অটোমোবিল মন

অটোমোবিল মন

But I don’t want to go among mad people, Alice remarked. ‘Oh, you can’t help that’, said the Cat : ‘We’re all mad here. I’m mad. You’re mad’.

Alice Wonderland

অটোমোবিলের ওয়ান্ডারল্যান্ডে আমরা স্পিডের জন্য পাগল, বিজনেসের জন্য পাগল, স্টেটাসের জন্য পাগল। রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যাল দেখে ডাইনেই যাই আর বাঁয়েই যাই, ট্রাফিক পুলিশবেশী মার্জার আমাদের যেন বলে দেয়—‘In that direction lives a Hatter, and in that direction lives a March Hare. Visit either you like: they’re both mad.’ ওদিকে যান—ক্যাডিলাক মালিক। এদিকে যান—স্কুটার মালিক। যাঁর কাছে ইচ্ছা যেতে পারেন, দু—জনেই পাগল। যেমন ‘হ্যাটার’ তেমনি ‘হেয়ার’। যেমন নেকড়েবাঘ তেমনি বেড়াল। প্রত্যেকেই পাগল এবং গোলাকার বলের মতো জীবনবৃত্তে ঘূর্ণায়মান। অটোমোটিভ যুগের গতির direction মাত্র দুটি। একটি ঊর্ধ্বগতি আর একটি নিম্নগতি। হয় উঠতে হবে, না—হয় নামতে হবে। উঠবার সময় মনে হয় :

 Up above the world you fly,

 Like a tea-tray in the sky.

 Twinkle-Twinkle

এবং নামবার সময় মনে হয় যেন টানেলের মতো শশকের গর্তের ভিতর দিয়ে দ্রুত নীচের দিকে নেমে যাচ্ছি—‘that would be four thousand miles down.’

ওঠার শেষ নেই, নামারও শেষ নেই। শহর থেকে বিচ্ছুরিত রিবনরোডে ক্রুশোর মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা বাস করি এবং শামুকের মতো অটোর খোলকের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে রেখে বেগের আবেগ—শিহরন অনুভব করি এবং

 And no man knows or cares who is his neighbour

 Unless his neighbour makes too much disturbance,

 But all dashed to and fro in motor cars,

 Familiar with the roads and settled nowhere…

 T.S. Eliot

প্রতিবেশীদের আমরা জানি না, চিনি না—জানতেও চাই না—চিনতেও চাই না যদি না অবশ্য প্রতিবেশীরা ভয়ানক কোনো গন্ডগোল করে নিজেদের জানতে চায় অথবা চেনাতে চায়। আমাদের সময় নেই। আমরা যাই আর আসি এবং আসি আর যাই দুরন্ত বেগে মোটরে। আমরা কিছু পথ চিনি আর কিছু চিনি না, শুধু ঝড়ের বেগে ছুটে চলি সেই পথের ওপর দিয়ে অথচ আমাদের স্থিতি নেই কোথাও। আমাদের পরিবার চৈতালি ঘূর্ণির মুখে ঝরাপাতার মতো ছিন্নভিন্ন তাই ছেলেরা মোটরসাইকেলে হাওয়ার বেগে ঘুরছে আর মেয়েরা তাদের বন্ধুর অটোসাইকেলের পেছনে উধাও কে জানে কোথাও—

 Nor does the family even move about together

 But every son would have his motorcycle

 And daughter rideaway on casual pillions

 Eliot

 যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে;

 মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে

 কোথায় আছে জানি না তো…

 জীবনানন্দ দাশ

যখন পাখির ডাকে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ত, যখন পাখির ডাকে মানুষ জাগত তখন গ্রাম্য মেঠো পথ দিয়ে গোরুর গাড়ি চলত এবং রাখালরা গান গেয়ে গেয়ে গোরুর পাল নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াত। তারপর একদিন পাখির ডাকে মানুষের ঘুম যদি আর না ভাঙে এবং রাতের শেষে প্রহরের মোরগের ডাকে মানুষ যদি আর না জাগে, যদি ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙে তাহলে জানলা দিয়ে ভোরের আলোয় সে প্রথম দেখবে আধুনিক শহরের মুখ, গ্রামের মুখ নয়। গ্রাম ভেঙে নতুন শহর গড়ে উঠেছে, ধনতান্ত্রিক যুগের শহর। গ্রাম আছে, কিন্তু গ্রামের যুগ আর নেই, শেষ হয়ে গিয়েছে। ঘোড়া, ঘোড়সওয়ার ও ঘোড়ার গাড়ির উদীয়মান তেজীয়ান বুর্জোয়া মালিকরা কদমগতিতে আধুনিক শহর সর্বপ্রথম দখল করে ফেলেছে। যেমন আঠারো শতক ও উনিশ শতকের কলকাতা শহর করেছিল।

মধ্যযুগের শহরে ধনী—দরিদ্র উচ্চনিম্নশ্রেণির লোকজন অনেকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলত। চলতে তারা বাধ্য হত, কারণ চলার পথের সংকীর্ণতা ছিল মধ্যযুগের শহরের বৈশিষ্ট্য। ধনিকরা ষোলো বেয়ারার পালকি করে অথবা তেজীয়ান ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেভাবেই চলুন—না কেন তখন অলিগলিতে সাধারণ লোককে চলবার মতো একটু পথ তাদের ছেড়ে দিতে হত। ঘোড়ার লাগাম টেনে তারা অন্তত একটু সরে দাঁড়াত। আধুনিক যুগের শহরে যখন বড় বড় অ্যাভিনিউ ও রাজপথ তৈরি হল তখন আর সাধারণ লোকের জন্য পথ ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন রইল না। এখন শুধু ঘোড়া বা ঘোড়সওয়ার নয়, তার সঙ্গে ঘোড়াগাড়িও চলবে। সরু পথ তাই চওড়া হল। ধনী—দরিদ্রের বিভেদ—বৈষম্য বিস্ফারিত করে আধুনিক শহরের রাজপথ বিস্তৃত হল। এই আধুনিক ধনতান্ত্রিক শহরের রাজপথের প্রশস্ততা মানুষের সঙ্গে মানুষের শ্রেণিব্যবধানের প্রশস্ততার প্রতীক। আধুনিক শহরের রাজপথের উপর দিয়ে বড়লোকেরা ‘ড্রাইভ’ করে যাবেন আর তার পাশে সাত হাত দূরে সাধারণ লোকেরা ভয়ে ভয়ে পায়ে হেঁটে চলবে। শহরের গ্র্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের উপর দিয়ে যাবে বিত্তবানদের বেগবান অশ্বযান আর বিত্তহীনেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পথ ছেড়ে দেবে এবং হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পাশের খানা—নর্দমায় পড়বে।

Now, with the development of the wide avenue, the dissociation of the upper and the lower classes achieves form in the city itself. The rich drive: the poor walk. The rich roll along the axis of the grand avenue: the poor are off-centre in the gutter: and eventually a special strip is provided for the ordinary pedestrian the side-walk.

 Mumford

সতেরো শতকে ফ্রান্সের পথে স্টেজকোচ চলতে আরম্ভ করে। হঠাৎ এই চলার গতি—যন্ত্রের নয়, দ্রুতগামী অশ্বের গতি—সাধারণ মানুষের জীবনে যে বিষম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল তা কল্পনা করা যায় না। এই সময়কার একজন ফরাসি লেখক লিখেছেন : ‘অশ্বযান থেকে সাবধান! কালো কোট পরে ফিজিশিয়ান যাচ্ছেন chariot-এ, ডান্সিং মাস্টার যাচ্ছেন cabriolet-এ, ফেন্সিং মাস্টার যাচ্ছেন diable-এ, প্রিন্স যাচ্ছেন দু—ঘোড়ার গাড়িতে গ্যালপ করতে করতে। সকলের গাড়ির চাকার তলায় রক্তের দাগ, ঘোড়ার খুরে রক্তের দাগ, পথের খোয়ায় রক্তের দাগ। বিভ্রান্ত পথিকের ফাটা মাথার রক্ত, ভাঙা হাড়গোড়ের রক্ত।’ এটা মোটেই অতিরঞ্জিত উক্তি নয়। বাস্তবিক সতেরো শতকে ফ্রান্সে স্টেজকোচ চলবার পর ঘোড়ার খুরের দাপটে পথে যত দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা পরবর্তীকালে রেলরোডের যুগেও ঘটেনি। অবশ্য আট—দশ—বারো—ষোলো অশ্বগতির (horse-power) অটোমোবিলের যুগে তার চেয়ে অনেক বেশি মর্মান্তিক ঘটনা শহরের রাজপথে ঘটেছে এবং প্রতিদিন ঘটছে।

কলকাতা শহরে আঠারো শতককে মোটামুটি পালকির যুগ বলা যায়। এ দেশি ও বিদেশি অভিজাতরা সামাজিক পদমর্যাদা অনুযায়ী নানা রকমের পালকিতে চড়ে বেড়াতেন। আঠারো শতকে ঘোড়াগাড়িরও প্রচলন হয়েছিল কিন্তু প্রাধান্য ছিল পালকির। উনিশ শতকের কলকাতাকে অশ্বযানের যুগ বলা যায়। যদিও পালকি অন্তর্ধান করল না তাহলেও প্রাধান্য হল অশ্বযানের। জীবনে নতুন গতিসঞ্চার করল ঘোড়া। দুইঘোড়া চারঘোড়া ছয়ঘোড়া আটঘোড়া নানা রকমের গাড়ি নিয়ে দৌড়োতে লাগল কলকাতার রাস্তায়। মাটির রাস্তা হল খোয়া—বাঁধানো রাস্তা, সরু রাস্তা হল চওড়া রাস্তা। অশ্বযানের চলার গতি বাড়ল। কত রকমের অশ্বযান কলকাতা শহরের রাস্তায় চলত—ব্রিৎসকা বরুচ ল্যান্ডো কেরাঞ্চি চ্যারিয়ট ফিটন ব্রাউনবেরি পালকিগাড়ি। ব্রিৎসকা, বরুচ ও ব্রাউনবেরি ছিল ফিটন—ল্যান্ডোর রকমভেদ মাত্র। কেরাঞ্চি ও পালকি গাড়ি প্রায় এক রকমের ছিল। কেরাঞ্চি ও পালকিগাড়ি ছিল এক জাতের এবং তাদের সংখ্যাও ছিল সবচেয়ে বেশি। একজন বিদেশি পর্যটক উনিশ শতকের প্রথম ভাগে কলকাতার রাস্তায় কেরাঞ্চির চেহারা ও চলা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন যে নেটিভরাই কেরাঞ্চিতে বেশি চড়ে এবং সাধারণত গ্রীষ্মকালে খালি গায়ে। রাস্তায় একসঙ্গে ছ—সাতখানা কেরাঞ্চি চলতে দেখা যায় বিশেষ করে পুজাপার্বণ বা শহরে কোনো উৎসবের সময়। এসব দেখে তিনি অবাক হননি কিন্তু অবাক হয়েছেন কেরাঞ্চির অস্থিচর্মসার ঘোড়াগুলোকে দেখে—‘The ponies that draw this story vehicle are mere skin and bone.’ এই কেরাঞ্চি ও পালকিগাড়ির চলতি বাংলা নাম ছিল ‘ছ্যাকড়া’ বা ‘ছক্কড়’। শহরের মধ্যবিত্তদের প্রিয়তম যান। পালকির চেয়েও প্রিয়। কারণ ছ্যাকড়ার হাড়গোড়সার ঘোড়ারও চলার একটা গতি ছিল, ছন্দ ছিল যা পালকির ছিল না বা গোগাড়িরও ছিল না।

তখন গঙ্গার ধারে কলকাতা শহরে বায়ুসেবনের আদর্শ স্থান ছিল স্ট্র্যান্ড রোড—‘The streets leading thither are resounding with the tramping of horses, the rolling of carriages, the cracking of whips and the shouts of he sable Jehus’ (১৮৩০—৪০ সাল)। আজকের দিনে ময়দানে অথবা ভিক্টোরিয়া হলের চারদিকে আগাগোড়া গঙ্গার ধারে অথবা রবীন্দ্রসরোবরে আমোদপ্রিয়দের যে ভিড় হয় তা সেকালের স্ট্র্যান্ডে হত না, হবার কথাও নয়, কারণ কলকাতার লোকের সংখ্যাই তখন এর বিশ ভাগের এক ভাগ ছিল কি না সন্দেহ। যানবাহনের সংখ্যাও অশ্বযান ও পালকি মিলিয়ে অনেক কম ছিল। এখন ময়দানে বা সরোবরে মনে হয় লোকের চেয়ে অটোমোবিলের সংখ্যা বেশি কিন্তু তখন স্ট্র্যান্ডের ছ্যাকড়া, ল্যান্ডো, বগি ও পালকির ভিড় দেখে তা মনে হত না। শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস তাঁর Wandering of a Pilgrim (লন্ডন ১৮৫০) গ্রন্থে লিখেছেন : ‘even the most petty-European shop-heeper in Calcutta has his buggy, to enable him to drive out in the cool of the evening’ (১৮২৩—২৪ সাল)। বগি ও ল্যান্ডো সাধারণত সাহেবদেরই প্রিয় ছিল এবং সাহেব দোকানদাররা পর্যন্ত সন্ধ্যায় বগিতে চড়ে বেড়াতে বেরুতেন। গাড়ির মালিকের সংখ্যা অবশ্য খুব বেশি ছিল না। এমনকী আনুপাতিক হিসাবেও বলা যায় যে আজকের দিনের কলকাতার জনসংখ্যা অনুপাতে অশ্বযান ও পালকির মিলিত সংখ্যাও কম ছিল। তাহলেও সাধারণ লোকের যদি ঘোড়া বা ঘোড়াগাড়ি চড়ার ইচ্ছা হত তাহলে তা জোগাড় করতে তাঁদের অসুবিধা হত না। গাড়ি ও ঘোড়া দুইই ভাড়া পাওয়া যেত, শুধু একদিনের জন্য নয়, এক মাস বা মাসাধিককালের জন্যও। ইংরেজরা তার জন্য কলকাতা শহরে বেশ বড় বড় স্টেবল তৈরি করেছিলেন। ধর্মতলা—বউবাজার প্রভৃতি অঞ্চলে এই ধরনের বড় বড় আস্তাবল ছিল এবং সেখানে ভাড়া দেওয়ার জন্য নানা রকমের গাড়ি ও ঘোড়া থাকত। হান্টার অ্যান্ড কোম্পানি, কুক অ্যান্ড কোম্পানি, এঁরা ছিলেন শহরের নামজাদা ‘স্টেবলকিপার’ এবং তখনকার সাময়িকপত্রে গাড়ি ও ঘোড়ার ভাড়ার ‘রেট’ জানিয়ে তাঁরা বিজ্ঞাপন দিতেন। এরকম একটি বিজ্ঞাপনের নমুনা এই :

 ঘোড়া একজোড়া : দৈনিক ১০ টাকা মাসিক ১৫০ টাকা

 ওই এবং একজনের মতো গাড়ি : দৈনিক ১৬ টাকা মাসিক ২৫০ টাকা

 ডবল সিটের চ্যারিয়ট : দৈনিক ২০ টাকা মাসিক ৩০০ টাকা

 একজনের ক্যারেজ : দৈনিক ৪ টাকা মাসিক ১২০ টাকা

 দু—জনের ক্যারেজ : দৈনিক ১০ টাকা মাসিক ১৫০ টাকা

 বগি ও ঘোড়া : দৈনিক ৮ টাকা মাসিক ১৫০ টাকা

 ঘোড়া একটি : দৈনিক ৫ টাকা মাসিক ১৩০ টাকা

–The Bengal and Agra Annual Guide and Gazetteer for 1841 এরকম ভাড়া দিয়ে যাঁরা ঘোড়া বা ঘোড়াগাড়ি চড়তেন তাঁরা সাধারণ মধ্যবিত্ত নন, রীতিমতো বিত্তবান। অটোমোবিলের যুগেও অটোকিপার ও অটোগ্যারাজ অনেক আছে এবং সেখান থেকে প্রাইভেট অটো দৈনিক ও মাসিক হারে ভাড়াও পাওয়া যায়। কিন্তু একালের অটোগ্যারাজের সঙ্গে সেকালের লিভারিস্টেবলের কোনো তুলনা হয় না। অশ্বযান ও অটোযানের মধ্যে যেমন পার্থক্য, ঠিক সামাজিক পরিবেশের মধ্যেও সেই পার্থক্য। জীবনের পথে চলার গতি ও ছন্দের পার্থক্য তো আছেই।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দেখা যায় কলকাতা শহরের রাস্তায় দু—একটি পোষা হাতিও চলে বেড়াত। হাতি হল ফিউডাল যুগের দীর্ঘস্থায়ী symbol এবং কলকাতা শহরে তখনও হাতি ছিল যথেষ্ট, কারণ কলকাতার নাগরিক সমাজে তখনও ফিউডাল সমাজের প্রভাব ছিল ব্যাপক। হাতি তারই প্রতিভূরূপে ঘুরে বেড়াত কলকাতার পথে। সামন্তযুগের পথিক গজমূর্তি স্বভাবতই নতুন যুগের ঘোড়াকে সন্ত্রস্ত করত। এমন দুর্ঘটনা কলকাতার পথে অনেক হয়েছে যে শহরের পথে হঠাৎ গজেন্দ্রগামী গজমূর্তি দেখে ভীত—আতঙ্কিত ঘোড়া পথের পাশে বা নালা—নর্দমায় চলন্ত গাড়ি যাত্রী সমেত উলটে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছে। আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে কলকাতার রাস্তায় উনিশ শতকের অশ্বযানের যুগে। সাহেব ও এ দেশি ধনিকদের ল্যান্ডো—ফিটন—চ্যারিয়টের মেজাজি ঘোড়ার চলার দেমাকে খোয়া—বাঁধানো কলকাতার পথ যেমন কেঁপে উঠেছে তেমনি সাধারণ লোকের বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছে ভয়ে। তারা বুঝেছে যে একটা যুগ অস্ত গিয়েছে সেটা হল ঢিমেতালের গোযানের যুগ এবং তার বদলে আর—একটা নতুন যুগের অভ্যুদয় হয়েছে সেটা হল কদমতালের অশ্বযানের যুগ। আসল যান্ত্রিক অটোমোবিলের যুগ তখনও কিন্তু অনেক দূরে। শুধু কলকাতায় নয়, ইংল্যান্ড—ইউরোপের শহরেও।*

ট্রেভেলিয়ান লিখেছেন :  ‘The common use of the motor car and motor bicycle was still in future when Victoria died.’ মহারানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর সময় (১৯০১) মোটর ও অটোসাইকেলের প্রচলন ইংল্যান্ডেও বিশেষ হয়নি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলে ফিউডাল সমাজের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল যদিও ট্রেভেলিয়ানের ভাষায় : ‘the penetration of village life by forces and ideas form the cities’ কিছুটা সম্ভব হয়েছিল প্রধানত বাষ্পীয় রেলওয়ের বিস্তারের ফলে। পরবর্তী ‘জেনারেশন’—এ অর্থাৎ আরও পঁচিশ—তিরিশ বছর পরে ‘With the coming of motor transport, the intrusion of urban life upon the rural parts, became aflood, turning all England into a suburb.’ অর্থাৎ বিশ শতকের প্রায় যৌবনকালেই বলা চলে প্রকৃত অটোমোটিভ যুগের সূত্রপাত হয়। শহর ও গ্রামের ব্যবধান দূর করে দিয়ে অটোমোবিল গ্রামের দিকে নাগরিক জীবনধারার প্রবাহপথ মুক্ত করে দেয়। তখন শুধু লন্ডন নয় অথবা ম্যাঞ্চেস্টারের মতো শিল্পনগরও নয়, সারা ইংল্যান্ড দেশটাই যেন একটা শহরতলিতে পরিণত হয়ে যায়। ইংল্যান্ড তখন কলকাতার শাসকদের দেশ। সেখানেই যদি বিশ শতকের বিশ—পঁচিশ বছর উত্তীর্ণ হবার আগে প্রকৃত অটোমোবিল যুগের সূচনা না হয়ে থাকে তাহলে কলোনিয়াল কলকাতায় নিশ্চয়ই তা হবার কথা নয়। তা হয়ওনি।

উনিশ শতকের শেষে ১৮৯৫ সালে দেখা যায় কারখানায় মাত্র ৩০০ মোটর তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯০০ সালে ৫০০০। ১৯০৫ সালে ২৫০০০। ১৯১০ সালে ১৮৭৩০। ১৯১৫ সালে ৮৯২৬১৮। ১৯২০ সালে ২২ লক্ষ মোটর তৈরি হয়। তাহলে দেখা যায় ১৯১৫—২০ সাল থেকেই অটোমোটিভ যুগের সূচনা হয়েছে। খুব বেশি হলে অটোমোবিল যুগের বয়স ৫০ বছরের বেশি নয়। অথচ গত হাজার হাজার বছরেও মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানুষের জীবনে যে গতিসঞ্চার করা সম্ভব হয়নি তা এই পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সম্ভব হয়েছে। এই গতি শুধু বিস্ময়কর বলে ব্যাখ্যা করা যায় না, এমনকী বৈপ্লবিক বললেও অর্ধেক বলা হয়। নৃবিজ্ঞানী রবার্ট লাউই (Robert Lowie) সুন্দর ভাষায় সভ্যতার এই অগ্রগতির একটি ইমেজ রচনা করেছেন :

We may liken the progress of mankind to that of a man of one hundred years old, who dawdles through kindergarten for eighty-five years of his life, takes ten years to go through the primary grades, then rushed with lightning rapidity through grammar school, high school and college.

আজ পর্যন্ত মানুষের অগ্রগতির বয়স যদি একশো বছর ধরা যায় তাহলে বলতে হয় যে পঁচাশি বছর ধরে কিন্ডারগার্টেনে আমরা শিশুদের মতো কলকাকলি করেছি, তার পরের দশ বছর প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং তার পরের পাঁচ বছরে তড়িৎগতিতে একেবারে উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সমস্ত সোপান পার হয়ে এসেছি। অটোমোবিলের সঙ্গে বিমানের যুগের কথা ভাবলে শেষের পাঁচ বছরকে পাঁচ মাস বললেও অত্যুক্তি হয় না।

উনিশ শতক শেষ হবার দু—চার বছর আগে যখন পৃথিবীতে কারখানায় তৈরি মোটরের সংখ্যা তিন—চারশোর বেশি ছিল না তখন কলকাতার পথে প্রথম মোটরগাড়ি চলতে আরম্ভ করে। কলকাতার প্রথম মোটরগাড়ি দেখেছেন এরকম অনেক লোক আজও বেঁচে আছেন। তাঁদের বয়স ৮০ বছরের বেশি নয়। ১৯০৪ সালে কলকাতায় মাত্র চারজন লোকের নামে চারখানি মোটরগাড়ি রেজিস্ট্রি করা ছিল। এই চারজন মোটরের মালিকের মধ্যে তিনজন ইংরেজ এবং একজন বাঙালি ‘বসাক’। ১৯১০ সালের আগে কলকাতার রাস্তায় ‘ট্যাক্সি’ চলত না। ১৯১০ সালের শেষে দেখা যায় সতেরোখানা ‘ট্যাক্সি’ কলকাতায় চলাফেরা করছে। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে ১৯১৮ সালে কোনো উদযোগী ব্যক্তি (A.Shovan) দুখানি খোলা ট্রাকের উপর বেঞ্চি পেতে প্রথম ‘পাবলিক বাস’ চালাবার চেষ্টা করেন খিদিরপুর থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত। তারপর ১৯২১ সালে ট্রামওয়ে কোম্পানি ১৪খানি বাস কলকাতায় চালাতে থাকেন। বিশ শতকের বিশের পর থেকে কলকাতা শহরে অটোমোবিল যুগের সূচনা হয়েছে দেখা যায়। তিরিশের শেষ পর্যন্ত তার খুব দ্রুত প্রসার হয়নি। কলকাতায় তখন পালকি একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেলেও ঘোড়াগাড়ির প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ থেকে অটোমোবিলের অতিদ্রুত প্রসার হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে তার সঙ্গে এসেছে বিমানের যুগ। জলপথের পর স্থলপথ, তারপর আকাশপথ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গত কুড়ি বছরের মধ্যে কলকাতা শহরের মেট্রোপলিটন জীবনের মতো অটোমোটিভ জীবনেরও বৈদ্যুতিক বিকাশ হয়েছে।

লাউই শিক্ষার স্তর দিয়ে অগ্রগতির ‘ইমেজ’ তৈরি করেছেন। মানুষের লোকোমোশনের স্তর দিয়ে কলকাতার চলার গতির এরকম একটা ‘ইমেজ’ তৈরি করা যায়। যেমন বলা যায় যে গোরু, পালকি, হাতি আর কিছু ঘোড়া নিয়ে আঠারো শতকের কলকাতা শহর শৈশবের দোলনায় দোল খেয়েছে। তারপর উনিশ শতকে পালকি, ল্যান্ডো, ফিটন, চ্যারিয়ট ও ছক্কড় নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে। বিশ শতকে প্রায় তিরিশের শেষ পর্যন্ত ওরাং—শিম্পাজির মতো ‘brachiation’ বা হেলেদুলে চলার পর্ব কেটেছে। চল্লিশ থেকে কলকাতা শহরের ‘bipedal locomotion’ বা সোজা হয়ে দু—পায়ে দাঁড়িয়ে চলার পর্ব শুরু হয়েছে। গত কুড়ি বছরের মধ্যে কলকাতা শহর যেন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চলতে শিখেই দু—চার পা চলে একেবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতে আরম্ভ করেছে। কোথায় দৌড়োচ্ছে, কেন দৌড়োচ্ছে তার কিছুই জানে না। কলকাতা শহর কেন, লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, নিউ ইয়র্ক, মস্কো, টোকিও পৃথিবীর কোনো ধনতান্ত্রিক শহরই তা জানে না। ‘অটোমোবিলিটি’ বা আত্মগতির যুগ এবং আত্মগতি যান্ত্রিক গতি। এই গতির কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো সীমানা নেই, কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই—আছে শুধু ছক কাটা শান—বাঁধানো পথের উপর দিয়ে টাকা ও মুনাফার ধাক্কায় অন্ধবেগে চলার গতি। কেবল গতি আর গতি। এ কিন্তু ঝঞ্ঝামদরসমত্ত বলাকার পাখার গতি নয়, শুধু স্বতঃগতিশীল অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন দিশাহারা জীবনের দুর্দান্ত অন্ধগতি, প্রচণ্ড আত্মঘাতী সর্বনাশে যার শেষ। মনোপলি ক্যাপিটাল এবং মাল্টিন্যাশনাল টেকনোলজির যুগের চূড়ান্ত দিগবিদিক জ্ঞানশূন্যতা।

অটোমোবিল যুগের মেট্রোপলিটন শহরের সঙ্গে রেলরোড যুগের নগরবিন্যাসের পার্থক্য আছে। রেলরোড যুগে কলকাতার মতো যে—কোনো বড় শহর হয় রেলপথের প্রান্তীয় কেন্দ্র। জলপথের প্রান্ত ও রেলপথের প্রান্ত হয়ে যে শহর গড়ে ওঠে সেখানে জনবসতি স্বভাবতই ঘনীভূত হয় অর্থনৈতিক কারণে। মানচিত্রে শহরটাকে মনে হয় যেন একটা জমাটবাঁধা জনপিণ্ড। চারদিকের জনবিরল গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বিরাট একটা পর্বতপ্রমাণ ইট—পাথরের স্তূপের মতো জনবহুল শহর দাঁড়িয়ে থাকে এবং স্তরে স্তরে তার জনপুঞ্জ যেন ফেঁপে উঠতে থাকে। কিন্তু অটোমোবিল যুগে শহর যখন চারদিকে প্রসারিত মোটররোড দ্বারা বাহুর মতো বেষ্টিত হয় তখন তার আসল মেট্রোপলিটন রূপের বিকাশ হতে থাকে। শহরকেন্দ্র থেকে দূরে এইসব মোটরপথের আশপাশে নতুন নতুন জনবসতি গড়ে ওঠে। তাতে মূল শহরকেন্দ্রে জনপুঞ্জের চাপ যে কমে যায় তা নয়, বরং দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহরের ভিতরের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। তার সঙ্গে আগেকার শহরতলির সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নতুন নতুন শহরতলি ও জনবসতি গড়ে ওঠে। রেলপথের দূরত্বের উপর এই ধরনের নতুন জনবসতিকে আর একান্ত নির্ভর করতে হয় না, কারণ অটোপরিবহণ তাদের রেলবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। সুনির্দিষ্ট রেলপথযুক্ত মেট্রোপলিটন শহরের আকৃতি হয় বহুপাকে জড়ানো মোটা দানার হারের মতো, যার মধ্যে বিরাজ করে পরস্পরসংলগ্ন শিরার মতো বিস্তীর্ণ অটোপথ। হারের মোটা দানাগুলি হল নতুন সব জনবসতি।

ট্রেভেলিয়ান লিখেছেন যে অটোমোবিলের যুগে গোটা ইংল্যান্ড দেশটাই যেন একটা বিরাট শহরতলির রূপ ধারণ করছিল এবং ‘the intrusion of urban life upon the rural parts’ যেন বন্যার বেগে আরম্ভ হয়েছিল। এ কথা যে কতখানি সত্য তা বর্তমানকালের কলকাতার রূপ দেখলেই বোঝা যায়। কলকাতার দশ—পনেরো—বিশ মাইলের মধ্যে যে সমস্ত গ্রামাঞ্চল আজও দেখা যায় সেগুলি শহর থেকে উদগীর্ণ জনপুঞ্জের চাপে, নাগরিক জীবনের প্রবল অটোপ্রবাহের ঘাতপ্রতিঘাতে দ্রুত তাদের গ্রামত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়া শহরতলির রূপ ধারণ করছে। কেবল যে শহরমুখী নতুন জনবসতির চাপেই এটা হচ্ছে তা নয় কিন্তু, মেট্রোপলিটন শহরের অবিরাম আত্মপ্রসারের গতি কাছাকাছি গ্রামাঞ্চলের জমিব্যবহারপদ্ধতিও (land-utilization pattern) একেবারে বদলে দিচ্ছি। নতুন নতুন কলকারখানা, কর্মকেন্দ্র, বাজার, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সিনেমা, আবাসিক বিদ্যালয় যত মেট্রোপলিটন শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, যত বাঁধা রেলপথ ও অবাধগতি মোটরপথের চারপাশে নতুন জনবসতি তৈরির চাহিদা বাড়ছে, তত আবাদি জমির প্রান্তরেখা দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শহরের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী (city-market-oriented) কিছু হয়তো পণ্যফসলের আবাদ হচ্ছে, কিছু পোলট্রি—ডেয়ারি হচ্ছে কিন্তু খাদ্যশস্যের এলাকা ক্রমেই পশ্চাতে অপসারিত হচ্ছে। এইভাবে মেট্রোপলিটন শহর অটোমোবিলের অবাধগতির ফলে বহু দূর পর্যন্ত পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের গ্রামত্ব ধ্বংস করে ফেলছে। শহর থেকে কাছে রেলপথের আশপাশে হয়তো—বা এখনও গ্রামের শ্যামলশ্রী একটু—আধটু দেখতে পাওয়া যায়। হঠাৎ মধ্যে মধ্যে সবুজ ধানের খেতও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু মেট্রোপলিটন সীমানার মোটরপথে গ্রাম্য নিসর্গের এই রূপ আর বড় একটা দেখা যায় না। কলকাতা শহর থেকে চল্লিশ—পঞ্চাশ মাইল দূর পর্যন্ত আজও রেলযাত্রী যে দৃশ্য দেখতে পান, মোটরযাত্রী ঠিক তা দেখতে পান না। রেলপথ ও মোটরপথের মাঝামাঝি ও শূন্যস্থানটুকু আজও রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে অটোমোবিলের গতিপথের শাখাপ্রশাখা বিস্তারে তা ভরাট হয়ে যাবে। এগুলি হল অটোমোবিলের সামাজিক জীবনের প্রভাব—প্রতিক্রিয়ার কথা। রেলরোডের রেডিয়াস ধরে বাষ্পীয় পরিবহণের যুগে শহর তার প্রভাব বিস্তার করত গ্রামাঞ্চলে এবং সেই প্রভাব কখনো ব্যাপক রূপ ধারণ করত না। অটোমোবিলের যুগে চারদিকে প্রসারিত অটোপথে রবিরশ্মির মতো শহরের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামাঞ্চল ক্রমে প্রসার্যমাণ শহরতলিতে রূপায়িত হতে থাকে। মানুষের জীবন শহরমুখী ও শহরনির্ভর হয়ে ওঠে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান ভেঙে যায়। শহরের অভাব—অভিযোগ, শহরের দাবিদাওয়া, শহরের জীবনযাত্রা, শহরের নীতি—দুর্নীতি শহরের ভোগবিলাস এবং সবার চেয়ে বড় সত্য শহরের নির্বিকার যান্ত্রিক মন অবাধগতিতে গ্রামাঞ্চলেও প্রবেশ করে। অটোমোটিভ যুগে গ্রাম্য মানুষকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হয় ‘autocomplex’ ও মেট্রোপলিসের মেকানিক্যাল মর্মরের মধ্যে সেই মনের মতো গ্রামের মানুষটিও যেন হারিয়ে গিয়েছে। সারল্য ও সভ্যতার সেই উচ্ছলতা, অকৃত্রিম মানবিকতার সেই বনফুলের মতো সৌরভ, ডিজেল—গেসোলিনের ধোঁয়ার দুর্গন্ধে চাপা পড়ে গিয়েছে। আর কোনোদিন তা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গ্রামের গ্রামত্ব, মানুষের মনুষ্যত্ব, জীবনের রূপরসগন্ধস্পর্শ অটোমোবিল ও অটোমেশনের পেষণে ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লক্ষ্যভ্রষ্ট যান্ত্রিকতার নিরবচ্ছিন্ন প্রভাবে মানুষের নির্লিপ্ততা ও নির্জনতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে অটোমোবিল, আর—একদিকে নতুন অটোমেশন। চলার গতি থেকে কর্মের গতি পর্যন্ত নীরন্ধ্র যান্ত্রিকতা। তার উপর যত দিন যাচ্ছে তত জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বাড়ছে এবং জ্যামিতিক প্রগ্রেশনে মানুষ বাড়ছে। জীবন ক্রমে শহরমুখী ও শহরনির্ভর হয়ে উঠছে। মানুষের সমস্ত চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে শহর। বড় বড় শহর তাই ‘পলিস’ থেকে ‘মেট্রোপলিস’ ও ‘নেক্রোপলিস’—এর মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পদে পদে যান্ত্রিকতা এবং তার সঙ্গে পাশাপাশি দৈত্যের মতো বিপুল জনতার দলনমর্দন। এর মধ্যে পড়ে মানুষ তার নিজস্ব মানবিক মূল থেকে কখন যে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তা সে নিজেই জানতে পারে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রাণীগত সম্পর্কের ক্ষীণ সূত্রটুকুও লোপ পেয়ে যায়। স্থূল দৈহিক সান্নিধ্য আছে—সান্নিধ্য কেন, দৈহিক দলন বলা চলে—যেমন পাবলিক বাসের ভিড়ে, দৈহিক প্যাসেঞ্জার ট্রেনে অথবা স্থলপথে যে—কোনো যান্ত্রিক পরিবহণে। বহু মানুষ একত্রে চলাফেরা করছে কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে কারও সঙ্গে কোনো আত্মিক সংযোগ নেই। মনোবিজ্ঞানী বারো (Trigant Burrow) বলেছেন : ‘Today human relations are through out superficial and not fundamental. They are psycho-social, not biological.’ মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ—সামাজিক হোক আর ব্যক্তিগত হোক—একটা বাহ্য আচারসর্বস্ব গতানুগতিক সম্পর্ক মাত্র। এমন কোনো গভীর সম্পর্ক নয়, প্রাণ পর্যন্ত যার শিকড় প্রসারিত। এই বাহ্য সম্পর্ক আধুনিক মানুষের, বিশেষ করে ধনতান্ত্রিক যুগের নাগরিক মানুষের লোকেকাত্বতাবোধ (community feeling) নষ্ট করে দিচ্ছে। লরেন্স একবার চিঠিতে বারোকে লিখেছিলেন : ‘I believe as you do… that it is our being cut off that is our ailment, and out of this ailment everything bad arises.’ আমাদের আসল ব্যাধি হল আজকের দিনে অত্যন্ত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও মানুষে—মানুষে দূরত্ব কমছে না বরং প্রতিদিন বাড়ছে। মানবিক সম্পর্কের এই দূরত্ববোধ থেকে সামাজিক জীবনে সব রকমের কদর্যতা ফুটে উঠছে এবং কদর্যতার বীভৎস বৈচিত্র্যও বাড়ছে।

মহানগরের উত্তাল জনসমুদ্রে প্রত্যেকটি মানুষ যে—যার জীবননৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছে, ঢেউয়ের আঘাতে ওঠানামা করছে, কোথাও কোনো কূল নেই, কিনারা নেই দ্বীপ নেই, যেখানে সে নোঙর করতে পারে। নোঙরহীন নৌকার যাত্রীর মতো সারাজীবন যদি জনসমুদ্রে ভেসে বেড়াতে হয় তাহলে সামাজিক মানুষ হিসেবে তো বটেই, একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ হিসেবেও জীবনের পূর্ণতাবোধ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এই পূর্ণতাবোধের অভাবের প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কতকটা প্রকৃতির প্রতিশোধের মতো দেখা দিতে থাকে। অথচ নাগরিক জীবনে জনসমাবেশের সুযোগ অফুরন্ত। আজ জনসভা, কাল প্রদর্শনী, তারপর কোনো রাজনৈতিক নায়কের আগমন, উৎসব—পার্বণ এরকম শত শত অনুষ্ঠান জনসমাকীর্ণ হয়। কিন্তু এই জনতা, মিছিল বা শোভাযাত্রা কোনোটাই সত্যকার সমাজসংবদ্ধতা (socialization), সামাজিক জনসংযোগ (social participation) অথবা মানবিক একাত্মতাবোধ করে না বরং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার (socialization) পথ সুগম করে দেয়।

বাণিজ্যিক বা আর্থিক স্বার্থ ছাড়া শহরে যখন মানুষের সঙ্গে মানুষ কথা বলে তখন মনে হয় যেন না বললে নয় অথবা বলতে হয় তাই বলে। অতিপরিচিত লোকের সঙ্গেও পথ চলতে দেখা হলে পরস্পর সম্ভাষণ জানিয়ে যখন কুশল—মঙ্গল জিজ্ঞাসা করে তখন শুধু চোখ আরে ঠোঁটের বাইরের যান্ত্রিক ক্রিয়াটুকু ছাড়া তাতে বিশেষ আর কিছু থাকে না। সংযোগশূন্য আত্মনির্বাসিত জীবনের ক্লান্তিতে আমরা এত দূর অবসন্ন হয়ে পড়ি যে কারও সঙ্গে কারও সামান্য একটু কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। দূর থেকে কোনো কথা বলার মতো লোক দেখলেই ভয় পাই এবং কী করে তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ভিড়ের মধ্যে আত্মগোপন করি। প্রত্যেকেই আমরা দ্বীপান্তরিত হতে চাই অর্থাৎ একলা থাকতে চাই। এলিয়টের ককটেল পার্টির Celia-র স্বীকারোক্তির কথা মনে হয়—

….Do you know–

It no longer seems worthwhile to speak to anyone!

No… it isn’t that I want to be alone,

But that everyone’s alone–or so it seems to me.

They make noises and think they are talking to each other;

They make faces, and think they understand each other.

And I’m sure that they don’t…

শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসবে ‘গ্রামবাসীদের প্রতি’ রবীন্দ্রনাথ এই কথাই বলেছেন: ‘ধনের বাহন হয়েছে যন্ত্র, আবার সেই যন্ত্রের বাহন হয়েছে মানুষ—হাজার হাজার, বহু শত সহস্র। তারপর যান্ত্রিক সম্পৎ প্রতিষ্ঠার বেদীরূপে তারা বড়ো বড়ো শহর তৈরি করেছে। সে শহরের পেট ক্রমেই বেড়ে চলেছে, তার পরিধি অত্যন্ত বড়ো হয়ে উঠল। নিউইয়র্ক লণ্ডন প্রভৃতি শহর বহু গ্রাম—উপগ্রামের প্রাণশক্তি গ্রাস করে তবে একটা বৃহৎ দানবীয় রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে—শহরে মানুষ কখনো ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত হতে পারে না। দূরে যাবার দরকার নেই—কলকাতা শহর, যেখানে আমরা থাকি, জানি, প্রতিবেশীর সঙ্গে সেখানে প্রতিবেশীর সুখে দুঃখে বিপদে আপদে কোন সম্বন্ধ নেই। আমরা তাদের নাম পর্যন্ত জানি নে।’

বাস্তবিক তা—ই। মহাসাগরের জনসমুদ্রে প্রতিদিনের জীবনতরঙ্গের গর্জানির মধ্যে আমরা বুদবুদের মতো বিলীন হয়ে যাই। সেই নিত্যনৈমিত্তিক জেগে ওঠা সেই ট্রাম বাস—মোটর অফিস—কারখানা খাওয়া অফিস—কারখানা দশটা পাঁচটা আটটা ছ—টা, সোমবার মঙ্গলবার বুধবার বৃহস্পতিবার শুক্রবার শনিবার রবিবার ঘুম আবার, সোম মঙ্গল ট্রাম—বাস—মোটর অফিস—কারখানা—

Waking, tramcar, 4 hours in office or factory, meal, tramcar, 4 hours work, meal, sleep, and monday, tuesday, wednesday, thursday, friday and saturday in the same rythm, this road in general is easily followed. But one day the ‘why’ comes out, and everything starts in this weariness mingled with surprise. ‘Starts’–this is important. Weariness is the end of the actions of a machine–like life, but it inaugurates at the same time a movement of consciousness.

Albert Camus

ক্লান্তি—অবসাদ—নিরবচ্ছিন্ন ক্লান্তি বিরামহীন যান্ত্রিক জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। হঠাৎ একদিন প্রশ্ন জাগে মনে—কেন? কেন এই অলাতচক্রে চংক্রমণ? চারদিকের কুয়াশার দিকে চেয়ে তখন মনে হয় ‘আমি আছি’! কুয়াশা ভেদ করে একটা চেতনার আলোকবিন্দু চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ‘At the end of the awakening comes, in time, the consequence : suicide or recovery’ (Camus), অবশেষে হয় আত্মোদ্ধার, না—হয় আত্মবিলোপ। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার শেষ ব্যক্তিগত সমাধান।

কলকাতা শহরের নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবন, টেলিফোন ভবন অথবা আর কোনো আট—দশতলা ভবন থেকে অথবা হাওড়া ব্রিজ থেকে শান—বাঁধানো পথের ওপর কি জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে যখন কোনো যুবক তার পরিবার আত্মীয়স্বজনদের ফেলে রেখে অচৈতন্যের অতল অন্ধকারে চিরদিনের মতো তলিয়ে যেতে চায় তখন শুধু দারিদ্র্যের সংগ্রামের ভয়ে সে তা করে না, পরন্তু একটা হৃদয়হীন যান্ত্রিক জীবনযাত্রার বিভীষিকা অসহনীয় হয়ে ওঠে বলে করে। চোখের সামনে জীবনটা যখন একটা দুস্তর মরুভূমির মতো ধু ধু করে, কোথাও একটু সবুজ ঘাসের মধ্যেও প্রাণের স্নিগ্ধ স্পর্শ যেন পাওয়া যায় না তখন, শুধু তখন এদিকের এই জীবন আর ওদিকের ওই মৃত্যুর মধ্যে সীমারেখাটুকু সে মুছে ফেলতে চায়। যে তা না পারে সে আবার প্রাত্যহিক জীবনের চাকায় ঘুরতে থাকে।

হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনের প্রতিদিনের দু—লক্ষ শহরযাত্রীর সঙ্গে মিশে গিয়ে সে আবার কলকাতার পথে চলতে থাকে। তারপর কলকাতা মেট্রোপলিটন অঞ্চলের আরও অন্তত তিরিশ লক্ষ লোক বাসে—ট্রামে—ট্রাকে—মোটরে বাহিত হয়ে এসে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনতার যে বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করে তার মধ্যে সে হারিয়ে যায়। তার সঙ্গে বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি, অটোসাইকেল ও প্রাইভেট অটোমোবিল মিলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক চলন্ত যন্ত্রের খরস্রোতও মিলিত হয়। তখন এই যন্ত্রজোয়ার ও জনজোয়ারের মধ্যে সেই লোকটিও ভাসতে ভাসতে চলতে থাকে—গর্জন হুংকার কান্না চিৎকার হাসি হর্ন হল্লা ঘণ্টা গুঞ্জন বিস্ফোরণ শিস গান স্লোগান হরিবোল রেডিয়ো লাউডস্পিকার হাম্বা হাহাকার উল্লাস করতালি ঘরঘর ঘ্যানঘ্যান—হাজার রকমের আওয়াজের মধ্যে সকলেই জাগে কিন্তু তার ‘আত্মা’ বা ‘চৈতন্য’ আর জাগে না। দশগুণ—বিশগুণ বেশি যাত্রীবাহী ট্রেনে—বাসে—ট্রামে যারা সবেগে অফিসে—কারখানায়—ঘরে গমনাগমন করে, তাদের ‘আত্মা’ হাজার হ্যাঁচকানিতেও জাগে না। জাগে শুধু ‘রিপু’, ষড়রিপু, কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য। ক্যাপিটালিস্ট মেট্রোপলিসে শুধু রিপু জেগে থাকে আর আত্মা যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে সেই আদিম ও সনাতন ছয়টি রিপু কলরব করতে থাকে মেট্রোপলিসের পথে পথে অফিসে অফিসে, কারখানায় কারখানায়। কামুক মানুষ, ক্রুদ্ধ মানুষ, লোভী মানুষ, মোহান্ধ মানুষ, মদমত্ত মানুষ, মাৎসর্যদগ্ধ মানুষ মেট্রোপলিসে চলে বেড়ায়। রিপুর জোয়ারে জনতার ঢেউয়ে তাদের ‘অহম’, তাদের ‘আত্মা’ আত্মপ্রকাশের কোনো পথ খুঁজে পায় না। অথচ তারা সকলে ‘আত্মহত্যা’ করে না। মেট্রোপলিসের এই কুৎসিত ভুবনেও তারা ‘সৌন্দর্য’ খুঁজে পায় এবং তাদের এই ‘সুন্দর ভুবন’—এ তারা মরতে চায় না। তাই জীবনযন্ত্রের চাকায় তারা আবার ঘুরতে থাকে—সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র শনি বাস ট্রাম—ট্যাক্সি—অটো অফিস—কারখানা খাওয়া—ঘুম—জাগা দশটা পাঁচটা নটা ছ—টা—

‘চৈতন্য’ শুধু তাদেরই জাগে অথবা ‘আত্মা’ যা—ই হোক যারা অটো—ওনার, যারা ব্যক্তিগত অটোমোবিলের মালিক। ওনার বা মালিকদের ব্যক্তিগতভাবে কেউ চেনে না—জানে না, তাদের সগোত্র যারা তারা ছাড়া, কিন্তু তাদের অটোমোবিলকে চেনে। মালিক টল—স্লিম সুদর্শন যুবক হোক আর গোলগাল বেঁটেখাটো কদাকার প্রৌঢ় হোক, তাতে কিছু আসে—যায় না। যে অটোমোবিলে মহানগরের পথে সে চলে বেড়ায় তার রূপ ও মডেলটাই আসল। সেটা হাম্বার না হাডসন, অস্টিন না মরিস, ক্যাডিলাক না পন্টিয়াক, ক্রাইসলার না স্টুডিবেকার না বুইক, প্রেসিডেন্ট না শেভ্রোলেট ওপালা, তাই দিয়ে তার ভিতরকার ব্যক্তিটিকে চেনা যায়। যারা প্রধানত মোটর নিজেদের চলাফেরার সুবিধার জন্য ব্যবহার করে, প্রতিবেশীদের কাছে, বন্ধুবান্ধব—আত্মীয়স্বজনের কাছে তাদেরও একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে কিন্তু সেটা শুধু একটি মোটরগাড়ির মালিকানার মর্যাদা। দশ—পনেরো—কুড়ি বছর আগেকার মডেলের অস্টিন বা মরিস হলেও তাদের কাজ চলে যায়—তারা মোটামুটি মেট্রোপলিসের ভিড়ের মধ্যে গতিশীল থাকতে পারে এবং তাতেই তারা খুশি। দরিদ্র আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছে অবশ্য সেই পুরোনো অস্টিন ও মরিসেরই যথেষ্ট স্টেটাস আছে কিন্তু তার বাইরে যে দুরন্ত গতিশীল অটোসমাজ সেখানে তার কোনো স্টেটাস নেই। অভিজাত অটোসমাজ তাদের প্রলেটারিয়েটের মতো উপেক্ষা করে চলে। বিশ শতকের আবির্ভাবকালে (১৯০০ সাল) যখন অটোমোবিল মাত্র ৫০০০ তৈরি হয়েছিল তখনকার সামাজিক অবস্থা, আর আজকের সামাজিক অবস্থা যখন ১৯৬৭ সালে লক্ষাধিক অটোমোবিল বছরে উৎপন্ন হচ্ছে এবং কোটি কোটি মোটর সারা পৃথিবীর শহরের রাজপথে ছুটোছুটি করছে, কখনোই এক হতে পারে না। কলকাতার রাস্তায় দশখানা মোটরও চলত না ১৯০০ সালে আর এখন দশ হাজারের দশগুণেরও বেশি মোটর চলে কলকাতার পথে। কিন্তু কলকাতার রাস্তাঘাটের অবস্থা সেই ‘baroque’ শহরের মতো আছে অথচ তার বাইরের রূপটা হয়েছে মেট্রোপলিসের মতো। অটোমোবিলের চাপে কলকাতার রাস্তায় যখন ‘ট্রাফিক জ্যাম’ হয়—ডালহৌসি বড়বাজার, চৌরঙ্গি প্রভৃতি অঞ্চলে—তখন শহরের লক্ষ লোকের মিছিল ও জনতার মতো মনে হয় যেন অটোমোবিলের মিছিল ও জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতএব পঁচিশ বছর কি পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতার লোকসংখ্যার মতো যখন অটোমোবিলের সংখ্যাও অনেক কম ছিল তখন মানুষের মধ্যে অটোমানসতার বিকাশ হয়নি। কিন্তু গত পঁচিশ বছরের মধ্যে এই অটোমানসতার (auto-mentality) অতিদ্রুত বিকাশ হয়েছে, শুধু কলকাতা শহরে নয়, সারা পৃথিবীর মেট্রোপলিটন শহরে।

বিশ শতকের পঞ্চাশের শেষদিক থেকে অটোমোবিল ক্রমেই মানুষের কাছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্টেটাসের সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে উঠেছে। এদিকে শহরের স্থাপত্যের মধ্যে যখন সমস্ত দিক থেকে একটা যান্ত্রিক একঘেয়েমি প্রতিফলিত, তা সে বসবাসের ঘরবাড়ির স্থাপত্যেই হোক আর প্রতিষ্ঠান অথবা কলকারখানার স্থাপত্যেই হোক, তখন শুধু গৃহের গড়ন—বৈশিষ্ট্যে নিজেদের স্টেটাস আর বাইরে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। গৃহের চাইতে তার আসবাবপত্তর, গ্যাজেট এবং সবার চেয়ে বড় অটোমোবিল হয়ে উঠছে স্টেটাসের প্রকৃত নিদর্শন। সমাজবিজ্ঞানীরা নাকি অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে সত্যিকার মর্যাদার নিদর্শনের মতো যাঁর অটোমোবিলের মালিক তাঁরা বাড়ির গ্যারেজে গাড়ি না ঢুকিয়ে রেখে বাড়ির সামনে রাস্তায় ‘পার্ক’ করাতে ভালোবাসেন। তার কারণ রাস্তা দিয়ে চলার সময় গাড়ির দিকে তাকিয়েই লোকে বুঝতে পারে যার বাড়ির সামনে গাড়ি তার স্টেটাসের স্তর কতটা উঁচুতে। শুধু নাকি বাড়ি দেখে তা বোঝা যায় না।

পৃথিবীর বড় বড় অটোমোবিল ব্যবসায়ীরা সমাজবিজ্ঞানী ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাহায্যে অনুসন্ধান করে দেখছে যে ‘nothing appeals more to people than themselves; so why not help people buy a projection of themselves?’ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হল নিজের রূপ। অন্য কেউ যত রূপবান বা রূপসি হোক—না কেন, নিজের চেয়ে নিজের কাছে কাউকে বেশি রূপবান বা রূপসি মনে হয় না। মানুষ যখন কোনো শখের জিনিস কেনাকাটা করে তখন ঠিক নিজের রূপের মতোই জিনিস নির্বাচন করে কেনে। কেনা জিনিসের মধ্যে নিজের রূপটি অভিক্ষেপ করে অর্থাৎ তার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। মহানগরে জনস্রোতের মধ্যে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, যখন তার নিজেকে চেনবার বা চেনাবার কোনো সুযোগ থাকে না, যখন অজ্ঞাত অপরিচিতদের বিপুল তরঙ্গের মধ্যে তার নিজের সত্তাটিও বুদবুদের মতো বিলীন হয়ে যায় তখন তার আত্মপ্রকাশের উপায় থাকে কোথায়? অথচ কোনো একসময় জনতার মধ্যেই হোক অথবা নির্জনতার মধ্যেই হোক যখন তার জনতাচৈতন্যের জড়ত্ব কেটে গিয়ে আত্মচৈতন্য ফিরে আসে এবং ‘আমি আছি’ এই বোধ জেগে ওঠে তখন যেভাবেই হোক তাকে প্রকাশ করারও একটা পথ খুঁজে বার করতে হয়। বর্তমান মনোপলি ক্যাপিটাল ও ক্রমোন্নত টেকনোলজির যুগে সেই পথের সন্ধান দিয়েছে অটোমোবিল। নিজের ‘ইমেজ’ তৈরি করার এমন সুযোগ এর আগে মানুষ আর পায়নি। অহমসর্বস্ব ফাঁকা মানুষের ইমেজ।

পালকির যুগে ঘোড়াগাড়ির যুগেও এই ‘ইমেজ’ মানুষ তৈরি করত। নানা রকমের পালকি ও নানা রকমের ক্যারেজের সঙ্গে তখনও মানুষের সামাজিক স্টেটাসের সম্বন্ধ ছিল। ব্যক্তিগত যানবাহন চিরকালই সমাজে ‘status symbol’-এর কাজ করেছে। ঝালর—দেওয়া জরি—ভেলভেটের গদি—আঁটা ষোলো—বেয়ারার পালকি এবং সাধারণ ডুলি বা দু—চারজন বেয়ারার পালকির মধ্যে নিশ্চয় যাত্রীদের সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য থাকত। সুসজ্জিত খানদানি জোড়া ঘোড়ার বা চার ঘোড়ার ল্যান্ডো আর দশ—বারো—ষোলো ঘোড়ার গতিযুক্ত অটোমোবিল পন্টিয়াক, ক্যাডিলাক, ওপালা বিভিন্ন যুগের ‘স্টেটাস সিম্বল’ মাত্র। কলকাতা শহরে রাজা রামমোহনের পালকি, মহারাজা নবকৃষ্ণর পালকি এবং সাধারণ রাম বা হরির পালকি দেখলে নিশ্চয় তার মালিকদের সামাজিক মর্যাদার স্তর অনেকটা বোঝা যেত। বিদ্যাসাগরের পালকি আর পাইকপাড়ার রাজাদের পালকি নিশ্চয় এক রকমের ছিল না। ঘোড়াগাড়ি হলে বিদ্যাসাগর বড়জোর ক্যারাঞ্চি বা ছ্যাকড়াতে চড়তেন কিন্তু শহরের বড় বড় বেনিয়ান ও মুচ্ছুদ্দিরা চ্যারিয়ট অথবা ব্রাউনবেরি ছাড়া চড়তেন না। পালকি বা ক্যারেজের যুগের মতো অটোমোবিলের যুগেও ব্যক্তিগত যানবাহন আত্মমর্যাদার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। অটোমোবিলের যুগে শতগুণ বেশি হয়েছে, কারণ চলার গতি বেড়েছে অনেক, যাদের সঙ্গে চলতে হয় তাদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক এবং যেখানে থাকে হয় শহরে তার আকারও হয়েছে অনেক বেশি বিরাট ও বিকট। সেটা ছিল ধনতন্ত্রের শৈশবকাল আর এটা হল ধনতন্ত্রের বার্ধক্য যা মনোপলি ও টেকনোলজির সঞ্জীবনী শক্তিতে উন্মত্ত—উদভ্রান্ত। এই বিরাট বিকট মহানগরে এই প্রচণ্ড বেগ ও ব্যস্ততার যুগে এবং মেট্রোপলিসে এই বিপুল জনগণবন্যার উদ্দাম স্রোতে অটোমোবিলই যে ডুবন্ত মানুষের বিলীয়মান ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রতীক হবে তাদের বিস্ময়ের কিছু নেই। হয়েছেও তা—ই এবং যাঁরা অটোমোবিল বেচে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছেন তাঁরা কয়েক কোটি টাকা খরচ করে মানুষের মন যাচাই করে দেখেছেন যে জনতাপ্রধান সমাজে অটোমোবিল দিয়ে মানুষ নিজের ‘ইমেজ’ রচনা করতে চায়। মানুষ তার হারানো ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করতে চায় অটোমোবিলের মধ্যে এবং যেহেতু অন্যত্র প্রকাশ করতে পারে না সেইজন্য সদম্ভে প্রকাশ করতে চায়। নামহীন—পরিচয়হীন সমাজে, যেখানে শুধু সংকেত ও প্রতীক দিয়ে মানুষকে চিনতে হয় সেখানে স্বভাবতই ব্যক্তিগত অটোমোবিল ব্যক্তিপরিচয়ের সবচেয়ে বড় সংকেত ও প্রতীক হয়ে ওঠে।

অটোমোবিল শুধু চলার বাহন নয়, যিনি চলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের বাহন, তাঁর সামাজিক স্টেটাসের বাহন, আর্থিক স্টেটাসের তো বটেই। একজন নামজাদা বাজারবিজ্ঞানী পিয়ের মার্তিনো অটোমোবিল সম্বন্ধে বলেছেন :

The automobile tells who we are and what we think we want to be …It is portable symbol of our personality and our position…..the clearest way we have of telling people of our exact position. In buying a car you are saying in a sense, ‘I am looking for the car that expresses who I am.’

অটোমোবিল জানিয়ে দেয়, আমি কে এবং আমি কী হতে চাই। আমাদের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার চলন্ত প্রতীক হল অটোমোবিল। এত পরিষ্কার করে এত সহজে অন্য কিছু দিয়ে কাউকে বোঝানো যায় না কে কীরকম ব্যক্তি, যত সহজে যত পরিষ্কার করে নিজের অটোমোবিলটি দেখিয়ে বোঝানো যায়। যখন আমি কোনো গাড়ি কিনি তখন সেই গাড়িটাই আমি কিনি যেটা চলার সময় বাইরে বলতে বলতে যাবে ‘আমি কে?’ ‘বুইক’ তাই তার বিজ্ঞাপনে জানিয়ে দেয়—‘It makes you feel like the man you are.’ আমেরিকার একটি বিখ্যাত Social Research Association অটোমোবিল ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে দীর্ঘদিন গবেষণা করে Automobiles : What They Mean to Americans নাম দিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। সামাজিক জীবনের এরকম বিচিত্র দলিল বোধহয় আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। গাড়ির ‘মডেল’ ও ‘মেক’ অনুযায়ী ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, রুচি, মেজাজ ইত্যাদি নাকি বিচার করা যায়। যেমন :

ক্যাডিলাক : দাম্ভিক Flashy মধ্যবয়সি, সামাজিক জীবনে গতিশীল, ভালো রোজগার, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন।

ফোর্ড : দানবীয় গতি, ভালো রোজগার, বয়সে তরুণ, উদ্ধত, Upper- lower class কাজের লোক, প্র্যাকটিক্যাল।

ডি সোটো : রক্ষণশীল, ভালো রোজগার, দায়িত্ববোধ আছে, উচ্চমধ্যবিত্ত, গর্বিত।

স্টুডিবেকার : ছিমছাম, শহুরে, বুদ্ধিজীবী, প্রফেশনাল, তরুণ, তৎপর।

পন্টিয়াক : নিশ্চিন্ত, উচ্চশ্রেণিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি, মধ্যপন্থী, ‘কনভেনশনাল’, কর্মব্যস্ত।

মার্কারি : সেলম্যান ‘assertive’ অবস্থাপন্ন, আধুনিক

এই রিপোর্টে মার্তিনোর কথা সমর্থন করে বলা হয়েছে যে অটোমোবিল ক্রেতারা যখন গাড়ি কেনেন (যাঁরা শুধু conveyance’ বা চলাফেরার সুবিধার জন্য কেনেন তাঁরা ছাড়া) তখন এই কথা মনে করেই কেনেন—‘I am looking for the car that expresses who I am?’ গাড়ির মালিকদের চরিত্র বিচার করে তাঁরা মন্তব্য করেছেন যে, যে সমস্ত লোক খানিকটা স্থিতিশীল ও রক্ষণশীল, যাঁরা বাইরে নিজেদের অত্যন্ত ‘serious’ ও ‘responsible’ বলে পরিচয় দিতে চান তাঁরা সাধারণত প্লিমাউথ, ডজ, ডিসোটো, প্যাকার্ড, চার দরজার সিজন গাঢ় রং এবং যত দূর সম্ভব কম গ্যাজেট পছন্দ করেন। সে সমস্ত লোক সমাজে স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করতে চান, এবং সর্বব্যাপারে আধুনিক হতে চান অথচ একটু মধ্যপথ ঘেঁষে চলেন তাঁরা সাধারণত শেভ্রোলেট, পন্টিয়াক, বুইক, ক্রাইসলার, দুই দরজার সিডন এবং হালকা রং পছন্দ করেন। যে সমস্ত লোক একটু বেশি মাত্রায় নিজেদের জাহির করতে চান, যাঁদের মধ্যে উদ্ভট স্বাতন্ত্র্য ও আধুনিকতা প্রকট তাঁরা কিনতে চান ফোর্ড, মার্কারি, ওল্ডসমোবিল, লিনকন উজ্জ্বল রং (দু—রকম) এবং যত রকমের সম্ভব উদ্বৃত্ত গ্যাজেট, ফ্যাড ইত্যাদি। যে সমস্ত লোক নিজেদের উঁচু স্টেটাস সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন তাঁরা ক্যাডিলাক, স্টুডিবেকার, হাডসন, ন্যাশ এই ধরনের সব গাড়ি পছন্দ করেন। লাল—হলদে—সাদা যা—ই হোক, তাদের গাড়ির রং খুব ‘ব্রাইট’ হওয়া প্রয়োজন। একদল লোক আছেন যাঁরা সংখ্যায় কম তাঁদের উঁচু স্টেটাস অটোমোবিলে প্রকাশ করতে চান না বরং তাঁরা তাঁদের বিশেষত্ব ছোট সাধারণ গাড়িতে অনেক সময় প্রকাশ করে থাকেন। খুব ধনী লোক কিন্তু হয়তো জিপ, স্টেশন ওয়গন বা পুরোনো মডেলের কোনো গাড়িতে চড়ে বেড়ান। এটা অবশ্য বড়লোকের খেয়ালের ব্যাপার। রিপোর্টের মূল বক্তব্য হল, যে—কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ‘portable symbol’ হল অটোমোবিল এবং ‘A car can sell itself to different people by presenting different facets of its personality.’

ধনতান্ত্রিক বিলাসের অমরাবতী আমেরিকার নাগরিক সমাজের সঙ্গে আমাদের দেশের নাগরিক সমাজের পার্থক্য আছে। কিন্তু এই পার্থক্য হল প্রধানত অর্থসামর্থ্যের পার্থক্য। তার জন্য কলকাতার মতো শহরে হয়তো নিউ ইয়র্ক—শিকাগোর মতো ক্যাডিলাক, প্যাকার্ড, ক্রাইসলার ও অন্যান্য বড় বড় অটোমোবিল হাজার হাজার দেখা যায় না অথবা সামাজিক স্টেটাসের সঙ্গে অটোর মডেলের সামঞ্জস্য সবসময় রক্ষা করা সম্ভব হয় না। বিরাট ধনী লোক বা উঁচু স্টেটাসের লোককে অনেক সময় অটোমোবিলের অভাবের জন্য হয়তো বাধ্য হয়ে ‘অ্যাম্ব্যাসেডর মার্ক টু’ অথবা ভ্যানগার্ড বা মার্সেডিজ চড়ে বেড়াতে হয় এবং এইসব গাড়িতে সবসময় তাঁদের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র বা মেজাজ সম্পূর্ণ প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু অটোমোবিলের বৈচিত্র্য ও সরবরাহের অভাব থাকা সত্ত্বেও কলকাতার নাগরিক সমাজে অন্তত একটা বিশিষ্ট স্তরের মধ্যে মোটর দেখলে মানুষ চেনা যায় এবং মানুষ দেখলে তার মোটরের ‘মডেল’ ও ‘মেক’ বলে দেওয়া যায়। কলকাতার বড় বড় ক্লাবে, যেমন ক্যালকাটা ক্লাব, লেক ক্লাব, হিন্দুস্থান ক্লাব, অটোমোবিল অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব ইত্যাদি—কোনো এগজিবিশন ককটেল পার্টি, গেট টুগেদার, সংগীত অনুষ্ঠান, ফিলমের উদবোধন, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, সিনেমা, অভিনেতা—অভিনেত্রীর সমাবেশ, ক্রিকেট ম্যাচ এবং এই ধরনের নানারকম অনুষ্ঠানে ও সমাবেশে বোঝা যায় যে অটোমোবিল শুধু ব্যক্তির বাহন নয়, ব্যক্তিচরিত্রের বাহন।

ট্রাউজার—বুশশার্ট—পরা যুবক সাতাশ—আটাশ থেকে পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশ বছর বয়স, সঙ্গে অতি আধুনিক সর্বধর্মিণী পোশাক রাজস্থানি—ছত্তিশগড়ির সংমিশ্রণ, ক্লাবে এসেছেন সামাজিক উৎসবে যোগদান করতে। দেখলেই বোঝা যায় যে ভদ্রলোক কোনো বিদেশি কোম্পানির দেড়—দু—হাজারি এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বা সেলস ম্যানেজার এবং তাঁর সহধর্মিণী তারই সুযোগ্য সঙ্গিনী। ক্লাবের সভ্যবৃন্দ ভদ্রলোক সম্বন্ধে যত—না সচেতন তার চেয়ে শতগুণ বেশি সচেতন তাঁর সহধর্মিণী সম্বন্ধে। তিনি অর্থাৎ মিসেস এক্স উৎসবের সামাজিকতা রক্ষা করছেন এবং সামান্য একটু মদিরা সিপ করে যখন ফ্লোরে পার্টনারের সঙ্গে নাচতে নেমেছেন, তখন ভদ্রলোক দূর থেকে সবান্ধব দেখতে দেখতে বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মুখে—চোখে এরকম স্ত্রী—র স্বামিত্ববোধের একটা লাল আভা সাদা আলোর মধ্যেও ফুটে উঠেছে। যদি অভিজ্ঞ অটোমানসবিজ্ঞানী কাউকে জিজ্ঞাসা করা যায় এই ভদ্রলোক ও মহিলা কীরকম গাড়িতে (মোটর) করে এসেছেন তাহলে তিনি চোখ বুজে বলবেন লেটেস্ট মডেলের ফিয়াট অথবা স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড এবং মালিকচালিত গাড়ি, ড্রাইভার নেই। সাধারণত এই ধরনের দম্পতি অ্যাম্ব্যাসেডরে চলবেন না। যদি দেখা যায় বেশ একটু ভারিক্কি লোক, বয়স চল্লিশের উপর, কোনো কোম্পানির ডিরেক্টর বা ম্যানেজার, মাথার মাঝখানে খানিকটা টাকের আভাস, সঙ্গে প্রফুল্লবদনা স্ত্রী আর্থিক নিরাপত্তায় সদাহাস্যময়ী, বেশ একটু গা—ঢালা ভাব অথচ খুব বেশি কৃত্রিম নন, তাহলে বুঝতে হবে তাঁরা নতুন অ্যাম্ব্যাসেডরে করে এসেছেন এবং ভদ্রলোক নিজে চালালেও সঙ্গে ড্রাইভার আছে। প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে পৌঁছেছেন, মাথার টাক আকপাল বিস্তৃত, বিচ্ছিন্ন কেশগুচ্ছগুলি অধিকাংশই সাদা, আকর্ণবিস্তৃত মুখের হাসি, দুটো কি তিনটে মিলের মালিক, সঙ্গে বিপুলকায়া স্ত্রী প্রৌঢ়া, পোশাক—প্রসাধনে বছর দশেক বয়স কমাবার ইচ্ছা, বেশ সুমিষ্ট সম্ভাষণ জানিয়ে অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তাহলে তাঁর অটোমোবিল স্টুডিবেকার—বুইক—ক্রাইসলার অথবা ডানা—মেলা আর যে—কোনো মডেলের অটোমোবিল হওয়াই সম্ভব। বাকি সব আগেকার মডেলের ফিয়াট—অ্যাম্ব্যাসেডর থেকে বহু পুরোনো মডেলের অস্টিন—মরিসের ভিড়। অটোর এই সাধারণ ভিড় দেখলে বোঝা যায় যে ক্লাবের সভ্যদের মধ্যে মধ্যস্তরের মধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশি, কিছু আপস্টার্ট স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডপন্থী চলতি হাওয়ার পথিক আর কিছু পরম নিশ্চিন্ত ধনী লোক। এই ধরনের ক্লাবে বা অনুষ্ঠানে ভিতরের মানুষ দেখার দরকার হয় না, কারণ বাইরের অটোমোবিলের সমাবেশ দেখে একেবারে প্রায় সঠিক বলে দেওয়া যায় যে সমাজের কোন স্তরের লোক এখানে মিলিত হয়েছেন। নমুনা হিসেবে দুই—একটি বিশিষ্ট অটোমোবিলের মডেল দেখে তাঁর মালিকের বয়স, পেশা, পোশাক, আর্থিক ও সামাজিক স্টেটাস সব প্রায় নির্ভুল বলা যেতে পারে। এ কথা বললে ভুল হয় না যে মেট্রোপলিটন কলকাতায় পৃথিবীর অন্যান্য মেট্রোপলিসের মতো ব্যক্তিত্বের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে অটোমোবিল—যান্ত্রিক ব্যক্তিত্বের যান্ত্রিক প্রতিমূর্তি। মেট্রোপলিটন কলকাতায় একটা নতুন অটোমানসের বিকাশ হচ্ছে।

অটোমোবিল ও অটোমানসের যুগে প্রেমের রং ও রোমান্স ‘প্রিমিটিভ’ বলে মনে হয়। প্রেমের কবিতা লিখে বা আবৃত্তি করে কেউ যদি আজকাল প্রেম নিবেদন করে তাহলে মনে হয় সে গোযান ও বৈষ্ণব পদাবলি যুগের উদভ্রান্ত লোক, অটোমোবিল ও বিটলেদের যুগের লোক নয়। অটোমোবিল যুগের প্রেম হল যান্ত্রিক ও ‘ভালগার’—‘vulgar promiscuities of automobile’ (Mumford)। গোযান ও অশ্বযানের যুগে প্রেমের কাহিনি অনেক রোমান্সের উপাদান জুগিয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নেই। তবে মধ্যে মধ্যে ক্যারেজ ও অটোমোবিলের সন্ধিক্ষণে বাইসাইকেলের কথা মনে হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে সেফটি বাইসাইকেল তৈরি হয়। তারপর একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক লিখেছেন : It took its place as an instrument of the new freedom as we glided forth in our thousands into the country, accompanied by our sisters and sweet hearts and wives…’ অটোমোবিলের কিছু আগে বাইসাইকেল সামাজিক জীবনে চলার পথে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে। সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক হয় বাইসাইকেল। তার আগেকার ক্যারেজ এবং পরবর্তী অটোমোবিলের ফিউডাল বা বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়। বাইসাইকেলের মালিক তাঁর প্রেমিকাকে বলতে পারতেন :

I’m half crazy all for the Love of you!

It won’t be a stylish marriage,

I can’t afford a carriage,

But you’ll look sweet,

Upon the seat

Of a bicycle made for two!

অটোমোবিলের যুগে বাইসাইকেল মজুরদের চেয়েও উপেক্ষিত। যদিও অটোসাইকেল ও স্কুটারের যুগে বর্তমানে এক নতুন ধরনের ‘অ্যাটমিক’ প্রেমের সূচনা হয়েছে তাহলেও বাইসাইকেলের অকৃত্রিম রোমান্স তার মধ্যে নেই। রোমান্স আছে স্পিডের হঠাৎ বাম্পিং—ক্র্যাশের। কিন্তু অটোমোবিলের যুগের ‘vulgar promiscuity’ অর্থাৎ বাছবিচারহীন স্বেচ্ছাচারী যৌনসম্ভোগ ছাড়া আর কিছু নেই। ট্যাক্সির মিটারের দিকে চেয়ে মিটার ওঠানামা করে, তারপর যে যার দৈনন্দিন কাজে চলে যায়। অতঃপর সেই সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র শনি ট্রাম আর বাস আর ট্রেন আর টেম্পো সেই অফিস আর কারখানা দশটা আর পাঁচটা স্লোগান করে বক্তৃতা, খবরের কাগজ আর সিনেমা—রেডিয়ো আর রেসকোর্স এই করতে করতে যদি পুনরায় প্রেমিক—প্রেমিকার চোখের দেখা হয় মেট্রোপলিসের রাস্তায় তাহলে আবার সেই ট্যাক্সি আর প্রেম, সেই ভি. আই. পি. রোড আর স্ট্র্যান্ড, সেই চীনে হোটেল আর স্কাইরুম, ট্যাক্সির মিটার ওঠে, প্রেমের মিটার ওঠে, তারপর যে যার ডেরায় চলে যায়, ঘুমোয়—জাগে এবং পুনরায় সেই দশটা—পাঁচটা ট্রাম—বাস সোম—মঙ্গল—বুধের অটোমেটিক জীবনে চাকায় ঘুরতে থাকে। নিজস্ব অটোমোবিলে প্রেমের ‘মোবিলিটি’ শতসহস্রগুণ বেড়ে যায় মেট্রোপলিসে, বিশেষ করে কলকাতার মতো মেট্রোপলিসের দু—তিনটি বহির্গমনাগমনের অটোপথে—জি. টি. বি. টি. আর ডায়মন্ড হারবার রোড বা বজবজ রোডে। প্রেম তখন হসংবলাকার মতো পক্ষবিস্তার করে ‘swept wing’ ডজ—স্টুডিবেকারে যতটা নয় তার চেয়ে অনেক বেশি টু—ডোর সিডান—স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডে নতুন মডেল ‘ফোর—ডোর’ ফিয়টে অথবা মার্ক টু অ্যাম্ব্যাসেডরে। তারপর যে যার আস্তানায় চলে যায় এবং শাওয়ার—বাথের পর অঘোর অচৈতন্য হয়ে ঘুমোয়। ভোরের সূর্য ওঠার পর থেকে টেলিফোন বেজে যায় কিন্তু কালা কান দুটোয় তার শব্দ পৌঁছোয় না। অটোমোবিলপ্রেমের ‘মোবিলিটি’ বা গতির শেষ হয়ে যায় তখন। ইঞ্জিন চলে, অটো চলে না, চালক নেই, কারণ শুধু ইঞ্জিনের ধুক—ধুক ধিক—ধিক শব্দ শোনা যায় বুকের মধ্যে। স্টার্ট—দেওয়া পরিত্যক্ত অটোমোবিলের মতো পড়ে থাকে পথের প্রান্তে মেট্রোপলিসের প্রেমিক ও প্রেমিকা এবং ধুক—ধুক ধিক—ধিক করে।

অটোমোবিল ব্যক্তির ‘ইমেজ’। অটোমোবিল ‘পোর্টেবল পার্সোনালিটি’ অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের চলন্ত প্রতীক। গতি আর বেগ, চলার জন্য চলা, বেগের জন্য বেগ, আবেগহীন বেগ আত্মগতি ‘অটোমোবিলিটি’। মনে হয় মেট্রোপলিসের বিপুল জনতার গড্ডলপ্রবাহে ডুবন্ত মানুষের বেঁচে থাকার, আঁকড়ে ধরার শেষ তৃণখণ্ড যেন অটোমোবিল। অটোমোবিলের মালিকানার সৌভাগ্য থেকে যারা বঞ্চিত অর্থাৎ শতকরা নব্বুইজন মানুষ—তাদের জন্য জি. টি. আর বি. টি. রোডের মতো জীবনের দুটি পথ খোলা—একটি আত্মহত্যার পথ, আর—একটি নৈরাজ্য ও ধ্বংসের পথ। কলকাতার মতো অভিশপ্ত মেট্রোপলিসে তা ছাড়া আর অন্য কোনো পথ নেই। জীবনের সমস্ত ভালোমন্দের মানদণ্ড, সমস্ত ন্যায়—অন্যায় নীতি—দুর্নীতির পার্থক্য, বিচারবোধ, সমস্ত নিটোল সোনালি স্বপ্ন এবং আদর্শ ধ্যানধারণা ও কল্পনা সব যেন বঞ্চিতরা স্টিমরোলার দিয়ে পিষে ফেলে ধূলিসাৎ করে দিতে চায়। দিচ্ছেও তা—ই। দিলেও তাদের বিরুদ্ধে আজ তাই অভিযোগ করা যায় না, কারণ অভিযোগ করার মুখ নেই। যে মুখ দিয়ে অভিযোগ করব তার উপর কলঙ্কের চুনকালির দাগ বসন্তের দাগের মতো চিহ্নিত হয়ে আছে। যারা ভাঙছে তারা ভাঙবেই। কোনো কলরব অথবা নীতিশাস্ত্রের কোনো শ্লোকের আবৃত্তিতে তারা কর্ণপাত করবে না। তাদের বিশ্বাস আজকের ভাঙনের শূন্যস্থান ভবিষ্যতে একদিন তারা ভরাট করে দিতে পারবে। কিন্তু যাঁরা অটোমোবিলবিলাসী ভাগ্যবান এবং মেট্রোপলিসের হৃদয়হীন বিবেকহীন নির্মানস মানুষ তাঁরা যা ভাঙছেন তা আর ভরাট হবে না কোনোদিন। মেট্রোপলিটন শহরের সামাজিক জীবনের শূন্যতা তাঁরা অটোমোবিল দিয়ে পূর্ণ করতে চাইছেন। অটোমোবিল তাঁদের আয়না, কলঙ্কিত মুখ ও বিকৃত ব্যক্তিত্বের আয়না। অটোমোবিলের উজ্জ্বল রঙের চকচকে আয়নায় নিজের মুখ নিজে দেখে তাঁর তৃপ্তি পেতে চান, স্বস্তি পেতে চান। কাচের (glass) যুগে অহমবোধ (Ego) যেমন অত্যুগ্র হয়েছিল তেমনি অটোমোবিলের যুগেও হয়েছে তবে তার উগ্রতা আরও অনেক বেশি। স্বচ্ছতা ও প্রতিফলনতার দিক দিয়ে যখন এমন কাচ তৈরি করা সম্ভব হল যাতে নিজের ছায়া নয় শুধু, নিজের হুবহু নকলরূপ পর্যন্ত দেখা যায় তখন মানুষের অহমবোধও একেবারে রূপান্তরিত হয়ে গেল। Techniques and Civilisation গ্রন্থে মামফোর্ড তাই বলেছেন : ‘Glass had a profound effect upon the development of the personality: indeed. It helped to alter the very concept of the self.’ মানুষের অহমবোধের ক্রমবিকাশে সতেরো শতকের স্বচ্ছ কাচের আয়না যদি একটি যুগান্তকারী পর্বান্তর হয় তাহলে বিশ শতকের অটোমোবিলের আয়না তার আর একটি যুগান্তকারী পর্বান্তর। দুটি পর্বান্তরের মধ্যে প্রভেদ অনেক কিন্তু সাদৃশ্যও আছে যথেষ্ট। শোনা যায় যে সতেরো শতকের একজন স্বেচ্ছাচারী দাম্ভিক সামন্তরাজা চারদিকের প্রজাবিদ্রোহের মধ্যে উন্মাদ হয়ে যখন নিজের শক্তি জাহির করার আর কোনো উপায় খুঁজে পাননি তখন তিনি তাঁর রাজপ্রাসাদে বন্দি হয়ে থেকে একটি বড় হলঘরের চারদিকে দেয়ালে বড় বড় কাচের আয়না ঝুলিয়ে নিজের রূপ নিজে দেখতেন আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তম্বিগম্বি করতেন হাত—পা নেড়ে এবং এই ভেবে সান্ত্বনা পেতেন যে তাঁর চেয়ে শক্তিমান বীর্যবান পুরুষ আর কেউ নেই। বিশ শতকেও অটোমোবিলের আয়নার দিকে চেয়ে আমরা যেন বলতে চাই যে মেট্রোপলিসের বিপুল জনস্রোতের মধ্যে আমরা একজন ‘বিশিষ্ট ব্যক্তি’ এবং নামগোত্রহীন মেট্রোপলিটন সমাজে আমাদের নামও আছে, গোত্রও আছে এবং আমরা কে তা আমাদের অটোমোবিল দেখলেই চেনা যায়। বাইরে যখন উত্তাল জনতার জোয়ার বইতে থাকে মহানগরে তখন এই বিপুল জনসমাজ থেকে নিজেদের ছিনিয়ে এনে অটোমোবিলের আয়নায় আমরা নিজেদের মুখ নিজেরা দেখে সান্ত্বনা পাই। মনে হয় যেন আমরা এরা—ওরা—আরও অনেকের মতো নই, যেন আমরা আমাদের অটোমোবিলের মতোই মূল্যবান ও এক—একজন মানুষ।

মেট্রোপলিটন শহরে অটোমোবিল হল মানুষের ‘ইমেজ’। অটোমোবিল মানুষের আত্মার আয়না। অটোমোবিল মানুষের বিকৃত ব্যক্তিত্ব এবং লুপ্ত মহত্ত্বের প্রতীক। এবং সবার চেয়ে বড় সত্য অটোমোবিলের মতো যান্ত্রিক মানুষের মন। নার্সিসাস বনদেবী ইকোর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার জন্য অ্যাফ্রোদিত তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। ঝরনার জলে নিজের রূপের প্রতিফলিত রূপ দেখে নার্সিসাস মুগ্ধ হয়ে আত্মবিলাপে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তারপর থেকে জনপ্রবাদ এই যে স্বচ্ছ জলের উপর নিজের রূপ নিজে দেখলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই বরণ করতে হয়। ঝরনার জলে আজ আর কেউ নিজের রূপ দেখে না। স্বচ্ছ কাচের আয়নায় দেখে কিন্তু তারও কোনো বিকিরণ হয় না বাইরে। ধনতান্ত্রিক মেট্রোপলিটন সমাজে মানুষ নিজের রূপ দেখে অটোমোবিলের আয়নায়। যার দেখে, মৃত্যু তাদের কপালে লেখা। অটোমোবিলের দুরন্ত গতিতে তারা আজ মেট্রোপলিস থেকে নেক্রোপলিসের (City of the dead) দিকে ছুটে চলেছে। কে তাদের গতিরোধ করবে?

১৯৬৭

……

* লেখকের ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *