথা বলছে লোকজন।

একটা আওয়াজ কানে ভেসে এল ওর। আওয়াজটা বলছে-আমাদের স্যামন চোরকে এমন শিক্ষা দেয়া দরকার, যেন আর কোনদিন চুরি করার সাহস না পায়। দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেল সে।

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল ফ্যাট অ্যালফ্রেড। হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল অডের দিকে।

‘আমি দুঃখিত।’ বলল বটে, কিন্তু গলায় দুঃখের কোন ছাপ নেই। ‘ভেবেছিলাম আমার ঘর পালানো সৎ ছেলে ফিরে এসেছে।’

অড মাথা নিচু করে মানুষটার দিকে তাকাল। হেসে বলল, আমিই সে। মানে বলতে চাইছি, আমি অড…আমিই সে।’

ফ্যাট অ্যালফ্রেড চুপ করে রইল। ওর আশপাশে ছেলে মেয়েদের মাথা দেখা গেল।

নার্ভাস ভঙ্গিতে অডের দিকে তাকাল ওরা।

‘মা আছে?’ অডের নিরীহ প্রশ্ন।

ফ্যাট অ্যালফ্রেড কাশল, ‘আসলেই যদি তুমি অড হয়ে থাক তো অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছ!’

অড শুধু হাসল—যে হাসিটা ওকে এতদিন মার খাইয়েছে।

ফ্যাট অ্যালফ্রেডের একদম ছোট সন্তানটা বলল, ‘তুমি পালিয়ে যাবার পর ওরা দুইজন অনেক ঝগড়া করে। মা বলেছিলেন, আমাদের তোমার খোঁজে যাওয়া উচিত। আর বাবার ভুলের জন্য তুমি পালিয়েছ। কিন্তু বাবা বলল, তার কোন দোষ নেই। আর বলল, আবর্জনার খোঁজে সে সময় নষ্ট করতে পারবে না। মা সঙ্গে সঙ্গে তোমার বাবার বাসায় চলে যায়। মানে যদি তুমি আসলেই অড হয়ে থাক।’

‘আমিই সে। মানে বলতে চাইছি, আমিই অড।’

থর যেমন ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপেছিল, অডও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে লাঠির উপর ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে এল গ্রামের অন্য মাথায়। গ্রামটাকে খুব ছোট মনে হলো, কিন্তু ওর আকার বেড়ে যাবার জন্য না। আর কয়েক সপ্তাহের মাঝেই বরফ গলে গেলে, সবাই নৌকা ভাসিয়ে অভিযানে যাবে। কেউ ওকে নিতে আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। কারণ এখন ওর আকার অনেক বড়। দাঁড় বাইতে শক্ত পোক্ত হাত দরকার। আর যদি একজন যাত্রীকে সাথে নিতে চায়… অসুবিধা কী?

যে বাড়িটায় জন্মেছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে নক করল অড। মা খুলল দরজা। কিন্তু তিনি জড়িয়ে ধরে কাঁদা শুরুর করার আগেই, এমনকি কাঁদা বন্ধ করে হেসে আবার কাঁদা শুরু করার আগে, অডকে মুখে তুলে খাওয়াবার আগে, অবাক হয়ে ওকে বলার আগে যে কতটা বড় হয়েছে আর সর্বোপরি, চোখের আড়াল হলেই ছেলেপিলে কত

দ্রুত বড় হয়ে যায় তা বলার আগেই, অড ওর মাকে বলল, ‘হ্যালো, মা। স্কটল্যাণ্ডে ফিরতে চাও? অল্প সময়ের জন্য?’

‘অবশ্যই চাই।’ মা বলল।

হাসল অড। মাথা নিচু করে দরজা গলে ঢুকে পড়ল ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *